#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১২)
শিবাজী আর স্বয়ম ওডিসিতে ঢুকে বসার মিনিট তিন চারেকের মধ্যেই ফের কাঁচের দরজা খোলার শব্দ হতে শিবাজী ঘাড় তুলে দেখল রাজন্যা ঢুকছে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি দেখা দিল। দ্বৈপায়ন ফোনে কারোর সাথে কথা বলছিল, শিবাজীর হাসি চোখে পড়তেই হাত নাড়িয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল ‘ কি হয়েছে?’
শিবাজীও ইশারায় ‘পরে জানাবে’ বলল |
– রাজন্যা, অ্যানালিসিসটা হয়ে গেছে?
– হ্যাঁ শিবাজী দা, হয়ে গেছে | আপনাকে খুঁজছিলাম…
– ঠিক আছে, আমাকে ই-মেলে পাঠিয়ে এদিকে চলে এসো।
রাজন্যার পাঠানো ডকুমেন্টটা দেখে মনে মনে তারিফ করলো শিবাজী | ধমক খাওয়ার পরে মেয়েটা যে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার পরিমাণ বাড়িয়েছে। প্রতিটা স্টেপে কি কি রিস্ক থাকতে পারে, কি কি ভাবে এগোনো যেতে পারে, এ বিষয়ে ছোট ছোট নোট লিখে দিয়েছে | দুই এক জায়গায় কোম্পানির আগেকার কিছু এ্যাপ্লিকেশনের উদাহরণ দেওয়া রয়েছে, স্ক্রিনশট সমেত | রাজন্যাকে পাশে বসিয়ে মিনিট চল্লিশেক ধরে বিভিন্ন ছোটখাট পরিবর্তন করে ডকুমেন্টটাকে ফাইনাল করলো শিবাজী |
– এটা তাহলে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি | কাল সকালে একটা মিটিং আছে, কেউ লেট করবে না…
বলেই মাথা তুলে শিবাজী দেখল বাকিরা কেউ ই নেই | ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল, সাতটা পাঁচ | ছেলেপুলেকে দোষ দেওয়ার নেই, আলাদা করে কাজের চাপ না থাকলে সাড়ে ছ’টা পৌনে সাতটা নাগাদই সকলে বেরোয় |
– ঠিক আছে তুমি তাহলে বেরিয়ে পড়ো রাজন্যা |
নিজের জায়গায় ফিরে আসতে আসতে রাজন্যা মনে মনে গজ গজ করল।
– মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি যে কাজটা পছন্দ হয়েছে, তবু একবার গুড জব কথাটুকু বলল না! আমার উপর কিসের রাগ কে জানে খ্যাঁচা লোকটার! হতো মণীষা, এখনই গুড জব, ওয়ান্ডারফুল জব, ওয়েল ডান বলে প্রশংসা করত নিশ্চয়ই।
শিবাজীর চোখে না পড়ে সেরকম ভাবে একবার মুখও ভেংচিয়ে নিল, তারপরেই তাড়াতাড়ি সামলে নিল নিজেকে | ভাগ্যিস আর কেউ নেই! কেউ দেখতে পেয়ে কমপ্লেন করলে চাপ ছিল |
ল্যাপটপ বন্ধ করে সমস্ত কিছু গুছিয়ে একবার ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমেই আঁতকে উঠল রাজন্যা। চা খেয়ে ফেরার সময়ই মেঘ করেছে দেখেছিল বটে, কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই এত জোরে বৃষ্টি নেমে যাবে তা ভাবতে পারেনি | আসলে ওডিসিতে সব কাঁচের জানলা হলেও সাদা সাদা ব্লাইন্ডস টানা থাকে, তার ফলে বাইরে কি হচ্ছে চট করে বোঝা যায় না | তাড়াতাড়ি ব্যাগের ভিতর হাতড়ে দেখে নিল, যা ভয় করেছে তাই | ছাতা নেই সাথে। এবার কি হবে! ওদের অফিসটা একটা টেক পার্ক গোছের জায়গায়, অর্থাৎ একটা ঘেরা এলাকার মধ্যে অনেকগুলি বহুতল বিল্ডিং | প্রতিটি বিল্ডিঙেই বিভিন্ন কোম্পানির অফিস | এর মধ্যে চারটে বিল্ডিং জুড়ে শুধু তাদের অফিসের লোকজনই বসে | কিন্তু মুশকিল হল, মূল রাস্তা থেকে এই বিল্ডিংগুলো বেশ খানিকটা দূরে | বাস বা অটো ধরতে গেলে অন্তত মিনিট পাঁচেক হেঁটে রাস্তায় পৌঁছতে হয় | মালবিকাকে ফোন করতে গিয়ে মনে পড়ল আজ তো ওর ভোর বেলার শিফট ছিল, অর্থাৎ ও ইতিমধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেছে। বিল্ডিং এর দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ রইলো রাজন্যা। কিন্তু বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণ নেই। সাড়ে সাতটা বাজে, যদিও ওর বাড়ি এখান থেকে খুবই কাছে, কিন্তু বৃষ্টি পড়লে অনেক সময় বাস বা অটোর সংখ্যা কমে যেতে দেখেছে।
আরো পাঁচ মিনিট কেটে গেল | নাহ্, বৃষ্টি মুষলধারেই পড়ে চলেছে। ধুর! যা হয় হবে! ব্যাগের মধ্যে থাকা একটা প্লাস্টিকের ফাইল থেকে কাগজপত্র বের করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে ফাইলখানাকেই মাথাযর ওপরে ধরে হাঁটা লাগালো রাজন্যা। কোনই লাভ হচ্ছে না, বৃষ্টির সাথে বেশ হাওয়াও রয়েছে। মাথার ঠিক উপরের অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি পুরোটাই ভিজে যাচ্ছে | তবু না থেমে যথাসম্ভব জোরে পা চালালো | বাস স্টপেজে পৌঁছে দেখল, যা আশঙ্কা করেছে তাই। একটাও অটো নেই! চায়ের দোকানের ঝুপড়ি গুলোতে গিয়ে দাঁড়ানো যেতে পারে, কিন্তু সেগুলো রাস্তার অন্য ফুটে | কি করবে ভাবতে ভাবতেই রাজন্যা বুঝতে পারলো ওর শরীরে একটা কাঁপুনি ধরছে | কোল্ড অ্যালার্জি আছে ওর, হঠাৎ করে ঠান্ডা জলে ভিজে গেলে দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়া এবং ক্রমাগত হাঁচি হওয়ার একটা সমস্যা হয় |
হে ভগবান! তাড়াতাড়ি একটা অটো পাঠিয়ে দাও | দরকার হয় অটো রিজার্ভ করে বাড়ি পর্যন্ত চলে যাব। কিপটেমি করবো না |
গাড়ি বার করার সময় বৃষ্টির তোড় দেখে অবাক হয়ে গেল শিবাজী | ঘন্টাখানেক আগেও আকাশের চেহারা দেখে এত জোরে বৃষ্টি হতে পারে মনে হয় নি | তাও ভালো একটু দেরি করে নেমেছে, আর খানিকক্ষণ আগে নামলেই ছেলেমেয়েগুলোর বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হতো। হঠাৎই শিবাজীর খেয়াল হলো, বাকিরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেও রাজন্যা মাত্র মিনিট দশেক আগেই বেরিয়েছে। অফিসের পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সময় বিল্ডিং এর মেন গেটের সামনে দিয়ে ঘুরে যেতে হয় | আজকে ঘোরার সময় ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শিবাজী একবার দেখল বিল্ডিং এর সিঁড়ির কাছে কেউ অপেক্ষা করছে কিনা | রাজন্যাকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে হয়তো মেয়েটা ছাতা টাতা নিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে। গাড়ি টেক পার্কের বাইরে বেরোতেই মাথায় সবুজ রঙের প্লাস্টিক ফাইল ধরা আপাদমস্তক ভিজা চেহারাটার দিকে চোখ গেল শিবাজীর। এইভাবে ভিজছে মেয়েটা! একটু অপেক্ষা করা যেত না!
ঘ্যাঁচ করে শব্দ করে একটা গাড়ি পাশে থেমে যেতে রাজন্যা চমকে দু’পা পিছন দিকে সরে এলো | অটো আসছে কিনা দেখার জন্য রাস্তার প্রায় মাঝখানে চলে এসেছিল। কিন্তু গাড়িটা আবার স্টার্ট নেওয়ার বদলে জানালার কাঁচটা নীচে নেমে এলো আর ভিতর থেকে একটা রাগী রাগী গলায় আদেশ শুনতে পেল,
– পাগলের মতন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছ কেন? উঠে এসো!
শিবাজী দা!
রাজন্যা দু’পা এগিয়ে এসে বলল,
– কি করব? শখ করে ভিজছি নাকি? আমি কি কাজল না রবিনা ট্যান্ডন? অটো পাচ্ছি না, বাস পাচ্ছিনা!
– তুমি কি কানে কালা? নাকি কারোর কথার শুধু ফার্স্ট পার্টটা শুনতে পাও, শেষের অংশটা শুনতে পাও না? উঠে আসতে বললাম তো!
রাগে রাজন্যার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল | কিন্তু মস্তিষ্ক এই সংকেত দিচ্ছে যে এখন রাগ করার সময় নয়। গত পনের কুড়ি মিনিট ধরে একইভাবে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে চলেছে এবং খুব শিগগিরই থামবে বলেও মনে হচ্ছে না | তবু উত্তর দিল,
– শুনতে সবই পেয়েছি, কিন্তু এই ভিজা অবস্থায় উঠলে আপনার গাড়ির সিট ভিজে যাবে।
– সেই ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে | শিগগির ওঠো |
শিবাজী বাঁদিকে ঝুঁকে গাড়ির দরজা খুলে দিল। রাজন্যা উঠে ব্যাগ কোলে করে জড়োসড় হয়ে বসলো | শিবাজী গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
– সিট বেল্টটা বেঁধে নাও…
রাজন্যা বাঁদিকে কাঁধের কাছে সিট বেল্টটা বার দুয়েক টানাটানি করেও খুলতে পারল না। কাঁচুমাচু মুখ করে বলল,
– খুলছে না তো!
– আস্তে করে টানো, খুলবে |
আরো একবার চেষ্টা করল রাজন্যা । নাহ্ খুলছে না | শিবাজী রাস্তার বাঁদিক করে আবারও গাড়িটা থামালো। পাশের দিকে ঝুঁকে এসে সিট বেল্ট টেনে রাজন্যার বুকের উপর দিয়ে এনে আটকে দিল | এই কয়েকটা মুহূর্ত রাজন্যা কাঠ হয়ে বসে রইল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই শিবাজীর শরীর থেকে পুরুষালি মাদকতাময় কোলনের সুবাস ওর মন এবং মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
– তোমার বাড়ি কাছেই বলেছিলে, সামনের মোড় থেকে কোন দিকে যাব?
– ডানদিকে | পরের ক্রসিংটা থেকে বাঁ দিক ঘুরে বাসস্টপেজে আমাকে নামিয়ে দিলেই হবে।
শিবাজী জিভে একটা বিরক্তি সূচক আওয়াজ করলো।
– গাড়িতেই যখন যাচ্ছি তখন বাসস্টপেজে নামবে কেন? বাড়ির সামনে নামিয়ে দিচ্ছি
নির্দিষ্ট ডানদিক বাঁদিক ইনস্ট্রাকশন নিয়ে শিবাজী রাজন্যার পেইং গেস্ট থাকার ঠিকানার সামনে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেল ঠিক আট মিনিটের মাথায়। মেয়েটা ভুল বলেনি। সত্যিই কাছে থাকে। সীটবেল্টটা এবারে রাজন্যা নিজেই খুলতে পারলো | কুন্ঠিত মুখে শিবাজীর দিকে তাকিয়ে বলল,
– আপনার সিটটা একেবারে ভিজে গেল।
– বর্ষার দিনে অমন হয় | ঘরে ঢুকে গরম জলে স্নান করে নিও |
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে গাড়ি থেকে নামল রাজন্যা। দরজা বন্ধ করে পেছন ফিরেই আবার এগিয়ে এলো জানলার কাছে,
– শিবাজী দা!
– হ্যাঁ বলো
– থ্যাঙ্ক ইউ বলতে ভুলে গেছিলাম। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
শিবাজী হেসে ফেলল।
– ইউ আর ওয়েলকাম। পরেরবার দয়া করে এরকম রাস্তায় বেরিয়ে না পড়ে অপেক্ষা কোরো | আমি, দ্বৈপায়ন স্বয়ম সকলেই গাড়ি নিয়ে আসি, কেউ না কেউ এটুকু পৌঁছে দেবে | এভাবে ভিজে শরীর খারাপের সম্ভাবনা বাড়িও না।
রাজন্যা কে ওর পিজিতে নামিয়ে দিতে শিবাজীর খুব একটা ডিট্যুর করতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল | বৃষ্টি এখনো পড়েই চলেছে, আগের থেকে সামান্য কমলেও গাড়ির ওয়াইপার একটানা চালিয়ে যেতে হচ্ছে | কলকাতার রাস্তার এক সমস্যা, বৃষ্টি পড়লেই ট্রাফিক জ্যাম বেড়ে যায় | সামনে লম্বা গাড়ির স্রোত ধুঁকে ধুঁকে চলছে। ইচ্ছে করেই একটু দেরি করে বের হয় শিবাজী, তাতে ট্রাফিকে আটকে থাকার যন্ত্রণা একটু হলেও কম হয়। কিন্তু আজ ভোগান্তি আছে কপালে বুঝতেই পারছে। হাত বাড়িয়ে এফএম টা অন করতেই লাইফ ইন আ মেট্রোর গানটা গাড়ির ভেতর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল
দিল খুদগর্জ হ্যায়
ফিসলা হ্যায় ইয়ে ফির হাত সে
কাল উসকা রাহা
আজ হ্যায় তেরা ইস রাত সে
ও মেরি জান.. ও ও
ও মেরি জান.. ও ও
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো শিবাজী | বিগত দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলেছে সে | সচেতন ভাবে কলেজের মেয়ে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি, অফিসে নিজের প্রজেক্টে কোন মেয়েকে রাখেনি। যে সমস্ত কাজে মহিলা সহকর্মীকে এড়ানো যাবে না, সেখানে প্রজেক্টের নেতৃত্ব দেবার সুযোগ ছেড়ে দিয়েছে স্বয়মকে। অফিসে মহিলা পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টকে বদল করে নিয়ে এসেছে তমোজিতকে। কিন্তু এই একরত্তি মেয়েটা দমকা হওয়ার মতন এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। মেয়েটা তার কাজের জায়গায় অত্যন্ত দক্ষ, প্রশংসনীয় বলা যেতে পারে, আবার ওর মুখে ওর পরিবারের প্রতি যে দায়িত্বশীলতার কথা শুনেছে তাও শিবাজীকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু শিবাজী তো নতুন করে কোনও মেয়ের প্রতি মুগ্ধ হতে চায় না | নতুন করে আঘাত পেতে চায় না |
গাড়িটা ট্রাফিকে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ | লাল সিগন্যালের প্রথম পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড শেষ হয়ে আবার নতুন করে চল্লিশ সেকেন্ড দেখাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই শিবাজী নিজের জায়গায় জমে গেল। একটা বহুতলের সামনে প্রমাণ আকারের পোস্টারে প্রখ্যাত সোনার দোকানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে জ্বলজ্বল করছে সমর্পিতা মল্লিক এর ছবি | সোনার গয়নার থেকেও উজ্জ্বল তার মডেল। সম্মোহিতের মতন সেদিকে তাকিয়ে রইল শিবাজী | এই চাহনি আর এই হাসির পেছনে যে কদর্য স্বার্থপরতা আর নিষ্ঠুরতার পরিচয় ও পেয়েছিল, সেই অনুভূতির ক্ষত সারা জীবন বয়ে চলতে হবে ওকে।
মন স্মৃতির সরণী বেয়ে পাড়ি দিল অনেক বছর আগের সেই দিনটাতে, যেদিন স্বস্তিকের মেহেন্দি কালেকশনের মডেল নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার কথা |
সেদিন ক্লাস ছিল শিবাজীর, তবু সৌভিকের জোরাজোরিতে অফিসে আসতে হয়েছিল। গতদিনের ইন্টারভিউ এ যে নটি মেয়ে ছিল তাদের মধ্যে দুজনকে সকলেরই পছন্দ হয়েছে | তনিমা পান্ডে এবং সমর্পিতা মল্লিক, এই দু’জনের মধ্যে কাকে নেওয়া হবে সেটা সেই সিদ্ধান্তটা নিতে অসুবিধা হচ্ছে। শিবাজী সৌভিকের কেবিনে ঢুকেই ব্যাকপ্যাক টা চেয়ারের উপর ছুঁড়ে ফেলে কোমরে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
– কি করতে হবে তাড়াতাড়ি বল দাভাই, আজকের ক্লাসটা মিস করতে চাই না।
সৌভিক হতাশ হবার ভঙ্গি করে বলল,
– তুই আমার দেখা একমাত্র ছেলে, যে এক দফা পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবার পরে আবার পড়াশোনা করতে ছুটছে, তাও আবার এত আগ্রহ নিয়ে!
– বাজে বকিস না! বল না ঠিকঠাক! আগের দিনই তো সিলেক্ট করে ফেললি মোটামুটি, আজকে আবার কি?
দুজনের প্রোফাইলের একটা সংক্ষিপ্ত সারমর্ম গোছের লেখা সামনে এগিয়ে দিল সৌভিক।
– এরা দুজনেই কোয়ালিফায়েড, স্মার্ট, স্টেজে নিজেকে ক্যারি করতে পারবে। এদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া খুব কঠিন হচ্ছে।
শিবাজী ভ্রু কুঁচকালো
– সমস্যার কি আছে! দুজনকে নিয়ে নে |
– ধুর! তাই হয় নাকি? একটা বাজেটের ব্যাপার আছে না…
শিবাজী কপালে ভাঁজ ফেলে কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল,
– তাহলে এক কাজ কর | মডেলদের আসল কাজ নিয়ে এ্যাসেসমেন্ট হয়ে গেছে | এবারে ভাব তোর মডেলদের তো রিপোর্টারদের প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়। এবারে যাচাই করে নে এই ধরনের প্রশ্নের সামনে পড়লে কোনজন ভালো উত্তর দেয় | তার উপর বেস করে নিয়ে নে…
– ব্রিলিয়ান্ট!
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে সৌভিক।
– খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছিস | টপাটপ কয়েকটা কোয়েশ্চেন সাজেস্ট কর দেখি!
– যাহ বাবা, নিজেকে নিজেই বাঁশ দিলাম মনে হচ্ছে!
চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো শিবাজী | টেবিলের উপর কনুই রেখে দুই হাতের তালুতে থুতনি রেখে ভাবল কিছুক্ষণ, তারপরেই সোজা হয়ে বসে বলল,
– কাগজ পেন নে! তারপরে তুই তোর মতন এডিট করে নিস |
সৌভিক চট করে পাশ থেকে নোটপ্যাড আর পেন টেনে নিল | শিবাজী বলা শুরু করল,
– এক, একজন মহিলা মডেলকে বিয়ে না করার এবং সন্তান না নেওয়ার যে শর্ত দেওয়া হয় সেটার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে আপনার মতামত বলুন |
লিখতে লিখতেই ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকাল সৌভিক | কিন্তু শিবাজী ততক্ষণে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে পরবর্তী প্রশ্ন বলা শুরু করে দিয়েছে,
– দুই, ধরুন আপনি একটি কন্ট্রাক্টের মধ্যে আছেন | সেই সময় অন্য একটি কোম্পানি অনেক বেশি অর্থের অফার আপনাকে দিল, এমনকি কন্ট্রাক্ট ব্রেক করার জরিমানার টাকাও তারা দিতে চাইল | সে ক্ষেত্রে আপনার সিদ্ধান্ত কি হবে? তিন, আপনাকে যদি এমন একটি পোশাক পড়ে ফটো শুট করতে বলা হয় যাতে আপনি সচ্ছন্দ নন, এক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? চার, হাই স্যালারি অথবা বিখ্যাত ডিজাইনার কোনটিকে বেছে নেবেন? পাঁচ, আপনার মতে একজন ফ্যাশন মডেলের কোন বিষয়ের দিকে সব সময় লক্ষ্য রাখা উচিত?
ভাইয়ের বলার গতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রশ্ন কটা নোটপ্যাডে লিখে নিল সৌভিক। বলা শেষ করেই ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে শিবাজী।
– শোন, আমাকে কিন্তু প্লিজ এই ইন্টারভিউয়ের সময় থাকতে বলিস না! আমি চললাম |
আর কোনোভাবেই ওকে আটকানো যাবে না বুঝে সৌভিকও আর জোর করল না।
প্রতিটা প্রশ্নের জমকালো উত্তর দিয়ে নির্বাচিত হয়ে গেল সমর্পিতা মল্লিক | দিন কয়েক পরে মাসের প্রথম দিন থেকেই তার জয়েন করার পালা | সমর্পিতার সাথে শিবাজীর দেখা হল আরো সপ্তাহ দুয়েক পরে | সেদিন মেহেন্দির ফেব্রিক এবং মূল ডিজাইনের ঘরানা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা |
শিবাজীর জন্য সৌভিক অফিসে আলাদা কেবিনের ব্যবস্থা করতে চাইলেও শিবাজী রাজি হয়নি | মেরে কেটে মাসে দুই থেকে তিন বার আসে, তার জন্য একটা বড় জায়গা আটকে রাখার কোন মানে হয় না | অফিসে এলে সৌভিকের চেম্বারেই বসে। সেদিন অফিসে এসে সৌভিকের চেম্বারের দিকে যাওয়ার পথে হালকা গোলাপি রঙের চুড়িদার পরা একটি মেয়ের সাথে দেখা হল | ওর সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি ঝকঝকে হেসে বললো,
– হাই! তুমি, মানে আপনি শিবাজি সেন তো?
শিবাজী দাঁড়িয়ে পড়ল | এই মেয়েটিকে তো অফিসে আগে দেখেনি।
– হ্যাঁ আমি শিবাজী সেন | আপনি?
উচ্ছল ঝরনার মতন হেসে উঠল মেয়েটি |
– চিনতে পারেননি বুঝি? আপনার দেওয়া কোয়েশ্চেন পেপারে ফুল মার্কস পেয়েই তো সিলেক্ট হলাম! আমি সমর্পিতা |
শিবাজীর তিরিশ সেকেন্ড মতন সময় লাগলো কথাটা বুঝতে | অভদ্রের মতন হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সমর্পিতার দিকে। সমর্পিতা শিবাজীর চোখের সামনে পাঁচ আঙুল নাড়ালো,
– কি হলো? চোখের পলক পড়ছে না নাকি? আমি এতটাও সুন্দরী নই!
সম্বিত ফিরে এলো। একটু অপ্রস্তুতভাবেই শিবাজী বলে উঠলো,
– তা না! আসলে সেদিনের আপনি আর আজকের আপনি, দুটোকে মেলাতে পারছি না!
সমর্পিতা মুচকি হাসলো,
– কোনটা বেশি ভালো বলুন দেখি আগে?
– ভালো আপনার দুটো অবতারই, তবে আজকে যেমন একটা পাশের বাড়ির মেয়ে গোছের লুক নিয়েছেন এটা অনেক বেশি ধরা ছোঁয়ার মধ্যে | সেদিন ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল।
সমর্পিতা একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল,
– আপনার কাছে দশ মিনিট সময় হবে? তাহলে একটু ক্যাফেটেরিয়াতে বসতাম।
শিবাজী ঘড়িতে সময় দেখে নিল। মিটিং শুরু হতে আরও মিনিট চল্লিশেক দেরি।
– ঠিক আছে চলুন…
স্বস্তিকের অফিসে ক্যাফেটেরিয়া বানানো নিয়ে একটা গল্প আছে। এই সমস্ত হাল ফ্যাশনের ব্যাপার-স্যাপার শিবনাথের পছন্দ নয় | ওই জায়গাটুকু অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যেত বলে তিনি যথেষ্ট আপত্তি জানিয়েছিলেন। শিবাজী তখন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে একটা উদাহরণ পেশ করেছিল,
– ধরো তোমার অফিসে দশ জন কর্মী | অবশ্যই তারা একটানা সারাদিন কাজ করতে পারে না, তাদের দিনে দুবার চা কিংবা কফি খেতে লাগে | বিকেল বেলার চায়ের সাথে একটু সামান্য স্ন্যাক্সও লাগে | সে ক্ষেত্রে তারা কি করবে? তুমি একটা নেসক্যাফের মেশিন বসাতেই পারো, কিন্তু যাকে সেই মেশিনে চা কফির র ম্যাটেরিয়াল ভরার দায়িত্ব দেবে, সে কিছুদিন পর থেকেই দুধ, চা, কফি, চিনি সব চুরি করা শুরু করবে এবং যন্ত্র থেকে একটা বিস্বাদ পানীয় বের হবে | তখন লোকজন বাধ্য হয়ে অফিসের বাইরে যাবে চা খেতে | এবারে আমাদের অফিসের ঠিক বাইরে কোনো ভদ্রস্থ চা কফির দোকান নেই। তাহলে তাদের যেতে হবে অন্ততপক্ষে মোড়ের মাথায়! অফিস থেকে মোড় পর্যন্ত যেতে সাত থেকে আট মিনিট লাগে | ঠিক চায়ের দোকানের পাশেই আবার কোনো স্ন্যাক্স এর দোকান নেই | সেটা পেতে গেলে রাস্তা পেরিয়ে অন্য ফুটে যেতে হবে | তাহলে চা খেয়ে অন্য ফুটে গিয়ে সিঙ্গারা নিমকি খেয়ে আবার অফিসে ফেরত আসতে অন্ততপক্ষে আধ ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট কেটে যাবে | দশ জনের মাথা পিছু চল্লিশ মিনিট মানে মোট চারশ মিনিট, অর্থাৎ ছয় ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের প্রোডাক্টিভিটি লস | অফিসের ক্যাফেটেরিয়া থাকলে এবং তাতে যদি কমন খাবার দাবার যেমন সিঙ্গাড়া, ভেজিটেবল চপ, ফিস ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বাটার টোস্ট জাতীয় জিনিস রাখা থাকে তাহলে এই সম্পূর্ণ কাজটা পনের মিনিট থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে | অর্থাৎ মোট দেড়শো থেকে দুশো মিনিট। তাহলে তোমার তিন ঘন্টার বেশি দৈনিক প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে |
ছেলের গোছানো যুক্তির সামনে আর কিছু বলেন নি শিবনাথ | ক্যাফেটেরিয়াও তৈরি হয়েছে |
সমর্পিতার সাথে ক্যাফেটেরিয়াতে এসে দুটো কফি আর এক প্লেট ফিশ ফিঙ্গার অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসলো শিবাজী |
– হ্যাঁ বলুন
– আপনি এই যে বললেন না, পাশের বাড়ির মেয়ে গোছের? আপনি হয়তো জানেন না, আসলে কিন্তু আমি আপনাদের পাশের বাড়িরই মেয়ে
– মানে?
শিবাজীর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সবটা |
– মানে হলো আপনি আমাকে চিনতে না পারলেও আপনাকে আমি প্রথম দিনেই চিনেছি | আপনি আমার কলেজের সিনিয়রই শুধু নন, আমরা মোটামুটি এক পাড়াতেই থাকি |
শিবাজী চমকে উঠল | ঝট করে মনে পড়ে গেল মেয়েটিকে ওদের ইয়ারের ফ্রেশার্সের দিন দেখেছিল | প্রতিবারের মতই সফট রাগিং হচ্ছিল | মেয়েটি একটুও না ঘাবড়ে ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী একটা সিডাক্টিভ গানের সাথে নাচ করে দিয়েছিল |
– মনে পড়েছে! আপনি সেই টিপ টিপ বরসা পানি…
– মনে পড়ে গেছে তো? হ্যাঁ, আমিই সেই |
– আমারও আপনাকে চেনা চেনা লেগেছিল কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিলাম না
– কোয়ায়েট ন্যাচারাল | আসলে এর পরে কলেজে হয়তো আমাকে এক দুই দিনই দেখেছেন তার কারণ আমি ওখানে আর কন্টিনিউ করিনি | ল পড়তে চলে গেছিলাম | তবে আমাদের বাড়ি কিন্তু আপনাদের বাড়ি থেকে ঠিক একটা স্টপেজ পরে |
– ও! তাই নাকি?
– একদমই তাই | তাহলে আপনি প্রতিবেশী হলেন কিনা বলুন?
– তা হলাম বটে!
– তাহলে প্রতিবেশী হিসাবে আপনার থেকে আমার একটা সাহায্য চাই।
কাউন্টার থেকে ছেলেটি ডাকতে সমর্পিতা উঠে দাঁড়ালো, ওকে হাতের ইশারায় বসতে বলে শিবাজী উঠে গিয়ে কফি আর ফিশ ফিঙ্গার সমেত ট্রেটা নিয়ে এলো |
– ঈশ্! আমার যাওয়া উচিত ছিল!
– তা কেন ? নিন কফি খান | আর বলুন দেখি
কি সাহায্য চান?
– দেখুন, আপনি আমার পূর্বপরিচিত হলেও এই মুহূর্তে আদতে আমার এমপ্লয়ার | আমার হয়তো এভাবে বলা উচিত হচ্ছে না, কিন্তু আমি নিরুপায়…
– আপনি খুলে না বললে আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না!
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে সমর্পিতা বলল,
– আসলে আমি যে স্বস্তিক জয়েন করেছি সেটা আমার বাবা মা জানেন না | বাবার ইচ্ছা আমি ওনার মতন ল-ইয়ার হই, কিন্তু আমার ল-ইয়ার হওয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই
– কিন্তু এখানে আমি কি সাহায্য করতে পারি বুঝতে পারছি না, তাছাড়া আমি যতদূর জানি এলএলবি’র ইন্টিগ্রেটেড কোর্সটা পাঁচ বছরের | তাহলে তো আপনার কোর্সও এখনো কমপ্লিট হয়নি?
– না, এবারে ফাইনাল ইয়ারে উঠবো | কিন্তু সেটা সমস্যা নয় | দেখুন আমার বাবার ধারণা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি মানেই নানান রকম নোংরামির আখড়া | ইফ আই রিমেমবার কারেক্টলি, আপনি কলেজের টপার ছিলেন | এরকম একটা মানুষ যদি গিয়ে বাবার সাথে একটু কথা বলে…
শিবাজী কথার মাঝখানে বাধা দিল,
– আমি কিন্তু স্বস্তিকের সাথে একেবারেই যুক্ত নই, কোম্পানি বাবার, বাবার পরে দায়িত্ব নেবে আমার দাদা, সৌভিক সেন, যার আন্ডারে আপনি জয়েন করেছেন | আমি যদি ধরেও নেই আমি খুবই ইম্প্রেসিভ একটা মানুষ, তাহলেও আমার বলাতে স্বস্তিকের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট কি করে হবে? আই এম অ্যাজ গুড অ্যাজ অ্যান আউটসাইডার!
– আপনাকে সব কথা বলতে হবে এরকম তো কোনো ব্যাপার নেই!
শিবাজী হেসে ফেলল,
– কি রকম কলেজ লাইফে বন্ধুর মাকে লেট নাইট পার্টিতে বন্ধুকে যেতে দেওয়ার জন্য রাজি করানোর প্রচেষ্টার রিক্যাপ বলে মনে হচ্ছে!
– প্লিজ শিবাজী এটুকু হেল্প আমাকে করুন | আমি জানি বাবার ভুল ধারণা একবার ভেঙ্গে গেলে আর কোন বাধা উনি দেবেন না…
– বুঝতে পারছি | তবে আমার মনে হয় এই ছোট্ট নির্দোষ নাটকটুকু আপনার জয়েন করার আগে করে নেওয়া উচিত ছিল | এখন যদি আপনার বাবাকে কনভিন্স না করতে পারা যায়, তাহলে কি আপনি চাকরিটা করবেন না?
মুহূর্তেই খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখালো সমর্পিতাকে |
– চাকরিটা তো আমি করবোই শিবাজী | আমার ছোটবেলার স্বপ্ন | সে ক্ষেত্রে হয়তো আমার জার্নিটা আরেকটু কঠিন হবে, এই আর কি!
শিবাজী গেছিল সমর্পিতাদের বাড়ি | সেই দিনই নয়, দিন কয়েক পরে | আলাপ হয়েছিল সমর্পিতার বাবা-মা এবং ছোট বোন সমাদৃতার সাথে। সমর্পিতার বাবা রাশভারী মানুষ। দু-একটা কেজো প্রশ্ন ছাড়া আর কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি। সমর্পিতার মা অবশ্য অনেক কথা বলেছিলেন | উনি যে পিসিমাকে চেনেন তাও জানিয়েছিলেন। জোর করে পরোটা আর আলুর দম খাইয়ে ছেড়েছিলেন | বলেছিলেন,
– তুমি মিঠির বস হতে পারো, কিন্তু আমার কাছে তো তুমি পাড়া ছেলে, আমি কিন্তু ওসব আপনি আজ্ঞে করতে পারব না!
ছোট থেকেই মাতৃস্নেহের কাঙাল শিবাজী কোথাও বিন্দুমাত্র অপত্য স্নেহসুলভ ব্যবহার পেলেই ভেতরে ভেতরে দ্রবীভূত হয়ে যেত | এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি | সমর্পিতার মা মাধবী মল্লিককে এক আলাপেই ফুল ভালো লেগে গিয়েছিল | পুরো পরিবারটাকে ভালো গিয়েছিল আসলে |
সামনে প্যাসেঞ্জার সিটে রাখা মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠতে শিবাজী এক ধাক্কায় বর্তমানে ফিরে এলো | সামনে মনে হয় কিছু একটা হয়েছে, আশেপাশের গাড়িগুলো প্রবল জোরে হর্ন দিচ্ছে, অনেকক্ষণ আটকে আছে এই সিগনালে | পিসিমা ফোন করছেন |
– হ্যালো পিপিয়া!
– হ্যাঁ রে বুবাই, টিভিতে দেখাচ্ছিল বৃষ্টির জন্য সারা কলকাতায় প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম | তুই কি বেরিয়ে পড়েছিস?
– হ্যাঁ পিপিয়া, বেরিয়ে তো পড়েছি, কিন্তু বিশেষ একটা এগোতে পারিনি। বেজায় জ্যাম
– ওহ্, সেটাই ভাবছিলাম | আচ্ছা, সাবধানে আয় |
– তিতলি কি করছে পিপিয়া?
– বিকেলে কৈলাসের সাথে খানিক লুডো খেলেছে, আর এখন ওর টিচার কি একটা নাকি মজার হোম ওয়ার্ক দিয়ে গেছে, সেই নিয়ে বসে আছে।
– হোম ওয়ার্ক আবার মজার!
– তাই তো বললো, এখন নাকি দেখানো যাবে না | শেষ হলে তবে দেখাবে।
– আচ্ছা! গিয়ে দেখব তাহলে কি এমন হোম ওয়ার্ক!
ওদিক থেকে সুমিত্রার মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এলো
– নারে বুবাই, এই মেয়েটি সত্যিই বাচ্চাদের সামলানোর কায়দা জানে | আমি তো দেখছি, এখন দিদিভাই সন্ধ্যা বেলা টিভি দেখার জন্য অত বায়না আর করে না। আর তাছাড়া যেদিন যেদিন টিউটর আসার দিন সেদিন তো রীতিমতো হা পিত্যেশ করে বসে থাকে।
শিবাজীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো আজ বিকেলের ঘটনাটা | হাতমুখ নেড়ে ঝুপড়ির দোকানদারের চাকে ঘোড়ার প্রস্রাবের সাথে তুলনা করছে একটা মেয়ে |
– কি যে বলো পিপিয়া! টিউটর নিজেই তো বাচ্চা মেয়ে, ও আবার বাচ্চাদের কি সামলাবে? ওকে তিতলি বন্ধু টন্ধু ভাবে মনে হয়।
– বন্ধু ভাবলেই বা! বন্ধুর মতন মিশে যদি…
সুমিত্রার কথা শেষ হবার আগেই আশেপাশের হর্নের আওয়াজ আরো তীব্র হয়ে উঠলো। প্রায় দশ মিনিট আটকে থাকার পরে সিগন্যাল সবুজ হয়েছে | তাড়াতাড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে শিবাজী বলল,
– পিপিয়া সিগন্যালটা ছেড়েছে | আমি বাড়ি পৌঁছে কথা বলছি।
ভাগ্যিস! সুমিত্রা ফোনটা টেবিলের উপরে রেখে ভাবলেন, এখনই একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলছিলেন। বলতে গেছিলেন, বন্ধুর মতো মিশে যদি কেউ অভিভাবকের জায়গা নিতে পারে তাহলে মন্দ কি! এ কথা শুনলেই বুবাই ভয়ানক রেগে উঠত |
(ক্রমশ)