হৃদ মাঝারে পর্ব-১৮+১৯

0
474

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৮)

রাজন্যা আস্তে আস্তে বলল,

– আর তো বছর দুই | ফ্ল্যাটটা রেডি হয়ে গেলে তোমাদেরকে কলকাতায় নিয়ে যাব।

অমরনাথ হাসি হাসি মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন,

– এই বয়সে কি আর ঠাঁইনাড়া হয়ে কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারবো রে মা! তুই ফ্ল্যাট কিনেছিস খুব ভালো করেছিস। নিজের একটা বাড়ি থাকা খুব দরকার। এই যে আজকাল মেয়েরা অভিযোগ করে বাবার বাড়ি আছে, শ্বশুর বাড়ি আছে, কিন্তু নিজের বাড়ি নেই, তোর সে দুঃখ থাকবে না। তোর নিজের বাড়ি আছে!

রাজন্যা অবাক হয়ে তাকালো,

– কি বলছো বাবা? তোমরা না গেলে আমি একা একা ফ্ল্যাটে থেকে কি করব? এখানের বাড়ি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে বলেই আমি আরো ফ্ল্যাট বুক করলাম!
– ওরে শরিকি সম্পত্তি থাকলে অমন ঝামেলা হয়, তোর জ্যাঠারা বললেই কি আর আমি বাড়ি ছেড়ে দেবো নাকি? আমার বাবার বাড়ি, তাতে হক তো আমারও আছে।

একঝলক মায়ের দিকে তাকালো রাজন্যা। আরাধনা বলেছিলেন অমরনাথের চিকিৎসার জন্য প্রচুর খরচ তাঁর দাদারা করেছেন, তা ছাড়াও বাড়ির বাৎসরিক মেরামতি বা অন্যান্য সাধারণ খরচ গুলির কিছুই অমরনাথ কখনো দিতে পারেননি বলে খুব শিগগিরই এ বাড়ি থেকে বেদখল হতে হবে। এই বয়সে এসে বাবা-মায়ের পক্ষে আইন আদালতের ঝামেলায় যাওয়া সম্ভব হবেনা আশঙ্কা করেই রাজন্যা নিজের উপরে বেশ খানিকটা অর্থনৈতিক চাপ নিয়েই হোম লোনটা নিয়েছিল।

আরাধনা বিরস কণ্ঠে বললেন,

– বাবার সব কথায় কান দিও না | উনি তো বিছানায় শুয়ে থাকেন। বাইরের অশান্তির সবটা তো আর উনি জানতে পারেন না | এটা ঠিকই যে কেউ উঠে যেতে বললেই আমরা উঠে যাব না | এ বাড়ি যেমন তোমার জ্যাঠাদের, তেমনই তোমার বাবারও | কিন্তু যদি পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে কিছু অর্থের বিনিময়ে বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিতে হয়, তখনও তো মাথা গোঁজার একটা জায়গা লাগবে। তপু এখনো ছোট | পারিবারিক অশান্তির জন্য ওর পড়াশোনাটা নষ্ট হোক সেটা কখনোই কাম্য নয় নিশ্চয়ই?

রাজন্যা মাথা নাড়ালো,

– না না, তপু ঠিক মতন পড়াশোনা করে ওর ক্যারিয়ারে ফোকাস করুক। তবে আমি কি জ্যাঠাদের সঙ্গে একবার কথা বলবো?

অমরনাথ আপত্তি করলেন।

– থাক না! যেমন চলছে চলুক। সেরকম বুঝলে তোকে বলবো না হয়…

টুকিটাকি আর কিছু কথার পরে রাজন্যা ওর আমেরিকা যাওয়ার কথাটা বলল | আর সপ্তাহ দুই বাদে মাসখানেকের জন্য অফিসের কাজে আমেরিকা যাবে | অমরনাথ বাচ্চাদের মতন খুশি হয়ে উঠলেন | তিনি কোনদিন কলকাতাতে গিয়েই রাত কাটান নি, সেই জায়গায় তাঁর মেয়ে প্লেনে করে বিদেশে যাবে, তাও আবার অফিসের কাজ করতে, ভাবতেই গর্বে তাঁর রুগ্ন বুক ফুলে উঠছে | পারলে তখনই গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীকে জানিয়ে আসেন। রাজন্যার খুব আনন্দ হচ্ছিল বাবাকে এতটা খুশি দেখে | মনের মধ্যের ভয় আর সংশয় গুলো দূর হয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। আরাধনা গম্ভীর মুখে বললেন,

– একা একা যাচ্ছ, নিজের খেয়াল কিন্তু নিজেকেই রাখতে হবে | ও দেশের সংস্কৃতি কিন্তু আমাদের মত নয়, নিজের সম্মান নিজেকেই বজায় রাখতে হবে।

রাজন্যা মাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল |

– আমরা খুব ব্যস্ত থাকবো মা, সারাদিন অফিসের কাজকর্ম নিয়েই পড়ে থাকতে হবে। এ যাত্রা ওই দেশ ঘুরে দেখা বা ওখানকার লোকজনের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগটা পর্যন্ত পাব বলে মনে হয় না!
– না হলেই ভালো | আর অফিসের কোন বসের সাথে যাবে বলছ, তার সাথেও অতিরিক্ত মেলামেশা করো না। একলা মেয়ে পেলে সুযোগ নিতে চায় অনেকেই

রাজন্যা মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলল না | আরাধনা আবার বললেন,

– দু সপ্তাহ পরে যাবে মানে এ মাসের শেষটা ওখানেই থাকবে। ওখান থেকে টাকা পয়সা কিভাবে পাঠাবে সেটা কিন্তু ভেবে রেখো।

রাজন্যার মনে হচ্ছিল ওর খুশির বেলুনে কে যেন একটা তিন ফুটিয়ে দিল। যথাসম্ভব নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল,

– আমি তো অনলাইন ব্যাংক থেকে টাকা পাঠাই মা, অসুবিধা হবে না | আমি ঠিক তারিখ মতন পাঠিয়ে দেবো |

খানিক পরে পাড়ার দু একজন বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য রাজন্যা বেরিয়ে যেতে অমরনাথ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

– মেয়েটার উপরে বড্ড বেশি চাপ দেওয়া হয়ে যাচ্ছে আরাধনা। সত্যি তো এতটাও খারাপ অবস্থা নয়। বাড়ি থেকে দাদারা উঠিয়ে দেবার কথা তো বলেনি, বাড়ির প্রমোটারকে দেওয়ার কথা বলেছে। সে ক্ষেত্রে প্রোমোটারের দেওয়া টাকার ভাগ তো আমিও পাব।

আরাধনা গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,

– তোমার মেয়ে ব্যাংকের ইএমআই দিয়েও দিব্যি তার মাসের খরচ চালাচ্ছে, বাড়িতেও টাকা পাঠাচ্ছে। ওই বাড়ি ওরই অ্যাসেট হয়ে থাকবে। তা না হলে ওই টাকা এতদিনে পোশাক আশাক সাজগোজ বন্ধুদের পার্টির হুল্লোড়ে উড়ে যেত | পরিবারে একটু অভাব না থাকলে ছেলে মেয়ে দায়িত্বশীল হয় না। তপুর টিউশনের নাম করে যে এক্সট্রা টাকা নিয়েছি, সেও তো ওর নামেই জমা থাকছে। দ্যাখো আমি ওর সৎ মা, আমি যে খারাপ সে কথা ওর কানে তোলার মতন লোক প্রচুর আছে| তাই আমার ভালো সাজার দরকার নেই। আমি না হয় খারাপই হলাম। কিন্তু ওর ভবিষ্যৎটা সুরক্ষিত থাক।

অমরনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন | আরাধনাকে তিনি মাঝে মাঝে ঠিক বুঝতে পারেন না |

শনিবার দিন টা কোনরকমে কেটে যেতেই রাজন্যার মনটা পালাই পালাই করে উঠলো। রাতের বেলা খেতে খেতেই রবিবার সকালে কলকাতা ফিরে যাওয়ার কথাটা জানালো | তপোব্রত বলে উঠলো,

– তুই যে রোববার দিনটা থাকবি বলেছিলি দিদি?
– সেই রকমই তো ভেবেছিলাম রে ভাই, কিন্তু অফিসের মেইলে দেখছি ভিসার ছবি তোলা জাতীয় কয়েকটা দরকারি কাজ সোমবার খুব সকাল সকাল করতে হবে। তাই রবিবার বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার |
অমরনাথ একটু মন খারাপ করলেন কিন্তু আরাধনা বাধা দিলেন না |

রবিবার খুব ভোরে কলকাতার ট্রেনে উঠে পড়ল রাজন্যা। তপু স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে গেল | রাত্রে খুব ভালো ঘুম হয়নি, মাঝে মাঝেই মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে যাচ্ছিল একটাই কথা, ওর আপনজনেরা কি সত্যিই ওর আপন? নিজের মায়ের স্মৃতি রাজন্যার কিছুই নেই বলতে গেলে, পুরনো অ্যালবামের কয়েকটা সাদা কালো ছবিই ভরসা। আরাধনার কাছ থেকে কখনো মনে রাখার মতন আদর আহ্লাদ না পেলেও সে অর্থে অবজ্ঞা অবহেলাও জোটেনি | সবসময়ই একটা দূরত্ব রাখা সম্পর্ক রয়ে গেছে ওদের মধ্যে | রাজন্যাও কখনো মা বলে জড়িয়ে ধরতে পারেনি আরাধনাকে, আরাধনাও কখনো বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি মেয়ের | হ্যাঁ, কখনোই ওর পড়াশুনায় কোনো রকমের ছেদ আনতে দেননি, কিন্তু এই চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে বাড়ির অর্থনৈতিক চাহিদা যেন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে | রাজন্যর মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরিটা না থাকলে বোধ হয় আরাধনার কাছে ও একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে |

ট্রেনের দুলনিতে এক সময় ঘুম এসে গেছিল রাজন্যার | খানিক পরে চোখ খুলে দেখলো ন’টা বাজে | আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হাওড়া পৌঁছে যাবে | কি মনে করে সুমিত্রার নম্বরটা বের করে ডায়াল করল। বার দু এক রিং হওয়ার পরেই সুমিত্রা ধরলেন

– গুড মর্নিং রাজন্যা, বলো |
– হ্যালো পিসিমা? বলছিলাম তিতলি কি বাড়িতে আছে?
– হ্যাঁ বাড়িতেই আছে, কেন গো?
– আসলে আমি তো বলেছিলাম আজ পড়াতে যেতে পারবো না, তবে বাড়ি থেকে ফিরে আসছি একটু তাড়াতাড়ি। তাহলে আমি যদি সরাসরি ওখানে গিয়ে তিতলিকে আজ পড়িয়ে দিতাম |

সুমিত্রা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন,

– সে কি কথা! এত কষ্ট করতে হবে না তোমাকে। অত দূর থেকে জার্নি করে এসেই আবার পড়াতে বসবে নাকি?

রাজন্যা হেসে ফেলল,

– আমার কিন্তু কোন অসুবিধা হবে না পিসিমা। আপনার আপত্তি না থাকলে আমি সোজা ওখানেই যাচ্ছি |
– আমার আর আপত্তি কিসের? তোমার ছাত্রী তো শুনলেই তিড়িক বিড়িক করে লাফাবে!
– আচ্ছা বেশ! ছাত্রীকে বলবেন আমি এগারোটা নাগাদ পৌঁছাব।

ঠোঁটে এক টুকরো হাসি রেখেই ফোন রাখলো রাজন্যা |

এগারোটা বাজার মিনিট কয়েক আগেই সেনভিলাতে বেল বাজাল রাজন্যা | কৈলাস দরজা খুলে দিতেই একগাল হেসে রাজন্যা বলল,

– কৈলাসদা আজ কিন্তু জব্বর খিদে পেয়েছে। প্লিজ একটু কিছু খাইও।

কৈলাস বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসলো।

– তুমি যে বাড়ি থেকে সোজা আসছো সে কথা জানার পরেও পিসিমা এখনো আমাকে ইন্সট্রাকশন দেননি ভেবেছো! তুমি যাও, আমি তোমার জন্য পরোটা আর আলু ভাজা নিয়ে আসছি | চা খাবে না কফি?
– খুব নির্লজ্জের মতন আবদার করছি কৈলাস দা। কিন্তু একটু কফি খাওয়াবে প্লিজ?
– শোনো, এই বাড়িতে আমরা এইসব আবদার গুলো শোনার জন্য মুখিয়ে থাকি | তবে আজ আমার কপালে একটু অন্য ঝামেলাও আছে…

রাজন্যা ভিতরে ঢুকে বড় ব্যাগখানাকে জুতোর রাকের পাশে রাখতে রাখতে জিজ্ঞাসা করল,

– কেন গো? কি ঝামেলা?

কৈলাস কাঁচুমাচু মুখ করে বলল,

– আর বলোনা, তিতলি দিদিভাই কোন বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে গিয়ে বাটার চিকেন না কি একটা খেয়ে এসেছে, এবারে তার বায়না বাড়িতে ওরকম বাটার চিকেন আর পোলাও বানিয়ে দিতে হবে। আমি তো কখনো মুরগির মাংস মাখন দিয়ে রান্না করিনি | পিসিমাও জানেন না। ছোড়দাভাই অফিস চলে গেছে। না হলে ওই তোমাদের কি ইন্টারনেটে খুঁজে খুঁজে বার করে দেয় তাই দিতে বলতাম |

রাজন্যা হেসে ফেলল,

– এই ব্যাপার! কোনো চাপ নিও না কৈলাসদা | আমি বলে দেবো তোমাকে বাটার চিকেনের রেসিপি | ওই জিনিসটা আমিও খুব ভালো বানাতে পারি |

আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে কৈলাসের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো,

– তাই নাকি! বড় ভালো খবর দিলে | এ যাত্রা বেঁচে গেলাম তাহলে!

তিতলির ঘরে গিয়ে রাজন্যা দেখতে পেল তিতলি সেই বিরাট বড় টেডি বিয়ারটাকে পাশে বসিয়ে মন দিয়ে টিভিতে কিছু একটা দেখছে। রাজন্যা পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দেখল টিভিতে একটা কার্টুন মুভি চলছে। মিনিটখানেক চুপচাপ দেখার পরেই রাজন্যা বুঝতে পেরে গেল এটা ব্রেভ মুভি, রাজন্যার খুব প্রিয় | বড় হবার পরেও অ্যানিমেশন মুভির নেশাটা ছাড়তে পারেনি রাজন্যা। তাই অন্য কোন সিনেমা দেখার তেমন একটা নেশা না থাকলেও, নতুন কোনও অ্যানিমেশন মুভি বেরিয়েছে খোঁজ পেলেই সেটা দেখে ফেলা চাই ওর | তিতলির দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটার চোখ ছলছল করছে | আলতো করে ওর কাঁধে হাত রাখতেই তিতলি চমকে উঠে রাজন্যার দিকে তাকালো, তারপরেই একগাল হেসে বলল,

– ফেয়ারি সিস্টার তুমি তো কাল আসো নি, আজকেও আসবে না বলেছিলে | ঠাম্মি যখন বলল তুমি প্ল্যান চেঞ্জ করেছ আর তুমি আসছো আমি কত্ত হ্যাপি হয়ে গেলাম!

রাজন্যা তিতলির পাশে বসে ওকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল,

-আমারও তো এই ছোট্ট প্রজাপতিটার জন্য মন খারাপ করছিল। তাই জন্য তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম। তা প্রজাপতি, তোমার মুভি দেখতে গিয়ে চোখ ছলছল করছে কেন?

তিতলি কলকলিয়ে বলে উঠলো,

– দ্যাখো না, প্রিন্সেসটা না বুঝতে পেরে ওর মাম্মাকে একটা বাজে জিনিস খাইয়ে দিয়েছে, ওর মাম্মা তো এবারে ভাল্লুক হয়ে গেছে! এবারে কি হবে? যদি বুঝতে না পেরে কিং এবারে ভাল্লুকটাকে মেরে ফেলে?
– ওও সোনা…

তিতলিকে আবারও একটু জড়িয়ে ধরল রাজন্যা।

– ডোন্ট ওরি! ভালো লোকেদের কখনো খারাপ হয় না | সো কুইনেরও খারাপ হবে না |
– তুমি কি মুভিটা দেখেছো ফেয়ারী সিস্টার?

রাজন্যা ঠোঁট টিপে বললো,

– দেখেছি মনে হচ্ছে | বাট আমি তোমাকে বলে দেব না লাস্টে কি হয়েছে | পড়া হয়ে যাবার পরে তুমি আবার মুভিটা দেখো |

তিতলি দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,

– যদি কুইন মরে যায় তাহলে আমি দেখব না | আমার মাম্মা আমার কাছে নেই, দ্যাট ইজ ব্যাড | প্রিন্সেসের মাম্মাও যদি প্রিন্সেসের থেকে হারিয়ে যায় তাহলে সেটা স্যাড মুভি, ব্যাড মুভি | আমি স্যাড মুভি দেখবো না!
– আচ্ছা আচ্ছা! এটা স্যাড মুভিও না, ব্যাড মুভিও না, ঠিক আছে? আর কিচ্ছু বলে দেব না কিন্তু তাহলে সব সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে!
– ইয়েএএ

তিতলি তিড়িং করে একটা লাফ দিয়ে উঠলো | রিমোট নিয়ে মুভি পজ করে রাজন্যা তিতলির হাত ধরে স্টাডি ডেস্কের দিকে এগিয়ে এলো। চেয়ার টেনে বসতে না বসতেই কৈলাসদা থালায় করে দুখানা পেল্লায় মাপের পরোটা, আলু ভাজা আর এক কাপ কফি নিয়ে এসে হাজির হল।

– থ্যাংক ইউ সো মাচ কৈলাসদা!

হাত বাড়িয়ে থালা আর কফির কাপ নিতে নিতে বলল রাজন্যা। কৈলাস হাসিমুখে বললো

– পড়িয়ে নিয়ে নিচে এসো | আমাকে রেসিপি বলে দাও।

তিতলিকে খানিকক্ষণ পড়িয়ে একটা ছোট কাজ দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো রাজন্যা | ওকে দেখে হাসলেন সুমিত্রা,

– কিগো মেয়ে? কৈলাস নাকি তোমাকে দিয়ে এক্সট্রা কাজ করাবার প্ল্যান করেছে আজ? আমি বলেছি এক্সট্রা কাজের চার্জ তুই দিবি!

তিনজনেই হেসে ফেলল | রাজন্যা কিচেনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কৈলাসকে দেখিয়ে দিল কিভাবে এবং কি কি দিয়ে চিকেন টা ম্যারিনেট করতে হবে |

– এরপরে একদম ইজি কৈলাসদা | দুটো মাঝারি মাপের পেঁয়াজ কেটে নাও | ঝিরি ঝিরি করার দরকার নেই, ডুমো ডুমো হলেই চলবে | তার সাথে আধ মুঠো কাজুবাদাম ঈষদুষ্ণ জলে দিয়ে মাঝারি আঁচে মিনিট দুয়েক গরম করে নাও। একটা গোটা টমেটো পুড়িয়ে নেবে। এবারে পেঁয়াজ টমেটো কাজু মিক্সিতে বেটে নেবে | ওইটা হলো গিয়ে তোমার বাটার চিকেনের গ্রেভি। এবারে কড়াইতে সাদা তেলের সাথে মাখন দেবে, গোটা গরম মসলা ফোড়ন দিয়ে কুচো পেঁয়াজ ভেজে তার উপরে চিকেন দিয়ে নাড়াচাড়া আর লাস্টে ওই কাজু বাটা দিয়ে দেবে | খুব বেশি জল দেবে না, মিনিট দশেক কষানোর পরে অল্প গরম জল দিয়ে ফুটিয়ে তারপরে ঢেকে রাখবে | আর লাস্টে কিন্তু অবশ্যই কসুরি মেথি দেবে। ব্যাস তোমার বাটার চিকেন রেডি!

সুমিত্রা বললেন,

– রেসিপিটা তো তেমন একটা কঠিন নয়! ওই কাজু বাটাটাই আসল, তাই না?

রাজন্যা হাসলো,

– ঠিক বলেছেন পিসিমা, একবার করো কৈলাসদা, তারপরে দেখবে তুমি নিজেই এটার নানান রকম ভেরিয়েশন করে ফেলতে পারছো।

রাজন্যা ফের দোতলায় উঠে যেতে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে কৈলাস বলল ,

– মেয়েটা বড্ড ভালো। তাই না পিসিমা?

সুমিত্রা একটা শ্বাস ছাড়লেন,

– খুব ভালো | আমার বড় মনে ধরেছে |

কৈলাস চমকে তাকালো,

– পিসিমা! মনে ধরেছে মানে? আপনি কিছু ভাবছেন নাকি?

সুমিত্রা মৃদু হাসলেন,

– ভাবছি তো অনেক কিছুই, কিন্তু কেবল আমার ভাবনায় তো চলবে না | দেখা যাক, ঠাকুরের কি ইচ্ছা!

আর কিছুক্ষণ পরে তিতলিকে পড়ানো শেষ করে পিসিমা আর কৈলাসদার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাজন্যা। অন্যমনস্কভাবে হেঁটে গলি দিয়ে বেরোনোর সময় খেয়াল করল না মিডনাইট ব্লু রঙের পরিচিত হণ্ডা সিটিটা থেকে এক জোড়া চোখ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাতে তাকাতে এগুলো | ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুমিত্রার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,

– আজকে তিতলির টিউটর এসেছিল মনে হল? দেখলাম রাস্তায়!

সুমিত্রা হাসলেন।

– হ্যাঁ রে, মেয়েটা বাড়ি থেকে সোজা এখানে এসেছিল | ফোন করেছিল সকালে, আসতে চাইলো, তাই আর না করি নি | যা বুঝি, তিতলি দিদিভাইয়ের ওপরে মায়া পড়ে গেছে ওর |

আর কিছু না বলে শিবাজী দোতলায় চলে গেল। আজ অফিসের কাজ একটু তাড়াতাড়ি সেরে এসেছে | কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং ইভেন্ট পিছিয়ে দেওয়ার জন্য তমোজিৎকে নির্দেশ দিয়ে এসেছে, যাতে আমেরিকা থাকাকালীন এখানে কোন ধরনের হাঙ্গামা না হয়। একটা লিস্ট বানাতে হবে | মাস খানেকের জন্য যাওয়া, কিছু দরকারী জিনিস বাদ পড়ে গেলে মুশকিল হবে | অফিসের কাজে যথেষ্ট গোছানো হলেও বাড়ির জিনিসপত্র বা বলা ভালো নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার কাজটা শিবাজীর কোনদিনই ভালো লাগে না। ওর জিনিসপত্র কৈলাসই গুছিয়ে রাখে | লিস্ট করে কৈলাসদার কাছেই ধরিয়ে দিতে হবে, ব্যাগ গুছিয়ে দেবে | দুপুরে খেতে বসে সারভিং বোলে লালচে হলুদ রংয়ের ঘন মুরগির ঝোল টা দেখেই তিতলি হাততালি দিয়ে উঠলো,

– কৈলাস জেঠু আমার বাটার চিকেন রান্না করেছে।

কৈলাস হাতায় করে তিতলির পাতে তুলে দিতে দিতে বলল,

– খেয়ে দেখো তো দিদিভাই, কেমন হয়েছে?

তিতলি ছোট্ট আঙুলে করে একটু গ্রেভি নিয়ে জিভে ঠেকিয়েই আকাশের দিকে মুঠি ছুড়ে বলল,

– হ্যাঁ দারুন দারুন! একদম ঋষিকাদের বাড়িরটার মতন!

শিবাজী মুচকি হেসে বলল,

– কি ব্যাপার কৈলাসদা? কই কোনদিন তো আলুর ঝোল ছাড়া অন্য কিছু খাওয়াওনি। আজ হঠাৎ বাটার চিকেন?
– কি করব? দিদিভাই এমন বায়না ধরল…
– আমিও তো মাঝে মাঝে বায়না করতাম অন্যরকম বানাও! তুমি তো খালি বলতে তুমি জানো না!

কৈলাস এবার একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল,

– সত্যিই তো জানি না | এইসব দোকানের রান্না কি কখনো আমি করেছি নাকি? জানিই না কি করে করতে হয় | নেহাত আজকে রাজন্যা দিদি শিখিয়ে দিল বলে তাই।

শিবাজী ভ্রু কুঁচকে ফেলল,

– রাজন্যা শিখিয়ে দিল?

সুমিত্রা হাসিমুখে বললেন,

– হ্যাঁ তো! একেবারে কোন জিনিস কতটা দিতে হবে, কতক্ষণ রাখতে হবে, কিভাবে করতে হবে সবটা ও-ই বলে দিয়ে গেছে…

শিবাজী চোখ বড় বড় করল | ওই ক্ষেপীর এইসব গুণও আছে!

(ক্রমশ)

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৯)

ব্যাংকের একটা কাজ সেরে অফিসে আসতে সামান্য দেরি হল শিবাজীর। অবশ্য ওর দেরিটাও বাকিদের তুলনায় তাড়াতাড়ি | এখনো সেরকম কেউ অফিসে পৌঁছয়নি | ওডিসিতে ঢোকার আগে ছোট মিটিং রুমটা থেকে সৌম্যর রাগত গলার বকাবকি শুনে দরজা ঠেলে উঁকি দিল। সৌম্য সাধারণত চেঁচামেচি করার ছেলে নয়। সেই কারণেই কৌতুহল। কেন যেন আন্দাজ করেছিল বকুনি খাওয়া ব্যক্তিটি রাজন্যা ছাড়া আর কেউ নয়। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, কাঁচুমাচু মুখ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে রাজন্যা | শিবাজী ভ্রু নাচাল

– কি হয়েছে?

সৌম্য হতাশ সুরে বলল,

– আর বোলো না | বারবার করে বলে দিলাম মাধ্যমিক থেকে সবকটা সার্টিফিকেট অরিজিনাল কপি নিয়ে আসতে, ভুলে গেছে।

শিবাজী কাঁধ ঝাঁকালো,

– তো কি হয়েছে? ওর বাড়ি তো এখান থেকে এখানে, গিয়ে নিয়ে আসুক!

রাজন্যা মিনমিন করে বলল,

– অরিজিনাল গুলো এখানে নেই। বাড়িতে। মানে বোলপুরের বাড়িতে।

শিবাজী চোখ কপালে তুলে ফেলল,

– তুমি তো বোলপুর থেকেই এলে! মানে বোলপুরেই তো গেছিলে অফিস থেকে শুক্রবার?

রাজননা একটা ঢোঁক গিলে মাথা নাড়লো | সৌম্য সামনের চেয়ার টেনে ধপাশ করে বসে পড়ল,

– তা না হলে আর বলছি কি! বারবার করে বলে দিয়েছিলাম মনে করে ডকুমেন্টগুলো নিয়ে আসতে | উফ! কি যে করিস রাজ! যাক গে, এক কাজ কর, ইমিডিয়েটলি বাড়িতে কারোকে ফোন করে বল স্পিড পোস্ট কিংবা কুরিয়ার করে পাঠাতে, তাহলে হোপফুলি দু-তিন দিনের মধ্যে চলে আসবে | কিন্তু ট্রাভেল ডেস্ক আজকের মধ্যে চেয়েছিল ডকুমেন্টগুলো, দেখি কি করে ম্যানেজ করি ।

শিবাজী একবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা রাজন্যার দিকে তাকালো তারপর জিজ্ঞাসা করলো,

– তোমার তো রবিবার রাত্রে ফেরার কথা ছিল, তাই না? তুমি কাল সকালেই তাড়াহুড়ো করে ফিরে এলে কেন?

রাজন্যা একবার মুখ তুলে তাকালো, তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল,

– কিছু না, ভালো লাগছিল না থাকতে।

শিবাজী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কিছু একটা হয়েছে, যে কারণে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও ভুলে গেছে মেয়েটা। সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

– দেখো ট্রাভেল ডেস্কে একটু রিকোয়েস্ট করে দু তিন দিন টাইম নাও।

মিটিং রুম থেকে বেরিয়েই ফোন নিয়ে সিঁড়ির কাছে দৌড়াল রাজন্যা | আরাধনার নাম্বারে ডায়াল করল | রিং হয়ে যাচ্ছে, তিনবার, চারবার, পাঁচবার | রাজন্যা নিজের মনেই পা দাপাচ্ছে | সিঁড়ি দিয়ে চলাফেরা করা দু-একজন লোক অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে তাকাতে গেল | সাতবার রিং হয়ে যাওয়ার পরে ওদিক থেকে আরাধনা ধরলেন,

– কতক্ষণ ধরে রিং হয়ে যাচ্ছিল! ফোন ধরছিলে না যে?
– এই সময় আমি রান্না ঘরে থাকি জানোই তো | সবার সবকিছু গুছিয়ে রেখে স্কুলে বেরোবো | তা কি হয়েছে?

রাজন্যা হড়বড় করে বলল,
– একটা গন্ডগোল করে ফেলেছি! অরিজিনাল মার্কশিট আর সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে আসার কথা ছিল, ভুলে গেছি। তপু কি ওগুলো একটু কুরিয়ার করে দিতে পারবে আমার কলকাতার ঠিকানায়?

আরাধনা কয়েক মুহূর্ত চুপ | রাজন্যা অধৈর্য স্বরে বলে উঠলো,

– বলো না! তপু তো তিনটে নাগাদ স্কুল থেকে চলে আসবে | তখন করলেও হবে |

আরাধনা কেটে কেটে বললেন,

– তোমার বিদেশ যাওয়ার কথা শুনেই আমি বুঝেছি ভিসার জন্য এগুলো লাগবে। বাড়ি গিয়ে ব্যাগটাও খোলোনি মনে হচ্ছে | দেখো ব্যাগের ভিতরের দিকের চেনে একটা হলুদ রঙের ফাইল আছে। ওর মধ্যে সব ডকুমেন্টস আছে।

রাজন্যা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল,

– আমার ডকুমেন্টগুলো তুমি দিয়ে দিয়েছো?
– হুম | দেখে নাও, কিছু মিসিং থাকলে ফোনে জানাও |

রাজন্যা প্রায় লাফাতে লাফাতে মিটিং রুমে চলে এলো | তখনো সৌম্য আর শিবাজী কিছু আলোচনা করছিল, দুজনেই ঘুরে তাকালো |

– সৌম্যদা, মা বলছে ডকুমেন্ট আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল | আমি চট করে একটু বাড়ি থেকে আসি?

শিবাজী একটু অবাক হলো | রাজন্যার মা নিজে থেকে আন্দাজ করে ডকুমেন্ট মেয়ের ব্যাগে ভরে দিয়েছেন! বোলপুরের মতন মফস্বল এলাকার মহিলা এই ধরনের বিষয় আন্দাজ করতে পেরেছেন! ভদ্রমহিলাকে বুদ্ধিমতী বলতে হবে!

রাজন্যা নিজের ডেস্কে এসে বসতেই মণীষা ওর কাছে উঠে এলো

– রাজন্যা আমার না আইডিটা লক হয়ে গেছে, আনলক করার জন্য সিস্টেমে একটা রিকুয়েস্ট রেইজ করতে হবে। একটু দশ মিনিটের জন্য লগ ইন করতে দেবে?

ওদের অফিসের একটা অনলাইন সিস্টেম আছে, যেখানে প্রত্যেক এমপ্লয়ির সমস্ত তথ্য জমা থাকে। যেকোনো ধরনের কাজ করতে গেলে যেমন ছুটির আবেদন করতে হলে অথবা ল্যাপটপে কোন নতুন সফটওয়্যার ইন্সটল করতে হলে বা প্রতি মাসের স্যালারি স্লিপ দেখতে হলে ওই সিস্টেমে নিজের আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকতে হয়। নিরাপত্তার খাতিরে প্রতি মাসে পাসওয়ার্ড বদল করা বাধ্যতামূলক | না করলে অথবা বারবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলে আইডি সাময়িকভাবে লক হয়ে যায়। তখন নিজের ল্যাপটপেও আর লগইন করা যায় না |

রাজন্যা মনীষার দিকে ফিরে বলল,

– আমি তো একটু বেরোচ্ছি, আমি এসে দিই? আর নয়তো অনুরাগ কে বলো…
– ওরা তো কেউ আসে নি আসলে | আমার একটা কাজ একটু বাকি ছিল, তুমি একটু লগইন করে দিয়ে যাও, আমি জাস্ট আমার আইডির রিকোয়েস্টটা করেই আবার তোমার ল্যাপটপ লক করে দিচ্ছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে…

রাজন্যা ঝপাঝপ কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে ল্যাপটপ আনলক করে মণীষার দিকে এগিয়ে দিয়ে, পার্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাড়ি গিয়ে ব্যাগের ভিতরের চেনে সত্যি সত্যি হলুদ ফাইলের মধ্যে সমস্ত অরিজিনাল ডকুমেন্টগুলো পেয়ে গেল। ফাইলটা তুলে দুবার মাথায় আর বুকে ঠেকিয়ে আবার অফিসে ফিরে এলো রাজন্যা। সবটা মিলিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল । সৌম্যর সাথে কথা বলে ডকুমেন্ট জমা দিয়ে যখন নিজের কাজ নিয়ে বসলো ততক্ষণে প্রায় লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে | আজ লাঞ্চের পরে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে | একটা নতুন ধরনের কাজের প্রুফ অফ কনসেপ্ট হিসাবে ও আর মণীষা কাজ করেছে। দুজনে দুটো পদ্ধতিতে | সেটারই ডেমনস্ট্রেশন আছে। রাজন্যার কাজ করাই আছে, একটা ওয়ার্ড ফাইল খুলে পরপর ইনস্ট্রাকশনের স্টেপগুলো লেখা শুরু করল | যেকোনো কাজের সাথে তার একটা ডকুমেন্ট না রাখলে ওর বড় অস্বস্তি হয়।

মিটিং শুরু হল | প্রথমে মণীষা ওর নিজের কাজটা প্রেজেন্ট করলো | সৌম্য শিবাজী স্বয়ম ছাড়াও সাবর্ণদা আছেন, তা ছাড়াও ভিডিও কলে আরো দুজন সিনিয়র ব্যক্তি আছেন। মণীষার ডিজাইনের ধরন এবং কাজের খুঁটিনাটি শিবাজীর তেমন একটা পছন্দ না হলেও এটা দিয়ে যে সমস্যার সমাধান হবে সে বিষয়ে সকলেই একমত হলো | এক দফা প্রশংসা সূচক কথাবার্তার পরে রাজন্যার পালা এল ।

রাজন্যা রীতিমতো আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রথমে তার কাজের পদ্ধতি এবং স্টেপ বাই স্টেপ কি কি করা হয়েছে ডকুমেন্ট খুলে সেটা সকলকে বোঝাল | তারপরে নিজের ল্যাপটপ থেকে চালাল প্রোগ্রামখানা। কিন্তু এক দুই স্টেপের পরেই স্ক্রিনে ভুলভাল মেসেজ আসা শুরু হলো। রাজন্যা হতভম্ব হয়ে গেল | কাজ ওর শুক্রবার সকালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল | অফিস থেকে বেরোনোর আগে সমস্তটা ভালোভাবে টেস্টও করেছিল | সকলের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে প্রোগ্রামটা আবার শুরু থেকে শুরু করল, কিন্তু আবারো একই বিপত্তি | শিবাজীর ভ্রু কুঁচকে গেছে | সাবর্ণদার মুখে ও বিরক্তির আভাস। সৌম্য ফিসফিস করে বলল,

– কিরে, তুই যে বললি টেস্ট করেছিস?

রাজন্যা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

– টেস্ট করেছিলাম সৌম্যদা, সব ঠিক চলছিল।

সাবর্ণ ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ঠিক আছে, টেক ফাইভ টেন মিনিটস | স্ক্রিন প্রেজেন্ট করা বন্ধ করে চট করে দেখে নাও কোডে কিছু বদল করতে হবে কিনা |

সাবর্ণদাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজন্যা ঝপ করে কোডটা খুললো। মনে হচ্ছে ছোটখাটো কিছু গন্ডগোলের জন্য এমনটা হচ্ছে। কিন্তু দু একটা পাতা দেখার পরেই চোখ কপালে উঠলো | বেশ কিছু অংশ নেই | নেই মানে জাস্ট নেই, হাওয়া! তাড়াতাড়ি ফাইলের তারিখ চেক করল | আজ সকালে মডিফাইড | ঝট করে মণীষার দিকে তাকালো রাজন্যা। নিরীহ মুখ করে বসে আছে মেয়েটা। মনে মনে দাঁত চিরবিড়ি করল রাজন্যা, তার মানে সকালে যখন ল্যাপটপ নিয়েছে তখনই কিছু করেছে ওই শয়তান | কিন্তু রাজন্যার বরাবরের অভ্যাস দিনের শেষে সমস্ত কাজের একটা ব্যাকআপ রাখা | চটপট ব্যাকআপ খুলে কোড নিজের মেশিনে কপি করে একবার চালিয়ে দেখে নিল | তারপরেই মুখ তুলে বলল,

– সাবর্ণদা, আই এ্যাম রেডি। একটা ছোট গন্ডগোল হয়েছিল।
– গো অ্যাহেড…

প্রেজেন্টেশনের বাকি অংশ মসৃণ ভাবেই চলল। ডিজাইন এবং ফাংশন দুইই চমৎকার এবং সাবর্ণদা এবং অপর দুই সিনিয়র ব্যক্তিও রাজন্যার কাজটাকেই নির্বাচন করলেন । মিটিং শেষ হলো | রাজন্যা ল্যাপটপ তুলে নিতে নিতে দেখলো মণীষা ক্রুর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে | রাজন্যাও পাল্টা একটা রাগী চাহনি নিক্ষেপ করল মণীষার দিকে | দুই মেয়ের এই চোখে চোখে কথাটুকু চোখ এড়ায় নি শিবাজী সেনের | এক এক করে যখন সকলে ঘর থেকে বেরোচ্ছে, শিবাজী একটু গলা খাঁকারি দিল।

– রাজন্যা একটু ওয়েট করে যাও।

রাজন্যা ল্যাপটপ বগলদাবা করে মিটিং রুম থেকে বেরোতেই যাচ্ছিল, শিবাজীর গম্ভীর গলার আদেশ শুনে থমকে গেল | মণীষা বেরোনোর আগে ওর দিকে একটা বাঁকা চাহনি দিয়ে গেল। শিবাজী এগিয়ে এসে মিটিং রুমের দরজাটা চেপে বন্ধ করে রাজন্যার দিকে ফিরল,

– তোমার কি হয়েছে বলোতো? ইম্পর্টেন্ট ডকুমেন্ট নিয়ে আসতে ভুলে যাচ্ছ, টেস্ট না করে কোড চালিয়ে দিচ্ছ! হোয়াট ইজ রং উইথ ইউ?

রাজন্যা মুহূর্তেই হাউমাউ করে উঠলো,

– শিবাজী দা ডকুমেন্ট না আনার গন্ডগোলটা আমি করেছি আমি মানছি | আমি ব্যক্তিগত কারণে একটু ডিস্টার্বড ছিলাম। কিন্তু কোড আমি গত সপ্তাহেই কমপ্লিট করে রেখেছিলাম এবং টেস্ট করেও রেখেছিলাম।
– ওহ্ রিয়েলি! তাহলে আজকে কি হলো? কোড নিজে নিজেই ভুলভাল হওয়া শুরু করল?
– মোটেই না! এসব ওই মণীষাদির কাজ…

শিবাজী ভ্রু তুলল,

– মণীষার কাজ! হাউ? এক্সপ্লেইন করো |
– আমার প্রোগ্রামটা যাতে ওর তার থেকে খারাপ দেখানো যায় তাই ও খানিকটা কোড ডিলিট করে দিয়েছিল শিবাজীদা!
– আচ্ছা! আর সেটা কি করে করল? কোড তো তোমার ল্যাপটপে ছিল! কোন সার্ভারেও ফেলা ছিল না | সো হাউ ডিড শী ম্যানেজ টু ডিলিট ইউর কোড?

রাজন্যা উত্তেজিত হয়ে পড়ল,

– শিবাজীদা আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না? আজ সকালে মণীষাদি আমাকে বলল ওর আইডি লক হয়ে গেছে, তাই আমার সিস্টেম থেকে রিকোয়েস্ট রেইজ করবে | আর এই কোডের সমস্যাটা চেক করতে গিয়ে আমি দেখলাম আজ সকালে আমার কোডের মডিফাইড ডেট টাইম দেখাচ্ছে। কখন জানেন? সকাল দশটা পাঁচ, যখন আমি অফিসেই ছিলাম না। বাড়ি গিয়েছিলাম ডকুমেন্ট আনতে!

শিবাজীর কণ্ঠস্বর বরফের মতো শীতল

– আর ইউ ইভেন লিসেনিং টু ইয়োর ওন ভয়েস? কি বলছ তুমি জানো?

রাজন্যা ল্যাপটপ টেবিলের ওপরে রেখে হাত ঝাঁকালো,

– নিশ্চয়ই জানি! বুঝতে পারছি মণীষাদির মত একজন সিনিয়র রিসোর্সকে ব্লেম করছি সেই ব্যাপারটা আপনার পছন্দ হচ্ছে না!

শিবাজী হতাশ ভাবে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। তারপর আঙুল দেখিয়ে বলল

– বসো

রাজন্যা বসলো বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুটছে | মণীষার কান্ডটার জন্য রেগে তো আছেই তার উপরে শিবাজীদা যে এটা বিশ্বাস করতে চাইছেন না, তার জন্য আরো বেশি করে রাগ হচ্ছে।

– যেটা বললে সেটা আরেকবার বলো…

শিবাজী খুব শান্ত স্বরে বলল | রাজন্যা অধৈর্য গলায় বলল,

– বললাম তো মণীষাদির আইডি লক হয়ে গেছিল বলে আমার সিস্টেম থেকে রিকোয়েস্ট রেইজ করেছিল। আর তখন…
– ওয়েট ওয়েট ওয়েট | মণীষা যখন রিকোয়েস্ট রেইজ করছিল, তুমি কোথায় ছিলে?
– আমি তখন ডকুমেন্ট আনতে গেলাম না?
– তার মানে তুমি বলতে চাইছো তোমার সিস্টেমে আইডি পাসওয়ার্ড দিয়ে মণীষাকে এ্যাকসেস দিয়ে তুমি সামনে থেকে চলে গেছিলে, তাইতো?

রাজন্যা হুড়মুড় করে আরো কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল | এতক্ষণে বিষয়ের গভীরতাটা ওর মাথায় ধাক্কা দিয়েছে | ওদের কোম্পানিতে পাসওয়ার্ড শেয়ার করাটা একটা সিকিউরিটি ভায়োলেন্স বলে গণ্য করা হয়। মণীষাকে নিজের অনুপস্থিতিতে ওর মেশিনে কাজ করতে দিয়েছে বললে মণীষা কি করেছে সেটা দেখার আগে ওর বিরুদ্ধেই শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজন্যার মুখ চোখ শুকিয়ে যেতে দেখে শিবাজী বুঝলো মেয়েটা এতক্ষণে নিজের ভুলটা ধরতে পেরেছে |

– তোমাকে কিন্তু আরো অনেক কেয়ারফুল হতে হবে রাজন্যা। অনসাইটে যাচ্ছ মানে ক্লায়েন্টের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে, কাজ করবে। সেখানে কিন্তু এই ধরনের ভুল করা চলবে না | চাকরি পর্যন্ত চলে যেতে পারে।

পাংশু মুখে ঘাড় উপর নিচে করল রাজন্যা।

– ঠিক আছে | তবে আমি চাইবো এই নিয়ে তুমি মণীষার সাথে কোন ঝামেলা না করো | ডোন্ট ওয়ারি, আমি অবশ্যই ওর সাথে কথা বলবো। মনে থাকবে?

একেবারে কিছু না বলে ছেড়ে দিতে হবে ভাবলেই গা রি রি করছে | রাজন্যাকে গোঁজ হয়ে থাকতে দেখে শিবাজী আবার জিজ্ঞাসা করল,

– কি হলো? কথাটা কানে গেল?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়াল রাজন্যা।

– ঠিক আছে, সীটে যাও |

রাজন্যা টেবিল থেকে ল্যাপটপ তুলে নিয়ে দরজা খুলে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই শুনতে পেলে পিছন থেকে শিবাজী বলছে,

– বাটার চিকেনটা দারুন হয়েছিল বাই দা ওয়ে |

ওখানেই থেমে গেল রাজন্যা | চোখ গোল গোল করে পিছন ফিরলো

– আপনি খেয়েছেন!
– খাবো না কেন?

শিবাজী হাসছে।

– না মানে আপনি বাটার চিকেন টিকেন খান? পিসিমা তো বলেন আপনি শুধু সবকিছু সেদ্ধ খান!
– বাবা পিপিয়া এসব নিয়েও আলোচনা করে নাকি? নাহ্, আমি সব সেদ্ধ খাই না | তবে সকাল সকাল তেল চুপচুপে লুচি আর আলু ভাজাটা আমি ঠিক নিতে পারি না |

খানিকটা নিজের মনে গজগজ করার মতো করে রাজন্যা বলল,

– লুচি আলু ভাজা কি আর লোকে রোজ রোজ খায়? কিন্তু ছুটির দিনে একটু লুচি পরোটা না হলে সেটাকে ছুটির দিন মনে হয় নাকি!

শিবাজী হেসে ফেলল,

– এক মাসের মধ্যে পিপিয়ার দ্বারা এতোখানি প্রভাবিত হয়ে পড়তে আমি এই প্রথম কারোকে দেখছি |
– প্রভাবিত হতে বয়ে গেছে! আমি নিজেও এই মতেই বিশ্বাসী।

রাজন্যা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে শিবাজী নিজের মনেই হাসলো একটু | এই মেয়েকে নিয়ে এক মাস বেশ ভুগতে হবে বোঝা যাচ্ছে। আচমকাই ফোনটা বেজে উঠলো, অপরিচিত নাম্বার তবে ট্রু কলারে সবুজ দেখাচ্ছে। তার মানে কোন স্প্যাম নয় আশা করা যায়, ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল শিবাজী।

– হ্যালো…

ওদিক থেকে মহিলা কন্ঠে ভেসে এলো,

– হ্যালো, আমি কি মিস্টার শিবাজী সেনের সাথে কথা বলছি?
– হ্যাঁ বলছি।
– আমার নাম তমালিকা আচার্য | আমি সমর্পিতা মল্লিকের লিগ্যাল এডভাইজার | আপনাকে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছিল, আশা করি আপনি সেটা পেয়েছেন?

শিবাজীর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল | দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

– হ্যাঁ পেয়েছি |
– ওকে | তাহলে আপনার বক্তব্যটা একটু জানতে পারলে ভালো হতো। আপনি কোন অপশনটা নিতে চাইছেন?
– দেখুন, এই বিষয়ে আমি কোন থার্ড পার্সন এর সাথে কথা বলবো না | সমর্পিতা কে বলবেন যেন ও সরাসরি আমার সাথে কথা বলে |

ওদিক থেকে মেয়েটির নম্র উত্তর ভেসে এলো,

– আই এম সরি স্যার কিন্তু এই বিষয়ে আপনাকে আমার সাথেই কথা বলতে হবে। অথবা আপনি যদি কোন লিগাল এডভাইজার অ্যাপয়েন্ট করে থাকেন তাহলে তার সাথে আমি কথা বলব | আমার ক্লায়েন্টের সাথে আপনার কোন ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে, সেটা আলাদা ব্যাপার কিন্তু লিগাল ব্যাপারে যাবতীয় কথাবার্তা আমার মাধ্যমেই হবে।

শিবাজী কোনরকমে একটা আচ্ছা বলে ফোন কেটে দিল |

মিটিং রুমের দরজাটা হঠাৎ দুম করে খুলে গেল, রাজন্যা মাথা বাড়াল,

– শিবাজীদা একটা দরকারি কথা ছিল।

শিবাজী রুক্ষ স্বরে বলল,

– এখন না রাজন্যা | প্রজেক্ট রিলেটেড কিছু হলে সৌম্যকে বলো, আমি পরে দেখে নেব | প্লিজ গো অ্যাওয়ে…

রাজন্যা মুখ চুন করে বেরিয়ে এলো। এই লোকটা এইরকম অদ্ভুত কেন? মুহূর্তের মধ্যে মুড বদলে বদলে যায়!

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে