#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১০)
সেনভিলা থেকে বেরিয়ে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল রাজন্যা | তিতলির বাবা যে শিবাজী সেন, সেটা জানার পরে মনের ভেতরে কেমন যেন একটা তালগোল পাকিয়ে গেছে। অফিসে দেখেই লোকটার প্রতি দুটো বিপরীত অনুভূতি কাজ করে ওর মনে | কখনো লোকটাকে অত্যন্ত ইগোযুক্ত একটা মানুষ মনে হয়, যার ব্যবহার রুঢ়, যে ভদ্রতা করতে জানে না, অতিরিক্ত গম্ভীর, অতিরিক্ত ডিমান্ডিং। আবার কখনো মানুষটাকে মনে হয় কড়া শিক্ষকের মতন, যে কাঠিন্যের আবরণে নিজের জুনিয়রদের ক্যারিয়ারকে আরো উন্নত করে তুলতে সাহায্য করে | অফিসের শিবাজীদাকে নিয়েই হিমশিম খাচ্ছিল, আবার এখানে ছাত্রীর বাবা শিবাজীদার মধ্যেও অল্প সময়ের মধ্যেই দুই রকম মানসিকতার পরিচয় পেয়ে খুবই দোটানায় পড়ে গেছে রাজন্যা।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নির্দিষ্ট রাইট টার্ণটা পেরিয়ে গেছে, খেয়াল করেনি | হঠাৎ আশেপাশের বাড়িগুলো অচেনা লাগায় থমকে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতেই একটা সরু গলার ডাক শুনতে পেল,
– এই! রাজন্যা না?
কে আবার ডাকছে ওর নাম ধরে! চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাতেই সামনের বাড়ির জানালায় একটা হাসিমুখ দেখতে পেল।
আরে এই মেয়েটির সাথেই তো সেই প্রথম দিন দেখা হয়েছিল! কি যেন নাম? সমাদৃতা!
এগিয়ে গেল।
– হাই!
চওড়া হেসে মেয়েটি বলল,
– হাইই! কি ব্যাপার? আবার রাস্তা ভুলেছো নাকি?
রাজন্যা একটু অপ্রস্তুত ভাবে হাসল,
– হ্যাঁ, মানে একটা জিনিস ভাবতে ভাবতে ওই আগের ডান দিক ঘোরাটা মিস করে এগিয়ে এসেছি | তবে এখান থেকে সোজা গিয়ে পরের ডান দিকটা নিলেই তো নেক্সট স্টপেজটা, তাই না?
– হ্যাঁ | তবে সোজা গিয়ে পরের স্টপেজে যাওয়ার চাইতে একটু পিছিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি ঠিক স্টপেজে পৌঁছাতে পারবে |
রাজন্যা ঘাড় নাড়াল,
– তা ঠিক! আসলে ঝট করে এগিয়ে যাওয়ার কথাই মাথায় আসে একটু পিছোলেই যে কাজটা সহজে হতে পারে, সেটা খেয়ালই থাকে না!
সমাদৃতা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল রাজন্যার দিকে। আলগোছে কি যেন একটা অসম্ভব কথা বলে দিয়েছে মেয়েটা। এ তো মানুষের চিরন্তন ব্যবহার। সবাই সবসময় এগিয়ে যেতেই চায়। কখনো যে দু’পা পিছিয়ে এসে একটা ভুল ঠিক করে নেওয়া যায় সে কথা কেউ ভাবেই না! সমাদৃতার মুখের ভাব হঠাৎ বদলে যাওয়াটা রাজন্যার চোখে পড়েছে। একটু এগিয়ে এলো জানলার দিকে।
– কি হলো? তুমি হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেলে?
– কই? না না! এমনিই…
রাজন্যা কি ভেবে হঠাৎ বলল,
– বাইরে আসবে? তাহলে একটু হেঁটে যেতাম, মে বি মোড়ের মাথা অবধি? আসার সময় দেখেছিলাম কয়েকটা ছোট ছোট স্টল হয়েছে | সামনে পয়লা বৈশাখ না? তাই জন্য টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বসেছে লোকজন | একটু সেসব জিনিস দেখাও হতো আর তোমার সাথে ভালো করে আলাপটাও হতো? আসলে তোমার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগছে |
সমাদৃতার চোখে মুখে নিমেষে একটা বিষাদের ছায়া নেমে এলো। খুব আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে বলল,
– সামহাও তোমার সাথেও আমার কথা বলতে খুব ভালো লেগেছিল আগের দিন। আজকেও লাগছে। কিন্তু আমি বেরোতে পারব না গো!
– কেন?
রাজন্যার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় | সমাদৃতা আলতো করে মাথা নাড়ালো,
– তুমি ভেতরে এসো বরং | ঘরে বসে গল্প করি…
– আমি আসলে একটু বেশি বকবক করি। আর ঝুপঝাপ লোকের সাথে বন্ধুত্ব পাতাই | হুট করে বাইরে হাঁটতে যেতে বললাম বলে তুমি বিরক্ত হলে না তো?
– না না! বিরক্ত হব কেন? বরং বেশ ভালো লাগছে। অনেকদিন কোন নতুন বন্ধু হয়নি…
– সেই জন্যই তো বলছি চট করে একটা চটি গলিয়ে বেরিয়ে এসো | মোড়ের মাথা অব্দি গিয়ে না হয় তোমাকে এই অবধি আবার এগিয়ে দিয়ে যাব?
সমাদৃতা কোন উত্তর দিল না | ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রাজন্যার কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো | মেয়েটা তো বেশ ভালোভাবেই কথা বলছে তাহলে পাঁচ সাত মিনিটের জন্য বাইরে বেরোতে এত আপত্তি কেন? নাহ্, মাত্র দুই দিনের আলাপে এভাবে প্রস্তাব দেওয়াটা উচিত হয়নি। মনে মনে নিজের মাথায় দুটো গাঁট্টা মারল রাজন্যা | ওর এই আগ বাড়িয়ে লোকের সাথে আলাপ করার অভ্যাসটা চেষ্টা করেও বদল করতে পারে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না | আজ বরং আসি | অন্য কোন দিন যাওয়া যাবে |
-কোনোদিনই আমি বেরোতে পারবো না রাজন্যা
– মানে?
– আমি হাঁটতে পারি না…
মিনিট কুড়ি হয়ে গেছে রাজন্যা সমাদৃতার ঘরে বসে আছে | ওর কাছ থেকে শুনেছে কিভাবে দেশের বিভিন্ন শহরে ভরতনাট্যমের স্টেজ পারফরম্যান্স করে বেড়ানো মেয়েটা চার বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় হাঁটাচলা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল | সমাদৃতা জানিয়েছে যে চিকিৎসা চলছে এবং ডাক্তাররা আশ্বাসও দিয়েছেন আর বছর দুয়েক পরে হয়তো ও নাচ করতে না পারলেও সাধারণ হাঁটাচলা করতে পারবে | এখনকার মত হুইল চেয়ারে বন্দী হয়ে থাকতে হবে না |
– ওই ওইটুকুই আশা!
ঘাড় ডান দিকে সামান্য হেলিয়ে একটা অদ্ভুত সরল ভাবে হাসল সামাদৃতা | রাজন্যার বুকের ভিতর থেকে একটা খারাপ লাগার বুদবুদ ওপর দিকে উঠে এলো | কতটুকুইবা চেনে মেয়েটাকে! তবু নিজেরই বয়সী একটা মেয়েকে ভাগ্যের ফেরে এভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়তে দেখে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে । একটা কথাই ঘুরেফিরে মাথায় আসছে, ভাগ্যের কাছে সত্যি মানুষ কত অসহায়।
আরো কিছুক্ষণ টুকিটাকি কথাবার্তা বলার পরে সমাদৃতার কাছে বিদায় নিয়ে রাজন্যা বাড়ির দিকে রওনা দিল। জানালা দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল সমাদৃতা | মাধবী মেয়ের ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন | রাজন্যা বেরিয়ে যেতেই ঘরে ঢুকে এলেন,
– কেন এসেছিল এই মেয়েটা? ওকে কি ওরা পাঠিয়েছিল?
সমাদৃতা অবাক হয়ে তাকাল,
– কি বলছ? ওরা মানে? সুমি পিসিরা?
– হ্যাঁ, আবার কে? এই মেয়েটাই তো তিতলিকে পড়াতে যায়, তাই না?
– তা যায়, কিন্তু হঠাৎ সুমি পিসিরা একজন বাইরের মেয়েকে আমাদের বাড়িতে কেন পাঠাবে বলতে পারো মা?
– জানিনা! জানিনা ওরা কি করতে চায়, কি করতে পারে! শুধু এটুকু জানি ওই পরিবারের জন্য আমার পরিবারটা শেষ হয়ে গেল |
– মা!!
ব্যথিত দৃষ্টিতে মাধবীর দিকে তাকালো সমাদৃতা।
– সবকিছু জেনেও তুমি এমন বলতে পারছ? আমাদের পরিবারের থেকে ওদের ক্ষতি বেশি হয়েছে মা | মুখে স্বীকার না করলেও সেটুকু তো তুমি জানো!
– কোন ক্ষতিই তো হতো না, যদি ওরা ঐ একগুঁয়েমি না করত! নিজেদের দোষে নিজেদের সর্বনাশ তো করলোই, আমার পরিবারটাকেও ভাঙচুর করে দিল…
মুখে আঁচল চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মাধবী | মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল সমাদৃতা |
হুইল চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে গেল ওয়ার্ডরোব এর কাছে | পাল্লা খুলে বার করে আনলো লাল রঙের মলাট দেওয়া অ্যালবামটা। পাতা উল্টানোর আগে একবার মলাটের উপরে সযত্নে হাত বুলালো। এই অ্যালবামের ভেতরের ছবিগুলো ছোট্টবেলার স্মৃতি | ওর, ওদের | জীবন তখনও এতটা জটিল ছিল না, জীবনে তখনও এত চাহিদা ছিল না। পাতা উল্টে গেল একের পর এক | থামল সেই পরিচিত পাতাটায় গিয়ে | আঙ্গুল ছোঁয়ালো পাতার মাঝখানে আটকানো একমাত্র ছবিটায়। আলতো ফিসফিসানি স্বরে বলল
– দিদিয়া!
দিনটা ছিল শনিবার | বাবার ল ফার্মে শনি রবি বলে কিছু ছিল না। সপ্তাহে সাত দিনই নির্দিষ্ট সময়ে বাবা বেরিয়ে যেতেন অফিসে। এ নিয়ে মাকে বহুবার রাগারাগি করতে দেখেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। কখনো পরপর দু তিন দিন বাড়িতেই থাকতেন আবার কখনো এক মাস টানা একদিনও ছুটি না নিয়ে অফিস করতেন। সেদিনও যথারীতি বাবা অফিসে | মা গিয়েছিলেন যাদবপুরে দিদুনের বাড়ি | সমাদৃতার তখন কলেজের পরীক্ষা চলছে, সোমবারের পরীক্ষার জন্য খানিক পড়াশুনা করছিল। হঠাৎ দরজার আওয়াজে তাকিয়ে দেখল তার দিদিয়া অর্থাৎ মিঠি একটা শর্ট জিন্সের স্কার্ট আর মাখন রঙা স্প্যাগেটি টপ পরে হাসিমুখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে | হাঁ করে দিদির দিকে তাকালো দিঠি ওরফে সমাদৃতা।
– কি দেখছিস চোখ গোল গোল করে? কেমন লাগছে বল না!
একটা ঢোঁক গিলে দিঠি বলল,
– মানে এরকম ড্রেস তুই কোথায় পেলি?
– উফ! কোথায় পেলাম টা পরের প্রশ্ন | আগে বল কেমন লাগছে?
এবারে মন দিয়ে দিদির মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিলো দিঠি |
– খারাপ না! কিন্তু বড্ড বেশি এক্সপোজড তো রে! এই পোশাকে কোথায় যাবি?
এতক্ষণ পেছনে রাখা হাতটা সামনে এনে চার ইঞ্চি লম্বা হিলওয়ালা জুতোটা পায়ে গলাতে গলাতে মিঠি বলে উঠল,
– আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। একটা ক্লোদিং লাইনের মডেল সিলেকশনে লাক ট্রাই করতে যাচ্ছি।
– মডেল!
হাঁ করে তাকাল দিঠি,
– তুই মডেলিং করবি নাকি? তাহলে তোর ল পড়ার কি হবে?
– ধুত্তোর! ওই বোরিং ল কে পড়বে? সারা জীবন সাদা শাড়ি পড়ে কোর্টে সওয়াল জবাব করব নাকি? আই বিলঙ্ টু দ্যা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড | একটা ব্রেক পেতে দে, তারপর দেখিয়ে দেবো আমার ক্যারিশমা |
– দিদিয়া আই নো তুই ভীষণ সুন্দরী। মানে চোখে পড়ার মতন সুন্দরী। কিন্তু মডেলিং! বাবা রাজি হবে না তো রে?
কাঁধ ঝাঁকালো মিঠি,
– রাজি না হলে না হবে! আমার কিছু করার নেই। আই এম অ্যান অ্যাডাল্ট ইনডিভিজুয়াল | নিজের ক্যারিয়ার নিজে চুজ করার ফ্রিডম আমার আছে |
একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল মিঠি |
– এই শোন, আমি এখন বেরোলাম, দেরি হয়ে যাবে নাহলে | তুই কিন্তু আপাতত মাকে কিছু বলিস না | সিলেকশনটা হোক, তারপরে আমিই বলবো।
মিঠি বেরিয়ে যাবার পরে বেশ কিছুক্ষণ পড়ায় আর মন বসলো না দিঠির | ওদের দুই বোনের মধ্যে দিদিয়াকে যে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর সে কথা ও ছোট থেকেই জানে। কথায় কথায় আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব বিনা প্ররোচনায় এই মন্তব্যটা করেই থাকেন।
– মাধবী তোমার ছোট জন সুন্দর, কিন্তু বড় জনের ধারে কাছে আসে না!
– দিঠির রংটা মিঠির থেকে একটু চাপা না গো?
– দিঠিটা এত ভাল নাচ করে অথচ মিঠির ফিগার দেখো! একেবারে চাবুকের মতন
– মিঠির বিয়ে নিয়ে তো মাধবীর চিন্তাই নেই, দিঠিটাকে নিয়ে তাও একটু সমস্যা হতে পারে…
মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো, দুঃখও হতো | মাও কখনো ওকে আগলে বাকিদের বাচ্চা মেয়েটার সামনে এমন কথা বলতে বারণ করত না | বড় মেয়েকে নিয়ে একটা আলাদাই গর্ব ছিল মায়ের | বড় হওয়ার সাথে সাথে দিদির সঙ্গে এই তুলনাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া শুরু করেছিল দিঠি | ছোটবেলায় দিদির উপর যেটুকু হিংসা ছিল, আস্তে আস্তে সেটুকু উধাও হয়ে গিয়েছিল | মিঠির কাছেও বাড়ির মধ্যে সবথেকে ভরসার মানুষ ছিল পাঁচ বছরের ছোট এই বোন | পড়াশোনায় বরাবরের ভালো এবং বিখ্যাত গুরু অরুণা রত্নমের স্নেহধন্য নৃত্য পটিয়সী ছোট বোনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিত মিঠি | তাই তার যে কোন দুঃসাহসিক কাজের সম্বন্ধে আগে থেকেই একটা আঁচ পেয়ে যেত দিঠি |
সন্ধ্যা হওয়ার মুখে মুখে মিঠি যখন ফিরলো, দরজা দিয়ে ওকে ঢুকতে দেখে আরো একবার হাঁ করে তাকালো দিঠি | সকালবেলার অত্যাধুনিক পোশাক উধাও | পরনে একটা সাধারন চিকনের কাজ করা কুর্তা আর পায়জামা, হাতে একটা ঢাউস ব্যাগ | বোনকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে এক চোখ টিপে ইশারা করে কাঁধের ব্যাগটার দিকে আঙুল দেখালো মিঠি |
দিঠি ফিক করে হেসে ফেলতেই মাধবী ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালেন,
– কি হয়েছে রে? হাসছিস কেন?
বলতে বলতেই বড় মেয়ের দিকে চোখ পড়ল।
– ওহ্, চলে এসেছিস? চা খাবি? এইমাত্রই ঢালছিলাম…
– হ্যাঁ দাও, যদি এক্সট্রা থাকে…
ব্যাগটা সন্তর্পনে সোফার কোনায় রেখে টেবিলের সামনে চলে এলো মিঠি | আরেকটা কাপ টেনে নিয়ে চা ঢালতে ঢালতে মাধবী প্রশ্ন করলেন,
– তা তোদের সেই পুরনো জামা কাপড় বিলি করার কাজ মিটলো?
– হ্যাঁ মা, ওখান থেকেই আসছি। কয়েকটা জামা ছেঁড়া বেরোলো, সেগুলো আর দিইনি। ব্যাগে করে নিয়ে চলে এসেছি | জেনে বুঝে ছেঁড়া জামা দেওয়া যায় বলো?
– কি দরকার? বাড়িতে কত জামা তোদের ভালো অবস্থায় বাতিল করে দিস!
দিঠি এবারে আর হাসি চাপতে না পেরে চায়ের কাপ সমেত উঠে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
– মা আমি পড়তে পড়তে চা খেয়ে নেব | ঘরে যাচ্ছি |
মিনিট দশকের মধ্যেই ঝড়ের মতন দিঠির পড়ার ঘরে এসে ঢুকলো মিঠি | ঢুকেই দিঠিকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় সটান একটা ঝাঁপ দিল | দুই বোনের খিলখিল হাসি আর গড়াগড়ির চোটে টানটান করে পাতা বিছানার চাদর একদিক থেকে খুলে মাটিতে লুটাতে লাগল |
দুই বোনে খানিক খুনসুটির পরে দিঠি বিছানা থেকে নেমে মাটিতে বাবু হয়ে বসলো
– এই দিদিয়া, কি হলো ওখানে বল! প্লিজ আমাকে আবার বস্ত্র বিতরণের গল্প দিস না।
মিঠি হাসতে হাসতে বলল,
– আমি যা বস্ত্র পরিধান করে গেছিলাম, তা দেখলে মায়ের আজকে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত!
– সে তো জানি! তুই ফিরছিস না দেখে মনে মনে টেনশনও করছিলাম যে ফেরার সময় কি হবে?
– হুঁ হুঁ বাবা! এই সমর্পিতা মল্লিক অত কাঁচা কাজ করে না!
– আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে! এবারে বল কি হলো?
– দ্যাখ ওরা ফাইনাল এখনো কিছু জানায়নি, তবে কথাবার্তায় যা বুঝলাম, আমার সিলেক্টেড হওয়ার হাই চান্স। একটা দিল্লির মেয়ে আছে ওর আর আমার মধ্যে যে কোন একজনকে নেবে। বাট পিকচার আভি বাকি হে মেরে ইয়ার!
রহস্যের গন্ধ পেয়ে দুই হাঁটু চিবুকের কাছে ভাঁজ করে চোখ বড় বড় করল দিঠি,
– কি রে! বল বল!
নিজেও বিছানা থেকে নেমে এসে বোনের পাশে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল মিঠি | দুই হাত উপর দিকে তুলে যাদুকরদের গিলি গিলি গি ভঙ্গিমায় নাড়াতে নাড়াতে বলল,
– জাস্ট গেস ওই ফ্যাশন হাউসটা কাদের?
– কাদের মানে ? তুই তো বললি স্বস্তিক নামের কোথায় একটা যাচ্ছিস!
– ইয়েস ডার্লিং! বাট ক্যান ইউ ইমাজিন স্বস্তিকের ওনার কারা?
ভ্রু কুঁচকালো দিঠি | সত্যি কথা বলতে এইসব ফ্যাশন হাউস সম্বন্ধে ওর কোন স্বচ্ছ ধারণাই নেই। পুজোর সময় মা বাড়িতে পূজা বার্ষিকী আনন্দলোক নেয় | তাতে নায়িকাদের বিচিত্র সব পোশাক পরা ছবি দেখে মা বলে ‘কি ফ্যাশন করেছে!’
দিঠিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর থুতনি ধরে একটু নেড়ে দিয়ে মিঠি বলল,
– ওদিকে জোড়াবটতলার দিকে সেনদের যে বড় সাদা বাড়িটা আছে, দেখেছিস নিশ্চয়ই? ওই শিবনাথ সেনের কোম্পানি হচ্ছে এই স্বস্তিক। ওনার ছোট ছেলে শিবাজী তো আমাদের কলেজেই পড়তো! বছরখানেকের সিনিয়র | আমি দেখেই চিনেছি!
– ওদের ব্যবসা আছে জানতাম, কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম জামা কাপড়ের মেটিরিয়াল এর ব্যবসা | তুই যে ফ্যাশন হাউজ বলছিস!
– আরে আমিও তো সেটাই জানতাম। স্বস্তিক যে এদের, তা জানলে আগে থেকে ওই বাড়িতে গিয়ে একটু খেজুর করে আসতাম না?
দিঠি ভ্রু কুঁচকালো,
– এ আবার কি ভাষা দিদিয়া! খেজুর করে আসা!
– ও লে আমার ছোনটা মোনটা রে! এরকম নেকু পুষু ভালো মেয়ে হয়ে রিয়েল লাইফে কিছু করতে পারবে না মামনি! যেখানে যেমন দরকার তেমন করে বাটারিং করতে হয়, তা না হলে রাস্তা স্মুদ হয় না, বুঝলে?
দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করে দিঠি বলে উঠলো,
– থাক বাবা! আমি বরং বাটারিং করতে লাগবেনা তেমন রাস্তা দিয়েই চলবো।
মিঠি হাসতে হাসতে মেঝের ওপরেই গড়িয়ে গিয়ে বোনের কোমর জড়িয়ে ধরল |
ছবিটার উপর আঙুল বোলালো সমাদৃতা | সেদিন সমর্পিতা ইন্টারভিউ দিতে বেরোনোর আগে মোবাইলে ওর এই ছবিটা তুলেছিল | তখনো গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের চাকচিক্য কিছুই নেই, রূপোলি দুনিয়ার পালিশ পড়েনি। তাতেও কি সুন্দর! নজর কাড়ার মতন সৌন্দর্য!
বাইরে পায়ের আওয়াজ হতেই তড়িঘড়ি অ্যালবামটা ওয়ার্ডরোবের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল সমাদৃতা। মাধবী দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়েছেন,
– অনেকদিন টেবিলে গিয়ে খাস না | আজ যাবি?
কথা না বাড়িয়ে হুইল চেয়ারের চাকায় হাত দিয়ে ঘুরিয়ে নিল সমাদৃতা,
– হ্যাঁ চলো, আসছি।
তিতলির বাবা আর অফিসের বস শিবাজী সেন যে একই লোক এই চাঞ্চল্যকর তথ্যটা দুদিন ধরে কোন রকমে মালবিকার থেকে লুকিয়ে রেখেছে রাজন্যা। এ কথা জানতে পারলেই মেয়েটা যে কি পরিমানে ওর পিছনে লাগবে সেই আশঙ্কা করেই এই সিদ্ধান্ত | সোমবার অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হবার সময় এটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল,
আচ্ছা শিবাজীদার সাথে ও স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলতে পারবে তো? যদি কখনো ভুল করে তিতলির প্রসঙ্গ তুলে অফিসে কিছু বলে ফেলে, তাহলে কি শিবাজীদা কিছু মনে করবে? শিবাজীদা কি বাকিদের বলেছে যে রাজন্যা শিবাজীদের বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন পড়াতে যায়?
মাথার মধ্যে কিছুক্ষণ এইসব কথাগুলো ঘুরপাক খাওয়ার পরে ধুত্তোর বলে বেরিয়ে পড়ল রাজন্যা। যা হবে দেখা যাবে।
সেই প্রথম দিনের পর থেকে আর কোনদিন দেরিতে অফিস ঢোকে নি রাজন্যা | মাঝেমধ্যে বরং বেশিই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়। তবে আজ পর্যন্ত কোনদিনও অফিসে পৌঁছে শিবাজীদার চেয়ার ফাঁকা থাকতে দেখেনি। একদিন সামলাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিল
– শিবাজীদা, আপনি কত সকালে অফিসে আসেন?
দ্বৈপায়নদা, যে কিনা শিবাজীদার সমসাময়িক এবং টিমের একমাত্র লোক যার সাথে শিবাজীদাকে কোনদিন চেঁচামেচি করতে দেখেনি, তিনি বলেছিলেন
– আরে সেনবাবু আসলে বেশি ট্রাফিকে গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন না, তাই ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্টটা করেই অফিসে চলে আসেন…
শিবাজীদাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে রাজন্যার মনে হয়েছিল কথাটা হয়তো খুব একটা ভুল নয় |
আজও ওডিসিতে ঢুকতে ঢুকতে নির্দিষ্ট চেয়ারটার দিকে চোখ যেতেই পাট ভাঙ্গা ইস্ত্রি করা ফরমাল সাদা শার্ট আর ট্রাউজার পরা মূর্তিকে মনোযোগ সহকারে ল্যাপটপে কাজ করতে দেখতে পেল | রাজন্যা যেখানে বসে সেখান থেকে দুটো রো পরে সামনাসামনি শিবাজীর সিট | কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুই একবার ঘাড় তুলে ওদিকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটার মুখে কোন ভাবান্তর নেই। প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে ফোনে কথা বলছে, জুনিয়রদের ধমকাচ্ছে, দ্বৈপায়নদা আর সাবর্ণদার সাথে কাজ নিয়ে আলোচনা করছে।
বারোটার খানিক পরে সৌম্য একটু জোরে জোরে জুনিয়রদের দলটার দিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– রাজন্যা, অনুরাগ, পাভেল আর মণীষা দুটোর মধ্যে লাঞ্চ শেষ করে নিস | একটা নতুন প্রজেক্ট এর রিকোয়ারমেন্ট নিয়ে আলোচনা করব | দুটো থেকে মিটিং রুম-এ বুক করা আছে, কাউকে যেন আলাদা করে আর ডাকতে না হয়। নোটপ্যাড নিয়ে সবাই চলে আসবি |
নতুন কাজ! ওয়াও!
রাজন্যা মনে মনে বেশ এক্সাইটেড হয়ে উঠলো। সপ্তাহ দুই আগের সেই ঘটনাটার পরে ওর মনে হয়েছিল শিবাজীদা হয়তো ওকে এখনই আর কোন নতুন প্রজেক্টে ডাকবে না | শেষ কয়দিন গতানুগতিক কাজ করতে করতে একটু হাঁপিয়েও উঠেছিল | অথচ বাকি জুনিয়ররা এ ধরনের কাজ নিয়েই রীতিমতো খুশি থাকে | বেশি মাথা ঘামাতে হয় না, দিনের মধ্যে চার পাঁচ ঘন্টা বাঁধাধরা কাজ করে ফেলতে পারলেই বাকি দিনটা গুলতানি করে কাটিয়ে দেওয়া যায় | কিন্তু রাজন্যার সেটা পছন্দ নয়। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে না পারলে দম বন্ধ করা একঘেয়েমি চেপে ধরে ওকে।
লাঞ্চের পরে মিটিং রুমে দুটোর মধ্যেই পৌঁছে গেল ওরা চারজন | দুটো থেকে দুটো দুই হয়ে গেলেই যে একজনের শীতল দৃষ্টির সামনে পড়তে হবে সে সম্বন্ধে নতুন পুরনো সকলেই ভাল রকম ওয়াকিবহাল । দুটো বাজার মিনিট খানেক আগে শিবাজী এবং সৌম্য মিটিং রুমে ঢুকলো। প্রথম পনের মিনিট নতুন প্রজেক্টের সম্বন্ধে ছোট করে একটা ধারণা দিয়ে দিল শিবাজী | তার সাথে এটাও জানিয়ে দিল যে এই প্রজেক্টটা কোম্পানির খুব উঁচু স্তরের কোন ব্যক্তির থেকে রেফারেন্স হিসেবে ওদের কাছে এসেছে |
– তাহলে বুঝতেই পারছ প্রজেক্টের প্রতিটা খুঁটিনাটি খুব মাইনিউটলি মনিটর হবে | আগামী ছয় সাতমাস তোমরা ডেডিকেটেডলি এই প্রজেক্টে কাজ করবে। নিতান্ত এমার্জেন্সি না হলে একদিনের বেশি ছুটি নেওয়া চলবে না | ফার্স্ট লেভেলের ডেভেলপমেন্ট কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত থাকতে হতে পারে | আমার আর সৌম্যর সাথে আলোচনা না করে সরাসরি কেউ ক্লায়েন্টের সাথে কোন কথাবার্তা বলবে না | আফটার ডেভেলপমেন্ট টেস্টিং এ যাওয়ার আগে একে অপরের কোড টেস্ট করবে। কারো যদি কোন আপত্তি থাকে এখনই বলে দাও |
রাজন্যার কেমন যেন মনে হল শিবাজীদা শেষ কথাটা ওকে উদ্দেশ্য করেই বলল |
(ক্রমশ)