#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ১)
– এই রাজ! তুই এখনও এই সব ঝাড়া মোছা করে চলেছিস? ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এই যে বললি আজ তোর নতুন প্রজেক্টের প্রথম দিন, সময় মত পৌঁছাতে হবে, তাহলে দেরি করছিস কেন?
যাকে লক্ষ্য করে কথা গুলো বলা হল সে আড় চোখে একবার দেওয়ালে লাগানো ঘড়িটা দেখে নিয়ে নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল,
– অনেক সময় আছে | আমার তো আর তোর মত আয়নার সামনে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপার নেই | স্নান করব, জামা প্যান্ট পরব, চুল আঁচড়াব, বেরিয়ে যাব | জানিসই তো, ঘর অগোছালো ফেলে রেখে আমি বেরোতে পারি না | বাড়ি ফিরে একটা মেসি জায়গা দেখব ভাবলেই আমার গা শিরশির করে |
– উফ, কি পিটপিটে বুড়ি রে তুই রাজ! যা যা স্নানে যা | বাকি আমি গুছিয়ে দেব |
হাতের কাপড়ের ঝাড়নটাকে যত্ন করে ভাঁজ করে জানালার নীচে ছোট্ট তাকটার ওপর রেখে ঘুরে দাঁড়াল রাজ ওরফে রাজন্যা | একটু গোলুমোলু চেহারার রাজন্যার গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মত, ঘাড় অবধি স্টেপ কাটা চুল পাখির বাসা সুলভ এলোমেলো | নিখুঁত তুলির টানে আঁকা ভ্রু আর বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ | টিকলো নাক আর পাতলা ঠোঁট, যেন খুব যত্ন করে এই মানবীকে তৈরী করেছেন কোনো কারিগর | সেই মানবীটির যদিও নিজের সৌন্দর্যের প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই, নিজেকে সাজানোর পরিবর্তে সে ঘর সাজাতে ভালবাসে | ঘর নোংরা থাকা তার দুই চোখের বিষ | তাই প্রতিদিন সকালের ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ গোছানোর পর্ব শেষ হলে অফিস যাওয়ার আগেই সবটা নিজের হাতে গুছিয়ে রেখে যায় |
– কি বললি? তুই গোছাবি ঘর? মিস মালবিকা মৈত্র, যে শ্যাম্পু করে বোতলের ঢাকনা আটকায় না, যার কোনো জুতোর দুই পাটি এক জায়গায় থাকে না, যার ঘুম থেকে ওঠার দুই ঘন্টা পরেও বিছানার চাদর বালিশ একই জায়গায় পড়ে থাকে, সে গোছাবে ঘর! সূর্যদেব, আপনি কোন দিকে উদয় হয়েছেন আজ?
বলে চোখ গোল গোল করে ওপর নীচে ঘোরাতে থাকে রাজন্যা |
– এই! এই!
তেড়ে ওঠে মালবিকা | মালবিকা বেশ একটু দীর্ঘাঙ্গী, গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও মুখশ্রী সুন্দর | রাজন্যা আর মালবিকার বন্ধুত্বের বয়েস বছর দেড়েক | কিন্তু এখন দু’জনে দিনভর এমন একে অপরের সাথে লতায় পাতায় জড়িয়ে থাকে যে তাদের বাল্য বান্ধবীই ভেবে থাকে লোকজন | পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক হওয়ার পর চাকরি খুঁজতে আসা মালবিকা আর ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট রাজন্যার একই বহুজাতিক কোম্পানিতে একই দিনে ইন্টারভিউ পড়েছিল | আর দু’জনেই সিলেক্টও হয়েছিল | রাজন্যা ট্রেনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আর মালবিকা ট্রেনি বিপিও অ্যাসোসিয়েট হিসাবে | রাজন্যার বাড়ি বোলপুরে, সিলেক্ট হওয়ার সাথে সাথে বাড়িতে ফোন করে মাকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল | পনের দিন পরে জয়েনিং, এর মধ্যে কলকাতা শহরে একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে | কোম্পানি বড় হলেও প্রথম ছয় মাসের ট্রেনিং পিরিয়ডে মাইনে তেমন বেশি না | তাই বুঝে শুনে চলতে হবে, হাজার তিনেক টাকার মধ্যে বাড়ি ভাড়া আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সেই নিয়েই চিন্তা করছিল | সেই সময়েই বাস স্টপের লোহার চেয়ারে বসা একটি মেয়েকে ফোনে বলতে শুনল,
– না না দাদা, ছয় হাজার কোথা থেকে দেব? আমার ওই আড়াই থেকে তিনের মধ্যে বাজেট | আর আমার তো দুটো রুম দরকারও নেই, একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাট পেলেই চলবে |
মেয়েটা ফোন রাখার পরে ওর দিকে গুটি গুটি এগিয়ে গেছিল রাজন্যা | আলাপ করার পরে জেনেছিল মালবিকা মেদিনীপুরের মেয়ে, ওরই মত কলকাতায় থাকার জায়গার খোঁজ করছে, একই দিনে ওরও নতুন চাকরিতে জয়েনিং | রাজন্যার শেয়ার করে থাকার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছিল মালবিকা | তার পর থেকে গত দেড় বছর ওরা শুধু রুমমেটই নয়, বেস্ট ফ্রেন্ডস |
মালবিকা হাউমাউ করে বলে উঠল,
– দ্যাখ আমার তোর মত ওসিডি নেই ঠিকই, তবে তাই বলে অতটাও অগোছালো আমি নই! আর তোর ভালোর জন্যই বলছি, বললি না নতুন টিম থেকে তোকে একদম সময় মত পৌঁছতে বলেছে আজ? খামোখা দেরি করিস না |
রাজন্যা এই কোম্পানিতে জয়েন করার অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে একজন দক্ষ ডেভেলপার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল | ওদের কুড়ি জনের টীমটা সারা ভারতে ছড়ানো ছিল, টীম লীডার সমেত দশ জন ছিল চেন্নাই এর, চার জন মুম্বই, দুই জন হায়দেরাবাদ আর রাজন্যা সহ চার জন কলকাতার | অনলাইন ভিডিও বা অডিও কলের মাধ্যমেই ওদের সব মিটিং হত | প্রত্যেকের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া, কোনো কাজ নিয়ে প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে সে বিষয়ে সাহায্য করা, নিয়মিত কাজের আপডেট নেওয়া সমস্তই ওই কলের মাধ্যমেই হত | কয়েক মাসের মধ্যে রাজন্যার স্বাধীন ভাবে ও সঠিক কাজ করার পারদর্শিতা দেখে ওর ম্যানেজার রমেশ রাজাকৃষ্ণন ওকে অন্যদের তুলনায় বেশি দায়িত্ব দেওয়া শুরু করেন আর রাজন্যাও সবটা সুষ্ঠু ভাবে করে সকলের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠতে থাকে | কিন্তু মাস দুই আগে কোম্পানির এক বড় সিদ্ধান্তের ফল হিসাবে ওদের টীমটাকে ভেঙে দেওয়া হয় | প্রতিটি শহরের এমপ্লয়ীদের সেই শহরেরই অন্য অন্য টীমের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয় | রাজন্যা আর কলকাতার আরো তিন জন ছেলে মেয়েকেও একই কারণে কলকাতার একটা বড় টিমের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে | কলকাতায় যতগুলো প্রজেক্টে কাজ চলত সেগুলো সমস্ত এবার থেকে এই টীমই সামলাবে | এই টীমের দুজনের সাথে আজ প্রথম মিটিং রাজন্যার, সকাল দশটায় | ন’টা বেজে গেছে দেখে তাই মালবিকা রাজন্যাকে তাড়া দেওয়া শুরু করেছে |
স্নান করে চটপট তৈরী হয়ে নিল রাজন্যা, সাজগোজের ধার দিয়ে ও যায় না, চুলটা একটু আঁচড়ে আর চোখে একটু কাজল ছুঁইয়ে একটা হালকা হলুদ রঙের টপ আর জীনস পরে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ল | বাসে উঠে দেখল ন’টা কুড়ি বাজে | কোনো চিন্তাই নেই, বাসে ঠিক দশ মিনিট লাগে, ভিতরে ঢুকে লিফটে করে উঠতে আরো দশ মিনিট, আর ল্যাপটপে সব ফাইল গুলো খুলে রেডি করতে আর পাঁচ থেকে দশ মিনিট, যথেষ্ট সময় হাতে |
বাস থেকে রাস্তা পেরোতে গিয়ে এক দিকে চোখ আটকে গেল রাজন্যার | ওয়াকিং স্টিক হাতে এক বৃদ্ধ বারবার ব্যস্ত রাস্তাটা পেরোনোর চেষ্টা করছেন, আবার পিছিয়ে আসছেন | না কোনো গাড়ি ওনাকে দেখে থামছে, না কেউ এগিয়ে আসছে ওনাকে সাহায্য করতে | একটু ভ্রু কুঁচকে থেকে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেল রাজন্যা |
– জ্যেঠু আপনি কি রাস্তা পার হবেন?
মোটা পাওয়ারের চশমার পেছন থেকে আশাণ্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন উনি
– হ্যাঁ মা, চেষ্টা করছি, কিন্তু গাড়ি গুলো এত জোরে যাচ্ছে, আর সিগন্যালটাও এদিকে বন্ধ হচ্ছে তো ওদিকে খুলে যাচ্ছে | আমি তো তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারি না, তাই ভয় পাচ্ছি |
– কোনো ভয় নেই, আপনি আসুন আমার সাথে |
রাজন্যার হাত ধরে দুইদিকের রাস্তা পেরোলেন বৃদ্ধ | যে বিল্ডিং এ যাবেন সেই বিল্ডিং এর গেট অবধি ওনাকে পৌঁছে দিয়ে গেটের দারোয়ানকে ওঁকে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে এল রাজন্যা | তার পরেই মোবাইলে সময় দেখেই দৌড় দিল নিজের অফিসের দিকে, সময় তখন ন’টা পঞ্চান্ন |
মিটিং রুমের ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে একটা ঢোঁক গিলল সৌম্য, দশটা বাজতে তিন মিনিট বাকি , এখনও মেয়েটা এসে পৌঁছল না | বারবার করে ওকে বলে দিয়েছিল যেন দেরি না হয় | অন্তত পৌনে দশটার মধ্যে পৌঁছে ল্যাপটপ সেট করে ফেলার কথা বলেছিল, কিন্তু সে মেয়ে কোথায়! আড় চোখে শিবাজীদার মুখের দিকে তাকাল, আপাত দৃষ্টিতে ভাবলেশহীন মুখ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে প্রচণ্ড রেগে আছে বুঝতে পারছে | সময়ানুবর্তিতাকে ভয়ানক গুরুত্ব দেয় শিবাজীদা, বাকি দোষ ত্রুটির তাও মাফ আছে, দেরির নেই | মেয়েটাকে ফোনও করল একবার, বেজে গেল |
তিন মিনিটের অস্থির অপেক্ষা, ঘড়িতে ঠিক দশটা বাজার সাথে সাথে শিবাজী সেনের গমগমে গলা শোনা গেল,
– সময় বলা হয় নি?
– হ্যাঁ শিবাজীদা, বলেছিলাম, রাজ তো আমাকে জোর দিয়ে বলল ও কাছেই থাকে, সময় মত পৌঁছে যাবে, হয়তো আটকে গেছে…
– তোমাকে কিছু জানিয়েছে?
– না, ইয়ে মানে…
বলতে বলতেই সৌম্যর ফোনটা বেজে উঠল, রাজের নাম দেখেই তড়িঘড়ি ফোন কানে দিল
– রাজ! কোথায় তুমি? ক’টা বাজে খেয়াল আছে?
ওই প্রান্ত থেকে ভেসে এল,
– চিন্তা করো না সৌম্যদা, আমি বিল্ডিং এ ঢুকে গেছি, লিফটের সামনে | দুই মিনিটে পৌঁছাচ্ছি | মিটিং রুম নাম্বার টু তো? আসছি এখুনি |
ফোন রেখে একটু হাসার চেষ্টা করল সৌম্য,
– পৌঁছে গেছে, দু মিনিটে আসছে |
উত্তরে শিবাজী আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকাল কেবল, ঘড়িতে দশটা বেজে পাঁচ |
দশটা আটে হুড়মুড় করে মিটিং রুমের দরজা খুলে ঢুকল যে মূর্তিটি তাকে দেখে শিবাজী সেনের ভ্রু কুঁচকে গেল আরো একটু | মেয়ে? নতুন ডেভেলপার একজন মেয়ে? তার নাম রাজ?
– গুড মর্নিং সৌম্যদা, গুড মর্নিং স্যার!
দরজা দিয়ে ঢুকেই হাসি মুখে বলল রাজন্যা | সৌম্যর সাথে আগের দিনই ভিডিও কলে কথা হয়েছে, অন্যজনকে চেনে না, দেখে সিনিয়র মনে হল, বসা অবস্থাতেও বেশ লম্বা বোঝা যাচ্ছে, লালচে ফর্সা গায়ের রঙ, ব্যাক ব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা | সাদা ফরমাল শার্ট আর কালো ট্রাউজার পরনে | প্রথম দর্শনে একটু থমকে যাবার মত, বাঙালি ছেলেদের মধ্যে এরকম সুদর্শন কারোকে আই টি কোম্পানিতে অন্তত চট করে দেখা যায় না |
রাজন্যার গুড মর্নিং এর প্রত্যুত্তরে সৌম্য হেসে গুড মর্নিং বললেও অপর জনের মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না | গম্ভীর মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাজন্যার দিকেই তাকিয়ে আছে মানুষটা | রাজন্যা একটু হলেও থতমত খেল, এরকম ভাবলেশহীন মুখ চোখ মুখ কেন লোকটার? রাগী নাকি? এই কি নতুন বস হবে ?
– রাজ, তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দিই, শিবাজী সেন, সিনিয়র টেকনিক্যাল আর্কিটেক্ট | আমাদের টিমের হেড যদিও সাবর্ণদা, সাবর্ণ মুখার্জি, কিন্তু ওভারঅল ডেভেলপমেন্ট আর প্রজেক্ট ডেলিভারি সমস্তটাই শিবাজীতার তত্ত্বাবধানে হয় |
সৌম্য ভূমিকা টুকু করে দিতেই রাজন্যা আরো একবার মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
– নাইস টু মিট ইউ স্যার, গুড মর্নিং!
– তোমার নাম কি?
রাজন্যা এরকম অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাতে আবারো গমগমে গলায় একই প্রশ্ন,
– নাম জিজ্ঞাসা করেছি, এতে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই | হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?
– রাজন্যা সান্যাল
– থ্যাঙ্কস
শিবাজী সৌম্যর দিকে ফিরল,
– মানুষকে তার সম্পূর্ণ নাম ধরে ডাকবে বা রেফার করবে | নামটাকে ইচ্ছা মত কাট ছাঁট করে নিয়ে ডিফর্ম করার প্রয়োজন নেই | বুঝেছ?
– হ্যাঁ শিবাজী দা |
সৌম্যকে মাথা নিচু করে উত্তর দিতে দেখে একটু খারাপই লাগল রাজন্যার, ওর বন্ধুরা বেশির ভাগই ওকে রাজ বলেই ডাকে | তাতে ও অভ্যস্তই হয়ে গেছে | বিষয়টা হালকা করতে বলে উঠল,
– কোনো প্রবলেম নেই স্যার, আমাকে অনেকেই রাজ বলে ডাকে | আচ্ছা তাহলে আমি এখানে ল্যাপটপ সেট করি?
– তার আগে একটা প্রশ্ন রাজন্যা | ক’টা বাজে?
– অ্যাঁ?
– টাইম, হোয়াটস দ্যা টাইম নাও?
রাজন্যা মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে বলল,
– দশটা বারো |
– তুমি এসেছ তিন চার মিনিট হয়েছে, তার মানে তুমি ঢুকেছ দশটা আট নাগাদ | তোমার কখন আসার কথা ছিল?
এবার রাজন্যা প্রসঙ্গটা বুঝতে পারল, দেরি হওয়া নিয়ে বকা খেতে হবে | তাড়াতাড়ি বলে উঠল,
– দশটা স্যার | আমি অফিসের সামনে পৌঁছেও গেছিলাম, তার পরে…
– তার পরেও দশটা আটে ঢুকেছ, রাইট?
– না স্যার, আসলে একজন…
– নো এক্সকিউজেস! জেনুইন রীজনে দেরি হলে সেটা ফোনে জানানো উচিত ছিল না? তোমার হাতে ফোন ছিল, রাইট?
– হ্যাঁ স্যার, কিন্তু…
– কিন্তু তুমি জরুরি মনে করো নি, তাই তো?
– স্যার মাত্র তো আট মিনিট লেট হয়েছে!
শিবাজীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল, রাজন্যার চোখে চোখ রেখে বলল,
– রাজন্যা সান্যাল, আমার কাছে দেরির স্ট্যাটাসটা বাইনারি, হ্যাঁ কিংবা না | ওই অল্প দেরি, বেশি দেরির কোনো শ্রেণী বিভাগ নেই | অ্যাণ্ড ইউ আর লেট | সো প্লিজ লীভ ফর টুডে |
রাজন্যার মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে প্রায়, থেমে থেমে বলল,
– লীভ – ফর – টুডে!
– ইয়েস
শিবাজী উঠে দাঁড়িয়েছে | ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,
– আমাদের টিম সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে ছ’ টা অবধি কাজ করে | মাঝে আধ ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেক, সেটা নিজের সুবিধা মত, দরকারি কাজ থাকলে দেরি অবধি থাকতে হয়, তাড়াতাড়ি আসতেও হয় | কোনো কারণে দেরি হলে অবশ্যই টিম লীডারকে জানানো প্রয়োজন | আগামী কাল আসার সময় কথাগুলো যেন মাথায় থাকে | বিনা ইন্টিমেশনে সকাল দশটার পরে এলে আমি সাধারণত ঢুকতে দিই না |
রাজন্যা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে | এই দেড় বছরে বরাবর শুনে এসেছে আমাদের কোম্পানি খুব ফ্লেক্সিবল | কাজ ডেলিভার করা নিয়ে কথা, তুমি যখন খুশি যেভাবে খুশি কাজ করতে পারো | আর এখানে এই লোকটা স্কুলের হেড মাস্টারের মত কথা বলছে | যেন স্কুলের ঘন্টা বেজে গেছে, আর ঢোকা যাবে না |
সৌম্যও হকচকিয়ে গেছে একটু | শিবাজীদার মেজাজ সম্পর্কে সে ভাল রকমের অবগত, মেয়েটা যে বেশ বকুনি খাবে তাও বুঝতে পারছিল, কিন্তু ওকে যে একেবারে বাড়ি চলে যেতে বলবে তা আশা করে নি | তাছাড়া এই সদ্য টেক ওভার করা প্রজেক্ট গুলোর মধ্যে একটার ডেমনস্ট্রেশন আছে আজ |
রমেশ রাজাকৃষ্ণনের সাথে কথায় বুঝেছে যে কলকাতার ছেলে মেয়েদের মধ্যে এই রাজন্যা মেয়েটিই বেস্ট, প্রতিটা প্রজেক্টের খুঁটিনাটিই ওর নখদর্পণে | কিন্তু শিবাজীদাকে কিছু বলতে যাওয়া বৃথা, সাবর্ণদা পর্যন্ত ওকে সমঝে চলে | আসলে এই লোকটা কাজে বসলে তার অন্য রূপ, যে কোনও কঠিন সমস্যার কোনও না কোনও সমাধান থাকে শিবাজী সেনের কাছে | তাছাড়া নতুন ধরণের কোনো কাজের জন্য আলাদা করে আর-এন্ড-ডি করতে হলেও তাবড় তাবড় মাথাকে এই শিবাজী সেনের কাছেই আসতে দেখেছে সৌম্য | তবু, মেয়েটা তো ওকেই রিপোর্ট করবে! তাই একবার চেষ্টা করল সৌম্য,
– শিবাজীদা, আজ তো ফার্স্ট দিন, তাছাড়া ওই ডেমোটা আছে |
– প্রথম দিন বলেই আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল | আর ওই টিমের আরও ছেলেপুলে আছে, তাদের কারোকে দিয়ে ম্যানেজ করো |
সৌম্য হতাশ হয়ে রাজন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ঠিক আছে রাজন্যা, কাল দেখা হবে তাহলে | ডট সাড়ে ন’টার মধ্যে চলে এসো |
রাজন্যা কোনো কথা না বলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এল | খুব রাগ হচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে | বাকিদের দেখল না, তার মানে ওরা আগেই এসে গেছে | প্রথম দিনেই এরকম একটা ইমপ্রেশন হল! একবার মনে হচ্ছে দরকার নেই এই টিমে কাজ করে, আজই মেইল করে দেবে রিলিজ চেয়ে | আবার পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ না করেই চলে যাবে! রিসেপশনে এসে সোফায় একটু বসল রাজন্যা | ওয়াই ফাই এখানেও পাওয়া যায়, কয়েকটা পড়াশোনার অনলাইন কোর্স চালু করেছিল, আপাতত তারই একটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক | এমনিতেও বাড়ি গিয়ে গরমের মধ্যে একা একা কিই বা করবে |
ঘন্টা খানেক পরে সৌম্য নীচের ফ্লোরে একটা প্রয়োজনে যাওয়ার জন্য লিফটের দিকে যেতে গিয়ে রাজন্যাকে রিসেপশনে বসে থাকতে দেখে অবাক হল,
– এই রাজন্যা, তুমি বসে আছ?
রাজন্যা কান থেকে হেডফোনটা খুলে অবাক গলায় বলল,
– কেন এখানে বসতে গেলেও কি শিবাজী স্যারের পারমিশন লাগবে নাকি?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিল সৌম্য,
– না না, তা কেন? আসলে ভেবেছিলাম তুমি বাড়ি চলে গেছ |
– নাহ, বাড়ি গিয়েই বা কি করব এখন, একটা অনলাইন কোর্স শুরু করা ছিল, ওটা শেষ করার চেষ্টা করছি |
– ওহ্, বাহ্ ভেরি গুড | ঠিক আছে কাল দেখা হবে |
কাজ সেরে জায়গায় ফিরে সৌম্য দেখল আবহাওয়া খারাপ | নতুন টিমের রাজন্যা ছাড়াও আরও দুটি ছেলে জয়েন করেছে আজ থেকে, অনুরাগ আর সুদীপ | আজকের ডেমনস্ট্রেশনের জন্য ওদের সব কিছু তৈরি রাখতে বলেছিল | কিন্তু দেখা গেছে এদের দুজনের কেউই সম্পূর্ণ প্রজেক্টটার সম্পর্কে জানে না, দুজনেই নিজের কাজ করা অংশটুকু বাদে বাকি কিছুই জানে না | এমনকি কিছু কিছু তথ্য যে কী ওয়ার্ড দিয়ে দিয়ে এনকোড করে স্টোর করা আছে সে বিষয়েও তাদের জ্ঞানের ঝুলি ফাঁকা | শিবাজী খুবই বিরক্ত মুখে অনুরাগকে বলল,
– ডেটা যে এনক্রিপ্ট করে স্টোর হয় সেটুকুও জানো না? এতদিন ধরে কাজ করছ এই প্রজেক্টে!
কাঁচুমাচু হয়ে অনুরাগের উত্তর
– আসলে স্যার, এগুলো তো সব রাজ দেখে | আমরা আমাদের পার্ট টুকুতে কনসেনট্রেট করি কেবল |
শিবাজীর থমথমে মুখ দেখে সৌম্য আস্তে করে বলল,
– শিবাজীদা, রাজন্যা কিন্তু এখনও অফিসেই আছে |
শিবাজী ভ্রু কুঁচকাল |
– হ্যাঁ, ওই একটা অনলাইন এক্জাম দিচ্ছে | ডাকব?
শিবাজীকে গম্ভীর মুখে চুপ করে থাকতে দেখে সৌম্য ফের বলল,
– ডাকি?
– আচ্ছা ডাকো |
রাজন্যার কাছে অবশ্য ইতিমধ্যেই অনুরাগের ফোন চলে এসেছে
– এই রাজ, তুই অফিস এলি না কেন আজ?
– এসেছিলাম, কিন্তু একটা গন্ডগোল হয়েছে | পরে বলব |
– আরে গন্ডগোল তো এখানেও | আজকেই নাকি কোন সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের লোকের কাছে ডেমো আছে | আমাদের পুরো প্রজেক্টটা খুলে বোঝাতে বলেছিল, কিন্তু আমি সুদীপ আমরা তো নিজেদের নিজেদের পার্ট টুকুই জানি | প্লাস এখানে নতুন সার্ভার থেকে প্রজেক্ট চালানো হচ্ছে, ডেটা এনক্রিপশনের কী ওয়ার্ড লাগবে | ওই সব তো তুইই দেখিস | এই টিমের যে টেকনিক্যাল হেড, শিবাজী সেন, মারাত্মক রাগী লোক | সৌম্যদা মনে হয় ওকে বলছে তোকে ডাকতে, তুই কোথায় রে রাজ?
রাজন্যা আচমকা ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় | দ্রুত পায়ে লবিতে গিয়ে লিফটের বোতাম টিপে বলে,
– আমি রাস্তায় রে! রাখছি এখন | দ্যাখ কোনো ভাবে ম্যানেজ করতে পারিস কি না |
সৌম্য রিসেপশনে এসে রাজন্যাকে দেখতে না পেয়ে অবাক হল | এই তো ছিল মেয়েটা, গেল কোথায়? সামনে বসা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল,
– আচ্ছা এখানে একজন মেয়ে বসেছিল এতক্ষণ, কোথায় গেল?
– উনি তো বেরিয়ে গেলেন এইমাত্র
এই মরেছে! সৌম্য তাড়াতাড়ি ফোন করল, তিন চার বার রিং হয়ে যাওয়ার পরে ফোন ধরল রাজন্যা
– হ্যাঁ সৌম্যদা?
– রাজন্যা তুমি কোথায়?
– আমি তো বাড়ি যাচ্ছি
– এই যে পরীক্ষা দিচ্ছিলে?
– হ্যাঁ, হয়ে গেল তো!
– রাজ, বাই এনি চান্স, ফেরত আসতে পারবে?
– না দাদা, সকালে অত ধমক খেয়ে শরীরটা কেমন খারাপ করছে | কাল তো সকালে যাচ্ছিই…
আরও একবার অনুরোধ করতে গিয়েও চুপ করে গেল সৌম্য | শিবাজীদা জানতে পারলে কপালে দুঃখ আছে |
ফোনটা কেটে যেতেই নিজের মনে মুচকি হাসল রাজন্যা,
– দ্যাখ কেমন লাগে! মাত্র আট মিনিট দেরী করার জন্য এরকম হ্যাটা করা!
(ক্রমশ)