হৃদ মাঝারে পর্ব-০৮

0
450

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ৮)

সিগারেটটা ধরিয়ে সামনের দিকে হাঁটা লাগালো শিবাজী | এই প্রসঙ্গটা ওর কাছে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা তো পিপিয়া জানে! তারপরেও কেন? কেন? শিবাজী তো এরকম ছিল না! রুক্ষ, রগচটা, কথায় কথায় রেগে যাওয়া, সন্দেহ বাতিক | শিবাজী সেন ছিল হাসিখুশি একটা ছেলে যে খুব সহজে সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারত, হই হই করে মাতিয়ে রাখতে পারতো সকলকে, বিপদে আপদে বন্ধুদের পাশে গিয়ে দাঁড়াত সবার আগে, আর হ্যাঁ, চোখ বুঝে বিশ্বাস করে ফেলত সকলকে |

সেই বিশ্বাসের মাশুলই দিতে হচ্ছে!

বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই ক্যাম্পাস থেকে চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল | প্রথমটায় শিবাজীও তাই করেছিল | কিন্তু তিন চার মাস চাকরি করার পরে মনে হল একটু প্রথাগত কম্পিউটার শিক্ষাটা না থাকলে অসুবিধা হচ্ছে। তাই চাকরি ছেড়ে এমসিএ আর তার সাথে একটা নামী ইন্সটিটিউটে দু বছরের প্রোগ্রামিং এর কোর্সে জয়েন করল | শিবনাথের খুব ইচ্ছা ছিল দুই ভাই একসাথে ব্যবসা দেখুক। কিন্তু শিবাজী বরাবরের মতোই তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল,

– দাভাইয়ের যদি কখনো মাঝে মধ্যে প্রয়োজন হয় আমি ওর সাথে থাকব। কিন্তু পুরোপুরি ভাবে ব্যবসায় আমি মন দিতে পারব না, আমার মাথায় ঢুকবেই না!

বড় ছেলে সৌভিক ওরফে টুবাই ভাইকেই সমর্থন করেছিল

– থাক না বাবা! ও ওর পছন্দের ক্যারিয়ার নিক |যখন দেখব সামলাতে পারছি না তখন ওকে ডেকে নেব না হয়। আপাতত এভাবেই চলুক। আর তুমিও তো একেবারে বুড়ো হয়ে যাও নি, তুমি তো আছ মাথার উপর!

অফিসে মাঝেমধ্যে পা রাখতে হতো বইকি শিবাজীকে | টুকিটাকি আছিলায় ভাইকে ডেকে পাঠাত সৌভিক ‌| হই-হুল্লোড় করা আমুদে ছেলেটা পাশে থাকলে কাজের উৎসাহ বেড়ে যায় | আর তাছাড়া ভবিষ্যতে যেন কখনো ছোট ভাইয়ের এ মনে না হয় যে কায়দা করে তাকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে – সেটাও মাথায় ছিল সৌভিকের |

সেদিন স্বস্তিকের নতুন ক্লোদিং লাইন ‘মেহেন্দি’ র জন্য মডেল সিলেকশন করার কথা | ‘মেহেন্দি’ খানিকটা ব্রাইডাল কালেকশন | আজকাল নতুন বউকে সব সময় শাড়ি পরতে হবে গোছের চিন্তা ভাবনা থেকে উচ্চবিত্তরা তো বটেই, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবাররাও বেরিয়ে এসেছে। তাই স্বস্তিকের এই লাইনটার টার্গেট নববধূরা, যাদের বিয়ের পরবর্তী বেশ কয়েক মাস বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে সেজেগুজে হাজিরা দিতে হয়। পার্টিতে পরার উপযোগী এথনিক গাউন, জমকালো আনারকলি চুড়িদার আর বিভিন্ন ধরনের লেহেঙ্গা নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘মেহেন্দি’ |

সৌভিকের ইচ্ছা ‘মেহেন্দি’ র লঞ্চের জন্য একজন নতুন মডেলকে নিয়ে আসা | প্রথম যে ফ্যাশন শো টা হবে তাতে অন্যান্য পুরনো মডেলদের ব্যবহার করলেও শো-স্টপার হিসেবে নতুন মডেল চাই তার | ইচ্ছে করেই এমন একটা দিনে সিলেকশন রেখেছে যেদিন শিবাজীর কোন ক্লাস থাকে না | কাজেই ইন্টারভিউ প্যানেলে উপস্থিত থাকতে না পারার কোন অজুহাতই শিবাজীর কাছে ছিল না |

প্রাথমিক নির্বাচন হয়ে গেছে, আজ ফাইনাল সিলেকশনের পালা | ইন্টারভিউ প্যানেলে মোট পাঁচ জন | শিবনাথ সেন নিজে, তাঁর দুই পাশে সৌভিক এবং শিবাজী | এছাড়াও আছেন স্বস্তিকের অন্যতম দুই বোর্ড মেম্বার ও শিবনাথের পুরনো বন্ধু মহেন্দ্র আগরওয়াল এবং সুমন্ত মজুমদার | ফাইনাল রাউন্ডের জন্য নয় জনকে নির্বাচন করা হয়েছে | এদের থেকেই একজনকে বেছে নেওয়া হবে ‘মেহেন্দি’র জন্য। ক্যান্ডিডেটদের ওয়েটিং রুমের পাশ দিয়ে আসার সময় শিবাজী এক ঝলক তাকিয়েছিল | উজ্জ্বল, ঝকঝকে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত টিপটপ কয়েককজন তরুণী বসে রয়েছে | দূর থেকে দেখে প্রত্যেককেই ছায়াছবির পর্দা থেকে উঠে আসা সুপার মডেলের মতন লেগেছে | নিজের চেয়ারে বসার আগে দাদার কানের কাছে মাথায় এনে ফিসফিস করে বলল,

– একজনকেই নিতে হবে?

সৌভিক হেসে ফেলল,

– কেন? তোর কি একাধিক জনকে নেওয়ার ইচ্ছা?
– না মানে, দূর থেকে দেখে তো সবাইকেই ডানা কাটা পরীর মতন লাগলো | কাকে ছেড়ে কাকে নেব গোছের অবস্থা!
– স্বস্তিকে একজনকেই লাগবে ভাই | তুই দেখ নিজের জন্য যদি কাউকে পছন্দ হয় !

ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল সৌভিক | শিবাজী তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,

– ওরে বাপরে! এত সুন্দর পাবলিককে পাশে নিয়ে ঘোরা খুব রিস্কের ব্যাপার। সানস্ক্রিন লোশনের মতন মেনস্ক্রিন লোশন লাগিয়ে বের করতে হবে!

সৌভিক সশব্দে হেসে উঠতেই শিবনাথ তাকালেন,

– কি গুজগুজ ফুসফুস করছ তখন থেকে? সবাই তো এসে গেছে। ক্যান্ডিডেট ডাকা শুরু করো |

শিবাজী আর কথা না বাড়িয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলো | সৌভিক ফোনে ওর অ্যাসিস্ট্যান্টকে কিছু নির্দেশ দিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– পাঠাতে বললাম। মোট নয় জন আছে | আমি ধরে রেখেছি অন অ্যান এভারেজ দশ থেকে পনের মিনিট করে সময় লাগবে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পুরো ইন্টারভিউটা শেষ হয়ে যাওয়া উচিত…

সৌভিকের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই প্রথম ক্যান্ডিডেট ঢুকল | একের পর এক ইন্টারভিউ চলতে থাকল | শিবাজী প্রথমবার এই ধরনের ইন্টারভিউ প্যানেলে উপস্থিত হয়েছে | ওর নিজস্ব খুব একটা প্রশ্ন কিছু করার ছিল না | ও মূলত ক্যান্ডিডেটদের কথা বলার ধরন আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডি করার চেষ্টা করছিল | প্রত্যেক ক্যান্ডিডেট বেরিয়ে যাওয়ার পরে নিজেদের মধ্যে একটু করে আলোচনা সেরে নিচ্ছিলেন শিবনাথ, মহেন্দ্র, সুমন্ত আর সৌভিক। সাত জনের ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়ার পরে সৌভিক একবার শিবাজী কে জিজ্ঞাসা করল,

– কিরে! তুই কোন মতামত দিবি না?

শিবাজী দুই হাত কাঁধের কাছে তুলল।

– আমার সবাইকে ভালো লাগছে। আমি মতামত দিতে গেলে তোমার আরো অনেকগুলো পজিশন তৈরি করতে হবে।

শিবনাথ বিরক্ত চোখে তাকালেন ছোট ছেলের দিকে | সবকিছুতে এই ছেলের এই ফাজলামি তাঁর পছন্দ নয় | বড় ছেলের দিকে ফিরলেন,

– তোমার এখনো পর্যন্ত কাকে সবথেকে পছন্দ হয়েছে? মেহেন্দি উইল বি কমপ্লিটলি ইওর ডিপার্টমেন্ট | তোমাকে পুরোপুরি কনভিন্সড হতে হবে |

হাতের নোটপ্যাডের দিকে একবার তাকিয়ে সৌভিক উত্তর দিল।

– এখনো পর্যন্ত কৃতিকা সান্যাল আর তনিমা পান্ডে কে পছন্দ হয়েছে | বাকি দুজনকে দেখে নিই?

শেষ মেয়েটি ঘরে ঢোকার পরে শিবাজীর ভুরু জোড়া নিজে থেকেই কুঁচকে গেল | মেয়েটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। সুন্দরী, কিন্তু অতিরিক্ত উগ্র সাজ পোশাকের জন্য স্বাভাবিক সৌন্দর্যটুকু চাপা পড়ে গেছে। সরু সুতোর মতন ফিতে দেওয়া একটা টপ আর হাঁটুর ওপর পর্যন্ত স্কার্ট পরে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে মেয়েটি। হয়তো ইচ্ছা করেই এমন খোলামেলা পোশাক পরে বোঝাতে চেয়েছে যে উন্মুক্ত ত্বকের পরিমাণ নিয়ে তার কোন ছুঁৎমার্গ নেই | বাকিদের চাইতে এর ইন্টারভিউ এর সময় লাগলো একটু বেশি | মেয়েটি বেরিয়ে যাবার পরে আলোচনাও হলো একটু বেশিক্ষণ | মনোজ এবং সুমন্তর একে পছন্দ হয়েছে, শিবনাথের বিশেষ পছন্দ হয়নি এবং সৌভিক খানিকটা দোলাচলে | শিবনাথের কপালে বেশ গভীর দুটো ভাঁজ | বিরক্তি গোপন না করেই তিনি বললেন,

– কি ধরনের পোশাক পরে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে দেখলে!

মনোজ হাসলেন
– তুমি কৌনসা বোরখা পরিয়ে স্টেজে হাঁটাবে? ভালোই তো! কোনো ইনহিবিশন নেই |

শিবনাথ তবু বললেন
– মডেলদের সম্পূর্ণ দুটো আলাদা ধরনের লাইফ লীড করতে হয়। স্টেজের লাইফ আলাদা, নরমাল লাইফ আলাদা

এবারে সুমন্ত মুখ খুললেন,

– সিলেক্ট হলে তোমার এমপ্লয়ি হবে, থোড়াই তোমার বাড়িতে থাকবে! স্টেজে ছাড়া অন্য কোথাও কিভাবে থাকে তাতে তোমার আমার কি?

আরো খানিকক্ষণ আলোচনার পরেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পেরে সৌভিক শিবাজী কে চেপে ধরল,

– এই ভাই! তোর কি মনে হয়?

চোখ বড় বড় করল শিবাজী

– শেষে আমার ভোটে ডিসিশন হবে! পাগলা কুকুরে কামড়েছে আমাকে? তবে মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছিল | বোধহয় এত মেকআপ করেছে বলে চিনতে পারলাম না।
– চিনিস? কি করে?
– তা জানি না, আই মিন ওটাই তো মনে করতে পারছি না | কিন্তু মনে হচ্ছে চিনি…

অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে কোন দিকে চলে এসেছে খেয়াল ছিল না | সামনের সাদা বাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো | তাড়াতাড়ি ঘুরে বাড়ির দিকে পা চালানোর আগেই একটা রিনরিনে কণ্ঠস্বর শুনতে পেল,

– বুবাইদা! কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে তাকাতে হলো | জানালার গ্রিলের ওপারে একজোড়া উজ্জ্বল চোখ আর একমুখ হাসি | বাইরে থেকে বুক অবধি দেখা যায়, কিন্তু ঘরের ভিতরে গেলে কি দেখতে পাবে তাও শিবাজীর জানা | নিজের অজান্তেই একটা ব্যথার ছায়া নেমে এলো ওর মুখে | নরম করে বলল,

– কেমন আছিস দিঠি?
– ভালো আছি | তুমি কেমন আছো? তিতলি, সুমি পিসি?
– সবাই ভাল রে | কাকু কাকিমা ভালো আছেন?

সমাদৃতা ঘাড় হেলালো,

– হ্যাঁ ভালোই আছে |
– আচ্ছা | আসি রে, আসলে সিগারেটটা ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে এসেছিলাম | পিপিয়া বসে আছে…
– ভুল করে এদিকে চলে এসেছিলে, তাই না বুবাই দা।? তুমি কনশাসলি এদিকে রাস্তাটা অ্যাভয়েড করো আমি জানি |

শিবাজী একটু অস্বস্তি মাখা মুখে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল তার অর্থ হ্যাঁও হতে পারে, না-ও হতে পারে | তারপরে জোর করে একটু হাসি টেনে এনে বলল,

– চললাম রে! ভালো থাকিস |

আর না দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল শিবাজী। জানলার গায়ে গাল ঠেকিয়ে শিবাজীর অপসৃয়মান চেহারাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সমাদৃতা। তারপরে নিজের মনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল | আট বছর সময়টা কম নয়, তবুও সবকিছু যেন ছবির মতন পরিষ্কার মনে পড়ে যায় তার |

তিতলিদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে ইস্তক রাজন্যা একটু অন্যমনস্ক | আসলে মাত্র কয়েক দিনেই বাচ্চা মেয়েটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে ওর ওপরে | এতদিন জানতো ওর মা নেই। কোথাও একটা নিজের সাথে মিল খুঁজে নিয়ে সমব্যথী মনে হতো | কিন্তু আজ জানতে পারলো মেয়েটির মা আছেন, অথচ তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রে হয়তো এতটাই ব্যস্ত যে ছোট্ট শিশুটির সঙ্গে একসাথে থাকার তাঁর সময় হয় না | এই ব্যাপারটাই ভাবিয়ে তুলছে রাজন্যাকে । এত ব্যস্ত কি মানুষ হতে পারে যে সে তার আত্মজাকে না দেখে, না ছুঁয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতে পারে | অবশ্য তিতলির মায়ের অনুপস্থিতির সময়কাল দিনের পর দিন, নাকি মাসের পর মাস, তা কেউ বলেনি | এটুকু ওর অনুমান | কারণ কারোর অল্প কিছুদিনের অনুপস্থিতিতে তাকে ‘নেই’ করে দিতে পারেনা বাড়ির লোকজন | পিসিমা প্রথম দিনেই বলেছিলেন তিতলির মা ‘নেই’ | আর তার ওপরে তিতলির পেটের ওই আঘাতের চিহ্নটা! একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার মনে নেই সে আঘাত কবে পেয়েছিল | তাহলে সে ঘটনা নিশ্চয়ই তার একেবারে শিশুকালের | আবার পিসিমার কথা শুনে মনে হলো প্রসঙ্গটা তিনি এড়িয়ে যেতে চাইছেন | অর্থাৎ অতীতের কোন অপ্রিয় ঘটনা জড়িয়ে আছে এর সাথে | আর এসব কিছুর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কে তিতলি নামের ওই ফুটফুটে বাচ্চাটা। যে কদিন পড়াতে গেল একদিনও তিতলির বাবাকে দেখতে পায়নি। তার মানে ধরে নেওয়াই যায় সেই ভদ্রলোক তার অফিস নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত | আবার শনি রবিবার সকালবেলাও তিনি বাড়ি থাকেন না | তাহলে তিতলি তার বাবার কম্পানিটা পায় কখন?

রাজন্যাকে গালে হাত দিয়ে বসে কিছু ভাবতে দেখে মালবিকা এগিয়ে এসে ওর কাঁধে টোকা মারলো।

– কিরে? ফিরে থেকে কি নিয়ে চিন্তা করছিস? অফিসে কিছু হল নাকি আবার?

রাজন্যা মুচকি হাসলো,

– এই! আমি কি এতই ঝামেলাবাজ নাকি রে? অফিসে সব সময় ঝামেলা হবে!
– কি জানি বাবা, তোর ওই বদরাগী বসের সাথে কি যে লাভ লেট সম্পর্ক বানিয়ে রেখেছিস!
– লাভ হেট? লাভ কোথায় দেখলি? পুরোটাই হেট।

মালবিকা সজোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল,

– হুঁ হুঁ বাবা! আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। গোটাটা হেট হলে, না খেয়ে কেঁদে কেটে সারারাত খালি পেটে থাকার পাবলিক তুমি নও।
– মার খাবি তুই মালবিকা!
– সে আমি মার খেয়ে নেব। তুই তার আগে একটা চুমু খা দেখি!

বলেই সোফা থেকে একটা কুশন তুলে নিয়ে চার পা পিছিয়ে গেল মালবিকা | রাজন্যা উঠে দাঁড়িয়েছে,

– চুমু খাব! কাকে?
– কাকে আবার? তোর ওই রাগী বসকে!
– কেন রে? তুই কি অফিসে তোর বসকে চুমু খেয়ে বেড়াস নাকি? শয়তান মেয়ে কোথাকার!

আরেকটা কুশন তুলে নিয়ে মালবিকার দিকে ছুঁড়ে মারল রাজন্যা। মালবিকা চট করে সরে যেতেই কুশন টা গিয়ে টেবিলের উপরে রাখা একটা জলের বোতলের গায়ে দিয়ে ধাক্কা খেলো এবং জলের বোতলটা দরাম করে মাটিতে পড়ে গেল।

– দ্যাখ কি করলি?

রাজন্যা চেঁচিয়ে উঠতেই মালবিকা কাঁধ ঝাঁকাল,

– আমি কোথায় করলাম? তুইই তো কুশন ছুঁড়ে মেরে বোতল ফেললি!
– কাঁচের বোতল হলে এক্ষুনি ভাঙতো!
– আর তুই কোমর বেঁধে পরিষ্কার করতিস!
– উফফ্!

মালবিকা ঝপ করে এগিয়ে এসে রাজন্যাকে জড়িয়ে ধরল |

– মুড ঠিক হয়েছে? এবারে বল কি হয়েছিল?

মালবিকাকে শুদ্ধুই সোফার দিকে দুই পা এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ল রাজন্যা।

– মনটা একটু খারাপ হচ্ছে জানিস…

সেন ভিলাতে ঘটা ঘটনাগুলো মালবিকাকে খুলে বলল।

– আমি না টুক করে মহিলার একটা ছবিও তুলেছি | ভালো করে তুলতে পারিনি, কারণ আমি চাইছিলাম না তিতলি বুঝুক আমি ছবি তুলছি। আসলে কেন যেন মনে হচ্ছিল মুখটা কোথাও দেখেছি
– কই দেখা!

ফোনের গ্যালারি খুলে ছবিটা বের করে মালবিকার দিকে এগিয়ে দিল। মালবিকা দুই আঙ্গুল ফোনের স্ক্রিনের উপরে টেনে জুম করে দেখেই উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলো,

– আরে এ তো স্যামি!
– স্যামি?
– সমর্পিতা মল্লিক, এই মুহূর্তে কলকাতার সব থেকে হট মডেল কাম নায়িকা | তুই আসলে টিভি দেখিস না তো একেবারেই, তাই শুধু চেনা চেনা লেগেছে | তা না হলে এই মহিলাকে দেখে না চেনার কথা নয়।
– ও মাই গড! ব্যস্ত অভিনেত্রী, সেই জন্য সে মেয়ের সাথে থাকে না? এরা বিয়েই বা করে কেন আর বাচ্চার জন্মই বা দেয় কেন? স্ট্রেঞ্জ!

মালবিকা দুই হাত তুলে থামায় রাজন্যাকে

– এই হ্যালো! ওয়েট ওয়েট | ডোন্ট বি সো জাজমেন্টাল! কত সময়ে তো কত পরিবারে দেখি বাবারা তাদের চাকরির জন্য পরিবার রেখে শহরের বাইরে, এমনকি দেশের বাইরেও থাকে | কই তখন তো কেউ সেভাবে আঙ্গুল তোলে না! যেহেতু মহিলা, তাই জন্য তার অ্যাম্বিশন থাকতে নেই? তার ক্যারিয়ার ইম্পরট্যান্ট নয়? মা হয়েছে বলে তাকে সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে হবে? তুই একথা বলছিস রাজ? আজকের দিনের মেয়ে হয়ে!

রাজন্যা একটু থমকে গেল | সত্যিই তো এভাবে ভেবে দেখেনি | বোলপুরে ওদের পাশের বাড়ির অভয়দা তো গুজরাটে থাকে। পরিবার নিয়ে ওখানে ভাড়া থাকতে গেলে সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যাবে। তাই সোনালী বৌদি দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকে | অভয়দা ছুটিছাটায় আসে। তাছাড়া আগের টীমে দিল্লির ছেলে অবিনাশকে তো দেখলো পাঁচ বছরের জন্য বস্টন গেল অনসাইটে | ওরও তো বউ আর একটা ছোট্ট মেয়ে আছে | কিছু না জেনেই তিতলির মাকে এভাবে ভিলেন ভেবে নেওয়াটা ঠিক হয়নি। একটু লজ্জা পেয়েই বলল,

– সরি রে, সত্যিই এভাবে ভেবে দেখিনি | আসলে বাচ্চাটা এত সুইট আর ও ওর মাকে যে খুব মিস করে সেটা এত প্রমিনেন্টলি বোঝা যায় যে আমি নিজের মনে মনেই একটা ধারণা করে নিয়েছিলাম |
– সে আমি বুঝেছি | তবে আমি এও বলছি না যে ওর মা আদতেই ভিক্টিম অফ দ্যা সিচুয়েশন। তার কারণ আমি রিয়েলিটি জানি না, বাট তুইও জানিস না | তাই আগে থেকে একটা কিছু ধারনা করে নিতে বারণ করছি। তবে এই সমর্পিতা মল্লিককে নিয়ে একসময় খুব হট নিউজ হয়েছিল।

রাজন্যা ভ্রু কুঁচকালো

– এক্ষুনি তো বললি মহিলা হটেস্ট মডেল। তাকে নিয়ে সব নিউজই তো হটই হবার কথা । স্পেশাল কি?

মালবিকা একটু ভাবার চেষ্টা করে দুদিকে মাথা নাড়ালো
– নাহ্, ঠিকটাক মনে পড়ছে না | তবে যতদূর খেয়াল করতে পারছি, কিছু একটা পারিবারিক স্ক্যান্ডাল | মানে যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার দাদা বা ভাইয়ের সাথে জড়িয়ে সামথিং হ্যাপেনড | তবে এটা কিন্তু প্রায় সাত আট বছর আগেকার কথা বলছি। আমার মাধ্যমিক দেওয়ার আগে আগে | আমাদের ওখানকার একজন দাদা কোনও একটা স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতো। ও-ই গিয়ে গল্প করেছিল, তারপরে মনে হয় কাগজে টাগজেও বেরিয়েছিল। জানিনা ইন্টারনেটে সার্চ করলে পাওয়া যাবে কিনা, তবে কিছু তো একটা ছিল।

রাজন্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

– ছাড়, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই | তবে যাই হোক, সাফার করছে বাচ্চাটাই | ওর বাবাকেও তো বেশ ব্যস্ত মনে হয়। বাড়িতে শুধুমাত্র পিসিমাই আছেন ওকে দেখে রাখার জন্য | আমাকে তো ছাড়তেই চায় না! মনে হয় সঙ্গী খোঁজে |
– সে তো হবেই | ওই সাইজের বাচ্চারা তো একটু অ্যাটেনশন চায় | যাই হোক, কি আর করা যাবে? এমনিও আর কটা বছর হয়ে গেলে ওরও একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়ে যাবে | তখন আর মাকে অত মিস করবে না |

রাজন্যা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। মাকে মিস করবে না! রাজন্যা যে আজও ওর মাকে মিস করে | আজও যে মনে হয় মায়ের কোলে মাথা গুঁজে সারাদিনের গল্প করতে পারলে কি ভালো হতো | সারাদিনের ছোট ছোট মন খারাপ গুলো, তুচ্ছ ভালোলাগাগুলো যদি মায়ের গলা জড়িয়ে গল্প করে বলতে পারতো, তাহলে কি মজাই না হত | মা যদি ছুটির দিনে চুলে তেল লাগিয়ে দিত কিম্বা একদিন আহ্লাদ করে মাছটা বেছে খাইয়ে দিত অথবা জ্বর হলে কপালে হাত বুলিয়ে দিত। রাজন্যা ওর মাকে সারা জীবনই মিস করবে | আরাধনার প্রতি ওর সেভাবে কোন ক্ষোভ নেই। সম্মানই করে। আরাধনাও যে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন তা বোঝে। কিন্তু দায়িত্ববোধ আর স্নেহ যেমন দুটো আলাদা জিনিস, মেনে নেওয়া আর ভালোবাসাও তেমনি সম্পূর্ণ দুটো আলাদা জিনিস। আরাধনা কে রাজন্যা মেনে নিয়েছে, ভালোবাসেনি | মা বানিয়ে উঠতে পারেনি। মায়ের কাছে নিজের খামতি গুলো নিজের অপারগতাগুলো নিঃসংকচে তুলে ধরা যায় | ‘মায়ের মত’ র কাছে যায় না |

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে