হৃদমাঝারে পর্ব-০৯+১০

0
975

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
পর্ব-০৯+১০

অতীত যে সবসময় আনন্দদায়ক সেটা কিন্ত নয়। অনেকের অতীয়ের পৃষ্ঠা উল্টালে শুধু বিষাদের ছায়াই দেখতে পাওয়া যায়। অন্ধকার এক রাতে শুভ্রতাও নিজের অন্ধকার অতীতের পাতা তুলে ধরে মেঘের সামনে।
‘আমি ছোট’বেলা থেকেই চার’দেয়ালের মাঝে বড় হয়েছি। আমাকে সবসময় এটা বলা হতো বাইরের ছেলে’মেয়েদের সাথে মিশতে না। ওদের সাথে মিশলে মুখের ভাষা খারাপ হয়ে যাবে। আমি বরাবরই চাপা স্বভাবের ছিলাম। তাই খারাপ লাগলেও কিছু বলতাম না। সারাদিন টিভি দেখা,পড়া এই অবধি আমার সীমানা ছিলো। আম্মু কোথাও বেড়াতেও যেতো না,আমিও যেতে পারতাম না। আব্বুর ভাষ্যমতে উনি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবেন না। এভাবেই আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। আমি এই চার’দেয়ালের মাঝে হাপিয়ে উঠেছি। প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথের কোনো ফ্রেন্ডের সাথে কথাও হতো না আমার। ভয় লাগতো আবার যদি ওদের সাথেও মিশতে না করে দেয়। বাবা-মার বাধ্য ছিলাম বলে কথা। এসএসসির শেষে পড়া নেই,নিজের একাকিত্বর সাথী হলো মোবাইল। যেটা আমার জীবনের কাল হয়ে এলো। একদিন ফেইসবুকে ট্রলের সময় একটা গান শুনলাম ভয়েসটা অসম্ভব ভালো লেগে গিয়েছিলো আমার। কমেন্ট করেছিলাম। এরপরই ওই গলার মালিক আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠায়। আমি এক্সেপ্টও করি। তার আইডির প্রতিটা গান শুনতাম,ভালো লাগতো। আমাদের মাঝে টুকটাক কথাও হতো। একদিন সে আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি এক্সেপ্ট করি না। কিন্ত মনে মনে আমিও তাকে পছন্দ করতাম। একদিন শুনলাম সে হসপিটালাইজড। সেদিন রিয়েলাইজ করলাম আই ফল ইন লাভ উইথ হিম! ওকে কল দিলাম। ও জিজ্ঞাস করেছিলো কেনো এতো হাইপার হয়েছি? আমি স্বীকার করেছিলাম যে আমি ওকে ভালোবাসি! এর পর সে বলেছিলো সে ঠিক আছে। আমার মুখ থেকে স্বীকার করানোর জন্য ছোট্ট একটা নাটক করেছে। এরপর থেকে আমাদের নিয়ম করে কথা হতো। দেখা হতো না কারণ,সে বলেছিলো সে আপাদত ঢাকায় আছে। তাদের রেস্টুরেন্ট সামলাচ্ছে। আর আমিও বের হতে পারতাম না। এরপর রেজাল্ট দিলো A+ পেয়েছিলাম। আমাদের জেলার সবচেয়ে বড় কলেজেই চান্স পেলাম! এর কিছুদিন পর সে আসলো দেখা করলো আমার সাথে। তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হলাম।
ঠিক একবছর পর জানতে পারলাম সে আমি থাকা অবস্থায় আরো একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করেছে। আমি দুনিয়া কেঁপে উঠলো। কিন্ত ততোদিনে আমি তার মায়ায় পুরোপুরি ভাবে জড়িয়ে গেলাম। কি করে ছাড়তাম ওকে। যাই হোক সব মেনে আবারও কন্টিনিউ করলাম। সেও সব বাদ দিয়ে দেয়। দেড় বছর পর জানলাম সে আমাকে নিজের ব্যাপারে যা যা বলেছে সব মিথ্যে। তার বাবা দেশে থাকে,সে বলেছিলো বাইরে থাকে। তাদের ঢাকায় কিছুই নেই,সে মিথ্যে বলেছিলো। ভেবেছিলাম তার বাবার সাথে তো আমার কিছু নেই। না থাকলে নাই বা থাকলো ক্ষতি কি। সে বলেছিলো আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে এসব বলেছে! এরপর থেকে ভালোভাবে সবটা চলছিলো। একদিন এসে বললো,,’শুভ্রা আমি চাকরি পেয়েছি!’ খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। ভেবেছিলাম এবার আমাদের ভালো সময় আসবে। আব্বু-আম্মু বিয়ের কথা বললে ওর কথা বলতে পারবো।
একদিন সে এসে বললো বিয়ে করতে চায় আমাকে। আমি বলেছিলাম বাসায় বলো। সে বলে এখন না,আরো কিছুদিন পর তার জায়গাটা আরেকটু শক্ত হোক। আমি বলেছিলাম তাহলে বিয়েও কিছুদিন পর। সে বলে,,”আমি ঢাকায় থাকি,তুমি গ্রামে। আমার ভয় করে। যদি হারিয়ে যাও। বিয়ে করে রেখে দেবো। তোমার বিয়ের কথার সময় সাধারণ ভাবে সম্বন্ধ নিয়ে যাবো। কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলবো না!’ তাও আমি রাজি হতে পারছিলাম না। সে ইমোশনাল ব্ল্যাকম্যাল করতে লাগলো। রাজি হয়ে গেলাম। এরপর লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলি!’

এটুকু বলে শুভ্রতা দুটো ঢোক গিললো। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে। নিজেকে সামলানোর জন্য বেলকনির গ্রিল খামছে ধরলো। মেঘের দিকে তাকানোর সাহস ফেলো না। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আবারও বলা শুরু করে,,

‘বিয়ের সতেরো দিনের মাঝেই আব্বু কিভাবে জেনে গেলো সবটা। আমার জীবনের নরক যন্ত্রণা সেদিন আমি টের পেয়েছিলাম। আব্বু-আম্মু জানার দুদিন পর আমাকে উনারা জানিয়েছিলো। দু’দিন আমার সাথে কথা বলেনি ওরা। তাও যতোটা ভয় পাওয়ার প্রয়োজন ছিলো আমি ততোটা পাই নি। ভেবেছিলাম ঝামেলা হলেও শেষ অবধি আমাদের মিল তো হবে! কিন্ত নাহ বাস্তবতা আমার প্রত্যাশার থেকেও যে নিষ্ঠুর। সে আমাকে আরো একবার ঠকালো। তার জব,কাবিননামা সবটাতে ঠকিয়ে দিয়েছে। সে আবারও আমার সাথে মিথ্যে মিথ্যে খেলা খেললো। আব্বু-আম্মু আমার সামনে দু’টো অপশন রাখলো। এক,ওর কাছে যাওয়া সাথে মা-বাবার সাথে আর সম্পর্ক না রাখা। আমি যদি যাই,বাবাও মাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার ভাইটা এতিম হয়ে যাবে। দুই,ওকে ডিভোর্স দেওয়া। আমি পুরো নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম। রুহিপু আমার সাথে ছিলো। আমার জেঠুরা আগে চিটাগাং থাকতো। দু’বছর আগে গ্রামে এসেছিলো। রুহিপু আমাকে সামলিয়েছে, আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিলাম। সপ্তাহ খানিকের মাঝে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। কিন্ত এই অবধি সীমাবদ্ধ থাকে নি। সবাই সবটা জেনে গিয়েছিলো। আব্বু,আম্মুকে ধরে ধরে জিজ্ঞাস করতো। সারাদিন কাঁদতাম তাও কেউ বুঝতো না। পাড়া-প্রতিবেশি সবাই ছিহ ছিহ করতো। কিছু করতে পারতাম না। মা-বাবাও আমাকে বুঝতে পারতো না। যেদিন প্রথম সম্বন্ধ নিয়ে আসে সেদিন আমার মা আমার চোখের ভাষা না বুঝলেও আমি আমার মায়ের চোখের ভাষা পড়েছি। সেখানে ছিলো দায়মুক্তির তাড়া। রাজি না হওয়াতে মা বলেছিলো,,’যা করেছিস করার আগে মনে ছিলো না? বিয়ের জন্য তো পাগল হয়ে গেছিলি। এখন বিয়ে দিচ্ছি তো ঠান্ডা হো!’ নিজের মায়ের মুখ থেকে এই কথা শুনে শুধু তাকিয়ে রইলাম। ইচ্ছে করছিলো মরে যাই,কিন্ত আমি খুব ভীতু আত্মহত্যার মতো পাপ করতে পারি নি।’

আর বলতে পারলো না শুভ্রতা। গলা থেকে যেনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। কেউ চেপে ধরে আছে যেনো। শরীরটা যেনো ছেড়ে দিচ্ছে। কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্ত তাও কাঁদতে পারছে না। বিয়ের দিন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলো আর দুর্বল হবে না কিন্ত তাও আজ আটকাতে পারছে না। গ্রিল ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো। মেঘ নিঃশব্দে এগিয়ে এলো শুভ্রতার পাশে। শুভ্রতাকে নিজের বাহুডোরে আবন্ধ করে নিলো। শুভ্রতার যেনো এই শান্তিটারই প্রয়োজন ছিলো। লেপ্টে রইলো মেঘের উষ্ণ বুকে। মেঘের মাঝে যেনো শান্তি খুঁজে ফেলো। মেঘ একহাতে শুভ্রতাকে ধরে আরেক হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,’কুল ডাউন শুভ্র! কিচ্ছু হই নি। শান্ত হও!’

মেঘের কথায় শুভ্রতা হুহু করে কেঁদে দিলো। নিজেকে আটকাতে পারলো না। মেঘের টি-শার্টের পেছনের অংশটা খামছে ধরে বলে,,
‘মেঘ ও ওরা আমার চরিত্রেও কালি ছিটিয়েছে। আমাকে আমাকে ওই সব মেয়েদের সাথে তুলনা.. ‘ শুভ্রতা আবারও থেমে গেলো।
মেঘ শুভ্রতাকে শান্ত করার জন্য বলে,,’শুভ্র! শান্ত হও। আমি আছি না। তোমাকে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না। আমি আছি তো তোমার সাথে!’ ‘আমি আছি তো তোমার সাথে!’ মেঘের কথাটা শুভ্রতাকে শান্ত করার জন্য কাজে দিলো। শুভ্রতা হালকা মাথা উঁচু করে মেঘের মুখের দিকে তাকালো। আবছা অন্ধকারেও যেনো সে মেঘের মুখ দেখতে পারছে। মেঘও শুভ্রতার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে পানি চিকচিক করছে।
‘সত্যি আপনি থাকবেন তো আমার পাশে? আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো? আপনিও আমায় ভূল বুঝে দূরে যাবেন না তো? আপনিও আমাকে অবিশ্বাস করবেন না তো? বলুন না। প্লিজ বলুন না!’ শুভ্রতা কেমন যেনো হাইপার হয়ে উঠলো। মেঘ শুভ্রতাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। পারলে যেনো বুকের মধ্যেই ঢুকিয়ে নেয়।
‘প্লিজ শুভ্র! শান্ত হও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কখনো একা ফেলে যাবো না। তুমি শুধু একটু শান্ত হও!’ মেঘের কথার মাঝেই শুভ্রতার শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। মেঘ শুভ্রতাকে ভালোভাবে ধরে ফেলে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। মেঘ তড়িঘড়ি করে খাটে শুইয়ে দেয়। গালে হালকা চাপড় মেরে বলে,,’শুভ্র!শুভ্র!চোখ খুলো প্লিজ!’ কিন্ত শুভ্রতার কোনো সাড়া নেই!

#চলবে?

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১০)

অন্ধকার কেটে নতুন সূর্যদয়। সবাই নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়েছে। পাখিরাও নিজেদের খাবারের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে কাকের ‘কা কা’ শব্দ বেজে আসছে। সূর্যের আলো চোখে মুখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে নেয় শুভ্রতা। কাল রাতে বারান্দার দরজা খোলা ছিলো যার জন্যই সূর্যিমামা তার কিরণ রুম পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাসে ফিটফিট করা চোখ পুরোপুরিভাবে খোলে শুভ্রতা। মাথা উঁচিয়ে মেঘের ঘুমন্ত মুখশ্রী চোখে পড়লো। শুভ্রতাকে পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ‘মানুষ কাঁথা কম্বল পেঁচিয়ে ঘুমাই, ইনি বউ পেঁচিয়ে ঘুমায়!’ নিজের মনের কথায় শুভ্রতা নিজেই অবাক। কি সাবলীল ভাবে নিজেকে মেঘের বউ দাবী করছে। অথচ একদিন অন্য কারো বউ হবে ভাবতেই পারে নি। আসলে এটা ঠিকই বলে ‘মানুষের অভ্যাস পাল্টাতে মাত্র একুশ দিনের প্রয়োজন!’ শুভ্রতার মাথায় কাল’রাতের চিত্র ভেসে উঠে। মেঘকে নিজের কথা গুলো বলতে পেরে বেশ হালকা লাগছে এখন। কিন্ত এরপর নিজেকে কেমন হালকা লাগছিলো মনে হচ্ছিলো সবকিছু আঁধার হয়ে আসছে। ‘তবে কি জ্ঞান হারিয়েছিলাম?’ নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে শুভ্রতা।
মেঘের নড়াচড়ার কারণে ধ্যান ভাঙ্গে শুভ্রতার। ফিটফিট করে চোখ খুলে মেঘ প্রথমেই শুভ্রতার দিকে তাকালো। সেটা কি সুন্দর দৃশ্য শুভ্রতার কাছে। শুভ্রতা মৃদ্যু হেসে বলে,,’শুভ সকাল!”
মেঘ শুভ্রতাকে না ছেড়ে আরেকটু জড়িয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে,,’শরীর কেমন লাগছে তোমার? এতো স্ট্রেস কেনো নাও তুমি? এখন উঠো যাও ফ্রেশ হয়ে আসো!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,,’এভাবে পেঁচিয়ে ধরে রাখলে উঠবো কি করে?’
শুভ্রতার কথায় মেঘ হাতের বাঁধন আলগা করে বলে,,’যাও ফ্রেশ হয়ে আসো!’
শুভ্রতা কথা না বাড়িয়ে খাট থেকে নেমে যায়। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। মেঘের অফিস সাড়ে নয়টায়। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে! শুভ্রতা চটপট ওয়াশরুমে চলে গেলো।

‘এই নাও এগুলো এখন খাবে তুমি!’ মাত্র ফ্রেশ হয়ে এসে হাত মুখ মোছার জন্য তোয়ালি নিয়েছে শুভ্রতা। এর মাঝেই মেঘ হাজির। শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’এগুলো কি?’
‘তোমার পুষ্টির অভাব! তাই এগুলা খাবা। আমি চাই না অকালে আমার বউ পুষ্টিহীনতায় ভুগক। নইলে আমার বাচ্চারাও তোমার মতো ফার্মের মুরগি হবে। কিছু থেকে কিছু হলেই চিতপটাং হয়ে পড়ে যাবে!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এই কয়দিনে মেঘকে একজন গম্ভীর টাইপের মানুষ বলেই আবিষ্কার করেছিলো। তার হঠ্যাৎ এই রুপ হজম করা কঠিন!
‘কি হলো? হা করে থাকবা না প্লেটটা হাতে নিবা। আমাকে অফিসের জন্য রেডি হতে হবে!’ মেঘের ধমকে শুভ্রতা প্লেট হাতে নেয়। মেঘ আলমারি থেকে জামা-কাপড় নিতে নিতে বলে,,’এটা খাওয়া শেষ করে কিচেনে যাবা। যদি না খাও খবর আছে। মাইন্ড ইট!’ কথাটা বলে মেঘ ধুপধাপ পা পেলে চলে যায়। শুভ্রতা অসহায়ের মতো ডিম দু’টোর দিকে তাকিয়ে রয়। ডিম যে তার একদম অপছন্দের। বিশেষ করে কুসুম’টা! শুভ্রতার এখন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে!
________________
ঢাকা শহর মানেই ব্যস্ত নগরী। এখানে জ্যামটা রোজকার রুটিন! কোনোদিন জ্যাম একটু কম হলে মানুষ অবাক হয়। কারণ দিনদিন যেনো জ্যামের সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। এর মাঝেই দু’জন কপোত-কপোতী বাইকে চড়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইক এসে কোচিং সেন্টারের সামনে থামলো।
‘শুভ্র দেখে নামো!’ মেঘের সাবধানীমূলক বাণীতে শুভ্রতা আস্তে ধীরে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল! মেঘ শুভ্রতার এক’হাত ধরে ভেতরের দিকে অগ্রসর হলো।
‘আরে মেঘ ভাইয়া যে। আসুন ভেতরে!’ একটা ছেলে বেশ মার্জিত ভাবে মেঘকে ডাকলো।
‘আরে রবিন। কি অবস্থা!’
রবিন নামক ছেলেটি মুচকি হেসে বলে,,’এইতো ভালো। আচ্ছা চলুন এডমিশনের কাজটা সেরে ফেলি! এনি (শুভ্রতাকে দেখিয়ে) এডমিশন নিবেন তাই তো?’
মেঘ মাথা নেড়ে বলে,,’হ্যাঁ।’ ওদের কথায় শুভ্রতা বুঝলো মেঘ আগে থেকেই কথা বলে সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। এডমিশন শেষে শুভ্রতাকে আজ থেকেই ক্লাস করার কথা বলা হয়েছে।
‘শুনো আমি তো নিতে আসতে পারবো না। তুমি ডাইরেক্ট একটা রিক্সা করে চলে যাবা। কারণ তুমি নতুন কিছু চিনবা না। ঠিক আছে?’ মেঘের কথায় শুভ্রতা মাথা দুলিয়ে বলে,,’আচ্ছা! সাবধানে যাবেন!’
‘আমি সাবধানেই যাবো। তুমি মন দিয়ে ক্লাস করো ওকে?’ মেঘ কথাগুলো বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

ক্লাসরুমে এতোসব অচেনা মুখের মধ্যে কেমন যেনো অস্বস্থি হচ্ছে শুভ্রতার। তাও পুরোপুরি ভাবে ক্লাসে মন দেওয়ার চেষ্টা করছে। একটা ক্লাস শেষ হতে শুভ্রতা ওই পড়াগুলো বসে বসে দেখছিলো। এর মাঝেই একটা মেয়ে এসে পাশে বসলো। শুভ্রতা তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের পড়ায় মন দিলো।
‘হাই কিউটি! তুমি নতুন!’ পাশের মেয়েটা বলে উঠে। কিন্ত ‘কিউটি’ সম্বোধন পেয়ে শুভ্রতা চোখ গোল গোল করে তাকালো। তাও নিজেকে সামলিয়ে বলে,,’জ্বি!’
মেয়েটি এবার মিষ্টি হেসে বলে,,’তোমার নাম কি?’
শুভ্রতা খাতাটা বন্ধ করে মেয়েটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,’নওশিন জান্নত শুভ্রতা। আপনার?’
‘আমার নাম ইহানা আফরোজ মাহি! আর আপনি আপনি করছো কেনো? আমি তুমি একই এজ,একই ব্যাচ!’
‘আচ্ছা!’ এর মাঝেই আরো চারজন এসে জড়ো হলো। তিনটে ছেলে একটা মেয়ে। শুভ্রতা সবার দিকে এক’পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। এর মধ্যে থেকে একটা ছেলে মাহির মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,’ওই তুই এখানে কি করিস?’
মাহি তেঁতে গিয়ে বলে,,’ঘোড়ার ঘাস কাটি। কাটবি?’
পাশ থেকে আরেকজন হো হো করে হেসে বলে,,
‘তুই এটাই ভালো পারিস!’ এসে ঝগড়া দেখে শুভ্রতারও নিজের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। স্কুল,কলেজেও ওরা এইরকম মজা করতো। শুভ্রতার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
‘তোদের আজাইরা কথা শেষ হলে। এই কিউটির সাথে পরিচিত হ। এ হলো শুভ্রতা। আর শুভ্রতা এরা (সবাই কে দেখিয়ে) এরা আমার ফ্রেন্ড অভি,ফারিয়া,নিশান,পিয়াশ!’ মাহির কথায় সবাই শুভ্রতাকে হাই বলে,শুভ্রতাও হ্যালো বলে। এর মাঝেই স্যার এসে উপস্থিত হয়। আর কথা হয় না কারো মাঝে। সবাই বসে পড়ে।
ক্লাস শেষে সবাই নিজেদের মতো চলে যায়। মাহিদের মাঝে অল্প সময়ে বেশ সখ্যাত হয় শুভ্রতার। ওরা বেশ মিশুক,আর শুভ্রতাও সহজে মিশে যেতে পারে। মাহিরা একটু আগেই চলে গেছে। শুভ্রতা রিক্সা নেওয়ার জন্য এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে। শুভ্রতা রাস্তার কাছে আসতেই একটা রিক্সা এসে তার সামনে থামলো। রিক্সাওয়ালা শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে,,’আপামণি আপনেই তো ৯ নং সেক্টরে যাইবেন?’ রিক্সাওয়ালার কথায় শুভ্রতা খানিক অবাক হয়। উনি কি করে জানলেন?
‘আপনি কি করে জানলেন আমি কোথায় যাবো?’ শুভ্রতার কথায় রিক্সাওয়ালা নিজের পান খাওয়া দাঁত গুলো দিয়ে হেসে বলে,,’আপনের স্বামী যাওনের সময় বইলা গেছে সাড়ে এগারোটায় আপনার ছুটি হইবো। আপনারে যেন পৌঁছাই দিয়া যাই!’
রিক্সাওয়ালার কথায় শুভ্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। মেঘ তাহলে ঠিক করে দিয়ে গেছিলো? শুভ্রতা নিজেরও খানিক দ্বীধা ছিলো। কারণ সে ঢাকায় নতুন। ছোটবেলায় এসেছিলো বাবা মায়ের সাথে। কিছুই চিনে না। কোনদিক থেকে কোনদিকে যাবে খবর নেই! শুভ্রতা হাসি মুখে রিক্সাতে উঠে বসলো। মনটা কেমন ফুড়ফুড়ে লাগছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। বের করতেই দেখে মেঘের মেসেজ এসেছে। আরো আগেই দিয়েছিলো। ফোন সাইলেন্টের কারণে বুঝে উঠে নি।

শুভ্রতা মেসেজ ওপেন করতেই ভেসে উঠে গুটি কয়েক শব্দ,,’তোমার নিজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ছুটির সময় একজন আসবে। আমি উনাকে বাসার রাস্তা ভালোভাবেই বলে দিয়েছি। টাকাও দিয়ে এসেছি। তুমি সাবধানে এসো!’
শুভ্রতা মেসেজটা পড়ে খানিক হাসলো।
________________
বাসায় এসে ফ্রেশ হয় কিচেনে গেলো শুভ্রতা। আজকে যেহেতু মন মেজাজ দু’টোই খুব ভালো তাই ভাবলো নতুন কিছু রান্না করবে। কিন্ত মেঘের পছন্দ-অপছন্দ কিছুই তার জানা নেই। তাই ছটফট মেঘের মায়ের নাম্বারে ডায়েল করলো।
ফোন ধরতেই শুভ্রতা সালাম দিয়ে,কুশল বিনিময় করে। তারপর বেশ অস্বস্থি নিয়ে জিজ্ঞাস করে ফেলে। শুভ্রতার অস্বস্থি দেখে উনি হাসলেন। তারপর বললেন মেঘের প্রিয় খাবার ‘বিরিয়ানি’ (হুদা। এখানে লেখিকা নিজের প্রিয় খাবার দিয়ে দিয়েছে😁)। শুভ্রতা সেই মোতাবেক রান্না বসিয়ে দেয়। মোটামুটি পারে সে। তারপর মেঘকে দুপুরে বাসায় আসার জন্য মেসেজ পাঠায়।

গোসল সেরে নামাজ পড়ে বসে আছে শুভ্রতা। মেঘের জন্য ওয়েট করছে। মেঘকে মেসেজ দিলেও তার রিপ্লাই পায় নি। হয়তো কাজে আটকে গেছে। প্রাইভেট অফিসের কাজ মাথার উপর দশহাত থাকে। শুভ্রতা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। ঘড়ির কাটা তখন আড়াইটে তে পৌঁছে গেছে। না মেঘ আজ আর আসবে না। শুভ্রতারও খেতে ইচ্ছে হলো না। সবকিছু ডেকে রেখে নিজের রুমে চলে গেলো। টেবিলে বসে বই পত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে। কিছুক্ষণ টেবিলে বসার পর উঠে গিয়ে বারান্দায় বসলো। শুভ্রতার একটা বাজে অভ্যেস আছে এক জায়গায় কিছুক্ষণ বসে পড়ার পর আবার অন্য জায়গায় গিয়ে পড়া। (এটা লেখিকার স্বভাবে। শুভ্রতা বলে চালিয়ে দিলাম!) কিন্ত বারান্দায় বসে শুভ্রতা পড়া কম আকাশ বেশি দেখছে। আর মেঘের কথা ভাবছে!

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে