বাবুই পাখির বাসা।
পর্বঃ-০৩ (শেষ)
পাখির অপারেশন আরম্ভ হবে কিছুক্ষণ পরে তাই প্রস্তুতি চলছে। একটু পরে ওকে অপারেশন করার জন্য থিয়েটারে নিয়ে যাবে তাই আপু দ্রুত ডাকতে গেছিল। হাসিহাসি মুখ নিয়ে পাখি বসে আছে, আমি কেবিনে গিয়ে দেখি আঙ্কেল আন্টি সবাই বসে আছে।
সবার সাথে পাখি কথা বললো, কেমন যেন মায়া ভরা তার চেহারা থেকে চোখ সরানো যায় না। এমন আগে কখনো মনে হয়নাই, হয়তো এভাবে কখনো চিন্তা করিনি। যে যার মতো করে কথা বলছে আর আমি পাখির দিকে তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। মনে মনে ভাবলাম, “এই মেয়েটার এমন হাসি ভরা মুখ সবসময় দেখতে পেলে মন্দ হবে না। আল্লাহর কাছে মনে মনে দোয়া করলাম, আমার জীবনের কষ্ট পরিমাণ যদি শেষ হয়ে থাকে। তাহলে এমন পুরষ্কার যেন আমি পাই। ”
|
|
চিন্তাযুক্ত মন নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছি অপারেশন শেষ হবার জন্য। কি হবে কে জানে? সবাই খুব চিন্তা করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, আমি একবার ভাবলাম যে গতকাল রাতে বাসের মধ্যে পরিচিত আঙ্কেলের কাছে কল দেবো। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করছি যে, অপারেশন শেষ হলে তারপর নাহয় কল দিয়ে কথা বলা যাবে।
– চোখ বন্ধ করে বসে আছি তখন পাখির বোন এসে বললো, ক্লান্ত লাগছে?
– চোখ মেলে তাকিয়ে একটু লজ্জিত হলাম, তারপর বললাম না তেমন কিছু না।
– খুব চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য?
– তা একটু হচ্ছে আপু, কতদিন কত কারণে ওকে বকাঝকা করেছি কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করে নাই। সবসময় চুপ করে সহ্য করে গেছে, আবার পরে কল দিয়ে ঠিকই কথা বলেছে। আজ যদি পাখির কিছু হয়ে যায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হবে। যদিও সে আমার খুব ভালো বন্ধু কিন্তু তবুও তার অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারবো না। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে বুঝলাম, আমার স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হবার সময় যে কষ্ট পেয়েছি। পাখির জন্য তার চেয়ে একটুও কম কষ্ট হবে না, আল্লাহ যেন বাঁচিয়ে দেয় ওকে।
– একটা প্রশ্ন করবো?
– জ্বি করুন।
– তুমি এমন ভালো একটা ছেলে কিন্তু তবুও তোমার ডিভোর্স কেন হলো?
– তেমন কোনো কারণ নেই আপু, কপালে লেখা ছিল তাই হয়ে গেছে। কারণ আমাদের মাঝে কখনো কোন বিষয় নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা হয়নাই কিন্তু আমার মেয়ে জন্মের সাথে পরেও শুধু ছোট্ট কিছু কারণে দুরত্ব তৈরি হলো। আমি জব করতাম আর আমার স্ত্রী বৃষ্টি সবসময় সন্তান নিয়ে বাসায় থাকতো। মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে কাজের প্রতি একটু বেশি অবহেলা করছিল। এই নিয়ে একটু একটু রাগারাগি চেঁচামেচি করতাম, আসলে অফিস শেষে বাসায় ফিরে মাথা সবসময় ঠিক থাকে না। আর আমরা দুজন পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু তার বাবা মা মেনে নেয় নাই। বৃষ্টি রাগ করে মেয়ে নিয়ে ওদের বাড়িতে চলে গেল তারপর ওর মা-বাবা বারবার আমাকে ডিভোর্স দিতে বলে। এভাবে মাস তিনেক পার হবার পরেই হুট করে সে ডিভোর্স দিতে চায়। খুব স্বাভাবিক ভাবে আমরা কথা বলছিলাম, এখনো প্রায় সেভাবেই মাঝে মাঝে কথা হয়। একপ্রকার যেন হাসতে হাসতে ডিভোর্স হয়ে গেল আমাদের কিন্তু সে বেদনা কতটা ভয়ংকর তা কি সবাই জানে?
– আশ্রয়, এমন কারণে বিয়ের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়? এটা অবিশ্বাস্য।
– আপু প্রতিদিন কিন্তু এই পৃথিবীতে অসংখ্য অসংখ্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে। কারো কারো জীবনে হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ আসে। আবার কারো জীবনে হঠাৎ করে এতো বড় কষ্টের ঘটনা ঘটে যে সেই কষ্টের ব্যথা সারাজীবন ভুলতে পারে না।
– তবুও এমনটা সহজে হয় না।
– আমার একটা বন্ধু ছিল সে বিদেশে থাকতো, পাঁচ বছর পরে যখন বাংলাদেশ ফিরছে তখন তার সম্পুর্ণ পরিবার অনেক আনন্দিত ছিল। বাংলাদেশে বিমান থেকে নামার পরে আমাকে কল দিল, তার মনের মধ্যে তখন অজস্র আনন্দ। এর ঠিক চার ঘন্টা পরে খবর পেলাম সেই বন্ধু বাড়ি পৌঁছানোর আগেই গাড়ি এক্সিডেন্ট করে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। এক মুহূর্তে তাদের সেই আনন্দ ভরা বাড়িতে সারাজীবনের জন্য কষ্টের মেঘ জমা হলো।
অপারেশন শেষ হয়েছে, ডাক্তার হাসি দিয়ে বললেন যে, আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের মেয়ে এখন বিপদ থেকে মুক্ত। সকলের বুকের উপর দিয়ে পাথরের বোঝা সরে গেল, একটু পরে পাখির অজ্ঞান অচেতন দেহটা বের করে কেবিনে নিয়ে গেল। আমি মুচকি হাসির চেষ্টা করে সেখান থেকে স্থানান্তরিত হলাম।
বাসে পরিচিত আঙ্কেলের কাছে কল দিলাম কিন্তু কথা বলতে পারি নাই। তিনি মোবাইল বাসায় রেখে বাইরে গেছেন, তাই যিনি কল রিসিভ করেছে তার কাছে খবরটা দিলাম।
★★
১৩ বছর পরে।
আজ শুক্রবার।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাই বেলকনিতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম, পিছনে কারো নিশ্বাসের শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে আছে।
– কি করো বাবা?
– তেমন কিছু না, কিছু বলবি মা?
– আমার মনটা খুব খারাপ বাবা।
– কেন কেন কেন? কি হইছে আমার আম্মুর?
– আমি প্রায় প্রতিদিন তোমার ডায়েরি পড়ি কিন্তু রোজ রোজ এক অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভালো লাগে না। তুমি আজকেই পাখির আন্টি আর আমার মা’র বাকি কাহিনি শেষ করবা।
– লিখতে ইচ্ছে করে না মা।
– তাহলে মুখে বলো, তবুও জানতে চাই।
– কি লাভ জেনে?
– পাখি আন্টির বিষয় কৌতূহল হচ্ছে, তিনি কেন আমার মা হলেন না? আর আমার মা শুধু শুধু কেন আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিল।
– তোমার মায়ের দ্বিতীয়বার মা হবার পরেই সেখানে তোমার অবহেলা শুরু হয়ে যায়। তারপর বৃষ্টি মানে তোমার মা নিজেই তোমাকে আমার কাছে দিয়ে দেয় কারণ সেই লোকটা নাকি একদিন তোমাকে খুব করে মেরেছিল।
– এই সামান্য কথা গুলো তুমি লিখতে পারো না?
– বাস্তব জিনিস লিখলে কেমন যেন ভালো লাগে না সবার কাছে তাই বন্ধ। কাল্পনিক অস্তিত্ব দিয়ে কিছু লিখতে গেলে সেগুলো পছন্দ করে সবাই।
– পাখি আন্টি কোথায় এখন?
– হাসপাতাল থেকে বাসায় যাবার পর তার সাথে বন্ধু থেকে প্রেম হয়েছিল। কিন্তু দুই মাস পরেই তোমার মায়ের মতো করে সেও বদলে যায়। ভালবাসা কেমন যেন হারিয়ে যায়, তখন বুঝতে পারলাম যে আমার মাঝে অনেক অপূর্নতা আছে মনে হয়। নাহলে সবাই ভালবেসে খুব কাছে এসে আবার কেন মাঝপথে ফেলে যাবে?
– এবার বুঝতে পারছি।
– কি?
– পরবর্তী জীবনের কাহিনিটা বিষন্নতা দীর্ঘশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ তাই লিখতে গিয়ে তুমি থমকে যাও বাবা, তাই না?
– এ প্রসঙ্গ টা বাদ দেওয়া যায় না মা?
– ঠিক আছে বাবা তাই দিলাম, কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে পারি? এটাই শেষ।
– কি?
– তুমি ডায়েরিটা “বাবুই পাখির বাসা” বলে লেখা আরম্ভ করলে কেন?
– ভেবেছিলাম বাস্তব আর কল্পনা দিয়ে মিশ্রন করে সাজিয়ে দেবো, কিন্তু হলো না।
– আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তাহলে পত্রিকা পড়ো আমি চা নিয়ে আসি।
স্নিগ্ধা চলে গেল ভিতরে, আমি রাস্তার পাশে তালগাছ এর দিকে তাকিয়ে আছি। যেদিন ডায়েরিটা লেখা শুরু করেছিলাম তখন এই গাছে বাবুই পাখির বাসা ছিল অনেক গুলো। এখন আর সেই বাসা নেই, সব পাখিগুলো হারিয়ে গেছে অজানায়।
(সমাপ্ত)
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)