@হৃদয় হরণী
#পর্ব_০৩
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু
নুপূর বাড়িতে ঢুকতে স্বর্ণা তার সেলফোন এগিয়ে দিলো।নুপূর বুঝলো না সে স্বর্ণার ফোন নিয়ে কী করবে?স্বর্ণাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে ফোন থেকে শব্দ হয়,”হ্যালো,নুপূর?”
নুপূর বুঝতে পারে তার সাথে কেউ কথা বলতে চাইছে।সে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে কানে লাগালো।তখন ওপাশ থেকে কেউ একজন বললো,”নুপূর,আপনার সাথে আমি পার্সোনালি কিছু কথা বলবো।আশা করি আপনি শুনবেন।”
ছোট করে নুপূর ‘হু’ বললো।সে জানে ওপাশের ব্যাক্তি কে?তবুও সে জানতে চায় কী বলবে ব্যাক্তিটি?
.
এত গরমেও আলোর হঠাৎ ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো।জ্বর আসার লক্ষণ এটি।মাথা থেকে সে সার্থককে সম্পূর্ণ রুপে বের করতে চাইছে অথচ মাথা থেকে ভাবনা সরছেই না।সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেজেতে।তার মনে পড়ছে সেই দিনের ঘটনা যেদিন সার্থক তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়।
কলেজের ক্লাস শেষ করে আলো আর হৃদয় আসছিলো।তখন সার্থক এসে বলে,”হৃদয়,আলোকে বাসায় আমি ড্রপ করে দিবো।তুমি চলে যাও।”
সার্থকের এমন কথায় আলো-হৃদয় দুজনে বেশ অবাক হয়।কিন্তু সার্থকের সাথে ভালো বন্ধুত্ব থাকাই না করতে পারেনি।তার বাইকে করে বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলে সার্থক মাঝপথে বাইক থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়।হঠাৎ গাড়ি থামাতে আলো নেমে সার্থকের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়।তখন হুট করে সার্থক বলে বসে,”আই লাভ ইউ।”
সার্থকের এমন কথায় আলো ভ্যাবাচেকা খেল।সে প্রশ্ন করে,”মানে কী?”
-“অর্নাসে পড় তুমি অথচ আই লাভ ইউ’র মানে বুঝো না?”
-“বুঝবো না কেন?আমাকে কেন বলছো?”
-“যাকে ভালোবাসি তাকে আই লাভ ইউ বলবো না তো কাকে বলবো?”
আলো আগেই ধারণা করেছিল সার্থক তাকে ভালোবাসে।নারীর তৃতীয় চক্ষু খুবই কার্যকরী।তারা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারে কোন ছেলের কী উদ্দেশ্য!
আলো উত্তরে কিছু বলেনি।ঠোঁট কামড়ে হাসি থামাতে ব্যস্ত সে।তা দেখে সার্থক রেগে বললো,”তোমার মজা মনে হচ্ছে?”
এ কথা শুনে আলো হাসি থামাতে পারলো না।খিলখিল করে হাসতে হাসতে বাইকে হেলান দিয়ে বললো,”সরি সরি,তোমার প্রপোজাল দেখে না হেঁসে পারছি না।”
সার্থক গাল ফুলিয়ে বাইকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।আলো একসময় হাসি থামিয়ে বলে,”চলো,যাওয়া যাক।”
সার্থক বলে উঠে,”মানে?তুমি আন্সার দিবে না?”
-“কিসের আন্সার?”
-“মজা করছি আমি?”
-“তোমার ‘আই লাভ ইউ’ বলতে ইচ্ছে হলো তাই তুমি বললে আমার বলতে হবে এমন কোনো বাধ্যকতা নেই।আর এমন শুকনো প্রপোজাল তো আমি জীবনে এক্সপেক্ট করবো না।”
-“শুকনো?বৃষ্টি কোথায় পাবো আমি?”
আলো মাথায় হাত দিয়ে বলে,”হায় আল্লাহ!এখন উনি বৃষ্টি খোঁজেন,বললাম কী বুঝলো কী!”
সার্থক বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে বললো,”আমার অগোছালো, অভিমানী শহরে তোমার নিমন্ত্রণ হৃদয় হরণী!”
পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় হুট করে স্টার্টে আলো সার্থকের পিঠে ধাক্কা খায়।আলো তার মুন্ড সার্থকের পিঠ থেকে আর তুলেনি।
অতীতের ডায়েরি থেকে বেরিয়ে আলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।সম্পর্ক তাদের প্রথমে ছিল বন্ধু,বন্ধু থেকে প্রেমের সম্পর্ক,তারপর বিয়ে!বিয়ে অতো সহজ ছিল না কারণ দু’জনে তখন সবে পড়াশোনা শেষ করেছে আর ব্যাচমেইট।অনেক কষ্ট করে তাদের বিয়ে হয় অথচ এখন?এখন দু’জনে আলাদা!
সার্থক এতদিন অভিনয় করেছে তার সাথে,এত নিখুঁত অভিনয় যে সে কিছু টের পায়নি।কষ্ট হচ্ছে আলোর নিজের ভাগ্যের উপর!আচ্ছা সার্থক কী নুপূরকে ভালোবাসে?ধুর,ভালোবাসে বলেই তো বিয়ে করলো আর মেয়েটি প্রেগন্যান্ট!
আলো খুব কাঁদছে কিন্তু সেই কাঁদায় কোনো জল নেই।বিরক্ত সে নিজের উপর কাঁদতে কাঁদতে।
তখনই হৃদয় চা নিয়ে তার রুমে আসলো।এক পলক তাকিয়ে আলো চায়ের কাপ নিলো।
হৃদয় স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,”কাঁদতে ইচ্ছে করলে কেঁদে নে।”
আলো ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর দিকে তাকালো।কিছু না বলে নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিলো।হৃদয় আবারো বললো,”বিজ্ঞান কী বলে জানিস?কান্না পেলে অনেকটা আবেগি হয়ে কাঁদুন,কারণ এতে করে কাঁদার ফলে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্ট্রেস হরমোন এবং টক্সিন থাকে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।মূলত কান্না শরীরকে এক প্রকার বিষমুক্ত করে ফেলে।পাশাপাশি এন্ডরফিন হরমোন তৈরি হয় যা মনকে সতেজ করে তুলে আর ভালো অনুভব হয়।”
আলো কটমট করে হৃদয়ের দিকে তাকালো।এই সময় কী বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করার?
আলো তার উপর রাগ ঝাড়ার আগে কক্ষে হৃদয়ের স্ত্রী প্রবেশ করলো।তখন হৃদয়ের স্ত্রী তাসনিন বললো,”কী হয়েছে?”
হৃদয় মৃদু হেসে বললো,”কই কিছু না।আলোকে কাঁদার উপকারিতা শেখাচ্ছিলাম।”
আলো আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,”চুপ।তুই একটা কথাও বলবি না।”তারপর তাসনিনের উদ্দেশ্য বললো,”কাকিমা ঘুম থেকে উঠেছেন?”
-“নাহ,আম্মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে।এখন জাগবে না।”
-“ঘুমের ওষুধ কেন দিলে আবার?”
-“হৃদয় তোমাকে আনতে যাওয়ার পর আম্মা চিৎকার চেঁচামেচি করে তাই নার্স ইনজেকশন দেয়।”
-“ওহ।”
-“তোমার কথা বলো,কী সিদ্ধান্ত নিলে?”
তাসনিনের প্রশ্ন আলো চুপসে গেল।কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি সে এখনো।কী সিদ্ধান্তই বা নিবে?
তখন তাসনিন বললো,”বাই চান্স,তুমি ডিভোর্সের কথা ভাবছো না তো?”
.
আসমা সিদ্দিকা নুপূরকে খোঁজছেন সন্ধ্যা থেকে।অথচ মেয়েটার দেখা নেই।বাগানেও দু-তিন দেখে এসেছেন।শেষে তিনি স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলে স্বর্ণা উত্তরে জানায় সে জানে না।সন্ধ্যা পেরিয়ে নিশি নামতেই তার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল।তিনি অতি দ্রুত কথাটি স্বামীর কানে তুললো।কিন্তু শারদ বিপরীত কোনো ইঙ্গিত দিলো না।বাধ্য হয়ে তিনি বললেন ছেলেকে।
এদিকে আলোর চলে যাওয়ায় সার্থকের মন মরা,মায়ের কথা সে কানেই তুললো না।কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই চেঁচামেচি শুরু হলো বাবা-মায়ের ঘর থেকে।সার্থক গিয়ে তাদের কথোপকথন শুনলো।
শারদ অত্যন্ত রেগে বললেন,”আশ্চর্য কথা বলছো তো তুমি আসমা।ঐ মেয়ে কোথায় উধাও হলো সেটা আমি জানবো?”
একই স্বরে আসমা সিদ্দিকা বললেন,”তোমরাই নুপূরের কিছু একটা করেছ।নাহলে ও কে খোঁজে দেখছ না কেন?”
-“আসমা,বাড়াবাড়ি করো না।আলো প্রতি তোমার সব অন্যায় মেনে নিয়েছি বলে ভেবো না ঐ মেয়ের প্রতি গোমার আদর মানবো।”
-“তোমার বউমার যেতে ইচ্ছে হয়েছে গিয়েছে,বাপের বাড়ি তো নাই।পর পুরুষের বাড়ি গিয়ে উঠলো।”
এই পর্যায়ে সার্থক কথা বললো,”মা,বাজে কথা বলো না।”
আসমা সিদ্দিকা বিছানায় বসে আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে কেঁদে বললেন,”আমি তো বাজেই বলি।গর্ভবতী বউটা যে কোথায় গেল,তার খবর নেই।”
মায়ের এমন কথায় সার্থকের টনক নাড়া দিলো।নুপূর কী সত্যি বাড়িতে নেই?
সে দৌঁড়ে বোনের রুমে গেল।সরাসরি স্বর্নাকে প্রশ্ন করলো,”নুপূর কোথায়?”
-“জানিনা।”
-“পুরো বাড়ি দেখেছিস?”
-“মা দেখেছে।”
-“কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?”
স্বর্ণা উত্তর দিলো না।সে ভাইয়ের দিকে দু’টো চিঠি এগিয়ে দিলো।সার্থক ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,”এসব কী?”
স্বর্ণা কথা বলা অর্থহীন মনে করলো।সে চিঠি দুটো ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো।স্বর্ণার মতে বেশি কথা বলা কণ্ঠনালির জন্য ক্ষতিকর।
.
‘সার্থক বাবু,
আপনি আমাকে এই ঢাকা-শহরে এনেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।আমি যদি শুরুতে জানতাম আপনার স্ত্রী আছে তাহলে মরে গেলেও আপনাকে বিবাহ করতাম না।আমি আমার বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে বিবাহ করেছি কিন্তু আমার বাচ্চার জন্য আপনাদের সম্পর্ক নষ্ট হউক আমি চাইনা।আপনি আসার সময় যখন গাড়িতে বলেছেন আপনার স্ত্রী আছে তখন আমি জানতাম এমন প্রলয় অবশ্যই হবে।কোনো নারীই চায় না নিজের সতিন আসুক।আপনি বলেছেন আপনাদের সম্পর্কে বিশ্বাস দৃঢ়।কিন্তু আমাকে বিবাহ করে আপনি বিশ্বাস ভেঙ্গেছেন।তাহলে আলো দিদি কেন বিশ্বাস করবে?যেটা আপনি প্রথমেই ভেঙ্গে ফেলেছেন।দিদি যদি আরেকজন পুরুষকে বিয়ে করতো তাহলে আপনার চিন্তা-ভাবনা কেমন হতো ভেবে দেখুন।
আপনার দ্বারা আমি নিজের শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছি।আমার থাকার জন্য সু-ব্যবস্থা করেছেন তিনি।ভাববেন না আপনি, আমি আমার স্বামীর কাছে ফিরে যাচ্ছি।আমি তার থেকে এই জন্মে পালিয়েই থাকবো।শুধু আপনার কাছে একটাই অনুরোধ আমার সন্তানের পিতার জায়গায় আপনার নাম লিখে দিবেন।ও কে আমি একটা সুন্দর জীবন দিতে চাই যার জন্য এত যুদ্ধ!আশা করি আপনি আর আলো দিদি আমার কথাখানা রাখার চেষ্টা করবেন।
গত তিনদিনে আমার জীবনে তুফান নিয়ে এসেছিলাম আমি।গ্রামের লোকজন কখনো আমার খোঁজ করলে জানিয়ে দিবেন আমি ভালো আছি,ভালো থাকবো।অপর চিঠিটা আলো দিদিকে দিলে আমার খুব উপকার হবে।”
ইতি,
নুপূর
.
ঘড়ির কাঁটা রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই।আলো ঘুমানো প্রস্তুতি নিচ্ছে।শরীরটা কেমন হালকা লাগছে।গা-টাও গরম।বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।সার্থককে ডিভোর্স দেওয়ার কথা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।কিন্তু যদি সত্যি দেখা যায় সার্থক নুপূর মেয়েটার সাথে সংসার করছে তাহলে তালাকই দিবে।
চোখে হালকা ঘুম আসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।এতরাতে কে আসলো ভেবে আলো আশ্চর্য হলো।পরক্ষণে সে ড্রয়িং রুম থেকে সার্থকের গলার আওয়াজ পেলো।আলোর বিস্ময় আকাশ ছুঁই ছুঁই!এতরাতে সার্থক এখানে কেন এলো?
হৃদয় আলোকে উঁচু স্বরে ডাকলো।আলো ভেবে পেলো না সে কী করবে?সার্থকের সাথে কথা বলবে না ঘুমের ভান ধরে এড়িয়ে যাবে?
(চলবে)
বি.দ্র:বানান ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন,ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন🌼