হৃদয়ের গহীনে পর্ব-০১

0
4167

#হৃদয়ের_গহীনে🍁
Part 1
#সারা_মেহেক

একটা কথা আছে,বিপদ যখন আসে তখন সবদিক দিয়েই আসে। মুসকানের হয়েছে তাই।সে ভাবেওনি এমন কিছু হবে।তার চাচা চাচি যে তাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে সে হয়তো কল্পনাও করেনি। এখন আবার তার তাকার জায়গাটুকুও নেই। কারন তার চাচাতো ভাই ভাবি তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।

ছোটো থাকতেই মা বাবা কে হারায় মুসকান। থাকতো মামা মামির কাছে। তারা ছিলেন নিঃসন্তান। তাই মুসকানকে অনেক ভালোবাসতেন।কিন্তু মুসকানের বয়স যখন ১০,তখন তার মামা হার্ট অ্যাটাক এ মারা যায়। এরপর থেকে মামি ই দেখভাল করতো মুসকানের। কিন্তু মাস দুয়েক আগে তিনিও মারা যান।লন্ডন এ বসবাসরত মুসকানের চাচা চাচি এ খবর জানতে পেরে মুসকানকে লন্ডনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে।
মামির মৃত্যুর খবর প্রথমে মানতে না পারলেও ধীরে ধীরে তা মেনে নেয় মুসকান। তার চাচা চাচি অনেক ভালোবাসে তাকে। কিন্তু চাচাতো ভাবি মুসকানকে একদমই সহ্য করতে পারে না।
মামির মৃত্যুর ২মাস পরই যে তাকে চাচা চাচির মৃত্যুর খবর শুনতে হবে সে ভাবেও নি।নিজেকে একটা অপায়া মনে হচ্ছে তার। কেনান আপন কেউই তার সাথে বেশিদিন থাকে না। তাকে ছেড়ে চলে যায়।সে শুধু ভাবে তাকে কি এই দুনিয়ায় ভালোবাসবে না আর কেউ। আচ্ছা যদি ভালোবাসে, কিন্তু আবার আপনজনের মতো যদি সে ও চলে যায়?

কালকে বিকালে হঠাৎ করেই সংবাদ আসে যে মুসকানের চাচা চাচি কার এক্সিডেন্ট এ মারা গিয়েছে।এক্সিডেন্ট এর জন্য তাদের পুরো শরীর ঝলসে যায়। পুলিশ বলেছে স্পট ডেথ। এটা শুনে মুসকান আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। কান্না করতে করতে ২বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।কিন্তু ভাইয়া ভাবি একবারও তার কাছে আসেনি।বাসার কাজের মেয়েটা মুসকানের খেয়াল রেখেছে।

আজকে সারাদিন শরীর ক্লান্ত ছিলো মুসকানের। সন্ধ্যার দিকে শরীর একটু ভালো লাগায় ডাইনিং এ যায় কিছু খাবার খেতে।কিম্তু সে খাওয়াটুকুও হয়ে উঠেনি তার। কারন ভাবি মুখের কাছ থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে মুসকানের গালে জোড়ে একটা চড় দেয়। এতে টাল সামলাতে না পেরে টেিবলের কোনায় গুঁতো খেয়ে পরে যায়।ভাবি রেগে বলে,

“তোর মতো এখনও এ দুনিয়ায় আছিস কেনো?
নিজ মা বাবাকে খেয়েছিস,আবার মামা মামি। এখন আবার চাচা চাচিও!!!!তুই মানুষ নাকি রাক্ষস রে??তোর সাথে থাকা মানুষগুলো বেশিদিন বাঁচে না।কবে যেনো আমাদের খেয়ে ফেলিস। তার আগেই বিদায় হ এখান থেকে।”

মুসকান কান্নারত অবস্থায় বলে,

“এসব কি বলছো ভাবি!!আমি এখন কোথায় যাবো??এখানকার কিছুই তো চিনিনা আমি।”

“সেটা আমার সমস্যা না। তুই এখন যাবি মানে এখনই যাবি। আমাদের সমস্যা আর বাড়াতে চাই না। দাঁড়া তুই এখানে।আমি তোর কাপড়চোপড় নিয়ে আসছি।নিজে আনতে গেলো আবার দেখা যাবে কিছু জিনিস চুরি করে আনছিস।”

মুসকানকে আর কিছুই না বলার সুযোগ দিয়ে ভাবি মুসকানের রুমে গিয়ে সব কাপড়চোপড় একটা ব্যাগে ভরে এনে মুসকানের সামনে দেয়।
মুসকান আকুতি মিনতি করতে থাকে।

“ভাবি,আমার কথাটা শোনো একবার।আমি কোথায় যাবো এ সময়ে??আমি তো একটা মেয়ে।ভাবি এটুকু চিন্তা করো যে আমি একা মেয়ে কোথায় আশ্রয় নিবো??”

“সেসব আমি জানি না বাপু। তুই শুধু বসে বসে খাবি।এটা তে হয়না। এ কয়দিন তো আব্বা আম্মা ছিলো তাই কিছুু বলেনি তোকেৃ কিন্তু এখন আর সহ্য হচ্ছে না তোকে।তুই এখনই চলে যা।নাহলে আমি ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে বাধ্য হবো।”

মুসকান এবার ভাবির পা ধরে বসে পরলো।

“ভাবি দয়া করে আমাকে থাকতে দাও। আমি কাজ করবো।টাকা কামাই করে এনে দেবো।কিন্তু তাও থাকতে দাও আমাকে।”

“তুই কতা শুনছিস না তো।চল এবার।…”
বলে মুসকানের হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে এনে দরজা আটকিয়ে দেয় ভাবি।

মুসকান কয়েকবার দরজা নক করে কিন্তু ভাবি দরজা খোলে না। শেষ পর্যন্ত মুসকানকে চলেই আসতে হয় সেখান থেকে।

রাস্তার হালকা আলোয় একা হাঁটছে মুসকান। নিজেকে বড্ড বেশি একা মনে হচ্ছে। অবশ্য মনে হওয়ারও কথা।কারন আপন বলতে কেউই নেই এ পৃথিবীতে তার।নিজেই নিজের সাথে কথা বলছে।আর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ফেলছে।

“ভাবি তো ঠিকই বলেছে। তুই তো আস্ত একটা রাক্ষস।সবাইকে খেয়ে ফেলিস তুই।
আল্লাহ এমন কেনো করলে আমার সাথে?আপন বলতে কাউকে রাখলে না কেনো?এখন আমি কোথায় যাবো?কার কাছে আশ্রয় নিবো?”

কিছুদূর যাওয়ার পর সেদেশীয় কিছু ছেলে মুসকানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“হেই বিইটিফুল লেডি,হোয়াই ইউ আর আলোন?ডু ইউ ওয়ান্ট আওয়ার কাম্পানি??”

এ কথা শুনে মুসকানের ভয়ে যেনো আত্মা শুকিয়ে আসলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।এক বিপদের উপর আরেক বিপদ।
মুসকান এমন ভাব নিয়ে হাঁটা ধরলো যেনো সে কিছুই জানে না।কিন্তু ছেলেগুলো পিছু ছাড়লো না।তারা মুসকানের পিছনে আসা ধরলো। ধীরে ধীরে মুসকানের বেশ কাছে চলে আসে তারা।মুসকান পিছে ফিরে দেখে যে ছেলেগুলো তার অনেক কাছে চলে এসেছে। এবার মুসকান আর কিছু না ভেবে ব্যাগটা রেখে দৌড়ানো শুরু করলো। তাকে এখন তার ইজ্জত বাঁচাতে হবে।প্রাণপনে ছুটছে সে।বারকয়েক পিছে তাকিয়ে দেখছে যে ছেলেগুলো এখনো তার পিছে পরে আছে কি না।
সে যা ভেবেছিলো তাই ই। ছেলেগুলে এখনো তার পিছে দৌড়াচ্ছে।

নিজ বন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলো আফনান।ছোটো থেকেই লন্ডনে থাকে সে পরিবারসহ। ভাইবোন নেই। কিন্তু প্রাণপ্রিয় এক বন্ধু আছে।
ফ্যামিলি বিজনেস জয়েন করেছে আফনান এক বছর আগে। ধীরে ধীরে উন্নতি করছে।দেখতে মাশাল্লাহ বেশ সুন্দর। দেখতে কিছুটা এ দেশীয়। কারন ছোটো থেকে লন্ডনে থাকতে থাকতে চেহারায় এ দেশীয় একটা ছাপ পরে গিয়েছে বলা যায়। হাইটেও বেশ। তার আবার গার্লফ্রেন্ড আছে। নাহ বলা যায় ছিলো।কারন রিসেন্টলি ব্রেকআপ হয়েছে। এগুলো অবশ্য তার কাছে টাইম পাস ছাড়া আর কিছুই না। কারন এ পর্যন্ত তার একটা গার্লফ্রেন্ডর প্রতিও তার লাভ ফিলিংস আসেনি।

এদিকে মুসকান দৌড়াতে দৌড়াতে একটা গাড়ীর সামনে এসে পরলো।আর সেই গাড়ীর মালিক হলো আফনান।মুসকান ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে আছে।
এদিকে গাড়ীর সামনে কে পরেছে,এটা দেখার জন্য আফনান গাড়ী থেকে বের হয়ে মুসকানকে দেখলো।গাড়ীর হেডলাইটের আবছা আলোয় মুসকানকে দেখে এক প্রকার ক্রাশ খেলো আফনান।সে মুসকানকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলো।কিন্তু তার আগেই উঠে আবারো দৌড় দিলো মুসকান। কারন সে আফনান কে এ দেশীয় ভেবেছে।আর তার মনে হয়েছে হয়েছে এদেশীয় এ ছেলে সে,হয়তো কিছু করবে।তারপর আবার যুবক।

মুসকান চলে যাওয়ার পর আফনানা আবার গাড়ীতে উঠলো। এখন আর তার কিছুই ভালে লাগছে না। তাই নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সে।

এদিকে মুসকান দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে গিয়েছে।সে সামনের দিকে একটা ভাঙা টাইপের ঘর দেখলো।গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিলো কারন তার মনে হলো এই জায়গায় হয়তো কেউ আসবে না। এখানে আপাতত থাকা যায়।মুসকান গিয়ে সেই বাড়ীতে আশ্রয় নিলো।
আলো বলতে কিছুই নেই। যে মোবাইল ছিলো বাড়ী থেকে বের করার সময় সেই মোবাইলটাও দেয়নি ভাবি।
সে জন্য এভাবে অন্ধকারেই কাটাতেই হবে তাকে।

হঠাৎ করে কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে আতঁকে উঠলো মুসকান। চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। পিছে থাকা ব্যক্তিটা মুখ চেঁপে ধরলো মুসকানের। সে ব্যক্তিটা বললো,

“প্লিজ ডোন্ট ডু দিস। আই এম হেয়ার টু হেল্প ইউ।”

এ কথা বলে সে ব্যক্তিটা মুসকানের মুখ ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে নিজের মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ধরলো নিজের মুখের উপর।
মুসকান ব্যক্তিটাকে লক্ষ্য করে দেখলো। মধ্য বয়সী একটা লোক।সে দেশীয় মানুষ সে।
মুসকান বললো,

“হাউ ডিড ইউ ফাউন্ড মি হেয়ার?”

লোকটি বুঝিয়ে বললো যে সে মুসকানকে দৌড়ে এখানে আসতে দেখেছে। ভেবেছে হয়তো মুসকান বিপদে তাই এগিয়ে এসেছে।লোকটি মুসকানকে ভরসা দিলো যে সে মুসকানের কোনো ক্ষতি করবেনা।
মুসকানের ইচ্ছা হলো লোকটাকে বিশ্বাস করতে।এখন অবশ্য এছাড়া আর উপায় নেই।
লোকটি মুসকানকে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো। তিনি নিজের মোবাইলে নিজের স্ত্রীী ছবি দেখালো মুসকানের ভরসা জিতার জন্য।

গাড়ীতে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর মুসকান জিজ্ঞাসা করলো লোকটিকে,

“ডু ইউ হ্যাভ ওয়াটার??”

“ইয়েস”বলে লোকটি একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো মুসকানের দিকে।
মুসকান সে পানি পান করলো ঠিকই।কিন্তএ কিছুক্ষনের মধ্য সে আর নিজ হুশে থাকলো না। অজ্ঞান হয়ে গেলো। কোন গন্তব্যের দিকে সে যাচ্ছে নিজেও জানে না।।

আধো আধো চোখ খুলে মুসকান দেখলো তার সামনে সেই মধ্য বয়সী লোক। আরেকটা যুবক ছেলে।নিজেদের মধ্য তারা কথা বলছে।যেটুকু শুনতে পলো মুসকান তাতে বুঝে গেলো যে এবার শেষ রক্ষাটুকুও হয়তো হবে না তার।

মধ্যবয়সী লোকটার সাথে যে কথা বলছে সে হলো আকাশ। ১৩ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর বাবা নতুন বিয়ে করে বলে তাকে অবহেলা করা হয়।একাকীত্বে ডুবে যায় সে। ১৩ বছর বয়সে পরিচিত এক আংকেলের সহায়তায় লন্ডনে আসে আকাশ।এখাকে সেই আংকেলের বাসা ছিলো।কিন্তু তিনি থাকতেন বাংলাদেশে।মাঝে মাঝে লন্ডনে আসতেন তিনি।
লন্ডনে তিনি যে বাসায় থাকতেন সেখানেই আকাশ আছে এখনো পর্যন্ত। ছোটো থেকে দেখভাল করতো সে বাসার একজন কাজের মেয়ে।মায়ের মতোই স্নেহ করে আকাশকে।নাম সোফিয়া।
আকাশ দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। সব মেয়েরা তার পিছে ঘুরঘুর করে।অনেকে তে তার রাতের সাথী হতেও দ্বিধাবোধ করেনা। আকাশের জীবনে এক রাতের সাথী হতে পেরেছে গুটিকয়েক মেয়ে।এসব মেয়েরা এতেই নিজেদের ভাগ্যবতী মনে করে। অবশ্য লন্ডনে তো এসব নরমাল।সোফিয়া অনেকবার আকাশকে মানা করেছে, কিন্তু আকাশ সে কথা শোনে না। বিজনেস করাটা একটা প্যাশন, কিন্তু এটা একটা নেশা।যা তাকে জেঁকে ধরেছে।
আকাশের সেই আংকেলের সহায়তায় লন্ডনে থেকে পড়াশোনা করেছে।আর উনার সহায়তায় নিজের বিজনেস দাঁড় করিয়েছে।

আকাশ সেই মধ্য বয়সী লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“চাচা অনেকদিন পর একটা সুন্দরী পেলাম।আজকের রাতটা ওসাম হবে। তোমাকে অনেক থ্যাংকস।”

সেই লোকটা এ কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে হেসে চলে গেলো।লোকটির নাম এনড্রিউ।তিনি আকাশের বাড়ীতে একজন কর্মচারী। আকাশের প্রয়োজ তিনি এগিয়ে যায়। সোফিয়ার হাসবেন্ড উনি।লোকটি আরো আকাশকে এসব খারাপ কাজে সাহায্য করে।আকাশের সাথে থাকতে থাকতে সোফিয়া আর এনড্রিউ বাংলা ভাষা বুঝে ঠিকই। কিন্তু ঠিকমতো বলতে পারেনা।

এনড্রিউ চলে যাওয়ার পর আকাশ রুমের দরজা আটকিয়ে মুসকানের দিকে এগুতে থাকে।
মুসকানের হালকা জ্ঞান থাকলেও ভয়ে সে আবারো অজ্ঞান হয়ে যায়।
মুসকানের কাছে এসে আকাশ দাঁড়ায়।মুসকানের দিকে হালকা ঝুঁকে মুসকানের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকাতে তাকাতে শার্ট খুলতে থাকে আকাশ।মুসকানের চেহারা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করছে সে।একধরনের মায়া আছে এ চেহারায় মনে হচ্ছে আকাশের। তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে।একটা নেশা কাজ করছে তার। এ নেশা খারাপ নেশা নয়। অন্য এক নেশা।
নাহ আর ভাবলে নিজের কাজটা করতে পারবে না আকাশ। তাই সে আর কিছু না ভেবে মুসকানের একদম কাছে চলে আসলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে