@হৃদয় হরণী
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু
সার্থক রাস্তা পার করতে চাইলে ঝড়ের গতিতে একটি বাইক তাকে ছুঁয়ে গেল।সে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল।পায়ের হাঁটুতে বেশ আঘাত পেয়েছে।
আলোর আত্মা কেঁপে উঠলো।সে দ্রুত সার্থকের কাছে গিয়ে বললো,”পাগল হয়ে গেছো তুমি?”বলতে বলতে তার গাল চোখের জলের স্পর্শে ভিজে গেল।আলো কান্না করতে করতে হৃদয়কে ডাক দিলো।
হৃদয় তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে ছিল বিধায় আলোর চিৎকার শুনে পেছন ফিরলো।সার্থকের এমন অবস্থা দেখে সে দৌঁড়ে এলো।আর দু’জনে মিলে তাকে হসপিটাল নিয়ে গেল।
.
নুপূরের দিনগুলো বেশ কাটছে।সে এখন বাংলোতে একা না।তার দেখাশুনার জন্য একজন বয়স্ক মহিলা আছেন।সারাদিন তার সাথে গল্প করেই কেটে যায়।তার প্রেগ্ন্যাসির সময় ৬মাস এখন।সে মনেপ্রাণে চাইছে তার সন্তান সুস্থ থাকুক,সুস্থভাবে জন্ম নিক!
কলেজে সে প্রথম প্রথম গিয়েছিল।এখন বাড়িতেই পড়াশোনা করছে।নুপূরের পড়াশোনার খরচ সব তার শুভাকাঙ্ক্ষীই চালাচ্ছে।সে পণ করেছে,একদিন যখন সে সফলের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যাবে তখন এই ব্যাক্তির সমস্ত টাকা শোধ করে দিবে।কিন্তু অর্থ শোধ করলেও উপকার কী শোধ করতে পারবে?সারাজীবন সে শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে ঋণী হয়েই রইলো।
.
আলো কাঁদতে কাঁদতে নিজের চোখ-নাক লাল করে ফেলেছে।এক সেকেন্ড তার মানুষটির প্রাণ চলে যেতে পারতো!কী করে ক্ষমা করতো আলো তখন নিজেকে?
এই দুই মাসে সার্থকের দিকে ফিরেও তাকায়নি।আজ তাসনিনের প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট আনতে গিয়েছিল হৃদয় আর সে।তখন রাস্তায় সার্থক তাকে ডাক দিলে মুখ ফিরিয়ে চলে অথচ।আর এখন..এখন কী অঘটন’টাই না ঘটলো!
সার্থক পা নাড়তে চাইলে আলো অগ্নি-দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আবার কী নাটক করতে চাইছো?”
সার্থক অসহায় কন্ঠে বলে,”আমি নাটক করছি?”
আলো তার সুর না পাল্টিয়ে বলে,”মাঝ রাস্তায় তামাশা করাটা নাটক নই?কে বলেছিল আমার পিছু পিছু আসতে?”
-“আফসোস আজ মরে যায়নি!”
আলোর বুক কেঁপে উঠে।কী সব বলছে সার্থক!সে মরে গেলে..আলো বাঁচবে কী নিয়ে?সার্থক কী তার মনের অবস্থা বুঝছে না?
সার্থক আবারো বললো,”আমার ভুলের শাস্তি হয়তো একমাত্র মৃত্যু!নাহলে এতদিনেও কিচ্ছুটি পরিবর্তন হলো না।”
আলো চুপ করে রইলো।সার্থক কী খুব বড় অন্যায় করেছে?আলো নিজেও জানেনা সে কেন পারছে না সার্থকের সাথে নরমাল হতে।তার কারণ কী ইগো?নাকি রাগ?
আলো উঠে আসতে চাইলে সার্থক বললো,”আলো,আমি বলবো না আমাকে ক্ষমা করো।তুমি নিজের জীবনটা বরং আমি বিহীন গুছিয়ে নাও।আমি সেই কীট যে তোমার জীবনের অন্ধকার!”
আলো পেছন ফিরে তাকালো।সার্থকের চাহনিতে অনুশোচনা স্পষ্ট।তারমানে আলো নিজে সফল হয়েছে!
‘অনুশোচনা’ শব্দটা সার্থককে প্রতি মুহুর্তে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।এই শাস্তি সব কিছুর উর্ধ্বে।কারো শারীরিক শাস্তির চেয়ে মানসিক শাস্তিটাই বেশি কার্যকর।
.
আলো কেবিন থেকে বের হতে হৃদয়ের সামনে পড়লো।তারা কেবিন থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো।হৃদয় বললো,”সার্থকের কথা বার্তায় অনুতাপ স্পষ্ট।দেখ আলো,দুই মাস হয়ে গেছে তুই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস।সার্থক শাস্তি পাচ্ছে এখন।আজ বা কাল আমরা যে কেউ মারা যেতে পারি।আজ দেখলি না,এক সেকেন্ডের জন্য সার্থক বেঁচে গেল।তখন কিন্তু উল্টে টাও হতে পারতো।ফলাফল তখন তুই নিজে বেঁচে থেকেও মরে যেতি।আজ আছি,কাল নেই।কী দরকার নিজের ইগো দেখিয়ে এড়িয়ে চলার?যতদিন আছি ভালো থাকি,ভালো রাখি।বাকিটা তুই বুঝিস।”
.
হৃদয়ের কাঁধে ভর দিয়ে সার্থক হাঁটতে লাগলো।পিছু পিছু আলো আসছে।সার্থক প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেও কোনো প্রশ্ন করলো না।হৃদয় সিএনজি দাঁড় করিয়ে দিতে আলো সার্থককে নিয়ে গাড়িতে বসলো।হৃদয় ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলো।এবারে সার্থক প্রশ্ন করলো,”তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
আলো স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,”কেন?আমার বাড়িতে যাচ্ছি।”
.
আজ পুরো নয় মাস দুইদিন পর নুপূরের পেইন শুরু হয়েছে।বয়স্ক মহিলাটি তাদের এলাকা বেশ কয়েকজন মহিলাকে ডেকে এনেছেন।নুপূরের চিৎকারে গাছের পাখিরাও ভয় পাচ্ছে।তখন এক মহিলা তার মুখে কাপড় দিলো।এত কষ্ট বোধ-হয় অন্য কোনো নারী পায় না যতটা একজন মা পায়।
এক ঘন্টার ব্যবধানে নুপূরের জন্ম হলো ফুটফুটে কন্যা সন্তান।নুপূর এক পলক তার সন্তানের দিকে তাকালো। কেমন কাঁদছে কন্যাটি!নুপূর তার চোখের কোণের জল মুছে নিলো।আজ থেকে যুদ্ধের প্রথম দিন।কাঁদতে মানুষ দূর্বল হয়।নুপূর কখনই দূর্বল হবে না।
বয়স্ক মহিলাটি নুপূরের কাছে তার মেয়েকে দিতে চাইলে নুপূর বহুকষ্টে বলে,”না চাচি।ও কে আমি ছুঁ’বো না।”
নারীর অন্যতম দূর্বল জায়গা তার প্রথম সন্তান।নুপূর জানে মেয়েটার দিকে আর কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে পুরো দুনিয়া ভুলে তাকেই নিয়েই পালিয়ে বাঁচতে চাইবে।তাই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো।কষ্ট কী তার নিজের হচ্ছে না?হচ্ছে,অবশ্যই হচ্ছে!কথায় আছে,”কোনো মা পারেনা তার সন্তানকে দূরে সরাতে।” কিন্তু নুপূর তো এখন সেই কঠিন কাজটাই করছে!
আরো দুই ঘন্টা বাদে নুপূরের কাছে সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর ফোন এলো।তিনি বললেন সন্তানটিকে দিনাজপুরে হাসপাতালে রেখে আসতে।কিন্তু নুপূরের অবস্থা বেগতিক হওয়ায় সে যেতে পারলো না।বয়স্ক মহিলাটিই তার কন্যাকে সুখ সাগরে নিয়ে গেল।আদৌ কী তার কন্যাকে আলো মায়ের রুপ দেখাবে?না-কি দূরেই ঠেলে দিবে?এমনটা হলে নুপূর মেয়েকে নিজের কাছেই রাখবে,অন্য কোথাও সুরক্ষিত রাখবে।
.
তৃতীয় বারের মতো মিসক্যারেজ হওয়ার পর আলো খুব ভেঙ্গে পড়েছে।সে জানে না তার উপর কোন অভিশাপের ছায়া দাঁড়িয়ে।কিন্তু সে যে কোনোদিন মা হতে পারবে না তা স্পষ্ট।সংসারী নারী যেমনটা তার স্বামীকে ভালোবাসে তেমনই তারা সন্তানের চাহিদাও রাখে।সন্তান তাদের কাছে অমূল্য সম্পদ।আলো বার বার তার ছায়া দেখেও হারাচ্ছে।এটা কী মরিচীকা নই?
আনমনে আলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিল।তার এখন কান্না পায় না,অথচ খুব করে চায় কাঁদুক।সার্থক তার আশে-পাশে পুরোটা সময় থাকছে।এই একটা বিষয়ে আলো অতি মুগ্ধ।
এ যদি আগের সার্থক হতো, তাহলে আলোর উপর রেগে থাকতো।বলতো,”তোমাকে বলেছিলাম কনসিভ না করতে,আমরা দত্তক নিবো।কিন্তু তুমি?তোমার বার বার কষ্ট পেতে ভালো লাগে।”
তবে এখনকার সার্থক বলছে ভিন্ন কথা।বলছে,”আলো,যা হওয়ার হয়ে গেছে।আল্লার যা চান তাই তো হবে।তুমি নিজেকে শক্ত রাখো।ইনশাআল্লাহ,একদিন সব ঠিক হবে।”
এই পরিবর্তন হয়েছে সেদিনের পর থেকে।নুপূর নামের ঝড়টা তার জীবনে এসে ভালো কিছু উপহার দিয়ে গেছে।সব খারাপের পেছনে কিছু ভালোও লুকিয়ে থাকে।কিন্তু ভালোটা থাকে ধূলোই ঢাকা,তাকে ঝেড়ে তার অস্তিত্ব খুঁজতে জানতে হয়।
এমন ভাবনায় আলো ডুব দেয় যে তাই সেলফোন বেজে উঠলে কেঁপে উঠে।আলো মোবাইলেট দিকে তাকিয়ে দেখে টেলিফোন নাম্বার।ভ্রু কুঁচকে সে রিসিভ করে।তখন ওপাশ থেকে এক নারী কন্ঠ বলে,”আপনি কী মিসেস আলো বলছেন?”
-“হ্যাঁ।আপনি কে?”
-“আমি দিনাজপুর মেডিক্যাল হসপিটালের স্টাফ বলছি।আপনার নামে একজন বাচ্চা রেখে গেছেন।যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাটিকে নেওয়া ব্যবস্থা করুন।”
-“বাট ম্যাম…”
-“তাড়াতাড়ি আসুন।”
আশ্চর্যের উঁচু চূড়ায় পৌঁছে যায় আলো।তার নামে বাচ্চা কে রাখবে?আলো তার রুমে এসে সার্থককে সবটা জানালো।একই ভাবে সার্থকও অবাক হলো।কিন্তু দু’জনে ভাবা-ভাবি শেষ করে দিনাজপুরের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলো।
.
আলো অনেকটা হাঁপিয়েই হাসপাতালে পৌঁছালো।খোঁজ নিয়ে সে স্টাফের কাছে গেল।আলোকে দেখে স্টাফটি বললো,”ঢাকা থেকে এসেছেন নাকি?আসুন..”
আলো আর সার্থক স্টাফের পেছন পেছন গেল।দোলনায় বাচ্চাটি কান্না করছে।আলোর চোখে জল চলে এলো।তখন তার মনে প্রশ্নও জাগলো না কার সন্তান এটি?সে আলতো করে বাচ্চাটিকে কোলে নিলো।এই ছোট্ট বাচ্চাটি জাদু জানে,না-হয় এতদিন কান্না না করা আলো এত কাঁদতো না।নাকি মেয়েদের চোখের জল কখনও শেষ হয়না?
সার্থক স্টাফের সাথে কথা বলে জানতে পারলো একজন বয়স্ক মহিলা এসে তাকে সন্তানের সাথে তাদের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল।সার্থকও ভেবে পাচ্ছিলো না কে করতে পারে এই কাজ?দিনাজপুরে তার জানা-শোনা তো কেউ নেই।
আলো বাচ্চাটিকে কোলে নিলে সার্থক খেয়াল করে বেডে একটা চিরকুট পড়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে সে সেটি হাতে নিলো।আলো বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিষয়টি তার নজর এড়ালো।সার্থক দেখলো চিরকুটে মাত্র দুটি শব্দ।”ইতি-নুপূর”
চমকে উঠলো সার্থক।এতদিনে মেয়েটির কথা তার মাথায় বিন্দুমাত্রও আসেনি।এই কন্যা তাহলে নুপূরের?নুপূর দিনাজপুরে?
সার্থক এক পলক আলো আর বাচ্চাটির দিকে তাকালো।কতদিন পর আলো সুখের কান্না কাঁদছে।নুপূরের বাচ্চা বললে আলো কী দূরে সরাবে?
মনের মধ্যে খুঁত খুঁত তা বেড়েই চলছে।অবশেষে সার্থক সিদ্ধান্ত নিলো আলোকে জানাবে না এই কন্যা কার।তার হৃদয় হরণীর কাছে এটা ধাঁধায় থাকুক।হয়তোবা কোনো একদিন সন্দেহ করবে কিন্তু নিশ্চিত হবে না।
সবসময় সব কিছু পরিষ্কার করা ভালো নই।কখনও কখনও গোলকধাঁধায় রাখা উচিত।উত্তর সে নিজে খুঁজে বেড়াক!
(সমাপ্ত)
(রিচেক করা হয়নি,অনেক ব্যস্ততায় লিখেছি,বানান ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন।)