হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬৫.
মানব জীবনের বাঁধা ধরা এক নিয়ম হলো মৃত্যু। সবচেয়ে বড় সত্যি। পৃথিবীর কোনো মানুষই আজীবন বেঁচে থাকে না। তার সব শখ সব আহ্লাদ পূরণ হলেও হায়াত ফুরাবার পর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সুইসাইড যারা করে তারাও মরতে চায় না। বেঁচে থাকতে চায়। সুখ চায়। ভালোবাসা চায়। ডিপ্রেশন নামক ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্তি চায়। তাদের এসব চাওয়া পাওয়া হয় না বলেও তারা বাঁচতে পারে না। একটা সুযোগ না পাওয়ায় তারা চলে যায়। মৃত্যুকে ভয় পাওয়া মানুষটাও মরে। কোনো মানুষই মরতে চায় না। সুন্দর প্রকৃতি, আকাশ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পারিপার্শ্বিক সর্বপ্রকার সম্পর্ক হুট করে ছিন্ন করতে কেউই রাজি নয়। মৃত্যু সেসবের ধার ধারে না। যার যখন মৃত্যু লেখা তার তখনই মৃত্যু হয়। আজরাইল (আ.) এক সেকেন্ডও দেরি করেন না। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার হয়তো কিছু করার থাকতে পারে, কিছু স্বপ্ন পূরণ করার থাকতে পারে, কাউকে কিছু বলার থাকতে পারে। চিরন্তন সত্য মৃত্যু সেই সময়টুকুও দেয় না। তেমনি দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত রোগ ভোগের পর আজ সকাল সাতটার দিকে ইন্তেকাল করেন মতিউর রহমান। এ ক’মাসের রোগে তিনি জর্জরিত হয়ে পরেছিলেন। প্রায় সবাই বুঝেছিলেন শেষ বয়সের রোগ, সহজে যাবে না। হয়তো কেড়ে নেবে মানুষটাকে। তাই নিলো।
গতরাতে কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ওনার। ক্লান্ত, অসার তার শরীর। পলকহীন স্থির দৃষ্টি। শ্বাস ধীর গতিতে চলছিলো। ডাক্তারও হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন ছুটে এসেছেন। হিমি দুদিন আগে থেকেই এখানে থাকছে। মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে সোজা মতিউর রহমানের বাড়ি এসে উঠেছে তাহির। শেষরাতের দিকে সেই মতিউর রহমানের চেক আপ করছিলো। ফজরের সময় মতিউর রহমানের চেহারা উজ্জল দেখাচ্ছিলো। চলে যাওয়ার সময় কি এমনটা হয়? হয়তো হয়। মতিউর রহমান বেশ শান্ত স্বাভাবিক ভাবে চলে গেলেন।
এক মাস আগে থেকেই যাদের ধারনা হয়েগেছিলো বৃদ্ধের হায়াত ফুরাচ্ছে তারাও হাউমাউ করে কাঁদছে। বাড়িতে এমন কেউ নেই যার চোখে জল নেই। অথচ এই ভদ্রলোকই না কি একসময় রেগে মেগে থাকতেন। যাকে তাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করতেন। আজ শুনা যাচ্ছে ওনার মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে দুটো নেই। কেউ ঠিকই বলেছেন, আপনি ভালো মানুষ ছিলেন সেটা জানতে হলে আপনাকে মরতে হবে। মৃত্যুর পরই আপনি সবার কাছে ভালো।
ইতিমধ্যে মতিউর রহমানকে মৃতের গোসল দেয়া হয়েছে। আত্মীয়রা কান্না থামিয়েছেন। লাশ কবরে নামানো হলে ঘনিষ্ঠজনরাও থেমে যাবেন। একদিনের ব্যবধানে সবাই ভুলে যাবে বাড়ির কর্তা নেই। কালও যে লাঠি হাতে গর্জন করতেন, রাগ ঝাড়তেন তিনি আজ থেকে আর এসব করবেন না। সব কিছুর উর্ধে চলে গেছেন কি না! মোজাম্মেল সাহেব এক দৃষ্টে খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা বাবাকে দেখছেন। বাবার বড় ছেলে ছিলেন। এখানে উপস্থিত সবার থেকে মতিউর রহমানের সাথে ওনার সম্পর্ক ছিলো গভীর। বাবার দিকে তাকিয়ে মনে পরছে ওনার সাথে কাটানো প্রত্যেকটি মুহুর্ত। আফসোস হচ্ছে কেনো এতগুলো বছর দূরে থাকলেন বাবার থেকে। কি হতো যদি এ দেশে থেকে বাবার সাথে সময় কাটাতেন? কেনো করলেন না? কেনো দূর দেশে শুধু ভবিষ্যতের চিন্তায় পারি জমিয়েছিলেন? ভেতর থেকে রাশি রাশি দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। চোখ জোড়া শুষ্ক। চেহারা বিধ্বস্ত। মুহিব রহমান আর নেহাল রহমান মৃত্যু পরবর্তীকালিন কার্যে ব্যস্ত। কান্না কাটির সময় নেই তাদের। আমিনা বেগম দীর্ঘ সময় শ্বশুরের ঘরে বসে থেকেছেন। আজ ভোর অব্দি কোনো অভিযোগ ছাড়া নিরলস ভাবে সেবা করেছেন শ্বশুরের। এখন তিনিও মুক্ত। তবুও কাঁদছেন। আশ্চর্য! রাদিবা এদিক ওদিক ছুটে আত্মীয়দের সেবা করছেন। এরা মৃতকে বিদায় জানাতে এসেছে না কি খাওয়া দাওয়া আর গল্প গুজব করতে এসেছে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। নিহানের চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল। দাদুর মৃত্যুতে ভেঙে পরেছে সে। হয়তো কোনো এক সময়ের কথা মনে করে অনুতপ্ত হচ্ছে। মিশ্মি তার শাশুড়ি আর জ্যাঠি শাশুড়ির সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। হিমি সবার থেকে আড়ালেই আছে। ফুঁপাচ্ছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ঠোঁট উল্টে ভয়ঙ্কর রকমের কান্না আসছে। হাত পা ছড়িয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে মন চাইছে তার। কিন্তু করছে না। নিজেকে সংযত রেখে নিরবে চোখের পানি ঝড়াচ্ছে। বাড়িতে আগরবাতি জ্বালানো হয়েছে। আতর আর আগরবাতির ঘ্রাণে ভীষন পবিত্র লাগছে সব। হিমির চোখে ভাসছে দাদুর বকা, শাস্তি, হাসি, রাগ, দুঃখ, ‘মরেই তো যাবো’ বলে ব্লেকমেইল করা, কঠিন পুরুষ থেকে হঠাৎই বাচ্চাদের মতো কোমল নিষ্পাপ হয়ে যাওয়া। সবই আছে, থেকেও কিছু নেই। দাদু নেই তারপরও আছে। অদ্ভুত অনুভুতি।
__________________
রাত বেশি হয় নি। তবু মনে হচ্ছে মাঝরাত। বাড়িতে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। এতোটাই নিস্তব্ধ সব যে বাইরের ঝি ঝি পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বসার ঘর আর রান্নাঘর ছাড়া কোথাও আলো নেই। মতিউর রহমানের ঘর থেকে এখনো আগরবাতির সুগন্ধ ভেসে আসছে। পরিবারের সদস্যরা যার যার ঘরে আছেন। কারো চোখে ঘুম নেই। সবার দৃষ্টি স্থির। মন ভার। বুক ভর্তি দীর্ঘশ্বাস। চোখে টলমলে জল।
“কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে নিজের শরীরটা কেনো খারাপ করছেন আপনি? দাদু চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরবেন না।”
তাহিরের কথায় অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হিমি। অভিমানী গলায় বললো,
“দাদু ফিরবে না বলেই তো কাঁদছি।”
“হিমি? এভাবে কান্নাকাটি করলে শরীর খারাপ করবে তো। ঠিকমতো খাননি ও। শান্ত হোন।”
তাহিরের কথায় চটে গেলো হিমি। ঝটকা মেরে বাহু থেকে তাহিরের হাত সরিয়ে বললো,
“হবো না। আপনি বুঝছেন না আমার কষ্ট হচ্ছে?”
হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো তাহির। আধশোয়া হয়ে বললো,
“বুঝতে পারছি।”
“তাহলে আটকাচ্ছেন কেনো?”
“কারন বিকেল থেকে তিনবার পেইন কিলার নিয়েছেন আপনি। ইটস নট গুড ফর ইউর হেল্থ। চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন আপনি। মাথা ব্যথা ছাড়ছে না। তারপরও কাঁদছেন। এতে আপনার ক্ষতি হচ্ছে বুঝছেন না?”
ডুকরে উঠলো হিমি। হাত দিয়ে চোখ মুছে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমার দাদুর কথা খুব মনে পরছে বাচ্চা ডাক্তার। দাদুকে যে আমি এতোটা ভালোবাসি তা জানতামই না। বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। খুব কান্না পাচ্ছে। বার বার দাদুকে দেখছি। মনে হচ্ছে দাদু আমার উপর রেগে আছে। দাদু পরশুদিন আমায় কি বলেছে জানেন?”
তাহির মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। হিমি ক্রন্দন রত অবস্থাতেই বললো,
“দাদু বলেছে আমি না কি একদম বদলে গেছি। আগের হিমি নই। আমি নতুন হিমি। দাদু না কি সেই পুরাতন ছন্নছাড়া হিমিকে মিস করছে। হঠাৎ না কি আগের হিমিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি দাদুর সাথে কথা বলতে পারি নি কেনো জানি। চুপ করে থেকেছি। দাদু নিশ্চয় খুব কষ্ট পেয়েছে! আমি আগের হিমি হতে পারলাম না। দাদুকে বলাও হলো না আমি আমার আগের দাদুকে মিস করি। ভালোবাসি তাকে। তার রাগ, বকা, শাস্তি সবটাই মিস করি।”
কথা বলতে বলতে হেঁচকি উঠে গেলো হিমির। তবুও কান্না থামে নি তার। তাহির উঠে বসে হিমির মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ালো। শান্ত শীতল গলায় বললো,
“হিমি? আপনি জানেন আগের হিমি আর এখনকার হিমির মধ্যে তফাত কতটুকু?”
হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তাহির বললো,
“আগের হিমি এম্ম্যাচিওর ছিলো। এখনের হিমি ম্যাচিওর। আগে হিমি কোনো কিছুর পরোয়া করতো না। এখন করে। আগে আপনি ছন্নছাড়া ছিলেন, ছুটতে ভালোবাসতেন। আর এখন আপনি গোছালো, শান্ত আর পরিবারের কাছাকাছি থাকতেই অভ্যস্ত। আচ্ছা, আপনি যে এভাবে কাঁদছেন জানেন আপনার কান্নার জন্য আপনার দাদু কতোটা কষ্ট পাবে? মৃতের জন্য দোয়া করতে হয়। কাঁদতে হয় না। কাঁদলে মৃতের আত্মা কষ্ট পায়। দাদু আগের হিমিকে দেখতে চেয়েছিলেন না? আগের হিমি কিন্তু কাঁদতো না। কাঁদলেও এভাবে পাগলামো করতো না। আপনি করছেন। করা উচিত নয়। দাদুর জন্য হলেও থামুন। নিজেকে সামলান।”
তাহিরের কথা শেষ হওয়া মাত্র হিমি হুমড়ি খেয়ে তাহিরের বুকে পরলো। কেঁদে উঠলো আবার। হেঁচকি তুলে তুলে কেঁদে তাহিরের টিশার্ট ভেজাতে লাগলো। তাহির বাধা দিলো না। একহাতে আলতো করে জড়িয়ে রইলো হিমিকে। উদ্দেশ্য হিমিকে শান্ত করা। হলোও তাই। কয়েক মিনিট পার হতেই হিমি তার শক্ত করে জড়িয়ে ধরা হাত ছেড়ে দিলো। কান্না থামলো। তাহির মুখ নিচু করে দেখলো হিমি ঘুমিয়ে পরেছে। এখনো হেঁচকি উঠছে যদিও। তাহির হিমিকে খাটে শুইয়ে কাঁথা জড়িয়ে দিলো গায়ে। ঘুমের মধ্যে মৃদু কম্পন করে নড়ছে হিমি। তাহির ডান হাতে হিমি হাত ধরে রেখে অন্য হাত তার কপালে ছুঁয়ালো। না জ্বর নেই। তবে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সন্ধ্যায় দু ঘন্টা শাওয়ার ছেড়ে বসেছিলো সে। বহু ডাকার পর তবেই বাইরে বেরিয়েছে। বার বার পেইন কিলার নিচ্ছে। মেডিসিনের সাইড এফেক্টেও অসুস্থ হতে পারে হিমি। এতো কান্নাকাটি আর দুশ্চিন্তার ফলে জ্বর আসা তো স্বাভাবিক। খেয়াল রাখতে হবে তার।
চলবে,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬৬.
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিলেন মুহিব রহমান। মতিউর রহমানের মৃত্যুর শোক এখনো কাটে নি কারোর। তবুও জীবনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে আগের মতোই জীবনযাপন করছেন সকলে। মুহিব রহমানের ঘর অন্ধকার। বারান্দায় অল্প আলো জ্বলছে। তাহির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সচেতনতা মূলক কাশি কাশলো। মুহিব রহমান সচকিত হয়ে সোজা হয়ে বসলেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটালেন ঠোঁটে। বললেন,
‘ভেতরে এসো।’
তাহির ভেতরে ঢুকলো। মুহিব রহমান বললেন,
‘তোমার আপত্তি না থাকলে ঘরের বাতি নেভানোই থাক!’
তাহির মাথা দুলালো। মুহিব রহমান তাহিরের দিকে চেয়ার এগিয়ে দিলেন। তাতেই বসলো সে। মেয়ের জামাইয়ের সাথে এখনো সৌজন্যতামূলক কথা বার্তা হয়ে উঠে নি ওনার। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরছেন।
‘আজ চলে যাবে?’
‘জি। অনেকদিন তো থাকলাম। এবার বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।’
মুহিব রহমান চুপ করে গেলেন। কথা কি করে আগানো যায় তাই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। উশখুশ করছেন। তাহির গলা কেশে বলে,
‘কিছু বলবেন?’
মুহিব রহমান মাথা দুলালেন। রয়ে সয়ে বললেন,
‘হিমিকে রেখে যাও। আরো কয়েকটা দিন থাকুক।’
‘আচ্ছা।’
তাহিরের এমন ছোট্ট স্পষ্ট জবাবে আবারও চুপ করে গেলেন মুহিব রহমান। বেশ অনেকক্ষন নিরবতায় কাটার পরও যখন তাহির উঠলো না তখন সহজ হলেন মুহিব রহমান। অপ্রস্তুত হেসে বললেন,
‘কয়েকদিন থেকেই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম।’
‘কি ব্যাপারে?’
‘আমি তোমার বাবার বিষয়ে জানতে চাইছিলাম।’
তাহির গাঢ় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘বাবার বিষয়ে আমি যতটুকু জানি সেটা আপনাদের বলেছিলাম। এর বেশি কিছু জানি না। উনি কোথায় গেছেন, কেনো গেছেন, ফিরবেন কি না একটা প্রশ্নের উত্তরও নেই আমার কাছে।’
হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লেন মুহিব রহমান। মৃদু স্বরে বললেন,
‘ওহ। তুমি কি এখনই চলে যাবে?’
‘হ্যা। আপনার থেকে কিছু জানার আছে। জানা হয়ে গেলেই চলে যাবো।’
কপালে চিন্তার ভাজ ফেললেন মুহিব রহমান। অন্ধকারে সেই ভাজ নজরে পরলো না তাহিরের। সে তার মতো করেই বললো,
‘আপনার আর হিমির মধ্যে যে দূরত্ব তা কি আপনি জেনে বুঝেই সৃষ্টি করেছেন?’
‘কিছুটা। আসলে, আমার স্ত্রীর মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারি নি। ভেঙে পরি। তখন আমার কাছে আমার স্ত্রীই প্রাধান্য পেয়েছিলো। আমি ভুলে গেছিলাম আমার মেয়ের কথা। আপেক্ষিক ভাবে সেটা ভুল। তবে তখন আমার কাছে ঠিক ভুল বিচার করার সময় বা জ্ঞান কিছুই ছিলো না। হাসির চলে যাওয়াতে আমি অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পরি। এ শহর, হাসির মৃত্যু মেনে নিতেই বিদেশ চলে গেছিলাম।’
‘বিদেশ থাকাকালীন একবারও হিমির কথা মনে পরে নি?’
‘পরেছে। কিন্তু আমি চাই নি মনে পরুক। যতোবার হিমির কথা মনে পরতো আমার মনে পরে যেতো হাসির মৃত্যু। তাই ইচ্ছা করেই হিমিকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম। সব যখন আমার আয়ত্তে ছিলো তখন দেশে ফিরার ইচ্ছা জাগলো। জানো, আমার দেশে ফেরার আরো একটা কারন ছিলো হিমি। আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাইছিলাম। তার সাথে সময় কাটাতে চাইছিলাম। যেটুকু সময় তার থেকে দূরত্বে কেটেছে তার দ্বিগুন তাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’
‘তাহলে দূরত্ব বেড়ে গেলো কি করে?’
মুহিব রহমান চেয়ারে গা এলালেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘দেশে ফিরে হিমিকে দেখে আমি চিনতে পারি নি। এই কথাটা আমায় খুব কষ্ট দিচ্ছিলো তাহির। আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে গেছিলাম। আমার মেয়ের সাথে আমি চোখ মেলাতে পারছিলাম না। অপরাধবোধ কাজ করছিলো। মনে হচ্ছিলো হিমি আমায় চায় না। হয়তে আমায় ঘৃণা করে। মেয়ের বেশ ভুষা, আমার থেকে দূরে দূরে থাকা আমায় সেটা মানতে বাধ্য করিয়েছে। তারপর হঠাৎ করে মাইনোর হার্ট অ্যাটাক হয় আমার। হাসপাতাল বাড়ি এসবের মধ্যে মেয়ের সাথে কথা বলা তাকে বুঝানো হয়ে উঠে না। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর জানতে পারি হিমি তার মামা বাড়ি গেছে। আমি ভেবেছিলাম কয়েকদিন পরই ফিরবে। কিন্তু হিমি প্রায় মাস খানেক পর ফিরেছিলো। আমার মনে হলো আমি আসায় হিমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটা তার বাবাকে অপছন্দ করে। আর কখনো তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় নি। যখন করতাম তখন ভয় হতো। যদি ও আমায় ছেড়ে একেবারে চলে যায়!’
তাহির শুকনো হেসে বললো,
‘এদিকে হিমি ভাবে আপনি তাকে ভালোবাসেন না। আপনি চান না উনি আপনার সাথে থাকুন। কোনো এক কারনে ওনার ধারনা হয়েছে আপনি হিমিকে অপছন্দ করেন।’
‘স্বাভাবিক।’
‘না স্বাভাবিক নয়। ওনাকে বলা হয়েছে আপনারা মানে আপনি আর ওনার মা ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। মেয়ে হওয়ায় আপনি খুশি হন নি। আর তাই ওনাকে অবহেলা করে বিদেশ চলে গেছিলেন।’
হতভম্ব গলায় প্রশ্ন করলেন মুহিব রহমান,
‘কে বলেছে এসব?’
‘সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কি সত্যিই মেয়ে সন্তান হওয়ায় খুশি ছিলেন না?’
‘এটা ভুল। আমি আর হাসি কখনোই ছেলে মেয়ে বিভেদ করি নি। বরঞ্চ আমরা আমাদের অনাগত সন্তানকে ভালোবেসেছি সে ছেলে না মেয়ে সেটা না জেনেই।’
‘তাহলে ছেলে সন্তানের জন্য কাপড়-চোপড়, খেলনা এসব কেনার মানে কি?’
‘ছেলে সন্তানের কাপড়? তুমি ভুল বলছো। আমরা শুধু ছেলে সন্তানের কাপড় খেলনা কিনি নি, মেয়ের জন্যও কিনেছিলাম। কেননা আমরা তখন জানতাম না আমাদের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে হবে। ইন ফ্যাক্ট আমরা দুটো নাম ডিসাইড করেছিলাম। মেয়ে হলে হাফসা আর ছেলে হলে মাহিন।’
উদ্বিগ্ন গলায় তাহির বললো,
‘হিমি তো বাক্সে বন্দী শুধুই ছেলেদের পোশাক খেলনা পেয়েছিলো। ওর ভাগের জিনিস তো পায় নি!’
‘পায় নি কারন ওর ভাগের পোশাক ও পরেছে। ছোট ছিলো বলে মনে নেই হয়তো। অথবা কেউ সেই দিকে খেয়াল করে নি। সবাই হয়তো এটাই বুঝাচ্ছিলো আমরা ওকে ভালোবাসি কিন্তু এটা বলে নি যে পোশাক ও ওই সময় পরেছে সেসব আমাদের কেনা। তাই এতসব মিস আন্ডার্স্টেন্ডিং!’
‘আচ্ছা আঙ্কেল, বিদেশ থেকে আসার সময় নিহানের জন্য জিনিস আনার কথা আপনার মনে ছিলো। হিমির কথা ভুলে গেছিলেন?’
‘তোমায় বললাম না দেশে ফেরার একটা কারন ছিলো হিমি। তাহলে ওর কথা কি করে ভুলবো? আমি ওর জন্যও জিনিস কিনেছিলাম তাহির। দেওয়া হয় নি। পারি নি। সংকোচ, জড়তা, অপরাধ বোধের কারনে এতবছর যাবত মেয়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক করে কথা বলতে পারি নি। গিফ্টস কি করে দিতাম? ইউ নো, আমি ওর প্রত্যেক জন্মদিনে উপহার কিনেছি। মাঝরাতে ওর ঘরেও গেছি। কখনো ওকে পাই নি, কখনো পেয়েও দিতে পারি নি। হিমি কোনো এক অজ্ঞাত কারনে আমায় ভয় পেতো। মাথা তুলে তাকাতো না। চুপ করে থাকতো। আমায় দেখলেই গুটিশুটি মেরে থাকতো। আমি বুঝতাম। কিন্তু বুঝেও কিছু করতে পারি নি। এই যে তোমায় এতো কথা বলছি, এর একটা শব্দও আমি হিমিকে বলতে পারবো না। আমার গলা কাঁপবে।’
তাহির মেরুদন্ড সোজা করে বসে বললো,
‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না। যা শুনার ছিলো, জানার ছিলো সব হিমি শুনে নিয়েছেন। জেনেছেন। আশা করি বুঝেছেন।’
মুহিব রহমান সোজা হয়ে বসে কপাল কুঞ্চিত করলেন। তাহির উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে দু হাত গুঁজে দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘বাইরে দাঁড়িয়ে অন্যের কথা শুনা উচিত নয়। জানেন না?’
মুহিব রহমান সেদিকে তাকালেন। অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ তাহির দেখছে। কি করে? মুহিব রহমান সংকোচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কম্পিত গলায় বললেন,
‘কে বাইরে?’
কোনো জবাব এলো না। তাহির মৃদু হেসে বললো,
‘আপনার মেয়ে। আসছি আমি।’
মুহিব রহমান আঁতকে উঠলেন। ওনার সব কথা হিমি শুনে ফেললো? তাহির আগে থেকেই জানতো? না কি এখন দেখলো? তাহির কি হিমিকে সবটা জানাতেই এসব প্রশ্ন করছিলো? হিমি বাবাকে এবার কি ভাববে? তাহির বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। দরজা পেরিয়ে ছায়ামানবীর পাশে দাঁড়িয়ে পরলো সে। হিমির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
‘আপনার বাবা চাইছেন আপনি থাকুন। থাকবেন?’
হিমি জবাব না দিয়ে অভিমানী চোখ তুলে তাকালো। চোখের জল গালে আঠার মতো লেগে আছে তার। ফুঁপাচ্ছেও একটু একটু। তাহির বললো,
‘থাকুন তবে। আমি চললাম। মান অভিমান মিটিয়ে নিন।’
হিমির থেকে জবাবের অপেক্ষা না করে হন হন করে বেরিয়ে গেলো তাহির। হিমি মৃদু কম্পন তুলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। মুহিব রহমানও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘরটা তখনও অন্ধকার। বাড়ি নিস্তব্ধ।
চলবে,,,,,,,,,