হৃদয় আকাশে প্রমবর্ষণ পর্ব-০২

0
933

#হৃদয়_আকাশে_প্রমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রবণী_সারা
#পর্ব-২

নিশান অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলো। মাঝপথে হঠাৎ তার গাড়িটা খারাপ হয়ে যায়। আশেপাশে কোনো গ্যারেজ ও নেই। নিশান ড্রাইভারকে বললো গাড়ি সারানোর লোক এনে গাড়ি ঠিক করে বাড়িতে যেতে। সে সি এন জি বা অটোতে চলে যাবে। নিশান রাস্তার মোড়ে এসে দাড়ালো। রাস্তার বিপরীত পাশে একটা ভার্সিটি। নিশান সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। দুপুর টাইম হওয়ায় কড়া রোদ মাথার উপর। সে এদিক ওদিকে তাকিয়ে খালি কোনো অটো দেখছে না। নিশান সামনের দিকে তাকাতে তার চোখ আটকালো ভার্সিটির গেটে। সাদা সালোয়ার কামিজ পড়হিত এক শুভ্র রমণী গেট থেকে বের হয়ে আশেপাশে চোখ বুঝাচ্ছে। এই শুভ্র রমণী আর কেউ নয় সে হৃদিতা। নিশান পূর্বেও দেখেছে তাকে। তবে সেভাবে কখনো খেয়াল করেনি। তাহলে আজ হঠাৎ কেনো চোখ আটকালো হৃদিতাতে! কেনোই বা হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো তার? নিশানের পছন্দের রং পড়েছে বলে? সাদা শান্তির প্রতিক তাইতো সাদা রং নিশানের ভীষণ ভালো লাগে। নিশানের ঘোর কাটলো গাড়ির হর্ণের শব্দে। সে নিজের কর্মে অবাক না হয়ে পারলো না। হঠাৎ হৃদিতার দিকে কেনো এভাবে চোখ আটকালো তার! রাইসার সাথে একমাস থেকেও এভাবে নিশান কখনো দেখেনি তাকে। এমনকি কোনো আকর্ষন তৈরি হয়নি মনে।

হৃদিতা রিকসা পেয়ে উঠে বসলো। এমন কড়া রোদে মাত্র ৫ মিনিট দাড়িয়ে সে ঘেমে একাকার। হৃদিতা রুপের জন্য টেডি কিনবে। আজ ভার্সিটি আসার সময় রুপ বায়না করেছে তার জন্য নতুন টেডি কিনে নিয়ে যেতে হবে। হৃদিতা ছোট বোনের আবদার কখনো নাকচ করে না। সুপার সপ ভার্সিটির বিপরীত দিকে হওয়ায় হৃদিতা রিকসা ঘুরাতে বললো। রিকসা ঘুরিয়ে রাস্তার উল্টো পাশে আসতে হৃদিতা নিশানকে দেখতে পেলো। নিশান এক হাত পকেটে গুজে দাড়িয়ে আছে। রোদে দাড়িয়ে থাকায় ফর্সা গাল লাল হয়ে গিয়েছে। হৃদিতার মনে হচ্ছে নিশানের দৃষ্টি তারই দিকে। তবে কি নিশান ও তাকে দেখেছে?
রিকসা ক্রস করে যেতে নিশান গভীর শ্বাস ফেললো। সে আবারো হৃদিতাকেই দেখছিলো। কিন্তু কেনো?
.
হৃদিতার দাদা বাড়ী গ্রামে। যদিও দাদা বেচে নেই তবে দাদী আছেন। হৃদিতার বাবারা এক ভাই দুই বোন। হৃদিতারা ও ছোট ফুপি ঢাকাতে অনেক বছর আগে থেকে থাকছে। আর গ্রামে বড় ফুপি থাকেন হৃদিতার দাদী এখন তার কাছে থাকেন। হৃদিতার বড় ফুপি কাল রাতে ফোনে জানিয়েছে হৃদিতার দাদী খুব অসুস্থ। তারা যেন দেখতে যায়। রেজাউল সাহেব সিদ্ধান্ত নিলো সকালেই যাবে তারা এবং হৃদিতার ছোট ফুপি রিতাও যাবে। বাধ সাধলো হৃদিতা তার গ্রামে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। বাবার কাছে কিছু না বলে মায়ের কাছে অনিচ্ছার কথা জানালো। হৃদিতার মা ওর বাবাকে বোঝালো তারা তো কালই ফিরে আসবে হৃদিতা নাহয় বাসায় থাক রুপকেও ওর কাছে রেখে যাবে। যদি যাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে শাফিন তো ঢাকাতে আছে ও নিয়ে যাবে। রেজাউল সাহেব মেনে নিলেন। সকালের নাস্তা করে তারা বেড়িয়ে পড়লো গ্রামের উদ্দেশ্যে।

শাহানা খান স্বামী ও দুই ছেলেকে দুপুরের খাবার খেতে দিলেন। রিফা কিচেনের দিকে আসতে নিলে শাহানা খান রিফাকে বললেন,
রিফা তুমি খেয়ে নিতে শাফিনের ফিরতে হয়ত দেরি হবে।

রিফা মৃদু হেসে বললো,
ওকে কল দিয়েছিলাম আসছে। কাকিমা আপনি বরং খেয়ে নিন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।

আমিও বরং তোমাদের সাথে খাবো। তোমার শাশুড়ি পৌছেছে ফোন দিয়েছিলে?

একটু আগেই ফোন দিয়েছিলাম। আধ ঘন্টা হলো পৌছেছে।

আয়মান খান খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন রিতা একা গিয়েছে নাকি। উত্তরে শাহানা খান হৃদিতার বাবা মায়ের কথা বললেন যে ওরাও গিয়েছে।

শাহানা খান রিফাকে বললো,
রিফা তোমার কাছে হৃদিতার নাম্বার আছে?

আমার কাছে তো নেই। শাফিনের কাছে আছে হয়ত।

আচ্ছা শাফিন এলে ওর নাম্বার থাকলে আমাকে দিতে বলো। রিতা বলে গেলো হৃদিতা রুপ বাড়িতে একা আছে একটু খোজ নিতাম আরকি।

নিশান খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। হৃদিতা রুপ একা আছে বাড়িতে কথাটা নিশানের মস্তিষ্কে হানা দিলো। রিশান খাওয়া বাদ দিয়ে মাকে বললো,
মা তুমি হৃদি আপুকে বলবে রুপকে নিয়ে এখানে চলে আসতে। কতদিন দেখা হয়না ওদের সাথে।

শাহানা খান হেসে বললেন,
হ্যা ওরা আসবে আর তুই রুপকে ইচ্ছে মত জ্বালাবি তাইনা।

রিশান মায়ের কথা শুনে মুখ গোমড়া করে ফেললো। উপস্থিত সবাই মিটিমিটি হাসছে যা দেখে রিশান খাবার ছেড়েই উঠে পড়লো।

হৃদিতা রুপকে খাইয়ে খেতে বসেছে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে রুপকে বললো রুম থেকে ফোন এনে দিতে। রুপ ফোন এনে হৃদিতাকে দিলো। আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। একবার রিং হয়ে কেটে গেলো। আবারো কল আসতে হৃদিতা রিসিভ করে সালাম দিলো। ফোনের ওপাস থেকে উত্তর নিতে হৃদিতা কন্ঠ শুনে চিনে ফেললো এটা শাহানা আন্টি। ওপাস থেকে বললেন,

হৃদিতা তুমি আর রুপ নাকি একা আছো বাড়িতে। একটা কাজ করো আমাদের বাড়িতে চলে এসো কাল তোমার মা বাবা ফিরলে চলে যেও।

আমাদের কোনো প্রবলেম হচ্ছে না আন্টি।পারবো থাকতে আপনি চিন্তা করবেন না।

তোমরা এলে ভালো লাগতো অনেকদিন দেখা হয়নি। রিশানও বারবার বলছে তোমাদের আসতে।

হৃদিতা হেসে বললো,
আন্টি আপনি বরং রিশানকে নিয়ে চলে আসুন।

তা কি করে হয় মা। তোমার ফুপি নেই রিফাও বাবার বাড়ি যাবে বিকেলে। বাড়ি ফাকা রেখে যাওয়া যায় বলো।

শাহানা খান হৃদিতার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো। হৃদিতাকে শাহানা খানের খুব ভালো লাগে। এ যুগে এমন নম্র স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে খুবই কম আছে বলে মনে করেন তিনি। বড্ড মায়া হয় মেয়েটার প্রতি তার।
.
সন্ধার খানিক আগে হৃদিতা কিচেনে রুপের জন্য পাস্তা রান্না করছে। রুপ বায়না ধরেছে সে পাস্তা খাবে। হৃদিতা বিনাবাক্যে চলে গেলো কিচেনে। নয়ত রুপ বাড়ি মাথায় তুলবে। রুপ ড্রইংরুমে টিভি দেখছিলো। কলিংবেলের শব্দ শুনে দৌড়ে বোনের কাছে গিয়ে বললো,

আপু কে এসেছে?

হৃদিতা ধমকের স্বরে বললো,
কে এসেছে আমি দেখেছি নাকি তাকে। যা গিয়ে দরজা খুলে দেখ। পারবি খুলতে?

রুপ মাথা নাড়ালো মানে সে পারবে। রুপ দরজা খুলে দেখলো রিশান দাড়িয়ে আছে পাশে নিশান ও আছে। তবে নিশানকে রুপ চিনতে পারে নি। রিশানের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো রুপ। দুহাত কোমড়ে রেখে বললো,

আমি না তোমাকে মানা করেছিলাম আসতে। কেনো এসেছো তুমি?

রুপের কথা শুনে রিশানের হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো। রিশানের প্রতি এখনো রেগে আছে সে। এতদিন আগের কথাগুলো এখনো ভোলেনি এই মেয়ে! রিশান তো ভেবেছিলো রুপ তাকে দেখলে খুশি হবে। রিশান চাপা শ্বাস ফেলে নিশানের দিকে তাকালো। নিশান অবাক চোখে রুপের দিকে তাকিয়ে থেকে রিশানকে জিজ্ঞেস করলো,

ওই তো রুপ তাইনা। এসব কেনো বলছে কাকে বলছে?

রিশান কিছু বলার আগেই হৃদিতা দরজায় এসে দাড়ালো। দু ভাইকে দরজার ওপারে দেখে ভীষণ অবাক হলো সে। রিশান হৃদিতাকে দেখে হেসে বললো,

হৃদি আপু কেমন আছো?

ভালো আছি। তোমরা এসময়! আন্টিও এসেছে?

না মা আসেনি। তুমি মাকে বলেছো না আমাকে আসতে তাইতো চলে এলাম। মা তো আসতে দিতে চাইছিলো না অনেকবার বলে তবেই রাজি করিয়েছি। একা পাঠাতে সাহস পাচ্ছিলো না এজন্য ভাইয়া নিয়ে এসেছে।

হৃদিতা একপলক নিশানের দিকে তাকালো। নিশানের দৃষ্টি তখন মেঝেতে। হৃদিতা মৃদু হেসে বললো,
খুব ভালো করেছো এসে। এসো ভেতরে এসো আপনিও আসুন।

নিশান চট করে মাথা তুললো। এই প্রথম তাকে উদ্দেশ্য করে হৃদিতা কিছু বলেছে। আপনিও আসুন, কথাটা যে তাকেই সম্মোধন করা। এতক্ষণ সে নিরব ছিলো। সে ভেবেছিলো রিশানকে পৌছে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু এখন কেনো যেনো মন চাইছে হৃদিতার কথা অনুযায়ী ভেতরে যেতে। রিশান হৃদিতার সাথে ভেতরে গেলেও নিশান এখনো আগের জায়গাতে দাড়িয়ে। রুপ নিশানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে মুখের ভাব পাল্টে ফেললো। এটা রিশানের বড় ভাই রুপ হয়ত বুঝতে পেরেছে। রুপের হঠাৎ করেই নিশানকে ভালো লেগে গেলো। হুট করে নিশানের হাত টেনে বললো,

ভাইয়া আসো।

রুপ নিশানকে ভেতরে টেনে এনে ড্রইংরুমে বসতে বললো। নিশান বসলো। রুপকেও পাশে বসিয়ে হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেটটা সেন্টার টেবিলে রাখলো। অতঃপর নিজের পকেট থেকে বড় দুইটা চকলেট বের করলো। মা ও রিশানের মুখে রুপের কথা অনেকবার শুনেছে। তাইতো মিষ্টি কেনার সময় রুপের জন্য চকলেট কিনে নিয়েছিলো। চকলেট গুলো রুপের দিকে বাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,

রুপের কি আমার থেকে চকলেট নিতে আপত্তি আছে?

রুপ চমৎকার ভাবে হাসলো। নিশানের থেকে চকলেট নিয়ে বললো,
ভাইয়া তুমি জানলে কি করে চকলেট আমার পছন্দ?

জানতাম না তো মনে হলো তাই নিয়ে এলাম।

রিশান পাশের সোফায় বসে রুপের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
পাজি মেয়ে একটা। ভাবটা দেখো যেনো আমাকে চেনেই না।

হৃদিতা ট্রেতে করে শরবত মিষ্টি কয়েকরকম ফল নিয়ে এলো। সাথে কিছুক্ষণ আগের বানানো পাস্তও আনলো। রুপ নিশানের গা ঘেষে বসে গল্প করছে নিশানও তাল মিলাচ্ছে তাতে। হৃদিতা পূর্বে কখনো নিশানকে এতটা খোলামেলা ভাবে কথা বলতে দেখেনি। হৃদিতার মনে হতো নিশান খুবই কম কথা বলে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। নিশান এত সব আনা দেখে মৃদু স্বরে হৃদিতাকে বললো,

শুধু শুধু কষ্ট করছেন এসবের প্রয়োজন ছিলো না।

হৃদিতা যেনো খানিক চমকালো। কেনো চমকালো ঠিক বুঝতে পারলো না। নিশানের দিকে না তাকিয়ে বললো,
এই সামান্য আয়োজনে মোটেও কষ্ট হয়নি আমার।

নিশান আর কিছু বললো না। ১৫ মিনিটের মত সময় কাটিয়ে নিশান বললো সে চলে যাবে। রিশানকে আবার কাল এসে নিয়ে যাবে। হৃদিতার ভীষণ সংকোচ হচ্ছে কথা বলতে। তারপরেও ভদ্রতা বজায় রেখে বললো রাতে খেয়ে যেতে। নিশান বললো আজ নয় অন্য একদিন খাবে। নিশান নিজেও এখানে আর বেশিক্ষণ থাকতে চাইছে না। হৃদিতার দিকে যতবার তাকাচ্ছে ততবারই বুকটা কেপে উঠছে। কেনো হচ্ছে এমন তা নিশানের অজানা। তাছাড়া বাড়িতে বড়রা কেউ নেই এভাবে থাকাটাও ঠিক মনে করছে না সে। তাই তো আরো দ্রুত বেরিয়ে যেতে চাইছে।

পরদিন দুপুর পরে হৃদিতার বাবা মা চলে এসেছে সাথে ফুপিও এসেছে। ফুপি বিকেলে চলে যাবে সাথে রিশানকে নিয়ে যাবে। যদিও নিশান আসতে চেয়েছিলো তবে ফুপি আছেন বলে আর আসেনি। হৃদিতার বাবা মা রিশানকে থেকে যেতে বললো। ওদিকে রিশানের স্কুল আছে তাই আর থাকতে পারলো না। তাছাড়া রিশানও হয়ত আর থাকতে চাইছে না রুপের কথা ভেবে। কাল আসার পর থেকে রুপের সাথে কিছু না কিছু নিয়ে খুনশুটি লেগেই ছিলো। রাতে তো রুপ রিশানকে ভয় পাইয়ে ছেড়েছিলো। রিশান ওয়াশরুমে আলো ছাড়া কখনো যায় না। ছেলেটা কাল রাতে ওয়াশরুমে যেতে রুপ বাইরে থেকে লাইট অফ করে দিয়েছিলো। বেচারা রিশান তো ভয়ে কেঁদে দিয়েছিলো প্রায়। ভাগ্যিস হৃদিতা এসে সময় মত লাইট অন করেছিলো।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে