হৃদ মাঝারে পর্ব-২৫+২৬

0
533

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২৫)

ওয়েস্ট ডে ময়েনে আসার পরে কেটে গেছে সপ্তাহ দুয়েক। প্রথম দিকের জড়তা কাটিয়ে নতুন পরিবেশে অনেকটাই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে রাজন্যা | শিবাজীর প্রস্তাব অনুসারে দুটো অ্যাপার্টমেন্টের কিচেন ব্যবহার না করে শুধুমাত্র শিবাজীর অ্যাপার্টমেন্টের কিচেনেই দুজনের দুই বেলার রান্না বান্না করে নেওয়া হয়। রাজন্যা অবাক হয়ে দেখেছে তার রাশভারি বসটি রান্নাবান্না বিশেষ করতে না পারলেও রান্নার জোগাড় করে দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ পটু | ঝপাঝপ সবজি কেটে দেওয়া অথবা বাসনপত্র পরিষ্কার করে ফেলার কাজে শিবাজী বেশ দক্ষ | প্রথম প্রথম রাজন্যা বেশ লজ্জা পেতো | দুই একবার শিবাজীকে বারণও করেছিল,

– ছেড়ে দিন না! আপনি আবার বাসন মাজছেন কেন? আমি মেজে নেব।

শিবাজী গম্ভীর ভাবে বলেছিল,

– এ দেশে থাকতে গেলে সবাইকেই নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়। তোমার যদি মনে হয় কিচেন সংক্রান্ত সমস্ত কাজ মেয়েদের করার কথা, দেন ইউ আর ইন আ রং প্লেস |

রাজন্যা আর তর্ক করতে সাহস পায়নি | তবে খাওয়ার পরে শিবাজী জায়গা ছেড়ে ওঠার আগেই নিজে উঠে নিজের এঁঠো বাসনগুলো ধুয়ে ফেলে |

ওদের অফিসটা ডাউনটাউনে | অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে অল্প খানিকটা হেঁটে গেলেই বাসস্ট্যান্ড | বাসে মিনিট কুড়ি লাগে অফিস পৌঁছতে। অফিসে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে | বেশ কিছু প্রবাসী ভারতীয় এই কোম্পানিতে চাকরি করে | তা ছাড়াও আমেরিকান এবং মেক্সিকান এমপ্লয়ীদের সাথেও আলাপ হতে বেশি সময় লাগে নি । রাজন্যার সাথে সব থেকে বেশি বন্ধুত্ব হয়েছে কার্ল নামের একটি মেক্সিকান যুবকের | ছেলেটি এখানকার পারচেজ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে | রাজন্যাদের নতুন প্রজেক্টে এই পারচেজ ডিপার্টমেন্টের একটা বড় অংশ অটোমেট করার কথা। কার্ল কথায় কথায় সুযোগ পেলেই রাজন্যার প্রশংসা করতে থাকে , একদিন রাজন্যার টিফিন বক্স থেকে আলুর দম টেস্ট করে সারা অফিসে রটিয়ে দিয়েছিল

– এভরিবডি শ্যুড টেস্ট দ্যা পটাটো ডিশ রাজ ব্রট টুডে!

লোকজনের দাবি মেনে একদিন বড় বাক্স ভরে সকলের জন্য আলুর দম নিয়েও যেতে হয়েছিল | সব মিলিয়ে বিদেশের অফিস পর্ব বেশ ভালই লাগছে রাজন্যার |

এখানে অফিসের কাজ শুরু হয় তাড়াতাড়ি,শেষও হয় তাড়াতাড়ি | কলকাতার মতো দেরি পর্যন্ত অফিসে থাকার চল নেই। সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে ওরা | অবশ্য ফিরে আসা মানেই যে রাজন্যার ছুটি তা নয় | বিকেলের চা কফি বানানোর দায়িত্ব শিবাজীর | কফি খেয়েই বসতে হয় সারাদিনের কাজের ডকুমেন্টেশন এবং অ্যানালিসিস নিয়ে | পুরো সময়টাই রাজন্যার প্রায় ঘাড়ের ওপরে বসে থাকে শিবাজী, একটা আধটা ছোটখাটো ভুল করলেও ধমক খেতে হয়। স্থানীয় সময় এগারোটা নাগাদ প্রতিদিন কলকাতা অফিসের সাথে ভিডিও কল করা হয় | সাবর্ণদা, স্বয়ম এবং সৌম্য প্রতিদিনই উপস্থিত থাকে, মাঝেমধ্যে মণীষা, পাভেল এবং অনুরাগকেও দেখা যায় | সেদিন কলের শেষে সৌম্য বলল,

– কিরে রাজন্যা। হাফ অফ দ্যা মান্থ কাটিয়ে দিলি তো, দেখলি কি ওখানে?

রাজন্যা ঠোঁট উল্টালো,

– কিছুই দেখিনি। শিবাজীদা বলে এখানে নাকি দেখার কিছুই নেই।

সৌম্য হাসতে হাসতে বলল

– ও শিবাজীদা আলসেমি করে বলে | তুই এক কাজ কর | ওখানে একটা বয়ফ্রেন্ড জোগাড় কর। করে উইকেন্ডে কোথাও ঘুরে আয়

রাজন্যা কিছু না ভেবেই বলল,

– বয়ফ্রেন্ড আলাদা করে খুঁজতে হবে না! অফিসে কার্ল বলে একটা ছেলে আছে, ওকে বললেই আমার সাথে যেতে রাজি হয়ে যাবে | আজকেই ওকে ফোন করবো।

কল শেষ হবার পরে অবশ্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এত রাত্রে কার্লকে ফোন করার ইচ্ছা থেকে বিরত হলো রাজন্যা। ল্যাপটপ বন্ধ করে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে কেবল শিবাজীকে জিজ্ঞাসা করল,

– কাল আমাদের সেরকম কিছু দরকারি কাজ আছে?

শিবাজী কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেইলের উত্তর দিচ্ছিল, মুখ না তুলেই বলল,

– না সেরকম কিছু নেই।
– আচ্ছা। গুড নাইট |

নিজের ঘরে চলে এলো | ঘুম থেকে উঠেই কার্লকে একটা গুড মর্নিং মেসেজ করে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন উত্তর আসবে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গুড মর্নিং মেসেজ ভেসে উঠলো মোবাইলের স্ক্রিনে | রাজন্যা লিখে পাঠালো

– কল করতে পারি?

উত্তরে আর কোন মেসেজ না এসে সোজা ইনকামিং কল এসে গেল | রাজন্যা ফোন ধরতেই ওদিক থেকে কার্লের উচ্ছ্বসিত গলা শোনা গেল,

– হেই রাজ! সকাল সকাল তোমার মেসেজ পেয়ে আমার দিনটা ভালো হয়ে গেল। বলো!
– কার্ল আমরা তো আর দু সপ্তাহ বাদে ফিরে যাব | অথচ ডে ময়েনের কিছুই দেখিনি | জানি ছোট জায়গা, কিন্তু একেবারে কিছুই কি দেখার নেই? তুমি আমাকে লোকাল গাইড হয়ে কোন একটা জায়গা দেখাতে পারো? বাড়ি গিয়ে লোকজনকে ছবি তো দেখাতে হবে!

কার্ল সোৎসাহে বলল,

– নিশ্চয়ই! চলো তোমাকে আজকে ব্ল্যাঙ্ক পার্ক জু দেখিয়ে আনি

রাজন্যা একটু দমে গেল, চিড়িয়াখানা! কার্ল ওর মনোভাব বুঝে বলল,

– না না, এটা সেমি ওপেন জু, খুব ভালো লাগবে দেখবে।

রাজি হয়ে গেল রাজন্যা | কথা হল কার্ল সাড়ে দশটা নাগাদ রাজন্যাকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পিক আপ করে নিয়ে যাবে | রাজন্যা তাড়াতাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য পোশাক বাছতে শুরু করল | এখানে আসার আগে মালবিকার জোরাজুরিতে কয়েকটা অন্য ধরনের জামা কাপড় কিনেছিল। তার মধ্যে একটা পেস্তা রঙের জাম্পস্যুট ছিল | আজ ওই পোশাক টাই বের করে নিল | স্নান করে জাম্পস্যুটটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল বেশ লাগছে। অফিস যাওয়ার সময় প্রতিদিন স্নিকার্স পরেই যায়। আজকে ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে আনলো ওর খয়েরি রঙের হিলতোলা জুতোটা। আজকে আবহাওয়া বেশ মনোরম এখানে। সাথে একটা সোয়েট শার্ট রাখলেই চলবে, এই মুহূর্তে গায়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না | জুতোটা খুলে রেখে স্লিপার পায়ে গলিয়ে শিবাজীর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে টোকা দিল। ওর কাছে অবশ্য এই অ্যাপার্টমেন্টের একটা চাবিও রাখা থাকে। তবু সকালবেলা একটা ঘুমন্ত মানুষের ঘরে চাবি ঢুকিয়ে প্রবেশ করাটা অভব্যতার সামিল | ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে রাজন্যাকে দেখে অবাক হয়ে গেল শিবাজী |

– কি ব্যাপার? সকাল সকাল বাইরে যাবার পোশাক আশাক পরে তৈরি?

রাজন্যা ঘরে ঢুকে কিচেন কাউন্টারের দিকে যেতে যেতে বলল,

– হ্যাঁ আজকে কার্ল আমাকে ব্ল্যাংক পার্ক জু তে নিয়ে যাবে বলেছে, ও সাড়ে দশটা নাগাদ পিক আপ করতে আসবে, তাই স্নানটা সেরে নিলাম | কফি খাবেন তো?

আচমকা মুখটা তেতো লাগতে শুরু করল শিবাজীর | গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল,

– তুমি যে কার্লের সাথে যাবে কই আমাকে বলোনি তো?

সসপ্যানে জল আর দুধ একসাথে মেশাতে মেশাতে রাজন্যা বলল,

– আজ সকালেই কথা হল | আপনি তো কোথাও যেতে চান না, তাই আর বিরক্ত করিনি |

পাশ ফিরতেই রাজন্যা দেখলো শিবাজী দুই হাত বুকের কাছে বেঁধে গম্ভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে | ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

– কি হয়েছে শিবাজীদা?
– তুমি এই কার্ল ছেলেটাকে কতদিন চেনো?
– না ইয়ে, মানে, এই তো এখানে এসেই তো আলাপ।
– তুমি ডে ময়েনের কতটুকু চেনো?

রাজন্যা কোন কথা না বলে চুপ করে তাকিয়ে রইল | শিবাজীর কন্ঠস্বর বরফের মত শীতল,

– কার্ল যদি জুয়ের নাম করে তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যায় তুমি কিছু করতে পারবে?

রাজন্যা চমকে উঠল। এসব তো ও ভাবেনি |

– কার্ল তোমাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাচ্ছে না কোনো হোটেল রুমে নিয়ে ফেলতে যাচ্ছে সেটা তুমি রাস্তা দেখে বুঝতে পারবে?

রাজন্যার মনে হল ওর হাত পা ঘামতে শুরু করেছে। আমতা আমতা করে বলল,

– না মানে, কার্লকে দেখে তো ওরকম মনে হয় না।
– তাই নাকি? কিরকম দেখতে হলে তাকে দেখে তার চরিত্র বোঝা যাবে রাজন্যা ম্যাডাম?

রাজন্যা কোন উত্তর দিতে পারল না কিছুক্ষণ | তারপর কাঁদো কাঁদো গলার বললো,

-তাহলে এখন আমি কি করবো?
-ওই ছেলেটাকে ফোন করে বলে দাও যে তোমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, যেতে পারবে না।
– আচ্ছা!
– এক্ষুনি ফোনটা করো, আমার সামনে |

শিবাজীর ধমক খেয়ে একটু কেঁপে উঠল রাজন্যা, জাম্প স্যুটের পকেট থেকে ফোন বের করে রিং করল | ওদিক থেকে কার্লের হৈ হৈ করা গলা ভেসে আসলো,

– হ্যাঁ এইতো রাজ। আমি আর টোয়েন্টি মিনিটের মধ্যে বেরোচ্ছি |
– আম আই এম সরি কার্ল, একটা খুব দরকারি অফিসিয়াল কাজ এসে গেছে। উইক এন্ডেই শেষ করতে হবে। আমার যাওয়া হবে না |

কার্ল হতাশ স্বরে বলল,

– সে কি! আজ কাল দুদিনই ব্যস্ত থাকতে হবে?

রাজন্যা শিবাজীর দিকে তাকিয়ে একটা ঢোঁক গিলে বলল,

– হ্যা কার্ল, ভেরি সরি!

ফোন কেটে গম্ভীর মুখে দুই কাপ কফি নিয়ে সোফায় এসে বসল রাজন্যা | আঙুল দিয়ে ঠেলে এক কাপ শিবাজীর দিকে এগিয়ে দিল। শিবাজী চট করে বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে বসলো | রাজন্যার থমথমে মুখটা দেখে একটু মায়া হল | আস্তে করে বলল,

– মন খারাপ হলো?

রাজন্যা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ল। শিবাজী বলল,

-আচ্ছা। কালকে একটা ক্যাব বুক করে আমি তোমাকে ঘুরিয়ে আনব। আজকেই যাওয়া যেত হয়তো, আসলে শরীরটা ভালো লাগছে না | কাল রাতেই গলাটা ব্যথা করছিল | আজকের দিনটা রেস্ট নিয়ে নি। কাল যাব পাক্কা | তুমি বরং গুগল করে নাও ওই চিড়িয়াখানা ছাড়া আশেপাশে আর কিছু যাওয়ার জায়গা আছে কিনা | গ্রেজ লেক বলে একটা সুন্দর লেক আছে এটুকু শুনেছি আর এখানকার লাইব্রেরীগুলোও নাকি খুব ভালো। তুমি চাইলে ঘুরে আসতে পারি |

রাজন্যা মনে মনে খুশি হলেও মুখে কিছু বলল না | কফি শেষ করে সিঙ্কে গিয়ে ধুতে ধুতে বলল,

– আমি তাহলে একটু ভ্যালি ওয়েস্ট মল থেকে ঘুরে আসছি | দুপুরে ওখান থেকে কিছু একটু খাবার প্যাক করে নিয়ে আসবো।

একটু থেমে যোগ করল,

– আপনি যাবেন?

শিবাজী মাথা নাড়ালো,

– না তুমি ঘুরে এসো। আমার মাথাটা একটু ধরে আছে। একটু শুয়ে নিই।
– ব্রেকফাস্ট করে নেবেন কিন্তু।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্রাউনি আছে তো, আপেলও আছে | খেয়ে নেব।

রাজন্যা নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে খানিকক্ষণ মোবাইলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ঘোরাঘুরি করে বেরিয়ে পড়ল ভ্যালি ওয়েস্ট মলের দিকে। এই মলটার জেসি পেনি, ইয়াঙ্কার গোছের দোকানগুলোতে মাঝে মাঝেই বেশ সেল চলে। লোকজনকে গিফট দেওয়ার জন্যও তো দু চারটে জিনিস কিনতে হবে |

ভ্যালি ওয়েস্ট মলে আজকে একাধিক দোকানে প্রচুর সেল দিচ্ছে | জেসি পেনিতে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ, ইয়াঙ্কারসেও চল্লিশ শতাংশ, তাছাড়াও আরো দু চারটে দোকানে সেল চলছে। কিছুক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে অনেক কিছুই কেনা হয়ে গেল | ভাইয়ের জন্য টি শার্ট আর সোয়েটার, বাবার জন্য সোয়েটার, মায়ের জন্য একটা নরম কম্বল, মালবিকার জন্য একটা পারফিউমের সেট আর নিজের জন্য একটা জ্যাকেট | মলটার এক তলায় বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাচ্চাদের খেলনার দোকানটা চোখে পড়েছিল আগেই। আজ দোকানটাতে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে যাবার জোগাড় | কত রকমের খেলনা! দাম অবশ্য একটু বেশি, তবু সেখান থেকে তিতলির জন্য একটা বড়সড় পুতুল কিনেই ফেলল রাজন্যা |

ঘন্টা তিনেক এই দোকান সেই দোকান টানা ঘোরাঘুরি করে রীতিমতো পায়ে ব্যথা হয়ে গেল। মলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফুড কর্নারে একটা আইসক্রিম শেক নিয়ে বসে অন্য একটা দোকান থেকে লাঞ্চের জন্য নুডুলস আর কুম পাও চিকেন পার্সেল করতে দিল রাজন্যা | শপিং করলে যে মন ভালো হয়ে যায়, কথাটা বড্ড সত্যি | সকালে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভেবে এত আনন্দ হচ্ছিল, তারপরেই শিবাজীদার ধমক খেয়ে তার দ্বিগুণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার এত কিছু কেনাকাটি করে মন খারাপ টা প্রায় উধাও হয়ে গেছে | এর মধ্যে আবার একটি সেলস গার্ল রাজন্যার পোশাকের প্রশংসাও করেছে | সব মিলিয়ে দিল আবার গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেছে | ধীরে সুস্থে মিল্কশেকটা শেষ করে পার্সেল করা খাবার নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল রাজন্যা | শপিংয়ের প্যাকেটগুলো নিজের অ্যাপার্টমেন্টে রেখে পোশাক বদলে একটা ঘরোয়া টি শার্ট আর পায়জামা পরে খাবারের বাক্স দুটো নিয়ে শিবাজীর অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় টোকা দিল। বার দুই টোকা দেওয়ার পরেও কেউ দরজা খুলল না দেখে একটু অবাক হয়েই চাবি দিয়ে লক খুলে ভিতরে ঢুকলো রাজন্যা। ভিতরে ঢুকে আরো অবাক | সকালে খাওয়া কফির কাপ এখনো সেন্টার টেবিল এর উপরে পড়ে রয়েছে, পাশে একটা ব্রাউনির খালি প্যাকেট, একটা গোটা আপেলও রয়েছে টেবিলের উপরে। সেটা যে খাওয়ার চেষ্টাও হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। শিবাজীদা বিছানায় শুয়ে আছে | অসময়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয় | রাজন্যা খাবারের বাক্স দুটো টেবিলের উপর রেখে ডাকল,

– শিবাজীদা, আমি চলে এসেছি, উঠুন খেয়ে নেবেন |

শিবাজীর থেকে কোনরকম সাড়া না পেয়ে এবার একটু গলা তুলেই ডাকলো রাজন্যা,

-ও শিবাজীদা খাবেন তো? অনেক বেলা হয়েছে কিন্তু!

তবুও সাড়াশব্দ নেই। এবার বেশ অবাক হলো রাজন্যা | বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখল অঘোরে ঘুমোচ্ছে মানুষটা, চোখ মুখ একটু যেন লালচে | একটু ইতস্তত করে গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেল। কিন্তু হাত ছুঁতেই চমকে উঠল। গায়ে তো প্রবল জ্বর! কপালে হাতের উল্টোপিঠ ঠেকালো, হ্যাঁ, বেশ জ্বর | আন্দাজে মনে হচ্ছে ১০২ এর উপরে তো হবেই | দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে মেডিসিনের ব্যাগটা নিয়ে এলো | থার্মোমিটার বার করে শিবাজীর ডান হাতটা একটু সরিয়ে টি-শার্টের ভেতর দিয়ে চেপে ধরল বগলের নিচে। মিনিটখানেক পরেই ডিজিটাল থার্মোমিটার শব্দ করে উঠতে বের করে দেখল একশো তিন পয়েন্ট পাঁচ | সর্বনাশ! চটপট ক্যালপলের পাতা ছিড়ে ওষুধ বের করে শিবাজীর কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল,

– শিবাজী দা। শিবাজী দা! একটু উঠুন প্লিজ, একটা ওষুধ খেয়ে নিন | বড্ড জ্বর এসেছে যে!

শিবাজী লালচে চোখ মেলে একবার তাকালো, তারপরে আবার চোখ বুজলো | মাথাটা বড্ড ভারী হয়ে আছে। তাকাতে পারছে না।

– ওষুধটা খেতে হবে, না হলে জ্বর নামবে না!

গ্লাসে করে এক গ্লাস জল নিয়ে ফের বিছানার কাছে চলে এলো রাজন্যা | বিছানায় বসে শিবাজীর গলা প্রায় দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিছানা থেকে টেনে তুললো খানিকটা। শিবাজী চোখ পিটপিট করলো, আবার কে টানাটানি করছে ওকে ধরে! সামনে এটা কে? রাজন্যা না? কোনো রকমে বিড়বিড় করে বলল,

– কি হয়েছে? ঘুমাতে দাও!
– ঘুমাবেন, আগে একটু ওষুধটা খান, হাঁ করুন…

শিবাজী ফের চোখ বুজে ফেলল | রাজন্যা কোনো রকমে বাঁ হাতে শিবাজী কে জড়িয়ে রেখেই ডান হাত দিয়ে ওর গালে আলতো চাপড় দিল দুটো।

– চোখ বুজলে হবে না। হাঁ করুন, হাঁ করুন |

চোখ বোজা অবস্থাতেই হাঁ করল শিবাজী। চট করে মুখে ট্যাবলেটটা ফেলে দিয়ে জলের গ্লাসটা ধরল রাজন্যা। দুই ঢোক জল মুখে দিয়ে ওষুধটা গিলে নিল শিবাজী | জলের গ্লাসটা পাশে রেখে শিবাজী কে ফের শুইয়ে দিল রাজন্যা। তারপর বসে বসে হাঁফাতে লাগলো | ওই ছয় ফুটিয়া দশাশই চেহারা কে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। পরবর্তী কুড়ি মিনিট খানিক বাদে বাদেই কপালে হাত দিয়ে দেখতে থাকলো | জ্বর কিন্তু নামছে না | মনে পড়ল ছোটবেলায় বেশি জ্বর উঠে গেলে মা ওর আর ভাইয়ের মাথা ধুয়ে দিত। কিন্তু এখানে মাথা ধোওয়াবে কি করে? বাথরুমে তো কোন বালতিই নেই | আবার দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে একটা সুতির তোয়ালে এনে চুপচুপে করে ভিজিয়ে শিবাজীর মাথা মোছাতে আরম্ভ করলো, মাথা, কপাল, ঘাড়, গলা, হাতের নিচে | শরীরের তাপে তোয়ালে গরম হয়ে উঠলে আবার বাথরুমে গিয়ে ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে আনছে । এমনি করে আরো আধঘন্টা কাটার পরে মনে হল যেন টেম্পারেচার একটু একটু নামছে | থার্মোমিটার দিয়ে দেখলো একশ একের একটু কম | এবারে একটা রুমাল ভিজিয়ে শিবাজীর কপালের ওপরে চাপিয়ে সোফায় গিয়ে বসল রাজন্যা। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জ্বর না কমলে এখনই রত্নেশকে ফোন করতে হতো |

আরো আধ ঘন্টা বাদে চোখ খুলল শিবাজী | প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কপালে কি একটা ঠান্ডা ঠান্ডা বোধ হওয়াতে হাত দিয়ে দেখল মাথার চুল গুলো ভিজা ভিজা আর কপালে একটা ভেজা রুমাল দেওয়া | মনে পড়ল ব্রাউনি টা খাওয়ার পরেই ভীষণ গা গুলাচ্ছিল। তাই আর আপেলটা না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল | জ্বর যে আসবে সেটা মনে হচ্ছিল | বরাবরই জ্বর আসার আগে ওর এরকম গা গুলানো আর মাথা ব্যথা হয়। ভুল হয়েছে ওষুধটা না খেয়ে শোওয়া | ভিজা রুমালটা সরিয়ে পাশে রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল সোফার উপরে দুই পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে রাজন্যা, মনে হয় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে | মেয়েটার পরনের টি শার্টটা গলার কাছে, বুকের কাছে হালকা ভেজা | ফিরে এসে ওই সম্ভবত মাথায় জল দিয়েছে, সামনে কাঁচের গ্লাস আর ক্যালপলের পাতা দেখে শিবাজী বুঝলো ওষুধটাও রাজন্যাই খাইয়েছে | কি করে যে খাওয়ালো! শিবাজী তো প্রায় বেহুঁশ হয়ে ছিল | বাথরুমে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে নামতে সামান্য শব্দ হলো, তাতেই চোখ মেলে তাকাল রাজন্যা | শিবাজীকে বিছানা থেকে নামতে দেখেই দৌড়ে সামনে চলে এলো,

– হাঁটতে পারছেন? আমি ধরবো?

শিবাজী কিছু বলার আগেই দুই হাতে ওর ডান হাত চেপে ধরল | কেন জানো ছোট্টখাট্টো মেয়েটার এই ভরসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া টুকু শিবাজীর কাছে বড্ড প্রয়োজনীয় মনে হল।

– বাথরুমে যাবেন?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল শিবাজী। তারপরে বলল,

– খুব খিদে পেয়েছে রাজন্যা।
– খাবার এনেছি তো, ঠান্ডা হয়ে গেল মনে হয়। গরম করে নিচ্ছি। আপনি একা যেতে পারবেন বাথরুমে?
– হ্যাঁ পারব

রাজন্যা হঠাৎ বলে উঠলো,

– ছিটকিনি বন্ধ করবেন না!

শিবাজী অবাক হয়ে ওর দিকে ফিরে তাকাতেই রাজন্যা লজ্জা পাওয়া মুখে বলে উঠলো,

– না মানে যদি অজ্ঞান হয়ে যান…

শিবাজী হেসে ফেলল,

– চিন্তা নেই, জ্বরটা ছেড়ে গেছে এখন। আর অজ্ঞান হবো না |

শিবাজী বাথরুম থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসতেই রাজন্যা প্লেটে করে খাবার এগিয়ে দিল। জ্বরের মুখে ঝাল ঝাল খেতে ভালোই লাগলো | আজকে আর শিবাজীকে কিছুতেই বাসন ধুতে দিল না রাজন্যা। দিদিমনির মতন কড়া নির্দেশের গলায় বলল,

– চুপ করে গিয়ে বিছানায় উঠুন

ধমকানোর লোক বদলে গেছে। শিবাজী বাধ্য ছেলের মতন বিছানায় গিয়ে শুলো। রাজন্যা সব বাসনপত্র ধুয়ে নিয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বলল,

– আপনি একটু রেস্ট নেবেন? আমি ও ঘরে যাব?
– না, তুমি একটু এখানে বসবে প্লিজ? একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে?

রাজন্যা চমকে উঠল | এমন স্বরে তো শিবাজীদা কে কখনো কথা বলতে শোনেনি | কিছু না বলে বিছানায় উঠে বসলো | আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

– মাথা ব্যথা করছে এখনো?
– নাহ্, কিন্তু হাত বুলিয়ে দিলে বড় আরাম লাগছে

রাজন্যা আর কোন কথা না বলে শিবাজীর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো | খানিক পরে আঙুলগুলো শিবাজীর একমাথা চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে আলতো করে টেনে দেওয়া শুরু করলে শিবাজীর মুখ দিয়ে নিজে থেকেই একটা আরামের আহ্ বেরিয়ে এলো।

– আপনার বুঝি এরকম হাই ফিভারের টেন্ডেন্সি আছে?

শিবাজী ক্লান্ত হাসলো,

– টেন্ডেন্সি ঠিক না, তবে জ্বর যখন হয় তখন হাই ফিভার উঠে যায়। আমারই ভুল হয়েছে। জ্বর আসছে দেখেই ওষুধটা খেয়ে নেওয়া উচিত ছিল |
– উচিত ছিলই তো! আমার যদি আসতে একটু দেরি হতো?
– আমি তো তোমাকে সবসময় এত বকাবকি করি রাজন্যা, তবু তুমি আমার জন্য এত কেন করলে?

রাজন্যা থমকে গেল | কেন করল এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো মুশকিল | শিবাজীদাকে জ্বরে অমন বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে যে ওর মনের ভেতরে কি ভাঙচুর হয়ে গেছিল সেটা কি করে বোঝাবে?

রাজন্যাকে চুপ থাকতে দেখে শিবাজী নিজের ডান হাত তুলে রাজন্যার হাতটা ধরে ফেলল,

– বললে না তো?

রাজন্যা ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠলো, তারপর খুব মৃদুস্বরে বলল,

– আপনি বকাবকি করেন ঠিকই, কিন্তু সেটা অন্যদের ভালোর জন্যই সেটুকু আমি বুঝি

রাজন্যা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল না দেখে শিবাজী আস্তে করে নিজের শরীরটাকে তুলে রাজন্যার কোলের উপরে মাথা রাখলো। তারপরে উদাস কন্ঠে বলল,

– নিজের চারিদিকে কাঠিন্যের পাঁচিল তুলে রাখতে রাখতে আমি ক্লান্ত রাজন্যা | তুমি কি একটা হেরে যাওয়া মানুষের গল্প শুনবে?

রাজন্যা আস্তে করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ফের শিবাজীর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে বলল,

আপনি যা বলবেন সব শুনবো শিবাজীদা…

(ক্রমশ

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২৬)

এবারে বেশ কয়েক মাস পরে কলকাতায় এলো সমর্পিতা, আর এই পাড়ায় এলো বোধহয় বছর তিনেক পরে। আসলে কলকাতায় এলেও আর এই বাড়িতে এসে থাকতে পারবে বলে ওর মনে হয় না। নয়ডার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে কোথাও গেলে অন্তত থ্রি স্টার হোটেল ছাড়া থাকতে পারে না | তার উপর বাড়িতে আসা মানেই ইমোশনের কচকচি, বাবার গম্ভীর মুখ, মায়ের সিমপ্যাথি পাওয়ার চেষ্টা, তার উপরে ওই সেন বাড়ি তো আছেই | কলকাতায় এসেই সাত দিনের জন্য একটা গাড়ি ড্রাইভার সমেত বুক করে নিয়েছে সমর্পিতা। সেনভিলার সামনে গাড়ি থেকে নেমে একবার এদিক সেদিক তাকাল, তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি, এমনকি বাইরের বাগানটাও একই রকম আছে | নিজের মা-সুলভ ইমেজটাকে জোরদার করার জন্য আজ শাড়ি পড়ে এসেছে | শাড়ী সামলে এগিয়ে গিয়ে বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল কৈলাস | কয়েক মুহূর্তের জন্য সমর্পিতাকে চিনতে পারেনি, তারপরেই বিস্ময়ে তার মুখ হাঁ হয়ে গেল। কৈলাসকে ওইভাবে ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুমিত্রা এগিয়ে এলেন |

– কি হয়েছে রে কৈলাস? কে এসেছে?

সমর্পিতা দুই হাত জড়ো করল,

– নমস্কার পিসিমা। কেমন আছেন?

সুমিত্রার মুখভঙ্গি কঠিন হয়ে উঠলো।

– এখানে কি মনে করে?

সমর্পিতা বাঁকা হাসলো।

– মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি পিসিমা।

সুমিত্রা দরজার সামনে থেকে নড়লেন না।

– মেয়ে? তোমার? হঠাৎ এতদিন বাদে মেয়ের কথা মনে পড়েছে!

সমর্পিতা সানগ্লাস খানা চোখ থেকে নামিয়ে বলল,

– মনে তো সবসময়ই পড়ে পিসিমা, নাড়ির টান বলে কথা | নেহাৎ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এতদিন স্ট্রাগল করতে হলো বলে তাই। এখন আমার আর্থিক অবস্থা স্টেবল হয়েছে, এখন আমি আমার মেয়ের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারব।

– আমাকে ভোলানোর চেষ্টা করো না! তুমি যে কেন মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছো সে আমি খুব ভালো করেই জানি। ছ’মাসের শিশুকে নিজের স্বার্থের জন্য ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলে, আবার এখন নিজের স্বার্থের জন্যই তাকে নিজের কাছে নিতে এসেছ! তোমার কি লজ্জা বলে কোন বস্তু নেই?

সমর্পিতা এবার সুমিত্রাকে খানিকটা ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এলো,

– আপনার এসব জ্ঞানের কথা শুনতে আমি আসিনি পিসিমা । তাও যদি আমার শাশুড়ি হতেন মানা যেত, আপনি কে? আপনার কথা খামোখা শুনতে যাব কেন আমি? দেখুন, তখন তো সত্যিই আমার আর্থিক সঙ্গতি ভালো ছিল না। আমি রাখতাম কি করে মেয়েকে? কনটেস্ট করলেও হেরেই যেতাম। কিন্তু মেয়ের মা যখন আজ আর্থিকভাবে স্বনির্ভর, তখন কোর্টের কাছে আপিল করলে মেয়ে সন্তানকে যে মায়ের কাছেই দেওয়া হবে সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কই ডাকুন দেখি তিতলিকে…

সুমিত্রা কঠিন স্বরে বললেন,

– না, তিতলি তোমার সঙ্গে দেখা করবে না |
– সে কথা আপনি বলার কে?
– আমি তিতলির গার্জিয়ান
– তিতলির গার্জিয়ান শিবাজী সেন, তিনি বর্তমানে বাড়িতে নেই। আমি তিতলির মা। কাজেই আপনি আমাকে ওর সঙ্গে দেখা করা থেকে কোনভাবেই আটকাতে পারেন না!

একতলা থেকে উত্তপ্ত কথাবার্তার আওয়াজ শুনে ছোট্ট তিতলি সিঁড়ির উপর থেকে উঁকি দিচ্ছিল | সমর্পিতার চোখ পড়ল শিশুটির ওপর | গলায় একরাশ মধু ঢেলে বলল,

– তিতলি মাম্মা, নিচে এসো! দেখো আমি তোমার জন্য কি এনেছি!

সুমিত্রা রাগত স্বরে বললেন,

– তিতলি দিদিভাই তোমার ঘরে যাও।

তিতলি ঠাম্মির এমন রাগী রাগী গলা কখনো শোনেনি। পায়ে পায়ে একটু পিছনে যেতেই সমর্পিতা সিঁড়ির কাছে চলে এলো | দুই হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল,

– তুমি তোমার মাম্মার কাছে আসবে না তিতলি সোনা? দেখো তো তুমি আমাকে চিনতে পারছো কিনা?

তিতলি বিস্ময়ে হতবাক |

– তুমি আমার মাম্মা?
– হ্যাঁ তো! এসো আমার কাছে!

তিতলি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল | সামনে দাঁড়ানো সুন্দর দেখতে আন্টিটার মুখের সাথে সত্যিই ওর কাছে লুকানো ছবিটার মিল আছে। তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না | সিঁড়ির শেষ ধাপে আসতেই সমর্পিতা দুই হাতে তিতলিকে কোলে তুলে নিল | তিতলির দুই গালে দুটো চুমু দিয়ে বলল,

– এইতো সোনা মেয়ে আমার!

অবাক বিস্ময় সমর্পিতার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে তিতলি বলল,

– তুমি যদি আমার মাম্মা হও, তাহলে আমার সঙ্গে থাকো না কেন?
– মাম্মা যে খুব বিজি সোনা, তাই জন্য তোমার সঙ্গে থাকতে পারেনি এতদিন | এইবারে মাম্মা তোমাকে তার সঙ্গে নিয়ে যাবে
– তাইইইই?

তিতলি হঠাৎ খুব খুশি হয়ে উঠেও পরমুহূর্তেই নিভে গেল,

– নিয়ে যাবে? নিয়ে যাবে কেন? তুমি এখানে এসে থাকতে পারবে না?
– তোমাকে যে বললাম সোনা, মাম্মা খুব ব্যস্ত, এখানে তো এসে থাকতে পারবে না। তুমি মাম্মার সাথে যাবে | একটা বিরাট বড় বাড়িতে থাকবে, অনেক খেলনা পাবে, কত নিউ ড্রেস পাবে!

তিতলি হাঁচোর-পাঁচোড় করে কোল থেকে নেমে গেল | মুখ গোঁজ করে বলল,

– আমার অনেক খেলনা আছে। আমার অনেক ড্রেসও আছে | কিন্তু আমি বাবাইয়াকে ফেলে, ঠাম্মিকে ফেলে, ফেয়ারি সিস্টারকে ফেলে এখান থেকে যাব না |

বাবাইয়া আর ঠাম্মি বুঝলেও ফেয়ারি সিস্টার না বুঝে সমর্পিতা জিজ্ঞাসা করল,

– ফেয়ারি সিস্টার আবার কে?
– আছে, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড | কত স্টোরি বলে আমাকে |

সুমিত্রা বিরক্ত মুখে সমর্পিতার অভিনয় দেখছিলেন | তিতলির মুখে ফেয়ারি সিস্টার ওরফে রাজন্যার কথা শুনে ওনার ঠোঁটে একটা হাসি খেলে গেল, একটা প্ল্যান এসেছে মাথায় | উনি বলে উঠলেন,

– তিতলি দিদিভাই, তোমার তো খাওয়ার সময় হয়ে গেছে | তাহলে তোমার মাকে বলো আজ তোমাকে গল্প বলে বলে খাইয়ে দিতে!

সমর্পিতা একটু ঘাবড়ে গেল | সুমিত্রার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করল মহিলা হঠাৎ এমন ভোল বদলে ফেলল কেন! ততক্ষণে তিতলি লাফিয়ে উঠেছে,

– হ্যাঁ মাম্মা, তুমি আমাকে খাইয়ে দেবে তো?

সমর্পিতা মনে মনে বিরক্ত হল | বাচ্চাদের খাওয়া মানে অন্তত প্রায় তিরিশ মিনিটের ব্যাপার | এখন এই আধঘন্টা ধরে বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে! কিন্তু এখন না করলে এতক্ষণের অভিনয়টা মাঠে মারা যাবে। তাই হাসিমুখে বলল,

– হ্যাঁ। খাইয়ে দেবো তো!

সুমিত্রা কৈলাসের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– কৈলাস, খাবারটা দিয়ে দে। আজ ওর মা ওকে খাইয়ে দেবে

কিছুক্ষণের মধ্যেই কৈলাস টেবিলে থালায় তিতলির খাবার সাজিয়ে দিল | তিতলি সমর্পিতার হাত ধরে একরকম টানতে টানতেই নিয়ে এলো টেবিলের কাছে। সমর্পিতার মনে পড়ল এ বাড়িতে সকলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করার একটা রেওয়াজ ছিল। কৈলাস আরো দুটো থালা সাজিয়ে দিল টেবিলের উপরে। সমর্পিতা হাত নাড়ল।

-না না আমি দুপুরে এসব ভাত টাত খাই না |

তিতলি হাত গুটিয়ে বসে আছে দেখে সমর্পিতা বলল,

– কি হল, তুমি খাচ্ছ না যে?

তিতলি ঠোঁট উল্টালো,

– তুমি খাইয়ে না দিলে খাবো কি করে?

সমর্পিতা সামনের কাটলারি স্ট্যান্ড থেকে একটা চামচ তুলে নিয়ে তিতলির ভাত মেখে বলল,

– হাঁ করো দেখি!

তিতলি দুই দিকে মাথা নাড়ল।

– গল্প!
– ও হ্যাঁ। তুমি আগে গালে ভাত নাও…
– আগে গল্প।

তিতলি অনড়। কি গল্প বলা যায় মনে পড়ছে না | বেশ কিছুক্ষণ মাথার মধ্যে হাতড়ানোর পরে সমর্পিতা বলতে শুরু করল,

– একজন লোকের একটা মেয়ে ছিল তার নাম ছিল সিনড্রেলা | সিনড্রেলার নিজের মা ছিল না।

তিতলি হই হই করে উঠলো,

– এটা তো অনেক পুরনো গল্প, আমি জানি।

সমর্পিতা বলল,

– ও তুমি জানো? আচ্ছা, তাহলে তোমাকে স্নো হোয়াইটের গল্প বলি
– স্নো হোয়াইট আর সাত জন বামনের গল্প? কতবার শুনেছি, নতুন গল্প বলো মাম্মা!

সমর্পিতা রেগে উঠলো।

– নতুন গল্প কোথা থেকে পাব? বাচ্চারা এই সমস্ত গল্প শুনেই খায় | বায়না কোরো না, খেয়ে নাও |

তিতলি হাত-পা ছুড়ে কান্না ধরল,

– আমাকে নতুন স্টোরি বলে না দিলে আমি কিছুতেই খাব না

সমর্পিতার ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি বেয়াড়া বাচ্চা রে বাবা! কিভাবে মানুষ করেছে এরা একে? এত অবাধ্য! জোর করে তিতলির মুখে চামচের ভাতটা ঢুকিয়ে দিতে দিতে বলল,

– খাওয়ার সময় অসভ্যতা করতে নেই, খেয়ে নাও বলছি

তিতলি কোনো রকমে মুখে ভাতটা নিল বটে, কিন্তু পরমুহূর্তেই থু থু করে পুরো ভাতটা ছিটিয়ে দিল সামনের দিকে। তার মধ্যে কিছুটা এসে পড়ল সমর্পিতার শাড়িতেও | তাড়াতাড়ি করে চেয়ার ছেড়ে উঠলো সমর্পিতা, দুই হাত দিয়ে শাড়ি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

– ইউ নটি গার্ল!

তিতলিও বলে উঠলো,

– ইউ নটি মাম্মা!
– কি বললি! ঠাস করে এক থাপ্পড় দেব!

তিতলি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল, সজোরে দুই দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,

– তুমি পচা মাম্মা, তুমি দুষ্টু মাম্মা তুমি চলে যাও এখান থেকে…
– অবাধ্য মেয়ে একটা!

সমর্পিতা হাত তুলতেই পাশ থেকে ওর হাত ধরে ফেলল কৈলাস। ঠান্ডা গলায় বলল,

– বউমনি! তুমি মুখে যাই বলো না কেন আমি সব শুনে নিয়েছি, কিন্তু আমার দিদিভাইয়ের গায়ে হাত দিতে গেলে সেই হাত আমি মুচড়ে ভেঙে দেবো। যদি ভালো চাও তো এখনই এই বাড়ি থেকে চলে যাও |

সমর্পিতা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার কৈলাসের দিকে, একবার সুমিত্রার দিকে তাকিয়ে গটগট করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল | যাওয়ার আগে ঘোষণা করে গেল,

– আমিও দেখবো কিভাবে তোমরা আমাকে আমার মেয়ের অধিকার পাওয়া থেকে আটকাতে পারো! আর বাড়ির চাকর হয়ে আমার হাত ধরার যে স্পর্ধা তুমি দেখিয়েছো তার জন্য ইউ উইল সাফার আ লট!

সমর্পিতা বেরিয়ে যেতেই সুমিত্রা তিতলিকে কোলে তুলে নিলেন | কাঁদতে কাঁদতে ততক্ষণে বাচ্চাটার হেঁচকি উঠে গেছে। আস্তে আস্তে দোলাতে দোলাতে ওর পিঠে চাপড় দিতে দিতে সুমিত্রা বললেন,

– কাঁদে না, কাঁদে না, সোনা, কাঁদে না, লক্ষী সোনা আমার, আজকেই তোমার ফেয়ারি সিস্টারকে ভিডিও কল করে নতুন গল্প শোনাবো।

তারপরে কৈলাসের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– কৈলাস, আজকের ডাইনিং রুমের সিসিটিভির রেকর্ডিংটা সত্যেন বাবুকে দিয়ে আসিস।

কৈলাস মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ডাইনিং টেবিলের নিচের ছড়িয়ে পড়া ভাত পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল |

রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে হোটেলে ফেরার নির্দেশ দিয়ে তমালিকা কে ফোন করল সমর্পিতা | তমালিকা ফোন ধরার সাথে সাথেই হিসহিসিয়ে বলল,

– তমালিকা তোমার সোর্স লাগাও | শিবাজী সেনের মেয়ে ফেয়ারি সিস্টার কাকে বলে? তার খোঁজ চাই আমার।

নিজের ঘরে এসে থম মেরে বসে আছে রাজন্যা | শিবাজীর কাছ থেকে আজ ওর জীবনের যে গল্প শুনল, তাতে বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত কষ্টে ভরে গেছে। শিবাজীদার বিবাহিত জীবনে কিছু চাপা কষ্ট আছে তা আন্দাজ করেছিল আগেই। কিন্তু তার সাথে সাথে এও ভেবেছিল যে হয়তো জেদি মানুষটার একগুঁয়েমির কোনো প্রভাবও আছে তার পিছনে | সত্যি বলতে কয়েকবার না দেখা সেই মহিলার প্রতি করুণাও বোধ করেছিল | মেয়েকে ছেড়ে থাকতে কোনো মায়ের কষ্ট হবে না, তা রাজন্যার চিন্তার বাইরে। তাই কিছু না জেনেই সেই মায়ের জন্য সমব্যথী হয়ে পড়েছিল কিছুটা |

শিবাজী আজ বহু বছর পরে কারোর কাছে মনের দরজা এভাবে হাট করে খুলে দিয়েছে। একে একে বলেছে কিভাবে সমর্পিতাকে স্বস্তিকের লিড মডেল হিসাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়। কিভাবে সমর্পিতার সাথে শিবাজীর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কিভাবে দুই বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় |

– সমর্পিতা ভেবেছিল ব্যবসায় না এসে আইটি তে চাকরি করাটা আমার একটা সাময়িক খেয়াল | সময়ের সাথে সাথে আমিও স্বস্তিকের হাল ধরার কাজে লেগে পড়বো। এবং আমাদের ব্যবসা ধীরে ধীরে আরো অনেক অনেক বড় হবে। আর সেই ব্যবসার ব্যানারেই বড় হবে সমর্পিতা মল্লিক এর ভাবমূর্তিও | সমর্পিতা আসলে আমাকে অনেকবারই হিন্ট দিয়েছিল যে আমার এই রুটিন বাঁধা চাকরি করার ইচ্ছাটা ওর পছন্দ নয় | আমিই বোকার মত ভেবেছিলাম হয়তো আমার ভালো চেয়েই এমনটা বলছে | বুঝিনি ও আসলে একটা শক্তপোক্ত সিঁড়ি চেয়েছিল। সমর্পিতার ফার্স্ট চয়েস আমি ছিলাম না, ছিল আমার দাদা | কিন্তু যে কথা আমার পরিবারের কেউ জানতো না আমি ছাড়া, এক দুর্বল মুহূর্তে সমর্পিতাকে সেই কথা আমি বলে ফেলেছিলাম। আমার দাদা গে ছিল। তার ফলে সমর্পিতার লক্ষ্য দাদার থেকে ঘুরে আমার দিকে চলে আসে | কিন্তু বিয়ের পরেও যখন ও দেখলো আমার ব্যবসায় পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ার কোন ইচ্ছাই নেই তখন ও ধীরে ধীরে স্বমূর্তি ধারণ করা শুরু করল | ও বারবার জোর দিয়ে বলতো যদি আমি ব্যবসায় অংশগ্রহণ না করি তাহলে আমার স্ত্রী হিসাবে ওকে ব্যবসার অর্ধাংশের মালিক বলে ঘোষণা করা হোক | কিন্তু আমার বাবা বোধহয় মানুষ চিনতে পেরেছিলেন। তাই আমি এক আধবার কথার ছলে এ প্রসঙ্গ তুললেও বাবা কিছুতেই রাজি হননি |

এ পর্যন্ত শুনে রাজন্যা প্রশ্ন করেছিল,

– যখন উনি বুঝতে পারলেন আপনার সাথে সম্পর্কটা কম্প্যাটিবল হচ্ছে না তখন তখনই উনি ডিভোর্স দিয়ে বেরিয়ে গেলেন না কেন? তিতলিকে কেন পৃথিবীতে আনলেন?

শিবাজী ম্লান হেসে বলেছিল,

– তিতলির জন্মানোটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট | কনসিভ করার পর ব্যাপার বুঝতে বুঝতে সমর্পিতার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল | বুঝতে পারার সাথে সাথেই অ্যাবর্শণ করার জন্য দৌড়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। আর সত্যি বলতে…

শিবাজী কে কথার মাঝখানে থেমে যেতে দেখে রাজন্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল খানিকক্ষণ | ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে শিবাজী খুব আস্তে আস্তে বলেছিল,

– সত্যি বলতে তিতলি আমার মেয়ে কিনা আমি জানিনা…

রাজন্যাকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে শিবাজী একটা বড় শ্বাস ছাড়লো, তারপরে বলল,

– তোমার হয়তো মনে হতে পারে আমি তোমার সিমপ্যাথি গেইন করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে সমস্ত কথা বলছি। আর তুমি আমার থেকে এতটাই ছোট, তোমাকে এই সমস্ত কথা বলাটা আমার উচিতও হচ্ছে না হয়তো। কিন্তু এই কথাগুলো আমি কোনদিনও কাউকে বলিনি, বলতে পারিনি | আমার মেল ইগো আমাকে বাধা দিয়ে এসেছে বরাবর। যে সময় সমর্পিতা ওর প্রেগনেন্সির কথাটা টের পেয়েছিল তার অন্তত চার পাঁচ মাস আগে থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে কনজুগাল লাইফ কিছু ছিলই না বলতে গেলে | সো আই রিয়েলি ডোন্ট নো! ইনফ্যাক্ট সমর্পিতা বাই হার্ট প্রেগনেন্সিটা কন্টিনিউ করতে চায়নি, কিন্তু শারীরিক কোন একটা জটিলতার কারণে ডাক্তার অ্যাবর্ট করতে রাজি হননি | সেই সময় এক বছর সমর্পিতা কোন মডেলিংয়ের কাজ করতে পারেনি | আমার স্ত্রী হওয়ার কারণে স্বস্তিকের সাথে কন্ট্র্যাক্টে স্পেশাল ক্লজ ঢুকিয়ে ব্যাপারটা সামলে দেওয়া গেছিল কিন্তু এই এক বছর স্টেজ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা সমর্পিতা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি | প্রেগনেন্সি পিরিয়ডে প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। আমি যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেও ওর তীব্র তীক্ষ্ণ বাক্যবানে জর্জরিত হয়ে অর্ধেক দিন মাঝ রাতের পরে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতাম | এই সময়ে সমর্পিতা ওর সব থেকে বড় নোংরা চালটা চলেছিল…

রাজন্যার চোখে প্রশ্ন দেখে শিবাজী খুব ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছিল লজ্জাজনক সেই সময়ের কথা যা একদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ওর চোখে পড়েছিল।

দোতালায় উঠে শিবাজী ঘরে সমর্পিতাকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে সৌভিকের ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে গিয়েছিল আর ঘরের ভিতর দৃশ্য দেখে সেখানেই আটকে গিয়েছিল ওর দুই পা ।

সৌভিক কতকটা অসহায় ভঙ্গিমায় বিছানা বসা, সামনে দাঁড়ানো সমর্পিতা। পরনে লম্বা ঝুলের স্কার্ট, উপরের টপ টা খুলে মাটিতে পড়ে আছে | অন্তর্বাস বিহীন উর্ধাঙ্গ সৌভিকের চোখের খুব কাছে | সমর্পিতা বলছে

– তুমি কখনো নারীসঙ্গ করোনি বলে বোঝনা | একটা রাত আমাকে দাও সৌভিক, আমি প্রমাণ করে দেব তুমি স্ট্রেইট! শিবাজীর মতন ছাপোষা মনোবৃত্তির ছেলে যে কি করে তোমাদের মতন ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মালো, আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই ‌| তুমি আর আমি কত সাকসেসফুল জুটি হতে পারি ভেবে দেখো সৌভিক | গিভ মি এ চান্স। গিভ ইয়োরসেল্ফ এ চান্স।

বলতে বলতেই সৌভিকের হাত তুলে নিয়ে নিজের বুকের উপর রেখেছিল সমর্পিতা | সৌভিক মুহূর্তেই ছিটকে গেছিল, তারপর চাপা স্বরে গর্জন করে উঠেছিল,

-আমি স্ট্রেট হই বা না হই, তুমি আমার ভাইয়ের স্ত্রী | গেট আউট ফ্রম হেয়ার | প্রেগন্যান্ট না হলে আজ এই মুহূর্তে আমি তোমার উপরে হাত ওঠাতে বাধ্য হতাম |

শিবাজীর মনে হয়েছিল পৃথিবীটা চারিদিকে চক্রাকারে ঘুরছে | কোনো রকমে টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে ফের নেমে এসেছিল | সুমিত্রার ঘরে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল,

– পিপিয়া আজকে তোমার ঘরে শুতে দেবে?

সুমিত্রা ভেবেছিলেন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আবার বোধহয় ঝামেলা হয়েছে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের ঘরে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শিবাজী যায়নি, যেতে পারে নি | সে রাতে খাওয়াও হয়নি ওর |

বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল রাজন্যার। হাত দিয়ে শিবাজীর মুখের ওপর চাপা দিয়ে বলেছিল,

– থাক, আর বলতে হবে না | আপনার কষ্ট হচ্ছে।

শিবাজী নিজের হাত দিয়ে রাজন্যার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বলেছিল,

– কষ্টটা বুকের ভেতরেই চেপে রেখে আছি এত বছর রাজন্যা। কখনো কাউকে বলতে পারব বলে মনে হয়নি | আজ আমাকে বলতে দাও।

বিকেলের পর শিবাজীর গা ফের গরম হচ্ছে দেখে আরেক দফা ক্যালপল খাইয়ে বিশ্রাম নিতে বলে নিজের ঘরে চলে এসেছে রাজন্যা। ভেতরে ভেতরে একটা রাগের আগ্নেয়গিরি ফুটছে যেন | হাতের কাছে পেলে ওই সমর্পিতাকে কয়েক ঘা মেরেই বসত হয়তো বা |

কিন্তু এই সমর্পিতার নাগাল পাবে কি করে? হঠাৎ মনে পড়ল, সমাদৃতা বলেছিল ওর দিদিও মডেল | ঝট করে মোবাইল বের করে মেসেজ করল।

– সমাদৃতা, তোমার দিদি মডেল বলেছিলে না?

কলকাতায় তখন অনেক ভোর হলেও সমাদৃতার উত্তর এলো প্রায় সাথে সাথেই

– হ্যাঁ, কেন?

রাজন্যা লিখল

– সমর্পিতা মল্লিক বলে একজন মডেলের খোঁজ চাই। তোমার দিদিকে জিজ্ঞাসা করে বলবে? খোঁজ দিতে পারবে কিনা?

কিছুক্ষণ ওদিক থেকে কোন উত্তর নেই। তারপরেই রাজন্যার ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে কলের রিং বাজা শুরু হল। ফোন ধরতেই ওদিক থেকে সমাদৃতার কাঁপা কাঁপা গলার আওয়াজ ভেসে এলো,

-সমর্পিতা মল্লিকের সঙ্গে তোমার কি দরকার?

রাজন্যা রাগী গলায় বলল,

– ওই নোংরা মহিলার সাথে আমার কোন দরকার নেই। কিন্তু ওই মহিলার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে একবার জিজ্ঞাসা করতে চাই ওকে এতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছিল?

একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল সমাদৃতা,

– সমর্পিতা মল্লিকই আমার দিদি রাজন্যা।

ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা অবাক হতো না রাজন্যা |

– তোমার দিদি! তোমার দিদি শিবাজীদার স্ত্রী ছিল? তুমি যে আমাকে বললে ওই পরিবারের সম্বন্ধে তুমি কিছু জানো না!

সমাদৃতা অপরাধী গলায় বলল,

– আসলে ওই অতীতটা এতটাই কষ্টকর যে আমরা কেউই ওই প্রসঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না…

কষ্টে রাজন্যার গলা বুজে আসছে,

– তুমি কি জানো শিবাজীদাকে কি কি সহ্য করতে হয়েছে তোমার দিদির জন্য? সে যে শুধু শিবাজীদার জীবনটাকে নরক করে দিয়েছিল তাই নয়, শিবাজীদার দাদাকে পর্যন্ত তার নোংরা খেলায় টেনে এনেছিল। ভদ্রলোক গে সেটা জেনেও প্রতিনিয়ত তাকে শরীরের লোভ দেখিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করত
– কি বলছো তুমি?

সমাদৃতার হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল

– ঠিকই বলছি | শিবাজীদা স্বস্তিকের মালিকানা কখনোই চাইবে না জানতে পারার পরে তোমার দিদি, শিবাজীদার দাদাকে কোনভাবে নিজের সাথে একটা সেক্স স্ক্যান্ডাল এ জড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল…

সমাদৃতার মাথার মধ্যে সেক্স স্ক্যান্ডাল কথাটা হঠাৎ যেন অনেকগুলো বন্ধ দরজা খুলে দিল। ভুবনেশ্বর থেকে ফেরার সময় সেই অ্যাক্সিডেন্টের আগে কি যেন বলেছিল দিদিয়া?

– একটা সেক্স স্ক্যান্ডাল! ব্যস তাহলেই আমি প্রথমে ভিকটিম সাজবো আর তারপরেই স্বীকার করে নেব যে আমি শিবাজীর নয় সৌভিকের সাথে লাইফ কাটাতে রাজি | পরিবারের কলঙ্ক ধামাচাপা দিতে ওরাও রাজি হয়ে যাবে | শিবাজী কে যদি দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সৌভিককে ম্যানিপূলেট করা আমার পক্ষে সহজ হবে।

তাহলে কি দিদিয়াই অ্যাক্সিডেন্টটা করিয়েছিল? ওই গাড়িতে তো শিবাজীদার দিল্লী যাওয়ার কথা ছিল | নেহাত অন্য গাড়িটা গন্ডগোল করল বলে আর সৌভিকদার মিটিং এর জন্য ফেরার তাড়া ছিল বলে গাড়ি বদলে ও আর সৌভিকদা তিতলিকে নিয়ে এই গাড়িতে কলকাতা ফিরতে নিয়েছিল।

এও কি সম্ভব?

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে