হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৬.
রাত পৌনে বারোটা। বসার ঘরে ক্ষিপ্ত অবস্থায় আছেন মতিউর রহমান। তুমুল রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। চেহারা কঠোর। নিঃশ্বাস তীব্র গতিতে উঠা নামা করছে। পরিবারের বাকি সদস্যরা এবং হানিফ শরীফের পুরো পরিবারও বসার ঘরে বসে আছেন। সবারই মুখ গোমরা। আমিনা বেগম স্বামীর উপর ভীষন অসন্তোষ জ্ঞাপন করছেন। মোজাম্মেল সাহেব সাধারন ভাবেই বললেন,
‘তৌসিফ, মুহিব তোর কলিগ, মনে আছে? মাঝে মাঝে অফিসের বদলে বাড়ি আসতো প্রজেক্ট করতে! ওর ছেলে তাহির। ডাক্তার ছেলে। হিমির সাথে পরিচয় হয়েছে মাস কয়েক হলো। বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিলো। তাই যাওয়া। কিন্তু ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম কনে পালিয়েছে। পাত্রপক্ষ লজ্জায় শেষ। পাত্রের মামা অনেক চিল্লাপাল্লা করছিলো। কনের বাবা মায়েরই বা কি দোষ? ওনাদের অগোচরেই তো মেয়ে কান্ড ঘটালো। অতিথিরাও যাচ্ছে তাই বলছিলো। উপায় না পেয়ে তাই হিমির সাথেই বিয়ে দিতে হলো।’
এতক্ষন পাথর হয়ে থাকা মুহিব রহমান আক্রোশ নিয়ে বলে উঠলেন,
‘হিমিই কেনো বড়ভাই? আর কেউ ছিলো না?’
‘ছিলো না বলেই তো হিমির সাথে বিয়েটা হলো। ওই মুহুর্তে বিবাহযোগ্য কোনো কন্যা ছিলো না আসরে। পাত্রপক্ষেরও তো একটা সম্মান আছে। এভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে গেলে আজীবন বোঝা বয়ে বেড়াতে হতো। পাত্রের এক মামা এডভকেট। কেইস করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছিলো কনেপক্ষকে। ওরা এসে আমায় ধরলো। হাতে পায়ে ধরে আর্জি করতে লাগলো হিমির সাথে বিয়ে দিতে। আমি আর কি করি? ওদের অবস্থা চোখে দেখার মতো ছিলো না। হিমিকে জিজ্ঞেস করলাম কি করা যায়। মেয়ে নাকচ করছে আবার নাও। আলাপ আলোচনার পর পাত্র বললো তার আপত্তি নেই। হিমিও মত দিলো। তাই আর দেরি করি। বিয়েটা দিয়েই দিলাম।’
‘তোমায় কে বলেছে রাজি হতে? কোনো খোঁজখবর নেয়া নেই কিছু নেই দুম করে বিয়ে দিয়ে দিলে?’
নেহাল রহমানের কথায় মৃদু হাসলেন মোজাম্মেল রহমান। বললেন,
‘খোঁজখবর আর কি নেবো? তৌসিফকে তো চিনিই সেই কবে থেকে। তার ছেলে যে নিতান্তই ভদ্র, ভালো হবে স্বাভাবিক।’
‘ওরা জোর করলো আর তুমি গলে গেলে? একটাবার আমাদের জানালেও না। আর কাউকে না জানালেও মুহিব ভাইকে জানানো উচিত ছিলো। তিনি হিমির বাবা। হিমির ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ওনার আছে।’
আমিনা বেগমের কথায় মাথা দুলালেন মোজাম্মেল সাহেব। মুহিব রহমানের চোখ ভিজে উঠলো। ভেজা চোখের পাতা মেলে ভাইয়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। মোজাম্মেল সাহেব কৌতুক করে বললেন,
‘আমি আরো ভাবলাম ওর কিছু বলার থাকবে না। বাবা যখন হিমির বিয়ে ঠিক করলো তখন তো কিছু বলে নি তাই ভেবেছি এবারও বলবে না হয়তো। কিছু বলার ছিলো মুহিব?’
মতিউর রহমান গর্জে উঠলেন। হাতের লাঠিটা ছুড়ে মারলেন মেঝেতে। বললেন,
‘মুহিবের কিছু বলার থাকুক বা না থাকুক আমার আছে। কি ভেবে এই কেলেঙ্কারি ঘটালে তুমি? মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সেটা জানা সত্ত্বেও কেনো করলে এমন? মেয়ের বাবা একবার আমার মাথা হেট করেছে এখন মেয়েও করছে। উফ, আমার আরো আগে এই মেয়েকে তাড়ানো উচিত ছিলো।’
মোজাম্মেল সাহেব ঘোর বিরোধীতা করে বললেন,
‘বাবা হিমি কিছু করে নি। যা করার আমি করেছি। বলার হলে আমাকে বলো। খামোকা মেয়েটাকে বকো না তো!’
‘তাই তো। তোমাকেই তো বলবো। বুড়ো বয়সে এসেও ছেলেখেলা করছে। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয় মোজাম্মেল!’
‘আমি তো বলছিনা বিয়ে ছেলেখেলা। বরং বিয়ে পবিত্র বন্ধন। একসাথে দুটো পরিবারকেও জুড়ে রাখে। সেটাই তো বলছি বাবা, হিমির বিয়ে হয়ে গেছে। যা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো যাবে না। মেনে নিন। হিমির শ্বশুরবাড়ির সাথে নতুন সম্পর্কের শুরু হলো সবে। এমন ভাবে বিয়েটা হলো ওদের সাথে কোনো কথাই হলো না। আমাদের উচিত হিমির শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সাথে আলাপ করা। নয় কি?’
‘না। আমার পক্ষে এসব সম্ভব নয়। একজনকে কথা দিয়েছি আমি। তোমরা আমার এই শেষ বয়সে এসেও আমাকে ছোট করবে। ছি ছি। এখন কি বলবো ওদের? ইশ, এঙ্গেইজমেন্ট করিয়ে রাখলেও হতো। সব মাটি করে দিলে মোজাম্মেল।’
হানিফ শরীফ গলা পরিষ্কার করে বললেন,
‘চাচা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই। হিমির বিয়ে এই ডাক্তারের সাথেই হওয়ার কথা ছিলো হয়তো। নয়তো দেখুন না, কিছুতেই কিছু নেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো! এমনিতেও ওর বিয়ে দিতে চাইছিলেন। আপদ বিদায় যাকে বলে! ওভাবে না হলেও এভাবে হলো। আমার বাড়িতেও সবাই হিমির থাকা পছন্দ করে না। সবাই মনে মনে চাইছিলো বিদায় হোক, আমরা শান্তি পাই। এবার বিদায় হয়েছে। কারো কোনো সমস্যা হওয়ার কারন দেখি না। হ্যা যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। তবে পাকা কথা হয় নি। তারিখও পরে নি। ওসব নিয়ে ভাববেন না। আপনি বললে আমি কথা বলবো ওদের সাথে। এখন আপাতত হিমির নতুন জীবন, নতুন সংসার নিয়ে ভাবা উচিত। সারাজীবন তো আমাদের সাথেই ছিলো। নতুন পরিবেশে কি করে সব সামলাবে, সবাই কিভাবে ওকে নেবে এসব নিয়ে চিন্তা হচ্ছে আমার। মোজাম্মেল ভাই? হিমিকে দেখতে যাবো না?’
হানিফ শরীফের কথায় পরিবেশ শান্ত হলো। মুহিব রহমানের বুক তবু ভারি। মোজাম্মেল রহমান সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘যাবো। কাল রিসেপশন হবে কি না তাও তো জানি না। সকালে একবার হিমিকে ফোন করে দেখি। তারপর আপনাদের জানাবো।’
মাথা দুলিয়ে সায় জানালেন হানিফ শরীফ। হাশিম শরীফ উঠে বেয়াই নেহাল রহমানের সাথে গলা মিলালেন। তারপর স্বপরিবারে বেরিয়ে গেলেন। আমিনা বেগম নিরাশ হয়ে শোবার ঘরে গিয়ে ঢোকলেন। মুহিব রহমানও জায়গা ত্যাগ করলেন। একে একে সবাই যার যার ঘরে গেলো। মতিউর রহমান দাঁতে দাঁত চেপে স্থির হয়ে বসে আছেন। ঘুম উড়ে গেছে ওনার। এখন বড় ছেলেকে গুলি করে মেরে দিতেও মন চাইছে।
………………………………
নিজের ঘরে দরজা আটকে শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন মায়মুনা জামান। বেশ অনেকক্ষন আগেই ছেলে বউ নিয়ে ঘরে এসেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে দরজায় দাঁড়াতেই সামিয়ার জায়গায় অন্য মেয়েকে দেখে থমকে গেছিলেন মায়মুনা। স্তম্ভিত, কৌতুহলী চোখ জোড়া মেলে ছেলের দিকে দেখেছিলেন। তাহির মাথা নুইয়ে রেখেছিলো। তাহিরের বড় মামা তাহির আর হিমিকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢোকে মায়মুনা জামানকে সমস্ত ঘটনা খোলে বলেন। সাথে সাথেই দুনিয়া ঘুরে যায় মায়মুনার। কি হওয়ার কথা ছিলো আর কি হয়ে গেলো! প্রেশার ফল করে মাথা ঘুরে পরে যান তিনি। ধরাধরি করে সোফায় বসিয়ে পানি খাওয়ানো হলো তাকে। হিমি তাহিরও ঘরে ঢোকে পরেছে ততক্ষনে। কিছুটা শান্ত হয়ে তাহিরের গা ঘেষে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে আকাশচুম্বি রাগ লাগলো মায়মুনার। এক লহমায় চিনে ফেললেন সেদিনের বেয়াদব মেয়েটিকে। আত্মীয় পরিজনের সামনে কিছু বলেন নি যদিও তবে রাগে মাথা ভনভন করছিলো ওনার। রেগে যাওয়ার দুটি কারন ছিলো। এক মেয়ে বেয়াদব, ওনার পছন্দ হয় নি। আর দুই কনে হয়ে ছেলেদের শার্ট প্যান্ট পরে আছে। মুখে সাজগোজ তো নেই-ই। বিয়ের কনে কেনো লম্বা চুল না থাকলে মেয়ে বলেই বোধ হতো না ওনার আছে। শেষমেষ ঘরের বউ কি না এই মেয়ে! ভাবতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন মায়মুনা। সেই সাথে মুখ ঝামটাচ্ছিলেন আত্মীয়রা। হিমির তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তাহির মায়মুনা জামানকে বুঝানোর চেষ্টা করার আগেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দুই ভাইঝিকে আদেশ দিলেন ওনাকে ঘরে শুইয়ে দিতে। তারাও মায়মুনার কথা মতো তাকে ঘরে দিয়ে এসেছে। বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে এসবের কোনো চিন্তা মায়মুনা জামানের হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে ছেলেকে নিয়ে।
দরজায় টোকা পরলো। মায়মুনা জামান ঘাড় হালকা উচু করে স্মিত গলায় বললেন,
‘আমি ঘুমাবো। বিরক্ত করো না।’
আবারও টোকা পরলো দরজায়। বিরক্তির শীষ তুলে আবারও কথা বললেন মায়মুনা,
‘কে বাইরে? বলছিতো ঘুমাবো। বিরক্ত করছো কেনো?’
‘মা? কথা ছিলো। আসবো?’
তাহিরের কন্ঠ শুনে শান্ত হলেন মায়মুনা। উঠে বসে বললেন,
‘এসো।’
তাহির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকলো। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মায়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। মায়মুনা ছেলের দিকে তাকালেন। পরনের পাঞ্জাবী, পাগড়ী, মালা কিছুই খোলে নি সে। তাহির মৃদু গলায় বললো,
‘সরি মা। তোমার কথা রাখতে পারি নি। সামিয়া এভাবে আমাদের ধোঁকা দেবে বুঝতে পারি নি। আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি তো জোর করে ওকে বিয়ে করতে পারতাম না!’
‘জোর করে বিয়ে করতে না পারলেও বিয়ে না করে বাড়ি ফিরতে পারতে তাহির। অন্য কাউকে বিয়ে করার দরকার ছিলো না।’
তাহির ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মায়ের পাশেই বসলো। মাথা মেঝের দিকে নুইয়ে বলে উঠলো,
‘আমি করতে চাই নি। মামা বললেন অপমানিত হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না। এই আসরেই বিয়ে করতে হবে। তোমার সম্মান রক্ষার্থে হলেও অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে। তাই,,,,’
‘তোমার মামার সাথে কথা বলবো আমি। খুব আমার সম্মানের চিন্তা তার! ওখান থেকে একবার ফোন করে জানালেও না?’
‘আমার ফোন তো বাড়িতেই ছিলো। মামা ভয় পেয়েগেছিলেন। তাই বাকিদের ফোন করে তোমায় জানাতে নিষেধ করছিলেন।’
‘কিসের ভয়?’
‘তুমি রেগে যাবে, কষ্ট পাবে। মামার মনে হচ্ছিলো তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।’
‘এখন বুঝি সুস্থ আছি?’
‘না তবে এখন আমরা সবাই আছি তোমার কাছে। আগে হলে মুশকিলে পরে যেতাম।’
‘যাকে বিয়ে করেছো সে বিয়েতে কি করে গেলো? কনেপক্ষ? তার পরিবার সম্পর্কে কোনো ধারনা আছে?’
‘উনি আমার পরিচিত। আমিই বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিলাম।’
মায়মুনা জামান অসন্তোষ চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘নাম কি? কিসে পড়ে? পরিবারে কে কে আছে?’
‘হিমি। পড়াশোনা করেন না। ইন্টারের পর ছেড়ে দিয়েছেন। যৌথ পরিবার ওনার। সবাইই আছে। মা ছাড়া। ওনার জন্মের সময় মা মারা যান।’
মায়মুনা জামান মুখ কঁচকালেন। বিতৃষ্ণা নিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই দরজা ঠেলে উঁকি দিলো হৃদি। বললো,
‘ভাইয়া? ভাবিকে ঘরে বসিয়ে রেখেছি। চলো।’
মায়মুনা জামানের তাৎক্ষনিক প্রশ্ন,
‘কোথায় যাবে?’
‘ওমা, বাসর ঘরে। আজ না বাসর!’
ভাইয়ের কথায় কটমট করে তাকালেন মায়মুনা। তাহিরের মামার তাতে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। বরং ভেতরে ঢোকে তাহিরকে টেনে দাঁড় করিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
‘আমি মামা হয়ে তোকে বাসর ঘরে দিয়ে আসবো? আহাম্মক! এই মাহি, রাফি, মারুফ ওরা কোথায়?একটাও কাজের না। হৃদি মা?’
হৃদি পেছন পেছন চলতে চলতে বললো,
‘হ্যা বাপি?’
‘পিউকে বল তো দুই প্লেইট খাবার দিয়ে যেতে। বর কনেরও খাওয়া হয় নি। ওরা ঘরে খেয়ে নেবে। যা যা।’
হৃদি উল্টো দিকে দৌড় লাগালো। তাহির ভ্যাবলাকান্তের মতো মামার সাথে চললো। ঘরের কাছে এসেই হাত ছেড়ে দিলেন তাহিরের মামা। ফিসফিস করে বললেন,
‘কেমন পরিস্থিতিতে তোরা সম্পর্কে জড়িয়েছিস বুঝতে পারছি। কিন্তু জড়িয়েই যখন গেছিস তখন এই সম্পর্কটা মেনে নিতে হবে। কনের জ্যাঠু বললেন তোরা একে অপরকে চিনিস। তাহলে তো অসন্তোষ হওয়ার কথা না। আর না চেনা পরিচিতির। তবুও কথা বলার হলে বল। মেয়েটাও ঘাবড়ে আছে। এখানে আসার পর খালি হৃদি আর রাফিরা দু এক কথা বলেছে ওর সাথে। তোর মা তো ফিরেও দেখে নি। ওকে ইজি কর। আর বাকিটা কাল বলবো। এখন যা। বাসর কর!’
কথাটা বলেই চলে গেলেন উনি। তাহির পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতেই প্লেইট হাতে এসে দাঁড়ালো মামাতো বোন পিউ আর চাকর শ্রেণির একজন। তাহিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘরে নিয়ে চললো তাকে। টেবিলে দুটো প্লেইট রেখে খাবার পানি রেখে মৃদু হেসে চলে গেলো ওরা। তাহির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হিমি ঘরে নেই। অথচ হৃদি বললো হিমিকে ঘরে বসিয়ে এসেছে। গেলো কোথায় এই মেয়ে?
চলবে,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৭.
ব্যালকনিতে কারো ছায়া দেখে এগিয়ে গেলো তাহির। উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে হিমি। চুলগুলো বাঁধনহারা তার। তাহির ধীর পা ফেলে হিমির পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালো। হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এখানে কি করছেন? ভেতরে চলুন।’
‘ভালো লাগছে না।’
‘মন খারাপ করছে?’
‘উহুম,,,, কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর পুরছে মনে হচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে লাগছে। কান্নাও পাচ্ছে।’
তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ব্যালকনির বাইরে দৃষ্টি দিলো। শান্ত গলায় বললো,
‘বিয়েতে আপনার মত ছিলো না। না?’
হিমি জবাব দেয় না। তাহির কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। হয়তো হিমির উত্তর জানতে চায়। হিমিকে অপ্রস্তুত দেখে নিজ থেকেই বললো,
‘আই অ্যাম সরি হিমি। আমার উচিত ছিলো বিয়েতে সম্মতি না দেয়া। আসলে, মামা এমন ভাবে বলছিলেন যে মনে হচ্ছিলো বিয়ে না হলে বড় কোনো অঘটন ঘটে যাবে। মায়ের কথা ভেবেই রাজি হয়ে গেছিলাম। আপনার সাথে আলাদা করে কথা বলা উচিত ছিলো আমার।’
হিমি বুকের গভীর থেকে নিঃশ্বাস টেনে বললো,
‘আমার বড়মার কথা খুব মনে পরছে বাচ্চা ডাক্তার। বড়মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমার কথা ভেবে কাঁদছেও হয়তো। রাগ করতেও পারে। মামুও চিন্তা করছে হয়তো। আমিও ভুল করে ফেলেছি জানেন! জ্যাঠুমনির কথা শোনা উচিত হয় নি। এখন খুব আফসোস হচ্ছে।’
‘আমারও আফসোস হচ্ছে। ভীষন আফসোস।’
তারপর দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। নিরবতায় ভেসে এলো ঝিম ঝিম কিছু শব্দ। দুজনের নিঃশ্বাসের আওয়াজ। তাহির হিমির দিকে ফিরলো। হিমি তখনও বাইরের দিকে তাকিয়ে। তার দৃষ্টি শূণ্যে স্থির হয়ে আছে। তাহির খেয়াল করলো হিমির চোখে পানি। হিমির উদ্দেশ্যে আহত গলায় বললো,
‘আমি বুঝতে পারছি আমার জন্য এসব যতোটা না কঠিন আপনার জন্য তার চেয়েও বেশি কঠিন। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আগে ছিলো। বুঝি নি। চাইলেই বিরোধীতা করে সরে আসতে পারতাম।’
কয়েক মুহুর্ত থেমে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি কেনো সরে আসেন নি হিমি।’
‘চেয়েছিলাম বাচ্চা ডাক্তার। জ্যাঠুমনি দেয় নি। এক মুহুর্তে ভেবেছিলাম পালাবো। পরে মনে হলো আমিও যদি পালাই তবে আপনাদের বেঁচে যাওয়া সম্মানটুকুও মাটিতে মিশে যাবে। আমি আপনাকে খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। আপনাদের ভালো রাখতে, জ্যাঠুমনির কথা রাখতে আর দাদুর পরিকল্পনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সরে আসি নি।’
‘দাদুর পরিকল্পনা মানে?’
‘পরে বলবো। এখন বলুন তো! আপনার মা কেমন আছেন? প্রেশার ঠিকঠাক আছে?’
‘হ্যা। এখন ভালো আছেন।’
‘রেগে আছেন নিশ্চয়?’
‘তা একটু আছেন। তবে রাগের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছেন। ওনার সাথে কথা না বলে বিয়ে করে ফেলায় আঘাত পেয়েছেন মা। মামার উপর রাগ ঝাড়তে পারেন।’
হিমি মাথা দুলিয়ে শুকনো হাসলো। মন বিষিয়ে উঠলো তার। জ্যাঠুমনি বলেছে এখন থেকে হিমির বাড়ি হলো ওর শ্বশুরবাড়ি। এটাই ওর সংসার। পরিবার। অথচ এখানেও কেউ তাকে নিয়ে খুশি নয়। বিশেষত্ব নেই কিছুতেই। কেউই হিমিকে চায় নি। আবারও নতুন কারো সাথে জড়িয়ে গেলো অজান্তে, অনিচ্ছায়। এখানেও উটকো সে। জীবনে কখনোই কি কারো বিশেষ মানুষ হতে পারবে না? জানে না হিমি। জানতেও চায় না। নিজেকে শান্ত করে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে। তাহিরের দিকে ঘুরে বলে,
‘কতক্ষন ধরে এতসব পরে আছেন। ফ্রেশ হোন গিয়ে।’
‘আপনি ফ্রেশ হবেন না?’
‘সাথে তো কিছু আনি নি বাচ্চা ডাক্তার। আপনি যান। আমার কথা ভাবতে হবে না। বাড়ি আপনার, ঘর আপনার। নিজের মতো করেই থাকুন। আমার জন্য আনকোম্ফোর্টেবল ফিল করবেন না। রিলেক্স!’
তাহির প্রত্যুত্তর করলো না। শোবার ঘরে ঢোকে আলমারি থেকে টাউজার আর টি শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকলো সে। বেশ কিছুক্ষন পর কাপড় পাল্টে ঘরে ফিরলো তাহির। ব্যালকনির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
‘হিমি? ভেতরে আসুন। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।’
হিমি ঘাড় বাঁকিয়ে বললো,
‘খিদে নেই। আপনি খেয়ে নিন।’
‘ফ্রেশ তো হবেন। হৃদির কোনো পোশাক আজকের জন্য পরে নিন। ডাকছি ওকে।’
হিমি মাথা দুলিয়ে ঘরে ঢোকলো। ওয়াশরুমে ঢোকে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো সে। তাহির সোফায় বসে ছিলো। হিমি বেরুতেই বললো,
‘সরি হিমি। দরজা বাইরে থেকে আটকানো। আমার ফোন মায়ের কাছে দুদিন ধরে। হৃদিকে ডেকেও লাভ হয় নি। নিজের ঘরে আছে হয়তো।’
‘ব্যাপার না। আমি এ কাপড়েই ঘুমাতে পারবো।’
‘একটু তো খাবেন! শরীর খারাপ করবে নাহলে।’
হিমি অসম্মতি জানালো। খাটের কাছে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি নিয়ে বললো,
‘কোথায় ঘুমাবো?’
তাহির চোখ তোলে তাকালো। বোকা বোকা গলায় বললো,
‘আমিতো খাটে ঘুমাই। আপনি কিসে ঘুমান?’
‘খাটেই!’
‘তাহলে জানতে চাইছেন কেনো?’
‘না মানে, খাট তো আপনার। আপনি ঘুমাবেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম আমি কোথায় ঘুমাবো। আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না আর।’
তাহির ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘বিরক্ত হচ্ছি না আমি। হবোও না। শুয়ে পরুন। আমার জন্য একপাশে একটু খানি জায়গা রাখলেই হবে।’
পরোক্ষনেই বললো,
‘তবে আপনার অসুবিধা হলে আমি সোফায় ঘুমাতে পারি।’
মাথা নাড়লো হিমি। বললো,
‘আরে না না। আপনার যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ঘুমান। আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।’
……………………………
‘মেয়ের পরিবার নিয়ে তোমাদের কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও আমার আছে। ছেলে আমার। সংসার আমার। আমার সংসারে কে আসবে, কে থাকবে সেটা আমার ঠিক করার কথা ছিলো। আর তোমরা নিজেদের মনমতো সব করে ফেললে?’
মায়মুনা জামানের কথায় মুখ ছোট করলেন ওনার ভাই। আমতা আমতা করে বললেন,
‘আপা এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।’
গর্জে উঠলেন মায়মুনা,
‘উপায় খুঁজতে বলেছে কে? বাড়ির হবু বউ পালিয়েছে মানেই বিয়ে ক্যান্সেল। তোমাদের উচিত ছিলো ওখান থেকে সোজা বাড়িতে আসা। আমাকে জানানো। তা না করে আমার থেকে সব আড়াল করে অচেনা, অজানা এক মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনলে। কি জানো ওই মেয়ের ব্যাপারে? ওর খানদান, বংশ, পরিবার, বাবা মা, শিক্ষা কিছুই তো জানো না। তাহলে বিয়ে দিলে কেনো আমার ছেলের সাথে? আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিলে তোমরা। আমি এটা তোমার থেকে আশা করি নি আফতাব।’
মায়মুনা জামানের ছোট ভাই আফতাব অসহায় কন্ঠে বললেন,
‘মেয়ের জ্যাঠু মোজাম্মেল রহমান এগিয়ে না এলে আমাদের সম্মান কি আর থাকতো? আর তাছাড়া মেয়েকে তো তাহির আগে থেকেই চিনতো। ও তো অমত করে নি।’
‘কেনো করে নি সেটা জানো? তাহিরকে তুমি বলেছো বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাবো, আমার অসম্মান হবে। একবার আমায় জানাতে পারলে না। তুমি বুঝতে পারছো না আফতাব এই মেয়ের সাথে আমার তাহিরের কিছুতেই যায় না।’
‘যার সাথে তাহিরের যেতো সেই তো পালালো। এখন যাকে ঘরে এনেছি তাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না।’
‘ফেলে দিতে বলছি না। শুধু বলছি খোঁজখবর না নিয়ে থাকলে এখন নাও। আমার সবকিছু জানা জ্বরুরি। আমার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। আমি বুঝি না বাড়ির মেয়ের বিয়ে এভাবে কেউ কি করে দিতে পারে? কোথায় বিয়ে দিচ্ছে, কার ঘরে পাঠাচ্ছে এসব তো জানবে! আমি যতোটা আমার তাহিরকে নিয়ে চিন্তা করছি মনে হচ্ছে না ওরা ওদের মেয়েকে নিয়ে করছে বলে। আশ্চর্য। বরের মায়ের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তাও মনে করেন নি ওনারা?’
‘আপা? কাল তো রিসেপশন। তখন নাহয় মেয়ের পরিবারের সাথে আলাপ হবে।’
‘কিসের রিসেপশন? যেখানে বিয়েই হলো হুটহাট সেখানে বউভাত, রিসেপশনের কোনো প্রশ্নই উঠে না।’
‘কিন্তু সবাইকে তো ইনভিটেশন করা হয়ে গেছে।’
‘মানা করে দাও।’
‘এখন?’
‘যখন ভালো মনে করো। আগামী কাল আমি আমার বাড়িতে এক্সট্রা কাউকে চাই না। যারা আছে তো আছেই। শুধু মেয়ের পরিবারকে জানিয়ে দিও। ওনাদের সাথে আমার কথা হওয়াটা জ্বরুরি। এখন যাও। মাথা ধরেছে আমার।’
আফতাব উদ্দীন মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই পিছু ডাকলেন মায়মুনা। বললেন,
‘প্যারাসিটামল আছে?’
‘না আপা।’
‘দেখো বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞেস করে। পেলে কাউকে দিয়ে পাঠাও। আমার ঔষধ শেষ হয়ে গেছে। আনানোর কথা মনে নেই।’
কথা বলতে বলতেই একহাতে কপাল টিপতে লাগলেন মায়মুনা। আফতাব উদ্দীন কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বেরিয়ে গেলেন। ভাগ্নের ভালোর কথা ভেবেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। অথচ আপা এমন ভাবে বলছেন যেনো তাহিরের উপর ওনার কোনো অধিকার নেই। মামা হয়ে ভাগ্নের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। অপমানিত বোধ করেন তিনি।
চলবে,,,,,,,