#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২৮)
নিজের ঘরের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদলো রাজন্যা। কিছুক্ষণ আগের সুন্দর মুহূর্তটা যে এভাবে বদলে যেতে পারে, তা তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু ঠিক কি যে হল সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না | কেউ তার মায়ের সম্বন্ধে কিছু বলল শিবাজীদাকে | কিন্তু মায়ের ছবি দেখে শিবাজীদার প্রতিক্রিয়া ওরকম হলো কেন?
খানিকক্ষণ বাদে চোখ মুছে উঠে বসল রাজন্যা। আরো একবার আরাধনার নম্বরে ফোন করার চেষ্টা করল, এবারেও রিং হয়ে গেল | বাবার কোন নিজস্ব নম্বর নেই। আর তপু এখন স্কুলে | হতাশায় নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ রাজন্যার মনে পড়ল আসার আগে মায়ের দেওয়া সেই নম্বরটার কথা। খুব দরকার না হলে ফোন করতে বারণ করেছিলেন আরাধনা | কিন্তু এই মুহূর্তে রাজন্যার খুব দরকার এমন কারো সাথে কথা বলা যিনি আরাধনাকে চেনেন | ব্যাগ হাতড়ে ফোন নম্বরটা বের করল। তারপরেই কাঁপা কাঁপা হাতে রিং করল।
ওদিক থেকে হ্যালো শব্দটা ভেসে আসতেই রাজন্যা একটু ঘাবড়ে গেল | কি বলবে? কাকে ফোন করেছে তার নামটা পর্যন্ত জানে না। এদিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ওদিকের মহিলা কন্ঠটি বার দুয়েক হ্যালো হ্যালো করে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন,
– কারা যে এসব ফাঁকা কল করে!
রাজন্যা একটু মনের জোর পেয়ে বলে উঠলো,
– আমাকে এই ফোন নম্বরটা আমার মা আরাধনা সান্যাল দিয়েছেন।
ওদিকের মহিলা কন্ঠ বললেন,
– কে দিয়েছে?
– আরাধনা সান্যাল…
– সে কে?
– আমার মা | বলেছিলেন, খুব দরকার হলে এই নম্বরে ফোন করতে |
মহিলা বললেন,
– একটু ধরো…
কিছুক্ষণ পরে এক বৃদ্ধের গলা ভেসে এলো,
– হ্যালো!
কি বলবে বুঝতে না পেরে আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করল রাজন্যা।
– আমাকে এই নম্বরটা আমার মা আরাধনা সান্যাল দিয়েছেন। বলেছিলেন খুব দরকার পড়লে ফোন করতে।
– খুব দরকার পড়েছে কি?
– হ্যাঁ, আমি একটু বলতে পারি আমার সমস্যাটা কি?
– হ্যাঁ বলো
রাজন্যা সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিল | কি কারনে এদেশে এসেছে তা বলল, তার সাথে যে শিবাজী সেন আছেন তাও বললো | শিবাজী সেনের সাথে তার অফিসের পরিচয় ছাড়াও শিবাজী সেনের মেয়েকে সে পড়ায় এবং বর্তমানে তাদের দুজনের মধ্যে একটি হালকা অনুরাগের সম্পর্ক হয়েছে সেটাও বাদ দিল না | ওই পারে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি ধৈর্য সহকারে সমস্তটা শুনছেন | রাজন্যা বলল,
-সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ শিবাজীদার ফোনে কেউ একটা ফোন করে আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু একটা বলেছে। মায়ের ছবি দেখেই শিবাজীদা হঠাৎ অদ্ভুত ব্যবহার করা শুরু করেছে। আমার সঙ্গে কথা বলছে না, আমার মুখ দেখতে চাইছে না। আজ আমাদের দেশে ফিরে যাওয়ার দিন। কিন্তু কি হলো সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না | মাকেও ফোনে পাচ্ছি না | মনে হল আপনি মায়ের পরিচিত। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে ফোন করলাম | আমি জানি আপনি শিকাগোতে থাকেন, হয়তো সেভাবে কিছু সাহায্য করতে পারবেন না | কিন্তু আমাকে এমন কোন তথ্য দিতে পারেন যা দিয়ে আমি বুঝতে পারি শিবাজী দা কেন আমার সাথে এই ব্যবহার করছে? হয়তো খুব বোকা বোকা অনুরোধ করছি, কিন্তু আমার কাছে এই একটাই অপশন ছিল এই মুহূর্তে।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পরে বৃদ্ধ বললেন,
– ফোন স্পিকারে দিয়ে শিবাজীর কাছে দাও
– শিবাজী দা দরজা খুলছে না তো
– বলো ফোনে প্রতীক লাহিড়ী আছেন। তাহলে খুলবে।
রাজন্যা কিছুই বুঝল না। কে প্রতীক লাহিড়ী? তাকে শিবাজী দা চিনবে? এমন একজন যাকে তার মা চেনেন আবার শিবাজী ও চেনে! অথচ রাজন্যা চেনে না! কিন্তু এই মুহূর্তে অবাক হওয়ার সময় নেই | ফোন স্পিকারে দিয়ে আবার শিবাজীর অ্যাপার্টমেন্টে ধাক্কা দিল
– শিবাজী দা, দরজা খোলো, একটু কথা বলো এনার সাথে
শিবাজী ভিতর থেকে বিরক্ত কন্ঠে উত্তর দিল,
– রাজন্যা জেদের একটা সীমা থাকে। তোমাকে বহুবার বলেছি, নিজের ঘরে ফেরত যাও
– চলে যাব শিবাজী দা, একটা মিনিট কথা বলো, প্রতীক লাহিড়ী ফোনে আছেন।
শিবাজীর চমকে উঠল | প্রতীক লাহিড়ী! তার দাদু!
উদভ্রান্তের মতন দরজা খুলল |
– উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছো? তোমরা সব মেয়েরা সমান! আমিই গাধা, বারবার বোকা বনেও আমার বোধ বুদ্ধি জাগ্রত হয় না!
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বৃদ্ধের শান্ত গলা শোনা গেল,
– বুবাই, মেয়েটিকে উল্টোপাল্টা কথা বলো না | ও কিছুই জানে না। আর ও রমলার নিজের সন্তানও নয়। রমলা ওর সৎ মা |
শিবাজী রাজন্যার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল ফোনটা | স্পিকার বন্ধ না করেই উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল,
– কে আপনি? আমার দাদুর নাম নিয়ে আমাকে উল্টাপাল্টা বোঝানোর চেষ্টা করছেন! কি জানেন আপনি?
একই রকম শান্ত স্বরে উত্তর ভেসে এলো,
– তুমি কি একটু ধৈর্য ধরে আমার কয়েকটা কথা শুনবে বুবাই? চাইলে তুমি ভিডিও কল করতে পারো | প্রচুর বয়স হয়েছে আমার, চোখমুখে, শরীরে বয়সের ছাপও পড়েছে | কিন্তু যদি পুরনো অ্যালবামে আমার ছবি দেখে থাকো আশা করি চিনতে পারবে |
অবিশ্বাসের মধ্যেও এক চিলতে আশার আলো | যে মেয়েটিকে খানিক আগেই নিজের সারা জীবনের সঙ্গী করার অঙ্গীকার নিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরেছিল, সে শিবাজীর মায়েরই আরেক সন্তান এ কথা মস্তিষ্কে আঘাত করার সাথে সাথে শিবাজী নতুন করে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়েছিল | ছোটবেলা থেকে আলাদা করে কেউ রমলার সম্বন্ধে খারাপ কথা ওর সামনে বলেনি, সুমিত্রা তো নয়ই, শিবনাথও না | কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে মায়ের প্রতি এক তীব্র অভিমান জন্ম নিয়েছিল শিবাজীর মনের মধ্যে | সমর্পিতার ঘটনার পরে সেই অভিমান শুধুমাত্র মা বা স্ত্রীতে সীমাবদ্ধ না থেকে সমস্ত নারী জাতির প্রতি ঘৃণার আকার ধারণ করেছিল |
রাজন্যা শিবাজীর জীবনে এসেছে এক ঝলক খুশির হওয়ার মতন, আর এসেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শিবাজীর মনের মধ্যে এতদিন ধরে গড়ে ওঠা বিদ্বেষের পাঁচিলটাকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। কিন্তু এই ছটফটে দমকা হাওয়া কি শুধু তার চারিদিকে বানিয়ে রাখা কাঠিন্যের পাঁচিলটাকেই ভাঙবে না, তার সাথে আবার করে তার জীবনটাকেও ভেঙ্গেচুরে এলোমেলো করে দেবে? এত বছর ধরে মেয়েদেরকে অ্যাভয়েড করে করে এসেও শেষ পর্যন্ত এই মেয়েই কি করে পৌঁছে গেল ওর মনের কাছাকাছি? তাহলে কি সেনভিলায় কোন রকমে পুনঃপ্রবেশ করার জন্য রমলা সেনের এ আর এক চাল? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে দুলতে ফোন কেটে ভিডিও কল করলো শিবাজী |
ফোনের অপরপ্রান্তে বিছানায় অর্ধশয়ান বৃদ্ধের মুখে প্রশান্তির হাসি | মাথায় অল্প কয়েকটা সাদা চুল, শীর্ণকায় চেহারা, তবু চোখ আর ঠোটের হাসিতে চেনা যায় | শুধু বাড়ির পুরোনো অ্যালবামেই নয়, স্বস্তিকের অফিসে একাধিক জায়গায় দাদু এবং ঠাকুরদার বাঁধানো ছবি আছে | শিবাজী অস্ফূটে বলে ওঠে,
– দাদু…
প্রতীক লাহিড়ী স্মিত হাসলেন, তারপর বললেন,
– রমলা যা করেছিল সেটা ভুল নয়, অন্যায় | তাই ওর দোষকে আমি ধামাচাপা দিতে চাইবো না | কিন্তু অনুতাপের আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে জীবনে ফিরেছে আমার মেয়েটা | সিনেমা জগতে রমলা সেন নাম অচল, তাই নাম নিয়েছিল আরাধনা | নতুন জীবনে এফিডেভিট করে আরাধনা নামেই ওর পরিচয় | কলকাতা ছেড়ে যাবার পরে দুর্গাপুরে বাড়ি কিনে সেখানেই সেটেল করব ভেবেছিলাম | রমলা মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগছিল, ওর চিকিৎসাও চলছিল | খানিকটা স্বাভাবিক হবার পরে ওখানেই একটা এনজিওতে পার্ট টাইম কাজ করা শুরু করেছিল অবসাদ ভুলে থাকার জন্য। প্রায় দশ এগারো বছর পরে যখন নতুন করে জীবন সঙ্গীর খোঁজ পেল, তখন আমার কাছ থেকে আমার পরিচয় বা পয়সাকড়ি কিছুই আর নিতে চায়নি | সম্পূর্ণরূপে নিজের দায়িত্বে সংসার শুরু করেছিল | আমি এদেশে চলে আসার পরেও খোঁজখবর রেখেছিলাম, নিয়মিত না হলেও যোগাযোগ আছে | এই মেয়েটি রমলার নিজের সন্তান নয়। তুমি যা ভাবছো তা ভুল |
ঘন্টা পাঁচেক পরে | শিবাজী আর রাজন্যা শিকাগো এয়ারপোর্টে বসে আছে, দিল্লির ফ্লাইট এর অপেক্ষায়। শিবাজীর এক হাতে রাজন্যার একটা হাত ধরা | দুজনের কেউই কোন কথা বলছে না | প্রতীক লাহিড়ীর সাথে কথা বলার পরে শিবাজী অন্তত পঞ্চাশ বার রাজন্যার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটাকে ওইভাবে ভেঙে পড়তে দেখে রাজন্যা নিজেও কেঁদে ফেলেছে | দুই হাতে শিবাজীকে জড়িয়ে ধরে বারবার একটাই কথা বলেছে,
– আমি কিছু মনে করিনি, আমি কিচ্ছু মনে করিনি শিবাজী দা | তোমার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ আমার, একটু বিশ্বাস করো আমাকে। অন্যের কথা কানে নেওয়ার আগে আমার কথাটুকু শুনো |
– তোমাকে দ্বিতীয়বার অবিশ্বাস করার আগে যেন আমার প্রাণ চলে যায়…
রাজন্যা চমকে উঠে একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেলেছে | ঠাস করে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছে শিবাজীর গালে | তারপর কান্নাবোজা গলায় বলেছে,
– এই ধরনের নাটুকে বাজে কথা বললে পরের দিনই আমি চলে যাব।
শিবাজী নিজের গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছে,
– বসকে থাপ্পড় মারলে!
রাজন্যা নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা চার অক্ষরের গালি দিয়েছে শিবাজীর মুখের উপরেই আর তারপরেই শিবাজীর মুখের অবস্থা দেখে খিল খিল করে হেসে লুটিয়ে পড়েছে শিবাজির বুকের মধ্যে।
শিবাজীর দাদু প্রতীক লাহিড়ী হাড়ের এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন দীর্ঘদিন আগেই | দেশে তার কোন চিকিৎসা নেই, চিকিৎসা করতে পাকাপাকি ভাবে আমেরিকায় যেতে হবে। রমলার মা তখন জীবিত। মা এবং বাবাকে বিদেশে রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন রমলা। ততদিনে তার আলাপ হয়েছে অমরনাথের সাথে। সহজ সরল আলাপি মানুষটাকে ভালো লেগে গেছিল রমলার | পরিবারের আর কেউ নেই এই পরিচয়ে অমরনাথের সাথে ঘর বেঁধেছিলেন রমলা। প্রতীক লাহিড়ী বরাবরই মেয়ের খোঁজ রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাবার থেকে কোন অর্থ সাহায্য নিতে চায় নি মেয়ে । অমরনাথের আগের পক্ষের সন্তান রাজন্যাকে কোলে তুলে নিলেও প্রতিবেশী এবং আত্মীয়াদের ব্যবহারে বুঝে গেছিলেন মেয়ের কানে সৎ মায়ের বিরুদ্ধে বিষ ঢালার লোকের অভাব হবে না | তাই দায়িত্ব পালন করে চললেও কখনো অতিরিক্ত স্নেহ প্রদর্শন করেননি। শুরু থেকেই রাজন্যার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে | মেয়ে বলে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। পরিবারের লাইয়াবিলিটি নয় অ্যাসেট হিসাবে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে।
সেই পরিবর্তিত আরাধনা সান্যাল এর মেয়ে রাজন্যা সান্যাল | বুদ্ধিমতী, স্বাধীনচেতা, একটু খামখেয়ালি কিন্তু স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী | এমন মেয়ের সাথেই বোধহয় শিবাজীর এলোমেলো, রুখা সুখা জীবনটার বাঁধা পড়ার ছিল।
রাজন্যার হাতে একটু চাপ দিয়ে শিবাজী বলল,
– আচ্ছা, তুমি কি আমাকে শিবাজীদা বলেই ডাকবে?
রাজন্যা ভালোমানুষের মতন মুখ করে বলল,
– তিতলি যদি আমাকে সিস্টার ডাকে তাহলে আইডিয়ালি আমার আপনাকে বাবা বলা উচিত। আবার মুশকিল হল, আমার মা এবং আপনার মা এক | সেই অর্থে আপনি আমার দাদা। দুটো মিলিয়ে বাদা বলে ডাকবো কি?
– তুমি একটি অত্যন্ত বিচ্ছু মেয়ে!
এক হাতে রাজন্যার কাঁধ জাপটে ধরে এয়ারপোর্টের মধ্যেই ওর ঠোঁটে একটা জোরালো চুমু এঁকে দিল শিবাজী |
সাত দিনের প্ল্যান নিয়ে কলকাতায় এলেও পনের দিন কেটে যাওয়ার পরেও ফেরা হয়নি সমর্পিতার | নিজের বাবা যে এভাবে আইনি ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দেবে তা সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। সেদিন সেনভিলায় ঘটনাটা যে ও বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি সমর্পিতা। ওর পাঠানো চিঠির প্রত্যুত্তরে এই ভিডিও রেকর্ডিং সমেত একটা লিগাল নোটিশ গেছে সমর্পিতার নামে। সেখানে সরাসরি সাক্ষী হিসেবে সুমিত্রা এবং কৈলাস তো আছেই, পুরোনো দিনের ঘটনার সাক্ষী দিতে হলে যে সমর্পিতা মল্লিকের মা বাবা এবং বোনও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে সেটাও স্পষ্ট ভাবে লেখা ছিল। নোটিশের বয়ানে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের সাথে এও লেখা ছিল যে সমর্পিতা মল্লিক শুধুমাত্র পাঁচ বছর আগে নিজের সন্তানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলেন তাই নয়, তিনি এখনো একটি শিশু কন্যার দায়িত্ব নিতে অক্ষম। তাঁর মধ্যে মাতৃত্বসুলভ কোন কোমলতা নেই।
রাগে গর গর করতে করতে বহু বছর পরে আবার ওই বাড়িতে পা রেখেছিল সমর্পিতা। ভেবেছিল আর কেউ না হোক মা অন্তত ওকে আগের মতোই খাতির যত্ন করবে | কিন্তু মাধবীও ওকে দেখে অত্যন্ত শুকনো গলায় বলেছিলেন,
– কি ব্যাপার, কি মনে করে?
– কেন, আমার বাড়িতে আমি আসতে পারি না?
– তোমার বাড়ি? এ বাড়ি তো তোমার নয়…
পাশ থেকে উত্তর দিয়েছিলেন সত্যেন।
– মানে! আমি এই বাড়ির মেয়ে। যেকোনো সময় আমি এই বাড়িতে আসতে পারি!
– না পারো না | তোমাকে আমি ত্যাজ্য কন্যা ঘোষণা করেছি | তাও রীতিমতো লীগ্যালি, দিল্লিতে ফিরে তোমার এডভাইজারের কাছ থেকে জেনে নিও।
বোনের কাছ থেকে খানিক সহানুভূতির আশা করলেও লাভ হয়নি। সমাদৃতা শীতল স্বরে বলেছিল,
– আমার সব মনে পড়ে গেছে দিদিয়া | এই মুহূর্তে আমার কাছে কোন পাকা প্রমাণ নেই ঠিকই। কিন্তু আমি জানি ওই অ্যাক্সিডেন্টটা তুই করিয়েছিলি। তোর জন্যই সৌভিকদা অসময়ে মারা গেছে, তোর জন্যই আমি এত বছর ধরে হুইল চেয়ারে বন্দী, তোর জন্যই তিতলির শরীরে একটা পার্মানেন্ট ক্ষতচিহ্ন হয়ে গেছে।
সমর্পিতার যে কোথাও থেকেই কোন ধরনের টাকা পাবার আশা নেই সে কথাটা সায়ন যেন কিভাবে জানতে পেরে আশেপাশে মহলে রটিয়ে দিয়েছে | তার ফলে বেশ কয়েকবার ভাটিয়াকে ফোন করেও কোনরকম আশানুরূপ উত্তর পায়নি সমর্পিতা। আর এক প্রডিউসার মনোজ মালিককে ফোন করতে তার সেক্রেটারি মুখের উপরে বলে দিয়েছে
আপনি যেসব আইনি ঝামেলায় ফেঁসে গেছেন ম্যাডাম, আমরা আপনার সাথে এই মুহূর্তে কাজ করতে চাই না।
আপাতত কলকাতায় থাকার মেয়াদ কয়েক মাস বাড়াতে হয়েছে | কয়েকটা ছোটখাটো ফ্যাশন শো এর কাজ আছে, আর একটা বাংলা ওয়েব সিরিজের জন্য মুখ্য চরিত্রে অডিশন দেওয়ার আছে. | এতগুলো দিন হোটেলের টাকা গোনাটা খরচ সাপেক্ষ হবে বলে একটা এয়ারবিএনবি ভাড়া করেছে | বালিগঞ্জ এলাকায় সাজানো গোছানো দুই কামরার ফ্ল্যাট | আপাতত এখানেই রয়েছে। মুশকিল হল গতকাল থেকে এদের ইন্টারনেট কানেকশনে একটা সমস্যা হচ্ছে | খবর দিয়েছিল কালকেই, কিন্তু এখনো লোক আসেনি, বিরক্তভাবে এআর বিএনবির হোস্টকে আরো একবার ফোন করতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ বেল বেজে উঠলো | দরজা খুলতে দেখল একটি অল্প বয়সী মেয়ে, পরনে চেক চেক শার্ট, একটা ঢিলা প্যান্ট, মাথায় একটা ক্যাপ |
– কি চাই?
বিরক্ত গলায় বলল
– ম্যাডাম, আপনি ইন্টারনেটের কি কমপ্লেন করেছিলেন?
– তুমি ইন্টারনেট ঠিক করবে?
সমর্পিতার গলায় অবিশ্বাস |
– কেন ম্যাডাম?
মেয়েটি অবাক হওয়া গলায় জিজ্ঞাসা করল |সমর্পিতা কাঁধ ঝাঁকালো,
– না, মানে, মেয়েরা সাধারণত এইসব করে না তো!
মেয়েটি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
– কি যে বলেন ম্যাডাম! মেয়েরা পারে না এরম কোন কাজ আছে নাকি? কোথায়, আপনার রাউটার টা কোথায় দেখি?
সমর্পিতা রাউটার টা দেখিয়ে দিয়ে বলল,
– তোমার কাজ করতে কতক্ষণ লাগবে?
– আধঘন্টা চল্লিশ মিনিটে হয়ে যাওয়া উচিত
– ঠিক আছে, আমি বাথরুমে আছি। কিছু দরকার লাগলে বল
– কিছু লাগবে না ম্যাডাম।
মেয়েটি ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে রাউটার সারাতে বসল |
সন্ধ্যার পর থেকে নেট দুনিয়া তোলপাড় | প্রখ্যাত মডেল এবং অভিনেত্রী স্যামি মল্লিকের ন্যুড ছবি ভাইরাল। নিজের ঘরে ন্যুড অবস্থায় হেটে আসছেন স্যামি মল্লিক, চুল আঁচড়াচ্ছেন, বডি লোশন লাগাচ্ছেন, প্রসাধন করছেন | শরীরের কোথাও একটি সুতো নেই | সাইবার ক্রাইম সেলে কমপ্লেন করার আগেই লাখ লাখ ডাউনলোড এবং শেয়ার | জানা গেছে কোন তৃতীয় ব্যক্তি নয়, সমর্পিতা মল্লিকের বাড়ির ল্যাপটপ থেকেই শেয়ার করা হয়েছে এই সমস্ত ভিডিও | প্রশ্ন উঠে আসছে এটা কি আদৌ কোন ধরনের হ্যাকিংয়ের ফল নাকি মার্কেট রেট বাড়ানোর জন্য স্যামি মল্লিকের নতুন চাল?
– আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ম্যাডাম? এভাবে নুড ফটোগ্রাফ আপলোড করে দিয়েছেন! ইন্টারনেটে আপনি যদি এই সমস্ত কান্ড কারখানা করেন আর এক্সপেক্ট করেন আমি এসব সামাল দেব দেন আই এম সরি ম্যাডাম, পারলাম না!
তমালিকার ক্রুদ্ধ কণ্ঠের উত্তরে কিছুই বলে উঠতে পারছে না সমর্পিতা। যে ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়েছে সেগুলো ও নিজেও দেখেছে | ভিডিওর মানুষটা ও নিজেই এবং ভিডিওগুলো আজকেরই | কিন্তু ও তো নগ্ন অবস্থায় ছিল না! বাথরুম থেকে রীতিমতো গায়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়েছিল | চুল আঁচড়ানো, ক্রিম মাখা কোন সময়ই নিরাবরণ ছিল না। তাহলে ভিডিও থেকে কোন জাদু বলে ওর পোশাকটা হাওয়া হয়ে গেল!
দ্বৈপায়নের সাথে ফোনে কথা বলছিল শিবাজী,
– হ্যাঁরে সমর্পিতার কি মাথাটা গেছে? লোকে তো বলছে ভিডিওগুলো ওর ল্যাপটপ থেকেই আপলোড হয়েছে।
শিবাজী গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ালো।
– জানিনা। আই জাস্ট হোপ, আমার সাথে জড়িয়ে কোন ধরনের প্রচার না হয়। আমি চাই না তিতলির উপরে সমর্পিতার বিন্দুমাত্র কোন ছায়াও পড়ে।
– আশা করা যায় পড়বে না! অনেক বছর হয়ে গেছে সমর্পিতাও কোথাও কোন জায়গায় তোদের সাথে ওর সম্পর্কের কথা এত বছর যাবত প্রকাশ করেনি। লোকে মনে হয় ভুলেই গেছে যে ও একসময় বিয়ে করেছিল।
– ভুলে গেলেই মঙ্গল
– সমর্পিতার একটা ইন্টারভিউতে দেখলাম ও বলেছে আজ নাকি কোন এক মেকানিক ওর বাড়িতে গেছিল রাউটার ঠিক করতে | ও সন্দেহ করছে কাজ সেই মেকানিকের |
শিবাজী উদাস গলায় বলল,
– হতেই পারে | আজকাল কত রকমের সিস্টেম হ্যাকিংয়ের মেথড বেরিয়েছে।
দ্বৈপায়ন হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
– ও বাই দা ওয়ে আমাদের টিম থেকে এবার হ্যাকাথনের বেস্ট প্রাইজ আসছে।
শিবাজী উৎসাহী হয়ে উঠলো,
-তাই নাকি? কে পাচ্ছে রে?
-কে আবার? তোর ফেভারিট, রাজন্যা সান্যাল…
শিবাজী অবাক |
– ও মেয়ের এসব গুনও আছে নাকি?
– তাই তো দেখছি।
ফোন রেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার নিউজ চ্যানেলটা চালালো শিবাজী | সব জায়গাতেই স্যামি মল্লিকের খবর | দেখল সমর্পিতা বেশ ক্ষুব্ধভাবে বলছে,
– আমি আপনাদের বলছি ওই মেকানিকেরই কাজ আমার রাউটার খারাপ হয়েছিল তার জন্য খবর দিয়েছিলাম
রিপোর্টার জিজ্ঞাসা করলেন,
– মেকানিকের নাম কি দিতে পারবেন? কেমন দেখতে বর্ণনা দিতে পারবেন?
সমর্পিতা বিরক্ত ভাবে বলল,
– মেকানিকের নাম আমি কি করে জানবো? জিজ্ঞাসা করেছি নাকি? তবে হ্যাঁ, একটি মেয়ে ছিল | মাঝারি উচ্চতা, কোঁকড়া চুল, গায়ের রং ফর্সা | চেক চেক শার্ট আর ঢিলা ট্রাউজার ছিল পরনে
শিবাজী সোজা হয়ে উঠে বসল | বিবরণটা কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে | পাশ থেকে ফোনটা টেনে নিল। ওপার থেকে রাজন্যার গলাটা পেতেই বললো
-হ্যাকাথনে বেস্ট প্রাইজের জন্য কংগ্রাচুলেশন
রাজন্যা একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বলল,
– আপনি খবর পেয়েছেন? থ্যাঙ্ক ইউ!
– খবর তো টিভিতে দেখাচ্ছে। আমি শুধু চিনতে পেরেছি এই যা!
রাজন্যা প্রথমত খেয়ে গেল। সর্বনাশ! এই লোকটা কি ত্রিকালদর্শী নাকি!
চলবে