#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৭)
মেয়েকে ডাকতে এসে আগে থেকেই ওকে উঠে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন মাধবী |
– কিরে! আজ এত ভোর ভোর উঠে পড়েছিস?
– হঠাৎ পায়ে ব্যথা করছিল মা | শুয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছিল, উঠে বসার পরে ঠিক আছে
মাধবীর চোখ দুটো ছল ছল করে এলো | এমন ছটফটে প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন যেন একটা ঘরে আর একটা চেয়ারে বন্দী হয়ে গেছে | চিকিৎসা চলছে ঠিকই, কিন্তু কবে যে তাতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে তার কোন গ্যারান্টি ডাক্তাররা দিতে পারেননি। আর একটু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করা গেলে মেয়েটাকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো যেত | মাধবী ভেবেছিলেন বড় মেয়ে ফ্যাশন দুনিয়ায় নাম করার পরে নিজে থেকেই বোনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে | কিন্তু মিঠি সে ধরনের কোনো কথা নিজে থেকে তো বলেই নি। কয়েকবার মাধবী ফোনে কথা বলার সময় এ প্রসঙ্গ তোলায় কায়দা করে এড়িয়ে গেছে। বলেছে ‘আমার আয় বেড়েছে ঠিকই মা, কিন্তু নিজেকে মেন্টেন করার জন্য ব্যয়ও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে | হাতে এমন কিছু টাকা থাকে না আমার।’
বছর কয়েক আগে সুমিত্রা একবার বাড়ি এসে প্রস্তাব দিয়েছিল ওদের ব্যবসার ট্রাস্ট ফান্ড থেকে দিঠির চিকিৎসা স্পন্সর করার। কিন্তু ওই বাড়ির টাকায় মেয়ের চিকিৎসা করাতে চাননি মাধবী | রীতিমতো অপমান করেই ফেরত পাঠিয়েছিলেন এক সময়কার বান্ধবীকে।
মাকে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখে সমাদৃতা চেয়ার সমেত এগিয়ে এসে মাধবীর হাত ধরল,
– কি হলো মা? আবার কি ভাবতে বসলে?
মাধবী মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
– তোকে এভাবে চেয়ারে বসে থাকতে দেখতে ভালো লাগে না রে মা!
– চিন্তা কোরো না, ডাক্তার তো বলেছেন বছর দুয়েক পরে আস্তে আস্তে পায় সাড় ফিরবে।
– দু’বছর এখনো অনেক দেরি
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাধবী
– এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম মা, আর দুটো বছর অপেক্ষা করতে পারব না?
মেয়েটা সহজে ভেঙে পড়ে না | ওকে দেখেই মনে বল জোটান মাধবী | জোর করে মন খারাপ ঝেড়ে ফেলে বলে ওঠেন,
– চা খাবি তো? তোর বাবা জিলিপি আনতে গেছে। ও ঘরে চলে আয় |
– আসছি, তার আগে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মা?
– হ্যাঁ রে বল
– তোমার দিদিয়ার সাথে সম্প্রতি কথা হয়েছে?
মাধবী চমকে উঠলেন। সমর্পিতার সাথে নিয়মিত কথা তাঁর হয় না | মেয়ে নিজে থেকে বিশেষ ফোন করে না, তিনিই করেন। শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে সব সময় ফোন ধরতেও পারে না | তবে দিন সাতেক আগে ফোন করেছিল | প্রথমেই কিছু না বলে প্রশ্ন করলেন,
– কেন বলতো?
– এমনিই, দিদিয়ার সাথে কতদিন কথা হয় না | আমার মোবাইল নাম্বার তো বদলায়নি, ও তো আমাকে একটু ফোন করতে পারে।
মাধবী চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে বললেন,
– ও তো খুব ব্যস্ত রে মা। জানিসই তো।
– এত ব্যস্ত মাসে একবারও ফোন করতে পারে না মা! বলো না লাস্ট কবে কথা হয়েছে? বলল কবে বাড়ি আসবে?
মাধবী কয়েক মুহুর্তে চুপ করে থেকে বললেন,
– এখনই মনে হয় আসবে না | তাছাড়া তোর বাবাকেও তো জানিস, মিঠি আসলেও কি তোর বাবা খুব ভালোভাবে তাকে অভ্যর্থনা করবে? থাক্, তার চাইতে দূরেই থাক, সফল হোক | তুই আয়, আমি চা বসালাম
রান্নাঘরে গিয়ে সসপ্যানে তিন কাপ জল বসিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন মাধবী | সেদিন সমর্পিতার ফোন পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন | অন্তত এতদিনে মেয়েটা নিজে থেকে ফোন করেছে। কিন্তু দুই চারখানা কুশল বিনিময়ের পরেই সমর্পিতা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিল | বাড়ির উইল সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, এই বাড়ি এবং রামপুরহাটের দেশের বাড়ি। হালকা ভাবেই উত্তরে মাধবী জানিয়েছিলেন যে সবকিছুই ওদের দুই বোনেরই | ভেবেছিলেন হয়তো পরিচিত কারো সাথে এ প্রসঙ্গে কথা হওয়ার জের টেনে মেয়ে এ কথা জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু ভুল ভেঙ্গেছিল মেয়ের পরের কথায়।
– আচ্ছা মা, আমি বাবার অবাধ্য হয়েছি বলে তো বাবার রাগ এখনো আছে | কিন্তু তার জন্য নিশ্চয়ই আমার অধিকার থেকে আমি বঞ্চিত হবো না?
মাধবী অবাক এবং খানিকটা অসন্তুষ্ট হলেও উত্তরে বলেছিলেন,
– তোমার বাবা তোমার উপরে রেগে আছে ঠিকই , কিন্তু বাবার কর্তব্য থেকে কোনদিনও সরে আসেনি। আসবেও না | এটুকু তোমার অন্তত বোঝা উচিত |
– তাহলেও বলা যায় না! আর বোনের চিকিৎসার পিছনে তো খরচ হয়ে যাচ্ছে | যদি কখনো আবার ওই বাড়ি বিক্রি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে? তার চেয়ে দুই বাড়িতে আমাদের দুজনের সমান সমান ভাগ না করে বাবা আমাকে রামপুরহাটের বাড়িটা এখনই লিখে দিক। এই বাড়িটা বোনের থাক!
মেয়ের কথার উত্তরে মাধবী কিছুই বলতে পারেননি, নির্বাক হয়ে ভাবছিলেন নিজের আত্মজাকে চিনতে কি এতটাই ভুল করেছেন! তখনই সমর্পিতা এ নিয়ে পরে আবার কথা বলবে বলে ফোন কেটে দিয়েছিল | একথা সত্যেনকে বলেননি মাধবী | আজ সমাদৃতাকেও বলতে পারলেন না | তবে যে কোনো কারনেই হোক, বড় মেয়ে সম্পত্তি নিয়ে এই মাত্রায় সচেতন হয়ে উঠেছে সে বিষয়টা তাঁর মনের মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছে |
সৌম্যর কাছ থেকে কথাটা শোনার পর পাক্কা দুই মিনিট ভ্যাবলার মতন বসেছিল রাজন্যা। আমেরিকা যেতে হবে ওকে, তাও আবার মাত্র দুই সপ্তাহ পরে | সৌম্য ওর মুখের সামনে দুই আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে শব্দ করল,
– কিরে! এরকম ব্যোমকে গেলি কেন? কাজের বিষয়ে তো তোকে কখনো এরকম থতমত খেতে দেখি না!
রাজন্যা আমতা আমতা করে বলল,
– না, ইয়ে মানে…
– না মানের কি আছে? তুই টেকনিক্যাল ব্যাপার স্যাপার ভালো বুঝিস, তাছাড়া প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে তোর ধারণাও অন্যান্য জুনিয়রদের থেকে বেটার | আর অনসাইট যাওয়ার অপরচুনিটি এসেছে, তোর তো খুশি হওয়া উচিত রে!
রাজন্যা একটু মাথা চুলকে বলল,
– সৌম্যদা, আসলে আমি তো কখনো প্লেনে চড়িনি | দেশের বাইরে দূরের কথা, দেশের ভিতরেও প্লেনে চড়িনি । এয়ারপোর্টেই যাইনি কখনো।
সৌম্য হেসে ফেলল,
– তার জন্য চিন্তা কি? একলা তো আর যাবি না! শিবাজী দা থাকবে তো!
কে থাকবে! রাজন্যার মনে হল ও চেয়ার থেকে পড়ে যাবে এবারে। এতক্ষণ ভাবছিল সৌম্য আর ও যাবে | কিন্তু সৌম্য যাবে না? শিবাজীদা যাবে? আর শিবাজীদার সাথে রাজন্যা যাবে? গোটা এক মাসের জন্য? রাজন্যার মনে হল বুকের ভিতর এত জোরে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে যে সামনে বসা সৌম্যদাও বোধহয় সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
– সন্ধ্যাবেলার মধ্যে ট্রাভেল ডেস্ক থেকে ই-মেইল এসে যাবে | সাবর্ণদা কথাবার্তা বলা শুরু করে দিয়েছে যাতে ভিসার প্রসেসটা ফার্স্ট ফরওয়ার্ড হয় | কোনো রকম চাপ হওয়া উচিত নয়, শুধু রাত্রিবেলা অবশ্যই ইমেইলটা চেক করবি, কোনো ডকুমেন্ট যদি ফিজিক্যালি জমা দিতে হয় তাহলে কাল নিয়ে আসবি |
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রাজন্যা শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করল,
– এই ক্লায়েন্টের অফিসটা কোথায় সৌম্যদা? মানে আমরা আমেরিকার ঠিক কোথায় যাব?
সৌম্য হাসলো,
– জায়গাটার নাম ওয়েস্ট ডে ময়েন | আইওয়া স্টেট | শিকাগো থেকে ঘণ্টা দেড়েকের ফ্লাইট | তোদের কি ধরনের ব্রেকআপ দেবে জানিনা, হয় দিল্লী হয়ে আর নয়তো দোহা হয়ে যাবি।
– মানে একটার বেশি প্লেনে চড়তে হবে!
রাজন্যা কে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে দেখে সৌম্য বলল,
– টেনশন এর কিছু নেই | তোর টিকিট পুরোটাই একসাথে হবে। দিল্লি থেকে শিকাগোটাই লম্বা ফ্লাইট, চৌদ্দ পনের ঘন্টা লাগবে।
– প-নে-র ঘণ্টা প্লেনে!
রাজন্যা চোখ গোল গোল করে ফেলল |
– ডিসটেন্স টা তো অনেকটা রে রাজ | সময় তো একটু লাগবেই…
– ওই ঘুপচি চেয়ারের মধ্যে হাত পা তুলে বসে থাকতে হবে পনের ঘণ্টা ধরে!
– হাঁটাহাঁটি করবি, এগুলো বড় বড় প্লেন হয় | খাবি, ঘুমাবি, খানিক মুভি দেখবি, গল্পের বই নিয়ে যাবি, পড়বি, টাইম কেটে যাবে, চিন্তা করিস না |
রাজন্যা ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সৌম্যকে কি করে বোঝাবে প্লেনে চড়ার টেনশন এবং শিবাজীদার সাথে যাওয়ার টেনশন। দুটো মিলে ওর মাথার মধ্যে এখন শব্দ করে ধোঁয়া ছেড়ে স্টীম ইঞ্জিন চলছে।
উত্তেজনা আর টেনশন, মাথার মধ্যে দুই অনুভূতির মারামারি ধাক্কাধাক্কি সামলাতে সামলাতে বাড়ি এসে মালবিকাকে যখন খবরটা দিল, মালবিকা রীতিমতো লাফ দিয়ে এসে রাজন্যাকে কে জড়িয়ে ধরল।
– ওয়াও রাজ! কান্ট ইমাজিন যে এত কম এক্সপেরিয়েন্সেই অনসাইট যাওয়ার চান্স পেয়ে গেলি!
– এত এক্সাইটেড হোসনা মালু, জাস্ট এক মাসের জন্য যাওয়া…
– আরে হোক না এক মাসের জন্য | এক মাস মানে পুরো তি-রি-শ দিন! ওরে তোর শপিং করতে হবে তো রে!
রাজন্যা ভ্রু কুঁচকাল,
– শপিং?
– আরে শপিং করতে হবে না? ওখানে থোড়াই তোদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম থাকবে! তোকে তো অফিস যেতে হবে। একটু ওয়েস্টার্ন ফর্মাল কিনবি না?
রাজন্যা ভ্রু সোজা না করেই বলল,
– কেন রে? আমেরিকাতে বুঝি সালোয়ার সুট পরে অফিস যাওয়া যাবে না?
– আহা, তা যাবে না কেন? কিন্তু তাই বলে রোজ সালোয়ার পরে যাবি নাকি?
– হুম দেখছি | এক আধটা কিনলেও কিনতে পারি, কিন্তু মোটেই আমি কোন বাজে খরচ করতে চাই না, এমনিতেই হাতে বেশি টাকা নেই |
মালবিকা রাজন্যার গলা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আচ্ছা রাজ, তুই অনসাইট যাওয়া নিয়ে খুশি নোস? আমারই এত এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে, তুই মুখটা এরকম প্যাঁচার মতন করে রেখেছিস কেন?
রাজন্যা মালবিকার হাতের ওপর হাত রাখল,
– আমার সাথে শিবাজীরা যাবে। মানে আমি আর শিবাজীদা যাব। সৌম্যদা যাচ্ছেনা।
মালবিকা আরেক দফা লাফ দিল,
– তুই আর তোর খারুস বস! হাউ রোমান্টিক! জাস্ট যদি লোকটা ম্যারেড না হতো!
– ধুর! শিবাজীদা ভীষণ রাগী | কাজের একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই প্রচন্ড বকাবকি করে | এখানে তো তাও বাকি টিম মেম্বাররা আছে, সবাই মিলে একসাথে সামলে দিই | ওখানে তো পুরো রাগটাই আমার ওপরে পড়বে!
মালবিকা দুই কাঁধ ঝাঁকালো,
– বেশি বকাবকি করলে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিবি। মেয়েরা কেঁদে দিলে ছেলেদের স্পিকটি নট হয়ে যায় |
– ভাগ!
রাজন্যা রাগী রাগী চোখ করে তাকালো,
– আমি ওরকম নেকুপসু মেয়ে হতে পছন্দ করি না তুই জানিস। কিন্তু সত্যি বলতে তেমন কনফিডেন্স পাচ্ছিনা | এখানে বসে কাজ করা একরকম, আর ক্লায়েন্ট অফিসে বসে কিছু করা আর একরকম |
– আরে এত ভয় পাস না | তুই যোগ্য বলেই না তোকে সিলেক্ট করেছে!
দুই বন্ধু আরো বেশ কিছুক্ষণ জল্পনা কল্পনা চলল | জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে এসেই রাজন্যা আগে মায়ের একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিল। সকালেই সুমিত্রা পিসিমা ওর টিউশন ফি পাঠিয়ে দিয়েছেন, মনে মনে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করেছে রাজন্যা। কিছু না বলা সত্ত্বেও নিজে থেকে আজকেই টাকাটা দিয়ে দেবেন সেটা ও আশা করেনি।
ডিনার শেষ করে নিজের ঘরে বসে একটা লিস্ট বানানো শুরু করল | কি কিনতে হবে, কি কি গুছিয়ে নিতে হবে, অফিসে কাউকে কিছু বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে কিনা | এই সব করতে গিয়ে মনে হল একবার বাড়ি গিয়ে বাবা মায়ের সাথে দেখা করে আসা দরকার। এমনিতেও অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো সব বাড়িতে। ওগুলো তো লাগবে ভিসার জন্য। অফিসে কথা বলে কাল যদি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে সন্ধ্যাবেলার মধ্যে পৌঁছে যাবে। শনিবার দিন সারাদিনটা থেকে আবার রবিবার ফিরে আসবে | রাতেই সৌম্যর সাথে ফোনে কথা বলে পারমিশন নিয়ে রাখলো | একবার মনে হয়েছিল শিবাজীদাকেও জানায়। কিন্তু একটা সংকোচ বা ভয়ে সেটা আর করতে পারল না | শুধু মনে মনে ভেবে রাখলো, আগামী একটা মাস তিতলিকে পড়াতে যাওয়া হবে না | তার আগেই আবার শনি রবি দুই দিন বাদ যাবে, পরের সপ্তাহে বুধবারের সাথে আরও দুটো দিন সন্ধ্যায় ওই বাড়ি ঘুরে আসবে |
পরিকল্পনামত শুক্রবার বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল রাজন্যা।মাকে ফোনে আগেই বলে রেখেছিল, তবে অনসাইট যাওয়ার কথা কিছু বলেনি, শুধু বলেছিল বাড়ি আসছে। আরাধনা আলাদা করে উচ্ছ্বাস দেখান নি, শুধু বলেছিলেন “সাবধানে এসো” |
বাড়ি পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজলো | এবারে প্রায় মাস চারেক পরে বাড়ি এলো রাজন্যা | ওদের বাড়িটা তিনতলা, পুরনো দিনের পরিকল্পনাবিহীন বাড়ি | অনেকটা ছড়ানো জায়গার উপরে তৈরি হলেও ভিতরে ঘরের বদলে বারান্দা আর উঠোন বেশি | এক তলায় একটা পাশে রাজন্যার বাবা-মা এবং ভাই থাকে, অন্য পাশটা বড় জ্যাঠার কাপড়ের ব্যবসার গুদামঘর | দোতলা আর তিন তলায় জ্যাঠারা থাকেন পরিবার সমেত । আগে সদর দরজা একটাই ছিল, কিন্তু যে বাড়িতে যার কাছেই লোক আসুক না কেন দরজা খোলার দায়িত্ব এক তলার বাসিন্দাদেরই ছিল | বছর কতক হলো দরজা আলাদা করার ব্যবস্থা করেছেন আরাধনা। বলেছেন
– আমি বাড়ি থাকি না, অসুস্থ মানুষটার পক্ষে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এসে পঞ্চাশ বার দরজা খোলা সম্ভব নয়। এই কলিংবেলের কানেকশন দোতলা আর তিন তলায় করে নাও, তাহলে যার বাড়িতে লোক আসবে সে এসে দরজা খুলতে পারবে |
জ্যাঠতুতো দাদারা একেবারে যে কথা শোনায়নি তা না, তবে আরাধনা পাত্তা দেননি। বড় ব্যাগটা নিচে রেখে নিজেদের দিকে দরজায় কলিংবেল টিপলো রাজন্যা | কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তপোব্রত ওরফে তপু লাফাতে লাফাতে এসে দরজা খুলল
– দিদিভাই! এসে গেছিস? আমি এই একটু আগেও বাইরে বসে ছিলাম তোর জন্য।
– সন্ধ্যাবেলা বাইরে বসে ছিলি কি রে? পড়াশোনা নেই তোর?
– আরে পড়াশোনা তো রোজ করি। তুই কলকাতা থেকে আসছিস, কি কি গিফট নিয়ে আসবি সে সব দেখব না? সেই উত্তেজনাতে আর পড়ায় মন বসাতে পারছি না!
হাত বাড়িয়ে ভাইয়ের চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে ভেতর দিকে পা বাড়াল রাজন্যা । আরাধনা রান্নাঘর থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখলেন, তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন,
– বাথরুমে গিয়ে আগে হাত-পা ধুয়ে নাও | বাইরের পোশাকে বাবার কাছে যেও না।
রাজন্যা বাবার ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। মায়ের কথা শুনে একটু থমকে দাঁড়ালো, তারপর ব্যাগ খুলে উপর দিকে রাখা একটা সুতির চুড়িদার তুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগুলো |
খানিক পরে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাবার ঘরে ঢুকল রাজন্যা | অমরনাথ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিলেন | মেয়েকে দেখেই একগাল হাসলেন,
– গলা পাচ্ছি কখন থেকে | কেমন আছিস রাজি মা?
– এই তো বাবা, বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে আসলাম | তুমি কেমন আছো?
– আমার কি আর খারাপ থাকার উপায় রেখেছিস? মাসে মাসে যা রাশি রাশি ওষুধ জোগান দিস, আর কেউ অসুস্থ হতে পারে না কি?
– কি যে বলো বাবা! বয়স হলে সবাইকেই একটু আধটু ওষুধ খেতে হয়। আমার বন্ধুদের বাবা মায়েদেরও খেতে হয় শুনি তো ।
– হা হা, তা বটে | কাজকর্ম কেমন চলছে?
– ভালো চলছে বাবা, অনেক কিছু নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারছি। আর বছর দুয়েক এই কোম্পানিতে থাকি, তারপরে চেঞ্জ করার চেষ্টা করব…
অমরনাথ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন,
– সে কি, কেন? এত বড় কোম্পানি, বদলাবি কেন?
রাজন্যা হাসল,
– চাকরি না পাল্টালে ঠিকঠাক মাইনে বাড়ে না বাবা |
অমরনাথ চুপ করে থাকলেন | মেয়ে এই বয়সে যা মাইনে পাচ্ছে তা তাঁর সময়ে ভাবতেও পারতেন না | তাও বুঝি কম পড়ছে? মেয়েটার উপরে কি বেশি চাপ দেওয়া হয়ে যাচ্ছে?
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এর মধ্যেই তপু লাফাতে লাফাতে ঘরে এসে ঢুকলো,
– এই দিদি, কি এনেছিস দেখালি না?
তপুকে এক ধমক দিয়ে ঘরে ঢুকলেন আরাধনা। বড় ট্রেতে চার কাপ চা, আর স্টিলের বাটিতে পেঁয়াজ, লঙ্কা, নারকেল কুচি, বাদাম দিয়ে মুড়ি মাখা এনে রাখলেন খাটের একপাশে | রাজন্যা খপ করে মুড়ির বাটিটা তুলে নিল। অনেকক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি। খিদে পেয়ে গেছে। আরাধনা একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসতে বসতে তপুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তপু রান্নাঘরে কটা বেগুনি ভেজে রেখেছি, নিয়ে এসে তারপরে বস।
তপু এক দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেগুনির বাটিটা নিয়ে এসে ট্রের উপরে রাখল কিন্তু বসলো না। রাজন্যার কাঁধে টোকা দিয়ে বলল,
– কিরে দিদি? কিছু আনিস কি বলিস না যেন!
রাজন্যা জানতো এই কান্ড হতে চলেছে, তাই অফিস থেকে বেরিয়ে পাশের শপিং মল থেকে টুকিটাকি খানিক কেনাকাটি করে এনেছে। মুড়ি চিবাতে চিবাতেই ভাইকে নির্দেশ দিল ব্যাগের মধ্যে থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা বের করে আনতে | প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একে একে বেরোলো তপুর জন্য ব্লুটুথ ইয়ারফোন, ক্যাপ্টেন আমেরিকা প্রিন্টেড টি-শার্ট আর আফটার শেভ লোশন | আরাধনার জন্য একখানা নন-স্টিক ফ্রাইং প্যান আর অমরনাথের জন্য একখানা বড় তোয়ালে |
– দারুন দারুন দিদি! এই ব্লুটুথ ইয়ারফোন টা তো তোকে আমি বলবো ভেবেছিলাম | তুই যে কি করে সব অটোমেটিক্যালি বুঝতে পেরে যাস!
চায়ের কাপে কোনরকমে একটা চুমুক দিয়েই মোবাইল নিয়ে এসে ইয়ারফোনটা কানেক্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তপু |
অমরনাথ হাসিমুখে তোয়ালে খানা ধরে বললেন,
– কি সুন্দর নরম রে, খুব ভালো হয়েছে।
আরাধনা অবশ্য ফ্রাইং প্যানখানা বাক্স থেকে বের করলেন না। হাতে করে নিয়ে পাশে মেঝের উপর রেখে বললেন,
– এই সমস্ত উল্টোপাল্টা খরচ না করে একটু পয়সা বাঁচিয়ে এখানে বাথরুমের দরজাটা ঠিক করালে কাজে দিত।
রাজন্যা একটু দমে গেল | তারপরে আস্তে আস্তে বলল,
– আর তো বছর দুই | ফ্ল্যাটটা রেডি হয়ে গেলে তোমাদেরকে কলকাতায় নিয়ে যাব।
(ক্রমশ)