হিমি পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
925

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৪০.

উন্মুক্ত মাঠে ঘাসের উপর পা লম্বালম্বি করে বসে আছে সূর্য। তার পাশেই ফোনে মগ্ন ইমন। দোহা গালে হাত রেখে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন সময় তাদের সাথে যোগ দিলো হিমি। হাটু ভাজ করে বসেই ভ্রু নাচালো সে। সূর্য সোজা হয়ে বসে পা ভাজ করলো। দু তিনটে ঘাস ছিড়ে হাতের মধ্যে পিষতে পিষতে বললো,

“মুখে কথা ক। মাইয়াদের চোখের ভাষা বোঝার লাইগা আমার জন্ম হয় নাই।”

হিমি দাঁত খিঁচে সূর্যের পিঠে চড় বসালো। ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“ওই ইমন? ফোন রাখ। আড্ডা দিতে আসলাম আর তোরা এক একজন এক এক কাজে বিজি? বাকিরা ক‌ই?”

ইমন ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বললো,

“প্রেম করে।”

হিমি আশ্চর্যান্বিত গলায় বলে,

“কার সাথে?”

সূর্য হাই তুলে গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চুলকে বলে,

“দুইজন দুইজনার লগে প্রেম করে। বুঝিস না?”

হিমি গোল গোল চোখ করে দোহার দিকে তাকায়। দোহা ভাবলেশহীন হয়ে হিমিকে দেখে লম্বা শ্বাস ফেলে। সূর্য বাঁকা হেসে ছোট ছোট ঘাস ছিড়ায় মন দেয়। যেনো এই কাজটা খুব‌ই গুরুত্বপূর্ণ। এই খা খা রোদে বসে থাকার কারনটাও ঘাস ছিড়া। ইমন গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে ফোন পকেটে পুরে বিজ্ঞ বিজ্ঞ গলায় বলে,

“দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ একে অন্যের প্রেমে পরবে স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক ঘটনা আরো বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠে যখন ওরা দুজন‌ই বন্ধু হয়। বলা হয়, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনোই শুধু বন্ধু হতে পারে না। তারা প্রেমে পরবেই। মেঘ আর সোহুর ব্যাপারটাও এক। ওরাও প্রেমে পরেছে। দেরি হয়েছে তবে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। এই স্বাভাবিক বিষয়টা এতো অস্বাভাবিক ভাবে নেয়ার কিছু নেই। আর না এতো ভাবার আছে। যা হয়েছে মেনে নে। শান্ত হো। খুব শিঘ্র‌ই ওদের বিয়ে। দাওয়াতের অপেক্ষা কর। বেশি ভাবিস না। চিল!”

হিমির চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

“সত্যি সত্যি ওরা প্রেম করছে?”

“না। সোহু প্রপোজ করেছে শুধু। মেঘ কিছু জানায় নি।”

দোহার কথায় চরম অবাক হলো হিমি। অবিশ্বাসী গলায় বললো,

“সোহু প্রপোজ করেছে?”

“হ্যা।”

হিমি হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো,

“অসম্ভব।”

“জগতে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সব‌ই সম্ভব। এটাও সম্ভব হয়েছে।”

হাসি থামিয়ে দোহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো হিমি। কৌতুহলী গলায় বললো,

“কি করে?”

“কি করে জানি না। তবে এটা হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীন সোহুকে খুব ছন্নছাড়া টাইপ লাগছিলো। গুমোট ভাব ধরে ছিলো। শেষ পরীক্ষার দিন কাউকে কিছু না বলে দুম করে বাড়ি চলে গেলো। দুদিন পর ফিরে এসে সোজা প্রপোজ করলো মেঘকে। ক্যাফে তে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। তোদের দুজনের‌ও থাকার কথা ছিলো সেখানে। তুই তো এলি না তবে সোহু এসেছিলো। কারো সাথে কথা না বলে মেঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিলো, ‘মেঘ আমায় বিয়ে করবি?’ আমরা সবাই থ বনে গেছি ওর কথায়।”

“মেঘ কি বললো?”

“কিছু বলে নি। আমাদের মতোই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো মে বি! সোহু অবশ্য মেঘের উত্তরের অপেক্ষাও করে নি। নিজে থেকেই বললো, ‘আমি জানি আমি কালো কিন্তু অসুন্দর ন‌ই। বিয়ের পর যদি তোর মনে হয় আমার মতো বিশ্রী দেখতে একটা মেয়েকে বিয়ে করে তোর জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাহলে কিন্তু আমি তোকে ছেড়ে কথা বলবো না। যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ভেবে চিন্তে নে। সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারবি তখন‌ই জানাবি। আমি অপেক্ষায় থাকবো।’ আমরা অবাক হয়ে দেখছিলাম সোহুকে। তবে মেঘের কোনো ভাবান্তর হয় নি। সোহুকে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো, ‘তুই আমায় ভালোবাসিস?’ সোহু স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘জানি না। বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তাই তোকে বললাম। করতে হলে জানিয়ে দিস। তোর উত্তর যদি না‌‌ও হয় তবুও চাপ না নিয়ে আমায় বলে দিস। আমার কষ্ট হবে না মোটেও। তোকে না পেলে যে আমি মরে যাবো বা তোর পেছনে ঘুরঘুর করবো তেমনটা নয়। আবার তোকে হুমকি ধমকি দিয়ে নিজের করবো তেমনটাও নয়! নতুন পাত্র খুঁজবো জাস্ট। বিয়ে করার তাড়া নেই, পাত্র হাতের নাগালে রাখা ভালো। তুই ভাব। তোর পরিবারকেও বল ভাবতে। তোর পরিবারের মত ছাড়া বিয়েটা হবে না। বাড়ি গিয়ে আলোচনা করিস বিষয়টা নিয়ে। আমার ছবি তো তোর কাছে আছেই। দরকার পরলে সামনা সামনিও দেখাতি পারবি আমায়। আমার সমস্যা নেই।’ ব্যস।”

হিমি চোখ কপালে তোলে বললো,

“সোহু এসব বললো?”

“বললো।” (সমস্বরে জানালো বন্ধুরা)

“তারপর মেঘ কি বললো?”

“কিছু বলে নি। উঠে চলে গেছে।”

“কোথায় গেছে?”

“হয়তো বাড়িতে, বলতে পারছি না।”

“আর সোহু?”

সূর্য নাক দিয়ে শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বললো,

“সোহু কলেজ লাইব্রেরী থেকে এক গাদা ব‌ই নিয়ে চলে গেছিলো সেদিন। আর দেখা পাই নি। ফোন রিসিভ করছে না। আগের ফ্ল্যাটে নেই এখন।”

হিমি ভ্রু কুঁচকে বললো,

“এসবের মধ্যে প্রেমের কথা আসছে কোত্থেকে? মেঘ কি জবাব দিলো না দিলো সেসব কিছুই তো জানিস না তোরা। কি করে বুঝলি ওরা প্রেম করছে?”

কাউকে বলতে না দিয়েই দোহা বলতে লাগলো,

“ওসব ওদের কল্পনা হিমি। জানিস ওরা কি কল্পনা করছে?”

হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। দোহা বললো,

“ওরা কল্পনা করছে সোহু আর মেঘ এই মুহুর্তে কোনো এক নদীর পারে বসে আছে। কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে তারা নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে মন প্রাণ জুড়াচ্ছে। সোহিনীর গায়ে লাল শাড়ি, খোঁপায় ফুল, হাতে চুড়ি, পায়ে আলতা, কপালে লাল টিপ, চোখে গাঢ় কাজল। মেঘ পরে আছে লাল রঙের পাঞ্জাবি। সোহিনীর মেঘের কাধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করছে। মেঘ তার এক হাত আকড়ে ধরে সান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ওরা ওখানে নেই।”

“তাহলে ওরা কোথায় আছে দোহা ম্যাডাম?”

ইমনের খোঁচা দিয়ে বলা কথায় ঠোঁট চ‌ওড়া করলো দোহা। বললো,

“মেঘ এখন নিজের ঘরে দরজা আটকে ঘুমাচ্ছে। আর সোহিনী অনুজ্জ্বল রঙের কোনো এক শাড়ি পরে এক টিউশনি থেকে অন্যটায় দৌড়চ্ছে। এই মুহুর্তে ঘামে ভিজে গেছে সে। তবুও রোদের মধ্যে হেটে হেটে যাওয়া আসা করছে। গট ইট?”

_________________

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের আধার নেমেছে। খাটে শরীরের উপরের অংশ এলিয়ে দিয়ে বাকি অংশ খাটের নিচে রেখে সিলিংএর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে হিমি। তার মাথার কাছে কিছুটা তফাতে বসে আছেন মোজাম্মেল সাহেব। বেশ অনেক্ষণ ধরেই তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা বলা যায় না ঠিক, প্রশ্ন উত্তর পর্ব। মোজাম্মেল সাহেব একের পর এক প্রশ্ন করছেন আর হিমি তার জবাব দিচ্ছে। যদিও সে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না তবে মোজাম্মেল সাহেব থেমে নেই। হিমির থেকে এই রহস্যের উদ্ধার করেই ছাড়বেন তিনি।

“বিয়ে কবে?”

“জানি না।”

“ও বলে নি?”

“কার্ড দিতে চেয়েছিলেন। আনি নি।”

“কেনো?”

“বিয়েতে যাবো না তাই আনি নি।”

“বিয়েতে কেনো যাবি না?”

“কারন আমি বিয়ে, ফাংশন এগুলোতে যেতে পছন্দ করি না।”

ঝংকার দিয়ে বললো হিমি। মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁট গোল করে আওয়াজবিহীন ‘ও’ বললেন। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন,

“বন্ধুর বিয়েতে যাবি না?”

হিমি শীতল চোখে তাকালো। মোজাম্মেল সাহেব উত্তর জানতে হিমির দিকে তাকিয়ে।

“উনি আমার বন্ধু নন।”

“তবে ‘উনি’ তোর কে?”

‘উনি’ শব্দটা ইচ্ছে করেই জোর দেয়া গলায় বললেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমি উঠে বসলো। দ্রুত নিঃশ্বাস টানছে সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপক রেগে গেছে হিমি। মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁট টিপে হাসলেন। গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন,

“বললি না তো ‘উনি’ তোর কে হয়?”

“কেউ হয় না।”

“তাহলে এতো উত্তেজিত হচ্ছিস কেনো? বিয়ে হচ্ছে হোক। তাতে তোর কি?”

হিমি বিরবির করে বললো,

“আমার কিছু না? নাই তো, আমার আবার কি? উনার ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করছেন। আমায় তো ইনভাইট‌ও করেছেন। বোকার মতো ইনভিটেশন কার্ড না আনা উচিত হয় নি। আমার উচিত ছিলো কার্ড আনা। বিয়েতেও যাওয়া। বর ব‌উকে গিফ্ট দেয়া। তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করা। শুভ কামনা জানানো।”

“ঠিক তাই।”

হিমি কেঁপে উঠলো। এতো আস্তে বলা কথাটা জ্যাঠুমনি শুনে ফেললো? হিমি কি তবে জোরে কথা বললো? বুঝতে পারলো না সে। যদিও মোজাম্মেল সাহেব তাকে বুঝার প্রয়োজনীয় সময় দিয়েছেন। হিমি চুপ করে মনে মনে কিছু ভাবলো। মোজাম্মেল সাহেব উঠে এসে হিমির পাশে বসলেন। হাত দুটো মুঠো করে দু পায়ের মাঝে রেখে স্থির চোখে সামনে তাকালেন। নীল রঙা দেয়াল সামনে। দেয়ালে কিছুই নেই। তবুও ওরা দুজন ওদিকে তাকিয়ে র‌ইলেন। বেশ খানিকটা সময় পর মোজাম্মেল সাহেব স্মিত গলায় বললেন,

“ভেবেই যখন ফেলেছিস তখন মনের ডাক্তারের কাছ থেকে বিয়ের কার্ড আন।”

“এখন বললে দেবে?”

“না দিলে জোর করে আনবি। ছিনতাই করবি। তবুও আনবি।”

“তোমার কি মনে হয়? আমার ওনার বিয়েতে যাওয়া ঠিক হবে?”

“বিয়েতে না যাওয়াটাই বরং বেঠিক হবে। ভুল হবে।”

“জ্যাঠুমনি? ওনার বিয়েতে কিন্তু আমি একা যাবো না! তুমিও যাবে আমার সাথে।”

“কেনো? তুই একা গেলে কি সমস্যা?”

“অনেক সমস্যা। আমার অস্বস্তি হবে। ওখানে তো বাচ্চা ডাক্তার ছাড়া আর কাউকেই চিনবো না। যদি কিছু ভুল ভাল করে ফেলি?”

“করবি না। তবুও তুই চাইলে যাবো। দরকার পরলে পুরো পরিবার নিয়ে যাবো। তোর মামুদের সবাইকে নিয়ে যাবো।”

হিমি ভড়কে গেলো। বললো,

“সবাইকে নিয়ে কেনো যাবে? আজব! ‌আমি তুমি ছাড়া আর কেউ যাবে না।”

“আচ্ছা।”

শিশুশুলভ গলায় বললেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমি দ্বিধান্বিত গলায় বললো,

“ওইদিন মানা করলাম আর আজ যেচে ইনভিটেশন আনবো? খারাপ দেখাবে না?”

মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁটে হাসি ফুটালেন। হিমির দিকে ফিরে বললেন,

“মনের ডাক্তারের সাথে তুই কখনো মেপে কথা বলিস নি। তাহলে কেমন দেখাবে সেই প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? যে সম্পর্কে ফরমালিটি নেই সে সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে এতো ভাবছিস কেনো? যা মন বলে কর। ছেলেটা তো মনের ডাক্তার! তোর মন ভুল বললেও সারিয়ে দেবে, চিন্তা নেই। কাল সকালেই চলে যাস। নাহলে দেরি করলি আর পরে দেখা গেলো তুই যখন বিয়ের তারিখ জানতে গেলি সেদিন‌ই বিয়ে!”

কথাটা বলেই উচ্চস্বরে হাসলেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমি চোখে মুখে থমথমে ভাব বজায় রেখে বসে র‌ইলো।

চলবে,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৪১.

সারাদিনের ব্যস্ততার পর সবে গোসল সেরেছে তাহির। ঘরময় ফর্সা আলো জ্বলছে। বাড়িতে মেহমান, ডেকোরেটার্সদের লোকজন। থেকে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। ভেজা চুলে হাত ডুবিয়ে টেবিলে রাখা কফির কাপ হাতে উঠালো তাহির। কাপে এক চুমুক দিতেই দরজায় প্রবল ভাবে থাবা দিতে লাগলো কেউ। তাহির ভ্রু কুঁচকালো। এতবার কড়াঘাত করতে হবে কেনো? খুলবেই তো সে। ধীরে সুস্থেও ডাকা যায়! ‌এমন ভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে যেনো এই মুহুর্তে দরজা না খুললে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে পরবে। এক মিনিটের জন্য‌ও নিস্তার নেই। কোথায় আরাম করতে এলো, এখনি ডাক পরলো! কার আবার দরকার পরলো? ভাবনার মাঝেই দরজার ওপাশের ব্যক্তি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। একনাগারে দরজায় বারি লাগাচ্ছে। তাহির গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে দরজার লক খুললো। সাথে সাথেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকলো হিমি। তাহিরকে দ্বিগুন অবাক হ‌ওয়ার সুযোগ করে দিয়ে খাটে বসে পরলো। ঠোঁট প্রশস্ত করে বললো,

“কেমন আছেন বাচ্চা ডাক্তার?”

তাহির অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে হিমিকে দেখছে। সম্পূর্ণ বিষয় বুঝতেই তার কয়েক মিনিট লেগে গেলো। অপ্রস্তুত গলায় বললো,

“আপনি এখানে কি করে?”

“হেঁটে হেঁটে!”

“বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলেন?”

“যেভাবে পাওয়ার পেয়েছি। সেটা না জানলেও চলবে।”

“কেনো এসেছেন সেটা তো জানতেই পারি?”

“পারেন। তবে আমার মনে হয় আগে দরজাটা লাগানো উচিত।”

হিমির কথায় হুশ এলো তাহিরের। ঝটপট দরজা আটকে ফিরে এলো হিমির সামনে। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো এখানে আসার কারন। হিমি জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো ঘরটায় চোখ বুলালো। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে স্টাডি টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। কফি কাপে চুমুক বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“নিচে কেউ আপনাকে দেখে নি?”

হিমির সরল জবাব,

“দেখেছে।”

আঁতকে উঠা গলায় প্রশ্ন করলো তাহির,

“কেউ কিছু জানতে চায় নি?”

“কি জানতে চাইবে?”

“আপনি কে? কেনো এসেছেন? কার সাথে দেখা করতে চান? এসব!”

“না।”

“কেনো?”

“নিচে আপনার বিয়ে উপলক্ষ্যে ডেকোরেটিং চলছে। আমি কয়েকজনের সাথে চুপিচুপি ঢোকে গেছি। সবাই ভেবেছে আমিও বাড়ি সাজাতে এসেছি। উত্তর পেয়ে গেছেন! ‌এবার আমার যা চাই দিন।”

তাহির আড়চোখে তাকালো। হিমি ভাব নিয়ে বললো,

“আপনার সম্পত্তির ভাগ চাইছি না। বিয়ের কার্ড চাইছি। দিন। চলে যাই।”

“বিয়ের কার্ড? কি করবেন কার্ড দিয়ে?”

“রেঁধে খাবো।”

“আপনি কার্ড খান?”

“খাই না খাবো। ট্রাই করে দেখি খাওয়া যায় কি না। দিন।”

তাহির নিঃশব্দে হাসলো। কাপ টেবিলে রেখে আলমারির পাল্লা খোলে কিছুটা ঝুঁকলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা কার্ড হাতে আলমারি লাগিয়ে দিলো তাহির। হিমির দিকে ফিরে এগিয়ে দিলো কার্ড। বললো,

“আসবেন?”

“হ্যা। আমি একা আসবো না। সাথে জ্যাঠুমনিও আসবে।”

“আচ্ছা।”

হিমি কার্ড উল্টে পাল্টে দেখলো। ভ্রু উচিয়ে তাহিরকে দেখে কার্ড খোলে ভেতরে লিখা অংশটা পরলো। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো,

“এই কার্ডটা কি আপনি পছন্দ করেছেন?”

তাহির ভ্রু কুঁচকালো। মনে করার চেষ্টা করে বললো,

“উহু। আমার পছন্দ খুব বাজে। এটা মায়ের পছন্দ।”

হিমি ফিক করে হেসে ফেললো। তাহির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে হিমির হাসিতে। দূর থেকেই বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে তার। হিমি হাসি থামালো। মাথা ঝেড়ে বললো,

“সরি। আসলে আপনার মায়ের পছন্দ ভীষন বাজে। তাই হাসি পেয়ে গেলো।”

তাহির গাম্ভীর্য নিয়ে তাকালো। হিমি সন্দিহান গলায় বললো,

“বিয়েটা আপনার পছন্দের মেয়ের সাথে হচ্ছে তো?”

তাহির মাথা নেড়ে অমত জানালো। ছোট্ট করে বললো,

“মায়ের পছন্দ।”

“আপনার একটুও পছন্দ হয় নি?”

“পছন্দ হ‌ওয়াটা জরুরি?”

“না। ভালোবাসাটা জরুরি। যাকে বিয়ে করবেন তাকে যদি ভালোই না বাসেন তবে সম্পর্কটা টিকবে কি করে?”

“বলতে পারছি না। আমার সাথে জড়িত কাউকে আমি কখনো ভালোবাসতে দেখি নি।”

“আপনার বাবা মাকেও না?”

“না।”

ছোট্ট করে জবাব দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলো তাহির। বেশ অনেকক্ষন পর নির্লিপ্ত গলায় বললো,

“আমার বাবা মা আপনার বাবা মায়ের মতো ভালোবেসে বিয়ে করেন নি। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের দু বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ওনারা কখনোই একে অপরকে ভালোবাসেন নি। আমার পৃথিবীতে আসাটাও পরিবারের ইচ্ছেতে হয়েছিলো। কিন্তু তা বলে আমাকে কম ভালোবাসেন নি। শুধু নিজের সাথে জড়িয়ে থাকা অপর মানুষটিকে ভালোবাসা দিতে পারেন নি।”

তাহিরের বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। উল্টো ঘুরে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আপনি কি এখন চলে যাবেন?”

“আপনি চাইলে থেকে যেতে পারি!”

তাহির হাসলো। বললো,

“আপনি ছেলে হলে আপনাকে থাকতে বলতাম। মেয়ে বলেই পারছি না।”

“আর আমি ছেলে হলে এতদূর আসতাম‌ই না।”

“কেনো?”

“বলা যাবে না। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”

“না।”

হিমি তাতে পাত্তা না দিয়েই বললো,

“বিয়েটা কেনো করছেন?”

“আমি ‘না’ বলেছিলাম হিমি!”

“আই ডোন্ট কেয়ার! জবাব দিন। কেনো করছেন বিয়ে?”

“মায়ের ইচ্ছা।”

“দারুণ! তা বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত আপনার মা নেবেন? আর আপনি ওনার ইচ্ছের কথা ভেবে সংসার করবেন?”

“তা করবো।”

“বাঃ। অসাধারন। আপনার বাবা মা তাদের বাবা মায়ের ইচ্ছার কথা ভেবে বিয়ে করেছিলো। আর আপনি আপনার মায়ের কথা ভেবে বিয়ে করছেন। দেখা গেলো আপনার ব‌উ‌ও তার বাবা মায়ের ইচ্ছের কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আপনাদের ব্যক্তিগত কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা, মতামত নেই?”

“আমার নেই।”

“কিহ! কেনো?”

“ছোটবেলা থেকে একা হাতে মা বড় করেছেন। ওনার কথার অবাধ্য হতে শিখি নি। উনি যা বলেন তা করতে এক পায়ে খাড়া থাকি আমি। মায়ের খুশিটাই মুখ্য।”

হিমি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,

“আপনার মা যদি বলেন, এক্ষুনি ব্যলকনি থেকে ঝাঁপ দিতে। দিবেন?”

“মা একথা বলবেন না।”

“যদি বলেন?”

“তবে ঝাঁপ দিতেও রাজি।”

হিমি আস্তে করে দুহাতে তালি বাজিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,

“আপনার মতো ছেলে যদি ঘরে ঘরে থাকতো তবে পৃথিবী বড়‌ই সুখের হতো। যেহেতু নেই তাই আপনাকেই আগামী প্রজন্মের জন‌্য আইডল করে তুলতে হবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অনেক বছর পর মিউজিয়ামে আপনার ছবি টানানো। নিচে লিখা, ‘দ্যা বেস্ট সন।’ বাচ্চারা খুটিয়ে খুটিয়ে আপনার ছবি দেখছে। শিক্ষকরা তাদের শিখাচ্ছেন কি করে মায়ের বাধ্য সন্তান হতে হয়। ঠিক আপনার মতো। আহা,,, পৃথিবী হঠাৎ‌ই সুন্দর হয়ে উঠলো। অদ্ভুত সুন্দর!”

তাহির আবার‌ও হাসলো। দরজায় কড়া নাড়লো হৃদি। উচু গলায় ডাকলো তাহিরকে।

“ভাইয়া? আসছো?”

তাহির অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো,

“আসছি তুই যা!”

হিমি চাপা স্বরে বললো,

“আপনার বোন?”

“হ্যা।”

“ওকে ভেতরে আসতে বলুন।”

হিমির কথায় চমকে উঠলো তাহির। হৃদিকে ভেতরে আসতে বলছে কেনো? হিমিকে দেখে ফেলবে তো! হিমি দ্বিতীয় বারের মতো বললো,

“বলুন না আসতে!”

তাহির মাথা নেড়ে গলা খাদে নামিয়ে বললো,

“পাগল হয়ে গেছেন? আপনাকে দেখে ফেলবে। মা জানতে পারলে খুব বড় তামাশা হয়ে যাবে বাড়িতে!”

হিমি তাহিরের কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে দরজার লক খোলে দিলো। রাগি গলায় বললো,

“আপনার বোনকে আপনি ডাকবেন না কি আমি চেঁচাবো?”

তাহির চোখ পিটপিট করে তাকালো। হিমিকে বিশ্বাস করে সে। হিমি যা বলে তাই করে। তাহির যদি হৃদিকে না ডাকে তবে হিমি চেঁচাতেই পারে। ভেবে লাভ নেই। হিমি যখন বলছে তখন ভেবেই বলছে হয়তো। কথাটা নিজেকে বিশ্বাস করিয়ে দরজা বাইরে মুখ বাড়িয়ে হৃদিকে ডাকলো তাহির। হৃদি নিচে চলে গেছিলো। ভাইয়ের ডাক শুনে দ্রুত পা চালিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাহির তাকে ভেতরে আসতে বললো। হৃদি ঘরে ঢোকলো। হিমি স্বাভাবিক ভাবেই হাত নেড়ে বললো,

“হাই!”

হৃদি চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেলো। বোঝার চেষ্টা করলো এই ঘরে সত্যিই একটা মেয়ে আছে কি নেই! পরক্ষনেই হিমির পোষাক, চুল দেখে চোখ গোল গোল করে তাকালো। বললো,

“তুমি ওই মেয়ে না যার সাথে শপিং মলে ফুপির সেই রকমের একটা ধাক্কা লেগেছিলো? তারপর কথা কাটাকাটি!”

হিমি আকাশ পাতাল ভেবে আবিষ্কার করলো মন থেকে ডিলিট করে দিতে চাওয়া সেই মহিলার কথা বলছে তাহিরের বোন। তাহির মুখ হা করে বললো,

“এনার সাথে মায়ের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো?”

হিমি চোখ কপালে তোলে বললো,

“মা! ওই মহিলা থুক্কু ওই আন্টি আপনার মা?”

“হ্যা।”

হিমি ভীষন আহত গলায় বললো,

“আপনার হবু ব‌উয়ের জন্য দারুণ কষ্ট হচ্ছে আমার। ইশ, বেচারিকে তো কথা শুনাতে শুনাতেই মেরে ফেলবেন আপনার মা!”

“হিমি!”

হৃদি উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,

“তোমার নাম হিমি? কি কিউট নাম! তোমার মতো। কিন্তু বললে না তো, এখানে কি করে? কথাবার্তায় মনে হচ্ছে ভাইয়াকে তুমি আগে থেকেই চেনো!”

হিমি ঠোঁট চ‌ওড়া করে বললো,

“আমায় না পালাতে হবে। যা জানার বাচ্চা ডাক্তার থেকে জেনে নিও।”

“কে বাচ্চা ডাক্তার?”

“তোমার ভাই! স্কার্ফ দাও।”

“স্কার্ফ দিয়ে কি করবে?”

“মুখ ঢাকবো। তোমার ফুপি দেখে ফেললে আমাকে সাবান পানি ছাড়াই ধুয়ে দেবে। দাও না!”

হৃদি মাথা থেকে স্কার্ফটা খোলে হিমির হাতে দিলো। হিমি মাথা সহ মুখ ঢেকে মাথা নেড়ে চলে যেতে নিলেই তাহির বলে উঠলো,

“কার্ড নেবেন না?”

“লাগবে না। যা দেখার দেখে নিয়েছি। টাটা।”

তাহির আর হৃদিকে হতবিহ্বল রেখেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো হিমি। হৃদি চোখ সরিয়ে বাঁকা চোখে তাহিরকে দেখলো। হিমির সাথে তাহিরের কি সম্পর্ক থাকতে পারে তাই ভাবতে লাগলো।

চলবে,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৪২.

হানিফ শরীফের বাড়িতে হিমির বাবার বাড়ির সবার নিমন্ত্রণ আজ। কয়েকদিন পর‌ই নিহান মিশ্মির বিয়ে। এর মধ্যে আত্মীয়তা আরো খানিক গাঢ় করার তাগিদ চলছে। মিশ্মিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে অথৈ। বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে গতকাল। বোনের বিয়ের জন্য এখানেই থাকবে কদিন।

“কি মিষ্টি লাগছে দেখতে! এতো তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে আমার তো বিশ্বাস‌ই হচ্ছে না মিশু।”

মিশ্মি প্রত্যুত্তর করলো না। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইলো। অথৈ উচ্ছাস নিয়ে মিশ্মির গা ঘেষে বসলো। কৌতুক মাখা গলায় বললো,

“কবে থেকে এসব প্রেম ভালোবাসা চলছিলো? আমায় বললিও না! তোর দুলাভাই না বললে আমি মানতাম‌ই না।”

মিশ্মি শুকনো গলায় বললো,

“তোর বর কি বলেছে?”

“ওই ই তো আমাকে বললো নিহান আর তোর ব্যাপারে।”

“আমার আর নিহান ভাইয়ার ব্যাপার! কি ব্যাপার?”

“ন্যাকা! প্রেমের ব্যাপারে।”

মিশ্মি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। অথৈ হাসি হাসি মুখে বললো,

“ক্যান্টিনে নিহান যে তোকে শাসন করছিলো, খাওয়াচ্ছিলো, তোকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো সব‌ই খেয়াল করেছে ও। নিহানকে দেখেই বুঝে গেছিলো কিছু একটা চলছে তোদের মধ্যে। আর পরে তো বিয়ের কথা বার্তা উঠতে একেবারে শিউর হয়ে গেলো। প্রফেসর বলে কথা! চোখ মুখ দেখেই বুঝে গেছে কার মনে কে আছে!”

মিশ্মি বিরবির করে বললো,

“শুধু বুঝলো না আমার মনে কে আছে! ‌প্রতিটা দিন তার চোখের সামনেই ঘুর ঘুর করেছি আমি। অথচ আমাকে দেখে বুঝলো না। কিছুই বুঝলো না।”

“কে, কি বুঝলো না?”

অথৈর কথায় মাথা নাড়লো মিশ্মি। কথা ঘুরাতে গিয়ে বললো,

“তোরা সবাই ভুল জানিস অথৈ। নিহান ভাইয়ার সাথে আমার প্রেমের কেনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক‌ও ছিলো না। উনি হয়তো আমায় ভালোবেসেছেন তবে আমি বাসি নি।”

অথৈ মৃদু হেসে বললো,

“বাসিস নি তাতে কি হয়েছে? বাসবি! আমিও তো ওকে আগে ভালোবাসি নি। বিয়ের পর বেসেছি। তোর ক্ষেত্রেও এমনটা হবে।”

“হবে না। তুই আর আমি এক ন‌ই।”

“পরিস্থিতি তো এক।”

“আংশিক। তুই বিয়ে করার শখ নিয়ে বড় হয়েছিস আর আমি কোনো প্রকার শখ ছাড়াই বড় হয়েছি। তুই বিয়ে করতে চাইছিলি আমি চাইছি না।”

“কেনো চাইছিস না? নিহান তোকে কতো ভালোবাসে।”

“তোরা সবাই এই এক কথায় পরে আছিস কেনো বলতে পারিস? নিহান ভাইয়া আমায় ভালোবাসে বলেই আমায় তাকে বিয়ে করতে হবে? আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই? আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না? না কি কেউ একজন আমায় ভালোবেসেছে বলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে আমায় বিয়ে করতে হবে! আমি বুঝতে পারছি না অথৈ। তোকে বুঝতে পারছি না। আজীবন তুই আমায় বুঝেছিস। হিমি আপু বুঝেছে। বুঝিয়েওছে। কিন্তু আজ তোমরা দুজনেই আমাকে বুঝছো না, বুঝাতেও পারছো না। মনে হচ্ছে যেনো আমি তোমাদের গলার কাটা! কোনোরকম উগরে দিলেই বাঁচো।”

অথৈ থম মেরে গেলো মিশ্মির কথায়। ঘরে ঢোকেন রোশন আরা। মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,

“বাইরে আয়। কখন থেকে বসে আছেন ওনারা।”

“আমি গিয়ে কি করবো মা? দাওয়াত তোমরা দিয়েছো গল্পগুজব করার হলে তোমরা করো। খাওয়াও তাদের। আমায় কেনো রেডি করিয়েছো আর যেতেই বা কেনো বলছো?”

ঝাঁঝালো গলায় বললো মিশ্মি। রোশন আরা গম্ভীর গলায় বললেন,

“ওরা তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মিশ্মি। বিয়ে সংক্রান্ত কারনেই আজ তাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তোকে বেশি কিছু করতে হবে না, বড়দের সালাম করবি, হেসে হেসে দুটো কথা বলবি। ওরা খেতে বসবে তুই সার্ভ করবি। চল।”

মিশ্মি নিজেকে শান্ত করে উঠে দাঁড়ালো। অথৈ বাইরে চলে গেছে ততক্ষনে। রোশন আরা মিশ্মির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলেন। থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বললেন,

“শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে তোকে। এবার একটু হাস! ‌সবাই ভাববে জোর করে বিয়ে দিচ্ছি।”

“দিচ্ছোই তো।”

“তোর ভালোর কথা ভেবেই দিচ্ছি।”

“আমার তো তা মনে হয় না।”

“তোর মনে না হলে আমার কিছু করার নেই। আমি তো তোর মা, কখনোই তোর খারাপ হোক সেটা চাইবো না। আমি জানি কোনটায় তোর ভালো, কোনটায় খারাপ।”

মিশ্মি বাঁকা হেসে বললো,

“জ্যাঠিমাকে দেখে শিখেছো?”

“কি শিখবো?”

“কি করে নিজের মন মতো সন্তানদের চালনা করতে হয়! ‌অন্বেষাপুকে তো ফাইনাল এক্সামটাই দিতে দিলো না জ্যাঠিমা। বিয়ে করিয়ে এক মাসের মধ্যে বিদেশ পাঠিয়ে দিলো। অথৈর মতামত না জেনেই বিয়ে ঠিক করে দিলো। হিরনকে ছোট্টবেলা থেকে হোস্টেলে থাকতে বাধ্য করে গেছে। এমনকি নিজের বোনদের বিয়েতেও আসতে পারে নি সে। তুমিও এর ব্যতিক্রম কিছু করছো না মা। আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছো। জোর করেই দিচ্ছো।”

“বেশ করছি। বিয়ে করতে অমত করলে তোমার হাত পা ভেঙে দেবো আমি। একের পর এক আকাম ঘটাচ্ছে আর বড় বড় কথা বলছে। তোমার ভাগ্য ভালো মতিউর চাচা বিয়েতে রাজি হয়েছেন। তোমার কুকীর্তি বের হ‌ওয়ার আগে ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে ও বাড়ি গিয়ে উঠো। নয়তো অন্যের সংসার ভাঙতে সময় লাগবে না।”

মিশ্মি রুদ্ধ গলায় বললো,

“আমি কারো সংসার ভাঙতাম না মা!”

“ভাঙতে কি ভাঙতে না সেটা এখন জানা বুঝার সময় নয়। বুঝদার হ‌ওয়ার পর থেকেই তো হিমিপু, হিমিপু করে গেছো। এখন যখন তোমার হিমিপু সত্যি সত্যি তোমার জীবনটা গড়ে দিচ্ছে তখন ভাঙতে চাও কেনো? সব মানিয়ে নিলেই হয়!”

“আমি নিহান ভাইয়াকে ভালোবাসি না। তাই তাকে বিয়েও করবো না। আগেও বলেছি আবার‌ও বলছি। বিয়ের দিন কিন্তু আমার মরা মুখ দেখবে তোমরা!”

তাৎক্ষনিক মিশ্মির গালে সজোরে চড় বসালেন রোশন আরা। বাহু টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

“বেয়াদব অসভ্য মেয়ে। মরা মুখ দেখাবেন উনি। চড় মেরে গাল ফাটিয়ে দেবো বলে দিচ্ছি। এতক্ষন ধরে ভালোয় ভালোয় বলছি তা শোনার নয়। ভালোবাসা দিয়ে কি করবি তুই? যাকে ভালোবাসিস সেও তো তোর হবে না। কিসের এতো ঢং? মার খাওয়ার স্বভাব! চোখ মোছ এক্ষুনি। শাড়ি ফারি ঠিক করে চুপচাপ নিচে আয়। খবরদার যদি চেহারা হাসি খুশি না রেখেছিস তবে দেখেনিস!”

কথা শেষ করেই ঝাড়া মেরে হাত ছেড়ে নিচে চলে যান রোশন আরা। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো মিশ্মি। হেঁচকি উঠে গেলো তার। টিস্যু পেপার নিয়ে চোখ মুখ মোছে জোরে জোরে শ্বাস টানলো এবার। অতিরিক্ত রাগ লাগছে মিশ্মির। সবার উপর রাগ লাগছে। বিশেষ করে হিমির উপর। হিমি যদি ওইদিন মিথ্যেটা না বলতো তবে মিশ্মির বিয়েটাও হতো না। সে তার মতোই থাকতো। হিমি নিশ্চয় জেনে বুঝে কাজটা করেছে।

চলবে,,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে