#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৩)
সমুদ্র দেখলে আর নিজেকে সামলাতে পারে না রাজন্যা। কমলালেবু রংয়ের সুইমিং স্যুট পরে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল সমুদ্রের দিকে। কি সুন্দর পরিষ্কার নীল আকাশ। আশেপাশে রঙিন পোশাক পরা লোকজনের ভিড় | সবে সবে ঢেউয়ের জলের মধ্যে পা টা দিতে যাবে, পেছন থেকে কেউ একটা গম্ভীর গলায় ডাকলো,
– রাজন্যা! কি হচ্ছেটা কি?
সমুদ্রস্নানে বাধা পড়ায় বিরক্ত হয়ে পিছন দিকে ফিরে তাকাতে দেখল সি-বিচের উপরে আপাদমস্তক ফরমাল স্যুট বুটে সজ্জিত হয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন শিবাজী সেন।
– আপনি? এখানে?
– কি করব? এখনই তো তুমি সমুদ্রের মধ্যে স্নান করে ঠান্ডা লাগিয়ে শরীর খারাপ বাধিয়ে বসে থাকবে। প্রজেক্টর কাজ কে শেষ করবে তাহলে?
– আমার ঠান্ডা লাগবে না শিবাজী দা। আমি সমুদ্র ভীষণ ভালোবাসি | আমি একটু সমুদ্র স্নান করে আসি?
-একদম না! শিগগিরই এদিকে এসো | তোমার ল্যাপটপ নিয়ে এসেছি | ওই দিকে একটা ছাতার তলায় বসে কোডটা শেষ করে ফেল।
– এখন! এই সি বিচে বসে?
– তা নয় তো কি! আসার আগে পারমিশন নিয়েছিলে? আগে কোড কমপ্লিট করো |
– ওটাতে তো অনেকটা সময় লাগবে শিবাজী দা! পুরো একটা ওয়ার্কিং ডে!
– তার মানে নয় ঘন্টা তো? এই আমি এ্যালার্ম সেট করে দিচ্ছি, তিন ঘন্টা পরে অ্যালার্ম বাজবে তখন চেক করবে কাজের ওয়ান থার্ড শেষ হয়েছে কিনা |
লম্বা লম্বা পা ফেলে শিবাজীদা চলে গেলেন | রাজন্যা সুইমিং স্যুট পরেই নিমের পাঁচন গেলার মতন মুখ করে ল্যাপটপ কোলে করে ছাতার নিচে গিয়ে বসলো | একটুখানি কাজ করতে না করতেই অ্যালার্মটা টিঁ টিঁ করে বেজে উঠলো | কি আশ্চর্য! লোকটা কি তিন ঘন্টার জায়গায় তিরিশ মিনিটে সেট করে গেছে নাকি? অ্যালার্ম বন্ধ করার চেষ্টা করছে রাজন্যা, কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।
উফ কি মুশকিল রে বাবা! মোবাইলটা নিয়ে ঝাঁকাতে শুরু করল রাজন্যা, তবুও টিঁ টিঁ শব্দটা একটানা হয়েই চলেছে | হঠাৎই দুম করে একটা শব্দ, আর তারপরেই কেউ একটা রাজন্যার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল,
– কিরে রাজ! কখন থেকে অ্যালার্ম বাজছে!
রাজন্যা পিটপিট করে চোখ খুলল। কোথায় সমুদ্র? কোথায় নীল আকাশ? কোথায় কমলালেবু রঙের সুইমিং স্যুট? সেই পুরনো সবুজ রঙের ফুল ফুল ছাপ নাইটিটা পরেই নিজের বিছানায় শুয়ে আছে আর বেড সাইড টেবিলের উপরে অ্যালার্ম টা একঘেয়ে টিঁ টিঁ শব্দে বেজে চলেছে | সামনে মালবিকার মুখ ঝুঁকে আছে ওর মুখের উপরে।
মালবিকা ওকে চোখ পিটপিট করতে দেখে গালে হাত দিয়ে বলতে গেল,
– কি হয়েছে রে
এবং পরমুহূর্তেই চমকে উঠে বলল,
– তোর তো জ্বর রয়েছে রাজ, গাটা গরম!
রাজন্যা আবারও চোখ পিটপিট করল | দুই চোখ এবং মাথা বেশ ভারী লাগছে।
থার্মোমিটার দিয়ে দেখা গেল একশো এক ডিগ্রি ফারেনহাইটের থেকে সামান্য বেশি তাপমাত্রা | জোরজার করে উঠিয়ে চা বিস্কিট খাইয়ে একটা ক্যালপল হাতে ধরিয়ে দিল মালবিকা |
– শোন আজকে আর অফিস যাস না!
– ওরে বাবা! নতুন প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে, এখন না গেলে চাপ আছে
– আরে, তোদের তো সিকিওর ওডিসি জাতীয় ঝামেলা নেই, সেরকম দরকার হলে বাড়ি থেকেই কাজ করিস, কিন্তু বেরোস না |
প্রথমদিকে অফিস যাওয়ার জন্য জেদ করলেও রাজন্যা বুঝতে পারছিল শরীরটা সত্যিই ভালো লাগছে না। ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে জ্বরটা নামলেও মাথা ব্যথাটা রয়ে গেছে। সৌম্যকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিল অসুস্থতার জন্য যেতে পারবে না, তার সাথে অবশ্য এও জানিয়ে দিল যে কোন প্রয়োজন হলে অবশ্যই যেন ফোন করা হয়।
মালবিকা অফিসে বেরোনোর আগে পাউরুটি টোস্ট আর ডিমের অমলেট খাইয়ে দিয়ে গেল | দুপুরের খাবারের জন্যও চিন্তা করছিল। কিন্তু রাজন্যা ওকে আশ্বস্ত করল, জ্বর মুখে এমনিতেও ভাত খেতে ভালো লাগবে না, একটু ম্যাগি ট্যাগি কিছু খেয়ে নেবে | মালবিকা বেরিয়ে যাওয়ার পরে খানিক এদিক ওদিক করে ফের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল রাজন্যা এবং অল্প সময়ের মধ্যেই অঘোরে ঘুমিয়েও পড়ল |
রাজন্যার খালি সিটের দিকে শিবাজীকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে দেখে সৌম্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল,
– শিবাজীদা রাজন্যা আজকে আসবে না | শরীরটা খারাপ হয়েছে।
শিবাজী অসতর্কভাবে বলে ফেলল,
– কি হয়েছে? জ্বর বাধিয়েছে নিশ্চয়ই?
– হ্যাঁ মানে জ্বর হয়েছেই বলল | আপনাকে মেসেজ করেছিল?
– না, মেসেজ করেনি | তবে যে ধরনের কান্ড কারখানা করে, তাতে জ্বর হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়।
সৌম্য খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, কিছুতেই মনে করে উঠতে পারল না গতকাল রাজন্যা কি এমন করেছিল, যার দরুন শিবাজীদা এই মন্তব্য করলেন |
সারাদিনের নানান রকম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল | লাঞ্চের পর স্বয়ম, সাবর্ণদা আর দ্বৈপায়নের সাথে নিচে সিগারেট খেতে নেমে হঠাৎই গতকালের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল শিবাজী।
আচ্ছা মেয়েটা আছে কেমন?
এখানে পিজি থাকে | একা একাই আছে নিশ্চয়ই | আদৌ ঠিকঠাক ওষুধ বিষুধ খাচ্ছে কিনা কে জানে! সিগারেট শেষ করে ফেরার পথে উচিত অনুচিতের দোলায় দুলতে দুলতেই রাজন্যাকে ফোনটা করে ফেললো শিবাজী |
এদিকে রাজন্যার মাঝখানে যে ঘুম ভাঙেনি তা নয়, কিন্তু মাথায় এবং গায়ে এমন ব্যথা করছে যে উঠে আর ম্যাগিটুকুও বানাতে ইচ্ছা করে নি | কোনো রকমে গোটা দশেক মেরি বিস্কুট গলাঃধকরণ করে আবার এক দফা ক্যালপল খেতে হয়েছে। সকালে ওষুধ খাওয়ার ঘন্টা পাঁচেকের মধ্যেই ফের থার্মোমিটারের পারদ একশ ছাড়িয়েছিল | ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত সব টুকরো টুকরো স্বপ্ন দেখছে | কখনো দেখছে বাবাকে নিয়ে একটা বিরাট বড় ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে, কখনো দেখছে ও আর মালবিকা মরুভূমিতে উটের পিঠে চেপে কোথায় যাচ্ছে | কখনো আবার দেখছে অফিসে সবাই কিছু একটা নিয়ে খুব চেঁচামেচি করছে | আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যেই ফোনের রিংটা শুনতে পেল | চোখ না খুলেই বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে কানে ঠেকালো,
– হ্যালো!
– জ্বরটা বাঁধিয়েই ছাড়লে তাইতো? বাড়ি ফেরার পরে যে গরম জলে স্নান করে নিতে বলেছিলাম, সেটা নিশ্চয়ই আর করা হয়নি?
এই রে! শিবাজীদা ফোন করেছে। গা ব্যথা ভুলে উঠে বসল রাজন্যা। সত্যি কালকে বাড়ি ফিরে আর গরম জলে স্নান করতে ইচ্ছা করেনি | টাওয়েল দিয়ে ভালো করে চুলটুকু মুছে নিয়েছিল শুধু | আমতা আমতা করে উত্তর দিল,
– হ্যাঁ, না মানে গিজারটা কাজ করছিল না, তাই গরম জল করতে পারিনি…
– তোমাদের ফ্ল্যাটে গ্যাস নেই?
– গ্যাস? আছে তো
– তাতে একটু জল গরম করে নেওয়া যেত না?
আচ্ছা মুশকিল! কোথায় ফোনে জিজ্ঞাসা করবে শরীর কেমন আছে? তা না হয় ধমকে যাচ্ছে তখন থেকে | রাজন্যার হঠাৎ খুব অভিমান হল | ফস করে বলে ফেলল,
– আমি তো সৌম্যদাকে বলেছিলাম, কোন দরকার লাগলে আমাকে বলতে | আমি বাড়ি থেকে কাজ করে দেব।
শিবাজী অবাক হয়ে গেল | কি কথার কি উত্তর!
ওদিকে রাজন্যা তখনও বলে চলেছে,
– আমি তো জানি কেউ কোনো কারণে আসতে না পারলে আপনি মনে করেন সে ইচ্ছে করে কাজে ফাঁকি দিচ্ছে | আমি ইচ্ছে করে জ্বর বাধাই নি | অনেকক্ষণ ওয়েট করেও বৃষ্টি থামছিল না বলে বাধ্য হয়ে ভিজতে ভিজতেই বাস স্টপেজ অব্দি গেছিলাম, অতক্ষণেও বাস বা অটো পাবোনা সেটা বুঝতে পারিনি। গা-হাত-পা ব্যথা করছে, সারাদিন বিস্কুট খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে আমারও ভালো লাগছে না।
– বোকা বোকা কাজগুলো কম করলেই এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যায়। বাই দা ওয়ে, বিস্কিট খেয়ে আছো কেন? লাঞ্চ করো নি?
– কি করে করব? আমার তো আর বাড়িতে কোনো পিসিমা বা কৈলাসদা বসে নেই মুখের সামনে খাবার নিয়ে | শরীর ভালো লাগছিল না তাই কিছু বানাতে ইচ্ছা করেনি।
শিবাজী চট করে মনে মনে ভেবে নিল, তার মানে ভালোই শরীর খারাপ হয়েছে | ওই মেয়ে সারাদিন শুয়ে আছে মানে জ্বরের প্রকোপ কম নয়। গম্ভীর গলাতেই বলল,
– হুম বুঝলাম, আমি অত্যন্ত অমানবিক বস | তবে এহেন আমিও চাইবো না অসুস্থ শরীরে কেউ দশ ঘণ্টা এসে অফিসে কাজ করুক | কালকের দিনটাও ছুটি নিয়ে নাও। একেবারে বৃহস্পতিবার এসো |
রাজন্যা হাউমাউ করে উঠলো,
– না না, আমি আজ রাতের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাব…
পরমহুর্তে শিবাজীর ধমক শুনতে পেল,
– তুমি কি জ্যোতিষী? যা বলছি তাই করো আর কালকে তিতলিকে পড়াতে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই |
– সেকি! পড়াতে যাব না কেন? ওটা তো ঘন্টা দুয়েকের ব্যাপার। অফিসে যদি নাও যাই, পড়ানোটা আমি অবশ্যই করিয়ে দিয়ে আসব।
উফ! এই মেয়েটা এত অবাধ্য কেন? দুটো দিন রেস্ট না নিলে যে শরীর ঠিকঠাক হবে না সেটুকুও কি একে কাগজে লিখে বোঝাতে হবে!
শিবাজী অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল,
– জ্বর নিয়ে ছোট বাচ্চাদের কাছাকাছি না যাওয়াই ভালো সেটুকু অন্তত তোমার বোঝা উচিত
ওওও তার মানে উনি ভাবছেন আমার থেকে তিতলির শরীর খারাপ হতে পারে? গোমড়া মুখ করে রাজন্যা বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে | যাবো না | যতক্ষণ না টানা বারো ঘন্টা আমার টেম্পারেচার নাইনটি এইট পয়েন্ট ফোর ডিগ্রী ফারেনহাইট দেখাবে ততদিন পর্যন্ত যাব না। পিসিমাকে বলবেন সেই অনুযায়ী মাইনে কেটে নিতে। আমি রাখছি |
ফোনের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই মাথা নাড়াল শিবাজি, সত্যি বোধহয় এই মেয়ের মাথায় ছিটের পরিমাণ স্কেল দিয়ে মাপতে হবে।
কেন যেন রাগ, দুঃখ, অভিমান সবকিছু একসাথে হচ্ছে | কোন মানে হয় না জেনেও ডান হাতের উল্টোপিঠ নিজের কপালে ঠেকিয়ে জ্বর আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল রাজন্যা | নেই বলেই মনে হচ্ছে | আজকে স্নানটা পর্যন্ত করা হয়নি। বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এক সেট পরিষ্কার জামা পড়ে বাইরে আসতেই পেটের মধ্যে ছুঁচোদের দৌড়াদৌড়ি টের পাওয়া গেল | রাজন্যা করুণ মুখে ম্যাগির প্যাকেটের দিকে তাকালো | সত্যি বলতে এই মুহূর্তে ম্যাগি যে শুধু বানাতে ইচ্ছা করছে না তা নয়, খেতেও ইচ্ছা করছে না | কিন্তু এবারে কিছু একটা খেতেই হবে | অনিচ্ছা সহকারেও একটা দশ টাকার ম্যাগির প্যাকেট বের করে এনে সবে কাঁচি দিয়ে কাটতে যাবে, এমন সময় বেলটা বেজে উঠল | এখন আবার কে এলো? মালবিকার তো ফেরার সময় হয়নি! দরজা খুলতে সামনে সুইগী ডেলিভারি ছেলেটিকে দেখে অবাক |
– আপনি রাজন্যা সান্যাল তো?
– হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো কিছু অর্ডার করিনি!
– না অন্য একটা আইডি থেকে অর্ডার হয়েছে | ফ্রম মিস্টার শিবাজী সেন | এনজয় ইওর ফুড ম্যাম |
খাবারের প্যাকেটটা হাতে ধরে খানিকক্ষণ বোকার মতন খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো রাজন্যা। তারপর খেয়াল হতে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে প্যাকেটটা খুলতেই ঝাল ঝাল চিকেন চাওমিন বেরিয়ে গেল |
ওয়াও!
আর কিছু ভাবার বা বলার সময় নেই | এক ছুটে গ্যাসের পাশে রাখা কাটলারি স্ট্যান্ড থেকে একটা কাঁটাচামচ বার করে এনে সরাসরি চাওমিনের বাক্স থেকেই খেতে শুরু করল রাজন্যা |
বুধবার সকালে সামান্য গা ব্যথা থাকলেও জ্বর আর আসেনি | আগের দিন দুপুরে চিকেন চাওমিন খেয়ে শিবাজীদাকে মেসেজ করে একটা থ্যাংক ইউ জানিয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছিল রাজন্যা। সত্যি, একটা গোটা দিন বিশ্রাম নেওয়াটা প্রয়োজন ছিল। রাতে অবশ্য মালবিকা রাজন্যার ফেভারিট এগ তড়কা আর রুমালি রুটি কিনে নিয়ে এসেছিল | বুধবার অফিস যাওয়ার একটু একটু ইচ্ছা থাকলেও খানিকটা শিবাজীর ধমকের ভয়েই ও পথ আর মাড়াল না | তবে দিনের মধ্যে বার তিনেক অনুরাগকে ফোন করে নতুন প্রজেক্ট এর কি কি কাজকর্ম হলো সে খোঁজখবর নিয়ে ফেলল | বাকি দিনটা কোনো রকমে টিভি দেখে আর গল্পের বই পড়েই কাটানো গেল | বিকেলের চা খাওয়ার পরে মনে হল সকাল থেকে জ্বর যখন আসেনি তখন তিতলির পড়ানোটা বাদ দেওয়ার কোন মানেই হয় না | যেমন ভাবনা তেমন কাজ, পোশাক-আশাক পরে বেরিয়ে পড়ল | আজ যদিও আকাশ পরিষ্কার, তবু হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে ফোল্ডিং ছাতাটা নিতে ভুলল না |
সেনভিলার সামনে যখন গিয়ে পৌঁছালো, তখন ছটা বেজে পনের মিনিট। বেল বাজাতে কৈলাস দরজা খুলে দিল। রাজন্যাকে দেখে একটু অবাক হয়েই বলল,
– একি! ছোড়দাভাই যে বলল তোমার শরীর খারাপ, তুমি আসবে না?
রাজন্যা হাসলো,
– হ্যাঁ কাল একটু জ্বর হয়েছিল, তবে আজ সকাল থেকে একদম ঠিক আছি।
ভিতরে ঢুকতে যেতেই কৈলাস একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে উঠলো,
– কিন্তু পিসিমা যে তিতলি দিদিভাইকে নিয়ে একটু বেরোলেন…
– বেরোলেন?
– হ্যাঁ | আজকে তুমি আসবে না শুনে দিদিভাই খুব বায়না করছিল। তাই ওকে নিয়ে পিসিমা কোথায় একটা যেন গেলেন
– ও! আচ্ছা ঠিক আছে, ফিরতে দেরি হবে?
– ঠিক জানিনা | যদি বলতো কাছাকাছি কোথাও গেছে, তাহলে তোমাকে বসতে বলতাম | কিন্তু কতক্ষণ শুধু শুধু বসে থাকবে বুঝতে পারছি না
– না ঠিক আছে কৈলাসদা, আমি আসলে ভাবলাম শরীর যখন ঠিক আছে তাহলে শুধু শুধু পড়াটা আর বাদ দেই কেন | বুঝিনি যে এরকম হতে পারে…
কৈলাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিরক্ত মুখে হাঁটা শুরু করল রাজন্যা | আশ্চর্য লোক! একবার তো জিজ্ঞাসা করতে পারত আজকে শরীর কেমন আছে? পড়াতে যেতে পারবে কিনা? সকাল থেকে একটাও মেসেজ বা ফোন তো নেইই, আবার এদিকে বাড়িতে বলে রাখা হয়েছে যে রাজন্যা পড়াতে আসবে না | নিজের মনেই একটা ভেংচি কাটলো | দুদিন ধরে বাড়িতে বসে থেকে একটু বিরক্ত হয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফিরতে ইচ্ছাও করছে না | মালবিকাটা আজ ওর সদ্য হওয়া বয়ফ্রেন্ডের সাথে কফি ডেটে গেছে | সেই গিয়ে ফাঁকা ফ্ল্যাটেই ঢুকতে হবে | আচ্ছা সমাদৃতার সাথে একটু গল্প করে গেলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ | ডানদিকের গলি দিয়ে বাস স্টপেজের দিকে না গিয়ে সোজা হাঁটা লাগাল রাজন্যা।
সামাদৃতাদের বাড়িতে বেল বাজাতে দরজা খুলে দিলেন ওর মা | মাধবী রাজন্যাকে চিনতে পারেননি, কাকে চাই জিজ্ঞাসা করাতে সমাদৃতার নাম বলল। ‘ভেতরে এসো’ বলে রাজন্যা কে নিয়ে সমাদৃতার ঘরের দিকে এগোতেই চট করে ওনার মনে পড়ে গেল এই মেয়েটিই আগের দিন এসেছিল | ঘুরে দাঁড়ালেন,
– আচ্ছা তুমিই আগের দিন এসেছিলে তাই না?
– হ্যাঁ কাকিমা
– ও, দিঠি বলছিল তুমি নাকি সুমিত্রার নাতনিকে পড়াতে যাও?
– হ্যাঁ, এই মাস খানেক এর কাছাকাছি হল পড়াচ্ছি
– আচ্ছা। কি অবস্থা না? ওইটুকু বাচ্চার জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখতে হয়!
রাজন্যা ওনার কথার মধ্যে শ্লেষটুকু বুঝতে না পেরে বলে উঠলো,
– সেই তো! বাচ্চাটার মা এখানে থাকেন না, আবার বাবাও এত ব্যস্ত | পিসিমার তো মনে হয় চোখের কোন একটা সমস্যা আছে |
মাধবী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন মেয়েটির দিকে,
– ওর মা এখানে থাকে না কে বলেছে?
এবারে রাজন্যার অবাক হওয়ার পালা।
– না মানে ওর মাকে তো দেখি না!
– কিন্তু ওরা কিছু বলেছে, কেন ওর মা ওখানে থাকে না?
রাজন্যার এবার একটু অস্বস্তি লাগছে | ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
– না না আমি অত কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। তিতলি মেয়েটা খুব মিষ্টি। আমার ওকে পড়াতে ভালোই লাগে। তাছাড়া আমার নিজেরও একটু পয়সা কড়ির প্রয়োজন ছিল | একটা ভালো পরিবারে একটা মিষ্টি বাচ্চাকে পড়ানোর কাজ পেয়ে আমার তো ভালোই হয়েছে।
– ভালো পরিবার, হুহ্…
নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে কথাটুকু বলে মাধবী সমাদৃতার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
– দিঠি, সেই মেয়েটি এসেছে…
রাজন্যা কে দেখে খুশি হয়ে উঠল সমাদৃতা | ঘরের ভিতরে ঢুকে বিছানার এক কোণায় বসতে বসতে রাজন্যা বলল,
– কেমন আছো?
সমাদৃতা হেসে ফেলল,
– এইতো তিনদিন আগেই দেখা হল | এর মধ্যে আর কি এমন হবে!
– তা বললে চলবে না | সোমবার বৃষ্টিতে ভিজে মঙ্গলবার জ্বরে উল্টে পড়েছিলাম আমি।
– এ বাবা তাই নাকি! আজকেই আবার পড়াতে এসেছ?
– আজ আসলে আর সকাল থেকে জ্বর ছিল না। তাই ভাবলাম শুধু শুধু পড়ানোতে কামাই করি কেন? কিন্তু এসে দেখলাম আমি আসবো না ভেবে তিতলি ওর ঠাম্মির সাথে কোথাও বেরিয়েছে |
– ওহো শুধু শুধু আসা হল। খুব ভালো করেছো কিন্তু এখানে এসে | আমার তো কোথাও বেরোনো হয় না তেমন, কেউ এলে খুব ভালো লাগে।
দুই প্রায় সমবয়সী তরুণী গল্প করল বেশ কিছুক্ষণ | তার মধ্যে নিজেদের ছোটবেলার নানান রকম গল্প, পছন্দের বই, পছন্দের সিনেমা সব কিছু নিয়েই আলোচনা চললো। মাধবী একবার এসেছিলেন চা আর সাথে চিকেন পকোড়া নিয়ে | মেয়েকে অনেকদিন বাদে এমন প্রফুল্ল ভাবে কারো সাথে গল্প করতে দেখে মনটা আর্দ্র হয়ে উঠলো | মেয়েটির সাথে সেনভিলার যোগসূত্রের কারণে একটু আগেই যে বিরূপ হয়েছিলেন, সেটুকু ভুলে বললেন,
– তোমার তো এ পাড়ায় যাওয়া আসা থাকবেই | মাঝেমধ্যে এসো অবশ্যই | দিঠির ভালো লাগবে |
ততক্ষণে গোটা দুয়েক পকোড়া রাজন্যার মুখে চালান হয়ে গেছে | চিবাতে চিবাতেই বলে উঠলো,
– এরকম পকোড়া যদি খাওয়ান কাকিমা, রোজ আসব | পড়ানো না থাকলেও আসব|
ওর কথা বলার ধরনে সমাদৃতার সাথে সাথে হেসে ফেললেন মাধবীও | রাজন্যা ততক্ষণে আরো দুখানা পকোড়া হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করেছে,
– না মানে ধরুন, এই যে চিকেন পকোড়ার মতন উপাদেয় একটা ব্যাপার, এটা মানুষ কেন আবিষ্কার করেছে? খাওয়ার জন্যই, তাই তো? এইসব ফেলে সারাদিন ধরে ওটস, গ্রিন টি, দালিয়ার খিচুড়ি কেন খাব বলুন? কি না, ওই সব খেয়ে সুস্থ ভাবে বেশিদিন নাকি বেঁচে থাকা যাবে | বেশিদিন বেঁচে করবটা কি? আরো বেশি দিন ধরে এসব অখাদ্য খাবার খাব? থাক! তার চাইতে আমি বিরিয়ানি, কড়াইশুঁটির কচুরি, চিকেন পকোড়া, মাটন রোগনজোশ খেয়ে তাড়াতাড়ি স্বর্গে যাব | স্বর্গে সেন্ট্রালাইজ এসিতে বসে আরো ভালো ভালো খাব |
এবারে সমাদৃতা জোরে জোরেই হেসে ফেলল | মাধবীও হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরোলেন |
উনি বেরিয়ে যেতে সমাদৃতার কাছে আরেকটু এগিয়ে এসে রাজন্যা বলল,
– এই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব গো?
– হ্যাঁ বলো
– তোমরা তো কাছাকাছি থাকো, তিতলির মায়ের ব্যাপারে কিছু জানো? আই মিন প্রথম দিন সুমিত্রা পিসিমা আমাকে বলেছিলেন যে ওর মা নেই | আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোনো কারণে উনি মারা গেছেন, কিন্তু পরে তিতলির কাছে ওনার ছবি দেখেছি | উনি তো বেঁচেই আছেন, তাহলে একসাথে থাকেন না কেন?
সমাদৃতার মুখটা কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল | পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– জানিনা গো, ওদের বাড়ির ব্যাপারে তেমন একটা কিছু জানিনা আসলে
– ও আচ্ছা | আসলে এই কয়েকদিনেই তিতলির উপরে ভীষণ মায়া পড়ে গেছে | আসলে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। আমি খুব ভালো বাচ্চা ম্যানেজ করতে পারি জানো তো | তাই তিতলির সাথে অল্প কয়েকদিনেই একটা কেমন যেন বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে আমার, আর তাতে বুঝতে পারি বাচ্চাটা ওর মাকে ভীষণ মিস করে |
সমাদৃতা টের পাচ্ছে চোখের কোনে বাষ্প জমা হচ্ছে | দুই চার বার ঢোঁক গিলে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
– না গো রাজন্যা। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি কিছু জানি না। আর নিশ্চয়ই স্পর্শকাতর বিষয়, আমার মনে হয় তুমিও এটা নিয়ে কারোকে কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না।
রাজন্যা মাথা নাড়লো,
– ঠিকই বলেছ | নিছকই কৌতুহল, তাও তিতলির মুখ চেয়ে |
– জানো তো রাজন্যা, মানুষকে ভগবান সমস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার মতন মানসিক শক্তি দিয়েই পাঠান। তা না হলে কি অহরহ কাছের মানুষের বিয়োগ যন্ত্রণা সহ্য করে আমরা আজ বেঁচে থাকতে পারতাম? তিতলিও ধীরে ধীরে ওর মায়ের অভাব বোধ কাটিয়ে উঠবে দেখে নিও |
– ঠিকই বলেছ | পুরোটা না জেনে নিজের মতো ভালো করতে গিয়ে আবার খারাপ না করে ফেলি!
– একদম ঠিক বলেছ।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বেরিয়ে পড়ল রাজন্যা | গল্পে গল্পে কখন আটটা বেজে গেছে টের পায়নি | জ্বরটা এ যাত্রা একদিনের উপর দিয়েই গেল তাহলে। কাল অফিস গিয়ে দেখতে হবে কাজকর্ম কতদূর কি এগিয়ে গেল | ওই মণীষা যতই সিনিয়র হোক না কেন, ওকে মোটেই প্রজেক্টের মেইন রিসোর্স হয়ে উঠতে দেওয়ার ইচ্ছা নেই রাজন্যার।
(ক্রমশ)
#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১৪)
রাজন্যা বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ হলো | সমাদৃতা চুপচাপ বসে আছে নিজের ঘরে। মুখে যতই বলুক যে কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতন মানসিক শক্তি মানুষের থাকে, সত্যি থাকে কি?
নিচু হয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকাল | ডাক্তার বলেছেন যেভাবে চিকিৎসা চলছে তাতে বছর দুয়েকের মধ্যে ও হাঁটাচলা করতে পারবে। তবে বিশেষ ধরনের নিউরোসার্জারিতে সাফল্যের আশা একটু বেশি, সে ক্ষেত্রে হয় তো আগের মত নাচের জগতেও ফিরতে পারবে ও | কিন্তু তার জন্য বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে, আনুমানিক অর্থ ব্যয়ের পরিমাণও প্রচুর | সমাদৃতার বাবা মোটামুটি সফল আইনজীবী ছিলেন | এক প্রজন্মেই প্রভূত পরিমাণ বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন | দুই মেয়েকে বড় করার সময় তাদের কোন রকমের আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখতে দেননি। বন্ধু মহলে বড়লোক বলেই পরিচিত ছিল ওরা | কিন্তু বছর কয়েক আগে ওদের পরিবারের উপরে ধেয়ে আসা সেই ভয়ানক কালবৈশাখীতে জীবনের অনেক সমীকরণই বদলে গিয়েছে। ওদের আর্থিক পরিস্থিতিও | তার জন্য অনেকাংশে পরিবারের এক প্রিয় সদস্যও হয়তো দায়ী। সেই দুর্ঘটনায় সমাদৃতার পায়ের সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই সময়কার কিছু কিছু স্মৃতিও | মাধবী মানতে চান না যে তাঁর সন্তান কোন অন্যায় করেছে, কিন্তু সমাদৃতার আবছা স্মৃতি হাতড়ালে ওর মনে হয় দিদিয়া কিছু একটা ভয়ানক অন্যায় করেছিল |
সমর্পিতা বাড়িতে না জানিয়ে স্বস্তিক ফ্যাশন হাউজে মডেল হিসাবে জয়েন করেছিল | এমনকি সমাদৃতাকেও এ ব্যাপারে জানায়নি | বলেছিল কোন একটা কোম্পানিতে একটা টেম্পোরারি জব পেয়েছে | ওদের বাবা সত্যেন মল্লিক অবশ্য তাতেও একটু রাগারাগি করেছিলেন | ল এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী পড়াশোনায় মন না দিয়ে চাকরি করছে সেটা তাঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না। আসল ব্যাপারটা জানা গেল যেদিন স্বস্তিকের মালিক শিবনাথ সেনের ছোট ছেলে শিবাজী সেন সমর্পিতার সাথে এই বাড়িতে এলো। সমর্পিতার অভিপ্রায় ছিল শিবাজীর মতন সুশিক্ষিত এবং মার্জিত ব্যবহারকারী যুবককে দেখিয়ে বাবার মনে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত মানুষদের সম্বন্ধে একটা ভালো ইম্প্রেশন তৈরি করা | মাকে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিল না সে | কথায় কথায় বেরিয়ে গিয়েছিল পরিবারটি ওদের বাড়ির কাছাকাছিই থাকে এবং শিবাজীর পিসিমা, সুমিত্রা দেবী মাধবীর পূর্ব পরিচিত। শিবাজী থাকাকালীন তেমন কিছু না বললেও সত্যেন ফেটে পড়লেন ছেলেটি বিদায় নেওয়ার পরে।
– তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে মিঠি? ল পড়া ছেড়ে তুমি এখন মডেলিং করবে?
বাবা যে এত সহজে মেনে নেবেন না সেটা আগেই আন্দাজ করেছিল সমর্পিতা, পাল্টা প্রশ্ন করল,
– কেন বাবা? মডেলিং খারাপ কিসের?
– খারাপ কিসের? কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে মডেলিং করতে যায়?
– কি বলছো তুমি বাবা? কোন জগতে আছো! টিভিতে যে বিজ্ঞাপন দেখো, বিভিন্ন রকমের ফ্যাশন শো এর অনুষ্ঠান দেখো তারা কি সবাই অভদ্র পরিবারের নাকি? মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স সেই সমস্তও তো দ্যাখো। তোমার কি ধারণা সেই সমস্ত মহিলারাও কেউ ভদ্র পরিবারের নয়?
– তা তুমি কি নিজেকে মিস ওয়ার্ল্ড পর্যায়ে ভাবতে শুরু করেছো নাকি?
সত্যেনের কণ্ঠস্বরে শ্লেষ ঝরে পড়ল |
– অবশ্যই না! সেটুকু বাস্তব জ্ঞান আমার আছে | কিন্তু একজন মিস ওয়ার্ল্ড সাধারণ মডেল হিসাবেই নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন, তাই না?
– শোনো মিঠি, বুঝতেই পারছি তোমার নিজেরও এই পেশাটা নিয়ে কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই, আর সেটা তুমি নিজেও জানো। তা না হলে মিথ্যে কথা বলে একমাস ধরে ওই চাকরি করতে যেতে না |
– একমাস আগে বললেও তুমি ঠিক এই ভাবেই রিয়াক্ট করতে বাবা | তাই একটু সময় নিয়েছি | স্বস্তিক ফ্যাশন হাউজ কলকাতার যথেষ্ট নামকরা, শপিংমলে তো দেখেছো ওদের ব্র্যান্ডের পোশাকের কি পরিমান চাহিদা | আর আজকে শিবাজীকেও দেখলে | ওকে দেখে নিশ্চয়ই তোমার অভদ্র পরিবারের বলে মনে হয়নি?
সত্যেন বাঁকা হাসলেন,
– তুমি নিতান্তই মূর্খ, তাই ওই পরিবারের ছেলেকে দিয়ে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট জাহির করতে এসেছ | যে ছেলের মা সিনেমা করার নাম করে অন্য লোকের বিছানায় গিয়ে ওঠে, তার চরিত্র দেখে আমি বিচার করব তাদের কোম্পানি কেমন?
– বাবা!
সমর্পিতা আর পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো সমাদৃতা দুজনেই হতবাক | শিবাজী এবং সৌভিকের মায়ের ঘটনাটা যে সময়ের সেই সময় সমর্পিতা অনেকটাই ছোট, সমাদৃতা জন্মায়নি। তার ফলে কাছাকাছি এলাকায় ওই নিয়ে যে কুৎসা ছড়িয়েছিল সে সম্পর্কে ওরা কিছুই জানে না |
সমর্পিতাকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সত্যেন ঠোট বেঁকিয়ে বললেন,
– যাও গিয়ে তোমার ওই ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করো তার মা কোথায়? কেন থাকে না তাদের সাথে? কোথায় থাকে?
– আহ্ কি হচ্ছে কি!
অনেকক্ষণ বাদে মৃদুস্বরে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন মাধবী | জ্বলন্ত চোখে মাধবীর দিকে তাকালেন সত্যেন |
– এই তোমার অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের ফলেই এইসব হয়েছে | মা হয়েছো, সারাদিন বাড়িতে থাকছো, অথচ টের পাও না মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কাদের সাথে মিশছে!
– আশ্চর্য! মাকে এর মধ্যে টানছো কেন?
সমর্পিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই সত্যেন প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলেন,
– এক থাপ্পড়ে মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব | আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা শুনে থাকতে হবে | ঐসব মডেলিং এর ভূত মাথা থেকে তাড়াও | এল এল বি কমপ্লিট করে ফার্ম জয়েন করো | গা দেখিয়ে ছোট ছোট পোশাক পরে লোকের চোখের সামনে হেঁটে বেড়াবে, সে আমি কিছুতেই মেনে নেব না |
আর কারোর কোন কথার অপেক্ষা না করে সত্যেন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন | মাধবী অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। বুঝলেন আজ আর বাড়িতে ডিনার করবেন না সত্যেন। কোনো বার অথবা রেস্টুরেন্টের খাবার এবং পানীয় ওঁর পকেট হালকা করবে আজ | কঠিন দৃষ্টিতে ফিরলেন বড় মেয়ের দিকে,
– তোকে আমি এত বিশ্বাস করি মিঠি, আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলি?
– কি করবো মা! তোমার কাছ থেকে লুকোতে চাইনি, কিন্তু তোমাকে বললেই তুমি বাবাকে বলে ফেলতে | বাবা না হয় অর্থোডক্স, কিন্তু তুমি তো জানো আমি ছোট থেকেই ফ্যাশন দুনিয়ায় পা রাখতে চাই | ভালো করে আমার দিকে তাকাও, তোমার মনে হয় আমি সারা জীবন ওই সাদা কালো পোশাক পরে কোর্টে সওয়াল জবাব করার জন্য তৈরি হয়েছি? আই বিলঙ্গ টু দ্যা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড মা | সেই ছোট থেকে পাড়ার ইভেন্ট, স্কুল-কলেজের ইভেন্ট, এমনকি হঠাৎ করে কোন শপিং মলে হয়ে যাওয়া ইভেন্টেও আমি কিভাবে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করেছি এবং কিভাবে সকলের প্রশংসা পেয়েছি সেগুলো তো তুমি জানো | তুমি ভুলে গেছো ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্যান্টালুনসে টিন এজার সেকশনের ফ্যাশন শো-তে আমি প্রাইজ পেলাম? স্কুল-কলেজের যাবতীয় অনুষ্ঠানে ঠিক সেন্টারের পজিশনটা সবসময় আমার জন্যই বাঁধা থাকতো কেন মা? এগুলো সমস্ত একটা জিনিসের দিকেই নির্দেশ করে | আই অ্যাম মেড ফর দ্যা স্টেজ মা! প্লিজ আমার পাশে দাঁড়াও, বাবাকে বোঝাও |
– তোর বাবাকে বোঝাতে গেলে আগে আমাকে বুঝতে হবে মিঠি, তোর একজ্যাক্টলি কাজটা কি হবে?
সমর্পিতা মাকে হাত ধরে এনে সোফায় বসালো | তারপরে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলল স্বস্তিক ফ্যাশন হাউজের নতুন লঞ্চ মেহেন্দি ক্লোদিং লাইনের কথা | এই নতুন ক্লোদিং লাইনের মুখ্য মডেল হবে সমর্পিতা। মডেল হিসাবে রাম্পে হাঁটা ছাড়াও আর কি কি ধরনের কাজ ওকে করতে হতে পারে, কি ধরনের এ্যাডের জন্য শ্যুটিং করার প্রয়োজন হতে পারে, মাঝেমধ্যে শহরের বাইরে যেতে হতে পারে। সমস্তটাই গুছিয়ে বলল |
– তাহলে ভেবে দেখো, বিবাহিত মহিলাদের পোশাক। সেটা নিশ্চয়ই গা বার করা কিছু হবে না। দরকার হলে আমি তোমাকে অফিসে সৌভিক স্যারের পারমিশন নিয়ে ড্রেসের স্কেচের একটা দুটো ছবি তুলে এনে দেখাতে পারি।
মেয়ের কথা শুনে খানিকটা হলেও নিশ্চিন্ত হলেন মাধবী | সত্যি বলতে মডেল বললে তাঁর মনেও গা দেখানো পোশাক পরে ক্যামেরার আলোর ঝলকানির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েদের কথাই মনে পড়ে।
– ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব | কিন্তু কথা দিতে পারছি না |
এতক্ষণে সমাদৃতা বেরিয়ে এলো পর্দার পিছন থেকে।
– মা! বাবা কি বলছিল ওই শিবাজীদার মায়ের ব্যাপারে?
মাধবী থমকে গেলেন | সেই সময় শিবনাথ সেনের স্ত্রী রমলার সিনেমায় নামা এবং পরবর্তীতে সিনেমা পরিচালকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে এই এলাকায় রীতিমতো গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল | কিন্তু অদ্ভুতভাবে এর বছর দেড়েকের পর থেকেই রমলাকে না আর সিনেমার পর্দায় দেখা গেল, না তাকে দেখা গেল সেন ভিলায় ফিরে আসতে | মানুষের কৌতুহল ক্ষণস্থায়ী নিয়মিত আলোচনা করার বিষয় না থাকলে, চর্চা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় | এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল | রমলা সেনের কথা ভুলে গিয়েছিল এলাকার মানুষ | আজ এতদিন পরে সেই প্রসঙ্গ ফিরে আসাতে একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন মাধবী | শিবনাথ সেনের বোন সুমিত্রা এবং মাধবী একই কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন, আলাদা করে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব না থাকলেও একে অপরকে চিনতেন এবং ভদ্রতা সূচক সম্পর্ক ছিল। সুমিত্রার বিয়েটা যে ঠিকঠাক হয়নি তা পরবর্তীকালে শুনেছিলেন নিজে এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর | পুরনো বান্ধবীর সাথে দুই একবার সাক্ষাৎ হলেও তেমন একটা ঘনিষ্ঠতা আর নতুন করে গড়ে ওঠেনি | তবে শুনেছিলেন শিবনাথ সেনের দুটি ছেলেকে মায়ের স্নেহ দিয়েই বড় করেছেন সুমিত্রা।
ছোট মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে মাধবী বললেন,
– শিবাজীর মা সিনেমার নায়িকা হয়েছিলেন। সেই নিয়েই কিছু পারিবারিক অশান্তি এবং উনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
– তাই নাকি মা? কি নাম ছিল ওনার?
– রমলা, রমলা সেন
চট করে ফোনে খানিক খোঁজাখুঁজি করে ফেলল সমর্পিতা। তারপর মুখ তুলে বলল,
– কই রমলা সেন বলে কোনো নায়িকার কথা খুঁজে পাচ্ছি না তো!
– দুটো তিনটে সিনেমা করেছিল। হয়তো সেজন্য…
– তা কেন? অন্তত নামটা তো দেখাবে | আচ্ছা কোনো ছদ্মনামে সিনেমা করেননি তো?
– ছদ্মনাম?
মাধবী একটু চিন্তা করার চেষ্টা করলেন | নাহ্, মনে পড়ছে না |
রাজন্যা বাড়ি ফেরার অল্প সময়ের মধ্যেই সুমিত্রার ফোন এলো,
– ও মেয়ে, কৈলাস বলল তুমি নাকি তিতলিকে পড়াতে এসেছিলে? আর এদিকে বাবাই যে বলল তোমার শরীর খুব খারাপ, তাই পড়াতে পারবে না?
রাজন্যা পড়ল একটু সমস্যায় | পিসিমা কি জানেন যে শিবাজীদাই ওর অফিসের বস? ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার অফিসের গোমড়ামুখো বসের নিন্দামন্দ করেছে পিসিমার সামনে। সেই ব্যক্তিটি যে তার আদরের ভাইপো সেটা জানার পরে রাজন্যার খাতির যত্নে যদি কম পড়ে? একটু আমতা আমতা করে বলল,
– আসলে গতকাল জানিয়েছিলাম যে শরীর খারাপ থাকলে হয়তো যেতে পারবো না | আজ দেখলাম জ্বর নেই, তাই চলে গেছিলাম |
– বোঝো কান্ড! অতদূর থেকে এলে, বসে একটু চা টা তো খেয়ে যেতে পারতে। কৈলাসটাও হয়েছে তেমনি!
– ও কিছু হয়নি পিসিমা | তবে চাইলে কাল গিয়ে ক্লাসটা করিয়ে আসতে পারি |
– আবার কাল আসবে? আচ্ছা দেখো | তোমার অসুবিধা না হলে এসো | তোমার ছাত্রী তো তার দিদিমণিকে না দেখতে পেলে রাজ্য মাথায় করে!
অভ্যাস মতন সকাল সকাল অফিস পৌঁছে ডেস্কের উপর ব্যাগটা রেখে সামনে তাকাতেই রাজন্যাকে বসা দেখে ভ্রু উপরে উঠে গেল শিবাজীর | একটু গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– কি ব্যাপার? আজকে ব্রাশ করতে করতে অফিস চলে এসেছ নাকি?
রাজন্যা মাথা তুলে একবার তাকাল, তারপরে গম্ভীর মুখে বলল
– গুড মর্নিং।
– গুড মর্নিং! কিন্তু আজকে এত সকালে কেন?
– শিবাজীদা, আপনি প্রথম দিন খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন যে দেরিতে আসা আপনি পছন্দ করেন না | তাড়াতাড়ি আসাও যে আপনি পছন্দ করেন না, তা তো বলেননি?
– আশ্চর্য! একটা সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে পারো না?
শিবাজী আর কোন কথা না বলে বিরক্ত মুখে ল্যাপটপ বার করে ডেস্কের উপরে রেখে সেট করতে লাগলো | রাজন্যা কিছুক্ষণ ওই দিকে তাকিয়ে থেকে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়ল | ভেবেছিল তাড়াতাড়ি গেলে অল্প কিছুটা সময় শিবাজীদার সঙ্গে একলা কাটাতে পারবে | জিজ্ঞাসা করবে কেন আগে থাকতে তিতলিকে ওর না আসার কথা বলেছিলেন | বাকিরা এসে গেলে এই বিষয়ে কথা বলা যাবে না | কিন্তু সত্যি, কি বলতে যে কি বলে ফেলল! আড় চোখে তাকিয়ে দেখল শিবাজীদার মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। একবার সরি বলবে কিনা ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠলো | মা ফোন করছে |
– হ্যাঁ মা…
ফোনে কথা বলতে বলতে উঠে ওডিসির বাইরে চলে গেল রাজন্যা | ওদের ওডিসি আর ওয়াশরুমের মাঝে একটা লম্বা করিডোর আছে। ওইখানে দাঁড়িয়ে বা হাঁটাহাঁটি করতে করতে লোকজন সাধারণত ব্যক্তিগত ফোনের কথাবার্তা বলে। আর তেমন তেমন আলোচনা হলে কেউ কেউ আবার সিঁড়ির কাছে গিয়েও কথা বলে।
– তোমার তো আগামীকাল স্যালারি পাওয়ার তারিখ | মনে করিয়ে দিলাম যে এ মাসে একটু বেশি টাকা পাঠাবে |
– হ্যাঁ মা, মনে আছে | তবে ভাইয়ের টিউশনের ওই এক্সট্রা টাকাটা আমি কালকেই পাঠাতে পারব না |
– মানে! ওর স্যার কে এক তারিখেই টাকা দিতে হয়। পাঠাতে পারব না বললে কি করে চলবে?
– তুমি তো জানো মা আমার ইএমআই, এখানে পিজির রেন্ট এই সমস্ত তে কতটা খরচা হয় আর তারপরে সত্যি বলতে এক্সট্রা টাকা থাকে না হাতে | আমি একটা নতুন টিউশন করছি, সেই মাইনের টাকাটাই ভাইয়ের টিউশনের টাকা হিসেবে দেবো ভেবেছি | ওখান থেকে মাইনে পেলে তবে দেব |
– তাহলে ওদেরকে বলো কালকে টাকাটা দিয়ে দিতে!
– ওরকম ভাবে বলা যায় না মা! সবে একমাস পড়াচ্ছি | এইভাবে টাকা টাকা করা যায় নাকি?
– বোকার মতন কথা বোলোনা, প্রফেশনাল হতে শেখো | আমাকে যেন কাল আবার ফোন না করতে হয়
ফোনটা কেটে যেতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাজন্যা | মুখটা তেতো লাগছে | মালবিকা মাঝে মাঝে ওকে বলে
– মায়ের সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে নেওয়াটা তোর ঠিক হচ্ছে না রাজ। মাঝেমধ্যে না বলতে শেখ…
কিন্তু কেন যেন রাজন্যা জোরালো প্রতিবাদ করে উঠতে পারে না কিছুতেই | ঘরের বাইরের প্রতিবাদী, বাচাল রাজ নিজের বাড়িতে নিজের আপনজনেদের কাছে কেমন যেন কথা হারিয়ে ফেলে | সেই ছোট্টবেলার মা মারা যাওয়ার পরের নিরাপত্তাহীনতা বোধটা আঁকড়ে ধরতে থাকে ওকে। কেবল মনে হয় না হয় করল একটু অন্যায় আবদার, তবু একটা পরিবার তো আছে সাথে।
ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় রাজন্যার ফোনের কথাবার্তার টুকরো টুকরো কথা কানে এলো শিবাজীর। এক তরফা কথার যেটুকু শুনতে পেল, তাতে বুঝতে পারল মেয়েটির কাউকে কিছু টাকা দেওয়ার আছে, যার জন্য তিতলির টিউশনের মাইনের উপরে ও নির্ভরশীল | আগের দিন বলেছিল মেয়েটি যে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। হয়তো সেই টাকার কথাই বলছে | মনে মনে ভেবে নিল শিবাজী, আজকেই পিপিয়াকে বলে দেবে রাজন্যার একাউন্টে মাইনের টাকাটা মাসের শেষ তারিখেই যেন ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। পড়ানোর দিনের জন্য অপেক্ষা না করে |
দিনটা মোটামুটি ব্যস্ততার মধ্যেই কাটলো | পুরনো প্রজেক্টগুলোর টুকিটাকি কাজ এবং নতুন প্রজেক্টের একাধিক মিটিং, বিভিন্ন প্ল্যান নিয়ে আলোচনা | রাজন্যা মনে মনে বিশেষ উত্তেজিত | যে কোনো নতুন কাজে হাত দিতে ওর বরাবরই ভালো লাগে | সৌম্যকে আগেভাগেই বলে রেখেছে, ওর দেরি অবধি অফিসে থাকা নিয়ে কোন সমস্যা নেই, ছুটির দিনে বাড়ি থেকে কাজ করা নিয়েও কোন সমস্যা নেই। সৌম্য হাসতে হাসতে বলেছে,
– আগে থেকেই এত এক্সপেক্টেশন সেট করে দিস না রাজ। ক্লায়েন্ট তাহলে মাথার উপরে চেপে বসবে। তেমন প্রয়োজন হলে করবি, কিন্তু সেটাকেই রেগুলার প্র্যাকটিস বানিয়ে ফেলিস না।
ছ’টা বাজতে রাজন্যা সৌম্যর কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
– সৌম্যদা তাহলে আজকে এখন আর কোনো কল নেই তো?
সৌম্য একবার ল্যাপটপে মিটিং ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল,
– না আজ আর কিছু নেই। তুই বেরোবি বলেছিলি তো? ঠিক আছে বেরিয়ে যা।
গত কয়েকদিন শিবাজীর বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়েছে, মেয়ের সাথে ডিনার করা বাদ গেছে কয়েকদিন | আজকাল যদিও তিতলি যে কোন বিষয়ে অপেক্ষাকৃত কম বায়না করে, পিপিয়ার মতে তার কারণ নাকি রাজন্যা! সে যাই হোক, কিন্তু সারা দিনের ব্যস্ততার মধ্যেও যে করেই হোক এটুকু সময় বের করতেই হবে | বাড়ি পৌছে গাড়ি পার্ক করে বেল বাজাল শিবাজী |
দরজা খুলে দিয়ে শিবাজীকে দেখে হাসলো কৈলাস
– ছোড়দাভাই, আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছ দেখছি?
– হ্যাঁগো, আজ একটু কাজের চাপ কম ছিল | তা আমার তিতলি রানী কোথায়?
সুমিত্রা সোফায় বসে ছিলেন, শিবাজীর গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘোরালেন,
– ও বুবাই, তাড়াতাড়ি এসেছিস? খুব ভালো হলো। না হলে আজকেও মেয়েটাকে আটকে দিত দিদিভাই
– মেয়েটাকে? কোন মেয়েটাকে?
ভ্রু কুঁচকালো শিবাজী
– কে আবার? ওর সাধের ফেয়ারি সিস্টার! যেদিনই তুই ফিরিস না, ও রাজন্যাকে আটকে দেয়, গল্প বলে ওকে ডিনার করিয়ে যাওয়ার জন্য। আর মেয়েটার ঝুলিতে আছেও বটে গল্প। আমিও তো পাশে বসে বসে শুনি।
– কিন্তু আজ তো বৃহস্পতিবার | মেয়েটি শনি রবি আর বুধবার পড়াতে আসে বলেছিলে না?
– হ্যাঁ, তাইই আসার কথা। কাল আসলে তুই বললি ও আসবে না, তাই আমি তো দিদিভাইকে নিয়ে একটু আমার বন্ধু অঞ্জলীর বাড়িতে গেছিলাম। অঞ্জলীর নাতির সাথে দিদিভাই খেললো খানিকক্ষণ | বাড়ি এসে শুনি রাজন্যা বিকেলে পড়াতে এসেছিল | তখন আমি ওকে ফোন করলাম | ও বলল কালকে মিস হওয়া পড়াটা আজ করিয়ে দেবে। আমি আর না করিনি |
নিজের মনে বিরক্ত ভাবে দুদিকে মাথা নাড়ালো শিবাজী | এই মেয়েটার বোধহয় কথা শোনার ধাতই নেই | দুটো দিন পুরোপুরি রেস্ট নিতে বলেছিল | তা না করে দিব্যি বিকেলবেলা উনি পড়াতে চলে এসেছিলেন।
কৈলাসকে কড়া করে এক কাপ কফি করতে বলে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলো শিবাজী | নিজের ঘরে যাওয়ার আগে এক অমোঘ আকর্ষণে তিতলির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল আর দরজার কাছেই আটকে গেল | চেয়ার টেবিল খালি, খাটের উপরে দুই হাঁটু উঁচু করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রাজন্যা আর ওর পেটের উপরে দুই দিকে দুই পা দিয়ে বসে আছে তিতলি | রাজন্যা বলছে
… তারপরে তো ইভান গিয়ে বলল সিভকা বুরকা জাদু কা লড়কা, চেকনাই ঘোড়া, সামনে এসে দাঁড়া।
তিতলি উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো
– তারপর? তারপর কি হলো?
রাজন্যা দুই হাত উপর দিকে তুলে আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
– সত্যি সত্যি একটা এত্ত বড় ঘোড়া কোথা থেকে কে জানে ছুটে এলো | তার খুরের দাপে মাটি কেঁপে উঠল, তার নাক দিয়ে আগুন ছুটছে, কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। মাটিতে পা গেঁথে বলল – “বলো কি হুকুম?” তখন ইভান তার বাবার আদেশ মতন ঘোড়াটার গলা চাপড়ে তাকে লাগাম পরালো, তারপরে ঘোড়াটার বাঁ কান দিয়ে ঢুকে ডান কান দিয়ে বেরিয়ে এলো | আর কি আশ্চর্য! কালি ঝুলি মাখা ইভান হয়ে গেল সুন্দর একজন ইয়াং ম্যান। ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজার বাড়ির দিকে রওনা হলো ইভান | এসে দেখলো রাজার বাড়ির সামনে চারদিকে কত লোক | বারোটা খুঁটির ওপরে বারোটা বাড়ির সমান উঁচু একটা ঘর আর তার চিলেকোঠায় জানালার পাশে বসে আছে রাজকন্যা…
– ছোড়দাভাই তোমার কফি রেখেছি টেবিলের উপর | নাকি উপরে দিয়ে আসব?
কৈলাসের চিৎকারে চমক ভাঙলো শিবাজীর | কখন যে গল্পের জাদুতে মশগুল হয়ে গেছে নিজেও জানেনা | সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এসে বলল,
– নিচেই রাখো, আসছি।
তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের দিকে পা চালালো। শিবাজী কথাটা যথাসম্ভব আস্তে বললেও রাজন্যার কানে গেছে। তড়াক করে উঠে বসল, তারপর তিতলির গাল টিপে বলল,
– তোমার বাবাইয়া এসে গেছে | আজকে তাহলে আমি এবারে বাড়ি যাই?
তিতলি গাল ফুলিয়ে বলল,
– কিন্তু ইভানের গল্পটা যে শেষ হলো না |
– ওটা আমি পরের দিন বলে দেব | চলো আগে আমরা হোমওয়ার্ক গুলো বুঝে নিই…
প্রস্তাবটা বিশেষ পছন্দ না হলেও পায়ে পায়ে এসে স্টাডি টেবিলের সামনের চেয়ারে বসলো তিতলি
(ক্রমশ)