@হৃদয় হরণী
#পর্ব_০৫
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু
আলো পা দু’টো আড়াআড়ি করে ছাঁদে বসে আছে।তার মুখের হাসি নেই তবে গত কয়েকদিনের চেয়ে অবস্থা অনেকটাই ভালো।দু’দিনে যা জ্বর হয়েছিল!আলো এক পানে
কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে।পুরো গাছটা রঙিন হয়ে আছে।কৃষ্ণচূড়ায় এক অদৃশ্য শক্তি আছে।এই ফুল সবাই পছন্দ না করলেও খুব কম মানুষই অপছন্দ করে।কৃষ্ণচূড়াকে সবাই গাছে দেখতে পছন্দ করে।
আলো তাদের মধ্যেই একজন।সার্থক আগে কৃষ্ণচূড়া নিয়ে কত কবিতা,ছন্দ তৈরি করতো।যখনই আলোর মন খারাপ হতো টুস করে কবিতা বলা শুরু করতো।
কলেজ থেকে বিদায়ের সময় আলোর মন খারাপ ছিল।আলো চারটা বছর এই কলেজে ছিল ছেড়ে যেতে মায়া তো লাগেই!তখন কেউ একজন তাকে পেছন থেকে চোখ বন্ধ করে দেয়।আলো ঘাবড়াতে যেয়েও ঘাবড়ায় নিই।কারণ সে বুঝে নিয়েছিল সার্থকই তার চোখ বন্ধ করেছে।
প্রায় দশ মিনিটের মতো হাঁটিয়ে আলোর চোখ থেকে হাত সারায়।আলো পেছন ফিরতে কৃষ্ণচূড়ার বর্ষণ শুরু হয়।আবেশে সে চোখের পাতা বন্ধ করে নেয়।
সেকেন্ড কয়েক শেষ হতে সার্থকের দর্শন পায় সে।আলো দেখে সে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়া।দৃষ্টি কৃষ্ণচূড়া ফুলে আটকাতে বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাগলো।দৃশ্যটা এমন যে আকাশে উড়ন্ত সাদা-নীল মেঘগুলোর মতো কৃষ্ণচূড়াও তার একটি অংশ।এই এক টুকরো মেঘটির রঙ লাল!লাল রঙের মেঘটিই আলোর মনের সমস্ত হতশা মুছে দিতে বৃষ্টি হয়ে নামে।
সার্থক তার দৃষ্টি আলোতে স্থির রেখে মুগ্ধ চাহনিতে বললো,”এই নারী যদি,এই নারী যদী কৃষ্ণচূড়ার এক ফালি মেঘ হয়,তবে আমি বৃষ্টি হতে প্রস্তুত!”
আলো ভ্রু কুঁচকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।সার্থক আবার বললো,”তোমার কৃষ্ণচূড়ার প্রতিটা রঙিন কাব্যে,প্রতিটা পাতায় আমার নাম লিখে রেখ হৃদয় হরণী!”
হৃদয় হরণী!এই একটা ডাক তার হৃদয় ছোঁয়ে যায়।কেঁপে উঠে সারা অঙ্গ।এই ডাকে সে আজীবন সাড়া দিতে প্রস্তুত।
কত নিমিষেই না আলোর হতাশা দূর করতো সার্থক।অবশ্য আলো সার্থক ছাড়া কিছু বুঝেও নিই।তাই সব ভুল মেনে নিতো।কিন্তু বর্তমানে….
.
-“এই পেত্নী কী ভাবিস?”
হৃদয়ের ধাক্কাতে আলোর ধ্যান ভাঙলো।মাথা নেড়ে সে কিছু না বললো।আলো প্রশ্ন করলো,”ব্যাবসায় লস খাচ্ছিস নাকি?দিন দিন এভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিস কেন?”
হৃদয় আফসোসের ভঙ্গিতে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,”কী আর করবো বল!বউ আগের মতো যত্ন নেয় না।”
আলো হৃদয়ের কথায় রিয়েকশন দেখানোর আগে তাসনিন উড়ে এসে বলে উঠলো,”বউ যত্ন নেয় না?এই তোর কী যত্ন করবো বল,এক্ষুণি বল কোন ক্ষেতের মুলা এনে তোকে খাওয়াতে হবে।”
হৃদয় আমতা আমতা করে বলে,”আরে আমি মজা করছি।মজা বুঝো না?ফান,ফান।”
-“ফান আমার জুতায় মিশে যাক।আজকে তোমার এমন যত্ন করবো জীবনেও বলবে না আমার কারণে শুঁটকি হচ্ছো।”
তাসনিন এটুকুতে থেমে গেলে ঝগড়া থেমে যেত। কিন্তু সে বিড়বিড় করে বললো,”দেখলে মনে হয় কংকালের মামাতো ভাই।এর চেয়ে তো চিকনা ভূতই বেশি সুন্দর।”
হৃদয়ের কানে কথা গুলো পৌঁছাতে ক্ষেপে গিয়ে বললো,”কী বললে তুমি?আমাকে নিয়ে তোমার মনে এইসব ফন্দি করেছো?তোমার চেয়ে তো রুপচাঁদা সুন্দরিই বেশি সুন্দর।”
-“ছিঃ,ছিঃ।অবশ্য তোমার চয়েস রুপচাঁদা সুন্দরী পর্যন্তই থাকবে।শুঁটকি মাছ + রুপচাঁদা সুন্দরী।বেস্ট কাপল!”
আলো পড়ে গেলো দুজনের মাঝখানে।সে এতক্ষণ ধরে মিটিমিটি হাসছিলো।নিজের হাসি কোনো মতে আটকিয়ে প্রশ্ন করলো,”রুপচাঁদা সুন্দরী মানে গলির পাগলিটা?”
তাসনিন আলোকে নিজের দিকে মুখ করে বলে,”এই পাগলের সৌন্দর্যই তোমার বন্ধু দেখলো।ভূতের চোখে সুন্দর আর কতটুকুই বা হবে!”
আলোকে হৃদয় এক হাত ধরে টান দিয়ে নিজের দিকে করে বললো,”যে ভূত ভূত করছে না, তাকে বলে দেয় আয়নায় গিয়ে নিজের শাঁকচুন্নির মতো চেহেরাখানা দেখতে।প্রতিদিন নিজেকে আয়নায় দেখে দেখে মাথায় ভূত চেপেছে।”
একইভাবে তাসনিন তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”হা হা হা!জোক্স,জোক্স!একখানা তাজা ভূতের সাথে থাকলে মানুষের মাথা কী আর ঠিক থাকে?চোখ দুটো যেন চোখ নই হাঁসের সদ্য পাড়া ডিম।কপাল তো,মাশা-আল্লাহ!এত বড় যে এগারো জন ফুটবল খেলতে পারবে।”
পাশের বাড়ির ছাঁদ থেকে ছয়-সাত বছরের বাচ্চা ছেলে বলে উঠলো,”হাঁস সদ্য একটা ডিম পাড়ে।হৃদু আঙ্কেলের চোখ একটা বড় একটা ছোট?”
তাসনিন কোমরে দু’হাত দিয়ে বাচ্চাটিকে ধমকিয়ে বললো,”আব্বে তুই চুপ।প্রতিদিন আমাদের কথায় তোকে নাক ঢুকাতে কে বললে?বেতন দেয় কেউ?”
হৃদয় দাঁত খিলখিলিয়ে হেসে বলে,”হা হা হা!এই না হলে মানুষের বাচ্চা!কোথাকার মূর্খ মহিলা লজিক ছাড়া কথা বলে,ভুল তো ধরবেই।চুন্নিগিরি মাছ ভাজা চোর।”
বাচ্চাটি তখন বললো,”প্লিজ স্টপ আঙ্কেল-আন্টি।পপকর্ণ নিয়ে আসছি।”
আলো ভিতরে ভিতরে হাসলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছে না।এরা দু’জনে টম এন্ড জেরির মতো লড়তে থাকে।এখন আলো হাসলে বোমাটা তার মাথার উপর ফাটবে।আলো চুপি চুপি পালাতে চাইলে হৃদয় আবার টেনে মাঝখানে দাঁড় করায়।তারপর বলে,”এই ময়লার প্রধানমন্ত্রী,নাক ফাটা বেলুনকে বল ভদ্রভাবে কথা বলতে।”
আলোকে তাসনিন নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”নিজের বর্ণনা কী আমার চেহেরায় দেখছে?ভদ্রতা কাকে বলে,কত প্রকার ও কী কী তার প্রশিক্ষণ আমার কাছ থেকে নেয় মানুষ।”
হৃদয় আলোকে নিজের দিকে ঘুরানের আগেই আলো তারদিকে ঘুরে গেল।হৃদয় বললো,”তাইতো বলি আজকাল অভদ্রের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কেন।প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তাহলে এখানে?”
তাসনিন রেগে বললো,”চুপ বান্দের চাচাতো ভাই।হিরো আলমের পিডিএফ।”
-“তুই ছকিনার পিডিএফ,ফটোকপি।”
-“তুই।”
-“তুই”
আলো মাথা নিচু করে তাদের দু’জনের মাঝখান থেকে পালিয়ে এসেছে।এখন দু’জনে একে অপরকে আঙ্গুল দেখিয়ে ঝগড়া করছে।যাকে বলে পায়ের উপর পা দিয়ে ঝগড়া করা।
আলো দূর থেকেই মজা পেয়ে হাসছে।হাসতে হাসতে আলো হৃদয়ের মায়ের সাথে দেখা করতে চলে আসে।
আড়চোখে আলোর চলে যাওয়া দেখে তাসনিন বললো,”হয়েছে,ঢং অফ করো।আলো চলে গেছে।”
-“হেঁসেছে?”
-“হাসবে না আবার?তাসনিন বলে কথা।”
হৃদয় ছাঁদ থেকে চলে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে তাসনিন বলে উঠলো,”বাই দ্যা ওয়ে,তোমার সাথে সত্যি সত্যি কংকালের একটা সম্পর্ক আছে।”
.
হৃদয়-তাসনিনের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’মাস।তাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়েছে।পূর্ব পরিচয় বলতে বিয়ের আগে কয়েকদিন ফোনালাপ।অথচ,দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা প্রগাঢ়।পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য বোধ হয় আন্ডারস্ট্যান্ডিংটাই বেশি জরুরি।ভালোবাসা,বিশ্বাস দু’টোই পরস্পর বোঝাপড়ার পরে জন্ম নেয়।
আলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।এমনটা নয় যে তার সংসারে আন্ডারস্ট্যান্ডিং নেই বরং এমনটা যে সার্থক বুঝে না।বা বলা যায় দুই লাইন বেশি বুঝে।ছ’বছরের সম্পর্কে আলোই বেশি স্যাক্রিফাইস করেছে।নাকি সংসারে নারীকেই বেশি ছাড় দিতে হয়?
বিয়ে পর এক সংসারী নারীই সবচেয়ে বেশি ত্যাগ করে।জন্মের পর বেড়ে উঠা পরিবেশ থেকে হুট করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।এটুকুতে নারী নিজেকে সামলাতে পারতো কিন্তু দিন কাটিয়ে রাত হতে নতুন আরেক পরিবার!নতুন চেহেরা,নতুন সম্পর্ক।তার কাঁধে তুলে দেওয়া হয় পুরো সংসারটা।দেবর,ননদ,শ্বশুর-শাশুড়ি,স্বামী প্রত্যেকের মন জয় করে তাদের মনে স্থান তৈরি করা।যদি তাতে ব্যর্থ হও তাহলে নারী তুমি ভালো না।এরপর আসে সন্তান…জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে তাকে প্রকৃত মানুষ করা মুখের কথা নয়।সংসারী নারীর এক লাইনে পরিচয়-সবার প্রথমে ঘুম থেকে উঠা আর সবার শেষে ঘুমানো।।কারণ তারা এই যুদ্ধের নিয়মিত যোদ্ধা।
তবুও শেষে তারা হাঁসে।শ্বশুর-শাশুড়ির একটুখানি দোয়া গ্রহণেই তার সুখ।স্বামী এক টুকরো ভালোবাসা তারা মনে করে, “এইতো চাঁদখানা হাতে পেলাম”।সন্তানের হাসিতে তারা আজীবন হেঁসে যেতে পারে।কেউ মনে করে নারীর কোনো বাড়ি নেই, তারা প্রথমে বাবার বাড়ি তারপর স্বামীর বাড়ি।কিন্তু অন্যজনের মত,নারী বাড়ি দুইটা।এক বাবার বাড়ি দুই.স্বামীর বাড়ি।যার দৃষ্টি ভঙ্গি যেমন!
আলো কক্ষে প্রবেশ করে দেখলো হৃদয়ের মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।এক মাস আগে থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে বেড রেস্টে আছে।আলো পাশে বসে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো।তখন তিনি চোখের পাতা মেলে আলোকে এক পলক দেখলেন।মৃদু হেসে আলো পাশের চেয়ারে বসে বললো,”খুদা লেগেছে?খাবে কিছু?”
তিনি মাথা না বোধক নাড়লেন।আলো উনার হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বললেন,”স্যূপ করেছি আমি।একটু খাও..”
এবারে উনি মুখ খুলে বললেন,”একটু পরে খাবো।হৃদু এসেছে?”
-“এসেছে মানে?ফুল মুভি করে ফেলছে।”
-“মানে?”
-“দু’জনে আবার ঝগড়া করছে ছাঁদে।”
তারা দু’জনে এক সঙ্গে হো হো করে হেঁসে ফেললো।হৃদয়ের মা বললেন,”আমি অনেক ভাগ্যবতী রে,তাসনিনের মতো মেয়ে আমার ছেলের বউ হলো।আমার সংসার কত সুন্দর করে সামাল দিচ্ছে!আর আমি মেয়েটাকে তার বাবার বাড়িতেও পাঠাতে পারিনি কয় মাস!কিছু দিতে পারলাম না ওকে।”
আলো উনার হাত নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরে চুমু খেয়ে বললো,”এই যে তুমি বলছো,”আমি অনেক ভাগ্যবতী”।এই একটা বাক্যই তোমাদের ছেলের বউদেরকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।আমরা বউমারা এই বাক্য শুনলেই সবচেয়ে সুখি!”
তার কিছুক্ষণ পর আবার বললো,”আচ্ছা, ওদের দু’জনকে আজকেই তাসনিনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই?কয়েকদিন থেকে আসুক আমি যখন বাড়িতে আছি।”
-“কতদিন থাকবি এভাবে?এক সপ্তাহ হয়ে গেল,সার্থক প্রতিদিন তোকে নিতে আসে কিন্তু তুই তার সামনে যাস না।তুই যে এভাবে চলে এলি তোর সংসারটা কে সামলাচ্ছে?”
আলো চুপ করে রইলো।এত জলদি সে সার্থকের কথায় সায় দিবে না।সে বললো,”আর কিছু দিন যাক।শুয়ে থাকো তুমি,আমি স্যূপ নিয়ে আসছি।”
আলোর মনটা কী তেঁতো হয়ে গেছে?আগে তো এমন ছিলো না।আগে ঝগড়া হওয়ার পর সার্থক একবার মাফ চাইলে সব ঠিক হয়ে যেতো।কিন্তু এখন সাতটা দিন সার্থক কি’না করছে!তবুও তার মন গলছে না।মনের দরজা বন্ধ হলে খোলা বোধহয় বেশি কঠিন।
.
সার্থক অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।তখন পেছন থেকে আসমা সিদ্দিকা বলে উঠলো,”কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
বিরক্ত হয়ে সার্থক বললো,”মা তুমি প্রতিদিন একই প্রশ্ন কেন করো?তুমি জানো যে আমি আলোকে আনতে যাচ্ছি।”
ক্রোধে তিনি বাজখাঁই গলায় বললে,”ঐ মেয়েকে প্রতিদিন আনতে যাস তুই।কিন্তু ফিরেছে কোনোদিন?ম্যাডামের তো রাগ উপচে পড়ছে।মেয়ে মানুষের এত তেজ ভালো না।”
সার্থক কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলো।মা মানুষটি কারণ বা অকারণে রেগে গেলে চুপটি করে সরে যাওয়ায় শ্রেয়।
(চলবে)
বি.দ্র-০২:বানান ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।