হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩৭.
সন্ধ্যের দিকে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢোকে হিমি। কাপড় না পাল্টেই খাটে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরে। হিমিকে বাড়ি ফিরতে দেখে চা রেখেই উঠে দাঁড়ান মোজাম্মেল সাহেব। ধীর পায়ে এগিয়ে হিমির ঘরে ঢোকে হালকা কাশেন তিনি। আওয়াজ পেয়ে ঘাড় কাত করে তাকায় হিমি। ঠোঁটে লম্বা হাসি ঝুলিয়ে উঠে বসে। ইশারায় মোজাম্মেল সাহেবকে খাটে বসতে বলে। তিনি এগিয়ে আসেন। খাটে বসে মৃদু হেসে বলেন,
-সারাদিন কোথায় ছিলি? ঘুম থেকে উঠে দেখাই পেলাম না তোর।
হিমি মিষ্টি করে হেসে বললো,
-দোহার বিয়ে ছিলো আজকে। সেখানেই ছিলাম।
মোজাম্মেল সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
-বিয়ে কি এখন শেষ হলো? এতো দেরি করে ফিরলি!
হিমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
-হ্যা।
মোজাম্মেল সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,
-ক্লান্ত লাগছে তোকে। ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় বদলে খেয়ে নে কিছু। তারপর কথা বলবো।
-দরকারি কথা থাকলে এখনি বলতে পারো।
মোজাম্মেল সাহেব ইতস্তত করে বললেন,
-উকিল সাহেব এসেছিলেন আজ।
-কিসের উকিল? কেনোই বা এসেছিলেন?
-কিসের উকিল নয়, ওনার নাম উকিল। উকিল মোস্তফা।
হিমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
-উকিল কারো নাম হয়?
-হয়। এই যে এই লোকের নাম উকিল। তবে উকিল সাহেব ওকালতি করেন না।
-তাহলে কি করেন?
-ঘটকালি করেন।
-ঘটকালি? মানে পাত্র পাত্রী খোঁজে বিয়ে করানো। তাই তো?
-হ্যা। জানিস, এই লোকটাই তোর বড়মা আর আমার বিয়ে করিয়েছে। তোর ছোটমা আর চাচামনির বিয়ের পেছনেও এই লোক ছিলো। শুধু তোর বাবার বিয়ে করাতে পারে নি। যতো মেয়ের ছবিই দেখিয়েছে তোর বাপ বলে উঠেছে, ‘আমি হাসিকেই বিয়ে করবো’!
হিমি খিলখিল করে হাসলো। হাসি থামিয়ে বললো,
-কিন্তু এখন ওনার কি কাজ? নিহানের বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। নতুন করে পাত্রী দেখতে হবে কেনো?
মোজাম্মেল সাহেব আদুরে গলায় বললেন,
-নিহানের জন্য তো নয় মা, তোর জন্য।
হিমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
-আমার জন্য মানে?
-তোর বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। বিয়ে তো করতে হবে বল!
-আশ্চর্য! কে খোঁজতে বলেছে ওনাকে?
-তোর দাদু। বাবার মনে হচ্ছে বেশি দিন আর শ্বাস প্রশ্বাস চলবে না ওনার। তাই যাওয়ার আগে সবার গোছানো জীবন, সংসার দেখতে চান। নিহানের বউ দেখা হলো এবার তোর বর দেখার পালা।
হিমি রাগান্বিত গলায় বললো,
-সেই কবে থেকেই তো তোমার বাবার মনে হচ্ছে উনি চলে যাবেন। এখনো তো দিব্যি বেঁচে আছেন। আর এই উছিলায় একের পর এক ব্লেকমেইল করে যাচ্ছেন।
মোজাম্মেল সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
-হিমি?
হিমি জিব কাটলো। ছেলের সামনে বাবার মৃত্যু বিষয়ক কথা বলা মোটেও উচিত না। বাবা যতোই বলুক অন্য কেউ বললে ছেলের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। হিমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
-সরি।
তারপর মোজাম্মেল সাহেবের পাশে বসে অভিমানী গলায় বললো,
-কিন্তু দাদু কি এটা ঠিক করছে বলো? যখন তখন যা তা করতে নির্দেশ করছে। না করতে চাইলেই ‘আমি তো মরেই যাবো’ এই ধরনের ইমোশনাল কথা বলে তার কথা মানতে বাধ্য করছে। বাড়ির সবাই মাথা দুলিয়ে ওনার কথায় উঠবসও করছে। তবে আমি করবো না। কিছুতেই না।
-সেটা বললে তো হবে না। অলরেডি ঘটককে তোর ছবি আর বায়োড্যাটা দেয়া হয়েছে। আমার ধারনা ভুল না হলে কালকের মধ্যে এক গাদা সিভি নিয়ে হাজির হবে।
-তুমি ওই ঘটক ফটককে কল করে বলে দাও আসার দরকার নেই। আমি বিয়ে করছি না।
-কেনো করছিস না?
-করতে চাই না তাই করছি না। ব্যস!
মোজাম্মেল সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন,
-জানিস তো, অধিকাংশ মেয়েই বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু তারা বিয়ে করে। তুইও করবি। যখন করবিই তখন মানা করে লাভ নেই। তবে বিয়ে করলে তোর লাভ আছে।
-কি লাভ?
সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো হিমি। মোজাম্মেল সাহেব বললেন,
-এখন যেমন দু বাড়িতে থাকতে তোর হিমশিম খেতে হয় বিয়ের পর হবে না। কারন বিয়ের পর তুই তোর শ্বশুরবাড়ি থাকবি। তোর নিজের ঘর, নিজের বাড়ি, নিজের সংসার। সব কিছু তোর। কারো থেকে কোনো পারমিশন নিতে হবে না তোকে। ভয়ও পেতে হবে না। এবাড়ি ওবাড়ি দৌড়তে হবে না। আর কোনো কাজে রেস্ট্রিকশনও থাকবে না।
কয়েক সেকেন্ড থেমে তিনি আবার বললেন,
-আমি ভাবছি তোকে আমরা পাত্রী দেখাবো না বরং তোর জন্য পাত্র দেখবো।
হিমি মুখ বাকিয়ে বললো,
-কি যা তা কথা বলছো! বুঝতেই পারছি না।
-শোন, প্রত্যেক মেয়েকেই ছেলের বাড়ির লোকেরা দেখতে আসে। তারপর পছন্দ করে। এবার হবে উল্টো। সম্পূর্ণ বিপরীত। মানে, আমরা যাবো পাত্র দেখতে। তুই সোফায় আরাম করে বসবি। আমরা কথা বার্তা বলবো। কিছুক্ষনের মধ্যে পাত্র আসবে। মাথা নুইয়ে বসে থাকবে। আমরা যার যার মতো প্রশ্ন করবো। তোর কিছু জানার থাকলে তুইও জিজ্ঞেস করবি। তারপর ছেলে পছন্দ হলে বিয়ে হবে নয়তো আরো ছেলে দেখবো। ব্যাপারটা কেমন হবে?
হিমি অবাক হয়ে সবটাই ইমাজিন করলো। উচ্ছল হেসে বললো,
-দারুণ বললে তো!
-তবে! এবার আরো একটা কথা জানার আছে।
হিমি ভ্রু নাচালো। মোজাম্মেল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
-তোর কেমন ছেলে পছন্দ? না মানে, পাত্র দেখার আগে তো ঘটককে জানাতে হবে কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি তুই। বল দেখি।
হিমি মাথা দুলালো। যেনো মোজাম্মেল সাহেব শতভাগ সত্যি বলেছেন। কিছুক্ষন ভাবার পর হিমি মুখ ফুলিয়ে বললো,
-বুঝতে পারছি না। কখনো সেভাবে ভাবি নি তো!
মোজাম্মেল সাহেব কৌতুহল চোখে তাকিয়ে বললেন,
-মনের ডাক্তার দেখতে কেমন?
-ভালোই।
-ডিটেইলসে বল। এই যেমন ধর, গায়ের রঙ, চোখ, চুল, উচ্চতা, ব্যবহার। এইসব!
-গায়ের রঙ তোমার মতোই। চো,,,,,খ! (মনে করার চেষ্টা করে বললো)চশমা পরা থাকেন, খেয়াল করি নি কখনো। মাথা ভর্তি পাতলা চুল, চাপ দাঁড়ি, লম্বা আনুমানিক ছয় ফুট, ব্যবহার ভালো। তবে রহস্যময়। কেনো বলোতো?
মোজাম্মেল সাহেব মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললেন,
-ফ্রেশ হতে যাবি তো।
হিমি ভ্রু কুঁচকে একপলক তাকালো জ্যাঠুমনির দিকে। তারপর মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকলো। মোজাম্মেল সাহেব গাঢ় শ্বাস টেনে ঘরের বাইরে বেরুলেন। বড় বড় পা ফেলে মুহিব রহমানের ঘরে উকি দিলেন। গলা খাকরি দিতেই বুক শেল্ফে বই রেখে ঘুরে দাঁড়ালেন মুহিব রহমান। চেহারা খুশি খুশি রেখে বললেন,
-ভিতরে আসো বড় ভাই।
মোজাম্মেল সাহেব ঘরে ঢোকলেন। মুহিব রহমান চেয়ার এগিয়ে দিলেও তাতে বসলেন না তিনি। থমথমে গলায় বললেন,
-হিমির সাথে কথা হয়েছে আমার। তবে বাবা হিসেবে তোরও কিছু কর্তব্য রয়েছে। এতো গুলো বছর পালন করিস না বলে আজও এড়িয়ে যাবি তা তো হয় না। আশা করছি কি বলতে চাইছি বুঝেছিস।
মুহিব রহমান শান্ত গলায় বললেন,
-কিন্তু বাবার কথার অমান্য করা হল,,,,,,,,
-তুই নিজের ভালোবাসার কথা ভেবে বাবার কথা অমান্য করেছিস। মেয়ের কথা ভেবে করতে পারবি না তা আমি বিশ্বাস করি না। আর তাছাড়া হিমির কথা উঠলে আমিও বাবার অবাধ্য হতে পারি। সেটা অবশ্য তুই জানিস। তবে আমি চাই এবার তুই হিমিকে বোঝ।
-দীর্ঘ বাইশ বছর যে সম্পর্কের সুতো ঠিক করতে পারি নি তা দু একদিনে পারবো বলে মনে হয় না।
-দু একদিনে পারতে হবে বলি নি। শুধু বলেছি পারতে হবে। সময় লাগবে, লাগুক। চেষ্টা করতে থাক।
কথা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও পেছন ফিরলেন মোজাম্মেল সাহেব। শক্ত গলায় বললেন,
-সকালে অন্তত বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলিস। আমি চাই না হিমির উপর কোনো জোরাজোরি হোক।
-তুমি ওকে সবটা বলো নি?
-না। আমার মনে হয় নি ওকে এই বিষয়ে জানাতে হবে। যতটুকু জানানোর প্রয়োজন ছিলো জানিয়েছি। আর জানতে হবে না হিমির। বাড়ির কেউই হিমিকে কিছু বলবে না। আমি মানা করেছি।
মুহিব রহমান চমকে উঠা গলায় বললেন,
-বড় ভাই হিমি যখন পরে কথাটা জানবে তখন?
-জানবে না। ও যখন জানবে তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। শি উইল বি ওকে বাই দ্যান!
-কি করে?
-তোরা বাপ মেয়ে একরকম! খালি প্রশ্ন করিস। যখন হবে তখন তো দেখতেই পাবি। এখন শান্ত হো, আর বাবাকে কি বলবি সেসব প্র্যাকটিস কর। বাবার সামনে গেলে কথা না বন্ধ হয়ে যায়!
চলবে,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩৮.
বিকেলের স্নিগ্ধ পরিবেশে নদীর পাড়ে তাহির আর হিমি বসে। বেশ কিছুক্ষন আগেই হঠাৎ করে চেম্বারে হিমির আগমনে ভড়কে যায় তাহির। প্যাশেন্ট কম ছিলো বিধায় হিমিকে অপেক্ষারত অবস্থায় রেখেই কাজ শেষ করেছে সে। হিমি তারপর তাহিরকে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে এখানে। হাসপাতালের গন্ধটা ভীষন বিদঘুটে লাগে হিমির। দশ মিনিটও বসার মতো নয়। কথা বলার তীব্র ইচ্ছেকে সঙ্গী করেই ব্রীজে এসেছিলো দুজনে। সেখানেও থাকতে পারলো না। রাস্তা জুরে গাড়ির বহর, ফুটপাতেও তিল পরিমান জায়গা নেই দাঁড়ানোর। চারদিক থেকে শো শো, বো বো আওয়াজ হচ্ছে। ওখানে শান্তিতে দাঁড়ানো যাবে না কথা বলা তো দূরে থাক। বাধ্য হয়েই নদীর পাড়ে বসা তাদের। তবে এখানে বসতে খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে। নির্মল বাতাস, নদীর কল কল শব্দ, পাখির কিচির মিচির, পাশের মাটির রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুব কম। একদিকে বড় এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। নদীর পাড় সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ।
দীর্ঘ সময়ের নিরবতায় ইতি টেনে হিমি বললো,
-সেদিন ফোন করেছিলেন। দেখা করতে বলছিলেন। কিছু দরকার ছিলো?
তাহির শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। হিমির প্রশ্নে চোখ টানটান করে তাকালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা দুলালো। ছোট্ট করে বললো,
-হু।
-কি দরকার ছিলো?
-দরকার তো মিটে গেছে হিমি। এখন না জানলেও হবে।
তাহিরের কথার বিপরীতে ভুরু কুঁচকে তাকালো হিমি। বললো,
-দরকার মিটে গেছে বলে জানতে পারবো না?
-জেনে লাভ নেই বলে বলছি না।
-লাভ ক্ষতির হিসেব করতে তো বলিনি। কি কারনে ডেকেছিলেন সেটা বলুন। আমি শুনবো।
তাহির শুকনো হাসলো। দু হাত দিয়ে ভাজ করে রাখা হাটু আকড়ে বললো,
-আমার এক পরিচিতা হুট করে অসুস্থ হয়ে পরেছিলো। ব্যক্তিগত কারনে আমি যেতে পারছিলাম না। আমি ছাড়া আমার পরিবার বা আত্মীয়দের সাথে তার পরিচয় নেই। তাই ভেবেছিলাম আপনার হাতে করে কিছু ঔষধ পত্র পাঠিয়ে দেবো। তার খোঁজ খবরও নেয়া হবে।
কথাটা শুনে হিমির মন খারাপ হয়ে গেলো। বাচ্চা ডাক্তারের কতোটা দরকার পরেছিলো হিমির। আর ঠিক সেই সময়েই সে আসতে পারলো না? কিসের এতো ইচ্ছা অনিচ্ছা তার? কি হতো ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেখা করতে আসলে? কেউ তো আটকাতো না তাকে। তবে কেনো এলো না সে? একটা বারের জন্যও ভাবলো না ভীষন দরকার না পরলে বাচ্চা ডাক্তার তার সাথে দেখা করে না। তারপরের দিনও তো দেখা করতে পারতো! তবুও করলো না। বান্ধবীর বিয়েতে যাওয়ার কথা মনে ছিলো, ম্যানেজমেন্ট অফিসে যাওয়ার কথাও মনে ছিলো। শুধু মনে ছিলো না বাচ্চা ডাক্তারের কথা। নিজের উপর ভীষন রাগ হয় তার।
তাহির গলা কাশে। হিমি হকচকিয়ে তাহিরকে দেখে করুণ গলায় বলে,
-ভীষন সরি বাচ্চা ডাক্তার। আমি বুঝতে পারি নি। আমার উচিত ছিলো আপনাকে কল করা। তাহলেই হয়তো জানতে পারতাম। আর আপনার পরিচিতাকেও দেখতে যেতে পারতাম। আপনি পরে দেখতে গিয়েছিলেন?
তাহির মাথা নেড়ে। বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাস নিভিয়ে বলে,
-না। অন্য একজনকে পাঠিয়েছি। আচ্ছা সেদিন কল কে রিসিভ করেছিলো?
-আমার জ্যাঠুমনি।
-উনি কি আপনার খুব ক্লোজ?
হিমির ঠোঁটে হাসি ফোটে। বলে,
-হ্যা। ছোট্ট বেলা থেকেই জ্যাঠুমনির সাথে ক্লোজ আমি। অনেক ভালোবাসেন আমায়। একদম মেয়ের মতো। আমিও বাবার মতো ওনাকে ভালোবাসি। এতো বছর বিদেশ ছিলেন। ওইদিনই দেশে ফিরেছেন তাই আর বেরোয় নি আমি।
তাহির মৃদু হেসে বললো,
-আপনি বোধ হয় আপনার জ্যাঠুমনিকে আপনার বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।
-তা বাসি। সত্যি বলতে বাবাকে হয়তো ভালোই বাসি না।
তাহির শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। হিমি অন্যমনস্ক গলায় বললো,
-সবার বাবা আপনার বাবার মতো ভালো হয় না! আপনার বাবা যেমন আপনাকে ভীষন ভালোবাসে তেমন আমার বাবা বাসে না। আপনাকে বলেছিলাম তো। আমার বাবা শুধু ভালো স্বামী ছিলেন। আর কিছুই না। আপনার বাবার মতো সবদিক থেকে বেস্ট নন।
তাহির নিঃশব্দে হাসলো। হিমির কপালে ভাজ। ভুরু উচিয়ে হিমির দিকে তাকালো। বললো,
-আপনাকে কে বললো আমার বাবা সব দিক থেকে বেস্ট?
-আপনিই তো বলেছিলেন আপনার বাবা আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। হয়তো এখনো বাসেন।
-বলেছিলাম। তবে বলি নি তিনি সব দিক থেকে ভালো।
হিমি বিস্মিত চোখে তাকালো। তাহির থমথমে মুখে বললো,
-আমার বাবা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। অন্তত আমি তাই মানি। কিন্তু ওনার শ্রেষ্ঠত্ব শুধু এখানেই আটকে গেছে। না কখনো ভালো স্বামী হয়েছেন আর না ভালো মানুষ ছিলেন। আমার মা বলেন, পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষদের মধ্যে বাবা একজন।
হিমি সরু চোখে তাকালো এবার। অস্ফুট স্বরে বললো,
-এমনটা কেনো?
-কারন আছে। বহু কারন। সময় করে একদিন আপনাকে বলবো সব। অনেক কথা বন্দি আছে আমার ভেতর। সব মুক্ত করবো। সেই সাথে কিছু কথা জমা রেখেছি। সেসবও আপনাকে জানাবো।
হিমি শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কৌতুহল নিয়ে বললো,
-শুধু আমাকেই জানাবেন?
-হ্যা।
-কেনো?
-অচেনা বলে। যদিও আমাদের মধ্যে অনেক চেনা জানা হয়েছে তবুও কোনো না কোনো ভাবে আমরা দুজনেই একে অপরের অচেনা। আমায় কেউ একজন বলেছিলেন, অচেনাদের সাথে কথা বলতে দ্বিধা করতে নেই। তারা কোনো ক্ষয় ক্ষতি করবে না। করার কথাও না। কারন তারা আমাদের অপরিচিত। তাই নির্দ্বিধায় সব গোপন কথা বলা যায়। খেয়াল রাখতে হবে সেই অচেনা মানুষ যেনো মন থেকে ভালো হয়। নয়তো বিপদে পরার সম্ভাবনা থাকে। সেই মানুষটার সাথে আপনার অনেক মিল আছে হিমি। জ্বরের ঘোরে আপনিও সেদিন এই ধরনের কিছু কথা বলেছিলেন। আমি জানি আপনি বিশ্বস্ত অপরিচিতা। তাই মনে মনে স্থির করেছি মাঝে মাঝেই বিরক্ত করবো আপনাকে। বুকটা ভীষন ভারি মনে হয়। হালকা করতে হবে।
হিমি অবাক চোখে দেখে তাহিরকে। তাহির তো এমন ছিলো না। যে কদিন তাহিরকে দেখেছে বার বার মনে হয়েছে ভীষন গোছালো মানুষ। বুঝদার। কম কথা বলেই অভ্যস্ত সে। দরকারি ছাড়া অদরকারি কথা মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে সব গুলিয়ে যাচ্ছে হিমির। তাহির অগোছালো হয়ে পরছে। কখনো কখনো বেশি কথা বলছে। অদরকারি কথাগুলোও দরকারি বলে বোধ করছে। অর্ধ পরিচিত এক বাউন্ডুলে মেয়েকে গোপন কথা বলতে চাইছে। তবে কি তাহিরকে চিন্তে ভুল করেছে হিমি?
__________________
“আপু তুমি জানো বাড়িতে কি হচ্ছে?”
“কি হচ্ছে?”
মিশ্মির অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনেও দায়সারা গলায় জবাব দিলো হিমি। মিশ্মি ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
“কি হচ্ছে মানে? এক সপ্তাহ ধরে ও বাড়ি থাকছো তবুও কিছু জানো না এ কথা আমি মানতে পারছি না।”
“আমি কি মানতে বলছি?”
“তুমি আমায় ইগনোর করছো?”
হিমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“ইগনোর কেনো করবো বলতো? তুই কি বলছিস আমি বুঝতে পারছি না। খোলসা করে বল কি বলবি।”
“নিহান ভাইয়ার সাথে আগামী মাসে আমার বিয়ের খবরটা নিশ্চয় অজানা নয় তোমার?”
হিমি ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বললো,
“ওহ এই কথা! সেটা তো জানিই।”
“তবে আটকালে না কেনো?”
মিশ্মির রুদ্ধ গলার প্রশ্নে কপালে চিন্তার ভাজ পরে হিমির। আলমারির পাল্লাটা বন্ধ করে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় বোনের। বলে,
“কি আটকানোর কথা বলছিস মিশু?”
মিশ্মি ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
“বিয়ের কথা বলছি আমি। বুঝতে পারছো না? এক নাগারে তোমায় কল করেছি একটা বারও রিসিভ করো নি। আর না কল ব্যাক করেছো। আমি অসহায়ের মতো কান্না কাটি করেছি। আম্মুর পায়েও ধরেছি। আব্বুকেও বলেছি। কেউ আমার কথা শুনে নি। তুমিও আমায় সাহায্য করলে না। এখন যে করেই হোক বিয়ে ভেঙে দাও। সবাইকে বলো আমি বিয়ে করবো না!”
“তুই এভাবে কাঁদছিস কেনো মিশু? শান্ত হো। আর বিয়ে করবি না কেনো?”
“কারন আমি বিয়ে করতে চাই না। আমার কথা কেউ শুনছে না আপু। প্লিজ! প্লিজ তুমি কিছু করো!”
হিমি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। শীতল গলায় বললো,
“আমি কিছু করতে পারবো না।”
মিশ্মি থমকে গেলো। কন্ঠে আকুলতা এনে বললো,
“কেনো পারবে না? নিহান ভাইয়া তো তোমার ভাই। তুমি বললে উনি নিশ্চয় সরে আসবেন এসব থেকে। আর তাছাড়া ওনার সাথে আমার এভাবে জড়িয়ে যাওয়ার কারনটাও তো তুমি আপু! তুমিই সেদিন সত্যিটা লুকাতে মিথ্যে বলেছিলে। নিহান ভাইয়াকেও নিশ্চয় তুমি রাজি করিয়েছো মিথ্যে বলার জন্য। এতসব মিথ্যের পর কোনো নতুন সম্পর্ক শুরু হতে পারে না। ওনার কথাটাও ভাবো। আমি কারো দয়ার পাত্রী হতে চাই না।”
হিমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঘন ঘন নিঃশ্বাস টানলো। মিশ্মির দিকে ফিরে তার দু বাহু ধরে আলতো করে খাটে এনে বসালো। মিশ্মি তখনো কাঁদছে। হিমি হাটু গেড়ে মিশ্মির সামনে বসে বললো,
“তুই কারো দয়ার পাত্রী হচ্ছিস না মিশু। নিহান তোকে বাঁচাতে মিথ্যে বলেছিলো। তবে অর্ধেকটা। বাকিটা সত্যি বলেছে সে!”
“কোনটা সত্যি?”
“নিহান তোকে ভালোবাসে। সেটা এখন থেকে নয় বেশ অনেকদিন থেকে আগে থেকেই। ও চাইছিলো তোকে নিজে সব জানাবে। কিন্তু সেই সুযোগ হয়েও হয় নি। নিয়তি যেমন! ঘুরে ফিরে তোর সাথেই বিয়ে ঠিক হলো।”
মিশ্মি শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। গাল বেয়ে অনর্গল নোনা জল পরছে। হিমি ঝটপট বললো,
“আমি জানি তুই মেনে নিতে পারছিস না। কারন এখনো তোর মনে ইয়াসির আছে। কিন্তু ওই মানুষটাকে মনে রেখে আদৌ কোনো লাভ আছে? সে তো বিবাহিত। সুখী। তুই কেনো তার কথা ভেবে পরে থাকবি? অন্যদিকে এক না একদিন বিয়ে তো হতোই! যার তার সাথে হওয়ার চেয়ে ভালো নিহানের সাথে হওয়া। ও তোকে ভালোবাসে। খুব ভালো রাখবে। তোকে বুঝবে। আর,,,,”
“আর বলতে হবে না। বুঝেছি আমি। মামাতো বোনের থেকে চাচাতো ভাই আর তার অনুভুতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তোমার কাছে। হওয়ারই কথা। রক্ত বলে কথা!”
হিমি আঁতকে উঠলো মিশ্মির কথায়। দ্বিধান্বিত গলায় মিশ্মিকে কিছু বলতে নিলেই উঠে দাঁড়ালো সে। হিমিও উঠলো। মিশ্মি চোখের জল মুছে বললো,
“আমার কথাটা একবারও মনে পরে নি না তোমার? ভাবোই নি, মিশ্মির কিছু বলার থাকতে পারে। মিশ্মিরও অনুভুতি থাকতে পারে। তোমার ভাইয়ের সুখটাই দেখলে, আমার কষ্টটা দেখলে না তো! আমার কান্না, ক্ষত কিছুই চোখে পরে নি? এই যে তুমি বললে না, যার তার সাথে বিয়ে হওয়ার চেয়ে ভালো নিহান ভাইয়ের সাথে হওয়া! আমার কাছে তোমার ভাই নিহানও ‘যার তার’ মতো। বিশ্বাস করো, নিহান ভাইয়াকে নিয়ে বিন্দু পরিমাণ অনুভুতি নেই আমার মাঝে। আমি ভেবেছিলাম আর সবাই না শুনলেও তুমি শুনবে। সফল না হলেও চেষ্টা করবে। কিন্তু ভুলেই গেছিলাম তুমি আমাদের কেউ নও! তুমি তো তোমার বাবার পরিবারকেই বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেবে।”
“মিশু তুই আমায় ভুল বুজছিস!”
“তাহলে বিয়ে আটকে দাও। প্রমান করে দাও আমি ভুল বুঝছিলাম।”
হিমি ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললো,
“সেটা হচ্ছে না মিশু।”
“কেনো? কেনো হচ্ছে না? তুমি চাইলেই কিন্তু সব বন্ধ করে দিতে পারো।”
“হ্যা পারি। কিন্তু করবো না। কেনো করবো না জানিস? কারন আমি তোর ভালো চাই। তোকে সুখী দেখতে চাই। তোর ভবিষ্যত সুন্দর করতে চাই।”
মিশ্মি কটমট করে তাকিয়ে বললো,
“যার নিজের ভবিষ্যত নেই সে আবার আমার ভবিষ্যত সুন্দর করবে। খুব চেনা হয়ে গেছে তোমায়। জ্যাঠিমা, মা, বার বার বলেছে আমায়। তোমায় বিশ্বাস না করতে। আমি করে গেছি। ওরা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, হিমির শরীরে ওর মা বাবার রক্ত বৈছে, ধোঁকা দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না। আমি সব কথা উপেক্ষা করে তোমার কথা শুনে গেছি। যা বলেছো বিশ্বাস করেছি। যা করতে বলেছো করে গেছি। আর না। এবার আমিই যা করার করবো।”
হিমিকে স্তম্ভিত রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মিশ্মি। হিমির ভয় হতে লাগলো। ঝোঁকের বসে কিছু করে না ফেলে মিশ্মি!
চলবে,,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩৯.
ঘর্মাক্ত দুপুর। সূর্যের তাপ প্রকট। ঘড়িতে দেড়টা বাজে। সোহিনীর ভেজা চুল থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। চুলের পানিতে শরীরে জড়ানো সুতির শাড়ির কিছু অংশ ভিজে যাচ্ছে। তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। ছাদে উঠে কড়া রোদে ভেজা জামা কাপড় মেললো সে। খালি বালতি হাতে নিয়ে সেড়ে ভেঙে নিচে নামলো। সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলা নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন সোহিনীর দিকে। ওনার মুখোমুখি দাঁড়ানো মহিলা মুখ কুঁচকালেন। সোহিনী তাদের এক পলক দেখে নিজের ঘরে ঢোকলো। দরজাটা আটকে দিতেই মধ্যবয়স্ক সেই সুন্দরী মহিলা বললেন,
“দেখেছো? কেমন মেয়ে! বিয়ে শাদি হয় নি তবুও শাড়ি পরে ঘুরঘুর করছে।”
অন্য জন তাচ্ছিল্য গলায় বললেন,
“হয়েছে তো। বলে নি। মুখচোরা মেয়ে। কারো সাথে কথা বলতেও তো দেখি না। বলি এই এতো বড় বিল্ডিংএ একা একটা ফ্ল্যাটে থাকে কি করে এই মেয়ে? পরিবার নেই নাকি?”
“শুনলাম, আগের জায়গা থেকে নাকি বের করে দিয়েছে।”
“সে কি! বের করে দিয়েছে!”
“নয়তো কি? নাহলে ওই মাঝরাতে ব্যাগ পত্র নিয়ে থাকতে আসে! নিশ্চয় কিছু করেছে। নাহলে, বের করবে কেনো?”
“ঠিকই তো! ভাবি, তোমার মেয়েকে দেখি মাঝে মাঝে এই মেয়ের সাথে কথা বলতে আসে। ওকে সামলে রেখো। এই মেয়েটাকে কেনো যেনো ভালো মনে হয় না আমার। তারউপর যা বললে! কাল বেশ রাতে ফিরেছে। ব্যাপার স্যাপার ভালো ঠিকছে না ভাবি!”
মাঝবয়সী মহিলার মুখে চিন্তার ছাপ পরলো। ওনার সতেরো বছর বয়সী মেয়ে যে সোহিনীর সাথে কথা বলে তা ওনার অজানা ছিলো। কিন্তু কি কথা বলে ওরা? বিগরে দিচ্ছে না তো মেয়েটাকে? দিচ্ছে নিশ্চয়! নাহলে, সন্ধ্যে বেলা ছাদে বসে থাকে কেনো ওনার মেয়ে? দুদিন পর সোহিনীর মতোই মাঝরাতে বাড়ি ফিরবে? আকাম কুকাম ঘটিয়ে মান সম্মান ডুবাবে? সোহিনীর নাহয় কিছু যায় আসে না তাতে, কিন্তু ওনার তো যায়! না যে করেই হোক এই মেয়েকে বিদায় করতে হবে এখান থেকে। মেয়েটাকে দেখলেই রাগ লাগে ওনার। শুধু ওনার নয়, বিল্ডিংএর বাকি সদস্যদেরও! মেয়েটার চলা ফেরা, সাজগোজ কিছুই ভদ্রতার কাতারে পরে না।
ওনার ভাবনার মাঝেই ঘরের দরজা খোলে বেরিয়ে এলো সোহিনী। পরনে ধূসর রঙের শাড়ি, কপালে কালো ছোট্ট টিপ, চুল ছাড়া, হাতে কয়েক গাছি চুড়ি। তাকে দেখেই চোখে মুখে তিক্ততা ছেয়ে গেলো দুই মহিলার। সোহিনী থমকে গেলো ওনাদের দৃষ্টি দেখে। এদের দুজনকে চেনে সে। একজন উপরের তলায় থাকেন। আরেকজন তার ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটটায়। এভাবে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার দিকে সন্দেহি চোখে তাকিয়ে থাকার কারন খুঁজে পেলো না সে। তবুও মিষ্টি করে হাসলো। দুজনকে সালাম জানিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। ভদ্র মহিলা দুজন একে অপরের মুখ দেখলেন। মুখ বিকৃত করে একজন বললেন,
“দেখলেন ভাবি? একটু আগে সুতির শাড়ি পরলো আর এখন পাতলা একখানা শাড়ি পরে বেরুলো! দেখলেন কান্ডটা!”
“দেখলাম। আচ্ছা বদমাশ তো! লোক দেখানোর জন্য এই শাড়িটা পরলো। বেয়াদব, নোংরা মেয়ে। আজ দেখবেন আমি ওনাকে বলবো। মালিককে বলতে হচ্ছে ঘটনা গুলো। এই মেয়ে তো আমাদের সবাইকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে! ছি ছি। কি অশ্লীল পোষাক!”
নিজেদের মধ্যে আরো কিছু কথা বলে তারা যার যার ঘরে গেলেন। অথচ জানলেনও না অসাবধানতায় খাটের কোনায় লেগে সুতির শাড়িটার আঁচল বিশ্রী ভাবে ছিড়ে গেছে। এই মুহুর্তে বাইরে পরে যাওয়ার মতো কাপড় তার কাছে ছিলো না। বাধ্য হয়েই পুরনো পাতলা শাড়িটা পরেছে সে। তার এই দারিদ্র কারো চোখে পরলো না। চোখে পরলো না তার অসহায়ত্ব। সেদিন রাতেও পরে নি। যখন সে হাতে মাত্র একটা ব্যাগ নিয়ে সকালের পরে থাকা জামাতেই বিল্ডিংএর সবচেয়ে ছোট কামরায় থাকতে রাজি হলো তখনও কেউ বোঝে নি এই মেয়ের অবস্থা ঠিক কতোটা খারাপ। কেউ খোঁজও নেয় নি তার কাছে রাতের খাবার টুকু আছে কি না! ওই দুই মহিলা সোহিনীকে যতোটা নোংরা ভাবছিলো তার থেকেও বেশি নোংরা ছিলো সোহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত ঘর। রাত জেগে ঘর পরিষ্কার করে ক্লান্ত হয়ে শুয়ার সময়ও পায় নি বেচারি। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেছে টিউশনি করতে। ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে এতোদিনের জমানো সব টাকাই এডভান্সে দিতে হয়েছে সোহিনীকে। বাকি দিনগুলোতে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে হলেও তাকে কাজের সন্ধান করতে হয়েছে। দেড় মাস ধরে পরীক্ষার কারনে কাজ নেই তার হাতে। পড়াশোনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে আশপাশে নজর পরে নি তার। যখন পরলো তখন সব শেষ। ভবঘুরের মতো ছুট লাগিয়েছে আবারও। এই সমাজে সোহিনী শুধুই নোংরা, অশ্লীল, বেয়াদব, খারাপ, অভদ্র! কিন্তু তারা জানে না এর পেছনের কারন। জানলেও ভাবাবেগ হবে না তাদের। কেননা, তারা যা ভাবতে চায় তাই ভাবে, যুক্তি খাটে না কিছুতেই।
___________________
“শুধু আমাকেই বলছেন? এতগুলো দিনে আপনি খোঁজ নিয়েছিলেন আমার?”
হিমি অপ্রতিভ হলো কিছুটা। ডিফেন্স করে বললো,
“আমার কাজ ছিলো। ব্যস্ত ছিলাম প্রচুর!”
“তাই না কি? কি কাজ ছিলো?”
“একটা ফাংশন ছিলো। বিয়ের অনুষ্ঠান।”
তাহির হাসলো। বললো,
“দেড় মাসই অনুষ্ঠান ছিলো?”
হিমি বিরোধীতা করে বললো,
“অনুষ্ঠানের কার্যক্রম তো আমাদেরই করতে হয়েছে না কি! বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই শুধু বিয়ে নয়। আরো অনেক কিছু আছে।”
“যেমন?”
“যেমন এঙ্গেইজম্যান্ট, গায়ে হলুদ, মেহেদী ফাংশন, বিয়ে, বাসর, বউ ভাত। এতো কিছুর জন্য প্রচুর সময় ব্যায় হয়। প্রতিটি ফাংশন আলাদা আলাদা জায়গায় হয় বলে সেসব জায়গার সাথে অনুষ্ঠানের মানানসই ডেকরেশন, থিম, খাবার দাবার, গেস্টদের আপ্যায়ন, তাদের সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখা। সবশেষে অনুষ্ঠান যেনো ভালোয় ভালোয় মিটে যায় সেসব দেখা হাতের মোয়া নয়! অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। ভেনু আগের মতো ঠিক ঠাক করে রাখা, ওখানে ব্যবহৃত আমাদের নিয়ে যাওয়া যাবতীয় জিনিসপত্র আগের জায়গায় পাঠানো, খরচ, হিসাব নিকাশ, ইত্যাদি করতে হয়। আপনি কি বুঝবেন এসবের!”
তাহির থমথমে গলায় বলে,
“একটা বিয়েতে এতোকিছু করতে হয়?”
“জি হ্যা।”
“আমি তো এসবের কিছুই জানি না। মা তো বলে নি আমায়!”
হিমি নির্বোধ গলায় প্রশ্ন করলো,
“এসব আপনাকে আপনার মা বলবে? কেনো?”
“সবকিছু তো মাই করছে।”
“সবকিছু!”
“আমার বিয়ের সবকিছু।”
হিমি চমকে উঠা গলায় বললো,
“আপনার বিয়ে?”
“হ্যা। আমার বিয়ে। আমি তো শুধু জানি কনের বাড়ি যাবো, কাবিন হবে। কনে নিয়ে চলে আসবো। ব্যস। এর মাঝে যে এতো অনুষ্ঠান হয় তা তো আমাকে জানানো হয় নি!”
হিমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“আপনার বিয়ে কবে?”
“এই মাসের শেষেই।”
“আপনি আমায় জানালেন না যে!”
তাহির বিব্রত বোধ করলো। মাথা চুলকে বললো,
“সরি। আসলে সময় হয়ে উঠে নি। কাজের এতো চাপ ছিলো! গাড়িতে কিছু কার্ডস আছে। ওয়েট আমি আনছি।”
তাহির গাড়ির দিকে যেতে নিলে আটকে দেয় হিমি। কৌতুহল মেশানো গলায় বলে,
“কিসের কার্ড?”
“ইনভিটেশন কার্ড! বিয়ের দাওয়াত দেবো না!”
হিমি মাথা নাড়লো। বললো,
“না দেবেন না।”
“কেনো?”
“এমনি। আমি বিয়ের অনুষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট করে থাকি। বিয়েতে থাকি না। তাই আপনার বিয়েতেও থাকবো না।”
“এক্ষুনি না বললেন, আপনাকে কেনো জানাই নি!”
“সেটা তো দাওয়াত পাওয়ার জন্য বলি নি। বলেছি জানার জন্য।”
তাহির বোঝলো না হিমির কথা। বোঝার চেষ্টা করার আগেই হিমি বললো,
“এনিওয়ে যা বলতে এসেছিলাম!”
তাহির সচেতন হলো। হিমি প্যান্টের পকেট থেকে একটা ভাজ করা সাদা কাগজ বের করে তাহিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এটায় আপনার বাবার ঠিকানা আছে।”
তাহিরের চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো। মনি চকচক করছে। ঠোঁটে হাসি নেই। হয়তো অপ্রত্যাশিত জিনিসটা পেয়ে শক্ড হয়ে গেছে সে। হিমির হাত থেকে কাগজ নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলালো চোখে। হিমি দু হাত ভাজ করে দূরে শূণ্য দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলো,
“জ্যাঠুমনিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা যখন বাড়ি থেকে চলে গেছিলেন তখন তৌসিফ আঙ্কেলের সাথে জ্যাঠুমনির যোগাযোগ ছিলো। আঙ্কেলের একটা নাম্বার জ্যাঠুমনির কাছে আজও আছে। সমস্যা হলো সেই নাম্বার অকেজো হয়েছে অনেক বছর আগেই। যদিও অকেজো হওয়ার আগে দু বার কথা হয়েছিলো তাদের। একবার যখন বাবা মা বাড়ি ফিরে আসে তখন জ্যাঠুমনি কল করেছিলেন। আর দ্বিতীয়বার কোনো এক বিশেষ দরকারে আঙ্কেল কল দিয়েছিলেন। এই ঠিকানাও তখন দিয়েছেন। জ্যাঠুমনি ঐ ঠিকানায় যান নি কখনো। আঙ্কেল বলেছিলেন অতিরিক্ত দরকার পরলেই যেনো ওখানে খোঁজ নেয়া হয় তার। দরকার পরে নি। বিধায় খোঁজ নেয়াও হয় নি। এখন আপনার দরকার পরছে। খোঁজ নেবেন?”
তাহির কাগজের ভাজ খোলে ঠিকানায় চোখ বুলালো। নিভে গেলো তার চোখের উজ্জলতা। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“বাবাকে ওখানে পাওয়া যাবে না হিমি।”
“আপনি এতো শিওর কি করে? একবার খোঁজ নিন।”
“নিয়েছি।”
“আমি তো এই মাত্র ঠিকানা দিলাম আপনাকে। খোঁজটা নিলেন কখন?”
“আপনি ঠিকানা আজ পেয়েছেন। আমি পেয়েছি বহু আগে। তখন বাবা ওখানে থাকতেন। কিছুদিনের ব্যবধানে ওখান থেকে চলে যান। ওই ঠিকানায় এখন কেউ থাকে না।”
“থাকেন। একজন বৃদ্ধকে রোজ ওই বাড়িতে থাকতে দেখা যায়!”
“জানি আমি। কিন্তু ওনার সাথে বাবার কোনো সম্বন্ধ নেই। আচ্ছা, আপনি কি করে জানলেন ওই লোকের কথা?”
“সূর্যকে পাঠিয়েছিলাম। ওই জানালো।”
“কে সূর্য?”
“আমার বন্ধু। যখন আমার কোনো তথ্য জানতে হয় এবং ব্যক্তিগত কারনে নিজে যেতে পারি না তখন সেই যায়।”
তাহির মাথা দুলালো। কয়েক মুহুর্ত নিরবতায় কেটে গেলো। হিমি শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“চলি বাচ্চা ডাক্তার। বিয়ের জন্য শুভ কামনা।”
তাহির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। হিমি বাইকে বসতেই পেছন থেকে বলে উঠলো তাহির,
“আপনি সত্যি বিয়েতে আসবেন না?”
“আসবো?”
“আপনার ইচ্ছা।”
“আচ্ছা।”
হিমি বাইক স্টার্ট দিলো। তাহির ব্যস্ত গলায় বললো,
“শুনুন!”
হিমি ঘাড় বাকালো। তাহির অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে হাসলো। এগিয়ে এসে হিমির বাইকের কাছে দাঁড়ালো। বললো,
“থেঙ্ক ইউ ফর ইউর হেল্প! আমার বাবাকে খোঁজার জন্য অনেক সাহায্য করছেন আপনি।”
“আমার সাহায্য কোনো কাজে লাগে নি বাচ্চা ডাক্তার। তাই ধন্যবাদ দেবেন না। তুলে রাখুন। যেদিন কাজে লাগবে সেদিন ধন্যবাদ দেবেন।”
তাহির ভ্রু উচিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ দিতেই হবে?”
“আপনি চাইলে এর বদলে অন্য কিছু দিতে পারেন। আমি মাইন্ড করবো না।”
হেসে ফেললো তাহির। হিমি শুকনো হেসে মাথা নেড়ে বললো,
“আসছি।”
তাহির হাত নাড়লো। হিমি বেরিয়ে গেলো বাইক নিয়ে। অলস ভঙ্গীতে গাড়িতে এসে উঠলো তাহির। সেইফটি বেল্ট পরে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে পেছনের সিটে তাকালো। সিট জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা এক গাদা ইনভিটেশন কার্ড। বিষাক্ত লাগে সবকিছু। কেমন যেনো অসামঞ্জস্য লাগছে। সামিয়ার বিয়ে করতে চায় না তাহির। কিন্তু করতে হচ্ছে। মা বলেছে তাই করতে হবে। মানা করতে পারে নি আগে এখন আটকানও যাবে না। বাধ্য হয়েই মায়ের হ্যা তে হ্যা মেলাতে হবে। তবুও আক্ষেপ নেই তাহিরের। এতো বছর পর মাকে আবারও খুব খুশি হতে দেখেছে তাহির। এই খুশিটা আজীবন দেখতে হলে বিয়ে তাকে করতেই হবে।
চলবে,,,,,,,,,