হৃদমাঝারে পর্ব-১৫+১৬

0
919

#হৃদমাঝারে
#নাইমা_জান্নাত
পর্ব-১৫+১৬

দীর্ঘ রজনী। আকাশ জুড়ে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা ছড়ানো ছিটানো তারা! একটা তারা একটু বেশীই জ্বলজ্বল করছে হয়তো শুক’তারা! ছাদে রাখা বেলী ফুল গাছ থেকে মোহনীয় ঘ্রাণ বের হচ্ছে। এই মুগ্ধকর পরিবেশে ছাদের রেলিং এর পাশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ,শুভ্রতা। দুজনেই মুখেই কোনো কথা নেই,কিন্ত এই নিরবতা যেনো অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। ছাদ থেকে সবাই নিচে নেমে শুতে চলে গেছে। সময় তো কম হলো না! ছেলে মেয়েদের আলাদা ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে। মেঘ সেটা মানতে নারাজ! তার বিয়ে করা বউ অন্যরুমে ঘুমাবে কেনো? ফলস্বরুপ সে শুভ্রতাকে আটকে রেখেছে নিজের কাছে। তার ভাষ্যমতে আজ তারা রাত জাগবে।
আজ মেঘের কথা,আচরণ গুলো অন্যরকম ঠেকছে শুভ্রতার কাছে। এতোদিনের মেপে মেপে কথা বলা মানুষটার মুখে এইরকম কথা যতোটা না অবাক করে ততোটাই খুশি হয় শুভ্রতা। মানুষটাকে আজ একজন প্রেমিক পুরুষের থেকে কম লাগছে না। নাই’বা হলো সে আর পাঁচটা তথাকথিত নায়কদের মতো রোমান্টিক, নাই বা দিলো মিনিটে মিনিটে সারপ্রাইজ কিন্ত তার ছোট ছোট কেয়ার গুলোই শুভ্রতার কাছে যথেষ্ট ভালোবাসার জন্য!
ধমকা বাতাসে শুভ্রতার বিণুনী করা কিছু চুল সামনে বেরিয়ে আসে। শাড়ি চেঞ্জ করা থ্রি-পিছ পরে নিয়েছে আগেই! হলুদ মাখানো শাড়িতে তো থাকা যায় না। শুভ্রতা কিছু করার আগেই মেঘ আলতো হাতে শুভ্রতার চুল’গুলো কানের পিছে গুঁজে দিলো।
‘এই সময়টা না হয় এখানেই থেমে যাক!’ মনে মনে প্রার্থনা করে শুভ্রতা। কিন্ত সময়কি কারো জন্য অপেক্ষা করে? উঁহু। মেঘ দু’হাতে আলতোভাবে শুভ্রতার মুখটা উঁচু করে ধরে, শুভ্রতা মেঘের হাত ধরে ইশারায় ‘কি?’ জিজ্ঞাস করে। মেঘ কিছু না বলে শুভ্রতার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দেয়। এটা নতুন না হলেও শুভ্রতার কাছে অনুভূতিটা সেই প্রথম দিনের মতোই। চোখ দু’টো বন্ধ করে নিঃশব্দে হাসলো। এই মানুষটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এতোদিন ধরে হারানো সবকিছুর ক্ষতিপূরণ স্বরুপ এই মানুষটাকে যেনো পেয়েছে!

মেঘ আর শুভ্রতা দু’জনেই রেলিং এর উপর উঠে বসে। আভিয়ানদের বাসার ছাদের রেলিংটা বেশ মোটা,যার কারণে সহজেই উঠে বসে যায়। শুভ্রতা মেঘের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। মেঘ নিজের প্রেয়সীকে আগলে রেখেছে।
‘শুভ্র! গান শুনবে?’ নিরবতা ভেঙ্গে মেঘ বলে। শুভ্রতার বুকে মাথা রেখেই মুখটা খানিক উঁচিয়ে বলে,,’আপনি শুনাবেন?’
মেঘ কিছু বললো না। শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে সময়টা উপভোগ করার চেষ্টা করে।

‘কিছু কিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যাথা হয়নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শুনে সে আড়ালে।

আকাশ যখন গাইবে বলে
আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গান..
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান…
আকাশ যখন ফিরতি পথে মন খারাপের সুর
বাতাস তখন নিরব চিঠি পাঠায় বহুদূর
বহুদূর…

কিছু কিছু ধুলো জমে আছে কাঁচে
ডাকনামগুলো ভীষণ ছোঁয়াচে
মরে যাওয়া জমি ভীজে গেলো জলে
চারাগাছ’গুলো কতো কি যে বলে…

তোমার এমনি আসা,এমনি যাওয়া
এমনি হাজার ছল,সাজিয়েছ যেন
তোমার এমনি খেলা খেয়াল খুশি
করছে কোলাহল,থামেনি এখনও
চুপিচুপি দেয়াল জুড়ে আঁকছি কতো
মন কেমনের পাতা
চুপিচুপি জানতে পেলাম নিরুদ্দেশে
মায়ার চাদর পাতা..

কিছু কিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যাথা হয় নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শুনে সে আড়ালে..
আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গানে
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান…..

গান শেষ করে চোখ খুলে শুভ্রতার দিকে তাকায় মেঘ। এতোক্ষণ গানটা সে চোখ বন্ধ করে গাইছিলো। আর শুভ্রতা মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মেঘ যে এতোভালো গান গাইতে পারে তার জানা ছিলো না। ইশ যদি জানতো তাহলে প্রতিদিন একটা করে গাইয়ে ছাড়তো। মেঘ তাকাতে দু’জনের চোখাচোখি হয়ে যায়।
মেঘ ইশারায় ‘কেমন হয়েছে?’ জিজ্ঞাস করলে শুভ্রতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,’খুব সুন্দর। আপনি এতো ভালো গান আমি জানতামই না!’
মেঘ মুচকি হেসে শুভ্রতাকে নিজের দিকে টেনে দু’হাতে শুভ্রতার কোমড় আঁকড়ে বলে,,’ম্যাডামের তাহলে ভালো লেগেছে বলুন!’
‘হুম অনেক!’ শুভ্রতার মেঘের কাঁধে দু’হাত দিয়ে বলে।
‘তাহলে আমার গিফট পাওয়ার অধিকার আছে! আমার গিফট?’
‘এ ্যাহ আমি কি আপনার জন্য গিফট নিয়ে ঘুরি নাকি? নাকি আমি জানতাম আপনি গান গাইবেন আমাকে গিফট দিতে হবে!’ শুভ্রতা ভেংচি কেটে বলে।
‘কিন্ত আমার যে গিফট চাই!’
‘আমার কাছে কিছু নেই। আপনি নিতে পারলে নিয়ে নিন কিছু!’
শুভ্রতার এই কথার অপেক্ষায় হয়তো ছিলো মেঘ। শুভ্রতার কথা শেষ হতেই মেঘ অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। শুভ্রতার ওষ্ঠের সাথে নিজের ওষ্ঠ মিলিয়ে দেয়। মেঘ আকস্মিক কাজ হতবম্ভ হয়ে যায় শুভ্রতা! কিছুক্ষণ পর মেঘ শুভ্রতাকে ছেড়ে দেয়। শুভ্রতা ছাড়া পেতে নাক মুখ কুঁচকে বলে,,

‘এই আপনি সত্যি আমার বর তো? এখানে আসার পর মাঝখানে আমার বর হাওয়া হয়ে গেছিলো। তখন নিশ্চয়ই আপনি আমার বরকে আটকে ওর জায়গায় নিজে চলে এসেছে! আমার ওই রস কষহীন বর এই সব কোনোদিন করতো না। আল্লাহ এখন তো মাঝরাত,এইসময় উনারা বের হন। তবে কি আপনি! থু থু। এই আমার বর কই? আমার ওই রস কষহীন বরই ভালো। ওইডা কই?’

শুভ্রতার মেঘ মেঘ খানিক জোরেই হেসে দেয়। শুভ্রতার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,’তোমার বরকে আমি ভ্যানিস করে দিয়েছি।’
কথাটা বলে দু’জনেই হেসে উঠে। শুভ্রতাকে হাই তুলতে দেখে মেঘ বলে,,’ঘুম পাচ্ছে?’
‘হুম।’
‘আচ্ছা চলো। এখন গিয়ে শুয়ে পড়। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তো!’
‘আচ্ছা চলুন।’ তারপর দু’জন মিলে নিচে নেমে গেলো।
_________________
‘মেঘ এটা কোনো কথা হলো? এভাবে কেউ বিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসে?’ শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে। মেঘ শুভ্রতার শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে,,’আমি কি বলেছিলাম? কিছু জিনিসের অধিকার ব্যক্তিগত ভাবে শুধুই আমার। এখন নড়াচড়া বাদ দিয়ে ঠিক ভাবে দাঁড়াও। আবার ফিরে যেতে হবে!’
শুভ্রতা ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়ে। আসলে মেঘের মা ঠিকই বলেছে তার ছেলে একটা ঘাড়ত্যাড়া!
শুভ্রতা বিয়ে বাড়ির ঘটনা ভাবতে লাগে। বিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য সবাই তৈরি হওয়ার জন্য উঠলে মেঘ এসে শুভ্রতাকে নিয়ে খালার কাছে যায়।
‘খালামণি,আমি আর ও একটু বাসায় যাবো। বরযাত্রী বের হওয়ার আগে আগেই চলে আসবো!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা কিছু বুঝতে পারলো না। তাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
‘কেনো রে মেঘ। কোনো সমস্যা হয়েছে এখানে? আসলে এতো কাজের মধ্যে আমি ঠিকমতো তোদের খেয়াল রাখতে পারছি না। শুভ্রতা মা, তোমার কোনো অসুবিধে হয়েছে?’
মেঘের খালার কথায় শুভ্রতা বলে,,’না না খালামণি আমার কোনো অসুবিধে হয় নি।’
‘কি হয়েছে সেটা আমি বুঝলে তো আপনাকে বলবো’ মনে মনে কথাগুলো বলে শুভ্রতা।

‘আসলে খালামণি,ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য যে জামা নিয়েছিলাম,ভূল করে ওই ব্যাগটা রেখে এসেছি। এখন রেডি হওয়া লাগবে তো। আর এখানে অনেক ভীড়ও বাসা থেকে এনে আবার এখানে রেডি হওয়া সম্ভব নয়। তাই ভাবলাম ওখান থেকে একেবারে রেডি হয়ে যোগ দিবো। তুমি চিন্তা করো না এখন মাত্র সাড়ে দশ’টা আমরা সাড়ে বারোটার মধ্যে চলে আসবো। তারপর আমি এসে আভিয়ানকে রেডি করে আমরা সোয়া একটার মধ্যে রওনা দেবো!’

‘আচ্ছা বাবা। তুই যা ভালো বুঝিস। তুই তো ছেলের মাঝে বড়। তোর উপরই সব দায়িত্ব। আমি ভরসা করি তোকে। সাবধানে যাবি,আসবি।’ তারপর মেঘ,শুভ্রতা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে।

‘আপনি খালামণিকে মিথ্যে বললেন কেনো?’
‘কই মিথ্যে বললাম। যে শাড়ি এনেছো সেটা আমার পছন্দ নয়,তাই বাসায় যাচ্ছি.’

‘আমি তো আপনাকে জিজ্ঞাস করেই এনেছিলাম!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ হাটা থামিয়ে সিএনজি ডাকে। তারপর উঠতে উঠতে বলে,,’শোন শুভ্র! তুমি যদি ওই বাসায় এখন রেডি হতে,আমি তোমাকে সাজাতাম কি করে? তাই আমরা বাসায় যাচ্ছি। আর কোনো কথা বলবা না। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে!’
মেঘের কথায় শুভ্রতার মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়! এই কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে!
________________________
‘হয়ে গেছে!” মেঘের কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। তারপর আবার দু’জনে ওই বাসার জন্য বেরিয়ে যায়।
‘আপনি একেকটা কান্ড এরকম করেন না? একদিন না হলে কি খুব বেশী ক্ষতি হতো?’ শুভ্রতার কথায় মেঘ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,,’আমি যদি একদিন তোমার সাথে না থাকি, তবে কি ক্ষতি হবে?’
মেঘের কথায় শুভ্রতা তড়িৎ গতিতে মেঘের দিকে তাকায়। মেঘের মুখ দেখে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে। মেঘ কথাটা বেশ গভীর ভাবেই বলেছে। শুভ্রতা মেঘের হাত ধরে বলে,,’সেটা আমি মানতে পারবো না!’
‘তাহলে আমিও মানতে পারবো না!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা মুচকি হাসে। উঁহু মানুষটা ভূল নয়।
বিয়ে বাড়িতে এসে শুভ্রতা মাহিদের কাছে চলে যায়। মেঘ আভিয়ানের কাছে যায়। এরপর সবাই মিলে কনের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
পুরো বিয়েটা শুভ্রতা খুব সূক্ষ্ম ভাবে দেখেছে। পুরোটা সময় মেঘ শুভ্রতার পাশেই ছিলো। শুভ্রতার আজ নিজের বিয়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।
________________
সবাই ফটো তুলতে ব্যস্ত। যে যা পারে শুধু ক্লিক করতে থাকে। পরে দেখে দেখে ভালো খারাপ নির্বাচন করবে। শুভ্রতার কোনো কালেই ফটোশুটে আগ্রহ ছিলো না। তাই চুপচাপ বসে আছে। মেঘ রাস্তার দিকে গিয়েছে,তাদের ফেরার সময় হয়ে এসেছ। গাড়ি এসেছে কিনা এইসব তদারকি করতে গিয়েছে। শুভ্রতার একা একা ভালো লাগছে না দেখে সেও উঠে সেদিকে যায়।

খানিকটা আগানোর পর মেঘের সাথে একটা মেয়েকে চিপকে থাকতে দেখে শুভ্রতা থম মেরে দাঁড়িয়ে যায়। মেঘের প্রায় গা ঘেঁষে ছবি তুলছে একটা মেয়ে। শুভ্রতা তা দেখে পা চালিয়ে সেদিকে যায়। আজ মেঘের খবরই আছে।

চলবে..?

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১৬)

বিদায়ের বেলা সবসময়ই কষ্টকর। একটা মেয়ে যখন নিজের চিরচেনা বাড়ি থেকে অন্য অচেনা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয় তখন তার মনের অবস্থা কেমন হয়,সেটা শুধু একটা মেয়েই জানে। এর পর থেকে নিজের বাবার বাসায় আসলেও দু’দিনের অতিথি ছাড়া আর কিছুই নয়। সবাই গাড়িতে উঠে পড়েছে। কেউ কেউ ফিরেও গিয়েছে। কাজিন মহল,মেঘ,শুভ্রতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আভিয়ানের বউয়ের বিদায় শেষ হলে রওনা দিবে। শুভ্রতা এককোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে,এখন আবার প্রিয়া (আভিয়ানের বউ) এর কান্না দেখে নিজের হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ব্যাপারটা কি অদ্ভুত না? সে নিজের বিয়েতে কাঁদে নি, এখন অন্যের বিয়েতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! মেঘ এসে শুভ্রতার পাশে দাঁড়ালে শুভ্রতা কিচ্ছু বলে না, মেঘের থেকে সরে গিয়ে মাহির পাশে দাঁড়ায়। মাহি শুভ্রতাকে দেখে মুচকি হাসে। মেয়েটার চোখেও পানি চিকচিক করছে,হয়তো প্রিয়ার কান্না দেখে!
শুভ্রতা কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতে লাগলো।
মেঘের পাশে একটা মেয়েকে দেখে শুভ্রতা সেদিকে এগিয়ে যায়। শুভ্রতাকে দেখে মেঘ ছিটকে দূরে সরে যায়। শুভ্রতা তা দেখে তীক্ষ্ম চোখে তাকায় মেঘের দিকে। যেনো চোখ দিয়েই মেঘকে ভষ্ম করে দিবে। মেঘ দু’টো ঢোক গিলে বলে,,’আরে শুভ্র! আসো। ও হলো আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড। প্রিয়ার কাজিন!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা জোরপূর্বক হেসে বলে,,’ওহ!’

‘হেই মেঘ। এটা কে?’ সুমাইয়ার কথায় মেঘ মুচকি হেসে বলে,,’মিসেস আবরার আওসিফ!’
মেঘের কথা হয়তো মেয়েটার পছন্দ হয় নি। মুখটা হাওয়া ছাড়া বেলুনের মতো চুপসে গেলো। শুভ্রতা তা দেখে পৈচাশিক আনন্দ পেলো।
‘দেখ শাঁকচুন্নি। এবার কেমন লাগে। আমার বরের সাথে নিকনিক করতে এসেছিস তাই না? তোর চিপকে থাকা আমি বের করছি!’ শুভ্রতা মনে মনে কথাগুলো বলে।
এর মাঝে আভিয়ান কোনো একটা প্রয়োজনে মেঘকে ডাক দিলে মেঘ “আসছি।’ বলে সেখান থেকে সটকে পড়ে। শুভ্রতা মেকি হাসি দিয়ে সুমাইয়ার দিকে তাকায়। সুমাইয়া ‘আচ্ছা আসছি।” বলে যেতে নিলে শুভ্রতা আটকে দেয়।

‘সে কি আপু,আপনি আমার স্বামীর বান্ধুবি একটু গল্প করবো না?’ শুভ্রতার কথায় সুমাইয়া ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রয়।
‘আপনারা একসাথে পড়ালেখা করেছেন?’
‘হ্যাঁ আমি আর মেঘ তো বেস্টফ্রেন্ডের মতো ছিলাম। মেঘ আমায় কতো হেল্প করেছে!’ সুমাইয়া আরো কিছু বলতে নেবে এর আগেই শুভ্রতা থামিয়ে দিয়ে বলে,,’আরে আপু। আপনার মেকাপ অনেকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে তো! এই দেখুন কাজলটা (কথাটা বলে শুভ্রতা হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে মুছে দেয়)।
‘ওহ থ্যাংস। আসলে তাড়াহুড়োতে ঠিকমতো সবটা হয় নি।’
দু’জনের কথা বলার মাঝেই একটা বাচ্চা হাতে দই নিয়ে হেটে আসছিলো। শুভ্রতাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শুভ্রতা আরে পিচ্চি বলে বাচ্চাটাকে ধরতে নেয়,তখন সুযোগ বুঝে পুরো কাপটা সুমাইয়ার জামায় ঢেলে দেয়। সুমাইয়া ছিটকে সরে যায়।

‘এই এটা তুমি কি করলে? দেখে চলতে পারো না? আমার পুরো জামাটাই নষ্ট করে দিলে!’ সুমাইয়ার চিল্লানীতে ভয় পেয়ে বাচ্চাটা দৌড়ে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে,,’ও মা ভূত!’
বাচ্চাটার কথায় শুভ্রতা আস্তে করে কেটে পড়ে। সুমাইয়া নিজের জামার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। সেখানে নিজের অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠে। তার মুখের অনেক জায়গায় কালো কালো কাজল লেপ্টে আছে, মুখের মেকাপ খানিকটা উঠে গেছে,কিছুটা আছে। নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যায়। তার মানে এসব শুভ্রতার কাজ।
‘দেখ শাঁকচুন্নি কেমন লাগে এবার! অন্যের বরের সাথে নিকনিক? নেহাত বিয়ে বাড়ি বলে আর কিছু করলাম না। নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন। এবার আমার বরটা কই? ওটাকে ধরতে হবে। কি সাহস,বলে কিনা ভার্সিটি ফ্রেন্ড!’ রাগে গজগজ করতে করতে শুভ্রতা চলে যায়!

‘ভাবী কি ভাবছো?’ মাহির কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। মাথা নেড়ে বলে,,’কিছু নাহ। চলো যাবার সময় হয়ে গিয়েছে!’ কথাটা বলে শুভ্রতা আগে আগেই গাড়িতে উঠে পড়ে। সে কিছুতেই মেঘের সাথে যাবে না। মেঘের পাশে বসবেও না। থাকুক অন্য মেয়েকে নিয়ে,সেল্ফি তুলুক। কই তার সাথে তো কোনো সেল্ফি তুলে নাই। তাহলে সে কেনো কথা বলবে? বলবে না কথা। কিছুতেই না। শুভ্রতার পাশে সিট খালি না পেয়ে মেঘ অন্য জায়গায় বসলো। ম্যাডাম যে ক্ষেপে গেছে সেটা ভালো ভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছে।
________________
‘মেঘ বাবা কিছু জিনিস একটু আনা লাগবে। তুই প্লিজ গিয়ে নিয়ে আসতে পারবি?’ মেঘের খালার কথায় মেঘ সম্মতি দিয়ে বলে,,’আচ্ছা। আমায় লিস্ট দাও। আমি নিয়ে আসছি!’ মেঘ নিজের খালার থেকে লিস্ট নিয়ে মার্কেটে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। বাসার সামনে শুভ্রতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাক ছাড়ে,,’শুভ্র!’ শুভ্রতা পেছন ফিরে মেঘকে দেখে ভেংচি কাটে। মেঘ দ্রুত পা চালিয়ে শুভ্রতার কাছে আসে।
‘শুভ্র। মার্কেটে যাচ্ছি। তুমি যাবে?’
শুভ্রতা কিছু না বলে চুপ করে আছে।
‘চুপ থাকা কি সম্মতির লক্ষণ?’
শুভ্রতা এবারও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ তা দেখে হাত ধরে বেরিয়ে যায়।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। কিন্ত একটাও খালি সিএনজি পাচ্ছে না। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। লিস্টে রুম সাজানোর জিনিসও আছে। ঠিক সময় না নিলে সাজানো কমপ্লিট হবে না।
‘উফফ। সিএনজি ছাড়ুন। বাসে চলুন!’ শুভ্রতা বিরক্ত হয়ে বলে।
‘কিন্ত বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে?’ মেঘ শুভ্রতার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে। শুভ্রতা রাগি দৃষ্টিতে তাকাতে মেঘ একটা অটো নিয়ে বাসস্টপে যায়। এখান থেকে আভিয়ানদের বাসা অনেকটাই দূর। সব জিনিস এক জায়গা থেকে নেবে বলেই মূলত মার্কেটে এসেছে।
‘আপনার কাছে বেলুন আছে না?’
‘হ্যাঁ আছে। কেনো?’
‘দিন।’ মেঘ শুভ্রতার দিকে একটা বেলুন এগিয়ে দিতে শুভ্রতা তা ফুলিয়ে নিজের থ্রি-পিছের সাথে পিট করে নেয়। তারপর বড় করে পেটের উপর ওড়না দিয়ে দেয়। দেখে একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার থেকে কম লাগছে না। শুভ্রতার কান্ডে মেঘ হা হয়ে যায়। অটো থেকে নেমে দু’জনে বাসে উঠে পড়ে। পুরো বাসে মানুষে ভর্তি। শুভ্রতাকে প্রেগন্যান্ট ভেবে একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বসতে দেয়। পাশে হয়তো ছেলেটির বন্ধু। মেঘ তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,’ভাইয়া আমার বউ প্রেগন্যান্ট তো। যদি কোনো সমস্যা হয়। আমি ওর পাশে বসি?’
মেঘের কথায় ছেলেটিও উঠে যায়। শুভ্রতা তা দেখে মেঘের কানে ফিসফিস করে বলে,,”আমাকে দিয়ে নিজের জায়গাটাও করিয়ে নিলেন?’
আসলে কি বলো তো,তোমাকে আমি যতোটা গবেট ভেবেছি,তুমি তার থেকে অনেক চতুর। কার বউ দেখতে হবে না?’ মেঘের কথায় শুভ্রতা ভেংচি কেটে ঠিক ভাবে বসে। কিন্ত বেলুন জিনিস কি স্থির থাকে? তাও শুভ্রতা যতোটা সম্ভব ঠিকভাবে রাখার চেষ্টা করে।
________________
“কি গো বউ। বাচ্চা-কাচ্ছা কিছু নিবা না? বিয়ে হইছে কয়েকমাস তো হই গেলো। কোনো খবর আছে নাকি?’
বয়স্ক একজন মহিলা কথাটা বলে। শুভ্রতার তার দিকে তাকিয়ে মহিলাকে চেনার চেষ্টা করে,মনে পড়েছে এটা আভিয়ানের ফুফি। শুভ্রতা কিছু না বলে সৌজন্যমূলক হাসি হাসলো। বিয়ে বাড়িতে আসবে এসব শুনবে না তা কি হয়! শুভ্রতা কিছু বললো না। পাশেই মেঘ বসে চা খাচ্ছিলো। বিয়ে বাড়িতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঘ চা খাওয়া বন্ধ করে আভিয়ানের ফুফিকে বলে,,’ফুফি,তোমার ছেলের বিয়ে হয়েছে কয়দিন হয়েছে?’
‘এই দু’বছর হবে কেনো?’
‘কয়টা ছেলে-মেয়ে?’
‘আরে এখনও একটাও হয় নি রে। কতো বলি তাও কানে নেয় না! বলে সবকিছুর একটা সময় আছে,প্ল্যানিং আছে!’

মেঘ এবার মুচকি হেসে বলে,,’তোমাএ ছেলের যদি সময়,প্ল্যানিং থাকে,তবে আমাদের থাকবে না কেনো? আমার বাচ্চা বউয়ের মাথায় এসব ডুকিও না এখন! সময় আসলে সবাই সু’খবর শুনবা!’
মেঘের শান্ত স্বরের উত্তর উনার পছন্দ হয় নি। জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,’আজ কালকার ছেলে পুলেদের কিছু বলা যায় না, যদি বলি একটা কথা শুনিয়ে দেয় তিন কথা। যা ইচ্ছে কর। আমাদের কি?’ কথাটা হলে মহিলাটি ওখান থেকে চলে যায়। শুভ্রতা মুচকি হাসে।

‘এই আপনি আমাকে বাচ্চা বউ বললেন কেনো? আমি বাচ্চা?’
‘নাহ তুমি বাচ্চা বউ।’ কথাটা বলে মেঘ শুভ্রতার নাক টেনে দেয়।
‘আচ্ছা উনি তো ঠিকই বলেছে,আমার বিয়ের কয়েক মাস হয়েছে। বাবু..’ আর কিছু বলার আগেই মেঘ থামিয়ে বলে,,’একটা বাচ্চাকে নিয়েই আমার অবস্থা কাহিল,আরেকটা পারবো না!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,,’এতোই যখন বাচ্চা তবে রাতে বাচ্চার কাছে আসেন কেনো?’
‘আমার বউ আমি আসি কার কি?’ মেঘ শুভ্রতার কাছে এসে বলে।
‘এরপর থেকে কাছে আসলে,শিশু নির্যাতনের মামলা করবো!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ হেসে দিলো। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কাউকে দেখতে না পেরে টুক করে শুভ্রতার গালে ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে গটগট করে হেটে চলে গেলো। মেঘের কান্ডে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দিলো।

চলবে..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে