হৃদ মাঝারে পর্ব-০৯

0
484

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ৯)

বৃহস্পতি আর শুক্র দুটো দিন পেরিয়ে শনিবার আসতে না আসতেই সকাল থেকে ব্যস্ত হয়ে উঠল রাজন্যা। আজকে তিতলির বাবা ওর সঙ্গে দেখা করবেন বলেছেন |

– এমনিতে তো নিজে বাড়ি থাকে না, এদিকে টিউটরের পাঁচ মিনিট দেরি হলেই অভিযোগের বন্যা!

ব্রেকফাস্ট করতে করতে রাজন্যা নিজের মনেই গজগজ করছিল | দেরি এড়ানোর জন্য মালবিকা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দোকানে গিয়ে চিকেন নিয়ে এসেছে, ভাল করে ধুয়ে, দই, আদা রসুন, সাদা তেল আর সব রকম মশলা দিয়ে ম্যারিনেটও করে রেখেছে | বাটার চিকেন হবে আজ, সাদা কাগজে স্টেপ বাই স্টেপ ইন্সট্রাকশনও লিখে রেখেছে | কিন্তু মনটা খুঁতখুঁত তো করছেই, মালবিকাটা বড্ড ফাঁকিবাজ, নির্ঘাত ঠিকমতো না কষিয়েই জল ঢেলে দেবে | কিন্তু আর কাজ এগিয়ে রেখে যাওয়ার মত সময় নেই | অফিস, টিউশন সব জায়গাতেই ঘড়ির কাঁটার টিকটিক ধরে চলা খিটখিটে লোকজনের পাল্লাতেই পড়তে হয়েছে।

ওয়ার্ডরোবটা খুলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল | এমন নয় যে তার প্রচুর পোশাক আশাক আছে যার থেকে বেছে নিতে খুব কষ্ট করতে হবে। তবুও কেন যেন পোশাকের উপরে আজ একটু গুরুত্ব দিতে ইচ্ছা করলো। গত মাসের পারফরম্যান্স বোনাসের টাকা দিয়ে শখ করে একটা আকাশ নীল রংয়ের চিকনকারি কাজ করা কুর্তি কিনেছিল। কি মনে করে
ওটাই বের করে আনলো।

হাতে একটু সময় নিয়েই বেরোলো | গোটা রাস্তাটা ভাবতে ভাবতেই চলল, এইটুকু একটা বাচ্চার পড়ানো নিয়ে তার সুপার বিজি বাবার কি এমন বক্তব্য থাকতে পারে যে তিনি আগাম তার জন্য জানিয়ে রাখলেন? রাজন্যার মনে পড়ে গেল ওরা যখন জয়েন্টের টিউশন নিতে পার্থদার কোচিং সেন্টারে যেত, প্রায় সবার অভিভাবকরা, বিশেষ করে মায়েরা, আলাদা আলাদা করে গিয়ে পার্থদার সঙ্গে কথা বলতেন। বোঝার চেষ্টা করতেন ছেলের বা মেয়ের পড়াশুনা কেমন চলছে | জয়েন্টে যেমন ফল করতে পারে, আরো কোন অতিরিক্ত বই লাগবে কিনা, বাড়িতে কতক্ষণ পড়তে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি |রাজন্যার জন্য অবশ্য কেউ কখনো যায়নি | তবে যেই যেই দিন রাত নটা পর্যন্ত টিউশন থাকতো, জ্যাঠতুতো দাদা গিয়ে কোচিং এর গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতো | পাশাপাশি সাইকেলে ফিরতে ফিরতে পড়াশুনা কেমন হচ্ছে, কেমন আছ, ভাল আছি গোছের দায়সারা কথাবার্তা হতো। জ্যাঠাদের সাথে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ থাকলেও বড় জেঠিমা যে জোর করে দাদাকে পাঠাতো সেটা বুঝতে পারত রাজন্যা | ওটুকুই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতো | কোচিং থেকে বেরোবার সময় বন্ধুদের বলতো, ‘যাই রে! দাদা নিতে এসেছে…’

সেনভিলায় পৌঁছে আজ আর বেল বাজাতে হলো না, পিসিমা আর কৈলাসদা বাইরেই ছিলেন | বাগানের গাছের পরিচর্যা করছিলেন | রাজন্যাকে দেখেই হাসলেন সুমিত্রা,

– এসে গেছো? গুড মর্নিং | যাও যাও, তোমার স্টুডেন্ট ওয়েট করছে।

রাজন্যাও হেসে মাথা নাড়ালো,

– গুড মর্নিং পিসিমা। গুড মর্নিং কৈলাসদা | আগে না বলার সুযোগ হয়নি, আপনাদের এই গার্ডেনটা ভীষণ সুন্দর |

কৈলাসের হাসি চওড়া হলো,

– ছোড়দাভাইয়ের বাগানের খুব শখ | নেহাৎ আজকাল সময় পায়না বলে, তা না হলে ছুটির দিনে সকালে এলে তাকে বাগানেই পেতে |

– ও হ্যাঁ…
যেন কিছু একটা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এরকম ভান করে রাজন্যা বলল,

– তিতলির বাবা আগের দিন বলেছিলেন ওনার কিছু কথা আছে তিতলির পড়াশোনা নিয়ে | উনি কি বাড়িতে আছেন?
– হ্যাঁ আছে তো | সকাল থেকেই কি সব ভিডিও কলে অফিসের কাজকর্ম সেরেছে। এখন বোধ হয় এক্সারসাইজ করছে | আমি ওকে বলে দেবো তুমি এসেছ…

সুমিত্রার কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে রাজন্যা বাড়ির ভিতরে চলে এলো | সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দেখতে পেল একদম উপরের ধাপে একটা গোলাপি রঙের টেডি বিয়ার আঁকা গেঞ্জি আর সাদার উপর নানান রঙের ফুল ফুল ছাপ দেওয়া হাফপ্যান্ট পড়ে তিতলি বসে আছে আর তার পাশে তার টেডি বিয়ার ভাই টুপাই |

– কি ব্যাপার! প্রিন্সেস আজকে সিঁড়িতে বসে আছো কেন?
– ফেয়ারি সিস্টার, খুব খুব ইম্পরট্যান্ট কথা আছে | তাড়াতাড়ি এসো | বাবাইয়া এক্সারসাইজ করে বেরোনোর আগে…

রাজন্যাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে খুব গোপন কথা বলার মত ভঙ্গি করে ওর হাত জড়িয়ে ধরল তিতলি।

তিতলির সাথে ওর ঘরের দিকে এগোনোর সময় ডান দিকের কাঁচের দেয়ালওয়ালা ঘরটার দিকে চোখ গেল রাজন্যার । এই ঘরটার পাশ দিয়ে প্রতিদিনই যায় কিন্তু কখনো সেভাবে খেয়াল করেনি | বোধহয় ভিতর থেকে পর্দা টানা থাকে অন্য দিন | আজকেও আছে তবে পুরোটা নয়, ঘরের অংশ বিশেষ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। একটা পুরোদস্তুর জিম। জিমের মধ্যে একটা জটিল দর্শন মেশিনের উপরে বসে সুগঠিত চেহারার একজন মানুষ যন্ত্রটার দুটো হাতল টেনে ধরে ব্যায়াম করছে | কসরতের কারনে হাতের পেশি ফুলে উঠেছে | কালো রঙের হাত কাটা টি শার্টের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান শরীরের বাকি অংশে বিন্দু বিন্দু ঘাম | চোখ সরিয়ে নিল রাজন্যা |

বাব্বাহ্, তিতলির বাবাইয়া এরকম মাসলম্যান লোক নাকি!

রাজন্যার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে এসে তিতলি বলে উঠলো,

– ফেয়ারি সিস্টার, তুমি কিন্তু বাবাইয়াকে বোলো না যে আমি তোমাকে মাম্মামের ছবি দেখিয়েছিলাম!
– না সোনা | আমি বলব না | আমাদের তো কথাই হয়ে গেছিল যে এটা তোমার আর আমার সিক্রেট, তাইনা?

রাজন্যা তিতলির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল |

– কালকে আসলে বাবাইয়া আমার ওয়ার্ডরোবে কয়েকটা জিনিস রাখতে গিয়ে মাম্মামের ছবিটা দেখে ফেলেছে। আমাকে বকেনি, কিন্তু ছবিটা সরিয়ে রেখেছে।

তিতলির কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে রাজন্যার মন খারাপ হয়ে গেল | বাড়ির লোকের সাথে যাই হোক, মাকে তার বাচ্চার থেকে দূরে রাখা কি এদের ঠিক হচ্ছে? একটা ছবি পর্যন্ত রাখতে দেবে না মেয়েটার কাছে! তিতলিকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,

– আমি তোমাকে তোমার মাম্মার আরেকটা ছবি এনে দেবো। চুপিচুপি।
– সত্যি!!
– প্রমিস |

আহ্লাদের চোটে রাজন্যার একেবারে গায়ের মধ্যে মিশে গেল তিতলি |

– আচ্ছা বাটারফ্লাই, চলো আমরা এবার একটু পড়াশোনা করে নিই | আজকে আবার আমরা একটু ম্যাথস করব কেমন? অ্যাডিশন…

এক্সারসাইজ সেরে অ্যাটাচড বাথরুমে একেবারে স্নান সেরে বের হল শিবাজী | আজ তিতলির টিউটরের সঙ্গে কথা বলবে বলে সকালে স্বস্তিকের অফিসে যায়নি, ভিডিও কলে মনোজিতের সাথে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে নিয়েছে | কতকগুলো ডকুমেন্ট সই করতে হবে, সেগুলো মনোজিৎ অফিসের গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে | তিতলির ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল মেয়েটি এসে গেছে, পায়ে পায়ে এগিয়ে তিতলির ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় শিবাজীর পা থেমে গেল ওইখানে। আকাশ নীল রংয়ের চুড়িদার পরা একটি মেয়ে তিতলির বিছানার উপরে বাবু হয়ে বসে আছে তিতলি তার পিঠের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ছোট ছোট দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আছে | মেয়েটি তিতলির বাঁ হাতের বাড়ানো আঙুলের দুটো বাদে বাকি আঙুলগুলো মুড়ে দিয়ে বলছে,

– তাহলে দেখো তোমার রাইট হ্যান্ডের পাঁচটা ফিঙ্গার এর সাথে লেফট হ্যান্ডের দুটো ফিঙ্গার রইল | তাহলে টোটাল কটা ফিঙ্গার?
তিতলি চটপট গুনে নিয়ে বলল

– সাতটা!
– তাহলে ফাইভ প্লাস টু কত হল?
– সেভেন!
– এইতো! ভেরি গুড!

তিতলি ওর টিচারের পিঠের উপর শুয়ে পড়ে দুলতে দুলতে বলছে,

– তুমি বলেছিলে একটা করে সাম ঠিক করলে তুমি আমাকে একটা করে হামি দেবে | তাহলে আমার আরও একটা হামি অ্যাড হল!

তিতলির সাথে বসে বসে মেয়েটিও দুলছে,

– তাইতো! আগের চারটে আর এখন একটা | আমি তো মনে হচ্ছে হামি দিতে দিতে টায়ার্ডই হয়ে যাব! টায়ার্ড হয়ে গিয়ে চিৎপাত!

শিবাজীর পা দুটো কে যেন চুম্বক দিয়ে আটকে দিয়েছে মাটির সাথে ,নড়তেই পারছে না ওখান থেকে। তিতলিকে এত খুশি শেষ কবে দেখেছে মনে করতে পারছে না | তিতলি ছিঁচকাঁদুনে বাচ্চা নয়, কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে একটু জেদি ঠিকই, তবে মোটের উপর শান্ত বাচ্চা | কিন্তু এমন অনাবিল আনন্দে মেয়েকে মেতে উঠতে দেখে শিবাজীর বুকের ভেতর কি যেন একটা ভাঙচুর হচ্ছে |

– না না চিৎপাত হওয়ার আগে আমার হামি!

তিতলি প্রায় ঝুলে পড়েছে মেয়েটি গলা ধরে এবং পরের মুহূর্তেই খিল খিল করে হাসতে হাসতে দুজনে মিলে বিছানায় লুটোপুটি | হাসতে হাসতেই তিতলির চোখ পড়ে গেল দরজার দিকে আর সাথে সাথে টপ করে লাফ দিয়ে উঠে বসল ,

– বাবাইয়া!

চমকে উঠল রাজন্যা

এ বাবা ছি ছি! তিতলির বাবা ওকে এভাবে ছাত্রীর সাথে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দেখল! কি ভাবলো! তাড়াতাড়ি করে জামা কাপড় ঠিকঠাক করে উঠে বসতেই সামনের দিকে তাকিয়ে একটা ধাক্কা খেলো | নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না | এ কাকে দেখছে এখানে?

– শিবাজী দা!

শিবাজীকে এই বাড়িতে দেখে রাজন্যা যতটা অবাক হয়েছে, শিবাজীও রাজন্যাকে দেখে তার থেকে কিছু কম অবাক হয়নি | দু’জনেই আক্ষরিক অর্থে চোখ গোল এবং মুখ হাঁ করে একে অপরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল | তিতলি বেচারা কিছুক্ষণ দুজনের দিকেই পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে বুঝল কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে | এক দৌড়ে গিয়ে শিবাজীর হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

– ও বাবাইয়া! কি হলো? তুমি ফেয়ারি সিস্টারকে দেখে এরকম অবাক হয়ে গেলে কেন?

ফেয়ারি সিস্টার!

ঝট করে সম্বিৎ ফিরে এলো শিবাজীর | মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

– ফেয়ারি সিস্টার মানে? সে আবার কি?

ফেয়ারি সিস্টারের ব্যাপারটা একটা সিক্রেট ছিল | সেটা বাবাইয়ার সামনে বলে ফেলে গন্ডগোল হয়ে গেছে | এবারে কি করা যাবে বুঝতে না পেরে কাঁদো কাঁদো মুখে রাজন্যার দিকেই তাকালো তিতলি | রাজন্যা তাড়াতাড়ি সামাল দিল,

– ও কিছু না | ওই একটা গল্প বলেছিলাম, তার রেফারেন্সে বলছে।
– ওহ্…

খানিকক্ষণ ফের দুজনেই চুপচাপ | তারপরে রাজন্যাই বলল,

– আপনি তিতলির পড়াশোনা নিয়ে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন?
– হ্যাঁ তা তো চেয়েছিলাম | কিন্তু তোমাকে দেখে সব গন্ডগোল হয়ে গেল। আচ্ছা, তিতলিকে কিছু একটা টাস্ক দিয়ে আমার স্টাডিতে এসো।

শিবাজী বেরিয়ে গেল | সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাজন্যা তিতলির ড্রয়িং খাতায় একটা ছবি এঁকে ওকে রং করতে বলে নিজেও বেরিয়ে এলো | বেরিয়েই মনে হলো স্টাডিটা কোথায় জিজ্ঞাসা করা হয়নি। পরমুহূর্তেই নিজের মনে কাজ ঝাঁকালো, এই ফ্লোরেই হবে নিশ্চয়ই | এই বাড়ির দোতলায় উঠেই প্রথমে ডান দিকে পড়ে ওই জিমটা | তারপরে তিতলির ঘর বাঁদিকে, তার থেকে এগিয়ে আর কোনদিন যাওয়া হয়নি। আজকে তিতলির ঘরটাকে পেছনে ফেলে আরেকটু এগিয়ে গেল রাজন্যা। জিমের পরে ডানদিকে আরেকটা ঘর, বাইরে থেকে তালা বন্ধ | দেখে একটু অবাক লাগলো, বাড়ির মধ্যে ঘর এভাবে তালা বন্ধ থাকে নাকি! হবে হয়তো! দামি জিনিসপত্র আছে | ওই ঘরের পরেই মুখোমুখি দুটো ঘর | বাঁদিকের ঘরে উঁকি দিয়ে একটা বিছানার কোণ দেখতে পেয়েই সরে এলো রাজন্যা। এটা নিশ্চয়ই বেডরুম | ডান দিকের ঘরের সামনে গিয়ে হালকা গলা খাঁকারি দিতেই ভেতর থেকে পরিচিত গলার আওয়াজ এল,

– চলে এসো…

ঘরে ঢুকেই বিস্ময়ে রাজন্যার মুখটা আরো একবার হাঁ হয়ে গেল | ঘরের দুটো দেওয়াল জুড়ে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত টানা বুক শেল্ফ, আর তাতে থরে থরে বই সাজানো | একদিকে বাংলা, অন্যদিকে ইংরেজি | তৃতীয় দেওয়াল জুড়ে জানালা আর অবশিষ্ট দেয়ালটিতে একটা সুদৃশ্য ডেস্ক এবং চেয়ার সেট করা | টেবিলের উপরে দেয়ালের গায়ে কয়েকটা ক্যাবিনেট | ঘরের মেঝেতে একটা বড় আয়তাকার কার্পেট পাতা, এদিকে ওদিকে ছড়ানো রয়েছে দু তিন খানা রংবেরঙের বীন ব্যাগ আর এক কোণে একটা রকিং চেয়ার | শিবাজী ওই রকিং চেয়ারটাতেই বসে আছে |

– এই ঘরটা খুব ইনফরমাল। তুমি বীন ব্যাগে যদি বসতে না পারো, তাহলে ডেস্কের সামনে থেকে চেয়ারটা ঘুরিয়ে নাও।
– না না আমার অসুবিধা হবে না।

রাজন্যা একটা বীন ব্যাগের উপরেই আরাম করে বসলো,

– হ্যাঁ বলুন…
– বলব তো বটেই | তার আগে বলো ওই রামগরুড়ের ছানাটা কি আমি?

এক হাত লম্বা জিভ বের করে ফেলল রাজন্যা | ভুলেই গিয়েছিল | রামগরুড় কেমন দেখতে হয় তা বোঝানোর জন্য তিতলির খাতায় এঁকে দেখিয়েছিল, আর তারপরে সেই ছবি দেখে শিক্ষিকা আর ছাত্রী অনেকক্ষণ হেসে কুটিপাটিও হয়েছিল | কি করে জানবে সেই রামগরুড়ই আদতে ছাত্রীর বাবা!

– না মানে ইয়ে, আসলে তিতলিকে ওই সুকুমার রায়ের কবিতা একটু বলছিলাম…
– হ্যাঁ কবিতা বলার আগের গল্পটাও আমি শুনেছি..

শিবাজীর দুই চোখে কৌতুক চিকচিক করছে |

মনে মনে নিজেকে দু’চারটে চড় লাথি কষিয়ে দিল রাজন্যা | ছবিটা আঁকা অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু সেটা তিতলির খাতায় ওভাবে রেখে না গেলেই হতো! গেল এবারে হয় এখানে টিউশনটা যাবে, নয়তো অফিসের রেটিংয়ে গোল্লা পড়বে।

রামগরুড়ের ছবিটা দেখেই খুব মজা পেয়েছিল শিবাজী, আর এখন রাজন্যার মুখের চেহারা দেখে পেটের ভিতর থেকে একটা হাসি কুলকুল করে উঠে আসতে চাইছে শিবাজীর | কিন্তু তবুও রাগ রাগ ভাব বজায় রেখে যথাসম্ভব গম্ভীর গলাতে বলল,

– ওই ছবিটা আমি অফিসে গিয়ে সাবর্ণদা, দ্বৈপায়ন আর স্বয়মকে দেখিয়েছি আর সেই নিয়ে সবাই কত হাসাহাসিও করেছি | এবার যদি ওরা জানতে পারে যে ছবির বিষয়বস্তুটি আমি নিজে, তাহলে কি রকম অবস্থা হবে বুঝতে পারছ?

হে ধরিত্রী মা! দ্বিধা হও | সাবর্ণদারাও দেখেছে! ভগবান!

ভয়ানক কাঁচুমাচু হয়ে রাজন্যা বলে উঠল,

– আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি শিবাজীদা!

চেপে রাখা হাসিটা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসার আগে শিবাজী মুখের কাছে হাত মুঠো করে একটু খুক খুক করে শব্দ করে নিল, তারপরে ঠোঁটে একটা আলগা হাসি টেনে বলল,

– যাই বলো, তোমার ছবি আঁকার হাত কিন্তু বেশ! আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু হাসির কথা হলে দিব্যি হাসতে পারি | হাসবো না, হাসবো না করে সেখান থেকে পালাই না! নেহাত অফিসে হাসার মতন সিচুয়েশন খুব একটা আসে না |

ওহ্! তাহলে শিবাজীদা রাগ করেনি? রাজন্যা এখনো ব্যাপারটা ঠিক হজম করে উঠতে পারছে না | চোখ পিটপিট করল কয়েকবার | তারপরে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল,

– আপনি আমাকে টিউশনটা থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন না তো তাহলে?

এবারে শিবাজীর অবাক হওয়ার পালা

– ছাড়িয়ে দেবো কেন?
– না মানে, যে আপনার সম্বন্ধে এরকম কথাবার্তা ভেবে এমন একটা ছবি এঁকেছে, তাকে আপনি মেয়ের টিউটর হিসেবে না রাখতে চাইতেই পারেন!
– টিউটর যার ছবিটা এঁকেছে সে তো মেয়ের বাবা না, টিউটরের বস | এখানে তো কোনো কনফ্লিক্ট নেই!

রাজন্যার চোখ জোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠলো | এই লোকটাকে অফিসে যেমন দেখে, বাড়িতে অন্যরকম দেখছে।

– একটা প্রশ্ন করছি | হঠাৎ টিউশনি করার ভূত মাথায় চাপল কেন?

রাজন্যা সাথে সাথে কোন উত্তর দিল না | ওকে চুপ থাকতে দেখে শিবাজী বলল,

– আচ্ছা ঠিক আছে, ইফ ইটজ টু পার্সোনাল আ কোশ্চেন, উত্তর দিতে হবে না |
– নাহ্, সেইরকম কিছু না | আসলে আমার বাবা বহু বছর শয্যাশায়ী, মা ওখানকার একটা ছোট স্কুলে চাকরি করে এতদিন সংসার চালিয়েছেন | কিন্তু এখন আমি চাকরি পেয়েছি, তাই বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় | তাছাড়া এখানে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি, তার ইএমআইতেও অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে যায়। ভাই ক্লাস নাইনে এবার, ওর টিউশন বই, ইত্যাদির পেছনে খরচ আছে | মাসের শেষে হাত একেবারে খালি হয়ে যাচ্ছিল | তাই অনেক দিন ধরেই একটা টিউশন খুঁজছিলাম | আর এমনিতেও আমি ছোট বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসি |
– সে তো দেখতেই পেলাম!

শিবাজী নিজের মনেই একটু নিচু গলায় কথাগুলো বলল

– কিছু বললেন?
– নাহ্, কিছু না |

শিবাজী একটু অবাক হয়েই রাজন্যার দিকে তাকিয়ে ছিল | আপাত দৃষ্টিতে জেদী, অতিরিক্ত চঞ্চল, বেশি কথা বলা এই মেয়েটি যে আদতে এক দায়িত্ববান সন্তানের ভূমিকা পালন করে তার পরিবারটাকে ধরে রাখার জন্য এমন একটা লড়াই চালিয়ে চলেছে তা কে জানতো?

– তোমাদের বাড়ি কোথায়?
– বোলপুরের ওদিকে…
– নিজেদের বাড়ি?
– হ্যাঁ নিজেদেরই | যৌথ পরিবার, জ্যাঠারা আছেন |
– তাহলে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনলে এত তাড়াতাড়ি?

রাজন্যা একটুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

– ও বাড়িতে আসলে কিছু সমস্যা হচ্ছে। জ্যাঠাদেরও বয়স হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার লোক বদলে গেছে। আর তাছাড়া বাবা তো বহু বছরই বাড়ির জন্য, পরিবারের জন্য কিছু করতে পারেনি | তাই আমাদের অধিকারবোধটাও একটু হলেও কমে এসেছে | হঠাৎ করে যাতে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে না হয় তাই একটা ছাদের ব্যবস্থা করে রাখা।

কেন যেন চোখ সরাতে পারছে না গোলগাল মিষ্টি মুখের মেয়েটার দিক থেকে | খানিক পরে ধ্যান ভেঙে ওঠার মতো শিবাজী বলে উঠলো,

– আচ্ছা কাজের কথায় আসা যাক…

দেখা গেল তিতলির পড়াশোনার ধরণ নিয়ে শিবাজীর বেশ কিছু মতামত আছে | গতানুগতিক পদ্ধতিতে বাংলা, ইংরেজি, অংক না করিয়ে উৎসাহ বাড়ানোর জন্য হাতে কলমে কাজ করে শেখানোর ইচ্ছা |

– যেমন ধরো এ ফর আপেল, বি ফর বল, সি ফর ক্যাট না করিয়ে বলা হলো বাড়ির মধ্যে কতগুলো জিনিস ও দেখতে পাচ্ছে যেগুলো এ দিয়ে শুরু বা বি দিয়ে শুরু | ও হয়তো প্রথমেই সব কিছু জানবে না, কিন্তু শুরুতে হয়তো আপেল, অ্যান্ট বা পিঁপড়ে, এসি, অ্যালার্ম ক্লক এইসব বলবে | বি দিয়ে বেড, বাটার, ব্রেড, ব্যাট, বটল বলবে মে বি | কিন্তু এতে ওর নতুন জিনিসের নাম জানার আগ্রহ বাড়বে, ভোকাবুলারি স্ট্রং হবে |

রাজন্যার বেশ ভালো লাগছে শুনতে | শুধু ভালো লাগছে নয়, এই মুহূর্তে ও ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কোন জিনিসটার কোন অক্ষর দিয়ে নাম শুরু সেটাই ভেবে চলেছে। আরো কিছুক্ষণ অন্যান্য বিষয় যেমন বাংলা, অংক, জেনারেল নলেজ, এই সমস্ত পড়ানোর সময় কি কি ভাবে শিশুটিকে এনগেজড এবং ইন্টারেস্টেড রাখা যায় তাই নিয়ে আলোচনা চলল |

– তুমি ওকে কয়েকটা ক্লাসিক আর রাশিয়ান উপকথার গল্প বলেছ শুনেছি

রাজন্যার ঠোঁটের হাসি চওড়া হল |

– হ্যাঁ, আসলে আমি নিজেও ছোটবেলার গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতাম | প্রচুর গল্পের বই পড়েওছি, তাই বাচ্চাদেরকে গল্প বলতে আমার খুব ভালো লাগে।
– হ্যাঁ, মেয়েটাও গল্পের পোকা | ডিনারের সময় একটা গল্প না শুনলে কিছুতেই খেতে চায় না।

হঠাৎই রাজন্যার মুখ থেকে পরিকল্পনা বিহীনভাবে ফস করে বেরিয়ে পড়ল প্রশ্নটা

– আচ্ছা শিবাজীদা, তিতলির মা কোথায়?

মুহূর্তেই ঘরের মধ্যেকার স্বাভাবিক সপ্রতিভ পরিবেশটা কেটে গিয়ে একটা দমচাপা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। চোখের সামনে কোনো মানুষের দৃষ্টি এভাবে বদলে যেতে প্রথম বার দেখল রাজন্যা। কেমন যেন শীতল, ক্রুর সেই দৃষ্টি |

– তিতলির মা নেই |

কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও নিজেকে আটকাতে পারল না রাজন্যা।

– হ্যাঁ, পিসিমাও প্রথম দিন তাই বলেছিলেন, কিন্তু মা নেই মানে কি? মারা গেছেন নাকি এখানে থাকেন না?

শিবাজী আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল

– এটা এই পরিবারের নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার রাজন্যা | প্লিজ ডু নট ইন্টারফেয়ার | তুমি যে দায়িত্বটুকু নিয়ে এসেছ, সেইটুকুতে কনসেনট্রেট করলে খুশি হব | এই প্রসঙ্গে কোনো কথা ভবিষ্যতে তিতলির সামনে তো নয়ই, এই বাড়িতেও আমি শুনতে চাই না | ইউ মে নাউ কন্টিনিউ ইওর টুডেজ সেশন প্লিজ |

রাজন্যাও বীন ব্যাগ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো | অপমানে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ওর |

একটু আগেই ওর পরিবারের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন ভদ্রলোক। এবং রাজন্যা তার উত্তরও দিয়েছে। আর তার দু মিনিট পরেই এরকম ব্যবহার! রাজন্যা ঠিক করে নিল ভবিষ্যতে এ বাড়িতে এলে শিবাজীর মুখোমুখি যাতে না পড়তে হয় সেই দিকে নজর রাখবে, আর কখনো যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে শিশুটিকে তার মায়ের সঙ্গে মেলানোর একটা সুযোগ আসে, তাহলে রাজন্যা অবশ্যই মেয়েটির মাকে তার সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহায্য করবে |

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে