#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৫)
– কৈলাসদা, কফিটা তুমি সত্যি বড় ভালো বানাও
কফির কাপে চুমুক দিয়েই বড় করে একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল শিবাজী | সুমিত্রা কুকিজের কৌটোটা সামনের দিকে এগিয়ে দিতেই শিবাজী মাথা নাড়ল।
– না পিপিয়া, কুকিজ টুকিজ খাব না, একটু পরেই তো ডিনার করবো | ওই নাটসের কৌটোটা দাও বরং ।
সুমিত্রা অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
– তোর বড্ড বেশী হেল্থ হেল্থ বাতিক হয়েছে বুবাই । এটা খাব না, সেটা খাব না | বাঙালি বাড়ির ছেলে লুচি খাব না, আলুর তরকারি খাব না, ভাত কম খাব এরকম করলে চলে না।
শিবাজী আলগা হাসলো,
– বয়স হচ্ছে তো পিপিয়া | তোমাদের জেনারেশনের লোকজনের থেকে আমরা ফিজিকালি কম্পারেটিভলি উইক | আমাদের স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নেই, তা নাহলে বেশিদিন টিঁকতে পারবো না | আর নিজের জন্য না হোক, তিতলির জন্য আমার এখন দীর্ঘদিন সুস্থ থাকাটা খুব প্রয়োজন।
সুমিত্রা রেগে উঠলেন,
– বুড়োদের মতন কথা বলিস না তো! এখনো পঁয়ত্রিশ পেরোস নি, এদিকে বয়স হয়ে যাচ্ছে বয়স হয়ে যাচ্ছে! অদ্ভুত কথাবার্তা বলিস।
– রাগ করো কেন? জানোই তো বাবার কোলেস্টেরল ছিল। আমারও ধাত থাকবে নিশ্চয়ই | সাবধান থাকতে দোষ কি?
কথার মাঝখানে কৈলাসকে হঠাৎ দৌড়ে বাইরের দিকে যেতে দেখে সুমিত্রা অবাক হলেন,
– কি হলো রে কৈলাস? দৌড়লি হঠাৎ?
– হুট করে বৃষ্টি নামলো দ্যাখো না পিসিমা | বাইরের বারান্দা থেকে চেয়ারের কুশনগুলো সরিয়ে রাখি…
– সত্যি এ বছর বর্ষাটা তাড়াতাড়ি এসেছে!
সুমিত্রা জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন
– একদিক থেকে ভালো, যা অসহ্য গরম পড়েছিল, তার থেকে অন্তত মুক্তি | অফিসে সারাদিন এসির মধ্যে থাকি। বাড়িতে এসেও আর এসিতে ঢুকতে ভালো লাগে না।
কথা বলতে বলতেই শিবাজী খেয়াল করল সিঁড়ি দিয়ে নামছে রাজন্যা। আর ওর জামা ধরে ধরে নামছে তিতলি | শিবাজীকে দেখেই বাকি সিঁড়িটুকু তরতর করে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়ল,
-বাবাইয়াআআ!
কফির কাপ টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে তিতলিকে কোলে তুলে নিল শিবাজী
– এইতো আমার প্রিন্সেস! পড়াশোনা হল?
তিতলি একদিকে ঘাড় হেলালো
– হ্যাঁঅ্যা…
শিবাজী তিতলির নাকে নাক ঘষে বলল,
– কোন সাবজেক্টটা সবচেয়ে ভালো লাগছে ম্যামের কাছে?
– ম্যাথ আর ইংলিশ…
উত্তর দেওয়ার আগে একটুও চিন্তা করল না তিতলি | শিবাজী মনে মনে স্বীকার করল, রাজন্যার ক্ষমতা আছে | এত অল্প সময়ের মধ্যে এইটুকু বাচ্চার মধ্যে দুটো বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মিয়ে দিতে পারা সহজ কথা নয়।
রাজন্যা নিচে নেমে শিবাজী আর তিতলির খুনসুটি দেখছিল | অফিসের রাশভারী রাগী লোকটার এই স্নেহপরায়ণ পিতার রূপটা চোখে বড় স্নিগ্ধ ঠেকছে। মনে পড়ে গেল ওর ছোটবেলায় বাবা ফিরলে এমনি করেই দৌড়ে গিয়ে বাবার গায়ে উঠত।
– পিসিমা আমি আসছি তাহলে!
দরজার দিকে পা বাড়াতেই শিবাজী উঠে দাঁড়ালো,
– দাঁড়াও আমি পৌঁছে দিচ্ছি। বৃষ্টি পড়ছে।
রাজন্যা ব্যস্ত হয়ে উঠল।
– না না, আমি ছাতা এনেছি, আপনাকে যেতে হবে না | এই তো ফিরলেন অফিস থেকে।
শিবাজী রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
– বৃষ্টি জোরে পড়ছে, শুধু ছাতায় আটকাবে না। দু মিনিট দাঁড়াও, আমি গাড়ির চাবিটা নিয়ে আসছি।
রাজন্যা অসহায় চোখে সুমিত্রার দিকে তাকালো | সুমিত্রা মাথা নাড়ালেন,
– বুবাই পৌঁছে দিয়ে আসুক। সবে জ্বর থেকে উঠেছ, বৃষ্টিতে ভিজলে নয়তো আবার শরীর খারাপ হবে। বাড়িঘর ছেড়ে দূরে থাকো, শরীর খারাপ হলে তো দেখারও কেউ নেই।
অগত্যা দাঁড়িয়ে রইল রাজন্যা | শিবাজী চাবি নিয়ে নেমে এসে রাজন্যাকে ইশারায় ডেকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো | প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে রাজন্যা সাবধানে সিট বেল্টটা টেনে নিজেই লাগিয়ে নিল আজ | শিবাজী ড্রাইভিং সিটে বসে একবার ওর দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই মুচকি হাসলো | গাড়ি বারান্দা থেকে বেরোতেই রাজন্যা বুঝতে পারলো সত্যিই বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে, ছাতা নিয়েও ভিজেই যেত।
ড্রাইভ করতে করতেই শিবাজী বলে উঠলো,
– আই মাস্ট সে, তোমার মধ্যে ছোট বাচ্চাদের ম্যানেজ করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে | তিতলি অবাধ্য বাচ্চা নয়, কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে যে পড়াশোনার প্রতি ওর ইন্টারেস্ট গ্রো করে যাবে সেটা আমি সত্যিই আশা করিনি |
রাজন্যা মৃদু স্বরে বলল,
– তিতলি যে শুধু অবাধ্য নয় তা না, ও ভীষণ ভীষণ মিষ্টি বাচ্চা
– তিতলির টিচারও কম মিষ্টি নয়
কথাটা মনে হতে একটু হেসে ফেলল শিবাজী । রাজন্যা অবাক হল,
– হাসছেন যে?
– ও এমনিই | বাই দ্য ওয়ে, ইভানের গল্পটার শেষটা আমারও শোনার ইচ্ছা রইলো।
রাজন্যার মনে হল ওর বুকের ভিতর কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে | খুব চেষ্টা করে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শিবাজীর দিকে তাকালো | নির্বিকার মুখে সোজা তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
– আপনি কি করে জানলেন আমি ইভানের গল্প বলছিলাম?
– বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে তিতলি কি করছে দেখতে গেছিলাম | চুরি করে গল্প শুনতে গিয়ে আরেকটু হলে কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
রাজন্যা টের পেল ওর দুই গাল গরম হয়ে উঠেছে। গাড়িটা গলি থেকে বেরোবার মুখেই একটা জোরে ব্রেক কষতে হলো | সাইকেল নিয়ে একজন মানুষ হুড়মুড়িয়ে গাড়ির সামনে এসে পড়েছে | ঝাঁকুনিতে রাজন্যার মাথা সামনে ঠুকে যেত যদি না সঠিক সময়ে শিবাজী বাঁ হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিত। শিবাজীর হাতের সাথে ধাক্কা খেয়ে সোজা হয়ে বসল রাজন্যা | শিবাজী জানলা নামিয়ে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো,
– কিভাবে সাইকেল চালাচ্ছেন! এখনই তো একটা কিছু হয়ে যেত।
লোকটা জড়ানো গলায় উত্তর দিল,
– দুঃখিত!
শিবাজী জানলার কাঁচ তুলতে তুলতে বিড়বিড় করল,
– যতসব মাতালের কান্ড।
তারপরেই রাজন্যার দিকে ফিরল,
– তোমার লাগেনি তো?
রাজন্যার তখনও বুক ঢিপ ঢিপ করছে। কয়েক মুহূর্ত আগের পুরুষালি স্পর্শটা মন মস্তিষ্ক ছেয়ে ফেলছে কেন কে জানে | কোনো রকমে মাথা নেড়ে না বলল | গাড়ি চলল ফের | খানিকটা যাওয়ার পরে শিবাজী কথা বলল আবার,
– আচ্ছা, এই ফেয়ারি সিস্টারের ব্যাপারটা কি?
এই রে! এটা আবার এই লোককে কে বলে দিল!
রাজন্যা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল।
– ও কিছু না!
– কিছু না মানে? আগের দিনও শুনলাম, আজও পিপিয়া বলল…
রাজন্যা আমতা আমতা করে বলল,
– আসলে প্রথম দিন তিতলির সাথে বন্ধুত্ব করার সময় ওকে বুঝিয়েছিলাম যে সিন্ডারেলার যেমন ফেয়ারি গডমাদার ছিল আমি সেরকম ওর ফেয়ারি গড সিস্টার…
শিবাজী চোখ কপালে তুলে ফেলল,
– সর্বনাশ! তিতলির সিস্টার মানে আমার মেয়ে!
রাজন্যা চমকে উঠল | এভাবে তো ভাবেনি! কি বলবে বুঝতে পারছে না, তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পারলে ভালো হয়। কোন রকমে ক্ষীন স্বরে বলল,
– না মানে তখন তো জানতাম না আপনিই তিতলির বাবা…
– আচ্ছা জানলে অন্য কিছু বলতে?
তিতলি হঠাৎ শিবাজীর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলো,
– জানলে আমি ওই বাড়িতে পড়াতেই যেতাম না।
– সেকি? কেন?
– ভুলে গেছেন অফিসে কি ব্যবহার করেছিলেন আমার সাথে প্রথম দিন?
– না ভুলিনি। কিন্তু তুমিও তো চুপটি করে সেটা মেনে নাওনি | কাজেই শোধ বোধ!
রাজন্যা চুপ করে থাকলো, এটা শিবাজী ঠিকই বলেছে | খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ | রাজন্যা চুরি করে একবার ডান দিকের লোকটার দিকে তাকালো | প্রবল বৃষ্টির মধ্যে অদ্ভুত কনফিডেন্স নিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলেছে। অফিসে সর্বক্ষণ ফর্মাল পোশাকে দেখা লোকটা এই মুহূর্তে একটা কালো রংয়ের মিনিয়ন প্রিন্টেড গোল গলা টি শার্ট পড়ে আছে আর তার সাথে খাকি রংয়ের ঢোলা পাজামা | হাফ হাতা টি-শার্টের নিচ দিয়ে বেরিয়ে থাকা সুগঠিত হাত দুখানা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা নিয়মিত অনুশীলন করা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী | আচমকা বাঁদিক ফিরল শিবাজী,
– কি হলো, তাকিয়ে আছ? কিছু বলবে?
ভয়ানক লজ্জা পেয়ে সামনের দিকে ফিরল রাজন্যা।
– না কিছু না
নিজের মনেই একটু হাসল শিবাজী | প্রবল ভাবে অস্বীকার করতে চেয়েও অস্বীকার করতে পারছে না | এই অল্প বয়সী মেয়েটার সান্নিধ্যে থাকতে ওর নিজেরও বড় ভালো লাগছে। ক্ষ্যাপাটে, অবাধ্য আবার নিজের কাজে দক্ষ এই মেয়েটা তার রুখাশুখা জীবনে এক ঝলক তাজা হওয়ার মতই যেন এসেছে।
শিবাজীর গাড়ি যখন রাজন্যার ফ্ল্যাটের নিচে এসে দাঁড়ালো, মালবিকা ওদের ড্রয়িং রুম লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল | রাজন্যাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠল । মিনিট তিনেক পরে কলিংবেল বাজতেই দ্রুত দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল,
– কে রে তোকে গাড়ি করে ছেড়ে গেল?
রাজন্যা অন্যমনস্কভাবে বলল,
– শিবাজীদা
মালবিকা একটু অবাক |
– তুই এত দেরি পর্যন্ত অফিসে ছিলি? সেদিন যে বললি প্রজেক্টটার কাজ এখনো সেভাবে শুরু হয়নি?
রাজন্যা মাথা নাড়ালো,
– নারে অফিসে ছিলাম না, পড়াতে গেছিলাম।
মালবিকা যোগসূত্র টা না বুঝে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল | ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজন্যা বলল,
– যেই বাড়িতে পড়াতে যাই, বাচ্চাটার কথা তোকে বলেছি না? তিতলি? ও শিবাজীদার মেয়ে।
– কি বলছিস রে?
মালবিকা ভীষণ অবাক হওয়া গলায় বলল,
– কবে জানতে পারলি?
– আগের দিন
– ও! আর তিন দিন ধরে আমাকে না বলে চেপে আছিস?
রাজন্যা চুপ করে রইল | মালবিকা একটু দুঃখ দুঃখ গলায় বলল,
– খুব বাজে হল | আমি ভেবেছিলাম তোর অফিসের ওই খারুস বসের সাথে তোর একটা দুষ্টু মিষ্টি টক ঝাল লাভ স্টোরি গড়ে উঠবে। কিন্তু এ তো বিবাহিত লোক বেরোলো। শুধু বিবাহিত নয়। বাচ্চার বাবা!
রাজন্যা চমকে উঠল | সত্যিই তো, অফিসে শিবাজীদার সাথে মান অভিমান, ঝগড়াঝাঁটি, রাগ যাই হোক না কেন, ভিতরে ভিতরে যে লোকটার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ বোধ করে তা অস্বীকার করতে পারে না | কিন্তু মালবিকা এইমাত্র যা বলল তা তো একশ শতাংশ সত্যি | এতদিন ও শিবাজীদা এবং তিতলির বাবাকে দুটো আলাদা ব্যক্তি হিসেবে জানতো | কিন্তু বাস্তবে তো তা নয় | শিবাজীদা বিবাহিত। ওনার স্ত্রী আছেন, সন্তান আছে | হয়তো স্ত্রীর সাথে এই মুহূর্তে বনিবনা নেই। কিন্তু সেই ভদ্রমহিলা আছেন এবং সেই ভদ্রমহিলা রূপে, অর্থে, গ্ল্যামারে তার মতন সাধারণ মেয়ের থেকে অনেক যোজন এগিয়ে। নাহ্, ভবিষ্যতে কোন বড় দুঃখ পাওয়ার আগে রাজন্যার নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।
রাজন্যা কে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বারবার পাশের খালি সিটটার দিকে চোখ যাচ্ছিল শিবাজীর। আজকাল কেন যেন মন নিয়ন্ত্রণে থাকছে না | খুব ইচ্ছা করছে নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে, কারোর সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করতে। কিন্তু ওই যে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায় | নিজের ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস নেই শিবাজীর | আরো একবার আঘাত পেতে পারবে না | নিজের মনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো | বেশ তো ছিল, কেন যে এই মেয়েটা ওরই টিমে এসে জয়েন করলো, আবার তিতলির টিউটর হিসাবে পিপিয়ার ওকেই খুঁজে পেতে হল! চাইলেও এড়াতে পারবে না |
বাড়ি ফিরে চটপট আরেক দফা ফ্রেশ হয়ে তিতলির সঙ্গে ডিনার করে নিল শিবাজী। আজ আর তিতলি গল্প শোনার জন্য বায়না করল না, বরং উল্টে খেতে খেতে নিজের সদ্য শোনা একটা গল্পই শিবাজী কে শুনিয়ে দিল। সুমিত্রা হেসে বললেন,
– তোর ম্যামের ঝুলিতে যে কত গল্প আছে দিদিভাই! আমাদের ছোটবেলায় ঠাকুরমার ঝুলি ছিল, সেই রকম রাজন্যার ঝুলি!
তিতলি হাততালি দিয়ে উঠে বলল,
– ঠিক ঠিক, রাজন্যার ঝুলি | হাত ঢুকালেই গল্প বেরোয়!
কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে না ভেবেও ঠোঁটের কোণে আসা মুচকি হাসিটাকে এড়াতে পারল না শিবাজী | খেয়ে উঠে খবরের কাগজ নিয়ে সোফায় বসতেই চোখ গেল সেন্টার টেবিল এর উপরে রাখা বাদামী রঙের খামটার দিকে | কৌতূহলী হয়ে হাতে তুলে নিতে নিতেই সুমিত্রাকে জিজ্ঞাসা করল,
– এটা কিসের খাম পিপিয়া?
কৈলাশ উত্তর দিল,
– তোমার নামে কিছু একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে | চোখের সামনেই রেখেছিলাম যাতে বলতে ভুলে না যাই, অথচ দেখো সেই ভুলেই গেছি.!
– ও কিছু হয়নি…
খামটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল শিবাজী | সুমিত্রা দূর থেকেই লক্ষ্য করলেন খামের ভিতরের চিঠিটা পড়তে পড়তে শিবাজীর চোখ মুখের ভাব হঠাৎই কঠিন হয়ে উঠলো।
– কি হয়েছে বুবাই?
উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে এসে উল্টো দিকের সোফায় বসলেন | শিবাজী কোন উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল |
– বাবাই কি হয়েছে? একটু বল!
শিবাজী আস্তে আস্তে মাথা তুললো, চোখ মুখ রাগে থমথম করছে
– সমর্পিতা, স্বস্তিকের অর্ধেক মালিকানা দাবী করেছে
– মানে! কোন অধিকারে?
– তিতলির মা হওয়ার অধিকারে | হয় তিতলির কাস্টাডি সম্পূর্ণরূপে ওকে দিয়ে দিতে হবে, নয়তো তিতলির আঠারো বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তিকের অর্ধেক মালিকানা সমর্পিতাকে দিতে হবে।
অসহ্য বিস্ময়ে নীরবে শিবাজীর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুমিত্রা | এক জীবনে এই ধরনের মেয়েদের থেকে কি নিস্তার নেই ছেলেটার? আর কত ক্ষতি করবে?
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শিবাজী ফের মুখ খুলল,
– তিতলিকে কিন্তু আমি কিছুতেই ওই মেয়ের কাছে দেব না পিপিয়া | তার জন্য স্বস্তিকের অর্ধেক কেন, সম্পূর্ণ স্বস্তিকও যদি ওকে দিয়ে দিতে হয়, তাই সই | যে মেয়ে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের মা বাবা বোন সকলকে ত্যাগ করতে পারে, সে কি করে তার সন্তানের দায়িত্ব নেবে? আমার কথা ছেড়েই দিলাম, আমি না হয় ওর জীবনে কয়েক বছরের জন্য অতিথি ছিলাম, কিন্তু বাকিরা তো ওর রক্তের সম্পর্কের জন?
সুমিত্রা এগিয়ে এসে শিবাজীর হাতের উপরে হাত রাখলেন,
– চিন্তা করিস না বুবাই | তিতলি সেনবাড়ির সন্তান, তিতলিকে কেউ এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবে না |
রাত্রে ভালো করে ঘুম হলো না শিবাজীর | ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নে অতীতের ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্মৃতির টুকরো বারবার এসে ঘুমের মধ্যে হানা দিয়ে দিতে থাকলো।
সেদিন ছিল মেহেন্দির প্রথম অফিসিয়াল ড্রেসের লঞ্চ ইভেন্ট | কলকাতার নামকরা একটি পাঁচ তারা হোটেলে অনুষ্ঠান | কিছু নির্বাচিত খবরের কাগজ এবং ফ্যাশন ম্যাগাজিনের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল মেহেন্দি সম্বন্ধে বেসিক একটু আইডিয়া দেওয়ার জন্য | দিনটা সমর্পিতার অফিসিয়াল আত্মপ্রকাশের প্রথম দিন ছিল | শিবাজী জানতো সমর্পিতার বাড়িতে মডেলিং নিয়ে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে। সমর্পিতার কথা মত ওর বাড়িতে গিয়ে ওর বাবাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেও বিশেষ একটা লাভ হয়নি। তাই ইভেন্টে সমর্পিতার বাড়ির লোককে নিমন্ত্রণ করা হলেও কেউ আসেননি দেখে শিবাজী অবাক হয়নি। সন্ধ্যা সাতটার সময় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা হলেও বিকেলের পর থেকেই লোকজন আসা শুরু করে দিয়েছিল | সাড়ে ছ’টার মধ্যেই ব্যাঙ্কওয়েট হল জমজমাট | কাঁটায় কাঁটায় সাতটার সময় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। শিবনাথ সেন উপস্থিত সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন সৌভিকের এবং ঘোষণা করলেন যে নতুন ক্লোদিং লাইন মেহেন্দি সম্পূর্ণরূপে সৌভিকের ব্রেন-চাইল্ড এবং এই লাইনের যাবতীয় কাজকর্ম, মার্কেটিং সমস্তটাই সৌভিকের দায়িত্বেই চলবে | ক্যামেরার ঝলকানি এবং হাততালির মধ্যে সৌভিক উঠে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে নিজের সম্বন্ধে খানিকটা বলে সরাসরি চলে গেল মেহেন্দির কনসেপ্টের বিষয়ে |
– আমাদের বাঙ্গালীদের জন্য বিয়ে ব্যাপারটা একটা ছোটখাটো বিষয় নয়, এটা একটা বড় উৎসব, বড় অনুষ্ঠান, যেটা ঠিক বিয়ের দিনে শুরু হয়ে শেষ হয় না | বিয়ের অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি চলতে থাকে শুধুমাত্র দুটি পরিবারের মধ্যে নয়, তাদের আত্মীয় বন্ধু সকলের মধ্যেই ওই বিশেষ দিনটিকে নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে থাকে | আবার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে স্ত্রী যখন স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করে, তখনও কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের রেশ চলে বেশ অনেকদিন ধরে | আমাদের রীতি অনুযায়ী নতুন বর বৌকে বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলায় মেয়ের বাড়িতে যেতে তো হয়ই, তাছাড়াও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বন্ধু সকলেই নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করার জন্য বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে | এক থেকে দেড় বছর নিউলি ম্যারেড কাপলদের যেতেই হয় এই ধরনের ইনভিটেশন অ্যাটেন্ড করতে | এবারে কথা হল এই সব ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নতুন বউ কি পরবে? আজকালকার মেয়েরা জিন্স ও পরে, শাড়িও পরে, সব ধরনের পোশাকেই তারা সমান স্বচ্ছন্দ | কিন্তু মুশকিল হল এক দেড় বছর ধরে সমস্ত অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে যেতে কি আর কারোর ভালো লাগে? পোশাকটা অনেকটা নিজের পছন্দের ব্যাপার, জোর করে চাপিয়ে দিলে সেটা যত সুন্দর পোশাকই হোক না কেন, মনে মনে খারাপ লাগতে বাধ্য | তাই যতই আপনি মনে করুন না কেন, নতুন বউকে যাবতীয় অনুষ্ঠানে লাল হলুদ শাড়ি পরেই দেখতে পাবেন, আজকালকার স্বনির্ভর দৃঢ়চেতা নববধূরা কিন্তু মোটেই সেটা চান না। কিন্তু তাই বলে কি মেয়েটি চাইবে তার খুড়শ্বশুরের বাড়িতে জিনস আর টপ পরে যেতে? অবশ্যই না! সে খুঁজবে এমন একটা কোনো এথনিক পোশাক যেটা তার নতুন বউয়ের গর্জিয়াসনেস কে এতোটুকু ক্ষুণ্ণ না করে তাকে সাবলীলভাবে যে কোন ওয়েদারে চলাফেরা করতে সাহায্য করবে | এই কথা মাথায় রেখেই স্বস্তিক প্রেজেন্টস দ্যা ফার্স্ট গ্লিমপস্ অফ মেহেন্দি কালেকশন!
তুমুল হর্ষধ্বনি আর হাততালির মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে গেল ফ্যাশন শো, ছয় জন মডেল বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে প্রদর্শনী করার পরে শো-স্টপার পোশাক পরে মঞ্চে দেখা গেল সমর্পিতাকে | স্নিগ্ধ হালকা পিচ রঙের স্লিভলেস পা পর্যন্ত লম্বা গাউনের উপর রুপালি রঙের সূক্ষ্ম নেটের কাজ করা লম্বা হাতা জ্যাকেট, কানে এবং গলায় রুপোর গয়না, পায়ের রূপোলি স্টিলেটো | মঞ্চের বাকিটুকু অন্ধকার, শুধু মাঝখানের আলোকিত অংশ দিয়ে কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে সমর্পিতা যখন একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ালো, কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত হলে পিনপতন নিস্তব্ধতা | কিন্তু সে ওই কয়েক মুহূর্তের জন্যই, তারপরেই প্রবল বেগে হাততালির শব্দে ভরে গেল সমস্ত ঘর | আলোচনা শুরু হয়ে গেল স্বস্তিকের নতুন শো-স্টপার মডেলকে নিয়ে |
সৌভিকের অনুরোধে নিজের বরাবরের পছন্দের জিন্স আর টি-শার্ট ছেড়ে ফরমাল থ্রি পিস স্যুট পরতে হয়েছিল শিবাজী কে | এক পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে সমর্পিতার দিকে তাকিয়ে ছিল | সমর্পিতা সুন্দরী তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ মেয়েটি যেভাবে অবিচ্ছিন্ন আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রথমবারের জন্য মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করল, ওকে দেখে কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে এটি ওর প্রথম প্রফেশনাল কাজ | পরবর্তী এক ঘন্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন, অন্যান্য নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা পর্ব সেরে বাড়ি ফেরার পালা | সমর্পিতার জন্য স্বস্তিক থেকে আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজকের পর থেকে সমর্পিতাকে সাংবাদিকদের থেকে একটু সাবধানে থাকতে হবে সেটা বিশেষ করে বলে দেওয়া হয়েছে। গাড়িতে ওঠার আগে সমর্পিতা শিবাজীর দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করলো,
– তুমি একটু আমার সঙ্গে যাবে প্লিজ?
এই কদিনে আপনি থেকে তুমি তে নেমেছে ওরা | পরিবর্তন টুকু শিবাজীর পছন্দই হয়েছে। আপত্তি না করে রাজি হয়ে গেল | গাড়ি চলতে শুরু করল | সমর্পিতা ক্লান্তভাবে গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল,
– আজ আমার মনে হচ্ছে যে আমার স্বপ্নের ক্যারিয়ারের প্রথম পদক্ষেপ সত্যিই নিতে পারলাম। কিন্তু বাড়িতে হয়তো বাবা এখনো এটাকে মেনে নিতে পারবে না…
– আমি কথা বলেও তো লাভ হবে না বলেছিলে?
সমর্পিতা মাথা নাড়লো
– নাহ্…
– তাহলে?
– তাহলে আর কি? দেখি কতদিন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব, তারপর দরকার হলে আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে | এত সহজে আমার স্বপ্নের গলা টিপে মারতে পারবো না আমি।
শিবাজী চমকে উঠল।
– তা কেন? বাবাকে বোঝাও! উনি নিশ্চয়ই বুঝবেন | ওনার তোমাকে নিয়ে এক রকমের আশা ছিল, তুমি তার বদলে অন্য কিছু করতে চাইছো | ওনার রাগ হওয়া স্বাভাবিক | আমার বাবারও তো ইচ্ছা ছিল যে আমি ব্যবসায় ঢুকি। আমার আইটিতে জয়েন করা নিয়ে বাবাও যথেষ্ট মনঃক্ষুণ্ণ, কিন্তু তাই বলে তো আর আমি আমার বাবা পিসি দাদা এদের ছেড়ে চলে যেতে পারি না!
সমর্পিতা সোজা হয়ে বসলো
– এটা কিন্তু আমারও খুব অবাক লাগে শিবাজী! তোমাদের এত বড়, এত প্রেস্টিজিয়াস ব্যবসা থাকতে তুমি আইটিতে চাকরি করতে যাবে কেন?
– ওটা আমার চয়েজ সমর্পিতা | ব্যবসা করতে আমার ভালো লাগেনা | আর তাছাড়া ওটা দাদা সামলাচ্ছে, ওই সামলাক না!
– কিন্তু…
– কোন কিন্তু নয়! সমর্পিতা, তুমি যেমন ল পড়া ছেড়ে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে তোমার ক্যারিয়ার বানাতে চাও। আমিও সেরকম ব্যবসা ছেড়ে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের ক্যারিয়ার বানাতে চাই।
– কাম অন শিবাজী! আমার এম্বিশনের সাথে তোমার খামখেয়ালিপনার তুলনা কোরো না! আই টি ইন্ডাস্ট্রিতে কটা পয়সা মাইনে পাবে তুমি? বরং যদি সৌভিক স্যারের সাথে মিলে তোমাদের ব্যবসাটাকে এক্সপ্যান্ড করো, তাহলে জাস্ট ইমাজিন তোমরা কোথায় পৌঁছাতে পারবে!
শিবাজী কাষ্ঠ হেসে বলল,
– এই প্রসঙ্গ থাক | এ নিয়ে অলরেডি বাড়িতে বাবার সঙ্গে নিয়মিত ঝামেলা বাধে…
সমর্পিতা একটু থমকে গেল। তারপর শিবাজীর ডান হাতের উপরে এক হাত রেখে বলল,
– ওকে ওকে, আমি জাস্ট আমার মনে হওয়াটা বললাম! আল্টিমেটলি ইটস ইওর লাইফ, ইওর চয়েস!
(ক্রমশ)
#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৬)
সকালে শিবাজীর ঘুম ভাঙলো একটা বাজে গোছের মাথা ব্যথা নিয়ে | তিতলিদের স্কুল আজ ছুটি, স্কুলের ফাউন্ডেশন ডে | সেটা ভুলে গিয়ে অ্যালার্মটা বন্ধ করা হয়নি। স্বভাবতই সাড়ে পাঁচটার সময় মোবাইলের অ্যালার্ম দায়িত্ব সহকারে সশব্দে বেজে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে | অ্যালার্ম বন্ধ করে ফের বিছানায় শুয়েও খুব একটা লাভ হলো না | বেশ কয়েকবার এপাশ ওপাশ করার পরেও ঘুম আসবে না বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লো শিবাজী |
মুখ হাত ধুয়ে সকালের ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ সেরে নীচে নেমে দেখল কৈলাস বাইরের বাগানের গাছগুলোর নীচে পড়া পাতা ঝাঁট দিচ্ছে | শিবাজীকে দেখে একগাল হেসে বলল,
– ভাবলাম তিতলি দিদিভাইয়ের স্কুল নেই, তাই তুমি বোধহয় আজ একটু দেরি করে উঠবে!
শিবাজী দরজার পাশে সদ্য দিয়ে যাওয়া খবরের কাগজটা তুলে নিতে নিতে বলল,
– আর বোলো না, অ্যালার্ম বন্ধ মধ্যে করতে ভুলে গেছিলাম | কৈলাসদা চা খাওয়াও না গো এক কাপ…
কৈলাস চোখ কপালে তুলল
– তুমি কফি ছেড়ে চা খাবে?
– হ্যাঁ, কড়া করে দুধ দিয়ে, আদা দিয়ে একটু চা করো | বড্ড মাথা ধরে আছে।
কৈলাস ঝাড়ু নামিয়ে রেখে রান্না ঘরের দিকে এগুলো | শিবাজী খবরের কাগজ খানা নিয়ে বারান্দার চেয়ার গুলোর একটায় এসে বসলো | কাল সন্ধ্যার বৃষ্টিতে চেয়ারগুলো সব ভিজে গেছিল। সকালে উঠেই কৈলাস সমস্ত মুছে শুকনো করে রেখেছে | খবরের কাগজটা খুলে বসতেই মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হলো | তাকিয়ে দেখল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্যালারি জমা করার এসএমএস | সাথে সাথেই শিবাজীর মনে পড়ে গেল রাজন্যার টিউশন ফি-টাও আজকেই দিয়ে দিতে হবে | ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে আলগোছে একবার হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস চেক করতে গিয়ে চোখ পড়ল একটা পরিচিত নম্বরের স্ট্যাটাসে,
বন্ধু মানে দম বন্ধ হয়ে আসা মেঘলা আকাশে রামধনুর ছোঁয়া
বন্ধু মানে সব হারিয়েও আবার সবকিছু ফিরে পাওয়া
কয়েক মিনিট আগের দেওয়া স্ট্যাটাস | দু এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে স্ট্যাটাসের উত্তরে লিখল শিবাজী
– সুপ্রভাত এবং জীবনে নতুন বন্ধুর আগমনের শুভেচ্ছা
প্রায় সাথে সাথেই ওদিক থেকে উত্তর ভেসে এল
– সুপ্রভাত শিবাজীদা, কেমন আছো?
– ভালো, তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো | সেদিনই তো দেখলে, যতটা ভালো থাকতে পারি আমি ততটাই ভালো আছি
– তোমাকে একটা ফোন করা যাবে?
– নিশ্চয়ই! আমি তো বেকার মানুষ
রিং হওয়ার সাথে সাথেই ফোন ধরলো সমাদৃতা
– কত বছর পরে যে তুমি ফোন করলে শিবাজীদা!
– আই এ্যাম সরি, কিন্তু তুমি তো জানো সমাদৃতা, যে স্মৃতি আমাকে সতত কষ্ট দেয় পারতপক্ষে সেই স্মৃতির মুখোমুখি হতে চাই না আমি |
– তোমার কষ্টটা আমি বুঝি শিবাজীদা | যাই হোক, আজ ফোন করলে?
– সমাদৃতা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করার জন্য ফোন করেছি…
– বলো
– আচ্ছা, সমর্পিতার সাথে কি তোমাদের যোগাযোগ আছে?
সমাদৃতা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ | নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে ফোনের মধ্যে দিয়েও। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল,
– দিদিয়া নিজে থেকে ফোন করে না। মা মাঝে মধ্যে ওকে ফোন করলে কথা হয় | তবে বেশিরভাগ সময়েই ওর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোন ধরে | ও খুব ব্যস্ত |
শিবাজী সামান্য ইতস্তত করে বলল,
– এই প্রশ্নটা করার আগেই বলে নিচ্ছি প্লিজ কিছু মনে করো না | সমর্পিতা কি বাড়িতে টাকা পাঠায়?
– এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করছ?
সমাদৃতার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় স্পষ্ট
– কারণ আছে | পরে বুঝিয়ে বলব |
– নাহ্ গত পাঁচ বছরে কখনো পাঠায়নি বলেই জানি। মাকে আলাদা করে কখনো কিছু পাঠিয়েছে কিনা বলতে পারব না
– আচ্ছা, বাড়ি থেকে কখনো টাকা চেয়েছে কি?
– সে কথা তো আমি বলতে পারব না শিবাজীদা, যদি টাকা চেয়েও থাকে মায়ের কাছে কিংবা বাবার কাছে চাইবে | সে কথা আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই। তবে ও ব্যস্ত নায়িকা, গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের জনপ্রিয় মুখ | ওর অর্থের প্রয়োজন কেন হবে?
– সেটাই আমিও বুঝতে চাইছি সমাদৃতা | সমর্পিতা স্বস্তিকের মালিকানা দাবি করে চিঠি পাঠিয়েছে গতকাল |
– সে কি?
– হ্যাঁ | ও একসময় স্বস্তিকের সাথে, আমাদের পরিবারের সাথে, এমনকি তিতলির সাথে সমস্ত সম্পর্ক অস্বীকার করে চলে গিয়েছিল | তাই বুঝতে চাইছি এখন হঠাৎ কি হলো যে অধিকার নিয়ে আইনি যুদ্ধে নামতে চাইছে!
সমাদৃতার কণ্ঠস্বর হঠাৎই দৃঢ় হয়ে উঠলো
– আমাকে কথা দাও শিবাজীদা, দিদিয়ার কোন অন্যায় আবদার আর তুমি প্রশ্রয় দেবে না | আমার বেশ কিছু স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গেছে, কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দেয় যে দিদিয়া ভয়ানক কিছু অন্যায় করেছিল এবং সেই অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে আমার বাবা-মায়ের সাথে তুমিও ছিলে | সে অন্যায়ের জন্য অনেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি | আর যেন নতুন করে ওকে কারো জীবন নষ্ট করতে দিও না।
শিবাজী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপরে খুব ধীরে ধীরে বলল,
– ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি সে স্মৃতি যেন তোমার কখনোই ফিরে না আসে সমাদৃতা | আপন জনের প্রতি বিশ্বাস চলে গেলে জীবন যে কিরকম দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায় তার ভুক্তভোগী আমি। আশা করি তোমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতাটুকু চিকিৎসায় ঠিক হয়ে যাবে আর তুমি জীবনে এগিয়ে যাবে | আর তখন পুরনো ঘটনাগুলোকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও |
সমাদৃতা হেসে উঠলো,
– জীবনটা কি আর গল্প উপন্যাস শিবাজীদা? তুমি যা যা বললে তা হলে তো আমি রূপকথার নায়িকা হয়ে যাব! কোন এক রাজপুত্র সোনার কাঠি রুপোর কাঠি এনে আমার পায়ে ছোঁয়াবে আর আমি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করব!
শিবাজী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব আস্তে আস্তে বলল,
– আই উইশ সমাদৃতা। আই উইশ…
ইতিমধ্যে কৈলাস ধুমায়িত চায়ের কাপ এনে একটা ছোট্ট টি টেবিলের উপরে দিয়ে গেছে | ফোন রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখল শিবাজী
– এই রাজ! ওঠ ওঠ! আজকে কি অ্যালার্ম দিস নি নাকি? সাড়ে সাতটা বাজে তো!
গতকাল সন্ধ্যায় বৃষ্টি হওয়ার পরে আবহাওয়া বেশ মনোরম | গুমোট গরম ভাবটা কেটে গিয়ে হালকা হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব ছিল রাত্রে। অনেকদিন পর বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না রাজন্যার। কিন্তু মালবিকার উপর্যুপরি হাঁকাহাঁকিতে না উঠে আর উপায় নেই | বিছানায় উঠে বসে দুই হাতে চোখ ডলতে ডলতে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
– একটু চা বসা না প্লিজ মালু, আমার আজ খুব বেড টি খেতে ইচ্ছা করছে
– ইল্লি আর কি! চা আমি করে দিচ্ছি কিন্তু তুই বাথরুমে যা শিগগিরই | অফিস পৌঁছতে দেরি হলে তোমার খারুস বস কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না, যতই রাতের বেলা ফ্ল্যাট অব্দি পৌঁছে দিক না কেন!
রাজন্যার ঘুমটা এই এক কথাতেই ম্যাজিকের মতন ছেড়ে গেল | কথাটা মালবিকা খাঁটি সত্যি বলেছে। ছোটখাটো একটা লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে, দ্রুত বিছানা গুছিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়ালো। চায়ের কাপ আর বিস্কুটের কৌটা নিয়ে চেয়ারে এসে বসতেই মালবিকা বলল,
– আজ রাতে চিলি চিকেন আর চাউমিন খাবি?
রাজন্যার চট করে মনে পড়ে গেল আজ তো মাসের শেষ তারিখ। হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিয়ে এসএমএস চেক করে নিল | মাইনের টাকা ঢুকে গেছে |
– চল খাই! টিফিনে কি নিবি?
মালবিকা কাপের চা টুকু শেষ করতে করতে উত্তর দিল,
– রাতের ভাত আছে আর আগের দিনের স্টু বেঁচে গেছিল তার খানিক চিকেনও আছে। এক কাজ করবি?
রাজন্যা ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
– অল্প একটু সবজি কেটে নিয়ে চিকেন ফ্রাইড রাইস? তুই ঝপাঝপ স্নানে যা, আমি লাঞ্চ রেডি করে নিচ্ছি।
ন’টার মধ্যে তৈরি হয়ে দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ল | ওডিসিতে ঢুকেই রাজন্যা একটা ‘গুড মর্নিং শিবাজী দা’ ‘গুড মর্নিং সৌম্যদা’ ছুঁড়ে দিল নিজের ডেস্কের দিকে এগুনোর আগে | সৌম্য প্রত্যুত্তরে গুড মর্নিং বললেও শিবাজী ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে শুধু একটা হুঁ বলে ফের কাজে ডুবে গেল | রাজন্যা আহত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত | এই মানুষটাকে বুঝতে পারা বড় কঠিন। গতকাল সন্ধ্যা থেকে আজ সকাল পর্যন্ত কতটুকুই বা সময়ের পার্থক্য? অথচ ব্যবহারের পার্থক্য আকাশ পাতাল!
দিনটা কাটলো মোটামুটি ঝড়ের গতিতে | সারাদিন জুড়ে প্রচুর কল, প্রচুর মিটিং, প্রচুর প্ল্যানিং | প্রজেক্টের প্ল্যানের প্রথম খসড়া কোম্পানির উচ্চতর আধিকারিককে পাঠাতে হবে আজই | সবক’টা মাথা এক হয়ে প্ল্যান তৈরি হচ্ছে | সৌম্যর ল্যাপটপ থেকে প্রজেক্ট করা রয়েছে সামনের হোয়াইট বোর্ডে | মোটামুটি যখন সকলে একমত হয়ে এসেছে, রাজন্যা আপত্তি জানালো,
– সৌম্যদা, একদম শুরুতে রিকোয়ারমেন্ট ডকুমেন্টেশনে তিন দিনটা বড়ই কম। ওটা অন্তত দু সপ্তাহ হওয়া উচিত।
সকলে ঘুরে তাকালো |
– দু সপ্তাহ! ছয় জনের দশটা করে ওয়ার্কিং ডে মানে সিক্সটি ওয়ার্কিং ডেজ ফর ডকুমেন্টেশন! রিয়েলি রাজন্যা?
মণীষার কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ স্পষ্ট | রাজন্যা মনিদীপাকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি সৌম্যকে আবার বলল,
– আমি মানছি রিসোর্সের টাইম হিসাবে দেখতে গেলে এটা অনেকটা সময়, কিন্তু ভেবে দেখো এই ডকুমেন্টেশনটা ফাইনাল না হলে কিন্তু তুমি কাজ শুরু করাতে পারবেনা | তার কারণ এটার উপরে তোমার কাজটা নির্ভর করবে। তিন দিনে যা হোক তা হোক করে রিকোয়ারমেন্ট বুঝে আমরা হয়তো কাজ শুরু করে দিলাম, কিন্তু সেটার যদি বদল হয় তাহলে কিন্তু আমাদেরকে কেঁচে গণ্ডুষ করতে হবে। আর তাতে আল্টিমেটলি সময় বেশি বই কম লাগবে না!
– কিন্তু রাজন্যা, এতে আমাদের ডেড লাইন টা প্রায় এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে, তাই না?
– এত বড় প্রজেক্ট সৌম্য দা, আমরা নিশ্চয়ই বাফার রেখেছি?
সৌম্য প্রজেক্ট প্ল্যানের উপর থেকে নিচ অবধি চোখ বোলালো | না, বাফার রাখা হয়নি। গোটা প্ল্যানেই ঠিক যেখানে যতোটুকু সময় লাগবে এস্টিমেট করা হয়েছে সেভাবেই প্লট করে দেওয়া হয়েছে |
শিবাজী মনে মনে রাজন্যার প্রশংসা করলেও মুখে কিছু বলল না | কিছু বাফার রাখার কথাটা পরে সৌম্যকে বলবে ভেবেছিল | রাজন্যার মত একজন জুনিয়ার মেয়ে এই কথাটা ভেবেছে দেখে খুশি হল | রাজন্যা নিজের মতের স্বপক্ষে আরো বললো,
– ধরো, যে কাজটা অনুরাগ আর আমি মিলে এক সপ্তাহে করব ভেবেছিলাম, কোনো কারণে আমাদের দুজনের কোনো আনপ্ল্যানড ছুটি নিতে হল। তখন এই টাইমটা কোথা থেকে ম্যানেজ হবে?
মণীষা বেশ বিরক্ত মুখে রাজন্যার দিকে তাকিয়ে ছিল | এবারে আবার বলে উঠলো,
– কেন প্রথম দিন তুমিই তো বলেছ, রাত অবধি কাজ করতে তোমার অসুবিধা নেই | কোনো কারণে আনপ্ল্যানড ছুটি নিতে হলে রাত অবধি কাজ করে করে সেটা সামাল দেবে।
– মণীষাদি, এটা জাস্ট একটা এক্সাম্পল ছিল | এখানে দুটো এক্সটার্নাল টুল এর সাথে ইন্টিগ্রেট করার স্কোপ আছে | আমরা যতটুকু স্টাডি করেছি তার বাইরে যদি কোন ধরনের সমস্যা আসে সেগুলো ম্যানেজ করার মত সময় হাতে থাকা দরকার | যাই হোক, সৌম্যদা তুমি দেখো, আমি জানি এই টিমে ডকুমেন্টেশনটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু আমার মনে হয় এটা এই ধরনের প্রজেক্ট এর জন্য একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় |
সৌম্য বুঝলো সেই প্রথম দিনের ডকুমেন্ট না দেখার প্রসঙ্গে একটা সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে নিল রাজন্যা। কথাটা নিতান্ত মিথ্যে নয় | সাবর্ণদাও কিছুদিন ধরেই বলছেন বড় প্রজেক্টগুলোতে ডকুমেন্ট ঠিকঠাক করার জন্য | আজকাল প্রজেক্ট ডেলিভারির পরেও অডিট হওয়া চালু হয়েছে | কি বলবে বুঝতে না পেরে শিবাজীর দিকে তাকালো |
– আমার মনে হয় রাজন্যার কথায় যুক্তি আছে | তবে দু সপ্তাহ শুধুমাত্র ডকুমেন্টেশনের জন্য রাখলে প্ল্যান টাকে জাস্টিফাই করা মুশকিল হবে | তাই ওই সময়টাতে অন্য কোন প্যারালাল অ্যাক্টিভিটি ঢুকিয়ে দাও।
মিটিং শেষে সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও মণীষা অপেক্ষা করে রইল। শিবাজী জিজ্ঞাসা করল,
– কিছু বলবে?
– হ্যাঁ শিবাজী দা, আপনি এই রাজন্যা মেয়েটিকে এত প্রশ্রয় দিচ্ছেন কেন? ওর কতটুকু অভিজ্ঞতা? এমনভাবে কথা বলছে যেন ওই ধরনের বড় প্রজেক্ট অজস্র হ্যান্ডেল করেছে!
শিবাজী মৃদু হাসলো,
– আইডিয়ালি রাজন্যা যে কথাগুলো বলেছে সে কথাগুলো আমি তোমার থেকে এক্সপেক্ট করেছিলাম মণীষা | তুমি ওদের থেকে অপেক্ষাকৃতভাবে সিনিয়র, তাই প্রজেক্ট প্ল্যানে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা তোমার চোখে আগে পড়া উচিত…
মণীষা থমকে গেল | ওর কথাটা এভাবে ওর কাছেই ফেরত আসতে পারে সেটা ভাবেনি | ওকে চুপ করে থাকতে দেখে শিবাজী আবার বলল,
– দ্যাখো মণীষা, তোমার বেশ কিছু অসুবিধা আমি মেনে নিয়েছি। তুমি বলে দিয়েছো সন্ধ্যা সাতটার পরে থাকতে পারবে না, তুমি এও বলেছ তোমাদের কনজারভেটিভ ফ্যামিলি, কোনোভাবেই তুমি অফিসের কাজে বিদেশে যেতে পারবে না | কিন্তু টিমের সাথে মিলেমিশে কাজ করাটা শিখতে হবে | আমরা এখানে একটা টিম হিসাবে কাজ করছি, আমি সিনিয়র বলে যে আমার কোন ভুল হতে পারে না তা তো নয়! এই একসেপ্ট করার ক্ষমতাটা আনতে হবে…
মণীষা আর কিছু বলল না | বুঝতে পারলো মাত্র কয়েক মাসেই এই মেয়েটা শিবাজী সেনের কনফিডেন্স অর্জন করে ফেলেছে। কিন্তু মনে মনে ভেবে রাখল সুযোগ পেলে এই রাজন্যা সান্যাল কে শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে |
মিটিং রুম থেকে ডেস্কে ফিরে শিবাজী দ্বৈপায়নের দিকে ঝুঁকলো,
– দীপু, তোর সাথে একটা দরকার আছে | একটু বাইরে আসবি?
– আসছি
মিনিট দুয়েক পরে শিবাজী আর দ্বৈপায়ন মিটিং রুমে গিয়ে ঢুকলো একসাথে |
– কি হয়েছে রে?
– আচ্ছা তুই বলেছিলি না তোর পরিচিত একজন ভালো লইয়ার আছেন?
– হ্যাঁ ওই আমার জামাইবাবুর ফার্মের অফিসিয়াল জিনিসপত্র যিনি দেখেন, কেন বলতো?
– আমার একটু সাহায্য লাগবে | সমর্পিতা কাল একটা চিঠি পাঠিয়েছে।
শিবাজীর সাথে দ্বৈপায়নের পরিচয় সেই এমসিএ পড়ার সময় থেকে | ফলে শিবাজীর ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত ওঠাপড়ার সঙ্গে পরিচিত ও। সমর্পিতার পাঠানো চিঠির বক্তব্য সম্বন্ধে শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থাকলো।
– আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ এত বছর পরে ও এটা করছে কেন!
– আই এম শিওর দেয়ার ইজ সাম ওয়ান নিউ ইন হার লাইফ, যে ওকে এটা করতে উসকাচ্ছে | আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল তুই লেটারের ক্লজ গুলো ভালো করে পড়েছিস? আই মিন যদি তুই তিতলিকে ওর কাছে ফিরিয়ে দিস তাহলে ও স্বস্তিকের মালিকানা চাইবে না?
শিবাজী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
– তিতলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না দীপু!
– সেটা পরের কথা | আমি বুঝতে চাইছি ওর কি আদৌ তিতলিকে ফিরে পাওয়ার কোন ধরনের আগ্রহ আছে ?
শিবাজী মোবাইলে চিঠিটার একখানা ছবি তুলে রেখেছিল, দ্বৈপায়নের দিকে এগিয়ে দিল | দ্বৈপায়ন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বার দুয়েক চিঠিটা পড়ে হাসিমুখ তুলে তাকাল শিবাজীর দিকে,
– ডোন্ট ওয়ারী | সমর্পিতার তিতলিকে নিজের কাছে ফেরত পাওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই। প্র্যাকটিক্যালি ওর দুটো অপশন একই কথা বলছে, হয় তিতলি ওর কাছে গিয়ে থাকবে, যাতে ও তিতলির অংশের ব্যবসা দেখাশোনা করতে পারে অথবা সরাসরি তিতলির অংশের পাওয়ার অফ অ্যাটর্ণি ওকে দিয়ে দিতে হবে | মোদ্দা কথা, ওর লক্ষ্য স্বস্তিকের পার্টনারশিপ |
– নিক! ওই নিয়ে যদি ও পুরোপুরি নিঃশর্তভাবে আমার জীবন থেকে বিদায় হয়, তাহলে অর্ধেক কেন পুরোটাই দিয়ে দিতে রাজি আমি |
দ্বৈপায়ন হাঁ হাঁ করে উঠলো,
– ইয়ার্কি নাকি! তোর দাদু ঠাকুরদার কষ্ট করে বানানো একখানা বিজনেস, সেটা ঐ বদমাইশ মেয়ের হাতে এমনি এমনি তুলে দিবি! আমার মনে হয় ঠিকঠাক ল-ইয়ারের হাতে পড়লে তোর চিন্তা করার কিছু নেই | আমি শতদ্রুদার সাথে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি সন্ধ্যাবেলা |
শিবাজী খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের সিটে বসতেই ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন তুলে দেখলো সাবর্ণদা কেবিনে ডাকছেন। অফিসের চ্যাটে না বলে কেবিনে ডেকেছেন যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু | শিবাজী দেরি না করে সীট ছেড়ে উঠে পড়ল | দ্বৈপায়ন মুখ তুলে একবার বলল,
– কিরে কোথায় চললি আবার?
– সাবর্ণদা ডাকছে | দেখি কি বলছে শুনে আসি…
সাবর্ণদার কেবিনে ঢুকে দেখল সৌম্য আগে থেকেই সেখানে বসে আছে, মুখ শুকনো | শিবাজী চেয়ার টেনে বসতে বসতেই সাবর্ণদা বিনা ভনিতায় শুরু করলেন।
– তোমাদের ইউএস যাওয়ার ডেটটা একটু এগিয়ে আসছে বুঝলে তো শিবাজী | প্রজেক্ট এর মাঝখানে নয়, প্রজেক্ট এর শুরুতেই যেতে হবে | আফটার টু উইকস ফ্রম নাউ | তোমাদের সাথে কথা বলে নিয়ে আমি ভিসা প্রসেস ফার্স্ট ফরওয়ার্ড করতে দেব।
শিবাজী একবার সৌম্যর মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– কিছু কি হয়েছে? সৌম্যর মুখ এরকম শুকনো কেন?
সৌম্য আমতা আমতা করে বলল,
– আসলে শিবাজীদা মায়ের সদ্য সদ্য শরীর খারাপ গেল, বাড়িতে তো আর কেউ নেই। এখন এক মাসের জন্য কি করে যাব সেটাই ভাবছি | ভেবেছিলাম প্রজেক্ট এর মাঝামাঝি সময়টাতে মানে এই মাস চারেক পরে মাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দেব | কিন্তু এখন সেটাও হবে না, মাকে প্রতি সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে দেখাতে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
– তাহলে?
সাবর্ণ কাঁধ ঝাঁকালেন,
– ইওর প্রজেক্ট, ইওর ডিসিশন | চাইলে তুমি একাও যেতে পারো, তবে আই উড প্রেফার আরেকজন টিম মেম্বার তোমার সাথে যাক | হোয়াট অ্যাবাউট মণীষা ?
সৌম্য আর শিবাজী একসাথে বলে উঠল,
– ও যাবে না!
– যাবে না বলে দিয়েছে?
– হ্যাঁ ওর বাড়িতে কি সব সমস্যা আছে, বাইরে যেতে পারবে না
– আশ্চর্য! বিয়ের আগেই এত কনসারভেশন!
– দেখলেন তো? আমি যখন বলি টিমে বেশি মেয়ে নেব না, তখন তো আমাকে হ্যাটা করেন!
– না না, ওটা তোমার জেনেটিক একটা মেয়েদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা, ওটা ঠিক নয়, তাহলে হু ইজ দ্যা নেক্সট চয়েস?
সৌম্য একবার শিবাজীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– আমার মতে রাজন্যা।
সাবর্ণ হাসলেন
– দ্যাট গার্ল?
সৌম্য উত্তর দিল,
– ও একটু ট্যারা ট্যারা কথা বলে আর একটু ছিটিয়াল ঠিকই কিন্তু এই মুহূর্তে এই গ্রুপের বেস্ট ডেভেলপার | আর শুধু ডেভেলপমেন্ট নয় ওর ইন জেনারেল প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধেও একটা স্বচ্ছ ধারণা আছে | আমার মনে হয়, ওকে নিয়ে গেলেই শিবাজীদার সব থেকে বেশি উপকার হবে…
(ক্রমশ)