হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা পর্ব-১১

0
720

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|১১|
#শার্লিন_হাসান

“পালিয়ে গেলো মির্জার বউ আর ভাগ্নে।”

আরিফের কানে কথাটা যেতে সাথের টাকে ঠাস করে চ’ড় মেরে দেয়। চুলগুলো টেনে বলে,

-ওইটুকুন মেয়ে আর বাচ্চার সাথে পারলি না? এমন দাম’ড়া হয়ে কী হলো? আর আমার সাথে সবার পার্কে যাওয়ার জন্য গেছে? শামিম সরদার তোদের না পুষে কয়টা গরু পোষলেও কাজে দিতো।

-আমাদের সাথে আপনিও কিন্তু আছেন।

পাশের জন বলতে তার গালেও চড় বসিয়ে দেয় আরিফ। তারা সবাই বেড়িয়ে পড়ে আনায়ার খোঁজে। পার্কের দিকে না গিয়ে তাঁদের পেছনে দৌড়ানো ছেলেটার কথা অনুযায়ী সামনে এগোচ্ছে তারা।

আনায়া, মিসবাহ দৌড়ে ছুটছে। পেছনে সেই ছেলেটাও দৌড়ে আসছে। ভাগ্যিস আজকে আনায়া লং ড্রেস পড়েনি। জিন্স আর ছোট জামা পড়েছে। দৌড়ের সাথে পিছলা হিজাবটা খুলে যাচ্ছে বারবার। আনায়া বিরক্ত হয়ে যায়। একহাতে হিজাব সামলে অন্য হাতে মিসবাহকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

কিছুটা সামনে এসে দু’টো পথ দেখতে পায় আনায়া। একটা সোজা আরেকটা অন্য গ্রামে ঢুকেছে হয়ত। আনায়া গ্রামের রাস্তাটা ধরে মিসবাহকে নিয়ে। সে জানে না সে কোথায় যাচ্ছে তবে পেছনে লোক আছে তাঁদেরকে ধরার জন্য এটা শুধু মাথায় ঘুরছে।

নিবরাস সোডিয়ামের কাছে এসেও কিছু পায়নি। লাইট দিয়ে আশে-পাশে তন্নতন্ন করে খুঁজে। ফোন হাতে তার দলের একজনকে কল লাগায়। কল রিসিভ হতে কয়েকটা গা’লি দেয় নিবরাস।

-চোখ কোথায় ছিলো তোদের? বলেছিলাম না আমাদের সবার আশে পাশে থাকতি।

-আমরা তো পার্কের আশে পাশেই ছিলাম স্যার। কিন্তু ম্যামকে দেখতে পাইনি।

-চোখ থাকলে না দেখতি। তোদের সব-কয়টাকে আমি পাই শুধু। এক্ষুনি লোক লাগা আশে পাশে রাস্তায় আর গ্রাম থাকলে গ্রামের রাস্তা গুলোতে। এই পাহাড়ি এলাকায় গাছপালা এতো বেশী বিরক্ত লাগে।

নিবরাস কল কেটে দেয়। তারিশা বিরক্ত হচ্ছে! তার মনে হচ্ছে আনায়া এক্সট্রা প্যারা হয়ে গেলো। ইশশ! কী সুযোগ ছিলো নিবরাসের সাথে ঘুরার। কী দরকার ছিল আনায়ার কল দিয়ে খবরটা দেওয়ার?

তারিশার ভাবনার মাঝে পরাগ বলে,

-নিশ্চয়ই শামিম সরদারের কাজ এটা।

-ও ছাড়া আর কে?

-আমার মনে হয় স্যার আপনার সুরক্ষা আগে দরকার। বউমনিকে খোঁজা যাবে।

-হ্যাঁ পরাগ ভাইয়া ঠিক বলেছে। নিবরাস ভাইয়া গাড়ীতে বসো! লোক তো লাগিয়েছো খোঁজার জন্য।

তারিশা বলে। নিবরাস বিরক্ত হয় তারিশার বা হাত ঢুকানো দেখে।
-আমার কিছু হবে না। আমি কচি খোকা নই! আর যার সুরক্ষা বেশী প্রয়োজন সে গিয়ে গাড়ীতে বসে পড়ো। খামাখা বা হাত ঢুকিয়ে আমার টেম্পার গরম করো না।

পরাগ, তারিশা চুপসে যায়। অতঃপর তারা চারজন সামনের দিকে অগ্রসর হয়।

গ্রামের রাস্তায় গাড়ী চালাচ্ছে জায়ান। সাথে আছে সীতারা আহমেদ,নাজিয়া,নিধি,সায়ন্তিক। তারা এই গ্রামের দোকানে যাবে।

সুনশান নিরব রাস্তা! তেমন একটা লোকের দেখা নেই। জায়ান গাড়ী চালাচ্ছে মনোযোগ সহকারে। হুট করে কোথা থেকে একটা মেয়ে আসে গাড়ীর সামনে। জায়ান ব্রেক কষে নেয়। মেয়েটা জানালার কাছে এসে হাত দিয়ে খোলতে বলে। জায়ান জানালা খোলতে আনায়া বলে,

-প্লিজ একটু লিভ দিন। আমি বড় বিপদের পড়েছি।

নাজিয়া জায়ানের পাশের সীটে বসা। সে তাকিয়ে দেখে আনায়া। চিনতে ভুল হয়নি কিন্তু অপরিচিত সেজে কথা বলতে হবে তার মায়ের সামনে। তড়িঘড়ি জায়ানকে বলে,

-আপুটা নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছে। আর গাড়ীতে জায়গা আছে সামনের সীট তো খালি প্রায়।

জায়ান মাথা নাড়িয়ে তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেয়। আনায়া মিসবাহ কে নিয়ে গাড়ীতে বসে পড়ে। জায়ান পুনরায় গাড়ী স্টার্ট দেয়। আনায়া তাকে বলে,

-সামনে কিছু লোক দেখবেন। প্লিজ গাড়ী থামাবেন না ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে।

তখন জায়ান বলে,

-ওদের সাথে আপনার কোন শত্রুতা আছে?

আনায়া খেয়াল করে নিধিকে সাথে সায়ন্তিককে। যদিও নিধি,নাজিয়াকে চিনে। কিন্তু তারা দু’জন চুপ। পাশে তাকাতে থমকে যায় আনায়া।

সীতারা আহমেদ তেমন রিয়েক্ট করেনি। সে নিজেও জানে না পাশে তারই মেয়ে বসা। কতগুলো বছর আনায়াকে দেখে না। সেই পাঁচ বছর কী ছয়বছর বয়সে ছেড়ে এসেছিলেন। এখন তো বাইশ একুশ বছর বয়স হবে। এতো কিছু চিনে না তিনি।

আনায়ার কোলে মিসবাহ বসা। সে চুপচাপ। গাড়ীতে সবাই মোটামুটি চুপচাপ। তখন আনায়া বলে,

-আমাদেরকে একটু পার্কের কাছে নামিয়ে দিয়ে আসবেন? আমার হাজবেন্ডকে কল দিয়ে বলে দিচ্ছি চলে আসতে।

-আপনার পেছনে ওরা পড়লো কেন?

প্রশ্ন করে জায়ান। আনায়া বলার আগে মিসবাহ বলে,

-ওরা আমার মামুর বিরোধী দলের লোক। আমার মামুর ক্ষতি করার জন্য আমাদেরকে কিডন্যাপ করতে চায়।

নাজিয়ার মাথায় মূহুর্তে শামিম সরদারের নাম চলে আসে। জায়ান তো শামিম সরদারের পক্ষে! এখন যদি শোনে বন্ধুর শিকার শত্রুর সম্পদ তার হাতে, তার খাঁচায় আদৌ ছেড়ে দিবে তো? বিশেষ করে শামিম সরদার চাবি ঘুরালেই সব শেষ। নাজিয়ার মনে পড়ে, সে জায়ানকে বলেছে শামিম সরদারের সঙ্গ ত্যাগ করতে। নিশ্চয়ই নাজিয়ার কথা শোনবে জায়ান। তবুও ভয় হচ্ছে জেনেশুনে যদি অজান্তে বিপদে ফেলে দেয় আনায়াকে।

আনায়া নিবরাসকে কল দেয়। সাথে,সাথে রিসিভ হতে বলে,

-পার্কের সামনে অপেক্ষা করুন আমরা আসছি।

কথাটা বলে কল কেটে দেয় আনায়া। মিসবাহকে শক্ত করে ধরে বসে! গাড়ীতে লাইট জ্বলছে সীতারা আহমেদের দিকে একটু পর পর নজর দিচ্ছে আনায়া। তার কোলে একটা ছেলে বসে আছে। দেখতে অনেকটা আনায়ার চেহারার অবয়ব পেয়েছে। না পাওয়ার কী আছে? বাবা ভিন্ন মা তো একজনই!

জাফিন আনায়ার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আনায়া মুচকি হাসে! ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগলো না মনে। সীতারা আহমেদের দিকে তাকাতে মুখটা মলিন হয়ে যায়। তার মা তাকে চিনতে পারছে না। এতোটা পর হয়ে গেলো? মানুষ বলে নিজের গর্ভের সন্তান যতই বড় হোক আলাদা টান থাকে! যতই অচেনা হোক তবুও চেনা,চেনা লাগে। আর সে কী জানে না আনায়ার বিয়ে নেতার সাথে হয়েছে যার অহরহর শত্রু!

নাজিয়া তার মায়ের দিকে তাকায়। সে ফোনে ব্যস্ত! পাশে তার বড় মেয়ে অথচ তার ভাবনা নেই। সত্যি কী চিনতে পারছে না আনায়াকে? নাজিয়া তখন বলে,

-আপু তোমার নাম কী?

-মিসেস মির্জা।

-আরে সেটা না তেমার আসল নাম বলো?

-অনু।

তখন মিসবাহ বলে,

-আনায়া ইবনাত না? অনু হলো কখন বউমনি?

-সোনা ওটা আনায়ার সংক্ষিপ্ত অনু।

সীতারা আহমেদ চোখ তুলে তাকান। আনায়ার দিকে তাকাতে দেখতে পান সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আনায়া তার বড় মেয়ের নাম ছিলো। কিন্তু কতগুলো বছর তাকে দেখেননি তিনি। এমনকি মেয়ের চেহারাটাও মনে নেই!

কেউ কিছু বলেনি আর। জায়ান ও প্রশ্ন করেনি। আনায়াকে নিয়ে পার্কের কাছে আসে। গাড়ী থেকে সবাই নামতে নিবরাসদের দেখতে পায়।

মিসবাহ আনায়াকে দেখে নিবরাস সবার আগে ছুটে আসে। পাবলিক প্লেসেই আনায়াকে জড়িয়ে ধরে নিবরাস। আনায়ার লজ্জা লাগছে। নিবরাসের তাতে হেলদোল নেই। নাজিয়া নিধি মিটমিট হাসছে। নিবরাস উত্তেজিত হয়ে বলে,

-তোমার কোথাও লাগেনি তো? ওরা কিছু করেনি তো আবার?

-না কিছু করতে পারেনি। ভাগ্যিস ওনাদের গাড়ীর সামনে পড়েছি।

জায়ান নিবরাসকে দেখে অবাক হয়ে যায়। শাহরিয়ার সায়ন্তিক সে নিবরাসের সাথে কুশল বিনিময় করে। এমপি স্যারের দেখা এভাবে পাবে ভাবতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা এমপির ওয়াইফকে সেভ করতে পেরেছে। নিবরাস জায়ানকে বারবার ধন্যবাদ দেয়।

সীতারা আহমেদ বুঝেছেন আনায়া তারই মেয়ে। খবর এসেছিলো মেয়ের বিয়ে এমপির সাথে হয়েছে। এমপিকে সবাই চিনে। কিন্তু তিনি আর কথা বাড়াননি। শুধু মেয়ের দিকে একনজর তাকান। পা থেকে মাথা অব্দি দেখেন।

সেখানে তাঁদের কথাবার্তা হতে তাদেরকে বিদায় জানিয়ে নিবরাস আনায়া,মিসবাহকে নিয়ে গাড়ীতে বসে পড়ে। রাত প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি।

গাড়ীতে বসেও নিবরাস আনায়াকে এক হাতে কাঁধে রেখেছে। পারে না গাড়ীতেই জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। আনায়ার মনে হচ্ছে সে হারিয়ে গেছে আর অনেকগুলো বছর পর তাকে ফিরে পেয়েছে। মিসবাহ সে অভিমান করে আছে। তার মামু সে তখন একটু জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়েছিলো এখন আর কিছু বললো না।

তারিশা বিরক্তি নিয়ে পেছনে বসে আছে। আজকের ঘুরাঘুরি টাই মাটি।

-এদের বর বউয়ের নাটক শেষ হবে না এ জীবনেও। এতো আহ্লাদ করা লাগে? ঢংয়ের শেষ নেই।

তারিশা মনে,মনে ভেংচি কাটে। আনায়ার গুষ্টি তুষ্টি মনে মনে উদ্ধার করে নিচ্ছে সে।

আনায়া মন মরা হয়ে বসে আছে। তার মা তাকে দেখেও না দেখার ভাণ করলো। চেনে না এমন কোন কথা না! নিবরাসকে দেখার পর নিশ্চয়ই বুঝেছে। কই তাকে তো জড়িয়ে ধরলো না একবার ও। অবশ্য নিজের স্বামী, সংসার সন্তানদের নিয়ে বেশ সুখেই আছেন।

কঠোর মনটাও ভেঙে যাচ্ছে বারবার। এক্ষুনি কান্না করতে পারলে শান্তি লাগতো আনায়ার। কান্না পাচ্ছে কিন্তু কান্না করতে পারছে না।

বাড়ীতে আসতে সবাই গাড়ী থেকে নামতে নিবরাস কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে, ‘যা হয়েছে কেউ যাতে কাউকে কিছু না বলে। এমনকি মিসবাহও যাতে মুখটা চুপ রাখে।’

মিসবাহ সে তো অভিমান করে আছে। বাকীরা ভেতরে চলে যায়। মিসবাহ ভেতরে যাওয়ার সময় আনায়া তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়।

-মিসবাহ সোনা বেস্ট! ব্রেইভ, ইন্টেলিজেন্ট।

-মামু একবার ও আমায় কোলে নিলো না। আমি কতগুলো দৌড় দিলাম কিছু খাওয়ালো ও না।

নিবরাস কোলে তুলে নেয় মিসবাহকে। মুখশ্রী তে চুমুতে ভড়িয়ে দেয়।

-সোনা আগামী কালকে এক ঝুড়ি চকলেট এনে দেবো।আজকে মামুর প্রেসার লো হয়ে গেছে। এখন মামিকে জড়িয়ে ধরে প্রেসার ঠিক করতে হবে।

-যাও তুমি ভীতু! সামান্য বিষয়ে কারোর প্রেসার লো হয়?

-আরে আমার সোনা এতো সাহসী! মাশাল্লাহ। নির্বাচনে তোমাকে দাঁড় করাবো।

মিসবাহ মাথা নাড়ায়। হেসে ভেতরে প্রবেশ করে। নিবরাস বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আনায়া ভেতরে প্রবেশ করার জন্য পা বাড়াতে নিবরাস তার কোমড় জড়িয়ে ধরে এক টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

-জান আমার প্রেসার লো হয়ে গেছে। একটু জড়িয়ে ধরবে আমায়? প্রেসারটা ঠিক করতে চাই।

– জড়িয়ে ধরার মাঝে প্রেসার ঠিক হওয়ার কী সম্পর্ক নেতাসাহেব?

-কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার লো প্রেসার হাই হবে তুমি জড়িয়ে ধরলেই। একটুর জন্য তো আমি হার্ট অ্যাটাক করিনি।

আনায়া জড়িয়ে ধরে নিবরাসকে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
-হার্ট অ্যাটাক করলে নিউজ হতো, ‘নেতা বউকে এক ঘন্টার জন্য না পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করেছে। এই নেতা নাকী আবার করবে জনগনের সেবা! এলাকার উন্নয়ন? সে তো বউ ছাড়া মৃ’ত। বউ কাছে নেই মানে নেতা হসপিটালে ভর্তি।

-একঘন্টা আমার কাছে এক যুগের সমান। আমি তো এক সেকেন্ডের জন্যও আমার বউকে ছেড়ে দূরে থাকতে রাজী নই।

-আমিও আমার বর মহাশয়কে ছেড়ে থাকতে রাজী নই।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে