#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ৩)
বাইরে গাড়ির শব্দ হতেই সোফা থেকে উঠে দরজার দিকে এগোলেন সুমিত্রা | ঘড়ির ছোট কাঁটা দশের ঘর ছুঁয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। বুবাই এর সাধারণত এত দেরি হয় না, তবে আজ সম্ভবত কোন জরুরী কাজে আটকে গিয়েছিল। বেল বাজানোর আগেই দরজাটা খুলে যেতে শিবাজীর ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি ফুটে উঠলো | বুঝতেই পারছিল পিসিমা জেগে বসে আছেন | ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
– আবার তুমি না খেয়ে বসে আছো পিপিয়া?
সুমিত্রা হাসলেন,
– না রে, আসলে সন্ধ্যা বেলায় পরোটা খেয়েছিলাম একটা, তাই পেট ভার | এই খেয়েই নিতাম একটু পরে |
– মিথ্যে কথাটা তুমি মোটেই বলতে পারো না পিপিয়া | বলেছি না, বেশি রাত অব্দি না খেয়ে থাকলে তোমার শরীর খারাপ করবে? আচ্ছা দাঁড়াও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি পাঁচ মিনিটে |
দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আগেই সাদা গোলাপী রঙে সাজানো ঘরটায় উঁকি দিল শিবাজী | ডিজনী প্রিন্সেস প্রিন্ট করা চাদর পাতা বিছানার উপরে একরাশ জুঁই ফুলের মতন ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট তিতলি | মেয়েটার সাথে আজ আর সময় কাটানো গেল না | ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে এগোল | বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আগে তিতলির ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত শিশুটির কপালে একটা চুমু খেয়ে তারপরে নিচে নেমে এলো | ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়ে গেছে | চেয়ারে বসতে বসতে শিবাজী অদূরে দাঁড়ানো কৈলাস কে উদ্দেশ্য করে বলল,
– কৈলাসদা তুমিও খেয়ে নাও এখন। আমাদের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না | এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে |
শিবাজীর থালায় তরকারি বেড়ে দিতে দিতে সুমিত্রা প্রশ্ন করলেন,
– আজকে অনেকটা দেরি হয়ে গেল যে তোর বুবাই?
– আর বোলো না পিপিয়া, আজকে সত্যিই খুব ঝামেলায় পড়েছিলাম।
অফিসে আজকের হওয়া ঝামেলাটার কথা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল শিবাজীর | আজ অনেক অনেক দিন পরে তাকে রীতিমতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, তাও একটা পুঁচকে মেয়ের জন্য | শিবাজী জানে ওর মেজাজের জন্য অনেকেই ওকে পছন্দ করেনা | নিতান্তই কাজে কোন ভুল ত্রুটি কখনো পাওয়া যায় না বলে বা যে কোন জটিল কাজে এই শিবাজী সেনের ওপরেই ভরসা করতে হয় বলে মুখ বুজে থাকে সকলে। কিন্তু আজ সন্ধ্যার মিটিং এ দু একজনের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি চোখ এড়ায় নি ওর |
– সে কি রে? কি হলো আবার!
পিসিমাকে এই সমস্ত সমস্যার কথা খুব বিশদে বলে লাভ নেই, বুঝবেন না | শিবাজী তেতো গলায় বলল,
– আরে, আজকে একটা নতুন টিমের ছেলে মেয়েরা জয়েন করলো আমাদের টিমে, তার মধ্যে একটি মেয়ে এত ইররেস্পন্সিবল, সমস্ত প্রোগ্রামের মধ্যে কিছু কিছু অংশ একমাত্র ওর জানা ছিল অথচ ও অফিসেই ছিল না। বেশ কিছু কথা শুনতে হল আমাদের।
– ওমা সে কি! আজকে প্রথম দিন, আর অফিসেই আসেনি?
শিবাজী থমকে গেল একটু | সকালে যে রাজন্যা কে ওভাবে বাড়ি চলে যেতে বলাটা ঠিক হয়নি সেটা সৌম্য আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে একবার | সাবর্ণদাও পরোক্ষভাবে একবার শুনিয়ে দিলেন | আসলে শিবাজী ভাবতেই পারেনি প্রয়োজন আছে বলার পরেও মেয়েটি ফিরে আসবে না |
সুমিত্রা নিজের মনেই বলে চলেছেন,
– আজকালকার ছেলেমেয়েদের এই এক দোষ। খুব সহজে সবকিছু পেয়ে যায় বলেই বোধহয় দায়িত্বের গুরুত্ব বোঝেনা।
শিবাজী ঝপ করে বাধা দিল,
– ছেলে মেয়েদের বলো না পিপিয়া | মেয়েদের বলো! আমার টিমে এতগুলো ছেলে কারোকে কখনো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করতে দেখি না | কাজ সহজ কঠিন হতে পারে, কারোর সময় কম কারোর সময় বেশি লাগে | কেউ সহজে একটা কাজ করতে পারে, আবার কারোকে অনেক চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু দায়িত্ববোধে কমতি নেই কারো |
– ও তোর রাগের কথা বুবাই | নিশ্চয়ই সব মেয়েরা অমন হয় না!
– তুমি জানো পিপিয়া, তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর যত জন মেয়ে বা মহিলা এসেছে তাদের কারোর দায়িত্ববোধ নেই, কর্তব্যজ্ঞান নেই! নিজের স্বার্থের বাইরে তারা অন্য কিছু ভাবতেই পারে না | তাদের কাছে স্নেহ, ভালবাসা, বিশ্বাস, দায়িত্ব, কর্তব্য এসবের কোন মূল্যই নেই | যে জাত নিজেদের প্রিয় মানুষের জন্য সামান্যতম চিন্তা করে না, তাদের কাছ থেকে আর বেশি কিই বা আশা করা যায়? আই হেট ওমেন!
ছেলেটার ব্যথার জায়গায় অজান্তেই আঁচড় কেটে বসেছেন বুঝে চুপ করে গেলেন সুমিত্রা | পিসিমার অপরাধী অপরাধী মুখটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল শিবাজীও | এই মানুষটাকে এভাবে কড়া কথা বলাটা উচিত হয়নি। এই মানুষটা না থাকলে শিবাজী সেন আজকের শিবাজী সেন হতে পারত না। অবসাদে তলিয়ে গিয়ে কোনো এক চরম পন্থা নিয়ে বসত হয়তো বহু বছর আগেই |
প্রসঙ্গ ঘোরাতে সুমিত্রা বলে উঠলেন,
– আরেকটু পনির দিই? কৈলাস আজ পনিরটা দারুন করেছে | তিতলিও চেটেপুটে খেলো |
রুটি ছিঁড়তে শুরু করেছিল | তিতলির খাওয়ার কথা শুনে ফের স্থির শরীরটা | মেয়েটা তার বাবাইয়ার কাছে গল্প না শুনে রাতের খাবার খেতে চায় না |
– পিপিয়া?
– হুঁ?
– তিতলি কি আজ খাওয়া নিয়ে খুব ঝামেলা করেছে?
সুমিত্রা হাসলেন,
– জানিসই তো মেয়ের জেদ | আমার বলা গল্প তো তার পছন্দ হয় না | বাবাইয়ার গল্প না শুনে সে কিছুতেই খাবে না…
– তাহলে?
– আজ আসলে একটা কান্ড হয়েছে, তিতলির খাবার সময়েই একটি মেয়ে দেখা করতে এসেছিল ওই টিউশনের ব্যাপারে।
সন্ধ্যাবেলার সমস্ত ঘটনাটা বর্ণনা করলেন সুমিত্রা | সবটা শুনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল শিবাজীর ঠোঁটের কোণে | কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যই | ফের স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্য এসে ঢেকে দিল কোমলতাটুকু | কে জানে, চাকরিটা পাওয়ার জন্যই হয়তো এত কেয়ারিং মনোভাব দেখিয়েছে | পড়াতে শুরু করার পরে আদৌ কোন কেয়ার নেবে কিনা তার কোন ঠিক নেই |
শিবাজীর মনের ভাবটা যেন পড়তে পারলেন সুমিত্রা | আলতো স্বরে বললেন,
– মেয়েটা কিন্তু সত্যিই বেশ ভালো রে! ওকে আগামী মাস থেকে আসতে বলেছি | আপাতত সপ্তাহে তিন দিন আসবে |
ভ্রু কুঁচকে উঠল শিবাজীর
– তিনদিন কেন? পাঁচ দিনের কথা হয়েছিল যে!
– আসলে মেয়েটি চাকরি করে | তাই শনি রবি আর সপ্তাহের মাঝখানে কোন একটা দিন আসবে |
শিবাজী একটু অসন্তুষ্ট মুখেই বলল,
– স্টুডেন্ট গোছের কারোকে নিলেই পারতে পিপিয়া | তিতলিকে পড়ানোটা তো আসল কাজ নয়, আসল কাজ ওর পড়তে বসার অভ্যাসটা তৈরি করে দেওয়া | একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা | সেই সময়টাই যদি দিতে না পারে, তাহলে কি করে হবে?
সুমিত্রা মাথা নাড়ালেন,
– দ্যাখ, অনেকদিন থেকেই তো খোঁজাখুঁজি করছি | তবে এই মেয়েটি যেমন চট করে তিতলির সাথে মিশে গেল, এমনকি ওর খাওয়ার বায়না দেখে দিব্যি গল্প বলে ওকে খাইয়ে দিল তাতে বুঝতে পেরেছি যে এর সাথে তিতলির বন্ডিংটা ভালো হবে | তুই না করিস না | এই শুরু করুক, তারপরে যদি বুঝি একে দিয়ে হচ্ছে না তাহলে আবার অন্য কাউকে দেখব না হয়? আমিই বসতে পারতাম তিতলিকে নিয়ে, কিন্তু সে তো তুই শুনবি না!
– তুমি তো জানো পিপিয়া কেন আমি আপত্তি করি? ডাক্তার তোমাকে চোখের উপরে কোনো রকম চাপ দিতে বারণ করেছে। তুমি আর তিতলি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো? কোন কারনেই তোমার স্বাস্থ্যের সঙ্গে আমি কম্প্রোমাইজ করব না |
একটা নরম হাসি সুমিত্রার চোখ ছুঁয়ে গেল | ছেলেটা বড় ভালবাসার কাঙাল। বাইরের লোকে ওর রূঢ় কঠিন আচরণটাই দেখে। আসলে ছোটবেলা থেকে আঘাত পেতে পেতে নিজেকে একটা কাঠিন্যের খোলসে বন্দি করে ফেলেছে ও, যাতে আর কেউ ওকে আঘাত করতে না পারে | ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন,
– আচ্ছা ঠিক আছে, শুনছি তো তোর কথা। খেয়ে নে। আবার তো কাল অফিস আছে |
খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ নেটফ্লিক্স আর প্রাইম ভিডিওতে এদিক ওদিক করে মোবাইলটা নিয়ে বিছানায় কাত হল শিবাজী | সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনিতে ও নিজে খুব একটা সক্রিয় নয় | কিন্তু দিনের শেষে একবার ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে চোখ বোলাতে ভুল হয় না | ফেসবুকের নিউজফিডে একবার উদ্দেশ্যহীন স্ক্রল করে তারপরে বিভিন্ন গল্পের গ্রুপে ঢুকে গল্প পড়াটা ঘুমোনোর আগে ওর একটা নেশার মতন। কিছু গল্পের পাতায় সত্যিই বেশ বলিষ্ঠ লেখনীর পরিচয় পেয়েছে। ন্যাকা বোকা পারিবারিক গল্পের সংখ্যা বেশি হলেও বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে লেখা জোরালো গল্পও এই ফেসবুকে পড়েছে | ফেসবুক খুলতেই জ্বল জ্বল করে উঠলো সমর্পিতার ছবি। আলো পিছলে যাওয়া মোমের মত মসৃণ ত্বক, বিপজ্জনক ভাবে ক্লিভেজ দেখানো লো কাট কালো টপ আর নাভির অনেকটা নীচ থেকে শুরু হয়ে হাঁটুর অনেকটা ওপরে শেষ হওয়া প্লিটেড স্কার্টে সমর্পিতা যেন বলিউডের শ্যুটিং ফ্লোর থেকে উঠে আসা কোন মডেল | কোন এক অজ্ঞাত কারণে শিবাজীর ফ্রেন্ডলিস্টে আজও সমর্পিতা আছে আর সমর্পিতার ফ্রেন্ডলিস্টে শিবাজী | ছবির মধ্যেও সমর্পিতার দুই চোখে যেন অজগর সাপের মতন সম্মোহনের হাতছানি তিক্ত যন্ত্রণাদায়ক অতীতকে ভুলে আবার সৌন্দর্যের সাগরে ডুব দেওয়ার অমোঘ আকর্ষণ। অন্যমনস্কভাবে ছবির নিচের লাইক বাটনে চাপ দিতে যাচ্ছিল শিবাজী। হঠাৎ যেন মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠলো কেটে কেটে বলা কথাগুলো |
– তুমি কি সত্যিই ভেবেছিলে ইউ ডিজার্ভ মি? আই অ্যাম এ ভেরি হাই মেইনটেনান্স প্রপার্টি ডার্লিং। তোমার ওই মধ্যবিত্ত মানসিকতার ঘেরাটোপে আমাকে বাঁধার চেষ্টা করো না | এই বাড়ির ছেলে হয়েও কি করে যে তোমার এ্যাম্বিশন এত কম আমি বুঝেই উঠতে পারি না!
মুহূর্তের মধ্যে সম্বিত ফিরে এলো | আঙ্গুল সরিয়ে নিল শিবাজী | চোয়ালের পেশী কঠিন হয়ে উঠেছে | মোবাইলের উপর থেকে নিচে একবার আঙুল টেনে রিফ্রেশ করে নিল নিউজ ফিড আর তারপরেই মুখের ভাব নরম হয়ে এল। ‘অসময়ের রূপকথারা’ পেজে নতুন গল্প প্রকাশিত হয়েছে | এই পেজটির মালিক অথবা মালকিন ভারি সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট গল্প লেখেন | ‘সি মোর’ লিংকে ক্লিক করে আজকের গল্প পড়া শুরু করল শিবাজী |
সকাল সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই তোয়ালে ঘাড়ে করে রাজন্যাকে বাথরুমের দিকে যেতে দেখে চোখ বড় বড় করলো মালবিকা।
– রাজ! সাতটা পঁচিশ বাজে জাস্ট! তুই স্নানে যাচ্ছিস এখনই?
– হুম্
ছোট্ট উত্তর দিয়ে একটা ক্লাচার দিয়ে চুল গুলোকে আটকাতে আরম্ভ করল রাজন্যা।
– এত তাড়াতাড়ি?
ফের জিজ্ঞাসা করল মালবিকা |
– একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চাই…
– বুঝলাম! কালকের কম্পেনসেশন?
মালবিকা ভ্রু ওঠাল | রাজন্যার কণ্ঠস্বর ক্ষুব্ধ.
– না, নো কমপেনসেশন | বিকজ আই ডিড নাথিং রং | গতকালও আমি সময় মত পৌঁছে যেতাম, নেহাত ওই ভদ্রলোককে সাহায্য করতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিল | আমার মনে হয়েছিল ওনাকে সাহায্য করাটা উচিত | তার জন্য যদি আট মিনিট দেরিও হয়ে থাকে তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না | আবার প্রয়োজন হলে আবারও ওই কারণে আমি দেরি করব |
আজ একটু বেশি সময় নিয়ে যত্ন নিয়ে তৈরি হল রাজন্যা। অফ হোয়াইট এর উপরে ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ফ্লোরাল প্রিন্টেড থ্রি কোয়ার্টার শার্ট আর চকোলেট কালারের ফর্মাল ট্রাউজার | পায়ে তিন ইঞ্চি হিলের পাম্প শ্যু | মুখে সামান্য মেকআপ, চোখের কোলে কাজলের আলগা টান আর ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক | কানে আমেরিকান ডায়মন্ড বসানো একটা ড্রপ ইয়ারিং ঝুলিয়ে বা হাতের কব্জিতে এই বছর নিউ ইয়ারে নিজের টাকায় কেনা টাইটান রাগার রিস্ট ওয়াচটা পড়তে পড়তে যখন ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো মালবিকা তীক্ষ্ণ চোখে ওকে জরিপ করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,
– কি ব্যাপার বলতো রাজ!
– কি ব্যাপার?
– তোকে কিরকম অন্যরকম লাগছে! আই মিন ইউ আর নট ইওরসেলফ টু ডে! হোয়াটস গোয়িং অন বেব?
মুচকি হেসে দুই কাঁধ ঝাঁকাল রাজন্যা
– নাথিং ইস গোয়িং অন! তোর মাথাটা গেছে।
মালবিকাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাজন্যা | অফিসে যখন পৌঁছল তখন নটা পনের বাজে। সৌম্য আগেই ওকে ফোন করেছিল একবার, বলেছিল অফিসে ঢুকেই জানাতে | এলিভেটার থেকে নেমেই সৌম্য কে ফোন করল রাজন্যা | বার দুই রিং হওয়ার পরেই ওদিক থেকে সৌম্যর গলা শোনা গেল,
-হ্যাঁ, রাজ?
-সৌম্যদা, আমি পৌঁছে গেছে অফিসে | ফ্লোরেই আছি | ওডিসি নাম্বার কত যেন? ফাইভ সি?
– দাঁড়াও দাঁড়াও, ওডিসির আগে তুমি মিটিং রুম নাম্বার ওয়ানে এসো। রিসেপশন থেকে ডান দিকে এসে প্রথম মিটিং রুম। আমি আসছি ওখানে |
মিটিং রুমে! কই আজ তো কোন মিটিং থাকার কথা বলা হয়নি! যাইহোক, নিজের মনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাগ স্ক্যান করে ভিতরে ঢুকে পড়লো রাজন্যা | মিটিং রুমের দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতেই দেখতে পেল উল্টো দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে সৌম্য আসছে |
– গুড মর্নিং সৌম্য দা।
– গুড মর্নিং রাজ।
মিটিং রুমে ঢুকে মুখোমুখি চেয়ারে দুজন বসার পরে সৌম্য বলল,
– তুমি হয়তো ভাবছো তোমাকে আলাদা করে মিটিংরুমে কেন ডাকলাম? আসলে কালকে তোমার ওভাবে চলে যাওয়াটা উচিত হয়নি রাজ | দ্যাখো, আমাদের টীমটা খুব ক্লোজ-নীট টীম, অনেকটা পরিবারের মত। তাই আমরা নিজেদের ইগো নিয়ে চলি না | সকলের সুবিধা অসুবিধা দেখেই চলার চেষ্টা করি |
রাজন্যা অবাক হয়ে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে, কি যে বলছে ওর কিছুই মাথায় ঢুকছে না | সৌম্য ওর অবাক হয়ে তাকানো দেখে আরেকটু বিশদে বোঝানো শুরু করে,
– দ্যাখো তোমাকে আমি বলেছিলাম গতকাল সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এর সাথে একটা মিটিং ছিল। এবারে ওই এ্যাপ্লিকেশনটা তোমার হাতে বানানো অথচ তুমি প্রেজেন্ট ছিলে না | আবার আনফরচুনেটলি, তোমাদের টিমের বাকি মেম্বাররা কেউই সম্পূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন টার সম্বন্ধে ভালো করে কিছু জানে না | তার ফলে কালকে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় অ্যাপ্লিকেশনের কিছু কিছু মডিউল ঠিকঠাক কাজ করেনি। এর জন্য আমাদের রীতিমতো ফেস লস হয়েছে কাল!
– এক মিনিট, এক মিনিট সৌম্যদা! কালকে প্রেজেন্টেশনে যদি কিছু গন্ডগোল হয়ে থাকে তার জন্য কি তুমি আমাকে দায়ী করছো নাকি?
রাজন্যারর কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট যে সে রীতিমতো ক্ষুব্ধ | সৌম্য সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল,
– না দ্যাখো, আমি ব্লেম করছি না। কিন্তু বলছি, ভবিষ্যতে এই ধরনের সিচুয়েশন অ্যাভয়েড করতে হবে আমাদের।
রাজন্যা নিজেকে আর সামলাতে পারল না | একটু তীর্যক কন্ঠেই বলে উঠলো,
– তা এই জ্ঞানটা তোমাদের শিবাজী স্যারকে দাওনি সৌম্যদা? আমাকে যদি কালকে উনি চলে যেতে না বলতেন তাহলে তো এই পরিস্থিতিই তৈরি হতো না!
– রাজ আই ক্যান আন্ডারস্ট্যাণ্ড শিবাজীদা কাল যেটা করেছিলেন ততটা হয়তো না করলেও চলত | কিন্তু উনি সিনিয়র মানুষ। ওনার উপরে অনেক দায়িত্ব। যে আচরণ ওনাকে মানায় সেটা কি তোমার আমার মতন জুনিয়রদেরকে মানায়? তাছাড়া তুমি তো কালকে চলে যাওনি, তুমি তো এখানেই ছিলে | তাহলে তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে জানার পরেও তুমি চলে গেলে কেন?
– সরি সৌম্যদা, মানতে পারলাম না। এটা প্রাইমারি স্কুল নয় যে টিচাররা স্টুডেন্টদেরকে কান ধরে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে সহবৎ শিক্ষা দেবে । তোমার শিবাজীদাও এখানে চাকরি করেন, আমিও এখানে চাকরি করি। অবশ্যই আমি ওনাকে রেসপেক্ট করব। বাট হি শুড অলসো রেসপেক্ট মি ব্যাক | আমার কাল দেরি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রথমত মাত্র আট মিনিট এবং আমার কেন দেরি হয়েছিল সেই কারণটা পর্যন্ত উনি শুনতে চাননি | তুমি এক্সপেক্ট করছো এর পরেও আমি ওনাকে হেল্প করব! পারলাম না!
– রাজ প্লিজ! টিমে থাকতে গেলে কয়েকটা জিনিস মেনে চলতে তো হবে?
– গত দেড় বছর তো একটা টিমেই কাজ করে এসেছি সৌম্যদা? ছড়ানো ছিটানো টিম হয়তো, কিন্তু টিম তো! একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এরকম ডিক্টেটারশিপ মেনে চলতে হবে সেটা আমার হজম হচ্ছে না |
সৌম্য আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো | ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখল শিবাজীদা কলিং | ফোনটাকে স্পিকারে রেখেই ধরল সৌম্য।
– হ্যাঁ শিবাজী দা
– কোথায় তুমি?
– এই একটু মিটিং রুমে, রাজন্যার সাথে কথা বলছি।
– ইফ শী ইজ অন দ্যা ফ্লোর অলরেডি, ওকে ওডিসিতেই নিয়ে এসো
গম্ভীর গলায় কথাক’টা বলে কেটে দিল শিবাজী।
মুচকি হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রাজন্যা |
– তোমার বস তোমার থেকে বেশি ইন্টেলিজেন্ট সৌম্য দা! হি নোজ দ্যাট হি নীডস মি নাউ | চলো |
সৌম্যর রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতন অবস্থা | এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে যে এভাবে কথা বলতে পারে, তা ওর ধারণার বাইরে | কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের ছুঁচো গেলার মতন অবস্থা | অ্যাপ্লিকেশন টাকে ঠিকঠাক চালাতে গেলে রাজন্যা ছাড়া উপায় নেই। তাছাড়াও মেয়েটা যা বলেছে, তা পুরোপুরি অস্বীকার করার মতো নয় | শিবাজীদা মাঝেমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত রুড আচরণ করে | তবে টিমের ছেলেপুলেরা জানে যে শিবাজীদা যেমন বকাবকি করে তেমনি প্রয়োজন পড়লে বুক দিয়ে আগলায়ও | কখনো ওদের সরাসরি সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এর কাছে কোন বিষয়ে জবাবদিহি করতে হয় না | সমস্তটা শিবাজীদাই সামলায়। কিন্তু নতুন মেম্বারদের সাথে প্রথম দিনেই রাগারাগি করা নিয়ে সাবর্ণদাও কাল খানিক ভর্ৎসনা করেছে শিবাজীদাকে |
ওডিসির ভিতরে পা দেবার সাথে সাথে উপস্থিত সকলে যেভাবে ঘুরে ওর দিকে তাকালো, রাজন্যা বুঝতেই পারল গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে বেশ বড়সড়ো আলোচনা হয়েছে। একটু অস্বস্তি হলেও মুখে একটা কনফিডেন্স ওয়ালা হাসি চিপকে এগিয়ে গেল ও |
রাজন্যাকে ওর সীট দেখিয়ে দিল সৌম্য,
– বসো আমি কয়েকটা ইমেলের উত্তর দিয়ে আসছি…
ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ মাউস চার্জার ইত্যাদি বের করে সেট করতে করতেই খুব কাছে একটা সদ্য পরিচিত গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনতে পেল রাজন্যা |
– অ্যাপ্লিকেশনটাকে দাঁড় করিয়ে দিতে কতক্ষণ লাগবে?
মুখ তুলে তাকিয়ে দীর্ঘদেহী সুপুরুষ মানুষটার চোখে চোখ পড়তেই একটা হার্ট বিট যেন মিস হয়ে গেল রাজন্যার | শিবাজী সেনের পরনে আজ একটা ঘন বাদামী রঙের ফরমাল শার্ট এবং ক্রিমরঙা ট্রাউজার | এতখানি সুদর্শন একটা মানুষ এরকম কর্কশ স্বভাবের যে কি করে হতে পারে! ভগবানের কারখানায় বড়ই গোলমাল হয়ে গেছে এইখানে | মনে মনে নিজের মাথায় সজোরে একটা চাঁটি মারল রাজন্যা | এই লোকটাকে দেখে কোথায় রাগে জ্বলে উঠবে, তার বদলে এরকম অদ্ভুত একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড অনুভব করছে কেন!
শিবাজীকে রাজন্যার ডেস্কের দিকে এগোতে দেখেই মনে মনে প্রমাদ গুনে নিজের দরকারি কাজ ফেলে উঠে এসেছে সৌম্য | আজকেও যদি এদের মধ্যে কোন কথা কাটাকাটি হয় তাহলে আরো একটা দিন নষ্ট হবে। ইতিমধ্যেই একটা চেয়ার টেনে রাজন্যার ডেস্কের পাশে বসে পড়েছে শিবাজী |
– আমি ওকে প্রবলেমটা বুঝিয়ে দিচ্ছি শিবাজীদা | ও তার মধ্যে ল্যাপটপ সেট করুক, নেটওয়ার্কে কানেক্ট করুক |
শিবাজী কিছু বলার আগেই রাজন্যা ফস করে বলে উঠলো,
– আমি কিন্তু বুঝতেই পারছি না সমস্যাটা ঠিক কোথায়, নতুন সার্ভারে অ্যাপ্লিকেশন হোস্ট করতে গেলে কি কি করতে হবে, কোন কোন জায়গায় বদল করতে হবে সেগুলো তো সমস্ত আমি ডকুমেন্টেই দিয়ে দিয়েছিলাম | সেগুলো করেও হয়নি?
– ডকুমেন্ট!
শিবাজী আর সৌম্য দুজনেরই অবাক হওয়া কণ্ঠস্বর শুনে রাজন্যা নিজেও দ্বিগুণ অবাক |
– সৌম্যদা তোমাকে যখন অ্যাপ্লিকেশনের কোড পাঠিয়েছি, তখন তো ডকুমেন্টস বলে একটা ফোল্ডারে সমস্ত টেকনিক্যাল এবং ফাংশনাল ডকুমেন্টও পাঠিয়েছিলাম। সেটা পাওনি?
শিবাজীর দৃষ্টি মুহুর্তেই রাজন্যার দিক থেকে ঘুরে সৌম্যর মুখের ওপর গিয়ে থামল | সৌম্য সামান্য আমতা আমতা করে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারছিল যে একটা বড়সড় গন্ডগোল করে ফেলেছে | আসলে ওদের টিমে সকলে খুব দায়িত্ব সহকারে কোডিং টা করলেও ডকুমেন্ট রাখার ব্যাপারটাতে টিমের ছোট থেকে বড় সকলেই বেশ আলগা। কোনো এক অদ্ভুত কারণে এই টিমের থেকে খুব কম লোকজনই ছেড়ে যায়, তার ফলে যে কোন সমস্যাতেই কোড যে লিখেছে, সে সব সময়েই উপস্থিত থাকে আর সমস্যার সমাধানও সে-ই করে। আলাদা করে কোন ডকুমেন্ট রেফার করার প্রয়োজন পড়ে না | ফলে রাজন্যার পাঠানো অ্যাপ্লিকেশনের কোড যত্ন সহকারে কপি করে নিলেও ডকুমেন্ট ফোল্ডারের প্রতি কোনো গুরুত্বই দেয়নি সৌম্য |
পুরনো ইমেইল খুলতেই ডকুমেন্ট ফোল্ডার পাওয়া গেল এবং তাতে সুন্দর করে বানানো ছবিসহ তিনটে ডকুমেন্টও পাওয়া গেল। ডকুমেন্টগুলো দেখতে দেখতে সৌম্য নিজের মনেই হাত কামড়ালো | এত সুন্দর করে স্টেপ বাই স্টেপ ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে যে গতকাল এই ডকুমেন্টটা খুললে যে কেউ প্রয়োজনীয় রদবদলগুলো করে নিতে পারত। কপালে অসীম দুঃখ আছে সেটা বুঝে পাংশু মুখে বসে রইলো সৌম্য।
– কতক্ষন লাগবে?
সৌম্য আর রাজন্যা দুজনেই শিবাজীর মুখের দিকে তাকাল | শিবাজী সরাসরি রাজন্যার দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করেছে।
– পুরো চেঞ্জ টা করে অ্যাপ্লিকেশন রান করাতে কতক্ষণ লাগবে?
রাজন্যা ঠোঁট কামড়ে ধরে দু এক মুহূর্ত ভাবল, তারপরেই কাঁধ ঝাঁকাল,
– কুড়ি মিনিট, তবে আফটার আই সাকসেসফুলি কানেক্ট উইথ দ্য নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ভিপিএন হিয়ার |
– ওকে
রাজন্যা অবাক হয়ে দেখল ‘ওকে’ বলার পরেও শিবাজী ওই জায়গাতেই বসে রইল |
‘কি জ্বালা রে ভাই ! এই লোকটা কি এখানেই বসে থাকবে নাকি !’
মনে মনে একটু বিরক্ত হয়েই কাজ শুরু করল রাজন্যা । ঠিক আঠারো মিনিটের মাথায় কাজ শেষ করে ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দিল শিবাজী আর সৌম্যর দিকে।
অনেকক্ষণ পরে সৌম্যর মুখে হাসি ফুটে উঠলো | গতকালের জন্য ধমক খেতে হবে ঠিকই, কিন্তু কাজটা যে আপাতত হয়ে গেল সেটা একটা বিরাট বড় স্বস্তির কারণ |
– দারুণ রাজন্যা! তোমার টাইম এস্টিমেট তো ব্যাপক!
সৌম্যর গলায় উচ্ছ্বাস | শিবাজী পকেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে | নিজের ডেস্কের দিকে যাবার জন্য পা বাড়াতেই রাজন্যা টপ করে বলে উঠলো,
– তাহলে আমি পরীক্ষায় পাস তো?
সৌম্য ফের প্রমাদ গুনলো | এই মেয়েটার মুখে কি কোন লাগাম নেই?
– পাস, উইথ স্টার মার্ক…
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সৌম্য। নেহাত শিবাজী ওদের দিকে পিছন ফিরে আছে, না হলে হয়তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারত না। শিবাজী সেনের ঠোঁটের কোণে এই মুহূর্তে একটা মুচকি হাসি লেগে রয়েছে |
(ক্রমশ)