#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
পর্ব-০১+০২
‘আমার বাবা-মা আমার প্রথম বিয়ের কথা লুকিয়ে আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বলতে পারেন আপনাদের ঠকানো হয়েছে। আশা করি এটা জানার পর আপনি বা আপনার পরিবার চাইবেন না এই রকম একটা মেয়েকে নিজেদের ঘরে বউ করে নিতে! আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন বলে আমি আশাবাদী।’ একশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো শুভ্রতা। কথা বলার পুরোটা সময় স্থিরভাবে টেবিলের উপর তাকিয়ে ছিলো। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনের লোকটা আয়েশি ভঙ্গিতে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। শুভ্রতার মনে মনে ভীষণ রাগ হলো। কথা বলার সময় কারো এভোয়েডনেস একদম সহ্য হয় না। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফোন স্ক্রোল শেষে টেবিলে দুহাত ঠেকিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো মেঘ। শুভ্রতার চেহারা একবার পরখ করে দেখে বলে,,’ওকে। এটার জন্যই আমাকে ডেকেছেন? আর কিছু বলবেন?’
শুভ্রতা মাথা নেড়ে বলে,,’নাহ। এইটুকুই আমি এখন আসি।’ কথাটা বলে শুভ্রতা পার্স আর ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর বাইরের দিকে অগ্রসর হতে নিলে পেছন থেকে মেঘের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,’There are less to every wine.’
মেঘের কথায় শুভ্রতার বাড়ানো পা থেমে যায়। মাথাটা হালকা পেছনে ঘুরিয়ে বলে,,’মানে?’
‘শুনেছি আপনি পড়ালেখায় খুব ব্রিলিয়েন্ট। এই কথাটার মানে নিশ্চয়ই জানেন? আর না জানলে খুঁজে নিবেন। মিনিংটা বের করতে পারলে বুঝবো আপনার আইকিউ কতটা সার্প!’ মেঘের হেয়ালি কথায় শুভ্রতার শরীর রাগে রী রী করে উঠলো। মনে মনে বলে,,’শুভ্রতা জাস্ট কুল ইয়ার। তোর এই বিয়েটাও ভেঙ্গে যাবে। যা পারুক বলে নিক। আর কোনোদিন তোর সামনে আসবে তো না। জাস্ট কুল!’ নিজেকে শান্ত করে শুভ্রতা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।
________________________
‘এই তুই কোথায় গিয়েছিলি হ্যাঁ? আজ তোর হলুদ আর তুই বাইরে গেছিলি? শোন শুভ্রা অনেক কষ্টে তোর বিয়েটা ঠিক করেছি। আল্লাহর দোহাই লাগে আর আমাদের সম্মান নষ্ট করিস না। আমাদের একটু মুক্তি দে। তোর জন্য কম অসম্মানিত তো হই নি। এবার অন্তত রেহাই দে!’ কথাগুলো বলে শুভ্রতার মা ছাদ থেকে নেমে গেলো। একটু আগে শুভ্রতা ফিরে দেখে বাসায় বিয়ের তোড়জোড় চলছে। শুভ্রতা কোনোমতে চেঞ্জ করে ছাদে চলে আসে। তখন পিছুপিছু এসে তার মা কথাগুলো বলে যায়। নিজের মায়ের মুখ থেকে এইরকম কথা শুনে কষ্ট পাওয়া উচিৎ। কিন্ত শুভ্রতার মনে হচ্ছে সে আশারুপ কষ্ট পাচ্ছে না। তবে কি তার শরীর এইসব অপমান সয়ে গেছে? শুভ্রতা আর ভাবতে পারছে না। ছাদ থেকে নিচের দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে শরীরটাকে শূণ্যে ভাসিয়ে দিতে। কিন্ত তার আগে যে অনেক কাজ আছে। নিজেকে প্রমাণ করার আছে। এটা বুঝানোর আছে যে,একটা ভূলের মাশুল এতো জঘণ্য হতে পারে না। ভূল শুধরে নেওয়ার সুযোগ তারও প্রাপ্য। সেও সুযোগ ফেলে নিজেকে প্রমাণ করে দিতে পারবে। শুভ্রতা আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে,,
‘আল্লাহ আমি জানি তুমি যা করো ভালোর জন্যই করো। আমি তোমার ইশারার বিরুদ্ধে চলতে পারবো না। কিন্ত আল্লাহ আমি কি করবো বলো? একটা নতুন জীবন মিথ্যে দিয়ে শুরু করবো? পারবো না আমি একজন মানুষকে ঠকাতে। কতোদিন লুকিয়ে রাখবো আমার অতীত? একদিন,দুদিন,একবছর? যেদিন সামনে আসবে সেদিন কি হবে? হ্যাঁ আমি একজন খারাপ সন্তান তাই তো মা এগুলো বলে গেলো! কিন্ত কি করবো বলো চাইলেও সবটা যে ঠিক করার ক্ষমতা নেই!’ রোদের জন্য শুভ্রতা বেশীক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ জ্বালা করছে। চোখের কোণে জল ভীড় করছে। কিন্ত সেটা কিসের জন্য শুধুই কি রোদের তেজ না অন্যকিছু! শুভ্রতা সেটা কাউকে জানাতে চায় না। অব্যক্ত কথাগুলো নিজের ভেতরে রাখাটাই শ্রেয়। শুভ্রতা ছাদ থেকে রুমে চলে গেলো।
________________
শুভ্রতাদের গ্রামের একতালা বাড়িটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারদিকে বাচ্চারা হইহই করছে। বড়রা কাজ করছে। শুভ্রতা নিজের রুমে চুপটি করে বসে আছে। একটু আগেই খালাতো বোন রুহি একটা হলুদ শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গেছে। এখন শুধু সাজানো বাকি। শুভ্রতার কাণে মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে উপহাসের কয়েকটা কথা ভেসে আসছে। যেটাতে কষ্ট পেতে না চাইলেও পেতে হচ্ছে। বুকের ভেতরটা খা খা করছে। এসব শুনলে তার মা-বাবা যে আরও কষ্ট পাবে! শুভ্রতা আর মানতে পারলো না উঠে বেলকনিতে চলে গেলো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,,
‘মানুষকে ঠিক কতোটা বিশ্বাস করলে মানুষ বিশ্বাসে মর্যাদা রাখে! কে জানে! সব খামতি কি শুধু আমার ছিলো? জীবনের কতোগুলো পথ তোমার সাথে হেটেছি। আর তুমি মাঝরাস্তায় আমায় শূণ্য করে ছেড়ে চলে গেলে? ক্ষমা করবো না তোমায়। কোনোদিনও না।’
শুভ্রতা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মেঘকে কথাগুলো সেই কখন বলেছে। কিন্ত মেঘের বাসা থেকে এখনও কোনো খবর আসছে না কেনো! শুভ্রতার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। লোকটা চাইছে টা কি। আগের বারের সব সম্বন্ধে সে প্রথম দিনেই ছেলেকে সব বলে দিয়েছিলো যাতে কথা না এগোয়। কিন্ত এবারের সম্বন্ধে কেউ আসেই নি। ছেলেপক্ষ নাকি আগ থেকেই ওকে পছন্দ করে রেখেছে। শুভ্রতা আবারও একই কাজ করবে ভেবে শুভ্রতার মা আজ সকালে জানিয়েছে সবটা। শুভ্রতা অনেক কষ্টে বাবার ফোন থেকে নাম্বার চুরি করে মেঘকে কল দিয়ে ক্যাফেতে ডেকে কথাগুলো বলেছে। ভেবেছিলো মেঘ বাসায় এসব জানালে বিয়ে ভেঙ্গে দেবে। কিন্ত না এখনও কোনো খবর আসছে না! শুভ্রতা রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিলো। মেঘের নাম্বারে ডায়েল করতে গিয়েও থেমে গেলো। ভাবলো আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।
‘কিরে শুভ্রা কি করছিস?’ শুভ্রতার খালাতো বোন রুহি রুমে ডুকতে ডুকতে বলে। শুভ্রতা রুহিকে দেখে বলে,,
‘ওহ রুহিপু তুই? আয় বস।’
রুহি শুভ্রতার পাশে বসে হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি আর কিছু অর্নামেন্টস বের করে বলে,,’দেখতো তোর পছন্দ হয় কিনা?’
শুভ্রতা শাড়িটার দিকে তাকালো। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি,আঁচলে বিভিন্ন লতা,পাতা,ফুল দিয়ে ডিজাইন। শুভ্রতা ঠিক এইরকম শাড়ি চেয়েছিলো। একদিন কাউকে বলেছিলো সবাই হলুদে হলুদ শাড়ি পড়ে,আমি আমার হলুদে আমার নামের সাথে মিলিয়ে শুভ্র রংয়ের শাড়ি পড়বো। শুভ্রতা আলতো হাতে শাড়িটি ছুঁইয়ে দিলো। রুহির দিকে তাকিয়ে দেখে রুহি একগাল হাসি নিয়ে বসে আছে। রুহি বলে,,’কিরে পছন্দ হয়েছে?’
শুভ্রতা মাথা নেড়ে বলে,,’খুব পড়িয়ে দাও!’
রুহিও হাসি মুখে শাড়িটি পড়িয়ে শুভ্রতাকে সাজিয়ে দিলো। অতঃপর শুভ্রতার কয়েকটা পিক তুলে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যায়।
____________________
ঘোর সন্ধ্যে। কিন্ত শুভ্রতাদের বাড়ির দিকে তাকালে বুঝা দায়। ছাদে স্টেজ করে শুভ্রতাকে বসানো হয়েছে। সামনে নানা পদের কেক,মিষ্টি,খাবার। বাচ্চারা গান চালিয়ে নাচানাচি করছে। কিন্ত শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। রুহি যাওয়ার দশমিনিট পর আবার এসে শুভ্রতার শাড়ি চেঞ্জ করিয়ে হলুদ শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গেলো। শুভ্রতা চেঞ্জ করতে চায় নি রুহি জোর করে চেঞ্জ করিয়েছে। রুহির ব্যবহারে শুভ্রতা পুরো অবাক। কিন্ত আপাদত মাথায় মেঘের কথা ঘুরছে। মেঘ এখনও বিয়ে ভাঙ্গলো না! তবে কি হয়ে গেলো বিয়েটা? শুভ্রতার বুক কেঁপে উঠলো।
গালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতে ধ্যান ভাঙ্গে শুভ্রতার। সামনে তাকিয়ে দেখে শুভ্রতার মা হাসি হাসি মুখে তার গালে হলুদ লাগাচ্ছে। শুভ্রতা তা দেখে মলিন হাসলো। এই মা একটু আগে তাকে কতো কথা বললো,তার থেকে মুক্তি চাইলো এখন খুশি মনে হলুদ লাগাচ্ছে।
‘হ্যাঁ মা মুক্ত করে দেবো তোমাদের। তোমরা চাইলেও তোমাদের কাছে আসবো না। আজ কি হবে জানি না। মেঘ যদি বিয়েটা ভেঙ্গে দেয় তবে আমিও তোমাদের মুক্ত করে দিয়ে যাবো।’ শুভ্রতা মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নিলো। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্ত নাহ সে কারো সামনে নিজের চোখের পানি ফেলে না। দুঃখ,কষ্টগুলো একান্তই তার ব্যক্তিগত। কাউকে দেখাতে চায় না। শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। একে একে সবার হলুদ লাগানো শেষ হলে সকলে গান,নাচ করা শুরু করে। শুভ্রতার ভালো লাগছে না বলে নিচে নেমে যায়। কিন্ত পথিমধ্যে একটা কথা কানে লাগে।
‘হুহ। আগেরবার তো নিজেই লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। কে জানে কি কি করেছে এই মেয়ে। আবার এখন ভালো লাগছে না। মন খারাপ লাগছে! হুহ ঢং।’
শুভ্রতা পেছন ফিরে চাইলো তার নিজের মামি অন্য একজনকে কথাটা বলছে। শুভ্রতার কেমন যেনো হাসি ফেলো। উপহাসের হাসি সেটা। নিজের উপর না মামির উপর কে জানে! আর দাঁড়াল না। পা চালিয়ে রুমে চলে গেলো। এখন একটু শান্তি প্রয়োজন। কিন্ত কে দেবে সে শান্তি! তার সব থেকেও কিচ্ছু নেই।
#চলবে?
#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(২)
রাতের শেষভাগ! কিছুক্ষণ পরেই আরেকটা নতুন দিন শুরু হবে। সাথে শুভ্রতার জীবনের নতুন অধ্যায়। কিন্ত তার জন্য শুভ্রতার মনে কোনো উত্তেজনা, উদ্দীপনা কিছুই কাজ করছে না। অনেকরাত অবধি কাজ করে সবাই এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুম নেই শুধু শুভ্রতার চোখে। বারান্দার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই গ্রিলের ফাঁকে যতটুকু দেখা যায় ততোটুকুই যেনো শান্তি। পাশেই গোলাপের চারায় কয়েকটা গোলাপ ফুটে আছে,কিছু কলি থেকে ফোটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিন হলে শুভ্রতা খুব সুক্ষ্মভাবে সেটা পর্যবেক্ষণ করতো। কিন্ত আজ যেনো নিজের মাঝে কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছে না। তার জীবনের প্রতি তার কোনো অধিকারই নেই! শুভ্রতা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। দূর মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। শুভ্রতা মাথায় ওড়নাটা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য রুমের মধ্যে যায়। খাটে উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রুহি। ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট রুহির অবস্থা দেখা যাচ্ছে। সকাল সকাল হালকা শীত করছে মনে হয় তার জন্য কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। শুভ্রতা মুচকি হাসে। যখন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন এই মেয়েটা তার পাশে দাঁড়িয়েছে। রুহি শুভ্রতার বড় জেঠুর মেয়ে। তার বাবারা দু ভাই। দুজনেই একসাথেই থাকে। রুহির আরো দুটো ভাই আছে। রুহি শুভ্রতার একবছরের বড় যার জন্য তুই তুকারি সম্পর্ক ওদের মাঝে। শুভ্রতা আর বেশী না ভেবে ওয়াশরুমের দিকে যায়। ওযু শেষে নামাজে দাঁড়ায়। তারপর রুহিকে ডাক দেয়।
‘রুহিপু। নামাজ পড়বি না উঠ।’ রুহি হাই তুলে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নেয়। শুভ্রতা আবারও বেলকনিতে যায়। ফ্লোরে বসে নিজের যত্নে গড়া ফুল গাছ গুলোকে আলতো ছুঁইয়ে দেয়। আর হয়তো এদের ছুঁয়ে দেখতেও পাবে না।
‘শুভ্রা!’ রুহির কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। মাথা তুলে তাকাতে দেখে রুহি হাতে চায়ের মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা রোজকার অভ্যাস। প্রতিদিন নামাজ শেষে রুহি দুমগ চা এনে দুবোন মিলে খাবে। শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে মগটা নিয়ে বলে,,’বস না।’ রুহিও শুভ্রতার পাশে ফ্লোরে বসে পড়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,,’তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না শুভ্র?’
শুভ্রতা চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে যায়। রুহির দিকে তাকিয়ে বলে,,’আমার আবার কিসের কষ্ট?’
‘তুই কি ওকে ভুলতে পেরেছিস?’ শুভ্রতা এবার চায়ের কাপটা পাশে রেখে দেয়। তারপর উদাস চোখে বলে,,
‘আমি মনে করতেই চাই না।’
‘ও এটা কিভাবে করলো বল তো! মানুষ এতো বেইমা!’
শুভ্রতা এবার রুহির কোলে মাথা দিয়ে বলে,,’ছাড়ো এসব। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে!’ শুভ্রতার কথায় রুহি হাসলো। ও খুব ভালোভাবেই শুভ্রতার কষ্টটা বুঝতে পারছে। কিন্ত মেয়েটা যে বড্ড চাপা স্বভাবের বুক ফাটে তবু মুখ ফুটে না। রুহি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করে,,’আল্লাহ মেয়েটাকে ভালো রেখো।’
____________________
বধূর সাজে কাজির সামনে বসে আছে শুভ্রতা। গায়ে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা, সাথে প্রয়োজনীয় অর্নামেন্টস,দুহাত ভরা মেহেদী,ব্রাইডাল মেকাপ। সব মিলিয়ে আজ যেনো অন্য রকম শুভ্রতা। শুভ্রতার অপরপাশে মেঘ বসে আছে। মাঝখানে নেটের ওড়না। শুভ্রতা মাথা নিচু করে আছে। কেনো জানি খুব কষ্ট হচ্ছে। পুরনো ক্ষতটা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে। তখনই কাঁধে কারো ছোঁয়া অনুভব করলো। রুহি দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা মনের কোথাও হয়তো নিজের মাকে আশা করেছিলো। কোণা চোখে তাকালো তার মা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতার মনটা আরো একবার ভেঙ্গে গেলো। মায়ের তাকে তাড়ানোর এতো তাড়া! শুভ্রতা আর ভাবলো না। তিন কবুল বলে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হলো। জড়িয়ে গেলো অপ্রত্যাশিত সম্পর্কে।
বিদায় বেলা সবসময় কষ্টকর ঠেকে। কিন্ত শুভ্রতার মনে কোনো জানি মুক্তির আনন্দ বইছে। আসলেই কি মুক্তি নাকি আরো গভীর যন্ত্রণা! পুরো বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে। শুভ্রতার বাবাও আজ বিদায় জানাতে গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। দুদিন পর শুভ্রতা নিজের বাবাকে দেখলো। লোক দেখাতে নাকি নিজের ইচ্ছেতে কে জানে উনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘ভালো ভাবে থাকিস শুভ্রা! সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।’
শুভ্রতাও নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। কিন্ত অদৃশ্য এক বাঁধা অনুভব করলো। চাপা স্বরে বলে,,
‘চিন্তা করবেন না এই শুভ্রা মরে যাবে তাও আপনাদের ধারে এসে দাঁড়াবে না। শুভ্রতা নামক কারো ছায়া আপনাদের জীবন পড়বে না। ভালো থাকবেন।’
মেয়ের কথায় শুভ্রতার বাবার হাত আলগা হয়ে এলো। তার একমাত্র মেয়েটাকে কতোটা কষ্ট দিয়েছে। কতটা যন্ত্রণায় জর্জরিত করেছে যার কারণে তার মেয়ে এই কথা বলেছে। চোখ দুটো ভিজে উঠলো উনার। শুভ্রতা সরে আসলো।
শুভ্রতার মা কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে জড়িয়ে বলে,,,
‘সাবধানে থাকিস মা। সবার কথা শুনে চলিস।’
শুভ্রতা একইভাবে নিজের মাকে বলে,,’হ্যা সবার সব কথা শুনে চলি বলেই আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আশা করি আজকের পর আমি নামক বোঝা আপনাদের জীবন থেকে দূর হয়েছে। মুক্তি দিলাম আপনাদের। একটা কথা বলি,সন্তানের কাছে মায়ের মৃত্যুর থেকে কষ্টদায়ক আর কিছুই নেই। আশাকরি আর কোনোদিন সন্তানের সামনে নিজের মৃত্যুর কথা বলবেন না। যাই। ভালো থাকবেন।’
শুভ্রতা মাকে ছেড়ে তার ছোট ভাই স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরে। রুহি আর স্নিগ্ধ শুভ্রতার সাথে যাবে। এতোক্ষণ মেঘ নিরব ভাবে সবটা দেখছিলো। এবার এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার বাবাকে বলে,,’চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আমার কাছে ভালো থাকবে।’ তারপর তাদের যাত্রা শুরু হয় নতুন গন্তব্যে।
____________________
ফুলে সজ্জিত রুমে বসে আছে শুভ্রতা। মাথায় মেঘ নামক চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাইছে কি মেঘ! কেনো বিয়ে করলো শুভ্রতাকে। শুভ্রতার মাথাটা কেমন ধরে যাচ্ছে। বার কয়েক মাথা ঝাঁকাল। নাহ মাথাটা কিছুতেই হালকা হচ্ছে না। খট করে দরজা খোলার আওয়াজে শুভ্রতা সেদিকে তাকালো। লালা শেরওয়ানী গায়ে মেঘ এগিয়ে আসছে। খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকেই তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা তা দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। তাও নিজেকে সামলে বলে,,’আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
মেঘ আলমারির কাছে যেতে যেতে বলে,,’বলুন। শুনছি আমি।’
শুভ্রতা খাট থেকে নেমে বলে,,’আমাকে কেনো বিয়ে করলেন আপনি?’
মেঘ আলমারি থেকে টি-শার্ট আর টাউজার নিতে নিতে বলে,,’আপনাকে আমার পরিবারের খুব পছন্দ হয়েছে বলে।’
শুভ্রতা তা শুনে খানিকটা রেগে বলে,,’কিসের পছন্দ হ্যাঁ? আপনি সত্যিটা বললে এই পছন্দ কোথায় হাওয়া হয়ে যেতো! আপনি কি চাইছেন আমাকে বলুন তো।’
‘আপাদত ফ্রেশ হতে। অনেক ধকল গিয়েছে। এসে বাকি কথা শুনবো।’ মেঘ কথাটা বলে শুভ্রতাকে তোয়াক্কা না করে ওয়াশরুমে চলে যায়। শুভ্রতা রাগে দুঃখে মাথার ওড়নাটা খাটে ফেলে দেয়,গায়ে থাকা গয়না গুলো খুলে খুলে একপ্রকার ছুড়ে মারে ড্রেসিংটেবিলের উপরে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। আপাদত রাগ কমানো খুব প্রয়োজন। কিছুক্ষণপর,মুখের সামনে পানির গ্লাস দেখে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে শুভ্র রংয়ের জামা,গোসলের কারণে মাথার চুল থেকে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। শুভ্রতা তাকাতেই ইশারায় পানি নিতে বলে। শুভ্রতা পানিটা নিয়ে এক শ্বাসে খেয়ে নেয়।
শুভ্রতা কিছু বলার আগেই মেঘ থামিয়ে বলে,,’আগে ফ্রেশ হয়ে এসো,বাকিটা পরে শুনবো।’
শুভ্রতার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে তাই আর কিছু বলে নি। নিজের জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয় শুভ্রতা। বাইরে এসে দেখে তার ছড়ানো ছিটানো জিনিস গুছিয়ে রাখা।
তা দেখে শুভ্রতা মনে মনে বলে,,’লোকটা গোছানো মনে হয়।’ শুভ্রতার ভাবনা ভাঙ্গে ভারী আওয়াজে,,’আমি এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা পছন্দ করি না। এর পর থেকে গুছিয়ে রাখবার চেষ্টা করো।’শুভ্রতা কিছু বললো না। মাথায় পেছিয়ে রাখা টাওয়াল খুলতে থাকে। মেঘ খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর মাথার নিচে হাত দিয়ে বলে,,’কাজ কম্পলি হলে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ো।’
মেঘের কথায় শুভ্রতা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে মেঘ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ‘আরে আমার কথাই তো শুনলেন না।’ শুভ্রতার কথার বিপরীতে কোনো উত্তর আসলো না। শুভ্রতা তা দেখে বলে,,’এতো ডোরেমনের নবিতার থেকেও ফাস্ট!’
#চলবে?