হৃদ মাঝারে পর্ব-১১

0
461

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১১)

– তাহলে বুঝতেই পারছ প্রজেক্টের প্রতিটা খুঁটিনাটি খুব মাইনিউটলি মনিটর হবে | আগামী ছয় সাতমাস তোমরা ডেডিকেটেডলি এই প্রজেক্টে কাজ করবে। নিতান্ত এমার্জেন্সি না হলে একদিনের বেশি ছুটি নেওয়া চলবে না | ফার্স্ট লেভেলের ডেভেলপমেন্ট কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত থাকতে হতে পারে | আমার আর সৌম্যর সাথে আলোচনা না করে সরাসরি কেউ ক্লায়েন্টের সাথে কোন কথাবার্তা বলবে না | আফটার ডেভেলপমেন্ট টেস্টিং এ যাওয়ার আগে একে অপরের কোড টেস্ট করবে। কারো যদি কোন আপত্তি থাকে এখনই বলে দাও |

চার জুনিয়র ডেভেলপার একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল | মণীষা সামান্য আমতা আমতা করে বলল,

– শিবাজীদা, আমার ওই লেট ইভিনিং অবধি থাকার ব্যাপারটাতে একটু অসুবিধা আছে | আসলে আমার বাড়ি তো অনেকটা দূর এখান থেকে, বেরোনোর পরে দেড় থেকে দুই ঘন্টা লাগে বাড়ি পৌঁছতে। সাতটা অবধি আমার কোন অসুবিধা নেই কিন্তু তার থেকে বেশি দেরি হয়ে গেলে একটু মুশকিল হবে |

শিবাজী গম্ভীর ভাবে তাকালো | এই মেয়েটি সদ্য সদ্য টিমে জয়েন করেছে | অন্য একটা প্রজেক্ট থেকে রিলিজ নিয়ে ওদের টিমে এসেছে এক মাসও হয়নি | সেভাবে কোন কাজ এখনো দিয়ে দেখা হয়নি। তবে সৌম্যর কাছে শুনেছে মেয়েটির বছর চারেকের এক্সপেরিয়েন্স | বাকি তিনজন আরো একটু জুনিয়র বলে একে দিয়ে বাকিদের কাজ মনিটর করাবে ভেবেছিল।

– তুমি কোথায় থাকো?

শিবাজী কিছু বলার আগেই রাজন্যার মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেছে। মণীষা রাজন্যার দিকে তাকালো, এই মেয়েটা বড্ড কথা বলে। একটু বিরক্তি সহকারেই উত্তর দিল,

– বেহালা ঠাকুরপুকুরের ওদিকে।
– ওহ্, অনেকটা দূরে সত্যি | তাহলে যেদিন যেদিন দেরি হয়ে যাবে, তুমি আমার সাথে থাকতে পারো | আমার বাড়ি এখান থেকে খুব কাছে।

মণীষা এবারে আর বিরক্তি চাপতে পারল না।

– রাজন্যা, আমি ওরকম যার তার বাড়িতে নাইট স্টে করতে পারি না | আমার অসুবিধা হয় |
– হ্যাঁ বুঝতেই পারছি তো! নিজের জিনিসপত্র সাথে না থাকলে কোথাও গিয়ে থাকতে অসুবিধা হয় বৈকি। তুমি এক কাজ করবে। একটা সেট জামা কাপড় অফিসের লকারে রেখে দিও | কোনোদিন প্রয়োজন পড়লে সেগুলো নিয়ে আমার সাথে আমার ফ্ল্যাটে চলে যাবে!

মণীষা অবাক | কি নাছোড়বান্দা মেয়ে রে বাবা!

– না, ব্যাপারটা জামা কাপড়ের নয়, আমি অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারি না |

রাজন্যা আরো কিছু বলার জন্য মুখ খুলছে দেখেই সৌম্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,

– ঠিক আছে, এখনো তো বোঝা যাচ্ছে না কিরকম কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে | সেটা সেই সময় বোঝা যাবে। কি করা যাবে তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে…

শিবাজী সৌম্যর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল | এখন মণীষাকে এই টিমে রাখাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না | কিন্তু ওর উপরে ইতিমধ্যেই বদনাম আছে মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ইনভল্ভ না করা নিয়ে, নতুন করে লোককে সেই নিয়ে আলোচনা করতে দিতে চায় না |

আরো কিছুক্ষণ প্রজেক্ট এর প্ল্যানিং নিয়ে কথাবার্তা চলল |

– দেখো এটা ইউএসএ’র একটা ইউটিলিটি সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি | এদের মূল ব্যবসায়িক কাজটা সমস্তটাই অনলাইন এবং অটোমেটিক সিস্টেমে হয়, কিন্তু যেমন আমরা জানি কোনো সিস্টেমই ফুল প্রুফ হয় না, সেরকম এদের সিস্টেমেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অটোমেটিক ওয়ার্ক ফ্লো ফেইল করে | সেই সময় ম্যানুয়াল ইন্টারভেনশন ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকে না | আমাদের কাজটা এই ম্যানুয়াল ইন্টারভেনশনের সিস্টেমটা তৈরি করা | কি ধরনের রিকুয়েস্ট ফেইল করেছে তার প্যাটার্ন বুঝে এবং সেই ধরনের ফেইলিওরকে অতীতে কিভাবে হ্যান্ডেল করা হয়েছে সেই হিস্টোরিকাল ডেটা দেখে আমাদের ম্যানুয়াল কাজটা যতটা সম্ভব কমিয়ে দিতে হবে |

খানিকক্ষণ টানা বলার পরে সামনের চারজনের মুখ দেখে শিবাজীর সন্দেহ হল ওরা হয়তো ব্যাপারটা ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না।

– আচ্ছা আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বলি | আমাদের এখানে ইলেকট্রিসিটির বিল আসে সবার বাড়িতে, তাই তো?

সকলেই বিনা বক্তব্যে ঘাড় হেলাল |

– কিভাবে বোঝা যায় আমি কতটা ইলেকট্রিসিটি কনজুম করেছি? আমাদের একটা করে মিটার থাকে, সেই মিটার রিডিং চেক করতে ইলেক্ট্রিসিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে লোক আসে, রাইট?

আবারও সকলে ঘাড় নাড়তে শিবাজী বুঝলো এইবারে ও ঠিকভাবে এগোচ্ছে।

– এবারে, বিদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই মিটার রিডিংয়ের প্রসেসটা অটোমেটিক | কিন্তু মিটারের বা মিটার বক্সের যদি কোন গন্ডগোল থাকে, তাহলে সেই অটোমেটিক প্রসেসটা কাজ করতে পারে না | তাই, মনে করো, কারোর মিটার বক্সের ডালাটা খোলা আছে এবং তার ফলে মিটার রিডিং হয়নি | স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটা একটা এরর মেসেজ পাঠিয়েছে ওদের সিস্টেমে | এদিকে ওই ব্যক্তি তো জানেন না যে তার মিটার রিডিং হয়নি বলে ওনার সঠিক সময়ে বিল জেনারেট হলো না | উনি ভাবলেন যে বিল জেনারেট হয়ে গেছে কিন্তু উনি বিলটা হাতে পাননি | এর জন্য তো ওনার পেমেন্ট করতে দেরি হবে আর ফাইন দিতে হবে | তখন উনি চিন্তিত হয়ে কাস্টমার কেয়ার কে এটা জানাবেন | এবার এই কাস্টমার কেয়ারের কাজটা দেখাশোনা করে আমাদের কোম্পানি। তারা এরর মেসেজগুলো চেক করবে, করে দেখবে বস্তুত ঘটনা কি ঘটেছে এবং তারপরে তারা একটা রিকোয়েস্ট পাঠাবে একজন ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার কে ওই কাস্টমারের বাড়িতে পাঠানোর জন্য | তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি, একটা বিশেষ ধরনের এরার মেসেজ পেলে আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত যে ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার কে পাঠাতে হবে | আমাদের সিস্টেমটা আমরা এমনভাবে ডিজাইন করব যাতে ওই এরর মেসেজ পেলেই সে নিজে থেকে ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের রিকোয়েস্টটা প্লেস করে দিতে পারে ওই কাস্টমারের ঠিকানায়। বোঝাতে পারলাম?

সকলেই সমস্বরে তাদের সম্মতি জানালো | রাজন্যা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতন শিবাজীর দিকে তাকিয়ে ছিল | এই গম্ভীর রাগী গোছের লোকটা যে ওদের বোঝানোর জন্য এরকম একটা সহজ উদাহরণ দিতে পারে সেটা ও স্বপ্নেও ভাবেনি | প্রজেক্টের বেসিক প্রয়োজন বোঝার পরে সৌম্য হোয়াইট বোর্ডে এঁকে প্রজেক্ট এর স্টেপ বাই স্টেপ প্ল্যান কি রকম হবে সেই নিয়ে আলোচনা শুরু করল |

– আমরা ঠিক এই ধরনের কাজ আগে না করলেও অন্য অনেক ইউটিলিটি কোম্পানির কাজ করেছি | তাই আমাদের কাছে একটা রিকোয়ারমেন্ট ব্যাংক আছে | আমরা আমাদের সলিউশনে সমস্ত কমন ফিচারগুলো রাখব | ক্লায়েন্টের সাথে কথা হয়েছে, ওদের দিক থেকেও একজন টিম লিডার থাকবে | আমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে সেই টিম লিডারের সাথে কথা বলে আমরা ক্লিয়ার করে নেব |

রাজন্যা ফস করে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে ডান হাত উপর দিকে তুলল |

– কি হয়েছে রাজন্যা? কিছু বলবি?

এই কয়দিনে সৌম্য তুমি থেকে তুই তে নেমে এসেছে |

– হ্যাঁ সৌম্যদা, মানে বলছিলাম যে আমাদের কোম্পানির যে টিম এসব কাজগুলো হ্যান্ডেল করে, মানে ওই কাস্টমার কেয়ারের কাজগুলো, তারা কোথায় বসে?

সৌম্য অবাক হলো | রাজন্যার প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারেনি | তবু উত্তর দিল,

– একটা টিম কলকাতাতেই বসে, আর আরেকটা টিম হায়দ্রাবাদে। কেন জিজ্ঞাসা করছিস?

রাজন্যা শিবাজীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল,

– আসলে আমি ভাবছিলাম এরা তো এই ধরনের কাজ অনেকদিন ধরেই করছে | তার মানে ওরা জানে সাধারণত কি ধরনের মেসেজ এলে শেষ পর্যন্ত কোন ধরনের সলিউশন দিতে হয়। তাহলে আমরা যদি কিছুদিন ওদের সাথে গিয়ে খানিকটা করে সময় ওদের সাথে কাটিয়ে ওদের পেইন পয়েন্ট গুলো বোঝার চেষ্টা করতাম, তাহলে হয়তো আমাদের প্রোডাক্টে তার সমাধান গুলো ঢোকাতে পারতাম…
– ওরা সবাই নন টেকনিক্যাল লোকজন | একটা টেকনিক্যাল সলিউশনে কি থাকতে পারে, সেই সম্বন্ধে কোন ইনপুট ওরা দিতে পারবে না | আমাদের সলিউশনটা তৈরি হয়ে গেলে তখন আমরা ওদেরকে ডেমনস্ট্রেশন দিয়ে দেব কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তার উপরে |

মণীষাও সৌম্যর কথায় সায় দিল,

– কাস্টমার কেয়ারের লোকজনের সাথে গিয়ে বসে কাজ করা! কি অ্যাবসার্ড আইডিয়া! আর তাছাড়া ওরা ওদের কাজ করতে ব্যস্ত থাকবে। আমরা গিয়ে ওদের পাশে বসে থাকলে ওদের অসুবিধাই হবে।

রাজন্যা একটু গুটিয়ে গেল, এ বিষয়ে আর কিছু বলা ঠিক হবে না বুঝতে পেরে ছোট্ট করে ঘাড় নেড়ে নিজের নোটবুকের দিকে চোখ নামালো। আর ঠিক তখনই ওকে অবাক করে শিবাজী বলে উঠলো,

– আমার কিন্তু মনে হয় রাজন্যা যেটা বলেছে, সেটা চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে | গ্রাউন্ড লেভেল ওয়ার্কারদের থেকে তাদের নিয়মিত কাজের প্যাটার্নটা যদি বুঝে নেওয়া যায়, তাহলে সেটাকে টেকনিক্যাল সলিউশনের ফর্ম দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের |

রাজন্যা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না | শিবাজী সেন ওর কথায় সায় দিলেন! সৌম্যদা এবং আরো একজন অপেক্ষাকৃত বেশি সিনিয়র ডেভেলপার ওর প্রস্তাবের বিরোধিতা করার পরে! মুখ তুলে ওদিকে তাকিয়ে শিবাজীকে এক মনে হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেমন যেন মনটা খারাপ হল | মনে মনে কেমন যেন আশা করে ছিল ওর প্রস্তাব সমর্থন করার পরে একটু হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবেন |

প্রাথমিক আলোচনা পর্ব শেষ হতে ওরা মিটিং রুম থেকে বেরোতে যাওয়ার ঠিক মুখে শিবাজী হঠাৎ বলে উঠল,

– বাই দ্যা ওয়ে, প্রজেক্ট এর মাঝে কোনো একটা সময় এক মাসের জন্য ইউ এস এ যেতে হতে পারে, সৌম্য আর আমাকেই যেতে হবে, তবে আমার অন্য কাজ পড়ে গেলে তোমাদের মধ্যে কোনো একজনকে যেতে হতে পারে | সবাই নিজেদের পাসপোর্ট আপ টু ডেট রাখবে |

মণীষার মুখটা সামান্য অন্ধকার হয়ে গেল | বাকিরা এক এক করে বেরিয়ে গেলেও ও দাঁড়িয়ে রইল | নিচু গলায় বলল,

– শিবাজী দা, আমার একটু কথা আছে আপনার সাথে…
– আচ্ছা! বলো

শিবাজী মিটিং রুমের দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে | রাজন্যা ঘুরে তাকাল একবার | ওর দুই ভ্রু কুঁচকে উঠল | ওই মণীষার আবার শিবাজীদার সাথে আলাদা করে কি প্রয়োজন! বড্ড নাক উঁচু একটা মেয়ে!

শিবাজীর সাথে আলোচনা সেরে বেরোনোর পরে মণীষার মুখটা যেন একটু খুশি খুশি মনে হল রাজন্যার । কেন যেন, খানিক রাগ হলো | মণীষা যে বিশেষ সুন্দরী তা নয় | ফর্সা বলা চলে না, অনেকটা দুধ চায়ের মতন গায়ের রং | কিন্তু তার পোশাক আশাক এবং সাজগোজ করার ধরন দেখলে বোঝা যায় সে ছোট থেকেই স্বাচ্ছল্যের মধ্যে বড় হয়েছে | একদিন মণীষার একটা কুর্তি দেখে রাজন্যার বেশ পছন্দ হয়েছিল | কোথা থেকে কেনা জিজ্ঞাসা করাতে মণিদীপ খুব তাচ্ছিল্য সহকারে বলেছিল,

– এটা ? এটা তো ফ্যাবের | অফিসে আমি ফ্যাব ইন্ডিয়া ছাড়া পরতে পারি না |

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে অনলাইনে সার্চ করে ফ্যাব ইন্ডিয়ার পোশাকের যা দাম দেখেছিল, নিজের মনেই দুটো নমস্কার ঠুকে মোবাইল ব্যাগে রেখে দিয়েছিল রাজন্যা |

আচ্ছা, মণীষা কি বলতে গেছিল? ইউএস-তে যাওয়ার কথা? হয়তো ওর খুব, অনসাইট যাওয়ার ইচ্ছা, সেটা আলাদা করে বলল | এরকম যদি হয় মণীষা আর শিবাজীদা একসাথে গেল! ব্যাপারটা কি ভালো হবে ? যদি শিবাজীদার মণীষাকে খুব পছন্দ হয়ে যায় ? সৌম্যদার কাছে অবশ্য শুনেছে যে শিবাজীদা মেয়েদের বিশেষ একটা পছন্দ করেন না | কিন্তু এই ক’দিনে মণীষার সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে তো শোনেনি। ও যেরকম শুরুর দিকে বকাঝকা খেয়েছে, মণীষার বেলায় কিন্তু তা হয়নি! অবশ্য মণীষা আর একটু সিনিয়র, আর ওর মতন আগ বাড়িয়ে সমস্ত কিছু করতেও যায় না | কিন্তু তবু! কেউ যদি নারীবিদ্বেষী হলে তো তার সব মেয়েকেই খারাপ লাগার কথা। শিবাজীদা কি আদৌ নারী বিদ্বেষী? নাকি রাজন্যাকে দেখতে পারেন না? মণীষারা সম্ভবত খুব বড়লোক | যে সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঁচখানা দুই থেকে চার হাজার টাকার জামা পরতে পারে তার নিশ্চয়ই অনেক পয়সা! শিবাজীদারাও তো বেশ উচ্চবিত্ত পরিবার | বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। শিবাজীদার মত মানুষের সাথে মণীষার মত মেয়েকেই বোধহয় মানায়। ঝট করে খেয়াল হলো রাজন্যার, কি সব ভেবে চলেছে ও! শিবাজীদার সাথে কাকে মানায় আর কাকে মানায় না, সে চিন্তা করে ওর কি লাভ! তাছাড়া শিবাজী দা বিবাহিত, তার একটা মেয়ে আছে |

আচমকা কোমরে একটা পেনের খোঁচা খেয়ে নড়েচড়ে বসল রাজন্যা, রাগী রাগী চোখ করে অনুরাগের দিকে তাকিয়ে বলল,

– কি হল কি? খোঁচা দিচ্ছিস কেন?

উত্তর না দিয়ে ইশারায় সামনের দিকে দেখালো অনুরাগ | সামনের দিকে তাকাতেই থমকে গেল রাজন্যা। শিবাজীদা ঠিক ওর ডেস্কের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।

– কি ব্যাপার! জেগে জেগে ঘুমোচ্ছ নাকি?

বিব্রত মুখ করে রাজন্যা উঠে দাঁড়াতেই শিবাজী ভ্রু কুঁচকালো,

– রাজন্যা, এটা ক্লাসরুম নয়, আমি হেডমাস্টারও নই | উঠে দাঁড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। সিট ডাউন এন্ড কমপ্লিট দা ডকুমেন্ট আই জাস্ট সেন্ট য়্যু | শেষ দশ মিনিটে মেল চেক করোনি নিশ্চয়ই?

নিজের মনে জিভ কেটে রাজন্যা চট করে মেলটা খুললো | নতুন প্রজেক্টের প্ল্যান এর একটা খসড়া | সেখানে কয়েক জায়গায় টেকনিক্যাল এ্যানালাইসিসের অংশে হাইলাইট করা | মেইলে রাজন্যাকে ওই অংশগুলো দ্বিতীয় বার করে ভেরিফাই করে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে |

– কবে লাগবে শিবাজীদা?
– কবে নয় | কখন | উইদিন নেক্সট ওয়ান আওয়ার |

আর কিছু না বলে শিবাজী পেছন ফিরে নিজের ডেস্কের দিকে চলে গেল | রাজন্যার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল | আশ্চর্য লোক! দিব্যি তো একটু আগেই মণীষার সাথে হেসে হেসে কথা বলে বেরোলো | ওর সাথে কথা বলতে গেলেই রাজ্যের বিরক্তি ভর করে কেন লোকটার মধ্যে! পরশুদিন বাড়িতেও ওরকম অদ্ভুত ব্যবহার করল!

মনে মনে সবে দু’চারটে বাছা বাছা গালাগাল দিতে শুরু করেছিল, হঠাৎ শিবাজী পেছন ফিরে বলল,

– কিছু বলছিলে?

রাজন্যার বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে উঠলো, গালাগাল গুলো মনে মনে দিতে গিয়ে জোরে বলে ফেলেছে নাকি? আমতা আমতা করে বলল,

– কই নাতো!
– ও আচ্ছা।

শিবাজী নিজের সিটে গিয়ে বসতেই অনুরাগ মুচকি হেসে রাজন্যার দিকে একটু হেলে ফিসফিস করে বলল,

– কি ভাষায় দিচ্ছিলি? বাংলা না হিন্দি?
– ক্কি? কি বলছিস?

রেগে গেলে রাজন্যার বসকে গালি দেওয়ার অভ্যাস সম্বন্ধে যথেষ্ট অবগত অনুরাগ, তাই রাজন্যার অস্বীকার করাকে পাত্তা না দিয়েই বললো,

– কয়েকটা তো আমি আন্দাজ করতেই পারছি…
– এই প্লিজ থেমে যা! কালকে চিকেন রোল খাওয়াবো
– পাক্কা?
– পাক্কা!

অনুরাগ হাসতে হাসতে কাজে মন দিল | রাজন্যাও মেইলের সাথে এ্যাটাচ করা ফাইলটা খুলে নিয়ে দেখতে বসলো এবং এক মিনিটের মধ্যেই কাজে ডুবে গেল।

কাজটা শেষ করতে অবশ্য ঘন্টাখানেকের একটু বেশিই সময় লাগলো | শিবাজী জানতো এত বড় অ্যানালিসিস চেক করা এক ঘণ্টার মধ্যে সম্ভব নয়। তাই মাঝখানে আর তাড়া না দিয়ে ধৈর্য ধরেই অপেক্ষা করছিল | সমস্ত ডকুমেন্টের ওপরে কাজ শেষ করে রাজন্যা খেয়াল করল এক ঘন্টার জায়গায় প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টা হয়ে গেছে। চোখ তুলে শিবাজীকে ডেস্কে না দেখতে পেয়ে গলা বাড়িয়ে শিবাজীর ডেস্কের উল্টো দিকে বসা দ্বৈপায়ন কে জিজ্ঞাসা করল,

– দ্বৈপায়নদা! শিবাজীদা কোথায় গেল?
– সেনবাবু? নিচে গেছে মনে হয় বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে!
– ও, স্মোক করতে গেছে? আচ্ছা আমি তাহলে একটু চা খেয়ে আসি। এই তোরা কেউ যাবি রে?

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে | অনেকেই আর আধ ঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে, তাই কেউই খুব একটা উৎসাহ না দেখাতে আপন মনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পার্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাজন্যা |

অফিস বিল্ডিং এর সামনের রাস্তাটা পেরোলেই সারি সারি ঝুপড়ি গোছের দোকান | চায়ের ব্যবস্থা মোটামুটি সব দোকানেই, তার সাথে নানা ধরনের খাবার, এক এক জায়গায় এক এক রকম | কোথাও গরম গরম কচুরি ভাজা হচ্ছে, কোথাও ছাঁকা তেলে ভেজে উঠে আসছে সোনালী রঙের বড় বড় অমৃতি, কেউ আবার বিরাট বড় লোহার চাটুতে ঢং ঢং করে শব্দ করে ধোসা ধোসা বলে ডাকছে | চাওমিন, আলু টিক্কি, ঘুগনি, এগ রোল, চিকেন রোল, ঝাল মুড়ি, পাপড়ি চাট – কি নেই! সাবর্ণ, শিবাজী আর স্বয়ম ওদের পরিচিত একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল | এইমাত্র একটা করে খাস্তা কচুরি শেষ করেছে তিনজনই।

সাবর্ণ একটু চিন্তিত স্বরে বললেন,

– আচ্ছা শিবাজী, এই নতুন প্রজেক্টটায় সব জুনিয়ার নিলে! সমস্যা হবে না তো?

– কি করব সাবর্ণদা? আপনিই তো বললেন কম বাজেটে রাখতে হবে। আমাকে আর সৌম্যকে দুজনকেই যদি থাকতে হয় তাহলে তো এমনিই বাজেট একটু হাই হয়ে যাচ্ছে

স্বয়ম বলে উঠলো,

– কেন সবাই জুনিয়ার না তো, ওই নতুন মেয়েটা কি যেন নাম? ও তো সিনিয়র?

শিবাজী একটু চিন্তিত মুখে বলল,

– হ্যাঁ বাকিদের থেকে সিনিয়র বটে, কিন্তু কাজ কতদূর কি করবে সন্দেহ আছে |
– কেন এরকম মনে হল কেন?
– না সেরকম কোনো কারণ নেই, আসলে আজকে সরাসরি বলে দিল সাতটার পরে ও কখনোই অফিসে থাকতে পারবে না | আবার কোন একজনকে ইউএসএ যেতে হতে পারে শুনে আমাকে বলল যে ওদের খুব কনজারভেটিভ পরিবার, ওকে যেন ইউএসএ যাওয়ার জন্য সিলেক্ট করা না হয় | এত বেশি রিজার্ভেশন থাকলে তাকে ক্রিটিক্যাল রিসোর্স হিসাবে কি করে কনসিডার করব?
– তাহলে কি ভাবছো? রিপ্লেস করবে?
– বুঝতে পারছি না | দেখি প্রথম একটা মাস | তবে আমার ধারণা রাজন্যা সামলে দিতে পারবে |

স্বয়ম একটা বিষম খেলো,

– রাজন্যা! মানে ওই ছিটিয়াল মেয়েটা যে প্রথম দিনেই পাঙ্গা নিয়ে নিয়েছিল তোর সাথে?

সাবর্ণ হো হো করে হেসে ফেললেন,

– আই লাইক দ্যাট গার্ল | শিবাজী সেনের সাথে পাঙ্গা নেওয়ার সাহস খুব বেশি মানুষের হয় না কিন্তু!

শিবাজী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কাছেই একটা কোনো দোকানে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকালো সেদিকে

– এটা চা হয়েছে? এটার মধ্যে কি আছে? দুধও নেই, চা পাতাও নেই, চিনিও নেই, এমনকি গরমও নয়। এটার জন্য আমি কেন সাত টাকা দেবো বলুন তো?

দোকানদার তেরিয়া ভাবে বলছে,

– ঝুপড়িতে কি অত কায়দা ওয়ালা চা পাওয়া যায় নাকি দিদি ? এখানে তো এরকম চা-ই সবাই খায়।
– তাই নাকি? এখনই আমি পাশের আরো পাঁচটা দোকান থেকে পাঁচ কাপ চা স্যাম্পল নিয়ে আসছি। আপনি খান, খেয়ে দেখে আমাকে বলুন আপনার চা টা ঘোড়ার হিসুর থেকে বেটার কিনা!

দোকানি রেগে মেগে কিছু বলার আগেই সামনে দাঁড়ানো আরেকটি ছেলেও বলে উঠলো,

– সত্যি কাকা। তোমার চা টা কিন্তু আজকে একেবারে যাতা। ফ্লাস্কে জল মিশিয়েছ নাকি?
– আমি জল মেশাইনি!
– আলবাত মিশিয়েছেন! নয়তো আরো খারাপ কিছু মিশিয়েছেন! ক’কাপ চা আছে, দেখুন দেখি! আমি পয়সা দেবো। আপনি খান ওই চা গুলো তারপর ভালো করে চা বানান। আমার সামনে।

– রাজন্যা না?

স্বয়ম চোখ গোল গোল করে বলল। শিবাজী দেখতে পেয়ে গেছে খানিকক্ষণ আগেই। দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,

– এই মেয়ের মাথায় কত মিটার ছিট আছে ভগবান জানে। চা কে বলছে ঘোড়ার হিসু! একটা কাজ দিয়ে এসেছিলাম, শেষ করে এসেছে কিনা কে জানে!

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে