#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
পর্ব-১৭+১৮
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই স্বপ্নের জায়গায়। ভরপুর সৌন্দর্য্য দেখার জন্যও যেখানে মানুষ ভীড় করে সেখানে চান্স পাওয়াটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভার্সিটির ভেতরে পা রাখতেই কেঁপে উঠে শুভ্রতার শরীর। সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। দীর্ঘ ছয়বছরের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। শুভ্রতার মামা যখন এখানে চান্স পেয়েছিলো,তখন মামার থেকে হাজারো গল্প শুনেছিলো। সেই গল্পই একটু একটু করে মনে গেঁথে গিয়েছিলো। নিজের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলো। কিন্ত মাঝে সেখান থেকে সরে গেলেও মেঘের সাপোর্ট এ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুভ্রতা নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধ পুরুষের দিকে তাকালো। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া এই মানুষটাকে তার জীবনে দেওয়ার জন্য। আভিয়ানের বিয়ের পর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সম্পর্কটা খুব সুন্দর হয়ে উঠেছে। দুম করে হওয়ার থেকে একটু একটু করে গড়ে উঠা সম্পর্ক সুন্দর,সাথে মজবুদও হয়!
‘শুভ্র ওইদিকে চল। ওখানে এডমিশনের কার্যক্রম চলছে।’ মেঘ শুভ্রতার হাতটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বলে। শুভ্রতা মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেয়। হ্যাঁ আজ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আজ সে তার স্বপ্নের ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে এসেছে। রেজাল্ট পাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্বাস করে উঠতেই পারে নি। অবশ্য না পারার কিছু নেই। সেই ইন্টারের প্রথম বর্ষ থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে কথা। শুধু শুভ্রতা একা না,কোচিং নতুন আলাপ হওয়া মাহিরাও চান্স পেয়েছে। এতে শুভ্রতা ভীষণ খুশি। কারণ সব বন্ধুরা একসাথে থাকতে পারবে।
__________________
‘শুভ্র! কই তুমি?’ মেঘের ডাকে বারান্দা থেকে রুমে আসে শুভ্রতা। মাত্রই মেঘ বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েছে। রুমে এসে দেখে মেঘ শার্ট পড়ছে। মেঘ বাসায় সবসময় টি-শার্টই পড়ে। শুভ্রতা খানিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস করে,,’কোথাও যাচ্ছেন?’
মেঘ বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,,’হুম। সাথে আপনিও যাচ্ছেন ম্যাডাম!’
‘আমি কোথায় যাবো?’ শুভ্রতা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাস করে।
‘অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না তোমাকে নিয়ে,সারাদিন বাসায় থাকো,আমিও অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। আর দু’দিন পর তো তুমি ভার্সিটি নিয়ে বিজি হয়ে যাবা। তখন তো টাইম হবে না। তাই ভাবলাম আজ বাইরে যাই!’
‘কিন্ত তাই বলে এতো রাতে?’ মেঘ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,,’রাত আটটা ঢাকা শহরের বিকেল!’
শুভ্রতা ড্রেসিংটেবিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’তা যা বলেছেন!’
‘জ্বি। এবার চলো চটপট রেডি করে দেই। এই নাও (খাট থেকে একটা প্যাকেট শুভ্রতার দিকে তা বাড়িয়ে) এটা পড়বা।’ শুভ্রতা মেঘের হাত থেকে প্যাকেটটা নেয়। সাদা রংয়ের উপর বিভিন্ন কালারের লতা,পাতা,ফুল দেওয়া,আর আচলটাতে পুরো সুতো আর ছোট বিভিন্ন কালারের স্টোন,পুতির কাজ! এক কথায় শাড়িটা শুভ্রতার খুব পছন্দ হয়েছে। শুভ্রতা শাড়িটা নিয়ে অন্যরুমে যেতে নিলে মেঘ শুভ্রতার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। শুভ্রতা ইশারায় ‘কি?’ জিজ্ঞাস করলে মেঘ আলতো স্বরে বলে,,’আমি পড়িয়ে দেই?’
‘নিন!’ শুভ্রতার সম্মতি পেয়ে মেঘ খুব সুন্দরভাবে শুভ্রতাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিলো। অন্যদিন মেঘ শুধু কু্ঁচি ঠিক করে দিয়ে সাজিয়ে দিতো। আজ প্রথমবার শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। শুভ্রতা মুগ্ধ চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটাকে যত দেখে ততোই যেনো অবাক হয়। কি আছে এর মাঝে যার জন্য শুভ্রতা বারে বারে আটকে যায়! মেঘের শাড়ি পড়ানো শেষ হতে শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে।
‘আপনি এভাবে শাড়ি পড়ানো কার থেকে শিখলেন? আর এতো পারফেক্ট কি করে হলো। সত্যি করে বলুন!’ শুভ্রতা কোণাচোখে তাকিয়ে মেঘকে প্রশ্ন করে। মেঘ আঁচল ঠিক করে দিতে দিতে বলে,,’কোঁণা চোখে তাকানোর কিছু নেই। ইউটিউব থেকে দীর্ঘদিন শেখার পর আজকে এপ্লাই করলাম!’
‘ইন্টালিজেন্ট!’
‘জ্বি এবার মুখটা বন্ধ রেখে,কাজ করতে দাও।’ কথাটা বলে মেঘ শুভ্রতাকে খাটে বসিয়ে দিলো। তারপর চিরুনি নিয়ে শুভ্রতার চুল আছড়ে দিলো।
‘এই তোমার চুলে এতো জট কেনো? তেল দেও না?’
‘নাহ জামাইয়ের খরচ বাঁচাই!’
‘দিতে ভাল লাগে না ওটা বলো। জামাইয়ের খরচ বাঁচাও,হুদাই গুল মারো!’ মেঘের কথায় দু’জনেই হেসে দিলো। আজ আর শুভ্রতাকে সাজালো না। জাস্ট শাড়ি,হাতে স্টোনের দু’টো চুড়ি,কানে একজোড়া ছোট ঝুমকো,খোলা কোঁকড়ানো চুল। ব্যাস শুভ্রতাকে পুরো শুভ্র রংয়ে রাঙিয়ে দিলো মেঘ।
‘তো মিসেস আবরার যাও যাক!’
‘অবশ্যই!’ হেসে দু’জনেই বেরিয়ে গেলো।
_________________
পিচঢালা রাস্তায় পা মিলিয়ে হাটতে লাগলো দু’জনে। এইদিকে গাড়ি তেমন চলাচল করে না,করলেও কয়েকটা রিক্সা বা মাঝে মাঝে বাইক। রাস্তার ধারে হাতে হাত দিয়ে হেটে চলেছে মেঘ আর শুভ্রতা। মৃদ্যু বাতাসে খালি পায়ে হাটতে দারুণ লাগছে।
‘আচ্ছা আপনি আমার পছন্দ গুলো এতো নিখুঁত ভাবে জানেন কি করে? আমাদের তো এরেঞ্জ ম্যারেজ,কথাও হয় নি। তাও জানেন কি করে?’ শুভ্রতা ঘাড় কাত করে মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে। ল্যাম্পপোস্ট এর আবছা আলোয় সাথে পাশ কেটে যাওয়া বাইকের হেড লাইটের আলোয় মেঘের মুখ ভেসে উঠে শুভ্রতার কাছে। পরক্ষণে পাশ কাটিয়ে বাইক চলে যাওয়াতে আবারও আবছা হয়ে যায়। তাও শুভ্রতা অনুভব করে মেঘের মুচকি হাসি টা। এখন যদি সেটা সরাসরি দেখতো তাহলে নিশ্চিত মনে মনে বলত,,’আপনার হাসিটা এতো সুন্দর কেনো!’
‘উত্তর তোমার আশেপাশেই আছে। মন দিয়ে ভাবো,ভাবলেই পেয়ে যাবে। আসলে আমরা মানুষরা যে কোনো সিচুয়েশনে সবকিছু জটিল করে ভাবি,কিন্ত সেটার সহজ সমাধান আমাদের হাতের নাগালে পাওয়া যায়!’
‘হ্যাঁ আর আপনি যে কথাটা সহজভাবে বলা যায়,সে কথাটা জটিল ভাবে বুঝিয়ে আমার ছোট্ট মাথাটাকে হ্যাং করে দেন!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ মুচকি হেসে শুভ্রতার পানে তাকায়। মেঘের হাসিটার মানে শুভ্রতা বুঝে উঠলো না। তাও এই সবকিছু বাদ দিয়ে সে চায় সময়টা উপভোগ করতে।
‘আচ্ছা আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন? বা রিলেশন করেছেন?’ শুভ্রতার কথায় মেঘ একটু দাঁড়িয়ে পড়ে, মেঘের দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে শুভ্রতা খানিক হকচকিয়ে গেলো। সে কি কোনো ভূল প্রশ্ন করেছে! মাথা তুলে মেঘের দিকে তাকায়,মেঘ শান্তভাবে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতার মনে হালকা ভয়ের আভাস ফেলো। কিন্ত মেঘ আবার হাটা শুরু করতে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।
‘আচ্ছা আমি কি ভূল কিছু বললাম? উনি আমার স্বামী আমি জিজ্ঞাস করতেই পারি,আমি যেমন আমার সব কথা উনাকে বলেছি,উনিও তো বলতে পারেন।অবশ্য আমি জোর করবো না। বলার হলে এমনিতেই হয়তো বলবেন।’ নিজের মনে মনে কথাগুলো বলে নিজেকে শান্ত করে শুভ্রতা।
‘তুমি যেদিন তোমার প্রথম প্রশ্নটার উত্তর বের করতে পারবে,সেদিন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে!’ মেঘের হঠ্যাৎ কথায় চমকে যায় শুভ্রতা, কিন্ত মেঘের কথার মানে বুঝতে পারে নি। মেঘকে এখন একজন জটিল মানব মনে হচ্ছে। তাও ভালো লাগছে। মোটকথা, যাকে ভালোবাসি তার সবকিছুই হুদাই ভাল লাগে!
‘আইসক্রিম খাবা?’
‘এই জন মানবহীন জায়গায় আপনার জন্য কে আইসক্রিমের দোকান নিয়ে বসে থাকবে শুনি?’
মেঘ শুভ্রতার কথার উত্তর দিলো না। চুপ’চাপ কিছুদূর গিয়ে অন্য গলিতে ডুকে। গলিতে ডুকে শুভ্রতা খানিকটা চোখ বন্ধ করে ফেলে। এতোক্ষণে প্রায় আবছা আলোয় হাটছিলো তো, তাই হঠ্যাৎ তীব্র আলো চোখ নিতে পারে নি। নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ খুলে। এই পুরো জায়গাটা খাবারে স্টল। হয়তো কোনো মেলা বসেছে। মানুষের ভীড়ে ভরপুর। পিঁপড়ের মতো মানুষে গিজগিজ করছে।
‘দেখলে এই শুনশান রাস্তায় আমার জন্য আইসক্রিম না,সব খাবার নিয়েই বসে আছে।’ মেঘের কথায় শুভ্রতা ভেংচি কাটে। মেঘ তা দেখে কিছু বলে না,গা বাঁচিয়ে অতি সাবধানে শুভ্রতাকে নিয়ে ভেতরে যায়। পুরো মেলাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারদিকে লাইটিং,ফুল,বেলুন শুভ্রতা চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে শুধু। শুভ্রতার পাশে মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুভ্রতাকে দেখছে। বিশেষ করে শুভ্রতার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা।
‘মেঘ চলুন কিছু কিনি!’
‘আমার কাছে টাকা নাই!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা মুখ বাঁকিয়ে বলে,,’আপনার কাছে না থাকলে নাই, আমার বরের কাছে আছে!’
‘তা কে আপনার বর শুনি?’
‘রসকষহীন, গোমড়ামুখো সকিনার বাপ!’
‘ছিহ শুভ্র। নিজের মেয়ের এই রকম একটা নাম রাখবা? ওয়াক, মেয়ে তোমার একটা চুলও আস্ত রাখবে না!’
‘আপনার আন্দাজি বকা শেষ হলে চলেন,আমি কিছু কিনবো!’ শুভ্রতা মেঘকে টানতে টানতে দোকানের দিকে নিয়ে যায়।
চলবে..?
#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১৮)
সময় স্রোত কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। নিজের মতো করেই বয়ে চলে। কেটে গেলো কতোগুলো দিন,মাস। শুভ্রতার ভার্সিটি লাইফও খুব সুন্দরভাবে কাটছে। সকালে উঠে মেঘের জন্য ব্রেকফাস্ট করা,ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে মেঘের জন্য অপেক্ষা করা,সারাদিনের জমিয়ে রাখা কথা বলা,মাঝে মাঝে হুটহাট করে ঘুরতে যাওয়া,সবটা মিলিয়ে শুভ্রতা শান্তিতেই আছে। অতীতের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা গুলো থেকে বেরিয়ে সুন্দর সব স্মৃতি তৈরি করছে। আজ শুভ্রতার ক্লাস অফ,তাই মেঘ অফিস যাওয়ার পর কাজে লেগে পড়ে। একে একে সারা বাড়ি পরিষ্কার করলো। যেগুলো আগে থেকে পরিষ্কার সেগুলোও কারণ ছাড়া ঝাড় দিলো। মানুষ বলে না ‘আকাম্মার কাজ বেশী।’ অনেকটা সেরকমই। সব শেষে মেঘের জামা কাপড় গুছানোতে লাগলো। মেঘ বরাবরই পরিপাটি কিন্ত শুভ্রতা টাইম পাস করার জন্যই গুছানো কাজ এলোমেলো করে আবার করবে। আলমারি খুলে সব গুছানোর পর হঠ্যাৎ কোণে একটা ছবির মতো কিছু দেখতে ফেলো। শুভ্রতা কৌতুহল মেটানোর জন্য ছবিটা হাতে নিলো। পেছনেই একটা তারিখ দেওয়া ২৩/০৯/২০১৬।
‘এতো পুরনো একটা তারিখ দেওয়া ছবি উনার কাছে কি করে এলো!’ শুভ্রতা কথাটা বলে ছটফট ছবিটার মেইন পাশে চোখ বুলালো। ছবিটা দেখে শুভ্রতা খানিক চমকে উঠলো।
এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলে,হাতে একটা বই,পাশেই খরগোশের ছানার পিঠে হাত দিয়ে বসে আছে একটা মেয়ে। তারচেয়ে বড় কথা ছবিটাতে সে নিজেই। এইরকম কোনো ছবি তুলেছে বলে তার মনে পড়ছে না। তুললেও সেটা মেঘের কাছে থাকার কথা নয়। শুভ্রতা আবারও আলমারিতে ঘাটাঘাটি করে। নাহ আর কোনো কিছুই নেই। শুভ্রতার কপালে ভাজ পড়লো। ছবিটা দেখেই মনে হচ্ছে খানিকটা দূর থেকে কোণাকোণি ভাবে তোলা। তার মানে ছবিটা আড়াল থেকে তোলা হয়েছে। কিন্ত কে তুলবে? আর সেটা মেঘের কাছেই বা কি করে আসবে?
সব প্রশ্ন গুলো শুভ্রতার মাথায় ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে। এটার উত্তর এখন একমাত্র রুহিই দিতে পারবে। শুভ্রতা ছটফট ফোন হাতে নিয়ে রুহির নাম্বার ডায়েল করলো।
‘কিরে কি অবস্থা বল!’ রুহির কথার উত্তর না দিয়ে শুভ্রতা বলে,,
‘রুহিপু মেঘ কি আমাদের বাসায় আগে কোনোদিন এসেছিল?’
‘কেনো বল তো? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?’
‘আহ রুহপু তুই বল না। আমাদের বিয়ের সময়ও আমি শুনেছিলাম,উনারা নাকি আগে থেকেই পছন্দ করেছিলেন। না চিনলে তো সম্ভব নয়!’
‘আসলে শুভ্রা,মেঘ..’ রুহি আর কিছু বলার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো। ‘ওয়েট কর।’ কথাটা বলে শুভ্রতা ফোন রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। হাতে থাকা ছবিটাও খাটের এককোণায় পড়ে রইলো। যাওয়ার সময় ঘড়ির দিকে তাকালো প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে,এই সময় আবার কে আসবে। এইসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে। দরজা খুলতেই চমকে গেলো শুভ্রতা। মেঘকে একজন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা তড়িৎ গতিতে গিয়ে মেঘকে ধরে জিজ্ঞাস করে,,’এই কি হয়েছে আপনার? ব্যান্ডেজ কেনো গায়ে?’
‘ভাবি সবটা বলছি। আগে ওকে শোয়ানোর ব্যবস্থা করুন।’ পাশে থাকা লোকের কথায় শুভ্রতা, ‘হ্যাঁ। ‘ বলে দু’জনে মিলে ধরে মেঘকে রুমে শুইয়ে দেয়। শুভ্রতা পাশে বসে। মেঘের হাতে ব্যান্ডেজ,পায়ের তালুতেও ব্যান্ডেজ করা,সাথে কপালের দিকটাও ব্যান্ডেজ করা। শুভ্রতার মেঘের দিকে তাকায়। চোখ ফেটে কান্না আসছে,কিন্ত কারো সামনে সে কাঁদতে পারে না বলে,দাঁতে দাঁত চেপে বসে রয়। কিভাবে হয়েছে বলার শক্তিটুকু যেনো পাচ্ছে না। মেঘ শুভ্রতাকে শান্ত করার জন্য মুখ খুলে ভাঙ্গা স্বরে বলে,,’ডোন্ট ক্রাই শুভ্র। আমি একদম ঠিক আছি।’
মেঘের কথায় শুভ্রতা কান্নামাখা কন্ঠে বলে,,’আমি দেখতেই পাচ্ছি। কিভাবে হলো?’
‘আসলে ভাবি কোম্পানির সাইটে গন্ডগোল হচ্ছিলো। মূলত আমাদের বসের উপর রাগ ছিলো ওদের। এর মাঝে মেঘ উপস্থিত হয়ে ওদের সামলাতে যায়। বসকে ওরা আঘাত করতে এলে মেঘ উনাকে সরাতে যান,তখন মেঘের গায়ে লেগে যায়। আসলে ওরা কোম্পানির কাজ হেলাফেলা করেছিলো বলে ওদের বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়াতে ওরা ক্ষেপে গিয়েছে। তারপর আমরা মেঘকে হাসপাতালে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করিয়ে এনেছি। অল্পের উপর দিয়ে যাওয়ার কারণে হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় নি। তবে হাতের স্টেচ টা একটু গভীর হয়েছে। সারতে সময় লাগবে। পরশু আবার চেক-আপের জন্য নিতে হবে। মেডিসিন সব আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবো। চিন্তা করবেন না ভাবি। খেয়াল রাখবেন। দেখবেন সেড়ে যাবে। ব্যাথা,আর ঘুমের ঔষুধ দিয়েছে। ঘুম হবে ওর। যত্ম নিবেন।’
‘আপনি একটু বসুন। আমি চা/শরবত আনি।’ শুভ্রতার কথায় বাধ সাধলো লোকটা। থামিয়ে বলে,,’না ভাবি,আপনি উতলা হবেন না। আমি এক্ষুণি বেরিয়ে যাবো। ওদিকের অবস্থা দেখতে হবে।’ শুভ্রতার মনের অবস্থা ভালো না বলে আর জোর করলো না। লোকটা বিদায় নিয়ে চলে গেলে শুভ্রতা দরজা লাগিয়ে আবার মেঘের পাশে এসে বসে। শুভ্রতার বসা অনুভব করতে মেঘ চোখ মেলে চাইলো। ব্যাথার কারণে মুখটা কেমন হয়ে গেছে। শুভ্রতা অতি সাবধানে মেঘের মুখে হাত বুলিয়ে দিলো। বুকের ভেতরটা কেমন যেনো করছে।
মেঘ ইশারায় শান্ত থাকার জন্য বলছে। কিন্ত শুভ্রতার এতোক্ষণ ধরে বেধে রাখা অশ্রু থামতে নারাজ। হু হু করে কেঁদে দেয়।
‘আপনাকে কে বলেছে ওখানে যাওয়া জন্য? আপনার যদি কিছু হয়ে যেতো? আমার কি হতো? এতো ভালো হতে কে বলেছে? কে বলেছে ওদের সামনে যেতে? আপনি কি বাচ্চা? এতো অসাবধান কেনো আপনি? আমাকে সবসময় বকা ঝকা করেন। এখন আপনার বেলায় কি হলো?’
শুভ্রতা কান্নার জন্য ঠিকমতো কথাই বলতে পারছে না। মেঘের ডান হাতে ব্যাথা ছিলো বলে,বা হাত উঠিয়ে শুভ্রতার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। শুভ্রতা মেঘের হাত চেপে ধরেই কান্না করতে লাগে।
‘শান্ত হও শুভ্র। এতো কান্নার কিছু হয় নি। দেখো আমি ঠিক আছি। হালকা একটু লেগেছে। শান্ত হও প্লিজ।’ শুভ্রতা নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসে। তারপর মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,
‘আপনার চেঞ্জ করা প্রয়োজন,ময়লা জামা কাপড়ে জীবাণু থাকবে,চেঞ্জ করে খাবার দিচ্ছি।’
‘একা চেঞ্জ করা সম্ভব নয়!’
‘একা কেনো? নিজের জ্বলজ্যান্ত বউ আছে দেখতে পাচ্ছেন না?’
‘ওমা আমার বুঝি লজ্জা করে না?’ মেঘের কথায় শুভ্রতা এক ভ্রু উঁচু করে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ তা দেখে হাসার চেষ্টা করে। শুভ্রতা বুঝলো মেঘ তাকে হাসানোর চেষ্টা করছে। কিন্ত এখন কিছুই ইচ্ছে করছে না। শুভ্রতা ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পানি,তোয়ালে নিয়ে আসলো। মেঘকে কোনোমতে উঠে বসালো। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে একা একটা মেয়ে উঠিয়ে বসানো বেশ কষ্টসাধ্য। হাতের কনুই’য়ের কারণে মেঘ ঠিক মতো নিজে নিজে উঠে বসতে পারছে না। তাই শুভ্রতাকে উঠে বসাতে হলো। তারপর তোয়ালে ভিজিয়ে মেঘের শরীর মুছিয়ে টি-শার্ট পড়িয়ে দেয়।
‘আপনি একটু বসুন। আমি আপনার জন্য খাবার আনছি।’ মেঘ শুভ্রতাকে আটকিয়ে বলে,,’তুমি পাশে বসো। আমার এখন ক্ষিধে পায় নি।’
‘ক্ষিধে পেয়েছে কি পায় নি,সেটা আমি বুঝবো। আপনি বসুন।’
‘পেট টা আমার!’
‘তো কি হয়েছে,পেট আপনার বর আমার!’ কথাটা বলে শুভ্রতা কিচেনে যায়। ফিরে আসে এক প্লেট ভাত নিয়ে। তারপর মেঘকে নিজের হাতে খাইয়ে,মেডিসিন দিয়ে শুইয়ে দেয়। নিজেই মেঘের মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঘুমের মেডিসিনের কারণে অল্পসময়েই মেঘ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। শুভ্রতা মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। ওই ছবির কথায় বেমালুম ভূলে গেছে। আপাদত ধ্যান জ্ঞান সবটাই মেঘের সুস্থতা কামনা।
______________
কারো গোঙানীর আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে শুভ্রতার। একটু আগেই চোখ লেগে এসেছিলো। হাতের উপর ভর দিয়ে শোয়ার কারণে হাতটা কেমন ঝিমঝিম করছে। মোবাইকের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়ির কাটা রাত এক’টায় পৌঁছেছে। শুভ্রতা উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। রুম আলোকিত হতে দেখে মেঘ কেমন কাঁপছে। শুভ্রতা তাড়াতাড়ি করে মেঘের কাছে গেলো। গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে যেনো। ব্যাথা থেকেই জ্বরটা উঠেছে। শুভ্রতা আলমারি থেকে মোটা কম্বল বের করে মেঘের গায়ে দিলো। কাঁপুনি যেনো থামছেই না। ভয়ে শুভ্রতা কেঁদে দিলো। এতোরাতে একা একা কি করবে বুঝতে পারছে না। নিজেকে কেমন ছন্নছাড়া লাগছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। তারপর বাটি ভর্তি পানি এনে মেঘের মাথায় কাপড় ভিজিয়ে দিতে লাগে। মেঘকে এই মুহুর্তে নাড়ানো সম্ভবও না। তাই মাথায় পানি না দিয়ে কাপড় ভিজিয়ে দিতে লাগলো। এতোরাতে কারো ফ্ল্যাটে গিয়েও হেল্প চাইতে পারবে না। শুভ্রতা পুরো রুম চেক করে,জ্বরের ঔষধ খুঁজে ফেলো। মেঘকে ডাক দিলো। জ্বরের ঘোরে মেঘ ফিটফিট করে তাকালো। শুভ্রতা কোনোমতে ঔষুধটা খাইয়ে শুইয়ে দিলো।
‘তুকি ঘুমাও শুভ্র। আমি ঠিক আছি।’ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলছে মেঘ। শুভ্রতা সে সব আমলে না নিয়ে একমনে কাপড় ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এখন এটা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এতো রাতে মেঘকে একা ফেলে ডক্টর খুঁজতে যাওয়াও সম্ভব না। শুভ্রতা ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মেঘের জ্বর ঘাম দিয়ে ছেড়ে দিতে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। এতোক্ষণ যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। ঘড়িতে দেখে তিনটে দশ বাজে। শুভ্রতা জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহর কাছে স্বামীর জন্য প্রার্থনা করতে দাঁড়ায়। তাহাজ্জদের নামাজ যে বরকরময়। আল্লাহ নিশ্চয়ই মন থেকে চাইলে ফিরিয়ে দেবেন না। এক বুক আশা আছে শুভ্রতার।
চলবে..?