হৃদ মাঝার পর্ব-২১+২২

0
539

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২১)

রাজন্যাদের অনসাইট যাওয়ার সময় এগিয়ে এলো | ভিসা প্রসেস হয়ে গেছে, টিকিটও এসে যাবে হাতে এক দুই দিনের মধ্যেই | গুগল করে দেখেছে, জায়গাটা খুবই চরম ভাবাপন্ন | কলকাতায় এখন রীতিমত গরম, বৃষ্টি পড়লে একটু আধটু ঠান্ডা হয় ঠিকই কিন্তু তারপরেই গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। কিন্তু ওয়েস্ট ডে ময়েনে এখনই হালকা ঠান্ডা, তাই হালকা শীতের পোশাক নিতে হয়েছে। মালবিকা সার্চ করে করে কিছু ছবি দেখে বলেছে ওখানে নাকি লম্বা শীতকাল এবং রীতিমতো বরফ পড়ে | রাজন্যার একটু যে আফসোস হয়নি তা নয়, শীতকালে গেলে বেশ বরফে ঢাকা পথঘাট দেখতে পেত | ওর বন্ধুদের মধ্যে যাদের অবস্থা ভালো, তারা ফি বছর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেত | রাজন্যাদেরই সেভাবে কোথাও বেড়ানো হয়নি | ও অবশ্য ভেবে রেখেছে যখন ওর অনেক পয়সা হবে তখন আর কিছু করুক না করুক, প্রতি বছর অন্তত সাত দিনের করে একটা ট্রিপ করবে, প্রথমে দেশের ভেতরের জায়গা গুলো দেখবে তারপর বিদেশে বেড়াবে । এর মধ্যে আরাধনা একদিন ফোন করে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো জিনিস মনে করে নিয়ে যেতে বলে দিয়েছেন। তপু এসএমএস করে দরকারি ওষুধের লিস্ট পাঠিয়েছে যেগুলো সাথে রাখা দরকার। অফিসেও অনেকে অনেক রকম সাজেশন দিয়েছে |

আগের দিনের কোড ডিলিট হয়ে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে রাজন্যা বিশেষভাবে সাবধান হয়ে গেছে। ওর যদিও খুব ইচ্ছা যাওয়ার আগে মণীষাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার, কিন্তু শিবাজীদা বারণ করেছে বলে কিছু করতে পারছে না | তবে যাওয়ার ঠিক দুদিন আগে একটা সুযোগ এসে গেল |

রাজন্যা অনুরাগ আর পাভেলকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল সার্ভারে কোন কোন কোডের ব্যাকআপ রাখা আছে | এর মধ্যে ওদের পুরনো প্রজেক্টের কোড যেমন আছে, তেমনি এই নতুন প্রজেক্ট এর জন্য কয়েকটা ছোট ছোট কাজ করা হয়েছে সেই কোডগুলোও রাখা আছে । মণীষা একবার উঁকি দিতে এসেছিল ঠিকই কিন্তু রাজন্যা ওকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিল,

– এগুলো সব ছোটখাটো ব্যাপার মণীষাদি, পাভেল আর অনুরাগ সামলে নেবে। ওই ফোল্ডারটাতেই আছে যেখানে রাখা থাকে। শুধু আমি পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখি, এবারে পাসওয়ার্ডটা সরিয়ে দিয়ে যাব যাওয়ার আগে যাতে ওরা সহজে অ্যাক্সেস করতে পারে।

মণীষা কিছু না বলে ওখান থেকে সরে গেলেও রাজন্যা চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে থাকলো। ওর আন্দাজ ঠিক হলে মণীষা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই ফোল্ডারে গিয়ে রাজন্যার রাখা কোডগুলো ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করবে |

আগামী কাল রাত দেড়টার সময় শিবাজী আর রাজন্যার ফ্লাইট, তাই কাল ওরা অফিসে আসবে না | বিকেলবেলা সাবর্ণদা একটা মিটিং ডেকেছেন | এই প্রজেক্টে যতজন কাজ করছে তারা সকলে, তার সাথে আরো কয়েকজন | স্বয়ম আর দ্বৈপায়নও আছে | খানিক হালকা কথাবার্তা, প্রথমবার অন সাইট যাচ্ছে রাজন্যা, তার জন্য কিছু পেশাগত উপদেশ ইত্যাদির পরে সাবর্ণদা মণীষার দিকে তাকিয়ে বললেন,

– মণীষা, শিবাজীর অনুপস্থিতিতে সৌম্য এখানকার প্রজেক্ট এর লিড আর তুমি সৌম্যর ব্যাকআপ | কাজেই প্রজেক্ট এর প্রতিটা আপডেট যেন তোমার ঠোঁটস্থ থাকে। যেকোনো সময় যে কেউ তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই যেন তুমি তার উত্তর দিতে পারো |

মণীষার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো | বড় করে ঘাড় নেড়ে বলল,

– নিশ্চয়ই সাবর্ণদা। আমি প্রস্তুত।

সৌম্য বলে উঠল,

– আচ্ছা একবার লাস্ট বারের মতন আগামী এক মাসের প্রজেক্টেড শিডিউলটা দেখে নিলে হতো না?

– নিশ্চয়ই!

শিবাজী ঘাড় নাড়াল,

– রাজন্যা, তোমার কাছে আছে না শিডিউলটা?

রাজন্যা গোবেচারার মতন মুখ করে বলল,

– হ্যাঁ, কিন্তু ল্যাপটপের সফটওয়্যারটা আপডেট হচ্ছে শিবাজীদা। মণীষাদি যদি একটু প্রেজেন্ট করে দেয়…

মণীষা প্রস্তুতই ছিল | তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,

– হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি করে দিচ্ছি…

ল্যাপটপ খুলে বসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মণীষার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যেতে দেখে সৌম্য ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,

– কি হয়েছে?
– কিছু না কিছু না…

মণীষা অপ্রস্তুতভাবে উত্তর দিয়ে ল্যাপটপে আঁতিপাতি ভাবে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করল | মিনিট দুয়েক কেটে গেল, সকলেই মণীষার দিকে তাকিয়ে আছে | মণীষার মনে হল এসি ঘরের মধ্যেও ও ঘেমে যাচ্ছে। প্রজেক্টের বেশ কিছু ডকুমেন্ট ওর ল্যাপটপে নেই। যেগুলো কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও ছিল | তার মধ্যে প্রজেক্ট প্ল্যান, আগামী এক মাসের শিডিউল, রিস্ক অ্যানালিসিস ডকুমেন্ট এবং একটা প্রেজেন্টেশন যেটা খুব কষ্ট করে গত তিনদিন ধরে বানিয়েছিল | মোটের উপর গত দুই তিন দিন যে সমস্ত ফাইল এর উপরে কাজ করেছিল তার কোনটাই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না | শিবাজী অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

– কি হলো? খুঁজে পাচ্ছ না নাকি ফাইল?
– না মানে শিবাজীদা, ছিল, কিন্তু ডকুমেন্টগুলো এখন খুঁজে পাচ্ছি না | কোথায় গেল বুঝতে পারছি না!

শিবাজী বিরক্ত মুখে বলল,

– আশ্চর্য টিম পেয়েছি একটা! কারো সিস্টেম থেকে কোড ডিলিট হয়ে যায়, কারোর সিস্টেম থেকে ফাইল হাওয়া হয়ে যায়!

বলতে বলতেই কিছু একটা সন্দেহ হওয়াতে রাজন্যার দিকে তাকালো শিবাজী। রাজন্যা নিরীহ মুখ করে বসে রয়েছে | শিবাজী ওর দিকে তাকিয়েছে টের পেয়েও অন্যদিকে ফিরে থাকলো। শিবাজী খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মণীষাকে জিজ্ঞাসা করল,

– তোমার ল্যাপটপ কারো কাছে দিয়েছিলে?

মণীষা প্রায় কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল,

– না শিবাজী দা
– তাহলে ফাইল কোথায় গেলো?
– বুঝতে পারছি না?
– কোনো ভাইরাস অ্যাটাক হয়েছিল?

সৌম্যর প্রশ্নের উত্তরে দুদিকে মাথা নাড়াল মণীষা | তারপরেই বিদ্যুৎ চমকের মতন মাথায় এলো একটা কথা। সার্ভারে শেয়ার করা ফোল্ডারে রাজন্যার রাখা কোডগুলো দেখছিল। বেশিরভাগ ফোল্ডার পাসওয়ার্ড ছাড়া হলেও গোটা দুয়েক ফাইলে পাসওয়ার্ড দেওয়া ছিল। তখনই একটা ফাইল চোখে পড়ে যার নাম রাজন্যা-ইম্পরট্যান্ট-পাসওয়ার্ড | কি ধরনের ফাইল খেয়াল না করেই মাউসে দুবার ক্লিক করে ফাইলটা খুলে ছিল | কিছু একটা মেসেজ এসেছিল বটে কিন্তু সেটা ভালো করে না পড়েই ‘ওকে’ করে দিয়েছিল পাসওয়ার্ড জানার আগ্রহে | কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন ফাইলই খোলেনি | রাজন্যার কোনো একটা চালাকি বুঝে বিরক্ত হয়ে ফোল্ডার বন্ধ করে দিয়েছিল | এখন মনে হচ্ছে ওটা এমন কোন ফাইল ছিল না তো যেটা ওর নিজের মেশিনের জিনিসপত্র ডিলিট করে দিয়েছে! মণীষা স্থান কাল পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো,

– রাজন্যা, তুমি এটা করেছ না?

রাজন্যা আকাশ থেকে পড়া মুখ করে বলল,

– আমি! মানে আমি তোমার ল্যাপটপ ধরলাম কখন?
– আমার ল্যাপটপ ধরোনি, কিন্তু ওই যে ফাইলটা রেখেছিলে সার্ভারে, ওটা কি মেশিনের কোড ডিলিট করে দেয়?

রাজন্যা যথাসম্ভব নিরীহ মুখ করে বলল,

– তুমি যে কি বলছ মণীষাদি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না | আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি আমাকে যা খুশি তাই বলে দোষ দেবে! আমি তো আজকে সকাল থেকে পাভেল আর অনুরাগকে কোথায় কি ফাইল থাকবে, কোথায় কি কি ব্যাকআপ রাখা আছে সেই সমস্ত বোঝাতে ব্যস্ত ছিলাম | তোমার সাথে তো আমার কথাই হয়নি!

মণীষা প্রায় কাঁদো কাঁদো ভাবে সাবর্ণর দিকে ফিরে বলল,

– বিশ্বাস করুন সাবর্ণদা, সব ডকুমেন্টস ছিল আমার কাছে। কি করে ডিলিট হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারছি না

সাবর্ণ গম্ভীর মুখে বসে আছেন, সৌম্য হতভম্ব | কি হয়েছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না | মণীষা যে হঠাৎ রাজন্যাকে কেন দোষ দিচ্ছে সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না। রাজন্যার মুখ দেখেও কিছু বোঝা যাচ্ছে না | আচমকা রাজন্যা বলে উঠলো,

– মণীষাদি, যদি ভুল করে ডিলিট হয়েও গিয়ে থাকে, তাহলে তোমার রিসাইকেল বিনে তো থাকবে। একটু দেখো না!

রাজন্যার দিকে রাগী রাগী চোখ করে তাকালেও মণীষা চট করে রিসাইকেল বিনটা খুললো এবং পরমুহূর্তেই ওর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,

– আছে আছে! আমাকে দুমিনিট দিন, আমি এক্ষুনি প্রেজেন্ট করছি |

মিটিং এর বাকিটা নির্ঝঞ্ঝাটেই কেটে গেল | দিনের শেষে যখন সবাই একে একে বেরোনো শুরু করেছে, রাজন্যাকে ব্যাগ গুছাতে দেখে শিবাজী গম্ভীর গলায় বলল,

– রাজন্যা, একটু ওয়েট করে যাও | আমি তোমাদের ওদিকেই যাব আজকে, তোমাকে ড্রপ করে দেব।

রাজন্যা একটু ঘাবড়ে গেলেও আপত্তি করার সাহস না পেয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ল |

কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে শিবাজীও বেরনোর জন্য তৈরি হয়ে গেল | রাজন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,

– চলো!

ভীতু বাচ্চার মতন ব্যাগ কাঁধে শিবাজীর পেছনে পেছনে চলল রাজন্যা | আগে কোনদিন অফিসের পার্কিং লটে আসেনি, তাই লিফটে করে বেসমেন্টে নেমে ঠিক শিবাজীর পিছন পিছন হেঁটে গাড়ির কাছ অবধি পৌঁছল, না হলে এই এত বড় জায়গায় এত গাড়ির মাঝে হারিয়ে যাবে মনে হচ্ছিল | ব্যাগ কোলে নিয়ে সীট বেল্ট বাঁধা নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখে শিবাজী বলল,

– ব্যাগটা পিছনে রাখো | এরকমভাবে বসবে কি করে?
– না ঠিক আছে, এক্ষুনি তো পৌঁছে যাব…

চেপে চুপে ব্যাগখানাকে পায়ের কাছে রাখল | শিবাজী গাড়িতে স্টার্ট দিল | বোতাম টিপতেই কাঁচের জানলা বন্ধ হয়ে এসি চালু হয়ে গেল গাড়িতে | অফিসের মূল গেট দিয়ে বেরোনো পর্যন্ত গাড়ির মধ্যে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। রাস্তায় ওঠার পরে রাজন্যাই প্রথম জিজ্ঞাসা করল,

– আমাদের ওদিকে আপনার কোন কাজ আছে?
– হুম

শিবাজী সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।

– ও আচ্ছা। কোনো দোকানে যাবেন?
– না, চিড়িয়াখানায়

রাজন্যা চোখ বড় বড় করে তাকালো | শিবাজীর মুখে কোন বিকার নেই, একইভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।

-চিড়িয়াখানা মানে? এখানে আবার চিড়িয়াখানা কোথায়?

শিবাজী গাড়ি চালাতে চালাতেই একবার বাঁদিকে তাকালো তারপর বলল,

– চিড়িয়াখানা ছাড়া এরকম বাঁদর আর কোথায় থাকে?

রাজন্যার বুকটা ধড়াস করে উঠলো | শিবাজীদা কি ওকে বাঁদর বলল? মুখে জিজ্ঞাসা করল,

– কোন বাঁদর?
– লেজবিহীন হাইটেক বাঁদর, যে কোড লিখে অন্যের মেশিনের ফাইল ডিলিট করে দেয়।

সর্বনাশ! ধরা পড়ে গেছে! মুহূর্তে রাজন্যার চোখ মুখ লালচে হয়ে উঠলো | আর কোনো কথা বলার সাহস পাচ্ছে না | শিবাজীদা যে এত সহজে ব্যাপারটা ধরে ফেলবে তা বুঝতে পারেনি | বিনা কথাবার্তাতেই বাকি রাস্তাটা পেরোলো | ফ্ল্যাটের সামনে গাড়িটা দাঁড়াতে রাজন্যা নেমে গিয়ে ঝুঁকে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে যেতেই শিবাজী বলল,

– এখানে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করা থাকলে অসুবিধা নেই তো?

রাজন্যা একটু অবাক হলো,

– আপনি কি এখানে গাড়ি পার্ক করে কোথাও যাবেন?
– হ্যাঁ, চিড়িয়াখানায় যাব বললাম যে!

রাজন্যা থতমতো খেয়ে গেল | ভদ্রলোকের মতলব বুঝতে পারছে না। শিবাজী রাস্তার ধার করে চেপে গাড়িটা দাঁড় করালো, তারপর নেমে এসে বলল

– চলো |

রাজন্যার মনে হল ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কোন রকমে ফ্যাঁসফেসে আওয়াজে জিজ্ঞাসা করল,

– কোথায়?
– তোমার ফ্ল্যাটে | কথা আছে |

আর কোন কথা না বলে চুপচাপ লিফটের দিকে পা বাড়াল রাজন্যা | টেনশনের চোটে দুবার ধরে চেষ্টা করেও দরজার লক খুলতে না পেরে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘামতে লাগলো। শিবাজী ওর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে লক খুলে দরজা ঠেলে বলল,

– ভিতরে এসো |

যেন রাজন্যার ফ্ল্যাটে নয়, নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকছে লোকটা!

ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকে চমৎকৃত হলো শিবাজী | এতটা সাজানো-গোছানো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখবে আশা করেনি | এরকম ছিটিয়াল একটি মেয়ে আরো একজন সমবয়সী মেয়ের সাথে থাকে, আশঙ্কায় ছিল ঘরে ঢুকে বেশ আপত্তিজনকভাবে এলোমেলো দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু না! পরিপাটি সাজানো ঝকঝকে একটা ফ্ল্যাট | ছোট্ট ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমে গোল গ্লাস টপ টেবিল এর উপরে একটা সাদা রংয়ের পোরসেলিনের পটে বাঁশ গাছ, তার পাশে কাঁচের জাগে জল এবং একটা কাঠের ছোট ট্রের উপরে দুটো কাঁচের গ্লাস উল্টো করে রাখা | টেবিলের দুদিকে দুটো চেয়ার | একধারে একটা তিনজন বসার মতন সোফা, তার সামনে একটা ছোট ফোল্ডিং কাঠের টেবিল | সোফার ওপরের কুশন গুলোও যত্ন করে গুছিয়ে রাখা | ওপেন কিচেনে একটাও না মাজা বাসন বা আলগা প্যাকেট কোথাও পড়ে নেই। অফিসে বেরোনোর আগে এইভাবে গুছিয়ে রেখে যাওয়া ষে সম্ভব সেটা শিবাজী কল্পনা করতে পারেনি | মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,

– বাহ্, তোমার ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর গোছানো তো!
– হ্যাঁ, মানে আমার বাড়িতে ঢুকে অগোছালো দেখতে ভালো লাগে না।

শিবাজী প্রশংসা সূচক মাথা নাড়ল | সত্যি ঘরে ঢুকে একটা সুন্দর গোছানো পরিবেশ দেখলে চোখের আরাম হয় তা তো ঠিকই |

রাজন্যা নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে খানিকটা মনোবল ফেরত পেয়েছে | বলল,

– আপনি বসুন | চা খাবেন?
– কফি খাওয়াতে পারলে খুব ভালো হয়…

রাজন্যা হাসলো,

– নিশ্চয়ই! আমি নিজেও কফির ফ্যান |

ঝটপট সাবান দিয়ে দুই হাত ধুয়ে দুটো সুদৃশ্য কাঁচের কাপে কফি নিয়ে এসে হাজির হলো । সাথে একটা প্লাস্টিকের কৌটোয় মেরি বিস্কুট |

– সরি, আর কোনো বিস্কুট নেই
– চলবে। মেরি বিস্কুট আমার অলটাইম ফেভারিট |

হাত বাড়িয়ে দুটো বিস্কুট নিয়ে শিবাজী কফির কাপে চুমুক দিল | দারুণ স্বাদ, আবার কফির উপরে দোকানের মতন ফেনাও বানিয়েছে কি করে যেন মেয়েটা | রাজন্যাও নিজের কফির কাপে একটা চুমুক দিল, তারপর আস্তে আস্তে বলল,

-আই অ্যাম সরি।
-কিসের জন্য?

রাজন্যা চুপ | শিবাজী অনুভব করতে পারল ওর প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। মনে মনে ভেবে এসেছিল মেয়েটাকে এই ধরনের ছেলেমানুষি করতে বারণ করবে | অফিসে আর একটু প্রফেশনাল ব্যবহার করার কথা বুঝিয়ে বলবে, কিন্তু এখন কোনো গম্ভীর কথাই মাথায় আসছে না, উল্টে মণীষার কাঁচুমাচু মুখটার কথা ভেবে ভয়ানক হাসি পাচ্ছে | অনেক অনেক বছর পরে নিজের অতীতের সেই পুরনো উচ্ছল, হাসিখুশি, সবসময় মজা করতে থাকা ছেলেটাকে আবার ছুঁতে পারছে যেন। শিবাজীর মুখে চোখে চাপা হাসির আভাস দেখে রাজন্যা একটু সাহস পেয়ে জিজ্ঞাসা করল,

– আপনি আমাকে খুব বকবেন, তাই না?

এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা হাসিটা শব্দ করে বেরিয়ে এলো এবারে | হাসতে হাসতেই শিবাজী বলল,

– বকবো বলেই তো এসেছিলাম, কিন্তু দেখো হেসে ফেললাম

রাজন্যা বলে উঠলো,

– ওকে একটু তো শাস্তি দিতেই হত। তবে প্রজেক্ট এর ক্ষতি হয়ে যাবে ভেবে পার্মানেন্ট ডিলিট করিনি |
– করেছিলেটা কি শুনি?
– কিছুই না | একটু লোভ দেখিয়েছিলাম | একটা ব্যাট ফাইলে রিসেন্ট ফাইল ডিলিট করার কমেন্ট লিখে রাজন্যা ইম্পরট্যান্ট পাসওয়ার্ড নাম দিয়ে সেভ করে রেখেছিলাম | আমি জানতাম মণীষাদি ওই নাম দেখলে ফাইলটা ওপেন করার চেষ্টা করবেই করবে…

এবারে হাসতে হাসতে শিবাজীর বিষম খাওয়ার জোগাড় | কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

– তুমি সাংঘাতিক মেয়ে!

রাজন্যা মুখ গোঁজ করে বলল,

– আমার সাথে কেউ বদমাইশি করলে তার উত্তরে একটু তো বদমাইশি করতেই হয়। তা না হলে আমি কিন্তু মেয়ে খারাপ নই!
– বুঝেছি! আগামী একমাস আমাকে সাবধানে থাকতে হবে |

শিবাজী হাসতে হাসতে বললেও রাজন্যা লজ্জা পেয়ে যায়।

– এ বাবা কি বলছেন? না না আমি এমন কিছু করবো না যাতে আপনার অসুবিধা হয়।
– সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমি যদি না বুঝে এমন কিছু করি যাতে তোমার অসুবিধা হয়, তখন তো আমার কপালে এরকমই কিছু একটা শাস্তি জুটবে বলে মনে হচ্ছে।
– মণীষাদি মোটেও না বুঝে কিছু করেনি, ইচ্ছে করে আমার কোড ডিলিট করে দিয়েছিল | কে বুঝে বদমাইশি করে আর কে না বুঝে ভুল করে সেটুকু বোঝার মতন জ্ঞান আমার আছে।
– শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। যাই হোক, প্যাকিং কমপ্লিট?

রাজন্যা ঘাড় হেলালো | শিবাজী কৌতুকমাখা সুরে বলল,

– ওখানে গিয়ে থাকবে কোথায়?

রাজন্যার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো | থাকবে কোথায় মানে? কোম্পানি ওদের থাকার ব্যবস্থা করবে না? আমতা আমতা করে বলল,

-ওই যে একটা হোটেলের এড্রেস দিয়েছিল মেইল করে…
-দিয়েছিল তো | কিন্তু সেটা কতদিনের সেটা দেখেছ তো?

রাজন্যা ভয়ানক ঘাবড়ে গেল | কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি মোবাইলে মেইল খুলে চেক করতে লাগলো, তারপরেই পাংশু মুখে বলল,

– এটা তো মোটে তিনদিনের
– সেই তো! কোম্পানি থেকে তিনদিনের হোটেল রিজার্ভ করে দিয়েছে। তার পরে কোথায় থাকবে?

এই ব্যাপারটা রাজন্যা একেবারেই ভেবে দেখেনি | সৌম্যদার উপরে খুব রাগ হচ্ছে, এতদিন এত কথা বলল, কই এটা তো বলল না যে থাকার ব্যবস্থা নিজেকে করতে হবে?

– আচ্ছা যদি এই হোটেলেই পুরো মাসটা থেকে যাই?
– হোটেলের ভাড়া জানো? পুরো মাসের মাইনে চলে গিয়ে পকেট থেকে দিতে হবে।
– তাহলে!!
– ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হয় ওখানে, ও দেশে অ্যাপার্টমেন্ট বলে | দুটো স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। তোমার আমার পাশাপাশি |

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো রাজন্যা | কি ভয়টাই না পেয়েছিল!

– শুধু শুধু আমাকে ঘাবড়ে দিলেন!
– শুধু শুধু! একা একটা মেয়ে যাচ্ছ, এই জিনিসগুলো ভাববে না?
– একা কোথায়? আপনি যাচ্ছেন তো!
– কিন্তু আমি তো আর তোমার গার্জিয়ান নই | নিজেরটা তো নিজেকেই বুঝতে হবে | আমি যদি তোমার অ্যাপার্টমেন্ট বুক না করতাম তাহলে কি করতে?

রাজন্যা বাচ্চাদের মতন গাল ফুলিয়ে বলে উঠলো,

– প্রথমবার যাচ্ছি, কিছুই জানিনা বলে এইসব হচ্ছে, পরের বার সব নিজের ব্যবস্থা করে নেব |
– ভেরি গুড। ঠিক আছে আমি উঠলাম, তাহলে কালকে এয়ারপোর্টে দেখা হচ্ছে | দশটার মধ্যে পৌঁছে যেও | তোমার সাথে কেউ যাবে?
– হ্যাঁ মালবিকা যাবে…
– মালবিকা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে অত রাতে একা ফিরবে?
– না, মানে, ইয়ে ওর বয়ফ্রেন্ড যাবে।

শিবাজী হাসলো,

– ঠিক আছে তাহলে | গুড নাইট |

(ক্রমশ)

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২২)

শিবাজী বেরিয়ে যাওয়ার পরে জামা কাপড় না ছেড়েই নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার উপর ধপাস করে শুয়ে পড়ল রাজন্যা | বুকের মধ্যে এখনো দুপ দাপ শব্দ হচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের মনের ভাব নিজেই বুঝে উঠতে পারে না | প্রথম দিন লোকটাকে ভয়ানক গম্ভীর, রাশভারি, রাগী এবং খারাপ মনে হয়েছিল | তারপর ধীরে ধীরে সেই মনোভাবের পরিবর্তন হতে হতে কখন যেন মনের কোণে একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে নিয়েছে এই মানুষটা | শিবাজীদাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারেনা, কখনো মনে হয় ভীষণ সংবেদনশীল, ভীষণ কেয়ারিং একজন লোক | কখনো মনে হয় মাত্রাতিরিক্ত রুড আর খামখেয়ালী | মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রাজন্যার হঠাৎ মনে হল ও কি শিবাজীদাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে? পর মুহুর্তেই মালবিকার কথাগুলো মনে এলো, শিবাজীদা শুধু যে বিবাহিত তাই নয়, শিবাজীদার পাঁচ বছরের একটা মেয়েও আছে | শিবাজীদা এবং সুমিত্রা পিসিমার আচরণে এটুকু বুঝেছে ঠিকই যে ওনার বিবাহিত জীবনে কিছু একটা সমস্যা আছে, কিন্তু এটা জানা নেই যে সেই স্ত্রী স্যামি মল্লিকের সাথে শিবাজীদার আদৌ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে কিনা | নিজের মনেই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল রাজন্যা। কি সব ভাবছে! নাহ্, এইসব ভাবার সময় ওর এখন নয়। ওকে এখন আপাতত নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে হবে | বাবা মা ভাইয়ের জন্য আরেকটু বেটার লাইফস্টাইল এর ব্যবস্থা করতে হবে | নিজের ফ্ল্যাটটাকে নিজের পছন্দ মতন সাজাতে হবে | ছোটবেলা থেকে স্বপ্নে দেখা জায়গা গুলোতে বেড়াতে হবে | এখনই কারোর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এই সমস্ত প্ল্যানগুলোতে জল ঢালা চলবেনা, আর তাছাড়া তিতলির সৌজন্যে শিবাজীদার সাথে যোগাযোগ তো ওর থাকবেই | তিতলিকে এই অল্প সময়ের মধ্যেই এত ভালোবেসে ফেলেছে রাজন্যা যে ওর সাথে দেখা না হলে মনটা কেমন যেন আনচান করতে থাকে । এই যে একমাস ডল পুতুলের মতন বাচ্চাটা কে দেখতে পাবে না সেটা ভেবে এখন থেকেই মনটা একটু একটু খারাপ হয়ে আছে।

আরো কিছু এদিক সেদিকের কথা ভাবছিল শুয়ে শুয়ে, হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো | উঠে বসে ফোনটা ধরে দেখলো সমাদৃতা | আগের দিন তিতলিকে পড়িয়ে ফেরার সময় সমাদৃতার বাড়িতে ঘুরে এসেছিল রাজন্যা। ওকে জানিয়েছিল যে মাসখানেকের জন্য অফিসের কাজে বিদেশ যেতে হচ্ছে। এই আরেকজন। অল্প কয়েক দিনের আলাপেই গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দুজনের। সেই দিনই ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়েছিল, সমাদৃতাকে রাজন্যা কথা দিয়েছে যে ইউএসএ থেকে নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রাখবে আর ছবি পাঠাবে।

ফোন তুলে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে সমাদৃতা বলে উঠলো,

– কি গো, তোমার প্যাকিং কমপ্লিট?
– হ্যাঁ, মোটামুটি কমপ্লিট | ওই দু চারটে জিনিস একেবারে যাওয়ার আগে ঢুকাবো।
– মনে করে কিন্তু কয়েকটা জিনিস অবশ্যই হাতের কাছে রাখবে | তোমার আইডেন্টিটি প্রুফ, মানে আধার কার্ড এবং পাসপোর্ট | যদিও আধার কার্ড টা কলকাতা এয়ারপোর্ট পেরোনোর পরে আর কাজে লাগবে না, তবু হ্যান্ডি রাখবে | টিকিটের কপি, তোমার অফিসের আইডি কার্ডের কপি, গিয়ে প্রথম যে ঠিকানায় উঠবে তার তার কমপ্লিট এড্রেস আর সম্ভব হলে ওখানকার কারো একটা কন্টাক্ট নাম্বার। শিকাগোতে নেমে ওখানকার একটা লোকাল ফোন নাম্বার নিয়ে নেবে। তোমার এই ফোন তো অকেজো হয়ে যাবে, ওখানকার লোকাল সিম এয়ারপোর্ট থেকেই পেয়ে যাবে | তা না হলে এ দেশে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না, পরে অবশ্য ওখানে গিয়ে নানান রকমের প্যাকেজ ট্যাকেজের খোঁজ পেয়ে যাবে |

রাজন্যা অবাক হয়ে গেল,

– তুমি এত কিছু জানো কি করে?

সমাদৃতা শব্দ করে হাসলো,

– আমার দিদি বিদেশে গেছিল কয়েকবার । ওর কাছেই শুনেছি।
– তোমার দিদি! কই তোমার দিদিকে তো দেখিনি।

সমাদৃতা একটু উদাস গলায় বলল,

– দিদি আমাদের সাথে থাকে না | ও খুব ব্যস্ত মডেল। ও এখন দিল্লিতে থাকে।
– ও আচ্ছা! খুব ভালো করলে এগুলো বলে দিয়ে | আমি তো প্লেনে এতক্ষণ ধরে বসে কি করব সেটা নিয়েও একটু চাপে আছি |
– তুমি বই পড়ো?
– পড়ি তো, কিন্তু এখানে বই খুব একটা নেই আর বই নিতে গেলে ব্যাগ ভারী হয়ে যাবে যে!
– তা কেন? অনলাইন পড়ো | দাঁড়াও, আমি তোমাকে আমার গুগল প্লে বুকস এর আইডি পাসওয়ার্ড পাঠিয়ে দিচ্ছি | তুমি অ্যাপটা প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করে নাও | ওখানে বেশ কিছু ভালো ভালো বই ডাউনলোড করা আছে | দেখবে জেফ্রি আর্চারের ক্লিফটন ক্রনিকল বলে একটা সিরিজ আছে, সাতটা গল্প। পুরো প্লেনে পড়েও শেষ করতে পারবে না, তবে দেখবে খুব ভালো লাগবে।
– আমি তোমার আইডি ইউজ করব? আবার যদি কিছু সমস্যা হয়? তার থেকে তুমি লিঙ্ক পাঠাও, আমি বরং কিনে নিচ্ছি!
– সমস্যা হওয়ার কথা নয়, আচ্ছা তবু ঠিক আছে | এমন কিছু দাম নয়। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি | তুমি কাল বেরোবে কখন?
– দশটার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছাব, ওই মনে করো নটা নাগাদ ডিনার করে বেরিয়ে যাব।
– ঠিক আছে, সাবধানে যেও | পৌঁছে খবর দিও।
– নিশ্চয়ই। তুমিও সাবধানে থেকো। ফিরে এসে দেখা হবে।

রাত্রিবেলাটা উত্তেজনায় ভালো করে ঘুম হলো না রাজন্যার | বেশ কয়েকবার ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল | শেষমেশ ভোরের দিকে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙলো মালবিকার ঠেলাঠেলিতে | মালবিকা অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। রাজন্যা চোখ খুলতেই বলল,

– শোন, ব্রেকফাস্টে চিঁড়ের পোলাও করা আছে। খেয়ে নিস | দুপুরে কিন্তু রিচ কিছু খাস না। আমি তাড়াতাড়ি ফিরব, সন্ধ্যায় চিকেন সুপ বানিয়ে দেব | আজ আর কোথাও বেরোস টেরস না। লাস্ট একবার চেক করে নিস কিছু নেওয়ার বাকি আছে কিনা | কিছু আনার থাকলে বলিস, আমি ফেরার সময় নিয়ে আসব।

রাজন্যা দুই হাত দিয়ে মালবিকাকে জড়িয়ে ধরল।

– তোর মত বেস্ট ফ্রেন্ড থাকতে আমার কিছু ভুল হবার উপায় নেই মালু। আই উইল মিস ইউ সো মাচ!
– আই উইল অলসো মিস ইউ ডার্লিং। তবে অফিসের কাজ ভালোভাবে সেরে, ভালোয় ভালোয় ফিরে আয়…

ঘুম থেকে উঠেই সমাদৃতার মনে পড়েছে কালকে বাড়ির ইন্টারনেট কানেকশনটা ঠিকঠাক কাজ করছিল না বলে বইয়ের লিংকগুলো রাজন্যাকে পাঠানো হয়নি। তাই ব্রাশটুকু করার আগেই মোবাইলে গুগল প্লে-বুক খুলে পছন্দের বইয়ের লিংকগুলো পাঠাতে শুরু করল | প্রথমেই ধরল জেফ্রি আর্চারের ক্লিফটন ক্রনিকলস | মনে মনে বলল ‘রাজন্যা, তুমি লাকি যে সবকটা গল্প পরপর টানা পড়তে পারবে!’ মনে আছে এক একটা গল্প শেষ করার পরে কি অসহ্য প্রতীক্ষায় কাটত তার পরবর্তী পর্ব বেরোনো পর্যন্ত | হোয়াটসঅ্যাপে লিখতে শুরু করল – এক নম্বর, অনলি টাইম উইল টেল, দুই নম্বর, সিনস অফ দ্যা ফাদার, তিন নম্বর, বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট, চার নম্বর, বি কেয়ারফুল ওয়াট ইউ উইশ ফর…

– দিঠি, কেমন আছো?

নিজের নাম শুনে চমকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকানো সমাদৃতা। সুমি পিসি, হাতে নেটের কাজ করা সাদা কাপড়ের ঢাকনা দেওয়া একটা কাঁসার থালা। মনে হয় কোথাও থেকে পুজো দিয়ে ফিরছেন।

সমাদৃত হাসলো।

– ভালো | তুমি কেমন আছো? এত সকালে কোথা থেকে ফিরছো?
– এই বুবাইয়ের জন্য একটু পুজো দিতে গেছিলাম |

জানলার কাছে এগিয়ে এলেন সুমিত্রা।

– হাঁ করো দেখি!

হাঁ না করে হাত পাতলো সমাদৃতা,

– হাতে দাও পিসি। এখনো দাঁত মাজিনি, মুখ ধুয়ে এসে খাবো।

সুমিত্রা সামান্য হেসে থালা থেকে একটা ফুল নিয়ে সমাদৃতার কপালে ছোঁয়ালেন, তারপরে প্রসাদী মিষ্টি তুলে ওর হাতে দিলেন

– শিবাজীদার জন্য হঠাৎ পুজো দিলে?
– ওই মাস খানেকের জন্য অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে। তাই একটু মঙ্গল কামনা এই আর কি | আমরা সব পুরোনো দিনের মানুষ কিনা, এইসব বিশ্বাস নিয়েই আছি
– ও আচ্ছা আচ্ছা।

সুমিত্রা বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে সমাদৃতা ভাবতে বসলো। আজকেই রাজন্যাও ইউএসএ যাচ্ছে এক মাসের জন্য আবার শিবাজী দাও বাইরে যাচ্ছে এক মাসের জন্য! এই দুটো ঘটনার মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে? রাজন্যা শিবাজীদার বাড়িতে তিতলিকে পড়াতে যায় এইটুকু জানে, কিন্তু ওরা কি একে অপরের পূর্ব পরিচিত?

দুপুরের পর থেকে অন্তত পাঁচবার সম্পূর্ণ ব্যাগেজ আরো একবার করে চেক করেছে রাজন্যা | দুটো বড় ট্রলি ব্যাগ আর একটা ল্যাপটপ ব্যাগ | মেয়েরা নাকি একটা আলাদা হ্যান্ড ব্যাগ নিতে পারে ল্যাপটপ ব্যাগ থাকলেও | কিন্তু রাজন্যা আর সেই সব রিস্ক নেয় নি, ল্যাপটপ ব্যাগটারই সামনের খোপে নিজের যাত্রাকালীন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে নিয়েছে। মালবিকা অফিস থেকে ফেরার সময় ওর এক বন্ধুর থেকে লাগেজ ওজন করার একটা যন্ত্র নিয়ে এসেছে | সেই দিয়ে বার কয়েক ওজন করে দেখে নেওয়া গেল সর্বাধিক ওজনের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে কিনা | গত কয়েকদিনে সকলে নানান রকম উপদেশ দিয়েছে ওকে, প্লেনে করে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার ওপরে যে এত রকম বাধা-নিষেধ আছে তা সত্যিই জানা ছিল না রাজন্যার | হ্যান্ড ব্যাগে লিকুইড জিনিস নিতে গেলে একটা নির্দিষ্ট মাপের বেশি নেওয়া যায় না, আবার ব্যাটারি জাতীয় জিনিস চেক ইন লাগেজে নেওয়া যাবে না, ধারালো জিনিস কোন্ ব্যাগে নেবে তারও নিয়ম আছে | রাজন্যার কেবলই মনে হচ্ছিল কিছু না কিছু ভুল করে ফেলবেই আর এয়ারপোর্টে শিবাজীদার কাছ থেকে বকা খেতে হবে।

সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হলো ঘনঘন বাথরুমে যাওয়া | মালবিকা বিরক্ত হয়ে বলল,

– এরকম করছিস কেন? মনে হচ্ছে যেন পড়াশোনা না করে উচ্চমাধ্যমিকের অংক পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছিস!

রাজন্যা ওর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাত দিয়ে মালবিকার হাত চেপে ধরে বলল,

– ভীষণ টেনশন হচ্ছে রে মালু!

মালবিকা চোখ ঘোরালো,

– একা তো আর যাচ্ছিস না! তোর বস তো যাচ্ছে সাথে, সে ঠিক সব সামলে নেবে।

রাজন্যা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

– ওই জন্য তো আরো টেনশন করছি। বোকামি করলে এয়ারপোর্টের লোকের সামনে ধমক খেতে হবে।

মালবিকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

– তোকে নিয়ে আমি কি করবো রাজ? তোর মতন স্মার্ট ড্যাশিং মেয়ে ওই খারুস বসের বকার ভয় পঞ্চাশ বার করে পায়খানায় যাচ্ছে! প্লিজ কাম অন! বি ইয়োরসেল্ফ! আমি এরকম ভীতু রাজকে আমার বন্ধু বলে মানি না।

মালবিকা এইসব বলে রাজন্যার কনফিডেন্স বাড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু রাজন্যা ভিতরে ভিতরে একটুও কনফিডেন্স পাচ্ছে না |

টেনশনের চোটে রাজন্যা ডিনারে কিছু খেতেও পারল না | মালবিকা বিরক্ত হয়ে বলল,

– তোর জন্য এত কষ্ট করে চিকেন স্ট্যু বানালাম। আর তুই দু চামচ খেয়ে উঠে পড়লি!
– স্বাদ পাচ্ছি না রে, মনে হচ্ছে একটু খেলেই আবার পটিতে যেতে হবে
– ভগবান! দিল্লিতে নামবি রাত সাড়ে তিনটে। তারপর ওখানে চার ঘন্টা ওয়েট করে শিকাগোর ফ্লাইট | মাঝ রাতে কিন্তু ক্ষিদে পাবে বলে দিলাম রাজ।
– এয়ারপোর্টে কিছু খেয়ে নেব | তুই আমাকে এখন জোর করিস না মনা, লক্ষী সোনা |

সাড়ে আটটা নাগাদ মালবিকার বয়ফ্রেন্ড আদিত্য ওদের ফ্ল্যাটে চলে এলো | আদিত্য ওদের থেকে বছর চারেকের বড় | অন্য একটা আইটি কোম্পানিতেই চাকরি করে | কাছাকাছি বাড়ি, ওর একটা আই টেন গাড়ি আছে, সেটা নিয়েই এসেছে | ন’টার খানিক আগেই তিনজনে বেরিয়ে পড়ল | বেরোনোর আগে বাড়িতে একবার ফোন করল রাজন্যা। ভাইয়ের সাথে, বাবার সাথে কথা বলার পর আরাধনা ফোন ধরে বললেন,

-সাবধানে যেও আর তপু তোমাকে একটা ফোন নম্বর পাঠাচ্ছে, যদি নিতান্ত দরকার হয় তাহলে ওই নম্বরে ফোন করো।

রাজন্যা খুব অবাক হয়ে বলল,

– এটা কার নম্বর মা?
– আমার এক পরিচিতর নম্বর | শিকাগোতে থাকেন, তবে খুব প্রয়োজন না হলে ফোন করো না |

মনে মনে একটু অবাক হলেও আর কোনো প্রশ্ন করল না রাজন্যা | ওদের ফ্ল্যাট থেকে এয়ারপোর্ট খুব বেশি দূরে নয়, ন’টা চল্লিশের মধ্যেই পৌঁছে গেল ওরা | গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো মালবিকা | গেটের সামনে গাড়ি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেয় না, আদিত্য গাড়ি নিয়ে গেল পার্কিং লট এ রাখতে। মালবিকা বান্ধবীকে একবার জড়িয়ে ধরল, তারপর ওর দুই কাঁধে হাত রেখে বলল,

– কি করবি এখন? ভেতরে ঢুকে যাবি?

রাজন্যা মাথা নাড়লো,

– না, শিবাজীদার জন্য অপেক্ষা করি। এমনিতেও আমি জানিনা ভিতরে ঢোকার পরে কি করতে হয়।

গাড়ি পার্ক করে খানিকক্ষণ পরে ফিরে এলো আদিত্য | রাজন্যার কথা শুনে হেসে বলল,

– চিন্তা কোরো না, ভেতরের লোকজন সব গাইড করে দেবে।

রাজন্যা তবু মাথা নাড়াল,

– না থাক | শিবাজীদা দশটার মধ্যে এসে যাবে | তোমরা ততক্ষণ একটু ওয়েট করো প্লিজ |
– না না, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। তুমি এয়ারপোর্টের ভিতরে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই আছি

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রাজন্যার ফোনে রিং হল, স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ‘শিবাজী দা কলিং’ | প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোন ধরলো রাজন্যা | ওদিক থেকে পরিচিত গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন এলো,

– আমি পৌঁছে গেছি, তুমি কত দূরে?
– আমিও পৌঁছে গেছি, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি |
– ঠিক আছে, আমি আসছি |

মিনিট কয়েকের মধ্যেই শিবাজীদাকে একটা চাকা ওয়ালা গাড়ির উপরে লাগেজ বসিয়ে হেঁটে হেঁটে ওদের দিকেই আসতে দেখল রাজন্যা। বরাবর ফরমাল পোশাকে দেখা লোকটার গায়ে আজকে নেভি ব্লু রঙের টাইট টি-শার্টের ওপরে সাদা আর নীল চেক চেক শার্ট | শার্টের বোতাম গুলো খোলা | পরনে হালকা নীল রঙের ডেনিম | চুলে জেল দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করা | গলায় ঝুলছে ওয়্যারলেস ব্লুটুথ ইয়ারফোন। মালবিক কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

– এইটা তোর বস রাজ! এ তো সাংঘাতিক হ্যান্ডসাম রে! তুই এর প্রেমে না পড়ে এতদিন ধরে আছিস কি করে?

মানবিকার পেটে একটা গুঁতো দিলো রাজন্যা | শিবাজী ওদের সামনে আসতে আলাপ করিয়ে দিল,

– শিবাজী দা, এই মালবিকা আর এ আদিত্য। মালবিকা, শিবাজী দা আমার বস।
– নাইস টু মিট ইউ। ঠিক আছে, তোমরা তাহলে আর রাত করো না, বাড়ি ফিরে যাও। থ্যাঙ্কস ফর ড্রপিং হার । তোমরা না এলে আমি পিক আপ করতে যেতাম |

মালবিকা রাজন্যার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো, রাজন্যা না দেখার ভান করে বলল,

– ঠিক আছে রে, তোরা বেরিয়ে পড় তাহলে | আমি পৌঁছে খবর দেব |

দুই বান্ধবীর আরেক দফা গলা জড়াজড়ির পরে রাজন্যা শিবাজীর সাথে এয়ারপোর্টের গেটের দিকে এগিয়ে গেল | শিবাজী একবার রাজন্যার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

– পাসপোর্ট কোথায়? আর টিকিটের কপি?

রাজন্যার মনে পড়ল সমাদৃতার কথা শুনে ও একটা স্লিং ব্যাগে ঢুকিয়েছিল সেগুলো | কিন্তু স্লিং ব্যাগটাকেই ল্যাপটপ ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। নিজের জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপ ব্যাগ হাতড়াতে লাগলো | শিবাজী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

– এই জিনিসগুলো হাতের কাছে রাখবে | সব জায়গায় কাজে লাগবে |

রাজন্যা ব্যাগের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করতে করতেই বলল,

– হ্যাঁ জানি জানি | আমাকে বলে দিয়েছিল তো | আছে সব এক জায়গায় করা।

বলতে বলতেই ব্যাগটা খুঁজে পেয়ে টেনে বার করল।

– পেয়ে গেছি। চলুন |
– ল্যাপটপ ব্যাগের চেইন টা বন্ধ করো আগে।

রাজন্যা এক হাত লম্বা জিভ কেটে ল্যাপটপ ব্যাগের চেইন ঠিক করে আটকে ল্যাপটপ ব্যাগ পিঠে আর স্লিং ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গেটের দিকে এগুলো |

এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকাটা নিয়ে কোনও সমস্যা হলো না | মোটা গোঁফওয়ালা রাগী চেহারার খাঁকি পোশাক পরা লোকটা একবার পাসপোর্ট আর টিকিটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার রাজন্যার মুখের দিকে তাকিয়েই ইশারায় ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিল | অনেকক্ষণ ধরে চেপে থাকা একটা নিঃশ্বাস ফুস করে বুক থেকে বের করে দিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে পড়ল রাজন্যা | আর ঢুকেই ভেতরের বিশাল বড় ঝলমলে কর্মব্যস্ততার সম্মুখীন হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর | লম্বা যাত্রাপথে কমফোর্টেবল পোশাক পরার কথা বলেছিল সকলেই। তাই রাজন্যা পরে এসেছে একটা হালকা হলুদ রঙের থ্রি কোয়ার্টার হাতাওয়ালা সুতির শার্ট আর তার সাথে লুজ ফিটিং কালো রঙের ডেনিম | হাতে ঘড়ি, একমাথা কোঁকড়ানো চুল পনিটেল করে বাঁধা | আক্ষরিক অর্থেই চোখ গোল গোল করে চারিদিক দেখছিল রাজন্যা | শিবাজী খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারের দিকে |

– তোমার দুটো লাগেজই তো চেক-ইনের?

সাড়া না পেয়ে পাশে রাজন্যাকে দেখতে না পেয়ে একটু এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখতে পেল মেয়েটা গেট থেকে ঢুকে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে দাঁড়িয়েই চারিদিকে দেখছে। শিবাজীর মনে পড়ল সৌম্য ওকে বলে দিয়েছিল যে রাজন্যার এটা প্রথমবার শুধু বিদেশ যাওয়া নয় প্লেনে চড়ারও প্রথম অভিজ্ঞতা | শিবাজী খানিকটা পিছিয়ে আবার রাজন্যার কাছে চলে এলো |

– চলো, চেক ইন করতে হবে তো!
– চেক ইন?
– হুঁ, তোমার যে ব্যাগ দুটো প্লেনের পেটের মধ্যে করে যাবে, সেই ব্যাগ দুটো কাউন্টারে দিতে হবে। ওরা ওজন চেক করে, স্ক্যান করে পাঠিয়ে দেবে। এরপরে আমাদের একটা সিকিউরিটি চেকিং হবে | আমাদের হ্যান্ড ব্যাগ এবং আমাদের বডি স্ক্যান হবে। ঠিক আছে?

মাথা নেড়ে শিবাজীর সাথে এগোল রাজন্যা | বন্ধুদের কাছে শুনেছিল চেক ইন করার সময়েই প্লেনের সিট দেওয়া হয় | শিবাজী যখন দুজনের টিকিট নিয়ে কাউন্টারের সুবেশা তরুণীটির সাথে কথা বলছিল, রাজন্যা একটু ঘাড় উঁচু করে বলল,

– আমি কি একটা জানলার ধারে সিট পেতে পারি?

শিবাজী ঘাড় ঘোরালো, তারপর মাথা নেড়ে বলল,

– পাবে | শুধু কলকাতা টু দিল্লি ফ্লাইটে আইল সিট তোমার | তারপরে দুটোতেই জানলার ধারেই পেয়েছ।

রাজন্যার মুখটা খুশি খুশি হয়ে উঠতেই শিবাজী ফের বলে উঠলো,

– লম্বা ফ্লাইটে কিন্তু জানলার ধারের সিট মানে প্রতিবার বেরোনোর সময় পাশের দুজনের কাছে অনুরোধ করে বেরোতে হবে। এখনো ভেবে দেখো, চাইলে চেঞ্জ করতে পারো…

রাজন্যা স্বজরে মাথা নাড়ল। কতবার আর বেরোতে হবে! তার জন্য জানলার ধার ছাড়বে নাকি!

শিবাজী আবার কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খানিক পরে তিনটে বোর্ডিং পাস রাজন্যার দিকে এগিয়ে দিল।

– চলো এবার ওদিকে | বুঝিয়ে দিচ্ছি |

বোর্ডিং পাস ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে রাজন্যা | সৌম্যদাও বলেছে, নিজেও গুগল করে দেখে নিয়েছে |

– দিল্লী টু শিকাগো আর শিকাগো টু ডে ময়েন বোর্ডিং পাস দুটো আপাতত ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখো। এখনকারটা হাতে রাখো |

বাধ্য মেয়ের মতন মাথা নেড়ে তাই করল রাজন্যা | সিকিউরিটি চেকের সময় কি কি করতে হবে সেটা শিবাজী বুঝিয়ে দিল। শরীর স্ক্যান হয়ে যাওয়ার পরে নিজের ল্যাপটপ ব্যাগটা না আসতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল রাজন্যা | শিবাজী ওর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করল,

– কি হয়েছে?
– আমার ল্যাপটপ ব্যাগটা ফেরত আসেনি শিবাজীদা!
– চলে আসবে | কোনো কারণে হয়তো দ্বিতীয়বার স্ক্যান হচ্ছে |

এর মধ্যেই একজন রাজন্যার ব্যাগটা তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন,

– এটা কার ব্যাগ?

রাজন্যা তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল,

– আমার!
– এটার মধ্যে কিছু একটা শার্প অবজেক্ট আছে | আমাদের ভিতরের সব জিনিস বাইরে বের করতে হবে।

শার্প অবজেক্ট মানে ধারালো জিনিস! রাজন্যা মনে করতে পারছে না কি হতে পারে | কাউন্টারের ধারের দিকে এগিয়ে গেল। ব্যাগ উল্টো করে ভিতরের সমস্ত জিনিস একটা বড় ট্রের উপরে ঢালা হয়েছে | গ্লাভস পরা হাতে জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে মেয়েটি একটা শাড়িতে লাগানোর ব্রোচ তুলে আনলো

– আমার ধারণা এটার জন্য সমস্যা হচ্ছিল

শিবাজী রাজন্যার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

– শাড়িতে পড়ার ব্রোচ তুমি ল্যাপটপ ব্যাগে নিয়ে কি করছো?

রাজন্যা আমতা আমতা করে বলল,

– এটা মনে হয় ব্যাগে থেকে গেছিল, অফিস থেকে একদিন বিয়ে বাড়ি গেছিলাম।
– এটা কিন্তু আমাদের ফেলে দিতে হবে ম্যাম…

করুণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়ে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালো রাজন্যা | কলকাতায় এয়ারপোর্টে আর কোন সমস্যা হলো না | নির্দিষ্ট সময়ে দিল্লির ফ্লাইটে উঠে পড়ল ওরা দুজনে। এই ফ্লাইটে শিবাজির সীট মাঝে আর রাজন্যার সীট একদম ধারে | ফ্লাইট চেক অফ করার সময় একটু ভয় ভয় লাগলেও ধীরে ধীরে প্রাথমিক দুশ্চিন্তাটা কাটিয়ে উঠল রাজন্যা । মন দিয়ে এয়ার হোস্টেসের দেখানো সেফটি ইন্সট্রাকশন গুলো দেখলো, সামনের সিটের পকেট থেকে তুলে এয়ারলাইনসের ম্যাগাজিন খানাও উল্টেপাল্টে দেখা হল | তারপরে যখন বুঝল ফ্লাইট এর অধিকাংশ যাত্রী চোখ বুজে একটা ঘন্টা দুয়েকের ছোট্ট ঘুমের ব্যবস্থা করছে, নিজেও সিট সামান্য পিছনে হেলিয়ে চোখ বুজল।

শিবাজী খানিকক্ষণ আগেই সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজেছিল | ঘুম অবশ্য আসেনি | ওর বরাবর রাত্রে এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া অভ্যাস। সেই সময়টা পেরিয়ে গেলে ঘুম কেটে যায়, তারপরে আর ঘুম আসতে চায় না | এখন বাজে প্রায় রাত দুটো, ফ্লাইটের এই ঘন্টা দুয়েক জেগেই কাটবে তা বুঝতে পারছে। আশা করা যায় শিকাগোর ফ্লাইটটায় খানিক ঘুমোতে পারবে | যদিও সমস্যা হল সেটা বেশিরভাগ সময়টাই দিনের বেলায় | রাজন্যা পাশে বসে খানিকক্ষণ উসখুস করছিল টের পেয়েছে শিবাজী | স্বাভাবিক! প্রথমবার প্লেনে উঠেছে, সবকিছুই নতুন লাগছে ওর কাছে। তবে কিছু পরে মেয়েটাও যে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে সেটাও বোঝা গেল | শিবাজী একবার আড়চোখে বাঁ দিকে তাকালো, রাজন্যার গা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে | কোন মেয়েলি পারফিউম সম্ভবত | হলদে রঙের শার্ট পরে মেয়েটাকে কেমন যেন সদ্য ফোটা ডেইজির মতন লাগছে | পাশে এয়ার হোস্টেস যেতে যেতে শিবাজীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,

– এনিথিং ফর ইউ স্যার?
– ওয়ান কফি প্লিজ!

মিনিট কয়েকের মধ্যেই কাগজের কাপে কফি দিয়ে গেলেন বিমান সেবিকা

অন্যমনস্ক ভাবে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল শিবাজী, হঠাৎ কোনো একটা এয়ার পকেটে পড়ে প্লেনে একটা মৃদু ঝাঁকুনি হল | রাজন্যা ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুমের মধ্যেই ডান হাত দিয়ে সীটের হাতলের উপরে রাখা শিবাজীর বাম হাতখানা চেপে ধরল একবার | শিবাজী সেদিকে তাকিয়ে ফের কফির কাপ ঠোঁটে তুলল |

মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক বছর আগের এই রকম এক প্লেন জার্নির কথা | সমর্পিতার প্রথম কলকাতার বাইরে ফ্যাশন শো, মুম্বাইতে |

– প্লিজ আমার সাথে চলো শিবাজী | আমি কোনদিন ফ্লাইটে উঠিনি, আমার ভয় করছে!
– ভয়ের কি আছে? তোমার সাথে তো তোমাদের টিমের মেম্বাররা থাকবেই…
– থাকবে থাকবে, কিন্তু ভয় পেলে কি ওদের কারোর হাত চেপে ধরতে পারবো? প্লিজ চলো!

শিবাজী তখন সদ্য সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে | ছয় মাসও হয়নি | এই সময় এক আধ দিনের ক্যাজুয়াল লীভ ছাড়া ছুটি পাওয়া মুশকিল | কিন্তু সমর্পিতা কোনো কিছু শুনতে নারাজ |

– যে করে হোক, চারটে দিন ম্যানেজ করো প্লিজ। ফ্লাইটে যদি ভয়ের চোটে আমার হার্ট ফেল হয় তখন কি হবে? তখন তোমার মনে হবে না তুমি গেলে এমনটা হতো না?
– এ আবার কি সব উল্টোপাল্টা কথা!

শিবাজী যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ততদিনে ওর চেতনা, বুদ্ধি সবই সমর্পিতাতে আচ্ছন্ন | সহজ কথায় রাজি করাতে না পেরে সমর্পিতা চোখে জল এনে ফেলেছিল |

– বেশ বুঝলাম! আমি বাঁচি কি মরি তাতে তোমার কিচ্ছু যায় আসে না | মানছি প্লেনে চড়া টা এমন কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু প্রথমবার যে! তুমি তো জানোই আমার বাড়ির লোক কেউ আমাকে সি অফ করতে পর্যন্ত আসবে না, ওদের কাছে এখন আর শুধু আমার এম্বিশনের নয়, আমার অস্তিত্বেরও কোন দাম নেই। এখন তো মনে হচ্ছে তোমার কাছেও নেই!

আবেগের এই আক্রমণের সাথে বেশিক্ষণ যুঝতে পারেনি শিবাজী | একগাদা মিথ্যে বলে চার দিনের ছুটি জোগাড় করেছিল অফিস থেকে। নেহাত অল্প সময়ের মধ্যেই ভালো এমপ্লয়ির তকমা এঁটে গিয়েছিল গায়ে, তাই সেই সময়কার বস খুব খুশি না হলেও খুব ঝামেলাও করেননি।

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে