হৃদ মাঝারে পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
680

#হৃদ_মাঝারে (অন্তিম পর্ব)

সেন ভিলায় আজ ভয়ানক হইচই | রাগী গম্ভীর রামগরুড়ের ছানা শিবাজী সেন আর খামখেয়ালী ছিটিয়াল খেপি রাজন্যা সান্যালের আজ এনগেজমেন্ট। প্রচুর লোক নিমন্ত্রিত | তার মধ্যে অফিসের গোটা গ্যাং, রাজন্যার কলেজের প্রচুর বন্ধু, মালবিকা ও তার বয়ফ্রেন্ড আদিত্য, বোলপুরে রাজন্যার সমস্ত পরিবার সকলেই নিমন্ত্রিত। সমস্ত ব্যাপারটা বেশ তাড়াতাড়িই হয়েছে | সমর্পিতা মল্লিক এর ঘটনাটার পরে শিবাজী আর রিস্ক নিতে পারেনি | সুমিত্রাকে গিয়ে বলেছিল,

– যা ডানপিটে মেয়েকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাতে তাকে বেশি দিন খোলা ছেড়ে রাখাটা ঠিক হবে না |

সুমিত্রা হেসে ফেলেছিলেন,

– খোলা ছেড়ে রাখা আবার কি কথা রে? বাঁদর নাকি?

শিবাজীও হেসে বলেছিল,

– ওই বাঁদরেরই জাত বোন, ল্যাজটাই যা নেই!

প্রতীক লাহিড়ীর কলকাতার বাড়িটা বহু বছর তালা বন্ধ করা ছিল | হোক না রমলার সৎ মেয়ে, তবু মেয়ে তো! তাই জোরজার করেই সেই বাড়ি খুলিয়ে রং করিয়ে ঝাড়পোঁছ করিয়ে নতুনের মতন ঝকঝকে করে দেওয়া হয়েছে। অমরনাথের জন্য বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করে বোলপুর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে এই বাড়িতে। তপুর আনন্দ দেখার নয়। দিদির বিয়ে বলে কথা! যতই সামনে উচ্চমাধ্যমিক থাকুক, এই কয়েকটা দিন বইখাতার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না এটা সে উচ্চকণ্ঠে সকলকে জানিয়ে রাখছে | রমলা শুরুতে একটু সংকুচিত হয়ে থাকলেও সুমিত্রা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন,

– বৌদিভাই এ তোমার এক অন্য জন্ম হয়েছে। তুমি আজ কন্যা পক্ষ, আমি পাত্রপক্ষ | কাজেই তুমি আমার বেয়ান |

শিবাজীর স্মৃতিতে মা বলতে কয়েকটা হলদে হয়ে যাওয়া ছবি | তাই রমলাকে দেখে আলাদা করে কোন আবেগের সৃষ্টি হয়নি | তবে অনুভব করতে পারলো এতদিন ধরে যে একটা অব্যক্ত ক্ষোভ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল, স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি সামনে এসে দাঁড়ানোর পরে সেই ক্ষোভের আর কিছুই টের পাচ্ছে না |

সুমিত্রা এসে ওর কানে কানে বলে গেছেন,

– শাশুড়িকেও মা বলতে হয় কিন্তু! কাজেই তোর কোন সমস্যা হবে না বুবাই।

আরাধনাকে রমলা বলে ডাকার লোক এ বাড়িতে আর কেউ নেই | রমলার চিহ্নও এ বাড়িতে তেমন একটা নেই আর | তিতলির ঘর খানাই একসময় রমলা আর শিবনাথের বেডরুম ছিল। অন্যমনস্ক হয়ে ওই ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরাধনা। কি একটা দরকারে শিবাজী সেই ঘরে ঢুকে আরাধনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সরি বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল, থমকে দাঁড়ালো ‘বুবাই’ বলে একটা ডাক শুনে | খুব আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো,

– হ্যাঁ বলুন
– আমার তরফ থেকে একটা উপহার আছে তোমাদের জন্য
– উপহার!

শিবাজী ভ্রু কুঁচকে ফেলল

– রাজন্যার মতন মেয়েকে জীবন সঙ্গী করতে পারছি সেটাই আমার লাইফের বেস্ট গিফট | এর বাইরে কোনো উপহার সত্যিই আমার দরকার নেই
– কিন্তু আমার যে দেওয়ার দরকার আছে…

আরাধনা মৃদু হেসে কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা থেকে একটা খাম বার করে এগিয়ে দিলেন শিবাজীর দিকে। শিবাজী হাত বাড়ালো না | একইভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,

– কি এটা?
– খুলে দেখো |

আরাধনার স্মিত শান্ত কণ্ঠস্বরকে অগ্রাহ্য করতে পারল না শিবাজী | হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে ভিতর থেকে আইনি স্ট্যাম্প দেওয়া কাগজটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল | কাগজের লেখাটুকু পড়ে হতভম্ব হয়ে আরাধনার দিকে তাকালো,

– এসব কি? ডিভোর্স পেপার!

আরাধনা একই রকম হাসিমুখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন |

– কিন্তু কেন?
– দেখো, রক্তের সম্পর্ক না থাকলে আইনত বিবাহে কোন বাধা নেই। কিন্তু একটা সামাজিক প্রশ্নচিহ্ন তো থেকেই যায়! নিজের জীবনে একটা বড় ভুল একসময় করেছি, এটুকু দিয়ে যদি তার সামান্যতম সংশোধন করা যায়।
– কিন্তু রাজন্যার বাবা, মানে মেসোমশাই?
– মেসোমশাই এর মত না থাকলে কি এমন সহজে ডিভোর্স হতো? মেয়ের জন্য এটুকু করতে পারবো না? আইনত এবং সামাজিক কোনোভাবেই এই সম্পর্কে কোন ধরনের বাধা থাকুক তা আমি চাই না

শিবাজী নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ | বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত আলোড়ন চলছে, কিন্তু আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতে না দিয়ে ঠোঁট চেপে উপর নিচে মাথা নাড়ল,

– থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ |

কিছু না ভেবে দুই পা এগিয়ে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে আরাধনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো শিবাজী | কয়েক মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও দুই হাতে শিবাজীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আরাধনা। দুই চোখে জল, হাতের উলটো পিঠে মুছে নিলেন সন্তর্পনে |

রাজন্যাকে আজকে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে পাচ্ছে না শিবাজী। পেস্তা রঙের লেহেঙ্গা চোলি পরে বাড়ির মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় এবং বাগানের বিভিন্ন কোনায় ঘুরে ঘুরে ছবির জন্য পোজ দিয়ে চলেছে | তার সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় রয়েছে ম্যাচিং পোশাক পরা সোমদত্তা সেন ওরফে তিতলি | তিতলি রাজন্যাকে কি বলে ডাকবে সেই নিয়ে অবশ্য একটা কনফিউশন সৃষ্টি হয়েছিল |

ফেয়ারি সিস্টার যে আর কিছুদিন পর থেকে এই বাড়িতেই ওর সাথে থাকবে সেটা শুনে তিতলির আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই | কিন্তু ওকে বলা হয়েছে যে রাজন্যাকে আর সিস্টার বলে ডাকা যাবে না | বাচ্চাটার ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে রাজন্যাই একটা উপায় বার করেছে | তিতলির গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে,

– আমাকে ফেয়ারি কুইন একটা প্রমোশন দিয়েছে | তোমাদের যেরকম ক্লাসে প্রমোশন হয়ে নার্সারি ওয়ান থেকে নার্সারি টুতে ওঠো, আমি সেরকম ফেয়ারি গড সিস্টার থেকে ফেয়ারী গডমাদার হয়ে যাচ্ছি…

তিতলি চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে বলেছে,

– তুমি তাহলে সিস্টার থেকে মাদার হয়ে যাবে? মাদার মানে তো মাম্মা, আমি কি তাহলে তোমাকে মাম্মা ডাকতে পারবো?

রাজন্যার বুক থেকে একটা দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেছে। বুঝে গেছে যে তিতলির তাকে মা হিসাবে মেনে নিতে কোন সমস্যা হবে না | তিতলিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাজন্যা বলেছে,

– হ্যাঁ সোনা, তুমি আমাকে এরপর থেকে মাম্মা বলেই ডাকতে পারবে |

অমরনাথের বোলপুরের আত্মীয় প্রতিবেশীদের অনেকে অবশ্য পাত্রের বয়স বেশি, দোজবর, বাচ্চার বাবা ইত্যাদি বলে অমরনাথের মন বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল | কিন্তু অমরনাথের তার মেয়ের পছন্দের ওপর অগাধ আস্থা | শিবাজী সেন যে আরাধনা সান্যালেররই আগের পক্ষের ছেলে সে কথা ফলাও করে আর কারোকে বলতে যাওয়া হয়নি। কি দরকার খামোখা জটিলতা টেনে এনে? বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি বোঝাপড়াটুকু অমরনাথেরই প্রস্তাব ছিল | আরাধনা প্রথমটা নানান রকম যুক্তি দেখালেও শেষে অমরনাথের কথা কতকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছেন | ঠিক করেছেন বোলপুরের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসবেন আগামী বছরেই |

ভালোয় ভালোয় এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান মিটে গেল। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে তিন মাস পরে | সুমিত্রা অনুরোধ করেছিলেন এই তিন মাস রাজন্যা সেন ভিলাতেই থাকুক। কিন্তু আরাধনা আপত্তি করেছেন।

– ভালো দেখায় না সুমি। ও যেরকম পেইং গেস্ট আছে তেমনই থাক, অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।

অতএব শিবাজী সেনের দিনের শেষে বাড়ি ফিরে রাজন্যাকে দেখার ইচ্ছাটা আপাতত তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখতে হয়েছে।

অফিসের রুটিন চলছে আগের মতোই | ডে ময়েনের প্রজেক্ট এর কাজটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর মাস খানেকের মধ্যেই প্রজেক্টের ফার্স্ট স্টেজ শেষ হয়ে সেকেন্ড স্টেজে পড়বে। সকালবেলায় একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রেখেছিল শিবাজী | মিটিংরুমে ঢুকে সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

– রাজন্যা কোথায়?

সৌম্য একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

– এসে যাবে শিবাজীদা

কিছুক্ষণের মধ্যেই মিটিং রুমের দরজা ঠেলে উঁকি দিল রাজন্যা

– আসবো?

শিবাজী নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো, দশটা চার |

-চার মিনিট লেট, আমি কিন্তু বলেছিলাম আমি লেট হওয়া পছন্দ করি না!

বাকি সকলকে উসখুশ করতে দেখেও পাত্তা দিল না শিবাজী | রাজন্যা শিবাজীর কথায় আমল না দিয়ে ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসলো | শিবাজীর ভ্রু কুঁচকে গেল | ব্যাপার কি?

– ঘড়িটা একটু চেক করলে ভালো হয়
রাজন্যা গলা সরু করে বলে উঠতে শিবাজী নিজের হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো | ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা নড়ছে না মনে হচ্ছে | তারপরেই খেয়াল করল, ডান দিকের ছোট্ট নবটা টেনে ঘড়িটা বন্ধ করে দেওয়া আছে, ঠিক দশটা বেজে চার মিনিটে। মোবাইলের দিকে তাকালো, দশটা বাজতে দুই । খেয়াল হলো সকালে অফিসে আসার পরে ঘড়িটা ডেস্কে খুলে রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছিল চোখে মুখে জল দিতে | সকলে হো হো করে হেসে উঠলো |

শিবাজী নিজের মনে শুধু একটা কথাই বলল – লেজ ছাড়া বাঁদরই বটে!

মিটিং মিছিলে ভরা ব্যস্ত দিন কাটলো | বিকেলবেলা রাজন্যা ব্যাগ গোছানো শুরু করতেই শিবাজী বলে উঠলো,

– একটু দাঁড়িয়ে যাও রাজন্যা, কাজ আছে |

রাজন্যা বেজার গলায় বলল,

– এখন আবার কি কাজ? সব তো করে দিলাম। আমার এখন বাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে।
– প্রজেক্ট শুরুর আগে কে যেন বলেছিল প্রয়োজন পড়লে দেরি অবধি থাকতে আমার কোন অসুবিধা নেই?

রাজন্যা মুখ বেঁকিয়ে আবার বসে পড়ল | একে একে টিমের সকলে চলে গেছে, ঘরের মধ্যে শুধু রাজন্যা আর শিবাজী |

– কি কাজ? শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছেন কেন?

শিবাজী উঠে পড়লো,

– চলো

গাড়িতে উঠে খানিকক্ষণ চলার পরেই রাজন্যা বুঝতে পারল গাড়ি পিজির দিকে যাচ্ছে না

– কোথায় যাচ্ছেন বলুন তো?
– যেখানে যাচ্ছি চুপটি করে আমার সাথে যাবে |

গম্ভীর ভাবলেশহীন গলা শিবাজীর | রাজন্যা একটু ঘাবড়ে গেল, চুপচাপ মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো ঘড়ি বন্ধ করে রাখা ছাড়া আর কিছু করেছিল কিনা আজ। গাড়িটা ক্যাফে মানস সরোবরের বিরাট গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই রাজন্যা সিটে বসেই একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে উঠলো | বিরাট বড় কৃত্রিম লেক এর মাঝখানে এই ক্যাফেটা হয়েছে মাস ছয়েক হলো | অনেকের কাছেই এটার কথা শুনেছে, ফেসবুকে তো অহরহ বিজ্ঞাপন দেখছে। অনেকদিন ধরেই আসার ইচ্ছা ছিল | আড়চোখে রাজন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

– গাড়িতে বসে লাফালাফি করছ কেন?
– আরে এই জায়গাটা তো দারুন! আমার খুব আসার ইচ্ছা ছিল, থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ!

ক্যাফের দোতলায় খোলা টেরেস এলাকায় ধারের দিকে একটা টেবিল বুক করা ছিল ওদের জন্য। সপ্তাহের মাঝখানেও বেশ ভিড়, দু একটা টেবিলে চার পাঁচ জনের বন্ধুদের গ্রুপ আছে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগই জোড়ায় জোড়ায় | রাজন্যার একটু লজ্জা করছিল, অফিসের কেউ যদি দেখে! রাজন্যাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে শিবাজী আস্তে করে ওর হাতের উপর হাত রাখল,

– লজ্জা পাচ্ছো নাকি? তুমি কিন্তু এখন আমার বাগদত্তা, কাজেই কারোকে লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই |

রাজন্যার নাকের ডগাটা অকারণেই লালচে হয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি উত্তর দিল,

– ধ্যুৎ, না না, লজ্জা পাবো কেন ? দেখছিলাম যদি…
– যদি চেনাশোনা কেউ দেখে ফেলে? দেখে যদি ফেলেই, কি বলবে? বসের সাথে প্রেম করছো?

এটাই! ঠিক এইটাই! এই কথাটাই মাথায় ঘুরছিল | ঠোঁটের ডগায় সব প্রশ্নের জবাব তৈরি থাকে যে মেয়ের সে কেমন যেন চুপ করে দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে মাথা নিচু করলো | শিবাজী এবারে নিজের দুই হাতের মুঠোয় বন্দি করে নিল রাজন্যার নরম তুলতুলে ডান হাত খানা, তারপর মুঠো শুদ্ধ তুলে এনে ঠোঁটে ছোঁয়ালো | রাজন্যা কেঁপে উঠল তিরতির করে। হাতটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারল না |

ইতিমধ্যেই ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছে সামনে | শিবাজী কোল্ড কফি আর স্যান্ডউইচার অর্ডারও দিয়ে দিয়েছে | রাজন্যার হাত এখনো শিবাজীর দখলে |

– কয়েকটা কথা বলার ছিল…

মিনিট কয়েকের নীরবতা ভেঙে শিবাজীই প্রথম বলল | চকিতে চোখ তুলল রাজন্যা |এতক্ষণ যেরকম লঘুস্বরে কথাবার্তা হচ্ছিল, এখনকার কথার সুর একটু যেন অন্যরকম।

– দ্যাখো, এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে মানে যে বিয়েটা করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আমাদের সম্পর্কের মাঝে একটা জটিলতা আছে, তা তো তুমি জানোই | এ নিয়ে তোমার মনের মধ্যে যদি কোন সংশয় থেকে থাকে তাহলে কিন্তু এখনো সময় আছে |

রাজন্যা খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো শিবাজীর দিকে, তারপর কোন উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল | শিবাজী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর ফের জিজ্ঞাসা করল,

– আমি কিন্তু খুব সিরিয়াসলি প্রশ্নটা করছি রাজন্যা | লীগালি কোন সমস্যা না থাকলেও একটা সোশ্যাল ট্যাবুর ব্যাপার থেকেই যায় | আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের মাঝে কোন প্রশ্ন চিহ্ন, কোন সংশয়, কোন ‘হয়তো’, ‘কিন্তু’, ‘যদি’ থাকুক | যদি দুজনে একসাথে নিঃসংকোচে পা বাড়াতে পারি, তবেই বাড়াবো। নচেৎ নয় |

শিবাজীর কথা বলার সময়টাতেও রাজন্যা অন্যদিকেই তাকিয়েছিল | কথা শেষ হতেই সজোরে নিজের হাতটা টেনে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,

– ফাজলামি হচ্ছে?

আশেপাশের টেবিল থেকে দু একজন ঘুরে তাকালো | শিবাজী অপ্রস্তুতভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাজন্যাকে বলল,

– কি হচ্ছে! আস্তে কথা বলো |

রাজন্যা গলার স্বর এতটুকুও না নামিয়ে বলল,

– কোনো আস্তে কথা টথা হবে না। আমাকে কি তিতলির বয়সী মনে হয় আপনার, যে আবেগের বসে কিছু একটা করে ফেলবো অগ্রপশ্চাত না ভেবে? আমি যদি নিজের মনের কাছে ক্লিয়ার না হতাম তাহলে এত দূর এগোতাম? যে জটিলতার কথা বলছেন সেটা আপনি যেদিন জেনেছেন আমিও তো সেই দিনই জেনেছি। কি বলতে চাইছেন, আপনি নিজের কাছে পুরোপুরি ক্লিয়ার আর আমি ক্লিয়ার নই? আপনি এই নিয়ে মনের মধ্যে প্রচুর চিন্তা ভাবনা করেছেন, করে নিশ্চিত হয়েছেন আপনার কোন কনফিউশন নেই | আর আমি কোন কিছু চিন্তা না করেই নাচতে নাচতে আপনার সাথে এনগেজমেন্ট করেছি? আমার বাবা মা যে এই বুড়ো বয়সে এসে ডিভোর্সের মতন একটা সিদ্ধান্ত নিল, জাস্ট ফর আস, সেটার গুরুত্ব বোঝেন আপনি? শালা এরকম গান্ডুর মতন কথা বললে না রাম ক্যালানি দিতে ইচ্ছা হয়…

কথাটা বলেই রাজন্যা দুই হাতে নিজের মুখ চাপা দিল, দুই চোখ বড় বড় | পাশের টেবিলের ছেলেমেয়ে দুটি ফিকফিক করে হেসে ফেলল | কথা বলতে বলতে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে ছিল রাজন্যা । এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আস্তে আস্তে বসে পড়ল আবার | শিবাজী দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে |

ভগবান! এই মেয়েকে নিয়ে কি করবে!!

এর মধ্যেই ওয়েটার এসে ওদের কোল্ড কফি দুটো দিয়ে গেল | রাজন্যা চুপচাপ নিজের গ্লাসটা টেনে নিয়ে সুরুত করে স্ট্র দিয়ে এক টান দিয়ে কাঁচুমাচু মুখে বলল,

– ভেরি সরি। ভেরি সরি শিবাজী দা |

শিবাজী মাথা তুলল। হতাশ গলায় বলল,

– তুমি কি আমাকে শিবাজীদা বলেই ডাকবে?
– না মানে ইয়ে অভ্যাস হতে সময় লাগবে | আর গান্ডু বলার জন্য সরি, বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে, বাট আশা করি বুঝতে পেরেছেন কি বলতে চাইছি?

শিবাজী দুই হাত জড়ো করলো,

– হ্যাঁ বুঝে গেছি | এর থেকে আর প্রাঞ্জল করে বলার দরকার নেই।

ওয়েটারটি স্যান্ডউইচ এর প্লেট নিয়ে ফেরত এলো | ওদের টেবিলে দিতে দিতে বলল,

– আর কিছু লাগবে স্যার? ম্যাডাম?

শিবাজী দুই দিকে মাথা নাড়ল,

– না, আপাতত না |

কোল্ড কফিটা খুব ভালো | রাজন্যা অলরেডি অর্ধেক শেষ করে ফেলেছে, স্যান্ডউইচের প্লেটটা টানতেই শিবাজী বলল,

– আরো একটা কথা…
– আরো একটা!

রাজন্যা বেজার মুখে স্যান্ডউইচ নামিয়ে রাখল।

– বলেই ফেলুন। মেজাজ গরম হয়ে গেলে খাওয়াটা নষ্ট হয়ে যাবে আমার।

শিবাজী মুচকি হাসলো, তারপরে বলল,

– এ কথাটায় তোমার রেগে যেতে হবে না মনে হয়। আমার বক্তব্য হলো সমর্পিতা শাস্তি পেয়েছে ভালো কথা। কিন্তু এভাবে ওর ন্যুড ফটো ভাইরাল করাটা মনে হয় ঠিক হয়নি। ও যেমনই হোক, তুমি তো অমন নও!

– আরে শিবাজীদা, সরি সরি শিবাজী | এই একটা কথা আমিও আপনার সাথে আলোচনা করব ভাবছিলাম | আমি কিন্তু সমর্পিতার ন্যুড ফটো ভাইরাল করিনি | হ্যাঁ, আমি একটা হ্যাকিং অ্যাপ ইন্সটল করে দিয়ে এসেছিলাম যাতে করে ওর ওয়েব ক্যামেরাটায় ফটো আর ভিডিও অটোমেটিক রেকর্ড হবে এবং উইদআউট ড্রেস ফিল্টার দিয়ে। কিন্তু সেগুলো অটোমেটিক্যালি ইন্টারনেটে আপলোড করার জন্য আমি কিছু করিনি | আমি ভেবেছিলাম পরে একদিন চেকআপ করতে যাওয়ার বাহানায় ওই ফটোগুলো সরিয়ে নিয়ে আসব এবং সেটা দিয়ে ওকে চাপ দিয়ে তিতলির কাস্টডির কেসটা বন্ধ করাবো। কিন্তু তার আগেই দেখলাম ওইসব ভিডিও ইন্টারনেটে পোস্ট হয়ে গেছে এবং মজার কথা হচ্ছে আপলোড হয়েছে সমর্পিতার একাউন্ট থেকেই | তার মানে আরো একজন কেউ আছে যে সমর্পিতার ল্যাপটপ হ্যাক করেছে | মহিলার শত্রুর অভাব নেই দেখছি |

শিবাজী ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো | রাজন্যা যে মিথ্যে বলবে না এটুকু সম্বন্ধে ও নিশ্চিত | কিন্তু তাহলে সমর্পিতার ছবিগুলো কে আপলোড করল? কয়েক মুহূর্ত পরেই জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল শিবাজী | যাক গে, সমর্পিতার জীবন, সমর্পিতার সমস্যা সমর্পিতাই বুঝুক | ওই এপিসোড আর নিজের জীবনে টানার প্রয়োজন নেই | সমাদৃতার সাথে কথা বলার পরে একবার তো ভেবেছিল সৌভিকের অ্যাক্সিডেন্টের কেসটা রি-ওপেন করাবে, কিন্তু পুরনো বিবর্ণতা আর ঘাঁটবে না বলেই না সেই পথে পা বাড়ায়নি। সৌভিকের ছবির সামনে গিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল

– দা’ভাই তোর অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারলাম না | কিন্তু আমি জানি তুইও হয়তো এই ঝঞ্ঝাটে যেতে চাইতিস না |

রাজন্যার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শিবাজী বলল,

– ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম | তবে যে কাজটা করেছ সেটা খুব রিস্কি ছিল। ভবিষ্যতে প্লিজ আর এরকম কিছু কোরো না |

রাজন্যা স্যালুটের ভঙ্গিতে হাত কপালে ঠেকিয় বলল,

– ইয়েস বস!

দুজনেই হেসে ফেলল |

– আমার মুখোমুখি বসতে ভালো লাগছে না, পাশের চেয়ারে বসি?

রাজন্যার আদুরে বিড়ালের ভঙ্গিতে করা প্রশ্নের উত্তরে শিবাজী প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো,

– চলে এসো

চেয়ার থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে শিবাজীর পাশের চেয়ারে বসল রাজন্যা। বাঁ হাত দিয়ে ছোটখাটো মানুষটাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল শিবাজী। রাজন্যা নিজের গ্লাসের কোল্ড কফিটুকু শিবাজীর অর্ধেক খালি গ্লাসে ঢেলে নিজের স্ট্র-টাও এই গ্লাসে ডুবিয়ে দিল। শিবাজী চোখ গোল গোল করে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছিল। রাজন্যা স্ট্র মুখে পুরে ভালো মানুষের মতন ঘাড় উঁচু করে ওর দিকে তাকাতে হেসেই ফেলল | অন্য স্ট্র টা নিজের মুখে পুরে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পাগলি মেয়েটাকে। মুখের ভিতর কোল্ড কফির স্বাদ নিয়ে লেকের জলের ওপর আশেপাশের বিল্ডিংয়ের আলোর প্রতিফলন দেখতে দেখতে আসন্ন ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে ডুবে গেল দুইজনে।

রাজন্যা শিবাজীর গল্প এখানেই শেষ নয় | ওদের একসঙ্গে পথ চলা আরো বাকি আছে। পুরোটাই হয়তো এখনকার মতন সহজ সুন্দর হবে না, হয়তো সমর্পিতা তার বিষাক্ত কোন তীর নিয়ে আঘাত হানবে ওদের সুখী সংসারের দিকে | সমর্পিতার অজানা শত্রু শিবাজী বা রাজন্যার জীবনে উঁকি মারতে আসবে হয়তো | কিংবা হয়তো তার কিছুই হবে না | এমনই মিষ্টি মধুর দাম্পত্যের গল্প আমাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলবে | আবার আগামী বছরের মাঝামাঝি ফিরব ওদের দুজনকে নিয়ে | ততদিন বরং ওরা একটু প্রেম করুক নিশ্চিন্তে |

আমাকে ভালবাসতে হবে না,
ভালবাসি বলতে হবে না.
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ নিয়ে
আমার ঠোঁটদুটো ছুয়ে দিতে হবে না.
কিংবা আমার জন্য রাতজাগা পাখিও হতে হবে না.
অন্য সবার মত আমার সাথে রুটিন মেনে দেখাকরতে হবে না.
কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও খেতে হবে না.
এত অসীম সংখ্যক “না”এর ভিড়ে
শুধু মাত্র একটা কাজকরতে হবে
আমি যখন প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব
তুমি প্রতিবারএকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটুখানি আদর মাখা গলায় বলবে “পাগলি”

(হেলাল হাফিজ)

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে