হৃদ মাঝারে পর্ব-০৪

0
496

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ৪)

নতুন টিমে কাজ করতে বেশ ভালো লাগছে রাজন্যার | প্রথম দিনের সেই খারাপ অভিজ্ঞতার পরে ও ভেবেই নিয়েছিল নিজের যোগ্যতাটুকু প্রমাণ করা হয়ে গেলেই ও এই টিম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আবেদন জানাবে। কিন্তু এখানে কাজ করতে গিয়ে পরিবেশটাকে বেশ ভালবেসে ফেলেছে | আর কোন এক অদ্ভুত কারণে সেই ভালো লাগার পিছনে অন্যতম আকর্ষণ চির খিটখিটে শিবাজী সেন | নাহ্, শিবাজী এই কদিনে হঠাৎ করে খুব কোমল স্বভাবের হয়ে ওঠেনি বা কথায় কথায় রাজন্যার প্রশংসাও করা শুরু করে নি | বরং মাঝে একদিন দেরী হবার জন্য সকলের সামনেই রীতিমতো অপমানজনক কথাবার্তা শুনতে হয়েছে রাজনাকে | কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই বকুনি শোনার পরেও রাজন্যার সামনের লোকটার উপরে একটুও রাগ হয়নি | বরং মনে হয়েছে দোষটা ওর নিজেরই ছিল |

এখনো পর্যন্ত রাজন্যা ওদের আগের টিমের করা প্রজেক্টটার উপরেই কাজ করছে | ওই প্রজেক্টের সম্বন্ধে এই টিমের দু তিন জনকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে এবং কিছু কিছু যা নতুন ফাংশনালিটি যোগ হয়েছে সেগুলোর উপরে ও নিজে কাজ করেছে। কিন্তু ওর মনটা ছটফট করছিল কোন একটা নতুন প্রজেক্টে শুরু থেকে কাজ করার জন্য | এমন কিছুতে যেখানে সরাসরি শিবাজীর সঙ্গে বসে কাজ করতে পারবে। সেদিন খানিক কিন্তু কিন্তু করেও লাঞ্চের পরে সৌম্যকে বলেই ফেলল,

– সৌম্যদা, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল…

সৌম্য সাধারণত লাঞ্চের পরেই মিনিট দশেকের জন্য নিচে যায় সিগারেট টানতে। রাজন্যার কথা শুনে পেছন ফিরে বলল

– হ্যাঁ বল্…

এই কদিনেই এই বাচ্চা মেয়েটাকে ভারী পছন্দ হয়েছে সৌম্যর | তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে খুব সহজেই | রাজন্যা সামান্য ইতস্তত করে বলল,

– সৌম্যদা অনেকদিন তো হলো এই সেম প্রজেক্টে কাজ করছি | আমাকে কোন একটা নতুন কাজ দেওয়া যায় না?
সৌম্য হেসে ফেলল |

– তোর রিকোয়েস্টের জবাব পরে দিচ্ছি | কিন্তু তার আগে বল দেখি, অনেকদিন কোথা থেকে হল? তুই আমাদের টিমে জয়েন করেছিস সে তো সবেমাত্র দশ দিন হয়েছে!
– হ্যাঁ আর সেই দশ দিন ধরেই তো পুরনো কাজই করে চলেছি…

রাজন্যার ঠোঁট উল্টানো দেখে সৌম্যর হাসি আরো চওড়া হলো
– কেন রে? এই যে কয়েকটা চেঞ্জ করলি তোর অ্যাপ্লিকেশনে?
– সেই আমার চেনা কাজই তো! তোমরা যে নতুন প্রজেক্টগুলো শুরু করছো তার কোনোটাতে আমাকে নেওয়া যায় না?

সৌম্য সামান্য ভাবলো | সত্যিই গোটা দুই নতুন প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে | রাজন্যা জুনিয়র হলেও এই কদিনেই বেশ বোঝা গেছে মেয়েটি চার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা যুক্ত ডেভেলপার দের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দিতে পারে | ওকে নতুন একটা প্রজেক্টে ঢোকালে ভালোই হয় | তবে শিবাজীদার সাথে কথা বলতে হবে |

– আচ্ছা দাঁড়া শিবাজী দার সাথে কথা বলি | রিসোর্স কে কোন প্রজেক্টে কাজ করবে সেটা শিবাজীদাই সিলেক্ট করে…

রাজন্যার পেটের ভিতর দিয়ে ফরফর করে এক ঝাঁক প্রজাপতি উড়ে গেল | আড় চোখে দেখেছে নতুন প্রজেক্ট এর আলোচনার সময় শিবাজী ডেভেলপারদের মিটিং রুমে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা স্কোপ অফ ওয়ার্ক, কিভাবে কাজ হবে, কে কি কাজ করবে, কার দায়িত্ব কতটা হবে সেই সমস্ত বিশদে বোঝায় | কেন যেন ওই রাগী গম্ভীর লোকটার কথাবার্তায় একটা অদ্ভুত চুম্বকীয় আকর্ষণ অনুভব করে রাজন্যা |

– প্লিজ বলো সৌম্যদা! আর এই অ্যাপ্লিকেশন টার সাপোর্ট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না | যখন যা দরকার লাগবে আমি ঠিক সময় বের করে সাপোর্ট করে দেব |

বেশ উৎফুল্ল মনেই বাড়ি ফিরল রাজন্যা | শিবাজীর সঙ্গে কি কথা হয়েছে এখনো সৌম্য জানায়নি বটে, তবে রাজন্যা মোটামুটি নিশ্চিত যে শিবাজীর সাথে সরাসরি কাজ করার সুযোগ ও পাবেই। বাড়ি ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে চায়ের জল বসাতে বসাতেই ফোনটা বেজে উঠল। নির্ঘাত মালবিকা! ফেরে নি এখনও মানেই বয় ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরছে | রাতে ডিনার করেই ফিরবে হয়তো | কিন্তু ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখটা শুকিয়ে গেল। মায়ের ফোন | গত দুদিন বাড়িতে ফোন করা হয়নি। তাড়াতাড়ি ফোনটা তুলল,

– হ্যাঁ মা!

ওদিক থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠ ভেসে এলো,
– মা-বাবাকে আদৌ মনে আছে কলকাতা শহরে গিয়ে?
ফোনের এপারেই মাথা নিচু করে ফেলল রাজন্যা। কিছু জবাব দিয়ে ওঠার আগেই আবারও তীব্র বাক্য বাণ ছুটে এল বেতার তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে,

– নবাব নন্দিনীর আজকাল বাড়িতে ফোন করার সময় হয় না কেন জানতে পারি?
– মা একটু ব্যস্ত ছিলাম, ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল লাস্ট দুদিন।
– সেই! অজুহাত বানাতে তুমি ছোট থেকেই ওস্তাদ | পৃথিবীর সব ব্যস্ততা তোমার ঘাড়েই আছে কিনা, তাই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাঁচ মিনিট বাড়িতে ফোন করার সময় হয়না তোমার |

চুপচাপ শুনে নিল রাজন্যা, বয়স্ক বাবা-মা বাড়িতে রয়েছেন। ফোন করে খোঁজ নেওয়াটা ওরই কর্তব্য। মায়ের প্রিপেইড ফোনে প্রতি মাসে পয়সা ও ভরে দেয় ঠিকই, কিন্তু তাতে তো আর ওর করণীয় কাজটা বাদ হয়ে যায় না!

– শোনো, যেটা বলার জন্য ফোন করছিলাম। তপুর এবার একটা ইংলিশ টিউটর না দিলেই নয়। ওর বন্ধুবান্ধবরা সব ভূপেন মোড়ে অনিরুদ্ধ স্যারের কাছে পড়ছে, গত বছর থেকে যারা পড়ছে তাদের তো রেজাল্ট খুবই ভালো হয়েছে। সামনের মাস থেকে তপুকেও ওনার কাছে দেবো।
– কিন্তু সন্তুদা যে তপু কে ইংরেজিটা দেখিয়ে দিচ্ছিল?
– শোনো রাজি, তোমার ওই ফ্রী এর সন্তুদা অমনি ফ্রি এর উপযোগীই পড়ায় | অ্যাদ্দিন তো পড়ালো, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না | অনিরুদ্ধ স্যারের কাছে হাতেনাতে ফল পাচ্ছে সবাই।
– আচ্ছা, ঠিক আছে…

রাজন্যা জানে তপুর ব্যাপারে ওর মতামতের কোন মূল্য নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে চুপ করে যায়। আচ্ছা, কোন বিষয়েই কি ওর মতামতের মূল্য আছে? হঠাৎ করেই ভাবনাটা মাথার মধ্যে চিড়িক করে ওঠে । বাড়ির সব বিষয়ে সকলে মিলে আলোচনা করা হয় ঠিকই। কিন্তু সিদ্ধান্ত?

তবে এই মুহূর্তে তপুর টিউশনের বিষয়টা ওকে জানানো হচ্ছে তার পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে | আচমকাই বুঝে ফেলল রাজন্যা । নামকরা টিউশন স্যার হলে তার টিউশন ফিও থাকবে নিশ্চয়ই |

– অনিরুদ্ধ স্যারের টিউশন ফি কত মা?
– আজকাল সব ভালো টিচাররা ক্লাস অনুযায়ী টাকা নেন। ওনার পার ক্লাস পাঁচশ টাকা | সপ্তাহে দুদিন ক্লাস।

রাজন্যা চমকে উঠলো | তার মানে মাসে অন্তত চার হাজার টাকা ! কোন কোন মাসে তার থেকেও বেশি হবে |
– এটা তো খুব বেশি মা!
– সেই! তোমার এখন ডানা গজিয়ে গেছে, ভাইয়ের জন্য যে কোন খরচ তো এখন বেশিই মনে হবে! ঠিক আছে, আমিই দেখছি…
রাজন্যা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,

– না মা, আমি দেখছি, তবে তুমি খোঁজ নিয়েছো তো? ওই স্যার সত্যিই ভালো?
– খোঁজ না নিয়ে তোমাকে আমি বলতে আসিনি রাজি…
টেলিফোনের ওপারে আরাধনা সান্যালের কণ্ঠস্বর স্থির এবং কঠিন |
-আচ্ছা ঠিক আছে | বাবা কেমন আছে মা?
-ঠিকই আছে | ওষুধগুলো অর্ডার করে দিও সময় মত | রাখছি |

আরাধনা সান্যাল রাজন্যার নিজের মা নন | ওর তিন বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন ওর গর্ভধারিনী প্রতিমা। অমরনাথ অর্থাৎ রাজন্যার বাবা সে সময় কাজ করতেন একটি বেসরকারি অফিসে | অর্থনৈতিক দিক থেকে ওদের অবস্থা খুব স্বচ্ছল না হলেও নড়বড়েও ছিল না। যৌথ পরিবার, তিন ভাই মিলেমিশেই থাকতেন মোটামুটি। প্রতিমার মৃত্যুর পরে বছর দুয়েক রাজন্যার জেঠিমারাই ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন। মা মরা মেয়েটার প্রতি সকলেরই একটু আলাদা মমতাবোধ ছিল |

আরাধনার সঙ্গে অমরনাথের আলাপ অমরনাথের অফিসের এক সহকর্মীর বিয়েতে | আরাধনা উচ্চশিক্ষিতা, সুন্দরী, খুব বড় পরিবারের মেয়ে, কোনও পারিবারিক দুর্যোগের কারণে একলা হয়ে পড়েছিলেন | অমরনাথ নিজেও ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ, বৈভবের চাকচিক্য না থাকলেও দুবার ফিরে দেখবার মতই তাঁর চেহারা ছিল | আলাপের এক মাসের মধ্যেই বিয়ের সিদ্ধান্ত | মেয়ের বাপের বাড়ির দিকে একেবারেই কেউ না থাকাটা অমরনাথের দাদা এবং বৌদিদের কাছে একটু আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালেও বিয়েটা হয়ে গেছিল খুব তাড়াতাড়ি। শিক্ষিতা সুন্দরী শহুরে মেয়ে আরাধনার সাথে গ্রাম্য আটপৌরে জা দের কোনদিনই তেমন একটা বনিবনা হয়নি। সাড়ে পাঁচ বছরের রাজন্যাকেও তার জেঠিমাদের কাছ থেকে সরিয়ে এনেছিলেন আরাধনা | বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই আরাধনা এবং অমরনাথের সন্তান তপোব্রত, তপু, পৃথিবীতে এলো | ভাই হওয়ার আনন্দে শুরুতে খুশিতে ডগমগ হয়ে থাকলেও ছোট্ট রাজন্যা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল যে পরিবারে ওর গুরুত্বটা যেন কমে আসছে | মা-বাবা ছোট্ট ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত | জেঠিমাদের কাছে গেলে ওনারাও একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ওকে ফের মা বাবার কাছেই ফেরত পাঠান | রাজন্যা নিজেই নিজের জগৎ খুঁজে নিয়েছিল গল্পের বইয়ের পাতায়, ছবি আঁকার খাতায় আর পড়াশোনার মধ্যে | ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস টেন একটানা প্রথম স্থান অধিকার করে গেছে রাজন্যা | উচ্চমাধ্যমিকে জেলার মধ্যে প্রথম, ভালো পরিমাণে স্কলারশিপ পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়া, তারপরে কলেজের ক্যাম্পাস থেকে পাওয়াই এই চাকরি, সে হিসাবে দেখতে গেলে হীরের টুকরো মেয়ে | যতটা কদর তার হওয়া উচিত ছিল, তা জোটে নি মেয়েটির কপালে | সৎ মা যে তাকে অনাদরে রেখেছিলেন, এ কথা বলতে পারবে না রাজন্যা, তবে ভাই পরিবারের মধ্যমণি ছিল এবং আছে, আর সে নিয়ে আজও মাঝে মাঝে রাজন্যার বুকের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম চিন চিনে ব্যথা হয় |

চিন্তার জগতে এমনই হারিয়ে গিয়েছিল রাজন্যা যে প্রথমবার কলিংবেল বাজাটা শুনতেই পায়নি | দ্বিতীয় বার বেজে উঠতে প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুললো। মালবিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বলে উঠল,

– কিরে! কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি! কি করছিলি?
– কিছু না রে, শুনতে পাইনি।

রাজন্যার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে মালবিকার একটা কি যেন সন্দেহ হয় |
– এই মেয়ে! কিছু একটা হয়েছে তোর | আবার অফিসে ঝামেলা হয়েছে নাকি রে?

রাজন্যা তড়িঘড়ি বলে ওঠে,

– না না, অফিসে কিছু হয়নি।
– তাহলে?

ঝপ করে রাজন্যার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে লাস্ট ফোন কলের নামটা দেখেই মালবিকার ভ্রু কুঁচকে ওঠে |

– কাকিমা ফোন করেছিলেন? আবার কিছু হয়েছে?

রাজন্যার সাথে যে ওর মায়ের সম্পর্কটা খুব যে স্বাভাবিক নয়, তা রাজন্যা কখনো নিজের মুখে না বললেও এই দেড় বছরে বুঝে ফেলেছে মালবিকা | মেয়েটা স্নেহের কাঙাল | আপন জনের থেকে একটু ভালোবাসার জন্য জান লড়িয়ে দিতে পারে | কিন্তু ওর চাকরি পাবার পর থেকে বাড়ি থেকে যে পরিমাণে ডিমান্ড আসতে দেখেছে সেটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি মালবিকার |

মালবিকাকে এড়ানো যাবে না জানে রাজন্যা, তাই তপুর নতুন ইংরেজি টিউশন এর কথাটা বলেই ফেলল |

– ভেবেছিলাম তিতলিকে পড়িয়ে যে বারো হাজার টাকা পাবো তাতে একটু সুরাহা হবে, মাসের শেষ দিকে পুরো হাত খালি হয়ে যাচ্ছে | কিন্তু তার থেকে চার হাজার টাকা তো ভাই এর টিউশনি তেই চলে যাবে দেখছি |
– আচ্ছা রাজ তোকে কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে কাকিমা যা যা চাইবে সব তোকে মেটাতে হবে? এই দু মাস আগে ভাইয়ের জন্য ট্যাব কিনে দিলি ওর অনলাইন ক্লাসের জন্য | আবার এখনই টিউশনের জন্য এতগুলো টাকা! মাসে তোর এখানকার একটা তো খরচ আছে | তার ওপর ফ্ল্যাটের ইএমআই | এগুলো তো বাড়ির লোককে বুঝতে হবে!

ম্লান হেসে মাথা নাড়ে রাজন্যা,

– দ্যাখ, বাবার যখন অ্যাক্সিডেন্টটা হয় তখন তো আমি স্টুডেন্ট | মা-ই তো তখন চাকরি করে সংসার চালিয়েছে। এখন আমি চাকরি করছি, সংসারের দায়-দায়িত্ব আমার নেওয়াই উচিত |
– দায়িত্ব নিবি না কেন? তাই বলে অতিরিক্ত খরচ গুলো সব তোর ঘাড়ে দেওয়াটা তো ঠিক নয় | বোলপুরে চার হাজার টাকার টিউশন ? বাড়াবাড়ি না? তুই কত টাকার টিউশন পড়তিস শুনি?

হেসে ফেলল রাজন্যা,

– এক টাকারও না |
– তাহলে?
– কি তাহলে?
– তুই যদি বিনা টিউশনে পড়ে এত ভালো রেজাল্ট করতে পারিস, তাহলে তোর ভাইকে হঠাৎ চার হাজার টাকার টিউশন পড়তে হচ্ছে কেন?
– ধুৎ! ওইভাবে কম্পেয়ার করা যায় নাকি…

বিরক্ত মুখে কাঁধ ঝাঁকাল মালবিকা,

– ভালোমানুষির একটা সীমা আছে | সেটা পেরিয়ে গেলে সেটাকে বোকামি গাধামি বলে | যা খুশি কর!

রাজন্যা জানে মালবিকার কথায় যুক্তি আছে এবং মালবিকা যা বলছে ওর ভালোর জন্যই বলছে | তবু ও তপুর টিউশনের টাকা দিতে আপত্তি করার কোন যুৎসই কারণ খুঁজে বের করতে পারে না |

আজ আর এ নিয়ে ভেবে কাজ নেই | কাল মাসের প্রথম দিন, শনিবার পড়েছে | ওই বাড়িতে বাচ্চাটাকে পড়াতে যাওয়া আছে | যেকোনো নতুন জিনিস শুরু করতে রাজন্যার বরাবরই খুব ভালো লাগে | দুশ্চিন্তাগুলোকে আপাতত সরিয়ে রেখে রাতের খাবারের কি ব্যবস্থা হবে ভাবা শুরু করতে যেতেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো | অপরিচিত নাম্বার | ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা পরিচিত গম্ভীর গলা শোনা গেল।

– রাজন্যা, আমি শিবাজী বলছি।

নিঃশ্বাসটা যেন গলার কাছে আটকে গেল রাজন্যার। শিবাজী দা সরাসরি ওকে ফোন করছে! কোন উত্তর না পেয়ে শিবাজী ফের জিজ্ঞাসা করল,

– হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ রাজন্যা?

তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল।

– হ্যাঁ শিবাজীদা, বলুন
– তুমি কি এখন একটা আধ ঘন্টার কলে জয়েন করতে পারবে প্লিজ? আসলে সৌম্যর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন | ও বলল সকালেই নাকি তোমার সঙ্গে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে? তোমাকে বিশেষ কিছু করতে হবে না | জাস্ট যদি প্রেজেন্ট থাকতে পারো | এই কাজটার সঙ্গে তোমাদের আগের প্রজেক্টটার বেশ মিল আছে, তাই দরকার পড়লে হয়তো পাঁচ সাত মিনিটের জন্য ওই অ্যাপ্লিকেশন টা একটু দেখাতে হতে পারে | অবশ্যই তোমার যদি অসুবিধা না থাকে |

রাজন্যা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,

– না না, অসুবিধা নেই | কটায় কল?
– সাড়ে আটটায়

চট করে ঘড়ির দিকে তাকালো রাজন্যা। সাড়ে আটটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি।

মালবিকা আজ ফেরার সময় হাত রুটি আর চিকেন তড়কা কিনে নিয়ে এসেছে | মাসের শেষ দিনটায় মাইনে ঢুকলে একটা দিনের জন্য একটু বেহিসাবি হয় মেয়েদুটো | নিজেরাই নিজেদের তোয়াজ করে, নিজেরাই নিজেদের ছুটি দেয় এক রাতের রান্না করা থেকে | একটু মোগলাই পরোটা কিংবা রুটি তড়কা কিংবা দোকানের চাওমিন এর সাথে ঝাল ঝাল চিলি চিকেন হাপুস হুপুস খায় | টেবিলের উপর রুটি তড়কার প্যাকেটটা দেখেই রাজন্যার মনে পড়ে গেল রাতের খাবার বানানোর ঝামেলা নেই আজ | একটু স্বস্তি আর একটু ফুর্তি মেশানো একটা নিঃশ্বাস ওর বুক দিয়ে নেমে গেল | ল্যাপটপ অন করে দেখলো ইতিমধ্যে মিটিং এর ইনভাইট চলে এসেছে, তবে কলটা শুধুমাত্র অডিও নাকি ভিডিও সেটা শিবাজীদা বলেনি। কি ভেবে একটু ফরমাল পোশাকই পরে নিল | বিছানার উপরে ল্যাপটপটা রেখে একটা চেয়ার টেনে বসার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল পিছনে কোন ঝোলানো জামা কাপড় গোছের কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা | ওকে ওভাবে চোখ ঘোরাতে দেখে মালবিকা হেসে ফেলল,

– ওই রাজ! ব্যাকগ্রাউন্ড চেঞ্জ করে নেওয়া যায় তো! এসব টেনশন নিস কেন? একটা ঝাঁ চকচকে অফিস রুম বসিয়ে নে পিছনে…

রাজন্যা হেসে ফেলল | সত্যি ভুলেই গেছিল, ঝটপট একটা ব্যাকগ্রাউন্ড সেট করে নিয়ে কলে ঢুকে পড়ল |

ভাগ্যিস! সবার ভিডিও অন রয়েছে | নিজেকে দেখে নিল একবার | খুব অদ্ভুত লাগছে না তো? পিছনে একটা বিদেশি ধাঁচের অফিস রুম! বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পাওয়া গেল না | কল শুরু হয়ে গেল | মুগ্ধ হয়ে শুনছে রাজন্যা, শিবাজীদা প্রথম দশ মিনিট একটা প্রেজেন্টেশন দিল, তারপরে কি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বোঝাচ্ছে | যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সাবলীল ভাবে | একটা অদ্ভুত কনফিডেন্স কথা বলার মধ্যে | কিছুক্ষণ পরে টিম মেম্বার হিসাবে রাজন্যার পরিচয় করিয়ে দিল সবার সাথে | এবার ওকে চটপট একটা ডেমো দেখাতে হবে। রাজন্যা তৈরিই ছিল | পুরো অ্যাপ্লিকেশন এত কম সময়ে দেখানো সম্ভব নয়, তাই কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ মডিউল টুকটুক করে দেখিয়ে দিল | সকলের মাথা নাড়া দেখে বুঝতে পারলো ভালোই বলেছে | শেষ করার ঠিক আগে একটা প্রশ্ন উড়ে এল,

– এই অ্যাপ্লিকেশন টা ডেপ্লয় করার কোনও রেস্ট্রিকশন আছে কি? মানে আমি চাইলে আমার অ্যাকাউন্টে করতে পারি?
– অফকোর্স স্যার! এটা খুবই ফ্লেক্সিবল একটা অ্যাপ্লিকেশন | আপনার একাউন্টের উপযুক্ত করে কনফিগার করে দেওয়া যাবে।

রাজন্যা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিল |

– বাহ নাইস টু হিয়ার | কিরকম সময় লাগবে অ্যাপ্রক্সিমেটলি?

শিবাজী বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই রাজন্যা উত্তর দিয়ে দিয়েছে

– সাধারণত আমাদের এক থেকে দুই মাস সময় লাগে স্যার…

প্রশ্নকর্তা এবার শিবাজী কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– আই থিঙ্ক দিস অ্যাপ্লিকেশন উইল মিট আওয়ার বেসিক রিকোয়ারমেন্টস | আর যেহেতু তাড়াতাড়ি ডেপ্লয় করা সম্ভব, আই উড সাজেস্ট, যতক্ষণ না আমাদের নতুন প্রজেক্টটা লঞ্চ হচ্ছে এটা দিয়েই আমরা কাজ চালাতে পারব |
– হ্যাঁ নিশ্চয়ই | তবে আমাদের একটু স্টাডি করতে হবে | সব একাউন্টে অ্যাপ্লিকেশন টা যে ঠিকভাবে কাজ করবে সেটা এখনই গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না…

শিবাজীর উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেল রাজন্যা | আগের টিমে ও অন্তত তিন চার জায়গায় এই অ্যাপ্লিকেশন চালিয়েছে, তাহলে শিবাজীদা হঠাৎ এখানে নেতিবাচক কথা বলছে কেন? তাহলে কি ওদের বানানো অ্যাপ্লিকেশন টার প্রশংসা সহ্য করতে পারছে না শিবাজী সেন? হুট করে মাথাটা গরম হয়ে গেল রাজন্যার। এই লোকটা এত অহংকারী কেন?

রাজন্যা বেশ সপ্রতিভ ভাবে বলে উঠলো,

– স্যার আই ওয়াজ পার্ট অফ দ্যা অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট টিম এ্যান্ড উই হ্যাভ ইম্প্লিমেন্টেড দিস ইন মাল্টিপল অ্যাকাউন্টস | ডেফিনিটলি আমাদের একটু স্টাডি তো করতেই হবে, কিন্তু আমি নাইনটি নাইন পার্সেন্ট সিওর যে এই অ্যাকাউন্টে এটা আমরা খুব তাড়াতাড়ি ডেপ্লয় করে দিতে পারব যদি প্রয়োজন থাকে |

অপর প্রান্তের বয়স্ক ব্যক্তিটির মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো | তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,

– আই লাইক দ্যাট পজিটিভ অ্যাটিটিউড। ঠিক আছে শিবাজী, উই উইল স্পিক লেটার।

কল শেষ | একে অপরকে গুডবাই, গুডনাইট, হ্যাপি উইক এন্ড জানিয়ে কল থেকে বেরিয়ে পড়ল সকলে | ল্যাপটপ বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠতে না উঠতেই ফোনটা বেজে উঠলো | ফোনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে উঠল রাজন্যার | নম্বরটা সেভ করা হয়নি ঠিকই কিন্তু দেখেই বুঝতে পেরেছে | ফোন তুলে হ্যালো বলার সাথে সাথে কানের উপরে আছড়ে পড়ল ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর,

– তুমি নিজেকে কি মনে করো রাজন্যা সান্যাল? এক বছরের একটু বেশি সময় চাকরি করে বিশাল বড় হনু হয়ে গেছো তুমি? ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে পারো না সে তো প্রথম দিনেই বুঝেছি, সিনিয়র অডিয়েন্সের সামনে টিম লিড কোনো কথা বললে সেই মুহূর্তে সেটার উপরে কথা বলতে নেই সেই বুদ্ধিটুকুও তোমার নেই? তুমি যে এতটা ডাম্ব সেটা আমি সাসপেক্ট করিনি।

শিবাজী এত চেঁচিয়ে কথা বলছে যে কানে লাগছে রীতিমত | রাজন্যা হতভম্ব | কি এমন বলেছে ও? এত ইগো প্রবলেম লোকটার?

– আমি তো জাস্ট কাজটা করা যাবে কি না বলছিলাম…
– আর আমি তোমার কথাকে মাঝখান থেকে কেটে বলেছিলাম যে আমাদের একটু স্টাডি করতে হবে, রাইট?

রাজন্যার থেকে কোন উত্তর না শুনতে পেয়ে শিবাজী আবার চেঁচিয়ে উঠল,

– সে ইয়েস অর নো! স্টুপিডের মতন চুপ করে থাকবে না!
– ইয়েস শিবাজীদা

রাজন্যার চোখে জল এসে গেছে |

– যে সমস্ত অ্যাকাউন্টে আগে কাজ করেছ সেখানে কতজন ইউজার?
– একশ, দেড়শ…
– তারা দিনে কতগুলো করে ডেটা ইনপুট করে?

একটু ভেবে উত্তর দিল

– এক একটা একাউন্টে একেক রকম
– ম্যাক্সিমাম?
– সত্তর থেকে একশ
– তার মানে মাসে যদি ত্রিশ দিনই ওয়ার্কিং ধরি, তাহলে মাসে ম্যাক্সিমাম সাড়ে চার লাখ, রাইট?
– হ্যাঁ

ক্যালকুলেটর খুলে দেখে নিয়েছে রাজন্যা | শিবাজী আর চিৎকার করছে না, কিন্তু অসম্ভব গম্ভীর গলা

– যে একাউন্টের কাস্টমার লিডার কথা বলছিলেন তাদের ইউজার কত জানো? সাতশ প্লাস, এবং তারা দিনে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টা করে রেকর্ড এন্ট্রি করবে | নাউ ক্যালকুলেট মাসে কতগুলো করে রেকর্ড সেভ হবে
– তিয়াত্তর লাখ পঞ্চাশ হাজার…

হিসাব করে বলার সময় গলাটা একটু কেঁপে গেল রাজন্যার | ওদিকের প্রশ্ন তখনও শেষ হয়নি |

– এতদিন যে সমস্ত একাউন্টে কাজ করেছ তাদের ডেটা কোথায় সেভ থাকত? কোন সার্ভারে?
– সার্ভার না | একটা কোন মেশিনকে সার্ভার এর মতন ব্যবহার করা হতো।

কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে টের পাচ্ছে রাজন্যা |

– মাসে তিয়াত্তর লাখ পঞ্চাশ হাজার ডেটা রো সেভ করতে গেলে বছরে কত জিবি স্টোরেজ স্পেস লাগবে কোন ধারণা আছে? সেটার জন্য আলাদা সার্ভার কিনতে হবে, সেই সার্ভার কিনতে গেলে কত খরচ হয়, সেট-আপ করতে কত সময় লাগে কোনও আইডিয়া আছে তোমার? তাছাড়া তোমাদের অ্যাপ্লিকেশনের কোন ধরনের লোড টেস্টিং হয়নি | আদৌ এত ডেটা হ্যান্ডেল করতে পারবে, নাকি ক্র্যাশ করে যাবে তার গ্যারান্টি দিতে পারবে তুমি?

রাজন্যার বুকের ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে | সত্যিই এত কিছু ভেবে দেখেনি | কোনরকমে বলল,

– আই অ্যাম সরি শিবাজীদা।
– ইউ শ্যূড বি!

শিবাজীর কণ্ঠস্বরের পারদ চড়েছে আবারও |

– মানুষ একটা জিনিস না জানতেই পারে। না জানাটা আমি দোষের মনে করি না | কাজ করতে করতেই শেখে, কিন্তু অবাধ্যতা? টিমের কথা না ভেবে নিজেকে গ্লোরিফাই করার চেষ্টা! দ্যাট ইজ সামথিং উইচ আই ডু নট টলারেট | সম্ভব হলে কালকেই তোমাকে আমার টিম থেকে বের করে দিতাম। যা ড্যামেজ করেছ সেটা আগে সামাল দিয়ে নিই, তারপরে আই উইল ডীল উইথ ইউ | এর মধ্যে তোমাকে যেটুকু করতে বলা হবে তার বাইরে নিজে পাকামি করে কোন একটা কাজও করবে না | কোন একটা কথাও বলবে না কারো সাথে |

ফোন কেটে গেল | হাত থেকে মোবাইলটা ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল রাজন্যা। ফুলে ফুলে কাঁদছে। ভীষণ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অন্যায় করে ফেলেছে সেটা বুঝেছে। কিন্তু এত কড়া কড়া কথাগুলো না বললেই কি চলত না? ভুল কি কেউ করে না? একটা ভুলের জন্য টিম থেকে বের করে দিতে হবে? নিজেই বেরিয়ে যাবে রাজন্যা | পরের দিন গিয়েই রিলিজ রিকুয়েস্ট দেবে |

মালবিকা দুবার খেতে ডাকতে এসে ফিরে গেল | খিদে নেই | হাত ধরে টানাটানি করেও লাভ হলো না |

সকালে ঘুম ভাঙলো প্রায় সাড়ে নটা | ঘুম ভাঙলো ঠিক না, মালবিকা ডেকে তুলল।

– কিরে উঠবি না? আজকে তোর টিউশনের প্রথম দিন তো | বলছিলি যে এগারোটায় যেতে হবে?

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে