হৃদয় হরণী পর্ব-০২

0
1517

@হৃদয় হরণী
#পর্ব_০২
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু

আলো নিজের সেলফোন নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো।এখন একমাত্র হৃদয়ই পারে তাকে সামলাতে।চক্ষে জল নিয়ে আলো কল লিস্টের প্রথম নাম্বারটিতে ডায়াল করলো।দু বার রিং হতে ওপাশে রিসিভ হলো।

আলোর উদ্দেশ্য সে বললো,”হ্যালো,বল আলো।”

বন্ধুর কন্ঠস্বর শুনে আলো উত্তরহীন কাঁদতে লাগলো।কান্নার শব্দ শুনে হৃদয় ঘাবড়ে গিয়ে বললো,”আলো,তুই কাঁদছিস কেন?কী হয়েছে?”
-“হৃদয়…ও”

কান্নার বেগ এতো বেড়ে গেল যে আলো কথা বলতে পারছে না।ওদিকে হৃদয় কী হয়েছে জানার জন্য চটপট করছে।ঠোঁট কামড়ে আলো এক নিঃশ্বাসে বললো, “স্বার্থক আবার বিয়ে করেছে।”
-“কিহ?মাথা ঠিক আছে তোর?”
-“ঠিক বলছি আমি।”

আলো কেঁদেই যাচ্ছে।বান্ধবীর এমন কথায় হৃদয় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।স্বার্থক-আলোর প্রেমকাহিনী এখনও কলেজে সবার মুখে মুখে।স্বার্থক কী করে এমনটা করতে পারে?

নিজের আশ্চর্য হওয়া থামিয়ে হৃদয় প্রশ্ন করলো,”স্বার্থক না অফিসের ট্যূরে বান্দরবান গেল?তাহলে বিয়ে?”
-“জানিনা আমি কিছু হৃদু।”

আলোর কান্না থামার নাম গন্ধ নেই।হৃদয় আবার প্রশ্ন করলো,”তোদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিলো কোনো কিছু নিয়ে?বা টের পেয়েছিস স্বার্থক অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে?”
-“সব ঠিক ছিল।এমনকি ও এক সপ্তাহ আগে ট্যূরে যাওয়ার সময়ও।কী হয়ে গেল হৃদু..”
-“স্বার্থক তোকে কিছু বলেনি?”
-“নাহ,উল্টো মেয়েটার জন্য আমার শাড়ি নিয়ে গেল।”

হৃদয় বলার মতো কোনো শব্দ খোঁজে পেল না।তার ভাবতে হবে,প্রচুর ভাবতে হবে।কী করে স্বার্থক এমনটা করলো?কৈফিয়ত তো স্বার্থককে দিতেই হবে।

ভাঙ্গা স্বরে হঠাৎ আলো বলে উঠলো,”আমি কী করবো হৃদু?আমার বাবার বাড়ির দরজা তো দু বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।আমি কোথায় যাবো?”

গালে লেগে থাকা অশ্রু মুছে পাগলের মতো আলো বললো, “শুন হৃদু…আমি না আমি সুইসাইড করবো।তখন..তখন,”
-“পাগলামো বন্ধ কর আলো।তুই ব্যাগ গুছিয়ে নেয়,আমি নিতে আসছি তোকে।দুপুরে খেয়েছিস?”

ক্রন্দন নিয়েই নিচু স্বরে আলো উত্তর দিলো,”নাহ।”
-“যাহ,কিছু খেয়ে নেয়।আর প্লিজ নিজের অভিমানকে এক পাশে রেখে স্বার্থক কিছু বলতে চাইলে শুনিস।হুট করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কোনো রিজন অবশ্যই থাকবে।”

আলো কিছু না বললো না।চারপাশের সবকিছু বিষাদ লাগছে তার।সবই অন্ধকার তার জন্য।আর যাই হউক,স্বার্থকের সাথে কথা বলতে পারবে না সে।
.
নুপূর তার শ্বাশুড়ির সাথে খেতে এলো।টেবিলে নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছিলো স্বর্ণা।বাকি আর কাউকে নুপূর আশে-পাশে দেখতে পেলো না।স্বর্ণার পাশের চেয়ারটাই নুপূর বসে পড়লো।এখন আপাতত পেটকে শান্তি করতে হবে।কিন্তু অচেনা পরিবেশে এভাবে খেতে নিজেকে কেমন বেহায়া লাগছে।তবে আসমা সিদ্দিকা অতি আদরেই তার ভাতের প্লেটে মাংস তুলে দিচ্ছে।

এমন যত্নে তাকে কোনোদিন কেউ খাইয়ে দেয় নি।সে জানে আসমা সিদ্দিকা তার রুপ দেখেই এত আদর করছে কিন্তু যখন জানবে স্বার্থক বাবু তার সাহায্য করেছে মাত্র!তখনই হয়তো বাড়ি থেকে বের করে দিবেন।কত অদ্ভুত চরিত্র রয়েছে এই ধরণীতে!

খেতে খেতে নুপূরের এক পর্যায়ে আলোর কথা মনে পড়লো।ঐ মেয়েটা নাকি তার সতিন!অথচ আশ্চর্য নুপূর তাকে মোটেও সতিন ভাবতে পারছে না।তার কারণ কী?কারণটা হয়তো স্বার্থক বাবুকে সে নিজের স্বামীর আসন দিলেও মনের কোণে রাখেনি।স্বার্থকের জন্য তার মনে সম্মান ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি নেই।সন্তান জন্ম দিয়েই যে নুপূর হওয়ায় নিরুদ্দেশ হবে!কী করে জগৎ সংসারকে বুঝাবে সে এ কথা?

নুপূরের খাওয়া শেষ হলে তার শ্বশুর উপস্থিত হলো।নুপূর তাতক্ষণাত ঘামতে শুরু করলো।এই মানুষটাকে সে বড্ড ভয় পেয়েছে।স্বার্থকের মতো অত বড় ছেলে কীভাবে চড় মারলো!বাই চান্স তিনি নুপূরকেও মেরে তাড়িয়ে দিবেন নাতো!

এমন অদ্ভুত চিন্তা আসায় নুপূর নিজেকে কিছুক্ষণ বকা দিলো।তার শ্বশুর কারো সাথে কথা না বলে চুপচাপই বেরিয়ে গেলো।পেছন পেছন স্বার্থকও বেরিয়ে যেতে চাইলে তার মা থামিয়ে দিয়ে বললো,”কোথায় যাচ্ছিস আব্বা?এই গরমে কোথাও বের হতে হবে না।”
-“মা তুমি একই কথাটা বাবাকে বলে থামাতে পারলে না?”
-“আমি কেন থামাবো?যে যাওয়ার সে এমনিই যাবে।”

স্বার্থক তার মায়ের চেহেরার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না।রাগ হচ্ছে তার মায়ের উপর!কেন হচ্ছে নিজেও জানে না।তার মায়ের উপর কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ।কারণ মাও যদি বিয়ের বিপক্ষে যেত তাহলে বাড়ি থেকে,আলোর কাছ থেকে বহু দূরে সরে যেতে হতো।যা সে কখনই পারতো না।

স্বার্থক তার ছোট বোনকে প্রশ্ন করলো,”আলো কোথায় দেখেছিস?”
-“ছাঁদে গিয়েছিল ভাবি।”

স্বার্থক ছাঁদে যাওয়ার জন্য ঘাড় ঘুরাতে আলোকে দেখতে পেলো।আলো তাকে দেখেও উপেক্ষা করে রুমে চলে গেলো।স্বার্থকের চেহেরাটা তার চক্ষে কাঁটার মতো ফুটছে।
.
-“আলো তুমি ব্যাগ গোছাচ্ছো কেন?”
-“হৃদয় আমাকে নিতে আসছে।”
-“পাগল হয়ে গেছ তুমি?”
-“আমি পাগল হয়েছি?আমি?আগে নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজেকে প্রশ্নটা করো।”
-“আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”
-“লজ্জা করছে না তোমার স্বার্থক?প্রথম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আবার বিয়ে করলে আর এখনও আমার সাথে ইমোশনাল কথা বার্তা বলছো?ছিঃ।ঠিক আছে;তোমার প্রশ্নের উত্তর শুনো-তুমি যখন আরেকটি বিয়ে করে বাসায় তুলতে পারো তাহলে আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি।”
-“আলো আমি পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি।বিয়েটা করতে চাইনি….”
-“স্বার্থক প্লিজ,আমাকে একা থাকতে দাও।তুমি চলে যাও রুম থেকে।জাস্ট লিভ মি এ্যলং!”

আলো এক প্রকার ঠেলেই স্বার্থককে রুম থেকে বের করে দিলো।এখন স্বার্থক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল শুরু করবে।ফলে আলো গলে যাবে আর কান্না করবে।সে কিছুতেই চাইছে না স্বার্থকের সামনে চোখের জল ফেলতে।তার থেকে কিছু শুনতে চায়না এখন।সবসময় স্বার্থক ভুল করে আর আলো তা মেনে নেয়।এজন্য পরে দেখা যায় বিষয়টি নিয়ে সে অনুতপ্ত নয়।কিন্তু এবার স্বার্থক কী করলো এটা?ও কী জানে না নারীর কাছে তার স্বামী অমূল্য সম্পদ।কোনো নারীই পারে না ভালোবাসের ভাগ কাউকে দিতে।স্বার্থক কী করে এমনটা করতে পারলো?আলো কিছুতেই পাত্তা দিবে না তাকে।অনুশোচনা হউক তার মধ্যে।

অনুশোচনা!এই অনুশোচনাই মানুষের খারাপ কর্মের বড় শাস্তি।যতই আইন,কঠোর শাস্তি হোক না কেন ব্যক্তির মধ্যে প্রথমে অনুশোচনা হতে হয়।তাহলে সে নিজে অনুতপ্ত হয়ে সারাজীবন কাঁদতে কাঁদতে কাটিয়ে দিবে।

.
আলো কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরে হৃদয়ের অপেক্ষা করতে থাকলো।খিদে তার একটুও পাইনি।বরং মনেই নেই কিছু খাওয়ার কথা।মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরছে।”স্বার্থক কেন দ্বিতীয় বিবাহ করলো?” সে তো সবসময় বলতো তার হৃদয় হরণী একমাত্র আলো।তাহলে এখন নুপূরকে কেন বিয়ে করলো?

নাহ!সব পুরুষই এক।তার নিজের বাবাও দুটো বিয়ে করেছে।তার মা মারা যাওয়ার দু বছর পরই অন্য এক মহিলাকে ঘরে আনেন।পরিচয় করিয়ে দেন,”আলো,উনি তোমার মা।”

আলো টের পাই বাবা’র প্রতি ঘৃণাটা তার সেদিন থেকে শুরু হয়।কিন্তু সাত বছরের মেয়েটি আস্তে আস্তে বড় হয়।সে বুঝতে পারে বাবা যে মহিলাকে বাড়িতে এনেছিল তিনি তার মায়ের জায়গায় ভাগ বসিয়েছে।এমনটা নয় যে মহিলাটি খারাপ কিন্তু ভালোও নয়।আলোকে কষ্ট দেয়নি,অন্য সৎ মায়ের মতো অত্যাচার করেনি কিন্তু আদরও করেনি।আলো একা বড় হয়েছে।একা জগতে বাঁচতে জানে।কিন্তু মাঝপথে স্বার্থকই তার সঙ্গী হলো।কী দরকার ছিল?

এত কাঁদার পরও কান্না শেষ হয়না কেন?কোথায় জমা থাকে এত কান্না?ওমনি ইমোশনে একটু আঘাত হলেও হুর হুর করে বেরিয়ে পড়ে।অসহ্য!

আলোর কর্ণের ভেসে আসলো হৃদয়ের কন্ঠস্বর।সে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো।আবারো মুখোমুখি হলো স্বার্থকের।আলো মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।হৃদয় হলো তার খুঁটি।

হৃদয় এতক্ষণ স্বার্থকের সাথে কথা বলছিলো।শেষে বললো,”স্বার্থক,আলো কিছুদিন আমার ওখান থেকে ঘুরে আসুক।ওর মাথা ঠিক নেই এখন।”

চেহেরা শুকনো করে রাখলো স্বার্থক।আলোকে থামানোর কোনো রাস্তা তার জানা নেই।এতক্ষণ রেগে ছিলো আলো উপর আর এখন প্রচুর রাগ হচ্ছে তার নিজের উপর,নুপূরের উপর।

স্বার্থক আমতা আমতা করে আবারো বললো,”হৃদয়,তোমরা সবাই আগে প্লিজ জানো আমি বিয়েটা কেন করলাম।আমি আলোকে কতটা ভালোবাসি তোমরা জানো না?”
-“জানি বলেই তুমি এখনো বাড়িতে আছো।প্রথম স্ত্রীর মত না থাকলে ২য় বিয়ে করাটা আইন এবং ইসলাম দু’দিকেই অপরাধ।”

স্বার্থক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।এখন বাড়ির কাউকে কিছু বুঝানো যাচ্ছে।পরিস্থিতি অতন্ত্য বিগড়ে গেছে।তাই বলে আলোও?আলোও তাকে ভুল বুঝবে?কত বিশ্বাস ছিল দু’জনের সম্পর্কে!স্বার্থক একগুঁয়ে।সে ঠিক করেছে বাড়ির সবাইকে বিয়ের ব্যাপারে খুলে বলবে রাতে কিন্তু আলোকে জানাবে না।আলো তাকে অবিশ্বাস কেন করলো?

হৃদয়ের সাথে আলো বেরিয়ে গেলে স্বার্থক তাদের দিকে চেয়ে রইল।এই আলো তো সেই না যে তার অভিমান!তার বেঁচে থাকার কারণ!সোনার সংসার ছিল তাকে।প্রতিটি মুহুর্ত ছিল আনন্দে ভরা।তার কানে বাজছে আলোর হাসির আওয়াজ।সেই সাথে দুপুরের কান্নার আওয়াজ!মেয়েটা কেঁদেছে,তার কারণে কেঁদেছে।অথচ স্বার্থক কথা দিয়েছিলো তার চোখে কখনো জল আসতে দিবে না।

স্বার্থকের সব রাগ গিয়ে পড়লে নুপূরের উপর।নুপূরের জন্য আজ সব কিছু হলো।না মেয়েটা তার সামনে আসতো আর না এত কিছু হতো…।নুপূরের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”তোমার জন্য জাস্ট আমার লাইফ হ্যাল হয়ে গেল।ষ্টুপিড গার্ল!”
.
স্বার্থক এটুকু শুনিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।আর নুপূর..সে হাটু গেঁড়ে বাগানে বসে কাঁদতে লাগলো।কান্না তার আজীবনের সঙ্গী।আল্লাহ কেন তার জীবনটা নরকে পরিণত করলো?সে যার জীবনেই যায় যেখানে কালবৈশাখী চলে আসে।সে কাঁদছে স্বার্থকের রাগ দেখানোর জন্য নয় কাঁদছে আলোর জন্য,স্বার্থকের জন্য।এ জীবনে আর যাই হউক আলোকে সে স্বার্থকের কাছে ফিরিয়ে আনবে।

নুপূর বিয়ে নামক সম্পর্কে পরিচিত মাত্র আর আলো বিয়ে নামক সম্পর্কে বেঁচে থাকা,ভালোবাসা!

(চলবে)

বি.দ্র:ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, বানান ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন🌼

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে