অঙ্গীকার (১৩তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
বুশরা চলে যাওয়ার পর থেকে মুনিরা দিনরাত কেঁদে যাচ্ছে। কে জানি বুশরাটা কি করছে? কিভাবে ওকে ওরা সামলাচ্ছে? খাবারটা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা? এসব বলে বলে উনি চোখের পানি ঝরাচ্ছে। ফোনে শাফীর সাথে কথা হয়। তারপরও চোখের সামনে দেখা আর ফোনে কথা বলা এক নয়।
বুশরা চলে যাওয়ার পর থেকে রাদিয়া ও সবার অলক্ষ্যে চোখের পানি ঝরায়। খেতে গেলে ওর মুখ দিয়ে খাবার যায়না। বুশরাকে না খাইয়ে ও কখনো খেতোনা। রাতে ঘুমাতে গেলে বিছানায় পাশ ফিরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। বিছানার ওপাশটায় বুশরা রাদিয়াকে ওর ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ঘুমাতো । হাটতে গেলে বাসার প্রতিটা জায়গায় বুশরার পায়ের আওয়াজ পায়। মেয়েটা ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো দিয়ে এক পা,, দু পা করে হেটে বেড়াতো। কখনো হাটতে গিয়ে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠতো। আধো আধো বুলি আওড়াতো।
মা,,মাম,,মা,,, বাব,,,বা,, না,, না,, না। রাদিয়া হাটতে গেলেই মনে করে পিছন থেকে বুশরা জামার কোনা টেনে ধরে আছে। আনন্দিত হয়ে পিছন ফিরতেই দেখে না কেউ নেই। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় ঘুম থেকে উঠে বুশরা কান্না করতেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখতেই দেখে খালি বিছানা পড়ে আছে বুশরা নেই। তখন রাদিয়া বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদে। সেদিন বুশরার একটা জামা রয়ে গেছে সেটা বুকে চেপে ধরে সবসময় লুকিয়ে কাঁদে। না এই মেয়েটাকে দূরে ঠেলে পর করতে গিয়ে তো মেয়েটা আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। ঘুমাতে গেলে বুশরা এসে আর ঘুমাতে দেয়না খেতে গেলে ওর কথা মনে উঠে খেতে পারেনা। আজকাল ভার্সিটিতে যেতেও ইচ্ছা করেনা।
রাদিয়া সেজদায় পড়ে কান্নাকাটি করে। তবে তা সবার আড়ালে। ও কাউকে বুঝতে দিবেনা নিজের দুর্বলতা। কষ্ট হলে নিজের হবে আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবে।
শাফী বুশরাকে নিয়ে আসার পর থেকে ঠিকমতো ব্যবসার পিছনে দৌড়াতে পারেনা। দাদি আর বাবা ছাড়া কারো কাছে থাকেনা ও। ওকে খাবার খাওয়ানো নিয়েও অনেক কষ্ট করতে হয়। খাওয়াতে গেলে দুই পা চেপে ধরে মাথাটা আরেকজন ধরে তারপর খাওয়াতে হয়। আর জোর করে এতো কষ্ট করে খাওয়ানোর পরে উঠে বসাতে না বসাতে দেয় বমি করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে শাফী নিজেই বুশরার ময়লা কাপড় চোপড় গুলো ধুয়ে দেয়। মা বলেছে ইফতিকে দিতে ও ধুয়ে দিবে। কিন্তু শাফী দেয়না ওর এক কথা আমার মেয়ে আমি সামলাতে পারবো।
সালেহা বুঝতে পারেনা শাফী হঠাৎই বা ওকে কেনো নিয়ে আসলো। আবার নিজে এতো কষ্টইবা করছে কেনো।
সেদিন শাফী যখন বুশরার ধোয়া কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিচ্ছিলো,, সালেহা আক্ষেপের সুরে বললো,,,এতো কষ্ট করার কোন মানে হয় শাফী?
-মা আমি আমার মেয়ের জন্য করছি এটাকে কষ্ট বলেনা। এটা আমার কর্তব্য।
-কিন্তু এভাবে আর কতদিন??
-যতদিন বেঁচে থাকি মা। ওর মা থাকলে তো আর আমায় এসব ভাবতে হতোনা।
-সেইজন্যইতো বলি ওর মাকে নিয়ে আসতে তাও তো শুনিস না।
-মা ওর মা মরে গেছে জানার পরও কিভাবে আমি নিয়ে আসবো?
-আমি কি বলছি সেটা তুই ভালো করে জানিস। বাচ্ছাটা আজ দুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে সেদিকে খেয়াল আছে।
-মা আমিতো বুশরাকে সুস্থ করার চেষ্টা করছি। কালতো ডাক্তার ও দেখিয়েছি। সুস্থ করার মালিক আল্লাহ।
-দেখ তুই যা করছিস বোকার মতো কাজ করছিস। অথচ তোকে আমি বুদ্ধিমান ভেবে ছিলাম।
আফিয়া মারা গেছে। তুই বা আমরা কেউই ওকে সহজে ভুলতে পারবোনা। কিন্তু তাই বলে ওর কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেয়া কেমন কথা। আফিয়া যখন নিজেই চাইতো বুশরার একজন মা হবে সেখানে তুই কেনো মুখ ফিরিয়ে রেখেছিস?
বাবা,, দুনিয়াটা আমাদের জন্য অনেক বড় পরীক্ষাগার। উপরওয়ালা সবসময় আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। কখনো আমাদের অনেক বড় নেয়ামত দান করেন আমরা তার কৃতজ্ঞতা আদায় করি কিনা তা দেখতে। আবার কখনো আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান এটা দেখতে যে আমরা ধৈর্য্যধারণ করতে পারি কিনা। জীবন এটুকুতে কেনো থেমে যাবে?
কেন নিজেকে এভাবে পড়ে পড়ে শেষ করবি?
আফিয়ার জন্য সবসময় দোয়া করবি এটাই ওর জন্য যাবে। মেয়েটার কথাটা রাখার চেষ্টা কর বাবা।
নিজের জন্য না হলেও বুশরার কথাটা ভাব।
-মা আমি চাইলে ও রাদি কেন রাজি হবে? ওর যেখানে এখনো বিয়ে হয়নি আর আমি সেখানে বিবাহিত এক বাচ্ছার বাবা।
-সেই বাচ্ছাটা তো ওর বোনেরই রক্তের। কেন রাজি হবেনা। তুই রাজি হলে আমরা ব্যবস্থা করবো। মেয়েটা ভালো!!!
-মা ও রাজি হবেনা আমি জানি। খালি খালি কথা বাড়াবে না। ওর নিজের কি কোন স্বপ্ন নেই। আমাদের ইচ্ছে পূরণ করতে ও কেন নিজের ইচ্ছের জলান্জলি দেবে?
যেটা হবেনা তাই নিয়ে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই বলে শাফী রুমে চলে গেলো।
বিকালে জাওয়াদ সাহেব আর মুনিরা আসলো বুশরাকে দেখতে। শাফী তখন বাসায় ছিলোনা। বুশরার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মুনিরা ওকে কোলে নিয়ে কেঁদে দিলো। এই অসুস্থতার ভিতরেও নানুর কোলে উঠে বুশরা হেসে দিলো। বুশরাকে উনারা নিয়ে আসতে চেয়েছিলো সাথে করে। কিন্তু সালেহা জানালো,,, শাফী নাকি ওকে এ অবস্থায় কোথাও নিতে নিষেধ করেছে। ও আসুক আগে কথা বলি তারপর দেখা যাবে।
মুনিরা মনে মনে বলে,,, কেন নিষেধ করেছে তাতো আমি ভালো করে জানি। থাক আমরা জোর করার কে এখন?? ওদের বাচ্ছা ওদের কাছেই থাক।
কিছুক্ষণ শাফীর আসার অপেক্ষা করে থেকে উনারা চলে গেলো। সালেহা অনেক করে বলেছে থাকার জন্য। শাফী ও বাসায় নেই ও যদি এসে শুনে উনারা এসে চলে গেছে তখন বেশ রাগারাগি করবে।
মুনিরা বললো,,, না আপা কি করে থাকি বলেন?? বাড়ীতে দু’দুটো জোয়ান মেয়ে আছে। ওদের একা রেখে কোথাও গিয়ে থাকতে পারিনা। আজকাল যুগ খারাপ। বিপদ আসতে ও সময় লাগেনা এখন থাকার কোন অবস্থা নেই। সময় করে কাল পরশু আবার আসবো বলে কারণ দেখিয়ে চলে গেছেন।
শাফী এসে একথা শুনার পর বললো,,, তোমরা তো আমাকে ফোন করতে পারতে? এটা কিরকম হলো উনারা এসে এভাবে না খেয়ে চলে গেলো। উনাদের মেয়ে নেই বলে উনাদের এতটুকু অযত্ন হোক আমি চাইনা মা।
-আমি অনেকবার করে বলেছি কিন্তু উনার কাজের দোহাই দিয়ে থাকেনি। অনেকবার তোর ফোনে কল দিয়েছি বারবার বন্ধ বলছিলো।
-কি জানি ফোন তো খোলাই ছিলো হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা বলে বুশরাকে নিয়ে ও রুমে চলে গেলো। বুশরাকে বিছানায় শুইয়ে একটু একটু করে জলপট্টি মাথায় দিতে লাগলো। আর তাছাড়া দোয়া পড়ে পড়ে ওর পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। শাফী বিড়বিড় করে বললো,,, তোর মা টা কেন এভাবে চলে গেলো??
তোর মা থাকলে কি আমায় তোকে নিয়ে এতো ভাবতে হতো?
ও বড় স্বার্থপর আমাদের কষ্ট দিয়ে নিজে গিয়ে সমস্ত দুনিয়াবি পেরেশান থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
সবাই বলছে তোর জন্য মা আনতে কিন্তু তুই বল মা এটা কি করে সম্ভব। তোর মায়ের মতো করে কি কেউ তোকে আদর করবে?
দুনিয়ার মানুষগুলো বড্ড স্বার্থপর রে মা!! বড্ড স্বার্থপর!!
তোর সুখের জন্য কাউকে আনলে যদি তোর কষ্ট আরো বেড়ে যায় তখন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। অনুশোচনার আগুনে সারাজীবন দগ্ধ হতে হবে আমাকে। তোর কষ্ট যে আমার কখনো সহ্য হবেনা।
এতদিন শাফী বুশরার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে রেখেছিলো। আজ মেয়েটার এ অবস্থা দেখে আপনা আপনি চোখের কোন বেয়ে অজোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ এতো ছোট একটা বাচ্ছা অথচ কি কষ্টটাই না পাচ্ছে!!! শ্বাসও নিতে পারছেনা ঠিক করে । আহারে ছোট বাচ্ছা !! আমরা তো অসুস্থ হলে কষ্টটা প্রকাশ করতে পারি কিন্তু এইটুকু একটা বাচ্ছা কাউকে নিজের কষ্টের কথা বলতে ও পারছেনা।
এই কয়দিনের জ্বরে শুকিয়ে কেমন বিছানার সাথে লেগে গেছে। অথচ কেমন নাদুসনুদুস ছিলো মেয়েটা। যেই দেখতো ওকে কোলে তুলে নিতো। সারারাত শাফী জেগেই কাটিয়েছে নামাজ পড়ে আর বুশরার দেখাশুনা করে।
মায়ের মুখ থেকে বুশরার অসুস্থতার খবর শুনে রাদিয়ার বুকের ভিতর কেমন যেনো অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। মেয়েটা এতো অসুস্থ অথচ আমিই জানিনা। এতো রাগ শাফী ভাইয়ার একবার আমাদের জানালে কি হতো?
রুমে এসে নামাজে দাঁড়ালো। আল্লাহ যাতে মেয়েটাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেয়। কি যানি মেয়েটা এখন কেমন আছে? কি করছে? জ্বরটা কি কমেছে? কিছু খেয়েছে তো??
মায়ের মুখ থেকে শুনেছে বুশরা অনেক শুকিয়ে গেছে। অজান্তে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। মাঝে মাঝে নিজের প্রিয় মানুষদের জন্য নিজের প্রিয় অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয় আজ রাদিয়া তা বুঝতে পারছে। বুশরার ভালো থাকার জন্য রাদিয়াকে নিজের সব স্বপ্ন ছাড়তে হবে। বোনের কথা রাখতে ওকে ছাড়তে হবে নিজের সব আবেগ অনুভূতিকে?
সেদিন সারারাত নির্ঘুম কেটেছে রাদিয়ার। সারারাত বুশরার চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলো।
পরদিন সকাল আটটার সময় শাফীদের বাসার কলিংবেলটা বেজে উঠলো। ইফতি দরজার ভিতর থেকে কে আসছে দেখেই দরজা খুলে শাশুড়িকে ডাক দিলো।সালেহা দরজার পাশে এসে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।
এ কাকে দেখছেন উনি??…….
চলবে………