#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৫ |
মূসার কেস শেষ করে নাশিদ সবে শান্তিতে বসেছে তখনই নয়ন এক বাক্স লাভ লেটার সশব্দে রাখলো। নাশিদ একবার বক্সের দিকে তো আরেকবার নয়নের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। নাশিদ ভ্রু কুচকে বললো,
-‘এগুলো কী নয়ন?’
-‘আপনার লাভ লেটার। প্রতিদিন আপনার জন্য লাভ লেটার আসে স্যার, মূসার কেস সেরে তো আপনি পুরো পাবলিক ফিগার হয়ে গেছেন। রোজ রোজ যেই পরিমাণ লেটার আসে, আমি জাস্ট স্পিচলেস!’
-‘জাস্ট শাট আপ নয়ন! এগুলো ফেলো বলছি। এসব আজারে কাজ দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমার?’
নয়নের দাঁত কেলানো বন্ধ হয়ে গেলো নাশিদের ধমকে। সে মুড অফ করে বাক্সটি নিয়ে জানালা দিয়ে চিঠিগুলো ফেলে দিলো। সেই রাস্তা দিয়েই রথি যাচ্ছিলো আর সব চিঠি তার উপরেই পরলো। নাশিদ নয়নকে আবার দেয় ধমক! নয়ন চিঠি ফেলা বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়।
-‘কমসেন্স নাই তোমার? বলি কী আর করছো কী? তোমায় কে বলেছে এসব জানালা দিয়ে ফেলতে?’
-‘আপনি-ই তো বললেন ফেলে দিতে।’
নাশিদ মাথা নিচু করে দুই হাতে নিজের চুলগুলি মুঠ করে ধরলো। নয়ন একবার জানালার দিকে তো আরেকবার হাতের চিঠিগুলোর দিকে তাকালো।
থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই যেন আমার উপর চিঠির বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। এসবে আমার চরম রাগ হলো। একবার উপরে তাকিয়ে হাতে কয়েকটি চিঠি নিয়ে থানায় ঢুকে গেলাম। একজন কর্মচারী আমাকে তাদের স্যারের কাছে নিয়ে যেতেই দেখলাম চিঠিগুলো পরেছে ওনার কক্ষ থেকেই। এবার আমার ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। যার হাতে চিঠির বক্স ছিলো তাকে বলে উঠলাম,
-‘আপনি কী পাগল? এভাবে আমার উপর চিঠি ফেলার মানে কী? ওটা রাস্তা, মানুষ ওখান দিয়ে চলাচল করে। আপনার মাঝে যদি এইটুকু কমনসেন্স না থাকে তাহলে আপনি কেমন পুলিশ? চিঠির জায়গায় যদি অন্যকিছু হতো আর আমার যদি কোনরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো তাহলে তার দায়ভার কী আপনি নিতেন?’
মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে নাশিদ মাথা তুলে তাকালো এবং রথিকে দেখে সে খানিক চমকে গেলো। বিয়ে বাড়ির রথি এবং বর্তমান রথির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য লাগছে।
আমি এবার অফিসারের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবো তৎক্ষনাৎ ওনাকে দেখে আমার মুখ অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। এ যে নাশিদ, নাফিসার ভাই। উনি তাহলে এই থানায় দায়িত্বে আছে? দুজনই দুজনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নয়ন ততক্ষণে জলদি কাউকে দিয়ে রাস্তায় পরা চিঠিগুলো পরিষ্কার করতে বলে দেয়। নাশিদ অস্ফুট সুরে বলে উঠে,
-‘তুমি রথি, রাইট?’
আমার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। ওনার সামনে আমি কীসব বলে ফেললাম, এখন উনি আমার সম্বন্ধে কী ধারণা করবেন? আমি বাজে মেয়ে? পরমুহূর্তে ভাবলাম, আমি তো ভুল কিছু বলিনি। ভেবে নিজেকে কিছুটা শান্ত করলাম এবং একটা কথাই বললাম,
-‘হুম। আপনার কর্মচারীদের একটু কমনসেন্স শিখিয়ে দিয়েন। নয়তো দেখা যাবে পুলিশ সাধারণ মানুষকে নয় সাধারণ মানুষ পুলিশকে সেবা দিচ্ছে!’
বলেই আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে আসলাম। কেন যেন ওনার ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত আমার সহ্য হয় না, অস্বস্তি অনুভব হয়।
নাশিদ এখনো রথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রথির কথাগুলো সে ঠিকমতো হজম করতে পারেনি। এতদিন কেসের মাঝে ডুবে থাকার কারণে তার মগজ থেকে এই “রথি” একদমই মুছে গেছিলো। আবারও এই রথি তার মগজে হানা দিলো। আবারও সে রথির রহস্য জানতে পূর্বের ন্যায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সেদিন নাশিদ নয়নকে আচ্ছাশিড় বকাঝকা করলো। কারণ, তার কারণে বাইরের মেয়ে এসে জ্ঞান দিয়ে গেছে যা নাশিদ এখনো হজম করতে পারছে না।
নয়নও সেদিন থেকে নিজেকে শোধরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো।
কোচিং সেন্টারে যেতে একটু দেরী-ই হয়ে গেলো। কোনরকমে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতেই ফাহাদ স্যারের সঙ্গে দেখা হলো।
-‘কী ব্যাপার রথি? আজ দেরী হলো যে?’
থানার কথা বলতে চেয়েও রথি বললো না। থানা এবং নাশিদ, এই দুটো শব্দ রথি নিজের মাঝেই রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাই “এমনি” বলে ফাহাদকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে ছুটে গেলো। সারা ক্লাসেও নাশিদের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভুলতে পারলো না। কই এতদিন তো নাশিদের কথা এতবেশি মনে পরেনি তাহলে আজ এসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? ওনাকে থানায় দেখতে পেয়ে?
এই মাসের বেতনের হিসেব করতে করতে হেঁটেই বাসায় ফিরছিলাম তখনই আমাদের এলাকার বখাটে শামুন আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শামুন বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বলে,
-‘হায়! মে মার যাওবা! এভাবে তাকিও না, এখানে লাগে!’
-‘ফাইজলামি একদম ভালো লাগে না শামুন, পথ ছাড়!’
-‘আগে হ্যাঁ বলে দাও, ছেড়ে দিবো।’
-‘কিসের “হ্যাঁ”?’
-‘ওইযে, তিন মাস আগে যেটা বলেছিলাম, সেটার উত্তর!’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বুকে দুইহাত গুঁজে বললাম,
-‘আমি মরে গেলেও তোকে আমার উত্তর “না”-ই থাকবে। সাবধান করছি, আমার থেকে দূরে সরে যা। নয়তো তোর এমন হাল হবে তুই তা এই জীবনেও ভুলতে পারবি না!’
আমার কথায় শামুন ফিক করে হেসে দেয়।
-‘যা হবে না জেনেও এক কথা দিয়ে ভয় দেখাও এটা বেশ ভালো লাগে। তোমার তেঁজ তো আরও বেশি। তাইতো হুট করে তোমায় পুরো মনটা দিয়ে দিলাম। যাইহোক, আমি তোমার জন্য সব করতে রাজি, জাস্ট! অন্য ছেলের প্রতি দুর্বল হলে তোমার কী হাল করতে হয় তাও আমার জানা আছে। তুমি আমার ওকে? বাই ডার্লিং!’
বলেই আমার থুঁতনিতে হাত দিতে যাবে তখনই আমি দু’কদম পিছিয়ে গেলাম। শামুন হাসতে হাসতে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আর আমি বিষন্ন মনে বাড়িতে ফিরলাম। বাড়ি ফেরার সময় যেন আমার পা চলছিলো না। ইচ্ছে করছিলো সব ফেলে এমন একটা দুনিয়ায় চলে যাই যেখানেই শুধুই আমার নিজস্ব রাজত্ব চলবে, একান্তই নিজস্ব রাজত্ব। সেখানে কেউ থাকবে না।
★
সন্ধ্যার পর নাফিসা, নেওয়াজ, তার বউ এবং নাশিদ একসাথে ঘুরতে বের হয়। কিছুদিন আগেই নেওয়াজ ও তার বউ তনু হানিমুন থেকে ফিরেছে। নাফিসা আর তনু কথা বলে বলে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বিভিন্ন আলাপ করছে। নেওয়াজ কেএফসির থেকে দুটো জুস নিয়ে আসে। অতঃপর নাশিদকে এক গ্লাস দিয়ে নিজেরটা পাইপ দিয়ে খেতে শুরু করে। নাশিদ আনমনেই জুসটা খাচ্ছে। নেওয়াজ অনেকক্ষণ ধরেই নিজের ভাইয়ের আচরণ লক্ষ করছে। এবারও নাশিদের আনমনা তার চোখ এড়ালো না।
-‘কী ব্যাপার নাশিদ? এমন আনমনা দেখাচ্ছে কেন তোকে? অনেকক্ষণ ধরেই আমি তোকে লক্ষ করছি, কোনো কী সমস্যা?’
-‘না ভাইয়া। তেমন কিছু না!’
-‘আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছিস?’
-‘আরে নাহ।’
-‘আমার সাথে চালাকী করবি না নাশিদ!’
-‘ফাইন! বলছি, থানায় এক মেয়ে ইনডাইরেক্টলি আমায় জ্ঞান দিয়ে গেছে।’
বলেই পুরো কাহীনি সংক্ষেপে তুলে ধরলো। তবে নাশিদ জানালো না রথি নাফিসারই বেস্টফ্রেন্ড। অচেনা মেয়ে বলে পুরো ঘটনাটিই সে তুলে ধরলো। নেওয়াজ নাশিদের এসিস্ট্যান্টের কর্মকান্ডে হু হা করে হেসে উঠলো। এমন বলদও পুলিশের চাকরি মানে নাশিদেরই এসিস্ট্যান্ট! হাস্যকর।
-‘যাক, আশা করছি মেয়েটার কথায় নয়নের মাথা খুলবে। হায়রে কাহীনি লাভ সেটারময়।’
নাশিদ উত্তরে কিছু বললো না। নেওয়াজ আবারও নাশিদকে খুচিয়ে বলে উঠলো,
-‘তুই বিয়ে করলেই দেখবি মেয়েরা তোর পিছে ঘুরা বন্ধ করে দিছে। আসলে তুই তো আমার মাহশাল্লাহ ভাই তো তাইতো মেয়েদের লাভ লেটার নিতে নিতে বেচারা নয়ন মাঝখান দিয়া ফাইসা গেছে। বিয়ে করে ফেল, আমি তো করেই ফেললাম। সো তোর লাইন ক্লিয়ার বস!’
-‘নো ওয়ে। কোনো আলতু ফালতু মেয়েদের আমার জীবনে জায়গা নেই! আর এদের কাউকে বউ বানানো তো বিলাসিতা!’
-‘তাহলে তোর কেমন মেয়ে পছন্দ?’
-‘আত্মনির্ভরশীল, সাধারণ একজন! এইটুকুই আমার এনাফ ভাইয়া!’
নেওয়াজ চুপ করে গেলো। কারণ সে জানে এরকম মেয়ে হারিকেন দিয়ে সারাজীবন খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আর পেলেও তারা নাশিদের পার্সোনালিটির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। নেওয়াজের মতে তার ভাই তার একজন আদর্শ। হ্যাঁ নাশিদ তার ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও নেওয়াজ নাশিদকে আদর্শ হিসেবে মানে এবং ভালোবাসে। একচুয়ালি নাশিদ মানুষটাই এমন, তার মধ্যে কী কী জ্ঞান, বিচক্ষণতা লুকিয়ে আছে সবটাই যেন রহস্য। নাশিদকে কখনো অচেনা কারো সঙ্গে মিশতে দেখেনি, সেই ছোটবেলা থেকেই। হয়তো উপলব্ধি করেছিলো, তার এই দুনিয়ায় আপন মা বলতে কেউ নেই।
ভাবতেই নেওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হ্যাঁ নেওয়াজ জানে নাশিদ তার আপন ভাই নয়। যখন নাশিদের মা মারা যায় তখন নাশিদ মাত্র ২ বছর বয়সী ছিলো আর নেওয়াজ ছয় বছর বয়সী। আর নাফিসা, সে তো দুনিয়ার আলো দেখতেই তার মা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। নেওয়াজের এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, ওই টুকুনি দুই বাচ্চার পরিস্থিতি কী-রূপ ছিলো, তার মা কীভাবেই না দুজনকে একত্রে সামাল দিয়েছিলো। সবটা আজও তার চোখে ভেসে উঠে। চাইলেও ভুলতে পারে না। তবে সে নাশিদকে এবং নাফিসাকে আজও বুঝতে দেয়নি তাদের সৎ ভাই হচ্ছে নেওয়াজ। কারণ সে চায় না বাকি সৎ ভাইদের মতো নিজের চরিত্র খারাপ করতে। সে একজন আদর্শ ভাই হবে বলেই প্রতিজ্ঞা করেছে।
~চলবে।
#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৬ |
বিষন্ন নিকষ কালো রাত! চারপাশে শোঁ শোঁ শব্দে শীতল বাতাস বইছে। এই রাতে মই বেয়ে ছাদে উঠছে রথি। তাদের পুরো ছাদ টিনের হলেও বাথরুম এবং কিচেনের উপর দিয়ে ইট-সিমেন্টের ঢালাই করা। সেখানে ছোট সাইজের গাজী টাংকি। সেই গাজী টাংকির পাশে বড়-জোর দুজন মানুষ বসার মতো জায়গা আছে। আর এই ছোট জায়গাটি-ই রথির মন খারাপের সঙ্গী। মই বেয়ে উঠে সে টাংকির সঙ্গে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পরে এবং অদূর আকাশের পানে তাকিয়ে রয়। তার ভেতরের বেদনাগুলো চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। এ জীবনে এতো কেন কষ্ট? কেন গরিব হলে এতো কষ্ট, এতো লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়?
গরিব বলে কী তারা মানুষ নয়? আজ রথির তার বাবার প্রতি অনেক অনেক অভিমান জমেছে। কেন সে চলে গেলো? সে থাকলে যে তার দুর্দিন শুরু হতো না। রথি চোখের জল ফেলতে ফেলতে আকাশের পানে তাকিয়েই বলতে শুরু করলো,
-‘দেখছো বাবা? তোমার মেয়েকে ছায়া দেয়ার মতো কেউ নেই, একটি ভরসার হাত নেই যেখানে নিজে একটু সুরক্ষা অনুভব করবো। তোমার রাজকন্যা এখন খেটে মরে, এলাকার মানুষদের ভোগের বস্তু হয়ে গেছে। তার নির্দিষ্ট কোন সম্মান নেই, যে যেখানে পারছে অধিকার খাটাচ্ছে, খোটা দিচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না বাবা। তুমি না বলতে তোমার মেয়েকে যেই বাজে কথা বলবে তুমি তার জিহবা কেটে হাতে ধরিয়ে দিবে? এখন তুমি কোথায় পালালে বলো তো? তুমি যখন ছিলে তখন তো এতকিছু হয়নি? যেদিন ঘুমের মধ্যেই চলে গেলে তারপর থেকেই আমার প্রিয় ভাবীটাও বদলে গেলো সাথে আমি আমার পড়াশোনা ছেড়ে শিক্ষকতা করছি আর রাস্তায় যার তার কথা শুনছি। বাবা বিশ্বাস করো, আমি আর পারছি না। অনেক সহ্য করেছি, আর কতো করবো? জানো মা আজও লুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদে। আর আমি বুঝেও কিছু বলার ভাষা পাই না। কেন জীবনটা এতটা এলোমেলো হয়ে গেলো?’
বলেই দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ডুঁকরে কাঁদতে লাগলো। সময় এভাবেই অতিবাহিত হতে লাগলো কিন্তু কেউই রথির বেদনা মিশ্রিত অভিযোগ শুনলো না, কেউ না।
★
পরেরদিন এভাবেই আনমনা হয়ে কোচিং হতে রথি বাড়ি ফিরছিলো তখনই দূরে থানার সাইনবোর্ড দেখতে পায়। “থানা” শব্দটি দেখেই রথির মন খারাপ কেটে গিয়ে নাশিদকে ঘিরে তার ভাবনা শুরু হলো। আচ্ছা নাশিদ কী এখন থানাতেই আছে? ভাবতে ভাবতেই থানার পথে যেতে লাগলাম। পুলিশম্যানের জানালার সামনে আসতেই পা-দুটো উঁচু করে ওনার কক্ষে উঁকি দিলাম। হু, পুলিশম্যান ফাইল ঘাটতে ব্যস্ত। এসব মোটা মোটা ফাইলগুলিতে কী আছে তা জানার বেশ ইচ্ছে আছে আমার। হুট করে সেই স্ক্রু ঢিলাকে দেখে উঁকি দেয়া বাদ দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে চলে গেলাম। স্ক্রু ঢিলাটা হচ্ছে ওই পুলিশ যে কিনা আমার উপর চিঠির বর্ষণ করিয়েছিলো। একে স্ক্রু ঢিলাতেই বেশি স্যুট করে। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়? প্রতিদিনের মতো আজও ওই লম্পট শামুনের সঙ্গে দেখা। এই লম্পট অলরেডি আমার হাফ লাইফ বরবাদ করে দিয়েছে। এ ছেলে মানুষ, এলাকার নামকরা বখাটে, বেশি কিছু বলতেও পারি না। চুপ করে সহ্য করতে হয়। শামুন প্রতিদিনের মতোই কিছুক্ষণ জ্বালিয়ে বিদায় হলো। আমি সেখানেই মূর্তির ন্যায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
এভাবে রোজ আমি থানায় উঁকি দিতে শুরু করি। কেন জানি না পুলিশম্যানকে উঁকি দিয়ে দেখতে ভালো লাগে। এক মুহুর্তের জন্য হলেও আমার বেদনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসি। আচ্ছা এমন কেন হয়? ওনার সাথে তো আমার কোনরকম পার্সোনাল পরিচয় নেই। কখনো প্রাণ খুলে জাস্ট এক মিনিটও কথা বলিনি। তাহলে? এ কেমন অনুভূতি?
আজও ফেরার সময় থানায় উঁকি দিলাম কিন্তু আজ উনি অনুপস্থিত। ওনাকে না দেখতে পেয়ে আমি মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরলাম। মায়ের সামনে চেয়েও হাসি-খুশি থাকতে পারিনি, বারবার ওনাকে নিয়েই ভাবছিলাম। যখন ওনার কথা বেশি ভেবে ফেলি তখন মাথায় এক চাটি মেরে আম্মুকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে চলে যাই নয়তো আগামী দিনের লেকচারের প্রস্তুতি নিতে থাকি। এ ছাড়া অন্য কাজ নেই আমার।
এভাবে আরও কিছুদিন কেটে গেলো। প্রায় সময়ই উঁকি দিয়ে ওনাকে পেতাম না, তখন ভিষণ মন খারাপ হতো। ভাবীও নাকি তার বাবার বাড়ি গেছে তাই আপাতত শান্তিতে আছি, ডাকাডাকির ঝামেলায় নেই।
★
নাফিসা রেডি হয়ে নাশিদের রুমে আসতেই দেখলো নাশিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারারাত ডিউটি করে এখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নাশিদের ঘুম দেখে নাফিসার আর নাশিদকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এখন না ডেকেও যে উপায় নেই। আগামী মাসে তাদের ভার্সিটিতে একটি প্রোগ্রাম আছে, কয়েকজন টিচার বলেছে রথি যেন অবশ্যই আসে। নাফিসা ভাবলো অনেকদিন রথির সঙ্গে দেখা হয় না। ফোনে বলার চেয়ে বরং এক কাপ চায়ের সাথে সরাসরি বসেই জানালো। নাফিসা একা যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার মা বারণ করেন। বলেন নাফিসাকে যেন নাশিদ পৌঁছে দিয়ে আসে। তাই নাফিসা বাধ্য। আর রথি ওদের ডিপার্টমেন্টের টপার এবং খুবই শান্ত-শিষ্ট ছিলো বিধায় টিচাররা ওকে বেশ পছন্দ করতো। যখন অনার্স থার্ড ইয়ারে এসে রথি পড়াশোনা ছেড়ে দেয় তখন ওদের ইয়াকুব স্যার এবং আঞ্জুমান ম্যাম দুই-তিন দিন পরপরই রথির বাসায় গিয়ে ওদের বোঝাতো। কিন্তু রথি রাজি হয়নি৷ অবশেষে আঞ্জুমান ম্যাম হার মেনে চলে যাওয়ার আগে রথিকে বলে যায়,
-‘যদি কখনো দরকার হয় এই ম্যাম আর স্যারকে স্মরণ করিও। ইনশাল্লাহ পাশে থাকবো!’
রথি সামান্য হেসে “জ্বী” শব্দটিই মুখে উচ্চারণ করেছিলো। রথি প্রথমদিকে শান্ত-শিষ্ট আর বোকাসোকা হলেও সময় এবং পরিস্থিতির ব্যবধানে অনেকটা বদলে গেছে। এখন সে আত্মনির্ভরশীল একজন নারী।
নাফিসা উপায় না পেয়ে নাশিদকে ডাকলো। নাশিদ প্রথমে রেসপন্স না করলেও পরে উম..হা বলে আবারও ঘুমিয়ে যেত। নাফিসা উপায় না পেয়ে বিষন্ন মনে নাশিদের বেডে বসলো এবং নাশিদের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তাড়াতাড়ি উঠ না ভাই! রথির বাসায় যেতে যে লেট হবে।’
ঘুমের মাঝেও “রথি” নামটা কানে লাগতেই নাশিদ চট করে উঠে বসলো। নাশিদ আচমকা উঠে বসায় নাফিসা অবাকের চরম পর্যায় চলে আসে। নাফিসা গোল গোল চোখে নাশিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাশিদ নাফিসার এমন তাকানো দেখে প্রসঙ্গ বদলে বললো,
-‘কী সমস্যা? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আর জলদি ওঠার তাড়া দিচ্ছিলি কেন?’
-‘রথির বাসায় যেতাম। মা বলেছে তোর সাথে যেতেম’
-‘এই ভর-দুপুরে কী উপলক্ষ্যে?’ ভ্রু কুচকে বলল্প নাশিদ।
-‘নেক্সট মান্থ ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। সেই প্রসঙ্গেই।’
-‘কেন রথি কী জানে না? তুই কেন আলাদাভাবে ওকে বলতে যাবি?’
-‘ও তো গতবছর লেখাপড়া ছেড়েছে!’
নাশিদ থমকে গেলো। নাফিসার বলা এই একটি মাত্র বাক্য যেন নাশিদের মাথার উপর দিয়ে গেলো।
-‘মানে কেন?’
-‘আর্থিক সমস্যার জন্য। তোকে বলেছিলাম না, মেয়েটার জীবনে অনেক কষ্ট? আলাদা থেকে মা এবং নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার কাঁধে। তার মায়ের চিকিৎসার জন্য একটা ভালো শাড়ি তো দূর জামা পর্যন্তও কিনেনি ভাই, তাইতো ওরকম পুরানো শাড়ি পরে নেওয়াজ ভাইয়ের বিয়েতে এসেছিলো। মাঝে মধ্যে ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে চিন্তা করি আর আঁতকে উঠি, তাকে ছায়া দেয়ার মতো কেউ নেই!’
নাশিদ চুপচাপই সবটা শুনলো। তার যে এসব শুনে খারাপ লাগেনি তা সে অস্বীকার করবে না। নাশিদের ইচ্ছে করছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু রথি কী সেই সাহায্যের হাত গ্রহণ করবে? নাশিদ কিছুক্ষণ ভাবান্তর হয়ে বলে,
-‘কীসের জব করে?’
-‘একটা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করছে!’
নাশিদ বিছানা থেকে নেমে হাতে তোয়াল নিয়ে ওয়াশরুম যেতে যেতে বলে,
-‘নিচে গিয়ে অপেক্ষা কর, আমি আসছি!’
নাফিসা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। এই রথি চরিত্রটা তার কাছে যেন রহস্যের ভান্ডার। দেখে বোঝাই যায় না এইটুকুনি একটি মেয়ে এতটা অসহায়, ভেতরে কতটুকু পোড়া দাগ তার মাঝে বিদ্যমান। আচ্ছা নাফিসা তো বললো মা এবং রথির ভরণপোষণ, এর মানে কী রথির বাবা নেই? ও মাই গড!
কিন্তু নাশিদের এতটা কেন খারাপ লাগছে! নাশিদ রথির ভাবনা সাইডে ফেলে গোসল সেরে নিলো। অতঃপর রেডি হয়ে নাফিসাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
কোচিং থেকে বিষন্ন মনে বাসায় ফিরছি। আজও পুলিশম্যানকে থানায় পেলাম না। এর পুলিশ হওয়ার কী দরকার ছিলো? সারাদিন চোরে ডাকাতের পিছে ছুটো। বিড়বিড় করতে করতেই বাসার গেটের দিকে চোখ যেতে থমকে দাঁড়ালাম। পা যেন সামনে চলছে না। হা করে পুলিশম্যানকে দেখছি। উনি আমার বাসার সামনে কী করছেন? ওনার পাশের মেয়েটির দিকে খেয়াল হতেই দেখলাম নাফিসা। কিছুক্ষণ ভাবাশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই দেখতে পেলাম ওরা ভেতরে ঢুকছে। তখনই আমার ছোট বাসভবনের কথা মনে হলো। একপ্রকার ছুটে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের পথ আটকে গেলাম। রথিকে চোখের পলকে সামনে দেখতে পেয়ে নাশিদও কিছুটা থমকে যায়!
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।