হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬১.
নান্দনিক পার্কের উত্তর দিকে থাকা ছাতায় ঢাকা টেবিলে মুখোমুখি হিমি আর ইয়াসির। রোদ্দুরে খা খা করছে শহর। খোলামেলা এই পার্কের চারদিক গাছ গাছালিতে ঘেরা। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। দুপুর বেলা হওয়ায় পার্ক প্রায় খালি। এখানে সকালে আর বিকেলের দিকে ভীড় হয়। শিশু, বৃদ্ধ, জোয়ান সব ধাঁচের মানুষরাই একান্ত সময় কাটাতে এই ভীড়ে আসে। জনমানবে গিজ গিজ করা জায়গাতে কেউ কেউ আবার একাকিত্বে সময় কাটায়। মনোরম পরিবেশ। হিমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইয়াসির সাবলীল গলায় বললো,
‘আমি সত্যি বলছি। যা করেছি সবটা ইচ্ছাকৃত ছিলো। আমি জানতাম চিঠি প্রেরক মিশ্মি। আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো সে। সব জেনেই ওর সামনে এসে দাঁড়াই নি। এড়ানোর চেষ্টা করছি।’
হিমি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো,
‘আপনাকে প্রফেসর বলেই সম্বোধন করছি। কিছু মনে করবেন না যেনো। তো আপনি বলছেন আপনি মিশ্মিকে আড়ালে রেখেছেন শুধু মাত্র ইগো দেখিয়ে? আমার তা মনে হচ্ছে না।’
‘উহুম! আমি ইগো দেখাই নি। আর না মিশ্মিকে ধোঁকা দিয়েছি। ব্যাপারটা হচ্ছে যখন আমি জেনেছিলাম মিশ্মিই সেই যে আমায় ক্রমাগত ফলো করছে, চিঠি লিখছে, ভালোবাসছে তখন আমি তাকে থামাতে চেয়েছিলাম।’
‘থামান নি কেনো তবে?’
‘মিশ্মির কথা ভেবে।’
‘বুঝলাম না।’
‘মিশ্মির আমার প্রতি এট্রাকশটা আমি মেনে নিতে পারি নি। কোনো স্টুডেন্ট আমাকে ‘শিক্ষক’ এর জায়গায় না ভেবে লাইফ পার্টনার করার চিন্তা করুক সেটা কখনোই আমি চাই নি। তাই যখন মিশ্মির পাগলামো, কনসার্ন দেখেছি আমার রাগ হচ্ছিলো। একবার ভেবেছিলাম মিশ্মির সামনে দাঁড়াই। ওকে জানিয়ে দেই আমি ওকে চিনে ফেলেছি। কিন্তু পারি নি। আমার মনে হচ্ছিলো যে মেয়ে অপরপ্রান্তের মানুষটির ভাবাবেগের কথা না ভেবেই তাকে নিজের করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে সে মেয়ে কিছুতেই সরে যাবে না। বরং আমি সামনে দাঁড়ালে সে নতুন ফন্দি আটবে। হয়তো তার আমার প্রতি আকর্ষন বেড়ে যাবে। তাই এমন ভাব করে চলেছি যেনো সে বুঝে আমি তাকে খুঁজছি না। একারনেই তার লিখা অধিকাংশ চিঠি ছিড়ে ফেলেছি। আমার ধারনা ছিলো মিশ্মি আমার চিঠি পড়ার পরের রিয়েকশনটাও দেখতো। তাই ওকে দেখাতেই চিঠি ছিড়ে ফেলতাম। বিরক্তি দেখাতাম। আফসোস, মিশ্মি থেমে যায় নি।’
‘অথৈকে বিয়ে কেনো করলেন? প্রতিশোধ নিতে? না কি মিশ্মিকে কষ্ট দিতে?’
‘কোনোটাই না। আমি অথৈকে ভালোবেসেছি বলেই বিয়ে করেছি। আমাদের কলেজের ফাংশনে একবার অথৈ এসেছিলো। তখন তাকে দেখে অকারনেই ভালো লেগেছিলো। আমি জানতাম না ও মিশ্মির বোন। পারিবারিক ভাবে যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই তখন অথৈকে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। তখনও মিশ্মি অথৈর সম্পর্ক জানতাম না। এঙ্গেইজমেন্টের রাতে দেখেছিলাম মিশ্মিকে। অথৈর থেকেই জেনেছিলাম ওরা কাজিন। সবটাই কাকতালীয়।’
হিমি টেবিলের দিকে ঝুঁকলো। দুহাত টেবিলের উপর রেখে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো ইয়াসিরের দিকে। ক্ষীণ গলায় বললো,
‘মিশ্মি তো সব মেনে নিয়েছিলো প্রফেসর। আপনাদের বিয়ে, নিজের বিয়ে। সবকিছুই। তাহলে শেষ মুহুর্তে কেনো ওকে জানালেন জেনে বুঝে আপনি তাকে এড়িয়ে গেছেন? তার ভালোবাসার অপমান করেছেন?’
মৃদু হাসলো ইয়াসির। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে রোদের তীব্রতা দেখে নিয়ে বললো,
‘গল্পটা বড়।’
‘বলুন। শুনতেই এসেছি আমি।’
‘আমি যখন ভেবেছিলাম আমার অথৈর বিয়ের পর মিশ্মি সামলে নেবে নিজেকে তখন মিশ্মি তার সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করছিলো। আমার কথা বাদ দিলাম অথৈর সাথেও ঠিক করে কথা বলছিলো না। অথৈ বিষয়টা আমাকে জানায়। আমি বুঝতে পারি মিশ্মির ভেতর কি চলছে। বাধ্য হয়ে আমি ডিসিশন নেই মিশ্মিকে সব জানাবো। ভার্সিটি ক্যান্টিনে ডেকে ওর সাথে কথা বলার সুযোগ চাইছিলাম। মিশ্মি সেই সুযোগটাই দিচ্ছিলো না। হুট করে কিছু বললে ওর রিয়েকশন হয়তো ভয়াবহ হতো। তাই পারফেক্ট সময় খুঁজছিলাম। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো মিশ্মির বর্তমান স্বামী মানে নিহান। আমি তাদের কথোপকথন দেখে বুঝতে পারছিলাম এখানে ইকুয়েশন অন্য। ভেবেছিলাম হয়তো মিশ্মির মাইন্ড ডাইভার্ট হয়েছে। নিহানই করেছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো যখন অথৈ জানালো মিশ্মি আর নিহানের মধ্যে গুরুতর প্রেম চলছিলো। চিঠি আদান প্রদান প্রেম। আসল সত্যিটা আমি জানতাম। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। অপেক্ষায় ছিলাম মিশ্মির মেনে নেয়ার। সেটাও হচ্ছিলো না। না সে নিজেকে সুযোগ দিচ্ছিলো আর না নিহানকে। হলুদের দিন বিকালে যখন আমার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তখন মিশ্মি আমার দিকে তাকাচ্ছিলো না। মৃদু কাঁপছিলো। সব মানতে চেয়েও পারছে না দেখে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে জানিয়ে দেবো আমি আগে থেকেই তার পরিচয় জানতাম। কিন্তু কি করে জানাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম,,,,’
‘নিজেকে মিশুর কাছে নিষ্ঠুর, খারাপ, অনুভুতিশূণ্য প্রমান করার?’
হাসলো ইয়াসির। বললো,
‘এছাড়া আর কোনো ওয়ে তো ছিলো না। ইউ ক্যান্ট ইমাজিন আমি যখন ওভাবে কথাগুলো বলছিলাম মিশ্মি না চেয়েও অবাক হয়েছিলো। রেগে ছিলো। ঘৃণা করছিলো আমাকে। তার ঠিক পর পর স্পষ্ট করে তাকিয়েছে আমার দিকে। সে তাকানোয় সংশয় ছিলো না, অভিমান ছিলো না, চাওয়াও ছিলো না। স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আমাকে হুংকার দিয়ে নিহানের সাথে কথা বলেছিলো। বিয়েতেও কেমন সহজ হয়ে কথা বলছিলো অথৈর সাথে। ইন ফ্যাক্ট রিসেপশনে তো আমার সাথেও কথা বলেছিলো। সহজ, সাবলীল ভাষায়। আমি এটাই চেয়েছিলাম। মিশ্মির সহজ হওয়া আর বাস্তবতা মেনে নেয়া ভীষন প্রয়োজন ছিলো। আমার একটা কথায় ও যে এতোটা এগুবে আমি ভাবি নি। তবে এগিয়েছে। অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে। আমাকে ভুল বুঝেই হোক সুখে থাকার চেষ্টায় আছে। আমি বিশ্বাস করি ও সুখে থাকবে।’
হিমি কপাল কুঁচকালো। বললো,
‘এমনটা না করলেও তো হতো!’
‘হতো না। এখন যদিও মিশ্মি আমার উপর রেগে আমায় অপরাধী ভেবে এগুচ্ছে একটা সময় পর ও ভুলেই যাবে আমার কথা। অথবা আমার এই অন্যায়টার জন্যই খুশি হবে। জীবনে পাওয়া সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসবে। তাকেই ভালোবাসবে।’
‘হয়তো। কিন্তু ওর ধারনা আপনি ওর ভালোবাসার অপমান করেছেন। ভুলটা তো ভাঙানো উচিত।’
বিরোধীতা করলো ইয়াসির। বললো,
‘ভুল ভাঙাতে গেলে তার অপমান করা হবে। লজ্জিত করা হবে তাকে। আমি সেটা চাই না।’
হিমি মাথা দুলালো। কি ভেবে হঠাৎ বলে উঠলো,
‘আচ্ছা, কখনোই কি মিশ্মির প্রতি তেমন অনুভুতি জন্মায় নি?’
‘না। প্রথম থেকেই আমার মনে হতো এসব বাচ্চামো। হাসতাম আমি। পরে যখন মনে হলো ব্যাপারটা সিরিয়াস তখন রাগ লাগতো। তেমন কিছু অনুভব করলে আমি মিশ্মিকে আশা দেখাতাম। দেখাই নি তো! কখনো কখনো কারো জীবন সুন্দর করে সাজাতে হলেও তাকে এড়িয়ে যেতে হয়। রিজেকশন মানে সব সময় এই নয় যে হাস্যরস করা হচ্ছে বা অনুভুতির অপমান করা হচ্ছে। বরং অনুভুতির অপমান না করতেও কখনো কখনো রিজেক্ট করা উচিত। আমিও তাই করেছি। সামনে এলে মিশ্মি কখনোই ছেড়ে দিতো না। তাই নিজেকে দোষী বলে চালিয়ে দিলাম। থাক না ও এই বিশ্বাস নিয়েই। ওরা ভালো থাকলেই হলো।’
হিমি সতেজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
‘মিশুর ভুলটা নাহয় নাই ভাঙালেন কিন্তু অথৈ। ওর ভুলটা ভাঙান। নাহলে আজীবন আপনাকে দোষী ভেবে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে।’
নিঃশব্দে হাসলো ইয়াসির। মাথা চুলকে বললো,
‘অথৈ যদি চিঠিটা হাতে না পেতো তবে জানাতাম না। আমি চাই না ওদের দু বোনের মধ্যে মতভেদ হোক। ওরা একে অপরের দৃষ্টি এড়াক তাও চাই না। কিন্তু কদিন ধরে অথৈ তো আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। না বলে হচ্ছে না।’
ঠোঁট চওড়া করে হিমি বললো,
‘বলে দিন। ও বুঝবে। আশা করছি মিশু অথৈ দুজনেই এই ব্যাপারটা ভুলে যাবে। সংসার গুছিয়ে নিজেদেরও সামলে নেবে।’
‘তাই হোক।’
______________________
হাসপাতাল থেকে ফিরতেই হিমি তাহিরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তাহির ডাক্তারি ব্যাগ টেবিলে রেখে টাই খোলায় মনোযোগ দিলো। হিমি খাটের এক পাশে দাঁড়িয়ে আয়নায় তাহিরের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। তাহির আয়নায় তাকিয়ে থেকেই ভ্রু নাচালো। হিমি মুখ কালো করে বললো,
‘আমার একটা জিনিস চাই। দেবেন?’
তাহির পেছন ফিরলো। টাই টা নামিয়ে রেখে বললো,
‘বিকেলে ফোন দিয়েছিলাম তো। তখন বলেন নি কেনো কিছু লাগবে? নিয়ে আসতাম। এখন তো যাওয়া সম্ভব না। কাল বলবেন নিয়ে আসবো।’
হিমি বিরক্ত দেখিয়ে এগিয়ে এলো। তাহিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
‘কিনে আনার জিনিস না কি যে আপনি নিয়ে আসবেন?’
‘কেনার জিনিস নয়?
‘না।’
‘তবে? কি চাই বলুন!’
হিমি ঢোক গিললো। লাজুক মুখ নত করে আমতা আমতা করে বললো,
‘বাচ্চা।’
‘কার বাচ্চা?’
হিমি মুখ তোলে তাকালো। তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
‘আমাদের বাচ্চা।’
তাহিরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কৌতুহল দমন করতে না পেরে বললো,
‘বাচ্চা দিয়ে কি হবে?’
‘কি হবে আবার কি? বাচ্চা চাই এটা বললাম।’
রেগে গেলো হিমি। তাহির ভ্রু কুঁচকে রেখে বললো,
‘কেনো?’
‘আশ্চর্য! বিয়ে হয়েছে বাচ্চা হবে না?’
‘আপনি শিওর হয়ে বলছেন?’
‘হ্যা। পুরোপুরি শিওর হয়ে বলছি। আমার বাচ্চা চাই।’
তাহির মিটিমিটি হাসলো। কোমরে হাত রেখে বললো,
‘আর ইউ শিওর এবাউট ইট?’
মাথা দুলিয়ে সায় জানালো হিমি। তাহির ধীর পায়ে এগুলো হিমির দিকে। হিমি সরু চোখে তাহিরের গতিবিধি লক্ষ করে পিছুতে লাগলো। তাহির এক বাত বাড়িয়ে হিমির বাহু ধরে কাছাকাছি দাঁড় করালো। মৃদু হেসে বললো,
‘প্রসেস টা জানো তো?’
বিষম খেলো হিমি। তাহির তাতে পাত্তা না দিয়ে হিমির মুখের কাছে মুখ আনলো। স্লো ভয়েজে বললো,
‘ভয় করছে?’
হিমি ডানে বায়ে মাথা নেড়ে মাথা পিছুতে নিলো। তাহির হিমির দুগালে হাত রেখে মাথাটা সোজা করে রাখলো। হিমি কাঁপতে লাগলো। নিঃশ্বাস তুমুল গতিতে উঠানামা করছে। তাহিরের মুখটা আরো একটু কাছে আসতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে দিলো হিমি। তাহির ফিক করে হেসে ফেললো। হিমিকে ছেড়ে দিয়ে আলমারি থেকে কাপড় বের করলো। ঠেস মারা গলায় বললো,
‘চুমু খেতে ভয় পায় আবার বাচ্চা চাই ওনার!’
চলবে,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬২.
পুরো পরিবার সমেত সোহিনীর বাড়ি গিয়ে উঠেছে মেঘ। তখন সবে গালে হলুদের প্রস্তুতি চলছে। হুট করে অচেনা মানুষদের দেখে মনে কৌতুহল জাগে গ্রামের মানুষদের। সোহিনী এগিয়ে এসে মেঘের পরিচয় জানায় সবাইকে। এও বলে যে সে মেঘকেই বিয়ে করবে। গ্রামে হুলুস্থুল পরে যায়। ‘সোহিনী শহর থেকে ছেলে আনিয়েছে’ কথাটা যেনো বাতাসের ন্যায় ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। যাদের বিয়েতে আসার কথা ছিলো না তারাও এসে উপস্থিত হয়। সোহিনীর বাবা মা পরেছেন ব্যাপক অস্বস্তিতে। গ্রামের যে ছেলের সাথে সোহিনীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে দলবল নিয়ে আসছে শুনেই কাঁপাকাঁপি শুরু হয় সোহিনীর বাড়ির সকলের। তবে মেঘ তাদের আশ্বস্ত করে। বেশ অনেকক্ষন সময় নিয়ে সোহিনীর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে বুঝাতে সক্ষম হয় সোহিনীর সাথে তার বিয়ে হওয়াটাই উচিত। অতঃপর মেঘের বাবা মাও গ্রামের পঞ্চায়েতে অংশ নেন। কথা বার্তা, আলাপ আলোচনা সিদ্ধান্ত এটাই দাঁড়ায় যে বিয়ে হবে আজ রাতে। সন্ধ্যের আগে আগে হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হতে হবে। ততক্ষনে বর রেগে আগুন। সে কিছুতেই পিছপা হচ্ছে না। গুরুজনরা প্রচুর বুঝিয়ে শেষে কাজ না হওয়ায় পঞ্চায়েত থেকে নির্দেশ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের। এর মধ্যেই অবশ্য নতুন কনের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর আজ রাতেই তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। সোহিনী স্বস্তি পেলো। সোহিনীর বাবা মাও আশ্বস্ত। তাদের পছন্দ করা ছেলের থেকে মেঘ হাজারগুণ ভালো ভেবেই বুক থেকে বোঝা নামলো তাদের।
শুরু হলো হলুদের তোড়জোড়। মেঘের পুরো পরিবার সোহিনীর গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে থাকবে বিয়ে অব্দি। বিয়ে শেষে কনে নিয়ে সোজা শহরে চলে যাবে। এতে কারো কোনো আপত্তি নেই। তাড়াহুড়ার মধ্যে হলুদের গোসল দেয়া হলো। মেঘ সময়ই পেলো না বন্ধুদের খবর দেয়ার। অথচ সন্ধ্যে হতে না হতেই দেখা পাওয়া গেলো সবার। পায়ে কাদা মাখামাখি করে চেয়ারম্যানের বাড়িতে উঠলো সূর্য। তার ঠিক পরেই দোহা আমিনের সাথে এসে উপস্থিত হলো। সোহিনী ফোন দিয়ে জানালো হিমি তাহির কনের বাড়ি পৌঁছে গেছে। বাকি ছিলো ইমন। ইমনের নাম্বার শুধু সূর্যের কাছে থাকায় সে জানিয়ে দিয়েছিলো মেঘ সোহিনীর বিয়ের কথা। চাঁদপুর থেকে ওই রাতেই সোহিনীর গ্রামে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো না তার কাছে। ইচ্ছা সত্ত্বেও তাই আসে নি সে। তবে ফোনে খোঁজখবর নিয়েছে, বিয়ের শুভেচ্ছাও জানিয়েছে।
বন্ধুমহলের খুশি বাঁধনহারা। দুই বন্ধুর একে অপরের সাথে বিয়ে হওয়ার পর যেনো তাদের বন্ধুত্ব নতুন রুপ নিলো। ক্যাম্পাসে মেঘকে সোহিনীর বর, আর সোহিনীকে মেঘের বউ বলেই সম্বোধন করা শুরু হলো। পরীক্ষা ঝড়ের গতিতে কাছে আসছে তাদের। ইমন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। চাঁদপুর থেকে ফিরেছে সপ্তাহ দুই আগে। সুপ্তি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বাধ্য হয়েই তার পরিবার মেনে নিয়েছে বিয়েটা। যদিও উঠতে বসতে খোটার শেষ নেই! তবুও তারা ভালো আছে। ছোটখাটো একটা চাকরি পেয়েছে ইমন। আপাতত সেটাই করছে। বউ নিয়ে চলার মতো খরচ নিয়েই দিন কাটছে। এখানে আসার পর বন্ধুত্বে দূরত্ব কেটেছে। যখন তখন আড্ডা দিতে না পারলেও রাতে কাজ শেষে ঠিকই চায়ের দোকানে দেখা মিলছে তিন বন্ধুর। কখনো সেই আড্ডায় যোগ হচ্ছে সোহিনী। দোহা কলেজে ক্লাস করতে আসা ছাড়া আর কোথাও যাচ্ছে না। কলেজ ক্যান্টিনেই বন্ধুদের সাথে ফ্রী টাইমে আড্ডা দেয় সে। হিমি এখন প্রায় রোজই চলে আসে তাদের সাথে দেখা করতে। আধঘন্টা মতো বসে চা খাওয়ার ফাঁকে জম্পেশ গল্প করে। অতীতে হাতড়ে বেরায়।
সবকিছুই ঠিক ছিলো। এরমধ্যেই একদিন পাতলা গড়নের উনিশ বিশ বছর বয়সী এক মেয়ে এসে দাঁড়ায় তাহিরের বাড়ির দরজায়। তাহির সেদিন ডিউটির চাপে অস্থির। নাইট ডিউটি শেষ করে ভোরে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই ছুটেছে হাসপাতালে। হাসপাতালে এমার্জেন্সি হলে এমনটাই হয়, বলা নেই কওয়া নেই যেকোনো সময় ছুট লাগাতে হয়। তাহিরও তাই করে। এদিকে মেয়েটি এসেই খোঁজ করে তাহিরের। মায়মুনা দীর্ঘক্ষণ মেয়েটিকে দেখে বুঝতে পারলেন তিনি মেয়েটিকে এর আগে কখনো দেখেন নি। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগছে। মেয়েটির চেহারা ওনার চেনা পরিচিত কারো সাথে মিলে যাচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে সেই চেনা পরিচিত মানুষটা কে তা খুঁজতে গিয়ে। মেয়েটিকে দেখে অত্যন্ত ভয়ার্ত মনে হচ্ছিলো মায়মুনার। জিজ্ঞেস করেন কে সে? তাহিরের সাথে কি দরকার? প্যাশেন্ট কি না? বাড়িতেই কেনো এলো? তাহিরের চেম্বারে কেনো গেলো না হেন তেন। মেয়েটি একটা কথারও জবাব দিলো না। শুধু বললো,
‘ওনাকে ডেকে দিন না। উনি আমায় চেনেন।’
মায়মুনা হাল ছাড়লেন। তাকে ঘরে বসতে দিয়ে ফোন লাগান তাহিরকে। বললেন কোনো এক মেয়ে তাকে খুঁজছে। নাম, ধাম কিচ্ছু বলছেনা। তাহির হয়তো বুঝে গেলো কে হতে পারে। তাই কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে বললো,
‘আমি আসছি। ওকে অপেক্ষা করতে বলো।’
মায়মুনা জামান চমকালেন। কি হলো ব্যাপারটা? তাহির একবারও জানতে চাইলো না কেনো কে এই মেয়ে? তাহিরের সাথে কি পরিচয় তার? ভাবনাগুলো থামছে না তার। মেয়েটিকে যে আরো কিছু প্রশ্ন করবেন তারও উপায় নেই। ভয়ে বা লজ্জায় জড়সড় হয়ে আছে সে। মায়মুনা জামান লেবুর শরবত দিলেন। সে খেলো না। চুপটি করে মাথা নুইয়ে বসে রইলো। প্রায় মিনিট পঁচিশ এভাবে বসে থেকে বললো,
‘ওয়াশরুম ইউজ করতে পারি?’
মায়মুনা সায় জানালেন। ফুলকে ডেকে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বললেন। হৃদি তুমুল কৌতুহল নিয়ে বললো,
‘ফুপি, এ কে গো? ভাইয়ার বান্ধবী?’
বিরক্ত চোখে তাকালেন মায়মুনা। বললেন,
‘দেখে মনে হয় এই মেয়ে তাহিরের বান্ধবী? বেশি হলে মেয়েটায় বয়স উনিশ হবে। আর তাহির ত্রিশ। এগারো বছরের পার্থক্য।’
হৃদি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হঠাৎ বললো,
‘ভাবির বান্ধবী?’
‘তাও তো মনে হচ্ছে না। আর মেয়ে তো হিমির নাম একবারও উচ্চারণ করলো না। এসে থেকেই ‘তাহির ভাই, তাহির ভাই’ করছে।’
হৃদি সন্দিহান গলায় বললো,
‘ভাইয়ার বোন! মানে কোনোভাবে ভাইয়ার বাবার বাড়ির সম্পর্কের আত্মীয় নয় তো?’
ধাতস্থ হলেন মায়মুনা। হতে পারে। ও বাড়ির সাথে মায়মুনার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তাহিরের ছিলো। মাঝে মাঝেই তাহিরকে তাদের সাথে ফোনে কথা বলতে শুনেছেন মায়মুনা। আটকান নি। তিনি চান নি তাহির তার দাদা দাদু, বা জ্যাঠাদের সাথে সম্পর্ক চ্যুত করে। মনে মনে ভাবলেন এই মেয়েটি কার মেয়ে হতে পারে। ক্যালকুলেট করে যা পেলেন তা হলো তাহিরের এক কাকুর তখন সদ্য বিয়ে হয়েছিলো। এই মেয়েটি নিশ্চয় ওনার? তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন। মেয়েটি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আবারও বললো,
‘তাহির ভাই আসেন নি?’
মায়মুনা মাথা নাড়লেন। বললেন,
‘চলে আসবে। বসো।’
মেয়েটি বসলো। মায়মুনা মেয়েটি পর্যবেক্ষন করে বললেন,
‘তোমার বাবার নাম জামাল?’
মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবেই মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। মায়মুনা মনে করে করে আরো কয়েকজনের নাম বললেন। প্রত্যেক বারই মেয়েটি না জানালো। ক্লান্ত বোধ করলেন মায়মুনা। সদর দরজা খোলা দেখে হিমির কিছুটা কৌতুহল জাগলো। ঘরের ভেতর উঁকি ঝুকি মেরে তবেই ঢুকলো সে। মায়মুনা হিমিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে বললেন,
‘সময়ের খোঁজ রাখা লাগে না? কখন বেরিয়েছিলে আর কখন ফিরেছো? লাঞ্চ করে এসেছো না কি করো নি?’
হিমি জবাব দিলো না। তার দৃষ্টি তখন সোফায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটিও লক্ষ করলো হিমিকে। হিমি মায়মুনাকে পাশ কাটিয়ে মেয়েটির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। শুকনো হেসে বললো,
‘তুমি? কেমন আছো?’
মেয়েটি হাসলো। হাসি মুখে বললো,
‘ভালো আছি ভাবি।’
‘কখন এলে?’
‘একটু আগেই।’
মায়মুনা চমকালেন। হৃদি মুখ হা করে হিমি আর মেয়েটির কথোপকথন শুনলো। তারপর উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘ভাবি? তুমি চেনো একে?’
হিমি জবাবে বললো,
‘হ্যা চিনি। বাচ্চা ডাক্তার পরিচয় করিয়েছিলেন।’
মায়মুনা হটকারিতা করে বললেন,
‘পরিচয় করিয়েছিলো কেনো? কি সম্পর্ক ওর সাথে? আমায় তো কখনো বলে নি ওর কথা।’
হিমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সরে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বললো,
‘আপনাকে বলতেই বোধ হয় আজ ও এখানে এসেছে।’
‘তাহির তোমায় আসতে বলেছিলো?’
মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। ভয়ার্ত গলায় বললো,
‘না। আমি নিজে থেকেই এসেছি। তাহির ভাই বলেছিলেন এসে ওনার খোঁজ করলেই হবে।’
মায়মুনা মেয়েটির কথার আগামাথা বুঝলেন না। তিক্ত গলায় বললেন,
‘এই মেয়ে? কি নাম তোমার? ঝটপট সত্যি বলো। নাহলে এক মুহুর্তও এখানে থাকা যাবে না। বলো কি নাম?’
‘ওর নাম মৃত্তিকা।’
মেয়েটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হিমি বলে দিলো। মায়মুনা অবাক হলেন। মৃত্তিকা। নামটা শুনা শুনা লাগছে। কোথায় শুনেছেন ভাবতে গিয়েই মনে পরলো। তিনি সেটা মানতে পারছেন না। মনে প্রাণে চাইছেন যেনো ওনার ভাবনা ভুল হয়। যেনো এই মৃত্তিকা সেই মৃত্তিকা না হয়। বিধিবাম। তাহির আসতেই খোলসা হয়ে গেলো পুরো বিষয়। তাহির শীতল গলায় জানালো মায়মুনা যা ভাবছেন একদম ঠিক ভাবছেন। এই মৃত্তিকাই মিতার মেয়ে। তৌসিফ মাহমুদ আর মিতার মেয়ে। মায়মুনার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরলো। তাহির এই মেয়েটিকে কবে থেকে চেনে? কি করে পরিচয় হলো? এই মেয়ে এ বাড়ি কেনো এসেছে? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় গোলমাল পাকাচ্ছে। অথচ ওনার গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। শান্ত চোখে তাহিরকে দেখে তিনি নিজের শোবার ঘরে চলে গেলেন। দরজা ভেজিয়ে রেখে রুম অন্ধকার করে খাটে শুয়ে পরলেন।
চলবে,,,,,,,,,,,