হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫০.
শ্বশুরবাড়িতে আসার পর থেকেই তাহিরের জবাবদিহি চলছে। আর সেই জবাবদিহি করছেন জনাব মতিউর রহমান। সোফায় আয়েস করে বসে তাহিরের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে মতিউর রহমান বলে উঠেন,
‘আমার নাতনিকে কবে থেকে চেনো?’
‘কয়েক মাস হয়েছে হয়তো।’
‘তোমাদের মধ্যে ওসব সম্পর্ক হলো কি করে?’
তাহির ভ্রু কুঁচকালো। কৌতুহলী গলায় বললো,
‘কোন সম্পর্ক?’
‘ওইযে, প্রেমের সম্পর্ক!’
‘আমাদের মধ্যে এধরনের সম্পর্ক ছিলো না দাদু।’
‘ছিলো না?’
‘জি না।’
‘তাহলে বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো?’
‘মায়ের কথা ভেবে। তখন বিয়ে না করে ফিরে গেলে মা কষ্ট পেতেন, অপমানিত হতেন তাই।’
মতিউর রহমান ভ্রু উচিয়ে পরখ করলেন তাহিরকে। স্মিত গলায় বললেন,
‘মাকে ভালোবাসো?’
‘বাসি।’
‘মায়ের কথাতেই উঠবস করো নিশ্চয়?’
তাহির নিঃশব্দে হেসে উত্তর দিলো,
‘তা করি।’
মতিউর রহমান মাথা দুলালেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘তুমি কি করো?’
‘আমি একজন ডাক্তার।’
‘কিসের ডাক্তার?’
‘সাইকিয়াট্রিস্ট। চাইল্ড স্পেশালিস্ট।’
‘আমি অতো ইংরেজি বুঝি না। বাংলায় বলো।’
‘মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।’
মতিউর রহমান বাঁকা চোখে তাকালেন। বললেন,
‘মানুষের মন বুঝার ক্ষমতা আছে?’
‘আমার তো তাই মনে হয়।’
‘বলো দেখি আমার মনে কি চলছে?’
কথাটা বলে কিছুটা ঝুঁকলেন তিনি। তাহির মৃদু হেসে মতিউর রহমানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। কয়েক সেকেন্ড মতিউর রহমানের চেহারায় চোখ বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
‘আপনার মনে এখন বিশেষ কিছু চলছে না। একটু আগে অব্দি আমাকে নাতজামাই হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি তাই খানিক লজ্জা পাচ্ছেন।’
‘আমি লজ্জা পাচ্ছি? কেনো?’
‘জি পাচ্ছেন। কারনটা খুব সহজ। আমাকে আপনার মনে ধরেছে। আমার জন্য আপনি গর্ববোধ করছেন। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন নি আপনার নাতনির জীবনে এমন কেউ আসবে। এসেছে তাই খুশি খুশি লাগছে। প্রথমে রেগে ছিলেন বলেই এখন লজ্জা পাচ্ছেন।’
মতিউর রহমান মেরুদন্ড সোজা করে বসলেন। ডাট বজায় রেখে বললেন,
‘মিথ্যে কথা। আমি এখনো তোমায় নাতজামাই হিসেবে মেনে নেই নি। রেগে আছি।’
তাহির ফিসফিস করে বললো,
‘নিজের ডাট বজায় রাখতে একথা আপনি বলতেই পারেন। তবে সত্যিটা হলো আপনি আমায় মেনে নিয়েছেন। আপনি রাগ করতে চেয়েও রাগ করতে পারছেন না। খুশি খুশি অনুভব করছেন। অযথা রেগে যাওয়ায় এখন আফসোস করছেন। সেই সাথে আমাকে নিয়ে ভাবছেন। ঠিক বলি নি?’
‘না। ভুল বলছো। তুমি আসলে মানুষের মন বুঝো না। সব ভুয়া। নিশ্চয় ছোটবেলায় পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়েছো। পরীক্ষাতেও নকল করছ পাশ করেছো বোধ হয়। নয়তো এখন আমার মন বুঝতে পারতে। তোমার মা শুধু শুধু এতো টাকা খরচা করে তোমায় লেখাপড়া করালেন। কাজের কাজ হলো না, উল্টো বিগড়ে গেলে।’
তাহির ঠোঁট টিপে হাসি আটকালো। ভদ্রলোক যে ব্যাপক লজ্জা পেয়ে বিপাকে পরেছেন এবং তিনি সেসব বুঝতে দিতে চাচ্ছেন না সেটা তাহির বুঝতে পেরেছে। আর পেরেছে বলেই কথা বাড়ালো না সে। চুপ করে রইলো। দেখলো এই বৃদ্ধ ডাটিয়াল লোক কি করে একের পর এক গম্ভীর কথা বলে তাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করছেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। বসার ঘরে টেলিভিশনে খবরের চ্যানেল চলছে। কেউ দেখছে না যদিও। তবুও চলছে। জার্নালিস্ট দেশের খবর পড়া শেষ করে আন্তর্জাতিক সংবাদ পড়ছেন। তাহির মনোযোগী শ্রোতার মতো টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। টি টেবিলের উপর ফল, সন্দেস, চা, শরবত সহ আরো কিছু নাশতা জমা করেছেন আমিনা বেগম। তাহির বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
‘করেছেন কি? আমি আর কিছু খেতে পারবো না।’
আমিনা বেগম দ্বিগুন বিস্ময় নিয়ে বললেন,
‘পারবে না কেনো? কিছুই তো খাও নি বাবা! দুপুরেও ঠিক করে খেলে না বিকেলেও নাশতা করলে না এখনো খাবে না বলছো যে? শরীর খারাপ করছে?’
‘খাই নি বলছেন? আপনি যে জোর করে খাওয়ালেন! মাছের মাথা, মুরগী ভুনা, সবজি আরো কতো কি তো খেলাম! পেটে আর কতো জায়গা হবে?’
‘হতে হবে। এই বয়সে না খেলে আর খাবে কখন? এই যে আমায় দেখো। তোমার বয়সে খেতে চাইতাম না। এখন চাই। তবে পাই না। এতো বছর বিদেশে থেকেও শান্তি পাই নি। নিজে নিজে রেঁধে খেয়েছি। ভালো কিছু রাঁধতে পারতাম না বলে বিদেশীদের খাবার খেতে হয়েছে। দেশে ফিরে ভাবলাম পেট পুরে খাবো। কিন্তু এই মহিলা আমাকে ঠিকঠাক খেতে দেয় না। একবেলা চা দিলে আরেক বেলা দিবে না। দিলেও চিনি দিবে না। বিস্কুট দিবে না। তুমি যখন আমার বয়সে আসবে তখন পস্তাবে। তোমার বউ তো আবার রান্না বান্না জানে না। ভবিষ্যতে উপোস থাকতেও হতে পারে।’
মোজাম্মেল সাহেবের কথায় হেসে উঠলো তাহির। আমিনা বেগম মুখ ঝামটিয়ে তাহিরের দিকে সন্দেসের প্লেইট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ঠান্ডা হয়ে যাবে। খাও। চা শরবত দুটোই দিয়েছি যা ইচ্ছা খেতে পারো।’
মোজাম্মেল সাহেব সন্দিহান গলায় বললেন,
‘আর আমার নাশতা কোথায়?’
‘তোমার আবার কি নাশতা? ওসব মিষ্টি সন্দেস খেতে হবে না তোমায়। দাঁড়াও চা আনছি।’
রান্নাঘরে চলে গেলেন আমিনা। মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘বোরিং লাগছে না তো!’
তাহির মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে নাশতার প্লেইট নিচে নামিয়ে রাখলো। চায়ের কাপ হাতে উঠিয়ে চুমুক বসালো তাতে। চায়ের স্বাদ দারুণ হয়েছে। তাহির তৃপ্তি করে চা খেলো। আমিনা বেগম আরো এক কাপ চা এনে মোজাম্মেল সাহেবকে দিলেন। কিছুক্ষের মধ্যে বাড়ির বাকি সদস্যরাও এসে উপস্থিত হলেন বসার ঘরে। রমরমা পরিবেশ। তাহিরের এমন একটা পরিবার নেই বলে আফসোস হলো। অবাকও হলো সেই সাথে। হিমির এরকম দুটো পরিবার থাকার পরও সে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে না। সুখ অনুভব করে না। আর তাহির এরকম একটা পরিবারের আশায় কাতরায়!
এখানে আসার পর থেকে তাহির এক মুহুর্তের জন্যও একা থাকে নি। কেউ না কেউ ঠিক তার সাথে কথা বলতে, গল্প করতে চলে এসেছে। আমিনা বেগম তো রান্নাঘর থেকে শুধু বেরিয়েছেন তাহিরকে খাবার দিবেন বলে। অন্যথায় সারাটাদিন নতুন জামাইয়ের জন্য একের পর এক নাশতা, খাবারের পদ তৈরি করছেন। এতসবের মধ্যে রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া হিমির দেখা পায়নি তাহির। অজানা কারনে বাপের আসার পর পরই মুখ গোমরা করে রেখেছে হিমি। ঘরের বাইরে বেরুচ্ছে না। সন্ধ্যার দিকে একবার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেতে চেয়েছিলো। দাদু যেতে দেন নি বলে যাওয়া হয় নি তার। আবারও সেই ঘরে ঢোকে বসে আছে। বড়মা, জ্যাঠুমনি, নিহান কারো সাথেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না তাকে। কথা বলছেও না। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। নয়তো প্রিয় মানুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মানুষ নয় হিমি।
শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে কপালের উপর বাম হাত রেখে কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন ছিলো তাহির। হিমি ডেকে উঠলো তাহিরকে। কপাল থেকে হাত সরিয়ে সচেতন চোখে তাকালো তাহির। হিমি বাথরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে হলদে রঙের কুর্তি পরনে কালো জিন্স। দু হাতে দুটো চুড়ি, কানে সেই পুরনো ইমিটেশনের পাথরের দুলের বদলে সোনার ছোট্ট ঝুমকো। তাহির বিস্ময় নিয়ে উঠে বসলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
‘কিছু বলবেন?’
‘আপনি দেখছেন না কিছু?’
‘দেখছি। আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে গেছেন।’
‘কি?’
রাগান্বিত কৌতুহলী গলায় বললো হিমি। তাহির চট করে উঠে দাঁড়ালো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘আই মিন ছেলেদের পোষাক ছেড়ে মেয়েলী পোষাক পরেছেন। কিন্তু কেনো পরেছেন?’
হিমি এগিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কুর্তির ভাজ ঠিক ঠাক করতে করতে বললো,
‘আপনার মায়ের জন্য।’
‘আমার মায়ের জন্য মানে?’
‘আপনার মা কল করেছিলেন। বড়মাকে আমার নামে নালিশ করেছেন। মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো আচার আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ থাকায় ওনার বিরক্ত লাগে। সম্মানে লাগে। কথাগুলো আবার বড়মার সম্মানে লেগেছে। জোর জবরদস্তি করে এসব পরিয়েছেন আমাকে। শাড়ি ফাড়ি পরতে পারবো না। এতে আপনার মায়ের সমস্যা হবে না তো?’
‘আমি কি করে বলবো?’
‘কেনো? আপনি তো আপনার মাকে খুব ভালো করে চেনেন, জানেন, বুঝেন। আপনার মা আমাকে এই পোষাকে দেখলে কি বলবেন না বলবেন সেটা তো আপনার জানার কথা।’
‘হয়তো। কিন্তু বলতে পারছি না। আমি সত্যিই জানি না মা কি বলবেন। তবে এটুকু বলতে পারি মা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।’
হিমি গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘কিছুটা! তাতেই হবে। এর থেকে বেশি স্বস্তি আমি আর কাউকে দিতে পারবো না।’
তাহির মৃদু হাসলো। আয়নায় হিমির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপনাকে এই পোষাকে মানিয়েছে ভালো।’
‘অথচ আমার মনে হচ্ছে এই পোষাকে আমাকে জঘন্য লাগছে। এর পরিবর্তে যদি ঢোলা ঢালা টি শার্ট বা শার্ট পরতে পারতাম তবে আরাম পেতাম। শান্তি পেতাম।’
তাহিরের সহজ জবাব,
‘তবে তাই পরুন। এখন তো ঘুমানোর সময়। নিজের ঘরে আছেন। যা ইচ্ছা পরতে পারেন। বাইরে গেলে বিশেষ করে তখন নাহয় এসব পরবেন!’
হিমি মাথা নেড়ে ঘুরে দাঁড়ালো। ঝুটি করে রাখা চুল খোলে দিয়ে বললো,
‘বড়মার আদেশ এট লিস্ট আগামী একমাস এই ধরনের পোষাক পরতে হবে আমায়। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা। ঘুমানোর সময়ও। নাহলে না কি আমার অভ্যাস হবে না। বাড়ির বউ যাচ্ছে তাই অবস্থায় চলাফেরা করলে শাশুড়ি মায়ের হৃদয়ে আঘাত লাগতে পারে। স্বামীরও রাগ লাগতে পারে। আমি নতুন বউ, তাই নতুন বউয়ের মতো বিহেইভ করতে হবে। হবেই হবে। বড়মার কথা কখনোই ফেলি না বলে আজও পারছি না। অসহনীয় জ্বালাতন।’
চলবে,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫১.
ক্লাস শেষে মাঠের কোনায় গিয়ে বসলো ইমন আর সূর্য। চোখে মুখে ক্লান্তি। বন্ধুমহলের বাকিরা বিশেষ কিছু কাজে আটকে পরে ক্লাস করতে আসে নি। দেখাও হয় নি তাই। সূর্য গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে কপাল কুঁচকালো। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকালো। ইমন ঘাড় কাত করে বললো,
‘রেগে থেকে আদৌ লাভ আছে?’
‘আমি রাগি নাই।’
‘তোকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে ব্যাপক রেগে আছিস। দেখ সূর্য, হিমি তো ইচ্ছে করে কিছু করে নি। হুট করে হয়েছে সব। নাহলে অবশ্যই আমাদের জানাতো। বিয়েতে ওর জ্যাঠু ছাড়া পরিবারের আর একজন সদস্যও ছিলো না। ভাব একবার, কিভাবে হয়েছে বিয়ে!’
সূর্য বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
‘আমি ভাবতে পারুম না। আর ভাইবাই বা কি হইবো? যা হওয়ার তো হইছেই!’
‘সেটাই তো বলছি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তো আর সেটা চেঞ্জ হবে না। রেগে না থেকে কথা বল ওর সাথে।’
‘আমার এতো ঠেকা পরে নাই। তোর মন চাইলে তুই কথা ক। আমারে জোর করবি না।’
‘তুই এক্সেক্টলি কোন বিষয় নিয়ে আপসেট একটু বলবি?’
‘ধুর বাল। আমি আপসেট না। কতবার কমু শালা। একে তো হারামী বেঈমানী করছে আর এখন তুই আরেক প্যাচাল নিয়া আছোত।’
ইমন কৌতুহলী গলায় বললো,
‘কে বেঈমানী করলো?’
‘কেন? তোগো হিমি!’
‘হিমি এখন আমাদের হয়ে গেলো? তোর কিছু না?’
‘কথা ঘুরাবি না। শালা বলে কি না জীবনে বিয়া করবো না। প্রেম তো দূরের কথা। বিশ্বাসঘাতক। ওই ডাক্তারের লগে ঘন ঘন যোগাযোগ দেইখাই আমি বুঝছি কিছু একটা চলতাছে। নাইলে বিয়া করতে কইলো আর ধেই ধেই কইরা হিমি বিয়া করবো? অসম্ভব। তোরা বিশ্বাস করলেও আমি করি না মামা। আগে থাইকাই ওই ডাক্তারের লগে সম্পর্ক আছিলো। হারামীটারে একবার পাই খালি, দেখিস কি করি। না একটা কল, না মেসেজ। বেদ্দপ মাইয়া বিয়ার দুইদিন পর জানাইতাছে বিয়া কইরা জামাইয়ের ঘরে আছে। মনডায় চায় খুন কইরা দেই!’
সূর্যের কথার বিপরীতে হাসলো ইমন। সূর্যের উরুর উপর হাত রেখে শান্ত হতে বলে বললো,
‘সব কথার একটা নেগেটিভ দিক তুই বের করেই ছাড়বি? আজব! হিমি এমন না সূর্য। সেটা তুইও খুব ভালো করে জানিস। পরিস্থিতিই এমন ছিলো যে জানাতে পারে নি। সময় সূযোগ পেয়ে তবেই না জানালো। আর তুই জেদ ধরেছিস কথা বলবি না ওর সাথে? শালা এতো জেদ কিসের তোর?’
সূর্য জবাব দিলো না। মেজাজ তিরিক্ষি তার। কলেজ লাইফ থেকে বেস্টফ্রেন্ড বলে দাবি করা এক একটা বন্ধু অনায়াসে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে কথা বলছে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এসব তো মানা যায় না কিছুতেই! ইমন আর কথা বাড়ালো না। পড়া নিয়ে টুকটাক আলোচনা করে নিজের পথ ধরলো। তার বড়খালা হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পরেছেন। ওনার সাথে ইমনের আরো একটা সম্পর্ক আছে। বড়খালা ইমনের হবু শাশুরি। সুপ্তির মা। মেয়েটা অতিরিক্ত ভেঙে পরেছে। সময় অসময়ে ইমনকে ফোন করে কাঁদছে। অযথাই ভয় পাচ্ছে। ইমনের এখন সুপ্তিকে আর তার পরিবারকে সময় দেয়া উচিত। তাদের পাশে থাকা উচিত। ভবিষ্যত জামাই বলে কথা। সূর্যের রেগে যাওয়ার বিষয়েও জানে ইমন। হিমির বিয়ের ব্যাপারটা জানার পর থেকে বাকি বন্ধুরা যেমন বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তেমনি সূর্য রেগে আগুন হয়ে আছে। তার ধারনা হিমি ডাক্তারের সাথে আগে থেকেই প্রেম করতো। এই প্রেমটাই বিয়ে অব্দি গড়িয়েছে। কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারনে বন্ধুদের থেকে কথাগুলো লুকিয়েছে হিমি। অদ্ভুত, কল্পনাতীত কিছু ভাবনা নিয়েই মাঠের কোনায় বসে আছে সূর্য।
……………………………
হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে সোহিনী। রাতের রান্না বসিয়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালো সে। বেতের সোফায় বসে আছে মেঘ। তার দৃষ্টি ম্যাগাজিনে স্থির। ম্যাগাজিনটা পুরনো। সোহিনী ছোট্ট টেবিলটার মাঝখানে সুন্দরের জন্য সাজিয়ে রেখেছিলো। মেঘ এখন সেটাই পড়ছে। ইতিমধ্যে একবার পড়া শেষ করেছে যদিও তবুও পড়ছে। আসলে অবসর সময় পার করছে।
বিকেলের দিকে ইমনের থেকে সোহিনীর ঠিকানা যোগার করে এখানে এসেছে মেঘ। সোহিনীর সাথে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা বলার তাগিদেই এসেছিলো। কিন্তু আসার পর বিশ্রী ভাবে অপমানিত হয়েছে সে। সেই সাথে সোহিনীকেও অপমানিত হতে হয়েছে। প্রতিবেশীরা বাড়ির মালিককে আগেই খবর দিয়েছিলো বোধ হয়। নাহলে মেঘ সোহিনীর ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তিনি কোত্থেকে উদয় হলেন? সবার কথার তীরে বিচলিত হয়ে পরছিলো মেঘ। ভেবেছিলো সোহিনী কেঁদে ভাসাবে। রাগ করবে। ব্যাগপত্র নিয়ে অন্যত্র পারি দেবে। নয়তো মেঘকেই তাড়িয়ে দেবে। অথচ সেসব কিছুই করে নি সোহিনী। অতি সাধারন ভাবে মিথ্যে কথা বলে দিলো। সবার সামনে গলা উঁচিয়ে বলে দিলো,
‘মেঘ আমার স্বামী। আমাদের বিয়ে হয়েছে কয়েক মাস হয়েছে। ওর কাজের জায়গা দূরে হওয়ায় আমার সাথে দেখা করতে পারে না। আগামীকালের ছুটি নিয়ে তবেই এসেছে দেখা করতে। আমাদের বিয়ের ছবি, কাবিন নামা, রেজিস্ট্রি পেপার দেখবেন?’
থতমত খেয়ে গেছিলেন সবাই। হয়তো কেউ প্রমান চাইতো কিন্তু তার আগেই বাড়ির মালিক থামিয়ে দিলেন। সোহিনীর পক্ষ টেনে বললেন,
‘এই মেয়ে সত্যিই বলছে। আমার এক ভাতিজা ওর বন্ধু। মিথ্যে বললে ওর থেকেই জানা যেতো। আপনারা ভুল বুঝে শুধু শুধু ওদের অপমান করছেন। ওদেরকে ওদের মতো ছেড়ে দিন। স্বামী স্ত্রী যখন তখন একসাথেই থাকবে। এখানে কারো কোনো কথা খাটে না।’
মেঘ অবাক হয়ে দেখছিলো সোহিনীকে। এই মেয়ে তো এমন ছিলো না। কয়েক মাসের ব্যবধানে এতো পরিবর্তন! মেঘকে ঘরে এলেও তার এখানে আসার কারন জানতে চায় নি সোহিনী। শুধু একবার জানতে চেয়েছে চা খাবে কি না। মেঘ হ্যা না কিছুই বলে নি। সোহিনী তবু চা বানিয়েছে। মেঘ কোনো কথা না বলে চা খেয়েছে। তারপর থেকেই একমনে ঘর দেখছে, ম্যাগাজিন পড়ছে সে। সোহিনীর ফ্ল্যাটে ঢোকেই বসার ঘর। বড় নয়, মাঝারি। পাশেই ডাইনিং টেবিল। মাঝখানে কোনো পার্টিশন নেই। ডাইনিং টেবিলের একদিকে বেসিন, অপরদিকে ফ্রিজ। বেসিনের সাথে লাগোয়া দেয়ালের অপর প্রান্তে রান্নাঘর। বসার ঘরে পাঁচটা বেতের সোফা, একটা ছোট বেতের টেবিল। একটা কর্নার র্যাক। তাতে কিছু ফুলদানি আর শোপিস রাখা। সোফার পেছনেই জানালা। তাতে ঝুলছে মোটা পর্দা। ডাইনিংএ একটা লাইট জ্বলছে। তাতেই পুরো ঘর আলোকিত। সোহিনীর শোবার ঘর দেখে নি মেঘ। হয়তো একটু ভেতরে। খাবার ঘর আর বসার ঘরের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাকা রয়েছে। সেই ফাকা জায়গা থেকেই একটা ছোট্ট বারান্দা মতো গেছে। সরু জায়গা। দুদিকে দেয়াল। বামদিকে বাথরুম। ডানদিকে হয়তো শোবার ঘর। সোহিনী নিশ্চয় ওখানে থাকে। আবার নাও থাকতে পারে। ভেতরে আরো রুম থাকতে পারে। জানা নেই মেঘের। সে এখন আড়চোখে সোহিনীকে দেখছে। তার কাজকর্ম দেখছে। মেঘকে বসিয়ে রেখে নিরবতায় কাজ করে চলেছে সে। কখনো রান্নাঘরে যাচ্ছে, কখনো টেবিল ঠিক করছে, কখনো ফ্রিজে কিছু রাখছে, কখনো ফ্রিজ থেকে কিছু বের করছে। মেঘের মনে হচ্ছে তার জন্য বিশেষ কিছু রান্না করছে সোহিনী। কিন্তু খাওয়ার সময় তার সে ধারনাও ভুল প্রমাণিত হলো। টেবিলে বিশেষ কিছু নেই। পাঁচ ছটা রুটি, ছোটখাট বোলে ভাত, এক বাটিতে ডাল, অন্যটায় সবজি ভাজি। দুটো প্লেইট রাখা দুদিকে। মেঘ খেতে বসে উপলব্ধি করলো এই সাধারন খাবারটাও অসাধারন লাগছে তার কাছে। সোহিনী এতো দারুণ রাঁধতে জানে তা সে জানতো না।
খাওয়া শেষ হতেই স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো সোহিনী,
‘এখন চলে যাবি না কি আরো একটু সময় থাকবি?’
মেঘ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
‘আমি কেনো এসেছি জানতে চাইবি না?’
‘তোর বলার হলে বল। শুনবো।’
‘এতক্ষন ধরে শুনতে মন চায় নি?’
সোহিনী টেবিল গোছাচ্ছিলো। মেঘের দিকে ফিরে বললো,
‘আমার তো এখনো শুনতে মন চাইছে না। তুই জিজ্ঞেস করলি তাই বললাম। অনেক রাত হয়েছে। বাড়ি ফিরবি তো।’
মেঘ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে স্থির চোখে দেখলো সোহিনীকে। তারপর সোফায় বসে পরলো। হাত পা টানটান করে বললো,
‘ভাবছি আজ বাড়ি ফিরবো না।’
‘তো কোথায় থাকবি?’
‘কেনো? এখানে থাকবো। আমার বউয়ের কাছে।’
চমকে উঠলো সোহিনী। হাতের কাজ ফেলে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এলো মেঘের দিকে। বিস্ময়ি গলায় বললো,
‘মানে?’
দুষ্টু হাসলো মেঘ। বললো,
‘তুই না আমার বউ। বউকে ছাড়া বর একা কি করে থাকবে বল তো? আমি তো পারবো না। তাই ভাবছি এখন থেকে তোর সাথেই থাকবো। কাল গিয়ে আমার যাবতীয় জিনিস নিয়ে আসবো। বুঝলি!’
সোহিনীর চোয়াল ঝুলে যাওয়ার যোগার।
‘আবোল তাবোল কি বলছিস মেঘ?’
‘আবোল তাবোল না তো। সত্যি বলছি বউ। তুমিই না আগে সবার সামনে বললে আমি তোমার স্বামী। অনেকদিন পর দেখা করতে এসেছি। আজকের রাত থাকবো।’
‘তুই তো জানিস, ওসব মিথ্যে বলছিলাম মেঘ! সবাই যেভাবে বলছিলো তাই না পেরে নিজের শেষ আশ্রয়টুকু বাঁচাতে বলেছি।’
মেঘ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠোঁট চওড়া করে হেসে বললো,
‘মিথ্যে কিসের বউ। যা বলেছো সব তো সত্যিই।’
‘কোনটা সত্যি?’
রাগে কটমট করে তাকালো সোহিনী। দু হাত কোমরে বেঁধে তাকালো মেঘের দিকে। মেঘ ধীর পায়ে সোহিনীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘ইউ নো হুয়াট সোহু, তুমি যেদিন আমায় বিয়ের প্রপোজাল দিলে সেদিনই তো আমাদের মন, আত্মা এক হয়ে গেছে। আমরা দুজন একে অপরকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি। আজ তুমি সেটাই বললে সবার সামনে। সব যখন সত্যিই তাহলে মিথ্যেটা কোথায়? আমি তোমার বর তুমি আমার বউ। চলো বাসর করি।’
ভড়কে গেলো সোহিনী। এতক্ষন মেঘের এগুনো দেখে পিছাচ্ছিলো সে। এবার থমকে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললো,
‘মজা করছিস আমার সাথে? এটা মজা করার মতো কথা হলো? ইডিয়েট!’
‘ছিহ! কি তুই তুই করছো? বরকে কেউ তুই করে বলে সোনা বউ?’
সোহিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। মেঘ কি পাগল হয়ে গেছে? না কি ইচ্ছাকৃত ভাবে সোহিনীকে হেনস্তা করতে চাইছে? বুঝে উঠার আগেই সোহিনীর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো মেঘ। শক্ত হাত জোড়া দিয়ে সোহিনীকে আবদ্ধ করে তার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো মেঘ। সোহিনী ছুটোছুটি করছে না। অস্থির হচ্ছে না। চুপ করে মেঘের কাছে বন্দী হয়ে রইলো।
‘প্রেম প্রেম পাচ্ছে সোহু।’
‘আমার বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।’
চলবে,,,,,,,,,,,