হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৩.
“শুনলাম তোর বাবা মা তোর বিয়ে ঠিক করছে। সত্যি?”
ইমনের প্রশ্নে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। মেঘ বিস্মিত চোখে তাকালো সোহিনীর দিকে। সোহিনী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ভাতের লোকমা মুখে তুলে খেতে খেতে বললো,
“হুম সত্যি।”
দোহা কাঁচা মরিচে কামড় বসালো। বললো,
“তুই তাহলে বিয়ে করছিস?”
“উহু আমি করছি না।”
“করছিস না? তবে তোর বিয়ে ঠিক হচ্ছে কেনো?”
হিমির সাথে তাল মেলালো সূর্য। বললো,
“তুই বিয়া না করলে বিয়া ঠিক হয় কেমনে? সত্যি কইরা ক সোহু তুই কি আমাগো মেঘরে ধোঁকা দেয়ার পয়তারা করতেছিস?”
সোহিনী মাথা নাড়লো। ধীর স্থিরে মুখের খাবার শেষ করে পানি খেলো। সোহিনীর উত্তরের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে মেঘ। সোহিনী উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসলো। টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“শহরে বখাটে ছেলেদের ওত পাত বেড়ে গেছে। মেয়েরা পরিবারের সাথেই সেইফ না আমি আবার একা থাকি। তাই বাবা মায়ের মনে হলো আমার বিয়ে করিয়ে দেয়া অতি আবশ্যক। একারনেই বিয়ে ঠিক হচ্ছে।”
দোহা পানি গিলে বললো,
“বেশ ভালো কথা। কিন্তু তুই মানা করিস নি আঙ্কেল আন্টিকে?”
“করেছি। শুনেন নি।”
“বিয়ে কবে?”
এতক্ষনে মুখ খোললো মেঘ। নির্লিপ্ত গলায় উক্ত প্রশ্ন করলো সে। সোহিনী এবারও স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
“জেনে লাভ নেই। আমিও জানি নি তাই। বিয়ে করছি না তো!”
হিমি বিরক্ত গলায় বললো,
“আজাইরা কথা সব! বিয়ে করছিস না তবে বিয়ে ঠিক হবে কেনো? এদিকে আবার মেঘকে বিয়ে করার কথা বলেছিস। কিছুই মাথায় ঢোকছে না।”
“সহজ বিষয় বুঝবি না কেনো? আমার বাবা মা চায় আমায় বিয়ে দিতে। তাই বিয়ে ঠিক করছে। আমি তাদের কথায় বিয়ে করতে চাই না তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। এবং ওরা ডাকলেও দেখা করতে যাচ্ছি না। কারন বিয়ে করছি না। এখানে ফেরার পর মনে হলো যার সাথে আমার বিয়েটা ঠিক হয়েছে তার থেকে ভালো মেঘ। আমার হুট করেই মেঘকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু মেঘ এখনো কিছুই জানায় নি। ব্যাপারটা খুব সহজ।”
হিমি সিঙারার প্লেইট ঠেলে সরিয়ে রেখে টেবিলের দিকে ঝুঁকে বললো,
“মেঘ যদি তোকে বিয়ে করতে না চায়?”
“অন্য কাউকে খুঁজবো। তবুও বাবার পছন্দ করা ওই লোকটাকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।”
ইমনের খাওয়াও হয়ে গেছে ততক্ষনে। সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো,
“ওই হারামজাদা তোর কাছে কি চায় সোহু? শুনলাম, তোর ফ্ল্যাটের বাইরে হল্লা করেছে?”
“কোন হারামজাদার কথা কস দোস্ত?”
সূর্যের উদ্বীগ্নতা ছাপিয়ে যায় বাকিদের মধ্যেও। ইমন থমথমে মুখভঙ্গী করে বলে,
“আরাফাত।”
দোহা খাওয়া বন্ধ করলো। মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় নিয়ে বললো,
“সোহুর এক্স!”
“হু। জেলে কেমনে পৌঁছালো সেটাও জানি না। বলবি?”
সোহিনী ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলালো। চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে বললো,
“আমার কাছে কি চায় তা তো জানি না। জিজ্ঞেসও করি নি। তবে অনেক হল্লা করেছে। চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়াও আমার দরজা ধাক্কাধাক্কি করেছে। পরে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছি।”
মেঘ নিচু স্বরে জানতে চাইলো,
“কি বলে ধরিয়েছিস?”
“যা সত্যি তাই বলেছি। হ্যারেজ করছে, রাত বিরাতে এসে ডিস্টার্ব করছে, অসভ্যতামো করার চেষ্টা করছে। আরো কিছু বলেছি। ভেবেছিলাম এবার শান্তি পাবো। তা আর হলো কোথায়! পুলিশি কার্যের পর বিল্ডিংএর মালিক সোজা আমায় বের করে দিয়েছে। মাঝরাতে পরে বহু কষ্টে অন্য একটা ফ্ল্যাট যোগার করেছি। এখনো আছে ও জেলে। থাক কয়েকদিন। শিক্ষা হোক।”
“ব্যাটা লুইচ্চা। ঘরে বউ রাইখা প্রাক্তনরে চায়। শালা ***** সামনে পাইলে খুন কইরা ফেলতাম! তোর উচিত আছিল ওই হারামীটারে ঘরে আটকাই রাইখা আমাগোরে কল দেয়া। এরপর দেখতি, কেমনে তার শয়তানি ঘাড় থাইকা নামাই। বেক্কল!”
সোহিনী শব্দ করে হাসলো। ইমন দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো,
“এখন সব ঠিক আছে তো?”
সোহিনী মাথা দুলালো শুধু। দোহার খাওয়া শেষ হতেই চায়ের অর্ডার দিলো সূর্য। সবাই মিলে মেতে উঠলো আড্ডায়। মেঘই শুধু ভাবনায় আটকে গেলো। সোহিনীর বাবা মা যদি জোর করে তবে কি সোহিনী বিয়ে করে ফেলবে? মেঘের উত্তর দেয়া হবে না? সোহিনী নিশ্চয় মেঘকে ভালোবাসে না! বাসলে অন্য কাউকে খোঁজার কথা বলতো না। বলতো, মেঘের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। মেঘ বিয়ে না করতে চাইলে সে কুমারী থাকবে। কিন্তু সোহিনী তো পুরো বিপরীত কথা বললো। মেঘকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে সোহিনীন অন্য কোনো কারন আছে কি?
___________________
নিরিবিলি পরিবেশের নিরবতাকে চ্যুত করে বেজে উঠলো মুঠোফোন। মোজাম্মেল সাহেব বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন। হাতে চায়ের কাপ। মাথার উপরে অন্ধকার আকাশ। চাঁদ তারাবিহীন আকাশ দেখতেও বেশ লাগছে ওনার। এর মধ্যেই হিমির ফোন পেয়ে কিছুটা বিচলিত হয়ে পরলেন তিনি। কাপ নিচে নামিয়ে রেখে ফোন উঠালেন। অভিমানী গলায় বলে উঠলো হিমি,
“জ্যাঠুমনি?”
মোজাম্মেল সাহেব কপাল কুঁচকালেন। ভাবুক গলায় বললেন,
“কি হয়েছে মা? তুই কাঁদছিস?”
“না। তবে মনে হচ্ছে কেঁদে দেবো।”
“কেনো? কান্নার কি হয়েছে?”
“বাচ্চা ডাক্তার আমার ফোন তুলছেন না।”
মোজাম্মেল সাহেব থমকালেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন,
“ফোন তুলছে না বলে কান্না পাচ্ছে?”
“বুঝতে পারছি না।”
মোজাম্মেল সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন,
“ফোন কেনো করেছিলি তাকে?”
“দেখা করতে ইচ্ছে করলো। ভেবেছিলাম চা খেতে খেতে গল্প করবো।”
মোজাম্মেল সাহেব হাসলেন। বললেন,
“পরশু তার বিয়ে। আজ ও তোর সাথে চা খেতে আসবে ভাবলি কি করে?”
হিমি লজ্জা পেলো কিছুটা। অপ্রতিভ গলায় বললো,
“খুব দরকার হলেও আসবে না?”
“না। আসবে না। বিয়ের পরও যে আসবে তারও কোনো মানে নেই।”
“কেনো কেনো? বিয়ের পর ওনার আমার কথা মনে পরবে না?”
“তুই তো বললি তোরা বন্ধু না।”
“নই তো!”
“যেহেতু তোরা বন্ধু না সেহেতু দেখা করার উত্তেজনাও নেই। বিয়ের পর ব্যস্ততা বাড়বে তার। একে তো ডাক্তার তার উপর স্বামী। স্ত্রীর কথাও ভাবতে হয়। স্ত্রীকেও সময় দিতে হয়। তার বিয়ের পর দেখবি মাসেও তোর সাথে দেখা করার সময় পাবে না সে। কথাও বলবে না হয়তো!”
হিমির গলায় কাঁপুনি ধরলো। আমতা আমতা করে বললো,
“এক্কেবারে ভুলে যাবেন?”
“ভুলতেই পারে। তোর কি কষ্ট হচ্ছে হিমি?”
জবাব দেয় না সে। ফোন কেটে দেয়। মোজাম্মেল সাহেব ফোন নামিয়ে রেখে মৃদু হাসেন। তিনি যা ভাবছেন তাই যদি হয়ে থাকে তবে হিমির জীবন ঘুরে যাবে। কয়েকদিনের মধ্যে এক নতুন হিমিকে দেখবেন তিনি। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের। হিমির অতীত বর্তমান উনি সুন্দর করতে পারেন নি। ভবিষ্যত করবেন। বদলে দেবেন হিমিকে নিয়ে সবার চিন্তাধারা। যা এতগুলো বছর হিমি পায় নি সবই পাবে এখন থেকে। মোজাম্মেল সাহেব ফোন উঠান আবারও। কল লাগান কারো নাম্বারে। পরিকল্পনা করতে হবে। সময় বেশি নেই হাতে।
__________________
মায়মুনা জামান হাতে দুটো বেনারসী শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটার রঙ গাঢ় লাল অন্যটার গাঢ় গোলাপী। কনেকে বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে শাড়ি দিতে হয়। তিনি সামিয়ার জন্য এ দুটো শাড়ি পছন্দ করেছেন। দিতে হবে যেকোনো একটা। কোনটা দেবেন সেটা নিয়েই কনফিউশনে পরে গেছেন তিনি। তাহিরকে ছাদ থেকে নিচে আসতে দেখেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। মুখের সামনে শাড়ি দুটো উঁচু করে ধরতে ঘাবড়ে গেলো তাহির। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালে তিনি বললেন,
“দেখোতো কোনটা সুন্দর লাগছে?”
“দুটোই সুন্দর মা।”
“দুটো সুন্দর বলেই আমার হাতে আছে। এখন এ দুটো থেকে যেকোনো একটা পছন্দ করো। বউয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে। তুমি যে শাড়ি পছন্দ করবে সেটাই বিয়েতে পরবে সামিয়া।”
“কেনো? ওনাকে ওনার পছন্দের শাড়ি পরতে দিলেই হয়। আমার পছন্দ ওনার অপছন্দ হতে পারে!”
“হবে না। আর হলেও বা কি! অভ্যাস করতে হবে। বিয়ের পর তোমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী থাকতে হবে তাকে।”
তাহির শুকনো হাসলো। মুখ ফসকে বলে ফেললো,
“তুমি তো বাবার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী থাকো নি মা! তাহলে অন্য কাউকে তার বরের পছন্দ অপছন্দে থাকতে বলছো কেনো?”
মায়মুনা জামানের হাসি মিলিয়ে গেলো। চোখ মুখ শক্ত হলো ওনার। তাহিরের খেয়াল হলো এ কথাটা বলা উচিত হয় নি তার। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করতেই মায়মুনা জামান মৃদু গলায় বললেন,
“তুমি তোমার বাবার মতো নও। আর না সামিয়া আমার মতো। যদি তুমি তোমার বাবার মতো হতে তবে অন্য কথা বলতাম। তোমাকে আমি আমার মতো করে বড় করেছি। ভালো ছেলে, ভালো ভাই, ভালো মানুষ হয়ে তৈরী হয়েছো তুমি। এবার ভালো স্বামী হওয়ার পালা। আমি বিশ্বাস করি তুমি সবদিক থেকেই ভালো হবে। তোমার কথায় আমি রাগ করি নি তাহির। ভুল বলো নি বলেই আমার ভালো লাগছে। যাই হোক, শাড়ি দুটো তোমার ঘরে রেখে দিচ্ছি। চাইলে সামিয়াকে শাড়ির ছবি দেখাতে পারো। তার যেটা পছন্দ হবে সেটা পাঠাবো। ঠিক আছে?”
তাহির প্রত্যুত্তর করলো না। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়মুনা জামান তাহিরকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠলেন। তাহির বুক ভরে শ্বাস টানলো। দু হাতে চুল মুঠো করে মনে মনে কিছু একটা আওড়ালো। উপলব্ধি করলো বাবার মতোই তার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না। বাবার মতোই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভয় হচ্ছে। বাবার মতোই বড় কোনো ভুল করবে না তো তাহির?
চলবে,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৪.
জাঁকজমকপূর্ণ আসর। কনের বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান। ঘর ভর্তি কনেদের মেহমান। বরযাত্রী এখনো এসে উপস্থিত হন নি। তবে বরের দাওয়াতে হিমি আর মোজাম্মেল সাহেব কিছু আগেই এসে পৌঁছেছেন। একটু আগে অব্দি হিমি মোজাম্মেল সাহেবের পাশে ছিলো না। কোনো এক অতি জরুরি কাজে বেরিয়েছিলো। মোজাম্মেল সাহেব একা সারা বাড়ি হেঁটেছেন। সময় কাটানোর জন্য গল্প করার তীব্র প্রয়োজন বোধ করছিলেন তিনি। তবে গল্প করতে ইচ্ছুক কাউকে পাওয়া যায় নি। দু একজন রাজি হয়েছিলো তবে তাদের সাথে কথা বলে জমছে না বলেই সরে পরেছেন তিনি। এই মুহুর্তে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ভাবনায় মগ্ন হয়েছেন মোজাম্মেল সাহেব। ভাবনার বিষয়বস্তু, বর কেনো এসে পৌঁছলো না? বিয়ে হবে কি না? হিমি কি করবে? এখন কোথায় আছে? মনের ডাক্তারের সাথে হিমির কোনো কথা হবে কি না? এর মধ্যেই পাশে এসে দাঁড়ালো হিমি। মুখে লেগে আছে এক চিলতে হাসি। চোখে উচ্ছ্বাস। মোজাম্মেল সাহেব চেয়ারে বসে থেকে ইশারায় হিমিকে কাছে ডাকলেন। হিমি কিছুটা ঝুঁকলো। তিনি বললেন,
‘কোথায় ছিলি এতক্ষন?’
‘সিক্রেট মিশনে।’
‘সিক্রেট মিশন? কি সিক্রেট মিশন? দেখ হিমি, আমার থেকে খবরদার কিছু লুকাবি না!’
হিমি মৃদু হাসলো। পাশ থেকে মোজাম্মেল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো,
‘লুকাবো না। বলবো। সময় হলে বলবো। এখন বসে বিয়ে দেখো। বাচ্চা ডাক্তার পল্টন নিয়ে এসে গেছে। কনের ভাই বোনেরা গেইট ধরেছে। এক্ষুনি ভেতরে আসবেন ওনারা।’
মোজাম্মেল সাহেব চাপা অস্বস্তি নিয়ে মাথা দুলালেন। হিমি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কালো টিশার্টের উপরে পরা লাল কালোর চেক শার্টের কলার ঠিক করলো। খোলা কুঁকড়ানো চুল হাত দিয়ে গুছিয়ে শার্টের হাতা গুটালো। মনে মনে হাসছেও প্রচুর। মোজাম্মেল সাহেব আড়চোখে ভাইঝিকে দেখছেন। না জানি কি কান্ড ঘটিয়ে এসেছে। ওনার পরিকল্পনার দফারফা না করে দেয়!
__________________
নির্জন রাস্তা ধরে ইমন আর মেঘ চলছে। হাতে তাদের সফট ড্রিঙ্কের ক্যান। থেকে থেকেই ক্যানে চুমুক বসাচ্ছে দুজনে। কথাও বলছে টুকটাক। এক পর্যায়ে ইমন সিরিয়াস ভঙ্গীতে বললো,
‘তোকে কিছু জানানোর ছিলো মেঘ।’
‘জানা।’
‘সোহিনীর ব্যাপারে।’
‘সোহিনী? কি ব্যাপার বলতো!’
ইমন ঘন শ্বাস টেনে ফুটপাতে বসে পরলো। হাতের ইশারায় মেঘকে বসতে বলে বললো,
‘সোহু তোদের সব কথা জানায় নি। কিছু কথা লুকিয়েছে আর কিছু এড়িয়েছে। বন্ধু হিসেবে আমার তোদের সব জানানো উচিত। সোহিনীর সামনে সবাইকে বলতে পারবো না তাই তোকেই বলছি। আফ্টার অল সোহুর হবু বর!’
শেষ কথাটা দুষ্টুমি করে বলেছে ইমন। মেঘ হাসলো তাতে। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো সব কথা। ইমন ঠোঁট গোল করে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘আরাফাত সোহিনীকে শুধু বিরক্তই করে নি বরং তাকে রেইপ করার চেষ্টা করেছিলো।’
‘হুয়াট!’
আঁতকে উঠে মেঘ। ইমন ব্যতিব্যস্ত গলায় বলে,
‘সোহিনী কোনোরকম নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। পুলিশ কম্প্লেইন করে ওই রাতেই বাড়ি যায়। ওখানে সব জানা জানির পর সোহিনীর বড় বোনের শ্বশুরবাড়ির কেউ একজন জানায় সুইসাইড এট্যাম্প্টের ঘটনা। পরদিন জোর করে সোহুকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে গ্রামের সবাই। বিয়ে থেকে বাঁচতে সন্ধ্যার দিকে পালিয়ে আসে। এখানে এসেও আরো বড় বিপদে ফেঁসে যায়। বাড়িওয়ালা তাকে ফ্ল্যাট থেকে বিতাড়িত করেছে। বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে সাথে একটা ছোট ব্যাগ ছাড়া কিছুই আনতে পারে নি। মাঝরাতে আমার সাথে দেখা। তখন সোহু ফুটপাতে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করায় অর্ধেক কথা বললো। বাকিটা এড়িয়ে গেছিলো। সাহায্য চাইছিলো আবার বলছিলো যেনো কাউকে না জানাই। তোদেরকেও না। শেষমেষ আমার পরিচিত এক আঙ্কেলের সাথে কথা বলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। ওখানেই আছে এখন।’
‘এতোকিছু হয়ে গেছে ও কিছু জানায় নি কেনো আমাদের? বন্ধুদের থেকে এসব লুকানোর মানে কি?’
‘নিজেকে শক্ত প্রমান করতে। জানিসই তো আরাফাতের সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর থেকেই কেমন হয়ে গেছে ও! নিজেকে শক্ত রাখতে হবে, ডোন্ট কেয়ার ভাব থাকতে হবে। তবুও নিজের অনুভুতি কষ্ট সব সামলে চলছিলো। এর মধ্যেই ওই **** ***** ফিরে এলো। সোহুর জীবনটা আবারও তছনছ করার চেষ্টা চালালো। সোহু ভেবেছিলো তার পরিবার তাকে সাহায্য করবে, বুঝবে। বুঝে নি। উল্টো ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করতে চায়। এখানে ফিরেও সবার চোখে নিজেকে দোষী দেখে নিজেকে শক্ত করে তুলেছে। এতোটাই শক্ত যে কাছ থেকে দেখলেও বুঝা যায় না কি চলছে ওর মনে। কি হয়েছে তার। এমন ভান ধরে চলাচল করছে যেনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তোকে যে প্রপোজ করলো না? ওটাও নিজেকে শক্ত প্রমান করে। ও তোকে ভালোবাসে মেঘ। সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। সোহু ভয় পায়। ভাবে যদি তুই তাকে রিজেক্ট করে দিস! তাই এমন ভাবে বিয়ে করার কথা বললো যেনো বিষয়টা খুব স্বাভাবিক। বিয়ে না হলেও ব্যাপার না। ও খুব সাধারন ভাবে নিচ্ছে এসব। আসলে এমনটা নয়। শুধুমাত্র সেল্ফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট, সেল্ফ রেসপেক্ট, স্ট্রং হতেই এমন করে বলেছে। ওর ধারনাও ঠিক। আমরা সবাই ভেবে নিয়েছি সোহু হয়তো সিরিয়াস নয় অথবা সে এক্সাইটেড নয়। সোহু বেহায়া হতে চায় না, আবারও কারো দয়ার পাত্রী হতে চায় না মেঘ।’
এটুকুতে থামলো ইমন। মেঘ স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইলো,
‘তুই এতো কথা কি করে জানলি? সোহিনী বলেছে?’
‘না। বললাম না, অর্ধেক বলেছে। বাকিটা আমি জেনেছি।’
কয়েক মুহুর্ত পর মেঘের দিকে তাকিয়ে আকুলতা ভরা গলায় বলে উঠলো ইমন,
‘বিষয়টা যদিও তোর আর সোহুর তবুও না বলে পারছি না। আমি তোদের দুজনেরই বন্ধু। দুজনকেই চিনি। আবদার করতেই পারি! তুই সোহুকে বিয়ে করে ফেল। মেয়েটা খুব ভালোবাসতে জানে। তোর পুরো পরিবারের সাথে মানিয়ে চলতে পারবে। ভীষন ভালোবাসে তোকে। ফিরিয়ে দিস না ওকে। মানছি সোহুর পরিবার তোর পরিবারের মতো অভিজাত নয়, সোহু কালো, তবুও,,,,,,’
ইমনের কথার মাঝেই ঝট করে বলে বসে মেঘ,
‘আমি সোহুকে ভালোবাসি ইমন।’
ইমন চোখ গোল গোল করে তাকালো। অবিশ্বাসী গলায় বললো,
‘সত্যি বলছিস? তুই সোহুকে ভালোবাসিস! কবে থেকে?’
‘সেটা আজকাল থেকে নয় অনেক আগে থেকেই। প্রথমে বলতে পারি নি সংকোচে, তারপর আরাফাতের সাথে ওর সম্পর্কের জন্য, এরপর হুট করেই ওর সুইসাইড এট্যাম্প্টের খবরে ভড়কে গেছিলাম। দুনিয়া অন্ধকার লাগছিলো। এতকিছুর পর সোহু দ্বিতীয় বারের মতো কারো সাথে জড়াবে কি না বুঝে উঠতে পারি নি। আড্ডার মাঝখানে তোদের বিশেষ করে সূর্যের খোঁচাগুলো বিরক্ত লাগে নি কখনো। আসলে সূর্য হয়তো সোহুকে নিয়ে থাকা আমার মনের সুপ্ত অনুভুতির আঁচ করতে পেরেছিলো তাই বার বার মজার ছলে আমাদের বিয়ে করার কথা বলতো। ভেবেছিলাম সময়, সুযোগ বুঝে একদিন সোহুকে বলে দেবো। তার আগেই আমায় অবাক করে দিয়ে ও বললো। আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারি নি। সোহু ঠিক করে কিছু বলে নি বলেই মানতে কষ্ট হচ্ছিলো। মন বলছিলো, এখানে অন্য ব্যাপার আছে। সোহু নিশ্চয় বিশেষ কোনো কারনে আমায় বিয়ে করতে বলছে। ভালোবাসা দূরে থাক ওর পছন্দের তালিকাতেও হয়তো আমি নেই। ভেবেই বসেছিলাম আমি বিয়েতে মানা করলে তার কিছু যায় আসবে না। দিব্যি অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে। তুই ভুলটা ভাঙিয়ে দিলি। থেঙ্ক ইউ সো মাচ দোস্ত! এতদিনে তবে সত্যিটা জানলাম। সোহুও আমায় ভালোবাসে।’
ইমন হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো,
‘সোহুকে কবে জানাচ্ছিস তুই বিয়েতে রাজি?’
‘এখন বিয়ে টিয়ে করছি না দোস্ত। এখন প্রেম করবো। প্রেম প্রেম পাচ্ছে আমার।’
‘সোহু প্রেম করবে?’
‘করতে বাধ্য।’
ইমন হাসলো। মেঘ সন্দিহান গলায় বললো,
‘দোস্ত? তুই তো বলেছিলি ওর বিয়ে ঠিক হচ্ছে। কিন্তু ও তো বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছে। আবার কিসের বিয়ে?’
ইমন মাথা চুলকে বললো,
‘ওর বাবা মাই জানে কেনো বিয়ে, কিসের বিয়ে। আমি তো খবর নিচ্ছিলাম। তখনই জানলাম আবার বিয়ের তারিখ ঠিক হচ্ছে। এবার বোধ হয় সোহুকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে ওরা।’
__________________
বরযাত্রী চরম বিরক্ত, ক্ষুদ্ধ। সেই সাথে অপমানিত। কনের বাবা মায়ের মাথায় হাত। সামিয়া পালিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক আগে অব্দি মেয়ে ঘরেই ছিলো। পার্লারের মেয়েরা সাজিয়ে গুজিয়ে বসিয়ে রেখেছিলো তাকে। সেও বিয়ে নিয়ে খুশি ছিলো। কিন্তু বরপক্ষের আগমনের কিছুক্ষন পর থেকেই জানা গেছে মেয়ে উধাও। সারা বাড়ি খোঁজা হয়েছে। বাড়ির কাছের পুরো এলাকা খোঁজা শেষ। মেয়েকে পাওয়া যায় নি। পাওয়া গেছে তার লিখে রাখা একটা চিঠি। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
“আমায় মাফ করে দিও। এই বিয়ে করতে পারবো না। শাহির ভিসা হয়ে গেছে। এই দুই মাসে চাকরিও যোগার করে ফেলেছে শাহি। আমি তার সাথে চলে যাচ্ছি। আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব রেডি। ডক্টর তাহিরের বাড়ি থেকে দেয়া লাগেজটাই নিয়ে যাচ্ছি। খোঁজে লাভ নেই। রাত দুটোর ফ্লাইটে দেশের বাইরে চলে যাবো। কোথায় যাচ্ছি বলতে পারলাম না, শাহি মানা করেছে। আল্লাহ্ হাফেজ!”
চিঠি পড়ে মাথা চাপড়ালেন সামিয়ার বাবা। সামিয়ার মা কেঁদে কেঁদেই বললেন,
‘ওই ছেলের তো চাকরি বাকরি কিছুই হয় নি। মিথ্যে বলেছে আমার মেয়েকে। আমার সাদাসিধে মেয়েটাকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিয়ে চলে গেলো! ওকে কিছু করে না দেয় ওই গুন্ডা ছেলে। ওগো? আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনো!’
তাহিরের মামা আক্রোশ নিয়ে বললেন,
‘রাখুন তো! সাদাসিধে মেয়ে! আপনাদের মেয়ে কি বাচ্চা যে একটা ছেলে বললো আর ও বিশ্বাস করে চলে গেলো? নিশ্চয় আগে থেকে পরিকল্পনা করেছিলো এসবের। ছি ছি! এখন কোন মুখ নিয়ে বাড়ি যাবো আমরা? আপনাদের মেয়ে তো আমাদের সবার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিলো একেবারে। আবার চিঠি লিখেছে! বিদেশ যাওয়ার লোভে আমার সোনার টুকরো ভাগ্নেকে এভাবে অপমান! তা তো মানা যায় না। আমি আপনার বিরুদ্ধে কেইস করবো। মান হানির মামলা করবো। আপনার মেয়ে যার সাথে পালিয়েছে তাকে শুদ্ধ জেলে পুরবো। কতো বড় বুকের পাটা! বিয়ের আসর থেকে মেয়ে পালায়।’
তাহির ধীর গলায় বললো,
‘সামিয়া যার সাথে পালিয়েছেন তার সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে আপনারা জানতেন না?’
সামিয়ার বাবা মাথা দুলালেন। বললেন,
‘এক নাম্বারের ধান্দাবাজ ছেলে। আমার মেয়েটা ফাঁসিয়েছে। দু মাস আগে হওয়া বিয়েটা ওই ছেলের কথায় পিছিয়ে এনেছে আমার মেয়ে। ছেলেটাকে শর্ত দিয়েছিলো দুই মাসে যেনো চাকরি যোগার করে। আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। পারে নি। ওই গর্দভ, অশিক্ষিত ছেলে কিছুই করতে পারে নি। সামিয়া বিয়েতে রাজি হয়। শাহির সাথে সব সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলে। আমরা ভেবেও পাই নি এমন কিছু ঘটতে পারে। ওই ছেলে আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে।’
তাহিরের মামা গর্জে উঠলেন,
‘থামুন মশাই। সব শুনে তো মনে হচ্ছে আপনারাই লাই দিয়েছেন আপনাদের মেয়েকে। অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন কি করে এই বিয়েতে মত দিলেন আপনারা? মেয়ে পালাবে না তো কি করবে? তাও তো ভালো বিয়ের আগে পালিয়েছে। যদি বিয়ের পর পালাতো? তবে? কোনো কিডন্যাপিং ফিডন্যাপিং হয় নি আপনার মেয়ে। চিঠিতে স্পষ্ট করে লিখে দিয়েছে ও পালাচ্ছে। ইশ, কি একটা অবস্থা! কি করে যে ছেলের মাকে মুখ দেখাবো! আপা হার্ট অ্যাটাক না করেন আবার!’
মোজাম্মেল সাহেব নিরব দর্শকের কাতারে রয়েছেন। হিমিকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে ঘাড় নিচু করে বললেন,
‘হাসছিস কেনো? সার্কাস হচ্ছে এখানে?’
হিমি জবাব দিলো না। ঠোঁট টিপে হাসছে। মোজাম্মেল সাহেবের সন্দেহ হলো। তিনি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
‘এসবে কোনো ভাবে তুই জড়িত না তো?’
হিমির হাসি চওড়া হলো। মোজাম্মেল সাহেবের চোখ দুটো রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় হয়ে গেলো। তিনি চোখ ঝাঁপটালেন। ঢোক গিলে বললেন,
‘কি করেছিস মা?’
‘বেশি কিছু করি নি। সামিয়াকে পালাতে সাহায্য করেছি। আর পালানোর আগে ওকে বুঝিয়েছি।’
‘কি বুঝিয়েছিস?’
‘বুঝিয়েছি ওর এই বিয়েটা করা উচিত নয়। শাহির সাথে অন্যায় হচ্ছে। ওর উচিত একটা চিঠি লিখে শাহির হাত ধরে পালানো। শাহিকে বিয়ে করে ফেলা।’
‘তারমানে কনেকে ভুজুম ভাজুম তুই দিয়েছিস!’
‘হ্যা।’
‘কি সাংঘাতিক! ওরা কোন দেশে যাচ্ছে?’
‘কোনো দেশে যাচ্ছে না তো। ইন ফ্যাক্ট ওরা এই শহরেই আছে।’
‘বলিস কি! তবে যে চিঠিতে লিখা দুটোয় ফ্লাইট! ছেলের চাকরি, ভিসা হয়েছে!’
‘ওগুলো তো আমি লিখিয়েছি।’
‘তুই?’
‘হ্যা।’
‘চিঠির সব কিছু সব মিথ্যা?’
‘সব মিথ্যা।’
‘এই যা! ছেলের চাকরি বাকরি নেই?’
‘উহু, বেকার। বেকার বলেই সামিয়া মেনে নিচ্ছিলো না। আমি দুজনকে এক করে দিয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওরা বেরিয়ে আসবে। তারপর শাহিকে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দিতে হবে। প্রবলেম সল্ভ!’
চলবে,,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৫.
‘তোকে কে বলেছে প্রবলেম সল্ভ করতে?’
‘কেউ বলে নি তো, নিজ দায়িত্বে করছি। আমি না কালই জানতে পেরেগেছিলাম যে বিয়েটা দুমাস পিছানো হয়েছে। কনেই পিছিয়েছে। সন্দেহ হলো। এখানে আসার পর তাই সোজা কনের সাথে কথা বলতে গেছিলাম। একটু চেষ্টা করতেই বলে দিলো সব। আমিও তাই তাকে তার প্রেমিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম। এবার আর বিয়ে হবে না। বাচ্চা ডাক্তার আমার ফোন উঠাবে, কথাও বলবে। দেখাও করবে। দারুণ না?’
মোজাম্মেল সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘মনের ডাক্তার যাতে তোকে সময় দেয় তাই এই কান্ড ঘটালি?’
‘হ্যা। তুমিই না বললে কাল রাতে!’
‘আমি? আমি আবার কি বললাম?’
‘বললে তো, এখনো সময় আছে। বুঝতে হবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে বাচ্চা ডাক্তার আমাকে না ভুলে যায়। আমাকেই কিছু করতে হবে। ভাবতেও তো বলেছিলে!’
‘আর তুই সারারাত ভেবে এই পন্থা অবলম্বন করলি?’
‘করলাম।’
মোজাম্মেল সাহেব শব্দ করে মুখ ভর্তি শ্বাস ছেড়ে অস্বস্তি জ্ঞাপন করলেন। হিমির চেহারায় তখনও হাসির ঝলক। উনি বুঝতে পারলেন উনি যা ভাবছিলেন হিমি তা ভাবে নি। এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানও তার নেই। থাকলেও হিমি ভাবতে চায় নি। বাচ্চামো করছে। এবং ইচ্ছে করেই করছে। মোজাম্মেল সাহেব হতাশ হলেন ভাইঝির কাজে।
এদিকে তাহিরের বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয় নিয়ে বর কনের আসার অপেক্ষায় মায়মুনা জামান। গল্প গুজব, কনের গুণ নিয়ে দারুণ আলোচনা চলছে। সবাই হাসি খুশি আছেন। কনের বাড়িতে ঘটে যাওয়া আকস্মিক অনাকাঙ্খিত ঘটনা এখনো তারা জানেন না। কেউ জানায় বলেই জানেন না। দিব্যি খাওয়া দাওয়া করছেন সবাই। হাসি ঠাট্টা করছেন। আত্মীয়রা মায়মুনা জামানকে হাসতে দেখছেন বহু বছর পর। ভদ্রমহিলার জীবনে খুশি হওয়ার কারন খুব একটা আসে নি। শেষ যৌবনে হেসে ছিলেন হয়তো। মাঝে মাঝে যাও তাহিরের কাজে খুশি হন তবুও তখন ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিত হাসি দেখা গেছে। এমন প্রফুল্ল ছিলো না সেই হাসি। আজ ছেলের বউ ঘরে আসছে এই কারনটাও অত্যধিক খুশি হওয়ার কিছু নেই। বরং ছেলে আঁচল ছাড়া হচ্ছে বলে দুঃখী হতে পারতেন। তা না করে তিনি হাসছেন। এক মুহুর্তের জন্যও হাসি সরছে না ওনার। হয়তো ছেলেকে নিজের মন মতো তৈরী করতে পেরেছেন বলেই এই খুশি। অথবা নিজের মতো চালনা করতে পেরে খুশি।
অন্যদিকে বেশ অনেকক্ষন বিচার বিবেচনা করে একই আসরে তাহিরের বিয়ে ঠিক হলো। কনে হিমি। এসব কিছুর পেছনে সয়ং মোজাম্মেল রহমানের হাত রয়েছে বুঝতে পেরেছে হিমি।
‘কথা বাড়াবি না হিমি। অনেক কষ্টে সবাইকে রাজি করিয়েছি।’
হিমি রাগান্বিত গলায় বললো,
‘কে বলেছে রাজি করাতে? রাজি করিয়েছো কেনো?’
‘তো করাবো না? বিয়ের আসরে বিয়ে না হলে বর পক্ষের কতবড় অপমান হয় তুই জানিস? একে তো নিজে যেচে পরে ছেলেটার বিয়ে ভাঙলি। এখন নতুন করে যখন সব ঠিক হচ্ছে সেটাও গুড়িয়ে দিচ্ছিস। কি চাইছিস তুই?’
‘আশ্চর্য! আমি বিয়ে করতে রাজি কি না সেসব না জেনেই আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো কি করে?’
‘তোকে সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম। বাবা তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখছেন না। তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
হিমি আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমি জানি না!’
‘বাবা বলেছিলেন তোকে বলতে। আমি বলি নি।’
‘কেনো বলোনি?’
‘কারন আমি জানি তুই বিয়েটা করবি না।’
‘করবো নাই তো!’
‘কিন্তু বাবা তোর বিয়ে দিয়ে ছাড়বেন।’
‘তোমার বাবা বললো আর তোমরা মেনে নিলে?’
‘তোর বাবাও তো মত দিয়েছে।’
‘আমার বাবা মত দিয়েছে! তারমানে আমার মতামত জানার দরকার পরলো না?’
‘উহু পরলো না। যেমন তুই মিশ্মির মতামত না জেনেই নিহানের সাথে বিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিস তেমনি বাবাও তোর মতামত জানতে ইচ্ছুক নন।’
হিমি মুখ ছোট করে ফেললো। তার এখন যেমন অনুভুতি হচ্ছে মিশ্মির নিশ্চয় এর থেকেও বেশি খারাপ লাগছিলো! ইশ বুঝলো না কেনো তবে মিশ্মির ইচ্ছে? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে অসহায় গলায় হিমি বলে উঠলো,
‘জ্যাঠুমনি আমি বিয়ে করবো না।’
‘তুই না চাইলেও জোর করে বিয়ে দেয়া হবে হিমি। হয় বাবা অসুস্থতার দোহাই দিয়ে, নয়তো তোর বাপের হার্ট অ্যাটাকের কথা বলে। এর থেকে ভালো মনের ডাক্তার। তুই ওকে বিয়ে কর। তোদের দরকারের সম্পর্ক বদলে যাবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে। সারাদিন রাত কথা বলতে পারবি। দুজন দুজনের সমস্যা মিটাতে পারবি। ভালো থাকবি।’
‘তুমি বাচ্চা ডাক্তারের মা কে চেনো না জ্যাঠুমনি। ভীষন বজ্জাত থুক্কু বদরাগী মহিলা। আমার সাথে একবার ধাক্কা লেগেছিলো কি বকাই না দিলো! খালি বকা? হুহ, বাবার চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলেছিলো। আবার আমার মুখোমুখি হলে জান নিয়ে নিবে। আমি পারবো না।’
মোজাম্মেল সাহেব উজ্জল চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘বাহ! শাশুড়ির সাথে আগে থেকে পরিচয় আছে দেখছি। দারুণ! দারুণ! এটাকে নিয়তি বলে। সবার সাথেই আগে থেকে আলাপ রয়েছে। এদিকে আমরা ছেলের মাকে না চিনলেও বাবাকে চিনি। আর কি লাগে? যা তৈরি হয়ে নে।’
‘জ্যাঠুম,,,,,’
হিমির কথার মধ্যেই মোজাম্মেল সাহেব তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলেন। কললিস্ট চেইক করতে করতে দুজন মেয়েকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। বললেন,
‘কনেকে নিয়ে যাও তো মা। রেডি করাও গিয়ে।’
‘আমি যাবো না। তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো জ্যাঠুমনি।’
‘বেশ করছি।’
হিমি ম্যাকি কান্না করে বলে উঠলো,
‘আমি কিন্তু বড়সড় কিছু ঘটিয়ে দেবো!’
‘যা ঘটিয়েছিস তার থেকে বড় আর কিছু ঘটানোর নেই। (ফিসফিস করে বললেন) এরা যদি জানে তুই কাঠখড় পুরিয়ে বিয়ের কনেকে ভাগিয়ে দিয়েছিস তাহলে কি হবে বুঝতে পারছিস? কান্নাকাটি না করে গিয়ে বিয়ে কর। মনের ডাক্তারের যেখানে আপত্তি নেই সেখানে তোর কিসের আপত্তি? যা যা। দেরি করিস না। আমি তোর মামুকে বলে দেই তোর বিয়ে হচ্ছে।’
…………………………
শোবার ঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন হানিফ শরীফ। কদিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছে না। বদ হজম হচ্ছে। কিছু খাওয়ারও রুচি নেই। মন মেজাজ বিগড়ে থাকছে সবসময়। ভালো কাজেও বিরক্তি অনুভব করছেন তিনি। রাত আটটা হলেই রাতের খাবার খেয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পরেন। এক দেড় ঘন্টা টানা হেঁটে ঘরে ফিরে সোজা ঘুম দেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। তবে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ফোন বেজে উঠায় বিরক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সোজা হয়ে বসে ফোন করা ব্যক্তিকে গালি দিতে দিতে স্ক্রিনে তাকান। হিমি ফোন দিচ্ছে দেখে মুখের গালিগুলো গিলে নিলেন। অবচেতন মনে দেয়া গালিকেও ফিরিয়ে নিলেন। হাসি হাসি মুখে ফোন উঠাতেই পুরুষালী গলা শোনা গেলো। হানিফ শরীফ তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘কে বলছেন?’
‘আমি। মোজাম্মেল রহমান। হানিফ ভাই বলছেন?’
‘জি বলছি।’
‘এই সময় ফোন দিয়ে বিরক্ত করতে চাই নি। কিন্তু না করেও উপায় নেই। একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা না বললেই নয়।’
‘বলুন তবে।’
‘হিমির বিয়ে।’
হানিফ শরীফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘জানি। মুহিব ভাই সেদিন জানিয়েছিলেন। ছেলে ইন্জিনিয়ার। ছেলের ছবি পাঠিয়েছেন। দেখি নি আমি। ইচ্ছে করে নি। হিমি রাজি থাকলেই হলো।’
‘হিমি রাজি নয়। তাই আজকেই ওর বিয়ে দিচ্ছি।’
‘রাজি না হলে বিয়ে দিচ্ছেন কেনো? আজকে দিচ্ছেন এর আবার কি মানে?’
‘মানে হলো বাবার পছন্দ করা ছেলেকে হিমি বিয়ে করছে না। আমি হিমির বিয়ে দিচ্ছি। আজ এবং এক্ষুনি।’
মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো হানিফ শরীফের। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ঘর্মাক্ত মুখ মুছে নিয়ে মনোযোগী হলেন ফোনে। মোজাম্মেল সাহেব বললেন,
‘ছেলে ডাক্তার। সাইকিয়াট্রীস্ট। হিমির পরিচিত। আজ ছেলের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। হিমি মেয়েকে ভাগিয়ে দিয়েছে।’
‘হিমি মেয়েকে ভাগিয়ে দিয়েছে! কেনো?’
‘কারন জটিল। এই মুহুর্তে বলতে পারছি না। সময় করে বলবো। আপাতত হিমির সাথেই বিয়ে হচ্ছে ডাক্তারের।’
‘হিমি ওই ডাক্তারকে বিয়ে করছে?’
‘রাজি হচ্ছে না। তবে আমি ওকে সাজাতে পাঠিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হিমি সাজবে না। শাড়িও পরবে না।’
‘তাহলে?’
‘প্যান্ট শার্ট পরেই বিয়ে করবে। এই বিয়ে থেকে পিছু হটতে পারবে না বলেই বিয়ে করবে। প্রথমবার কোনো বাঙালি মেয়ে প্যান্ট শার্ট পরে বিয়ে করছে দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। নয়?’
‘না।’
‘আপনি কি রেগে যাচ্ছেন?’
‘রাগছি না তবে বিরক্ত হচ্ছি। এভাবে হুট করে ভাগ্নীর বিয়ে হচ্ছে আমি মেনে নিতে পারছি না।’
‘মানতে তো হবেই। যাই হোক আপনারা বেরিয়ে পরুন।’
‘এড্রেস দিন। আসছি।’
‘কিসের এড্রেস?’
‘যেখানে বিয়ে হচ্ছে সেখানের। নাহলে আসবো কি করে? আমরা তো ঠিকানা জানি না।’
‘আপনারা এখানে আসবেন না। আমি মেয়ের বিয়ে দিয়ে ওকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেবো। এখানে আপনাদের কোনো কাজ নেই।’
কিছুটা স্তম্ভিত হলেন হানিফ শরীফ। বললেন,
‘তাহলে কোথায় আসতে বলছেন?’
‘আমাদের বাড়ি।’
‘কেনো?’
‘আপনি মামা হয়ে ভাগ্নীর বিয়ে মেনে নিতে পারছেন না মুহিব বাবা হয়ে কি করে পারবে? বাবাও রেগে যাবেন। আপনাকে সামলাতে হবে সব।’
‘আমায় কি করতে বলছেন?’
‘বেশি কিছু না, পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়ি যাবেন। বসার ঘরে সবাইকে জড়ো করে হিমির বিয়ের ঘটনার বর্ণনা করবেন। এবং সবার মতোই আমার ঘাড়ে দোষ চাপাবেন। আমার স্ত্রী আমিনা কান্নাকাটি করে জ্ঞানও হারাতে পারে। আপনি তবুও থামবেন না। বরং বাবার সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে বকা ঝকা করবেন। পারলে দু একটি গালিও দিবেন। মুহিব কিছু বলবে না। ওকে বলতে বাধ্য করবেন। ততক্ষনে আমি বাড়ি পৌঁছে যাবো। এরপর আবারও আমাকে দোষারোপ করবেন। সবাইকে শান্ত করে তারপর আমি আমার পক্ষ রাখবো। তখন আপনি আমার সাইড নিবেন। আমার সাথে তাল মিলিয়ে ‘হিমির ভালো হয়েছে’ এমন টাইপ কথা বলবেন। এভ্রিথিং উইল বি পার্ফেক্টলি অলরাইট।’
হানিফ শরীফ তব্দা খেয়ে গেলেন মোজাম্মেল সাহেবের কথায়। বাকরুদ্ধ হয়েগেলেন কিছুক্ষনের জন্য। মোজাম্মেল সাহেব নিরাশ গলায় বললেন,
‘যা বলেছিলাম! হিমি প্যান্ট শার্ট পরেই আছে। মেক আপ নেই। বিয়ের কনে এভাবে বিয়ে করবে? বিশ্বাস হয় না। এই মেয়েটা কিছুই শিখলো না। নিজের বিয়ের দিন এমন একটা লুক! অ্যালবামের বারোটা বাজিয়ে দিলো এই মেয়ে। রাখছি। আপনি বেরিয়ে পরুন।’
হানিফ শরীফ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও খাটে বসলেন। বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস উঠিয়ে চুমুক দিলেন পানিতে। হতাশা নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলে হালকা সোনালী রঙের পাঞ্জাবী বের করে পরলেন। ওখানে গিয়ে কি কি বলবেন তার একটা লিস্টও মনে মনে ঠিক করে নিলেন হানিফ শরীফ। হিমির জন্য মন কেমন করতে লাগলো ওনার। একটাবার ওর সাথে কথা হলে ভালো হতো। মেয়েটা হয়তো ভয় পাচ্ছে। হয়তো কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো বা রাগ করছে। মোজাম্মেল সাহেব বরের ব্যাপারে কিছু বললেনও না। জানা উচিত ছিলো। ছেলে, তার পরিবার সবাই ভালো তো? হিমিকে মেনে নেবে? হিমি ওদের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে? এখানের মতো ওখানেও অপমানিত হবে না তো হিমি? বুক ভেদ করে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো হানিফ শরীফের। না বোনের বিয়েতে থাকলেন আর না বোনের মেয়ের। বোনের সংসার টিকেও টিকলো না। তিনিও দেখলেন না। হিমির বেলায় একই জিনিস না ঘটে আবার। বুক ভারি হয়ে আসে হানিফ শরীফের। প্রশ্ন জাগে মুহিব রহমান কি করে নেবেন মেয়ের বিয়েটা?
চলবে,,,,,,,