হৃদ মাঝারে পর্ব-০২

0
539

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২)

মালবিকা বাড়িতে ফিরে রাজন্যাকে দেখে অবাক হয়ে গেল,

– কিরে তুই এত তাড়াতাড়ি?

রাজন্যা একটা হাই তুলে বলল,

– কাজ হয়ে গেল তাই চলে এলাম।

মালবিকা ভুরু কুঁচকাল,

– তোর তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেল এটা বিশ্বাসযোগ্য? প্রথম দিনেই কিছু ঝামেলা করিস নি তো রাজন্যা?

রাজন্যা আধশোয়া হয়েছিল, উঠে বসল |

– ঝামেলা মানে! আমি কি ঝামেলাবাজ নাকি?

মালবিকা কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে মুচকি হেসে বলল,

– ঝামেলাবাজ নও কিন্তু বড় বেশি ঠোঁট কাটা। তার জন্য ঝামেলা সৃষ্টি হয় |

রাজন্যা হাতের কাছ থেকে একটা কুশন তুলে নিয়ে মালবিকার দিকে ছুঁড়ে মেরে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাল,

-মোটেই আমার জন্য কোন রকম ঝামেলা সৃষ্টি হয় না! অফিসে একটা অত্যন্ত ঝামেলাবাজ লোক ছিল | ওই লোকটার জ্বালায় বিরক্ত হয়ে আমি বাড়ি চলে এসেছি |

মালবিকা হেসে ফেলল,

– ঠিক ধরেছি | কিছু একটা গন্ডগোল তো হয়েছে | কি হয়েছে খুলে বল দেখি!

রাজন্যা বেজার মুখে বলল,

– ধুর! ছাড় ওই কথা | একটা হুঁকো মুখো হ্যাংলা টাইপের লোক, সে নাকি আমার বসের বস | মাত্র আট দশ মিনিট দেরি করে যাওয়ার জন্য যা নয় তাই কথা শোনাল!

রাজন্যার থেকে এইটুকু হিন্টই মালবিকার পক্ষে যথেষ্ট | রাজন্যাকে চেপে ধরে বাকি কথা বিশদে জেনে নিতে আর বেশিক্ষণ সময় লাগলো না | তার পরে হাসতে হাসতে মাটিতে পেট চেপে বসেই পড়লো প্রায়,

– প্রথম দিনেই তোকে অফিস থেকে বের করে দিল! এই নাকি তুই তোর টিমের বেস্ট ডেভেলপার! এতদিন আমাকে গুলতাপ্পি দিতিস বল!

লম্বা করে জিভ বার করে মুখ ভ্যাংচাল রাজন্যা, বিড়বিড় করে বলল,

– হিন্দির ওই খারুস ওয়ার্ডটা এইরকম লোকের জন্যই তৈরি হয়েছে।
– তা তোর এই খারুস কে দেখতে কেমন রে? তোর বর্ণনা শুনে তো আমার চোখের সামনে একটা মোটা কালো ভারি চশমা পরা গোঁফওয়ালা লোকের মূর্তি ভেসে উঠছে |

ঝপ করে রাজন্যর চোখের সামনে শিবাজী সেনের মুখটা ভেসে উঠল, কতকটা নিজের মনেই বলে উঠলো,

– দেখতে তো হিরোদের মতন অথচ ব্যবহার ভিলেনের মত।
– কি বলছিস আপন মনে?
– কিছু না…

প্রসঙ্গ ঘোরাতে রাজন্যা বলে ওঠে,

– আচ্ছা তোকে যে দেখতে বলেছিলাম একটা টিউশনির ব্যাপারে? সেটার কিছু হল?
– আরে হ্যাঁ, তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম | আমাদের প্রজেক্টের একজন যেখানে পিজি থাকে তার পাশের বাড়ির এক কাকিমা নাকি তাঁর নাতনির জন্য একজন টিচার খুঁজছেন | কিন্তু ওনার সপ্তাহে অন্তত তিন দিন চাই। তুই তিন দিন কি করে যাবি?
– কোন ক্লাস কিছু বলেছে রে?
– আরে একেবারেই ছোট | বছর পাঁচেক বোধহয় বয়স |
– পাঁচ বছরের বাচ্চার জন্য টিউশন? কেন ওর বাবা মা কি করে?
রাজন্যা একটু অবাক গলাতেই বলে উঠলো। কাঁধ ঝাঁকালো মালবিকা,

– অত আমি জানি না! ওদের তিন দিন লাগবে সেটা শুনে আমি ওখানেই আটকে গেছি | তোকে জিজ্ঞাসা না করে আর কোন কথা বাড়াতে চাই নি | তবে আমার বন্ধুটা বলল এরা নাকি খুব বনেদি বাড়ি, কাজেই টাকা পয়সা বেশ ভালোই দেবে |

রাজন্যা একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল,

– টাকা-পয়সা ভালো দেবে বলছিস? দেখি তাহলে আরেকটা দিন এডজাস্ট করা যায় কিনা কোনভাবে…
– খুব দরকার রে? সারা সপ্তাহ অফিসে কাজ করবি আবার উইকেন্ডেও রেস্ট না নিয়ে বাচ্চা পড়াতে দৌড়াবি?
– তুই তো জানিস মালু আমার উপায় নেই | মাইনের টাকা তো বেশিরভাগই ইএমআই দিতেই চলে যায় | হাতে একটু টাকা থাকা তো প্রয়োজন বল | আর তাছাড়া আমার বাচ্চাদের কম্পানি খুব ভালো লাগে…
– হ্যাঁ বিয়ের পরে ফুটবল টিম বানাবি।

রাজন্যা হাতে ফের একটা কুশন তুলে নিতেই মালবিকা হাসতে হাসতে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল | রাজন্যার বাড়ির ব্যাপার জানে মালবিকা, ওর কাছে সব গল্পই শুনেছে | রাজন্যাদের পৈতৃক বাড়ি বোলপুরে হলেও সে বাড়িতে থাকার মেয়াদ সম্ভবত ফুরিয়ে এসেছে | রাজন্যার খুব ছেলেবেলাতেই ওর বাবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে উনি পঙ্গু হয়ে পড়েন | রাজন্যার মা একটা স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতা করেই সংসার চালিয়েছেন এতদিন | কিন্তু বছর কয়েক হল, রাজন্যার দুই জ্যাঠা ওদেরকে ওই বাড়ি ছেড়ে উঠে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছেন |

– সেকি কথা! বাড়ি তো তোদেরও, তোদেরকে উঠে যেতে হবে কেন?

মালবিকা জিজ্ঞাসা করেছিল | তখনই জেনেছিল যে রাজন্যার জ্যাঠাদের মতে ওর বাবার চিকিৎসার জন্য ওনাদের যে বিপুল অর্থব্যয় হয়েছে তা ওনারা এবারে ফেরত চান | আর তাছাড়া রাজন্যার মায়ের সামান্য শিক্ষকতার চাকরিতে ওদের তিনজনের খাইখরচ চলে গেলেও এই কুড়ি বছর ধরে যৌথ পরিবারের কোন সাধারণ খরচ অথবা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কোনো রকম টাকাপয়সাই ওরা দিতে পারেনি তাই বাড়ির উপরে ওদের অধিকারেরও সময়সীমা ফুরিয়েছে | চাকরি পাওয়ার পর প্রথম এক বছর দাঁতে দাঁত চেপে সঞ্চয় করেছে রাজন্যা | এরপরে হোম লোন নিয়ে আর নিজের ছোটবেলার এক জোড়া সোনার বালা বিক্রি করে একটা ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাট বুক করে ফেলেছে | আর বছর খানেকের মধ্যেই হ্যান্ডওভার পাওয়ার কথা | ফ্ল্যাটের চাবি হাতে পেলে যেটুকু কাজ না করালে নয় সেটুকু করে নিয়েই বাবা মাকে ওই অসুস্থ পরিবেশ থেকে এনে নিজের ফ্ল্যাটে রাখবে এটাই রাজন্যার এখন সবথেকে বড় স্বপ্ন |

রাজন্যাকে উদাস হয়ে পড়তে দেখে মালবিকা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,

– তাহলে এক কাজ কর | আগামী এক দুই দিনের মধ্যেই ওনার সঙ্গে কথা বলে আয় | আজকে তো কুড়ি তারিখ হয়েই গেল, সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাস থেকেই পড়ানো শুরু কর |
– বলছিস?
– একদম!
– তাহলে আজই ঘুরে আসি বরং, বেশি তো বাজে নি!

সত্যিই বেশি বাজে নি | মালবিকা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে ভদ্রমহিলার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে দিলো রাজন্যাকে |

বাড়িটা ওদের ওখান থেকে বিশেষ দূরে নয় | মিনিট দশেক অটোয় যাওয়ার পরে নির্দিষ্ট জায়গায় নেমে রাস্তার দু একজনকে জিজ্ঞাসা করে যখন মালবিকার দেওয়া ঠিকানাটার সামনে এসে রাজন্যা দাঁড়ালো, প্রথম কয়েক মিনিট হাঁ করে শুধু বাড়িটাই দেখতে থাকল | বিরাট বড় সাদা রঙের দোতলা বাড়ি বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘন সবুজ লন | বাড়ি আর লন ঘিরে যে নিচু পাঁচিলটা রয়েছে তার গা দিয়ে পরম যত্নে ভার্টিক্যাল গার্ডেন তৈরি করা | লনের এক কোণে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে পাথরের বসার জায়গা আর একটা আয়তাকাকার দোলনা | এই অংশটাতে একটা পাথরের ছাতার মতনও তৈরি করা রয়েছে যাতে বৃষ্টিবাদলার সময়ও নির্বিঘ্নে এই জায়গায় বসে থাকা যায় | প্রথম দেখাতেই এই ঘন সবুজ লনটার ফ্রেমে পড়ে গেল রাজন্যা | ওর মনে পড়ে গেল বোলপুরে ওদের বাড়ির পিছনে এক চিলতে একটু জায়গায় বাগান করেছিল ওর মা | সাধারণ সব গাছ, নয়নতারা, তুলসী, বেলফুল, গাঁদা ফুল | শীতের দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে ওই জায়গাটুকুতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকতে কি ভালই না লাগতো | নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল রাজন্যার | প্রাথমিক মুগ্ধতার রেশ কাটিয়ে কলিংবেল বাজানোর জন্য হাত বাড়াতেই দোতলার ব্যালকনি থেকে কচি গলার একটা চিৎকার শোনা গেল,

– আমি কিছুতেই বাবাইয়ার সাথে ছাড়া খাব না |

তার একটু পরেই আবারোও

– না না না আমি বাবাইয়া এলে তবে খাব, এখন খাব না!

বাচ্চা মেয়েটির কথার উত্তরে আরো একটি মহিলা কন্ঠ কিছু বলছে, কিন্তু বাইরে থেকে তা আর শুনতে পাচ্ছে না রাজন্যা | সামান্য ইতস্তত করে কলিংবেলে চাপ টা দিয়েই দিল | একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে দরজা খুলে গেল | একজন বেশ পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা মাঝ বয়সী ভদ্রলোক দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন,

– কাকে চাই ?
– মিসেস সুমিত্রা গুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওনার সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার
– ও পিসিমা ? আচ্ছা ভিতরে আসুন |

রাজন্যাকে ভিতরে নিয়ে গেল লোকটি, ঘরের ভিতরেটাও বেশ মুগ্ধ হয়ে দেখার মত | দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা বিরাট বড় লিভিং রুম, দরজার বাঁদিকে রাখা সুদৃশ্য শ্যু ক্যাবিনেটের পাশ দিয়ে চলে গেছে চওড়া সিঁড়ি | সিঁড়ির পাশের দেওয়াল জুড়ে ফিকে কমলার ওপর কালচে লাল রঙে মধুবনি ধাঁচের নকশা | উঁচু সিলিং থেকে ঝুলে থাকা সুদৃশ্য ঝাড়বাতি, দেওয়ালে পরিমিত জায়গা বাদ দিয়ে দিয়ে সুন্দর বেশ কিছু পেইন্টিং, ঘরের কোনায় বড় টেরাকোটার পাত্রে সবুজের স্পর্শ | কেমন একটা মন ভালো করা পরিবেশ | ওকে সোফায় বসতে বলে ভিতরদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি | খানিক অপেক্ষা করার পরে দোতলা থেকে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা শাড়ির আঁচলে চশমার কাচ মুছতে মুছতে নেমে এলেন। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হয় ষাটের কোঠায় বয়স | গায়ের রং প্রায় দুধে আলতা কিন্তু বড়ই শীর্ণ রুগ্ন চেহারা | রাজন্যার দিকে তাকিয়ে একমুখ হেসে বললেন,

– তোমাকে অনেক অপেক্ষা করালাম, তাই না ভাই?

রাজন্যা উঠে দাঁড়ালো, একটু হেসে বলল,

– না না, কই আর? এই মাত্রই তো এলাম |
– দাঁড়াতে হবে না বসো, বসো | কি খাবে? চা? কফি? কৈলাস! অ্যাই কৈলাস!

ভদ্রমহিলার ডাকাডাকি শুনে আগে দেখা সেই লোকটি কোথা থেকে যেন ছুটে এলো | রাজন্যা কিছু বলার আগেই তাকে দুই কাপ কফি বানানোর আদেশ দেওয়া হয়ে গেল | ভালোই হলো অবশ্য, মনটা একটু কফি কফি করছিল বটে | আজকে বিকেলে অফিস থেকে ফিরে চা-কফি কিছুই খাওয়া হয়নি |

কৈলাস চলে যেতে সুমিত্রা গুপ্ত রাজন্যার সামনে আরেকটা সোফায় বসলেন |

– তোমার তো বয়স খুবই অল্প দেখছি | কি কর? স্টুডেন্ট?
– না আন্টি | জব করি |
– আন্টি আবার কি? কাকিমা জেঠিমা মাসিমা পিসিমা এগুলো মুখে আসে না বুঝি?

ভদ্রমহিলা সস্নেহে ধমকে উঠলেন | রাজন্যা হেসে ফেলল, তারপরে বলল,

– অনেকেই এসব শুনতে পছন্দ করে না যে! তাই আন্টি ডাকাটাই সেফ!
– আমার তিতলিকে যদি পড়াও, তাহলে কিন্তু আমাকে পিসিমা ডাকতে হবে |

রাজন্যা হাসিমুখে মাথা নাড়ালো, ভদ্রমহিলার মধ্যে কেমন একটা আপন করে নেবার ক্ষমতা আছে | এখনো কোনো কথাই হয়নি বলতে গেলে, অথচ মনে হচ্ছে উনি যেন কত দিনের চেনা |

– স্টুডেন্টের সম্পর্কে একটু জানতে পারলে ভালো হত…

জিজ্ঞাসা করে ফেলল | সুমিত্রা উত্তর দিলেন,

– স্টুডেন্ট অর্থাৎ তিতলি আমার নাতনি | পাঁচ বছর পুরে ছয়ে পা দিয়েছে | এ বছর ক্লাস ওয়ান | ওকেই একটু নিয়মিত নিয়ে বসা প্রয়োজন | এমনিতে বুদ্ধিমতী, একবার পড়লে চট করে মনেও রাখতে পারে | কিন্তু খুব জেদী, যেদিন ইচ্ছে করবে, পড়বো না সেদিন কোনো ভাবেই ওকে পড়তে বসানো যায় না | শুধু পড়া কেন, কোন কাজই করানো যায় না ওর ইচ্ছা না হলে |
– আচ্ছা ওর গলাই কি পাচ্ছিলাম একটু আগে? খাব না বলে বায়না করছিল?
– ইস নীচ অবধি আওয়াজ আসছিল?
– শুধু নীচ না, বাইরে পর্যন্ত…

হাসল রাজন্যা | সুমিত্রা মাথা চাপড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন,

– হ্যাঁ ওরই গলা শুনেছ। ও একটু আর্লি ডিনার করে | ভোরবেলা স্কুল থাকে তাই তাড়াতাড়ি খেয়েই শুয়ে পড়তে হয়। ডিনারটা সবসময় ওর বাবার সাথেই করে, কিন্তু আজকে ওর বাবার অফিস থেকে ফিরতে দেরি হবে। ফোনে বলেছিল মেয়েকে খেয়ে নিতে। কিন্তু সে মেয়ে শুনলে তো! বাবা না এলে কিছুতেই খাবে না |
– খায়নি শেষ অবধি?
– নাহ্, কই আর খেল? বুবাই এর মাঝে মধ্যে এরকম দেরি হয়, এক একদিন দিব্যি লক্ষ্মী হয়ে খেয়ে নেয়, কিন্তু আজ কি হয়েছে, কিছুতেই কোন কথা শুনছে না!

একটু কিন্তু কিন্তু করেও প্রশ্নটা করে ফেলল রাজন্যা,

– ওর মায়ের কথাও শুনছে না?

সুমিত্রা সোজা তাকালেন রাজন্যার দিকে | ওনার দৃষ্টিতে বেদনার ছাপ স্পষ্ট | বললেন,

– মা নেই তিতলির |

রাজন্যা যেন ধড়ফড়িয়ে উঠল,

– আই এম সো সরি! আমি বুঝতে পারিনি |

সুমিত্রা হয়তো আর একটু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিরিং বিরিং করে প্রজাপতির মতো দোতলা থেকে নেমে এলো পাঁচ বছরের একটি ফুটফুটে বাচ্চা |

– বাবাইয়া কই, বাবায়া? তুমি বাবাইয়ার সাথে কথা বলছো তো ঠাম্মি?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রাজন্যা কে দেখে একটু যেন থতমত খেলো বাচ্চাটি তারপরে হরিণ পায়ে গিয়ে লুকালো ঠাম্মির পেছনে | সুমিত্রার সোফার পিছনে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটি, শুধু তার মুখটুকু দেখা যাচ্ছে সুমিত্রার ঘাড়ের পাশ দিয়ে | একমাথা কোঁকড়া চুলে রঙিন গার্ডার দিয়ে মাথার দুপাশে দুটো ঝুঁটকি বাঁধা | ফুলো ফুলো গাল আর অবাক দুটো চোখ দেখে বেশ মজা লাগলো রাজন্যার | ছোট থেকেই বাচ্চা খুব পছন্দ রাজন্যার, ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খুব সহজে অনেকটা সময় ও কাটিয়ে দিতে পারে। চোখ গোল করে বলল,

– তুমি কে? লুকিয়ে পড়লে যে বড়?

সোফার পেছন থেকে পাল্টা প্রশ্ন এলো,

– তুমি কে?
– আমি তো ফেয়ারি
– ফেয়ারি!!
– হুম্, কেন সিনড্রেলা তে পড়ো নি ফেয়ারি গড মাদারের কথা?
– তুমি ফেয়ারি গড মাদার?
– না আমি ফেয়ারি গড সিস্টার

গোলাপি ফ্রক পরা পুতুল পুতুল চেহারাটা এবারে চোখে একরাশ কৌতুহল নিয়ে সুমিত্রার সোফার পিছন থেকে বেরিয়ে এল,

– কার ফেয়ারি গড সিস্টার তুমি?
রাজন্যা চোখ মুখ কুঁচকে উপর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবার ভঙ্গি করতে করতে বলল,

– কার আমি তো ঠিক জানি না | নামটা বলে দিয়েছিল আমাকে, কিন্তু আমি ভুলে গেছি | আমাকে বলেছে ফাইভ ইয়ার্স এর একটা ছোট্ট মেয়ে তার ডাক নামের মিনিং হচ্ছে প্রজাপতি | তারই গড সিস্টার আমি |

তিতলি এবার পায়ে পায়ে রাজন্যার আরো একটু কাছে চলে এলো | অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

– আমার ডাকনাম তিতলি, তিতলি মানে তো প্রজাপতি | তাহলে কি তুমি আমার গড সিস্টার?

রাজন্যা নিজের দুই হাত বাড়িয়ে তিতলিকে একটু কাছে টেনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওর দিকে ভালো করে দেখতে দেখতে বলল,

– তোমার ডাকনাম তিতলি? কিন্তু মিলছে না যে!
– কি মিলছে না ফেয়ারি?
– আমাকে তো বলা হয়েছিল আমি যার গড সিস্টার সে খুব ভালো মেয়ে, সোনা মেয়ে |
– আমিও তো ভালো মেয়ে!
রাজন্যার কথা শেষ হতে না হতেই বলে উঠল তিতলি |

– কিন্তু আমি যে একটু আগেই শুনেছি তুমি বায়না করছো খাবে না বলে?

তিতলি ঠোঁট ফোলাল,
– বাবাইয়া আসেনি যে! কি করে খাব?
– আচ্ছা আজকে যদি বাবাইয়ার অফিসে বেশি বেশি কাজ থাকে আর তুমি যদি না খেয়ে বসে থাকো তাহলে তো বাবাইয়ার মন খারাপ হবে | কোনো ভালো বাচ্চা কি তার বাবার মন খারাপ করিয়ে দেয়?

তিতলির মুখ দেখে মনে হল সে একটু চিন্তায় পড়েছে | সুমিত্রা কিছু না বলে মিটিমিটি হাসছেন | তিতলি একটু মুখ গোঁজ করে বলল,

– বাবাইয়া স্টোরি বলে খাওয়ার সময়…
– আমিও তো স্টোরি বলে দেব বললাম রে দুষ্টু মেয়ে!

সুমিত্রা চোখ পাকালেন | তিতলি পিছন ফিরে ওঁর দিকে একবার তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল,

– তুমি তো সেম স্টোরি বারবার বলো | বাবাইয়া কত্ত রকম স্টোরি বলে…

রাজন্যার ভারি ভাল লাগছিল পুরো ব্যাপারটা | কেমন সুন্দর একটা ভালবাসার মান অভিমানের ওম মাখা সন্ধ্যা | মা হারা শিশুটির জন্য নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে একটা নরম কোণ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে | জ্যান্ত পুতুল তখনও রাজন্যার দুই হাতের মধ্যে | রাজন্যা আলতো করে বলল,

– আমি স্টোরি বলে দিই একটা? দেখি তুমি কেমন লক্ষী সোনা হয়ে খেয়ে নাও?
– তুমি বলে দেবে?
– হ্যাঁ! আমি তো তোমার ফেয়ারি গড সিস্টার না?

গোল্ডিলক আর ভালুক পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে খাওয়া শেষ হয়ে গেল তিতলির | সুমিত্রা জোর করে রাজন্যাকেও কিছু খাবার খাইয়ে দিলেন | খেয়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল রাজন্যার, ন’টা বাজে |

– আন্টি, আমি আসি…

সুমিত্রা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন,

– আরে তোমার সাথে তো আসল কথা কিছুই হল না | ওই দুষ্টু মেয়েকে সামলাতেই সময় চলে গেল |
– ঠিক আছে আন্টি, আমি পরে ফোন করে নেব |
– না না, পরে ফোন করার কিছুই নেই | আমি বুঝে গেছি তুমিই পারবে | তুমি আসছে মাস থেকেই পড়াও তিতলিকে |
– কিন্তু আন্টি, আপনি তো আমার ব্যাপারে কিছুই জানতে চাইলেন না?
– আবার আন্টি? বললাম না, পিসিমা বলতে? আর আমি বুঝে গেছি, এ মেয়ে তোমার কাছে জব্দ | সপ্তাহে পাঁচ দিন হলেই ভাল হত, কিন্তু তিন দিন দিয়ে শুরু করো | বারো হাজার দিই? ঘন্টা দুই করে দেখিয়ে দাও ওকে?

বারো হাজার! এই টুকু পুঁচকে মেয়েকে পড়ানোর জন্য? রাজন্যা একটু চোখ বড় বড় করে তাকিয়েও থেকে চট করে সামলে নিল নিল নিজেকে |

– আচ্ছা পিসিমা, তাহলে ফোন করে নেব পরে আরেকবার…

বেরিয়ে একটা বড় করে শ্বাস নিল রাজন্যা | কিছু দিনের জন্য তাহলে স্বস্তি! সত্যি হাত খালি হয়ে যাচ্ছিল একদম | ভাইটাকে হাত খরচের টাকাটাও পাঠাতে পারছিল না ঠিকঠাক |

( ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে