হৃদয় কোঠায় চাঁদের পূর্ণিমা পর্ব-০৩

0
797

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|৩|
#শার্লিন_হাসান

পরের দিন সকালে নিবরাস নামাজ আদায় করে রেডি হয়ে নেয়। আজকের দিনটা সে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মা-বাবাদের সাথে কাটাবে। তাঁদের সাথে গল্প করবে। রেডি হয়ে জিয়াউর রহমানের নাম্বারে কল করে। আনায়ার নাম্বার তার কাছে নেই। কল রিসিভ হতে নিনরাস সালাম দিয়ে খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে। আনায়ার সাথে কথা বলবে এটা জিয়াউর রহমানকে বলতে পারছে না নিবরাস। মনে,মনে দোআ করছে এই বুঝি তার শ্বশুর মশাই বললো, ‘নেও বাবা আনায়ার সাথে বলো।’

তখন জিয়াউর রহমান বলেন,
-কিছু বলবে বাবা?

-না,না তেমন কিছু না।

-আনায়ার সাথে কথা হয়েছে?

-আসলে ওর নাম্বার টা আমার কাছে নেই।

-আচ্ছা আমি হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি।

-আচ্ছা,ধন্যবাদ।

-আচ্ছা নিজের খেয়াল রেখো।

-আপনিও।

কল কেটে দেয় নিবরাস। কিছুক্ষণ পর হোয়াটসঅ্যাপে আনায়ার নাম্বার আসে। নিবরাস কল দেয় আনায়াকে। কয়েকবার রিং হতে রিসিভ করে সালাম দেয় আনায়া। ভয়েস শুনে বুঝতে পারে এটা নিবরাস।

-নামাজ পড়েছিলেন আজকে?

-এখন বলে কী হবে? সকালে জাগিয়ে দিলেন না কেনো?

-আমি কীভাবে জাগাবো?

-তো আপনার কাছে রেখে দিলেন না কেন?

-আচ্ছা এবার থেকে ফোনে এলা্র্ম সেট করে রাখবেন। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন।

-হুম বুঝলাম।

-ভার্সিটি যাবেন?

-হ্যাঁ যাবো।

-সুন্দর ভাবে চলাফেরা করবেন। নেতার বউ আপনি মাথায় রাখবেন।

-কী প্যারা দেখছেন?

-সেটা না আসলে আমার তো শত্রুর অভাব নেই। সেজন্য আপনাকে একা ছাড়তে চাইছি না।

-আরে চিন্তা করবেন না কে আমাকে কী বলবে? আর কেউই আমায় তেমন চিনে না। আমি ফেস আড়াল করেই রাখি।

-আচ্ছা বায় আমি বের হবো।

-যান ভাগেন।

আনায়া কল কেটে দেয়। নিবরাস বুঝতে পারেনা মেয়েটা মত। নিচে আসতে দেখে রোহিত আছে। পরাগ সহ তারা বেড়িয়ে পড়ে। আনায়ার ভার্সিটিতে লোক লাগিয়ে দিয়েছে নিবরাস, আনায়ার সেফটির জন্য।

সকাল দশটায় তারা আসে বৃদ্ধাশ্রমে। আসার পথে সবার জন্য ফুল নিয়ে আসে। সবাইকে নিয়ে একটা খোলামেলা রুমে বসে নিবরাস। সবার হাতে দু’টো করে গোলাপ দেয়। এর আগেও কয়েকবার এসেছিলো নিনরাস তবে তেমন গল্প করা হয়নি তার। সবার সাথে সুখ দুঃখের গল্প করছে। সবার সন্তানদের নিয়ে অভিমান, অভিযোগ শুনছে।

কেউ,কেউ সন্তানকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে পড়াশোনা করালো, বড় নামীদামী কলেজ,ভার্সিটিতে। ভালো পজিশনে জব হলো! বিয়ে করলো বৃদ্ধ বাবা মা সেবা করার ভয়ে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে গেলো।

কারোর বা সন্তান খোঁজই নেয়নি। আদৌ বাবা বেঁচে আছে তো?
অথচ সন্তান! বাবা-মা।

তারিশা মির্জা বাড়ীতে এসেছে। এবার এইচএসসি দিয়েছে। এই গতকালকে তার এক্সাম শেষ হয়েছে। ভালো গাইডলাইনের জন্য এক্সামের দুইমাস আগে হোস্টেলে উঠে তারিশা। মির্জা বাড়ীতেই ছোট থেকে বড় হয়েছে সে। মরিয়ম নওয়াজ ও তাকে অনেক আদর যত্ন করেন।

দুপুরে বাড়ীতে এসেই মামানি বলে ডাকছে তারিশা। মরিয়ম নওয়াজ তড়িঘড়ি আসেন। তারিশা তাকে জড়িয়ে ধরে।

-এক্সাম কেমন হলো মা?

-ভালোই হয়েছে মামনি। নিবরাস ভাইয়া কোথায়?

-সে তো আজকে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছে।

-আসবে কখন?

-চলে আসবে একটু পরই।

-মিসবাহ কোথায়?

-স্কুলে। নিবরাস হয়ত ওকে নিয়েই আসবে।

-আচ্ছা আমি মিসবাহকে আনতে গেলাম।

-আরে না দরকার নেই। তুমি বরং রেস্ট নেও। নিবরাস নিয়ে আসবে।

-তুমিও না মামনি। কতদিন হলো মিসবাহকে দেখি না আমি। গেলাম তো! ড্রাইভারকে নিয়েই যাবো।

-আচ্ছা যাও।

তারিশা মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে আসে। ড্রাইভার কে বলে গাড়ী বের করতে। তারিশা গাড়ীতে বসতে গাড়ী স্টার্ট দেয় ড্রাইভার তারা মিসবাহর স্কুলের দিকে যাত্রা শুরু করে।

-আংকেল বাড়ীতে কেউ এসেছিলো নাকী? নানার মৃত্যুবার্ষী কি তো সামনে এখন কোন আয়োজন হলো নাকী?

তারিশার কথায় ড্রাইভার মোতাহের বলে,

-সে কী মামনি তুমি জানো না এমপি স্যার যে বিয়ে করলো?

-না, আমি তো শুনিনি। কবে করলো বিয়ে?

-আর কয়েকদিন আগে। গতকালকে বৌভাত অনুষ্ঠান গেলো।

-আমার তো এক্সাম ছিলো।

-হুম! ওইরকম আয়োজন হয়নি। আর এমপি স্যার তো এসবে আগ্রহী না। একবারে সাধারণ ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে।

-বউকে দেখেছেন আংকেল?

-হ্যাঁ দেখেছিলাম। মাশাল্লাহ এমপি স্যারের জন্যই মেয়েটা।

-আমার থেকে বেশী সুন্দর আংকেল?

তারিশার কথায় মোতাহের হোসেনের কথা আটকে যায়। কাউকে বেশী সুন্দর, কম সুন্দর বলাটা ঠিক হবে না। যে যার মতো সুন্দর। কিন্তু মেয়েটা তো তুলনা দিয়ে ফেললো তার সাথে।

-কী হলো আংকেল?

-সে তার মতো সুন্দর আর তুমি তোমার মতো সুন্দর মা। মনে রাখবে আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। কখনো কারোর সৌন্দর্যের সাথে নিজের তুলনা করে মন খারাপ করবে না। আর না নিজের সৌন্দর্যের সাথে অন্য কারোর তুলনা করে কাউকে অপমান করবে।

-সেটা বুঝাইনি আমি।

-বুঝেছি আমি।

মিসবাহর স্কুলে গিয়ে পৌঁছানো পাঁচমিনিটের মাঝে নিবরাস আসে। নিজেদের গাড়ী দেখে চিনতে ভুল হয়নি তার। এরই মাঝে মিসবাহর স্কুল ছুটি হতে মিসবাহ চলে আসে। তারিশা গাড়ী থেকে বেড়িয়ে মিসবাহর কাছে যায়। নিবরাসকে দেখে হাসি মুখে বলে,

-কেমন আছো ভাইয়া?

-আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?

-আলহামদুলিল্লাহ।

-এক্সাম তো গতকালকে শেষ হলো। আই হোপ ভালো রেজাল্ট আসবে।

-ইনশাআল্লাহ ভাইয়া।

-মিসবাহ আন্টির সাথে যাবা নাকী মামুর সাথে?

-তোমার সাথে মামু।

-না থাক আন্টির সাথে যাও। কষ্ট করে এসেছে।

-কিন্তু…

-আমি বলেছি না মিসবাহ?

-হ্যাঁ যাচ্ছি।

তারিশা,মিসবাহ তারা আগে চলে যায়। পেছন দিয়ে নিবরাস আসে।

*******

ভার্সিটি থেকে এসে সোজা হাত পা ছিটিয়ে শুয়ে থাকে আনায়া। বাড়ীতে তেমন কেউই নেই। সে আর তার বাবাই থাকে। কাজের বুয়া এসে নাস্তা বানিয়ে দেয় সকালে। রান্না করে টুকটাক কাজ সেরে চলে যায়। আনায়া ও দেখাশোনা করে সবটা। তবুও মাঝেমাঝে অলসতা কাজ করে। সাথে একঝাঁক অভিমান,অভিযোগ কিন্তু এই অভিযোগ করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। অভিমান করার মতো পরিস্থিতি হতে দেয়নি তার বাবা। এই জন্যই বলে বাবারা বাবাই হয়। মায়ের অভাবটা পূরণ না হলেও আনায়া নিজেকে ভালো রাখা ট্রাই করছে। মরিয়ম নওয়াজ ভীষণ ভালো একজন মানুষ তাকে নিশ্চয়ই আগলে রাখবেন।

ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে মরিয়ম নওয়াজকে কল দেয় আনায়া। তার সাথে কথা বলে কিছুক্ষণ। সাথে তার আরেকটা ননদিনীর খোঁজ পায়। তারিশা নাম। আজকে বাড়ী এসেছে এতোদিন হোস্টেলে ছিলো।

কথাবার্তা শেষ হতে আনায়া কফি বানায়। জিয়াউর রহমান অফিস থেকে আসতে তাকে ঠান্ডা জুশ দেয় আনায়া। খাবার বেড়ে টেবিলের উপর রাখে।

বাবা মেয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। কথার কথায় আনায়া সাহস জুগিয়ে বলেই ফেলে,

-বাবা তুমি তো জানো তোমার থেকে আমি কিছু লুকাতে পারি না। এমনকি মনে প্রশ্ন জমা হলেও তার উত্তরটা তোমার থেকে না জানা অব্দি আমার শান্তি হয়না।

-হ্যাঁ বলো কী প্রশ্ন?

-এই নিবরাস মির্জা।

-কী হয়েছে আবার?

-শুনেছে এমপি নাকী আগেও একটা বিয়ে করেছে।

-তোমাকে এটা কে বললো?

-শুনেছি আমি তোমার থেকে বাকীটা শুনতে চাই।

-এরকম কিছু না মা। আমি জেনেশুনে তো আর তোমাকে আগুনে ফেলবো না। নিবরাস যথেষ্ট ভালো একটা ছেলে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের পরিবারে কালো দাগ আছে। অতীত! এখনো সমাজে কিছু প্রচলিত কুসংস্কার আছে। যদিও আমি সেসব টানবো না। আমি চাইনা তোমার মায়ের জন্য কেউ তোমায় বলুক যে, ‘মায়ের মেয়ে তার মতো হবে।’ নিবরাস যেমনই হোক তুমি মানিয়ে নিবে মায়ের মতো হবে না আশা করি।

-বাবাই তুমি জানো আমি মাকে ঘৃণা করি। তুমি কীভাবে একসেপ্ট করছো তার মতো আমি হবো? প্রশ্নই আসে না! আমি আমার বাবার মতো সৎ,ল্যায়ল হবো।

****

সন্ধ্যায় নিবরাস সহ বাকীরা বসে আছে। তারিশা সবার চায়ের কাপ ট্রে তে করে এনে দেয়। যদিও নিরব চৌধুরী এতে বকাঝকা করেচেন এতো লোক থাকতে তারিশা কেন চায়ের ট্রে আনবে।
তখন নিবরাস বলে,

-তোমার ভাগনির সুখ বেশী। কেউ বলেনি চায়ের ট্রে আনতে ও নিজেই এনেছে।

-আমার বউমনি এনে দিলে বেশী খুশি হতাম।

মাঝখানে মিসবাহ কথাটা বলে। নিবরাস তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। তাতে দমে যায় মিসবাহ। তারিশা মিসবাহর দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মিসবাহকে ওভার লাগছে। সব জায়গায় এতো বউমনি,বউমনি করা লাগে?

তখন মরিয়ম নওয়াজ বলেন,
-আচ্ছা আমরা,আমরাই তো। এতো রিয়েক্ট করার কী আছে? ওর মন চেয়েছে এনেছে এতো কথা শোনানো লাগে তোমাদের?

নিবরাস উঠে চলে আসে ফোন হাতে। তার কল এসেছে। এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না সে! এর আগেও ঘামায়নি আজকে বকাঝকা শুনে রিয়েক্ট করলো।

আননোন নাম্বার থেকে কল আসায় প্রথমে রিসিভ করেনি পরবর্তীতে কল আসাতে রিসিভ করে। অপরপাশে চিরপরিচিত কন্ঠ শামিম সরদারের।

-নেতা সাহেব! এলাকার উন্নয়ন নিয়ে খুব বেশী চিন্তা তাই না?

-থাকবেই তো চিন্তা আমার এলাকা।

-এতো সুনাম থাকবে না। বেশী না কয়েকটা বাচ্চা গুম করে তোকে জব্দ করতে পারলেই হলো।

-আমাকে জব্দ করে কী হবে?

-পথ থেকে সরিয়ে দেবো। নতুন করে এমপি নির্বাচন করবো আর প্রার্থী তে আমি দাঁড়াবো। শামিম সরদার রাজত্ব করবে। তুই জানিস তুই আসার পর আমার সব শূন্যের চৌকোঠায় দাঁড়িয়েছে।

হাসে নিবরাস। জবাব দেয়না। নিবরাসকে চুপ থাকতে দেখে শামিম বলে,

-তোর একমাত্র জানপাখি,প্রাণপাখি একমাত্র বউ আনায়া তাকে জব্দ করলেও কিন্তু অনেক কিছু করা সম্ভব।

-তারপর আর কাকে,কাকে জব্দ করবি?

-তোর পরিবারকে।

-আর কাকে?

-মজা নিচ্ছিস? তোর মনে হয় আমি তোর সাথে মজা নিচ্ছি?

-বায় তোর মজা আর সিরিয়াস কথা বুঝার মতো সময় আমার নেই।

নিবরাস কল কেটে দেয়। শামিম রাগে ফুসতে থাকে। তার দলের লোকদের আদেশ দেয় আনায়ার সব ডিটেইলস বের করে আনতে। সে নিজেও গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে জায়ানের বাড়ীর উদ্দেশ্য।

*****

রাতে নামাজ আদায় করে, ডিনার শেষে বৈঠক ঘরে যায় নিবরাস। সেখানে তার যত ফাইল,পেপার্স আছে তা দেখছে। আনায়াকে কী নিজের কাছে নিয়ে আসবে? তার লোক তো আছেই আনায়াকে প্রোটেকক্ট করার জন্য। তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না নিবরাস। আহিয়া যে আনায়ার কাজিন সেটাও আজকে খবর নিয়ে জেনেছে। সে নিশ্চিত বিয়েসাদীর খবর আহিয়াই আনায়ার কানে ঢুকিয়েছে। কিন্তু তাতে নিবরাসের কিছু যায় আসে না। চলার পথে কত বাঁধা আসবে! আনায়া বুঝলেই হলো। মেয়েটা লাফায় বেশী! তাকেই বুঝ দিতে হবে। মা হারানো মেয়ে চঞ্চল রয়ে গেলো অবশ্য অষ্টম আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু ও তো ওর মাকে ভালোই বাসে না। আবার কষ্ট!
এমন দয়ামায়াহীন মেয়ে তার কপালে জুটলে ভালোবাসা জুটবে কীনা সন্দেহ পোষণ করছে নিবরাস।

রাত একটার দিকে কাগজপত্র রেখে রুমে এসে শুয়ে পড়ে নিবরাস।
জিয়াউর রহমানের সাথে কথা বলে বাকী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে সে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে