হিমি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
929

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩৪.

মোজাম্মেল সাহেব বসার ঘরের বড় সোফার মাঝখানটায় বসে আছেন। পরনে বিদেশী পোশাক নয় বরং সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। ভদ্রলোকের মাথার অর্ধেক টাক। মুখে দাড়ি গোঁফ নেই। শ্যামা চেহারায় সব সময়ের মতো লম্বা হাসি। যেনো তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে খুশি মানব! ওনার চেহারা আর হাস্যোজ্জ্বল গলা শুনে প্রথম দফাতেই রসিক মানুষ বলে বোধ করা যায়। যা তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই। গম্ভীর পরিবশেকেও এক লহমায় শান্ত, শীতল করে দেয়ার ক্ষমতা ওনার আছে। যা এই মুহুর্তে হিমির মামার বাড়িতে বিরাজমান। দেশে ফিরে এক ঘন্টা মতো বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পরেছেন পরিবার নিয়ে। একমাত্র ভাতিজার বিয়ে বলে কথা! উঠে পরে না লাগলে হয়? ওনার এই যুক্তি কেউ মানুক চাই না মানুক তাতে ওনার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বেশ স্বাভাবিক ভাবে হেসে হেসে হিমির মামুদের সাথে কথা বলছেন। মাঝখানে নেই কোনো সংকোচ।

অনাহিতা নাহার স্বামী হানিফ শরীফের কথা মেনে নিয়ে রোশন আরার সাথে মিশ্মি সম্পর্কিত কোনো কথা বলেন নি। তিনি ভেবেছিলেন, আর যাই হোক রোশন আরা কিছুতেই এই বিয়েতে মত দেবেন না। কিন্তু ওনাকে অবাক করে দিয়ে রোশন আরা পরিবার আর নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে মেয়ের প্রেমের সম্পর্ককে বিয়ে অব্দি নিয়ে যাচ্ছেন। এসব না তিনি মানতে পারছেন আর না থামাতে পারছেন। ভেতর ভেতর ফুঁসছেন শুধু।

লাল কালোর সংমিশ্রণে সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় ওড়না টেনে পুতুলের মতো বসে আছে মিশ্মি। ভয়ে, অভিমানে আড়ষ্ট হয়ে আছে সে। বাম হাতের চুড়িগুলো ডান হাতের নখ দিয়ে খুটছে। চোখের দৃষ্টি অস্থির তার। নিহান এসে থেকেই গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছে মিশ্মিকে। এতক্ষনে নিশ্চিত তার মুখস্ত হয়ে গেছে মিশ্মির চোখের পাতা মিনিটে কয়বার পরেছে, কপালের ভাজ কতোটা প্রশস্ত, গোলাপি লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটের মাঝ বরাবর থাকা তিল, কানের পাশে উড়তে থাকা অবাধ্য চুল, নাকের পরিধিসহ আরো বহুবিধ ফ্যাক্ট! মোজাম্মেল সাহেব ভাতিজাকে লক্ষ করে আড়চোখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করলেন। বাঁকা হেসে গলা খাকরি দিয়ে বললেন,

“নিহু কিছু বলবি?”

নিহান হকচকালো। আমতা আমতা করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

“কি বলবো জ্যাঠুমনি?”

“কি বলবি সেটা তো তুই জানিস? কখন থেকে দেখছি মেহজাবিনকে দেখছিস! কিছু বলার থাকলে বল।”

নিহান বিষম খেলো। আমিনা বেগম বিরক্তি নিয়ে স্বামীকে খোঁচা দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,

“বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এসেছি আমরা। কিসব কথায় ঘুরপাক খাচ্ছো তুমি?”

“আমি কোথায় ঘুরপাক খেলাম? নিহুর চোখ‌ই তো মেহজাবিনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওকেও কিছু বলো।”

কথাটা বেশ চাপা গলাতেই বললেন মোজাম্মেল রহমান। তবুও নেহাল রহমানের কানে গেলো। তিনি কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। বাবার চাহনি দেখেই চুপসে গেলো নিহান। হাত পা গুটিয়ে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো মাথা নত করে বসলো। নেহাল রহমান হালকা হেসে বললেন,

“কারো যদি আপত্তি না থাকে তবে তারিখটা,,,,?”

রোশন আরা মাথা দুলিয়ে স্বামীকে ইশারা দিলেন। হাশিম শরীফ খুশি খুশি গলায় বললেন,

“হ্যা হ্যা। আমাদের কারো আপত্তি নেই। আল্লাহ্ যার জোর যেখানে রেখেছেন! ভাইসাব?”

হানিফ শরীফ চা খাওয়ায় মগ্ন ছিলেন। ছোট ভাইয়ের কথায় চোখ তোলে সন্দিহান চোখে তাকালেন। হাশিম শরীফ ঠোঁট নেড়ে কিছু বোঝাতেই হানিফ শরীফ ঝটপট মেরুদন্ড সোজা করে বসলেন। হাতের কাপ নিচে নামিয়ে এমন ভাব করলেন যেনো, ভুলে যাওয়া কোনো কথা হুট করে মনে পরেছে। তারপর সময় নিয়ে বললেন,

“চাচা এলে ভালো হতো। উনি সবার গুরুজন। ওনার মত জানা অতি আবশ্যক!”

মোজাম্মেল সাহেব আশ্বস্ত গলায় বললেন,

“অসুস্থ না হলে বাবা আসতেন। আর আমরা যে এখানে এসেছি সেটাও বাবার মত নিয়ে। উনিই বলেছেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে হোক। আপনারা চিন্তা করবেন না। যে তারিখে আপনাদের সুবিধা বলুন। আমরা এক পায়ে খাড়া!”

আমিনা স্বামীর কথা শেষ হতেই বললেন,

“ছেলে মেয়ের বাবা মাও বলুক তাদের ইচ্ছে।”

নেহাল রহমান ইতস্তত গলায় বললেন,

“বাবার কথাই শেষ কথা আমাদের জন্য। রাদিবার‌ও অমত নেই। বেয়াই বেয়ানদের কথা শুনি!”

“আমাদের‌ও অমত নেই।”

রোশন আরার কথা শুনে বিরক্তির শীষ বাজালেন মোজাম্মেল রহমান। বললেন,

“অমত নেই জেনেই এতোদূর আসা আমাদের। সেই কখন থেকেই অমত নেই অমত নেই শুনছি। এবার সিদ্ধান্ত নিন। নয়তো কারো মতের পরোয়া না করেই মেয়েকে ঘরে তুলছি আমরা। নিহু আর মেহজাবিন দুজনেই ভালো পোশাকে আছে। কাবিন করিয়ে দেই চলো তো। তোমাদের বাপ মায়েদের মত বিনিময় শেষ হলে পরে অনুষ্ঠান হবে। চলো!”

দু পরিবারের সদস্যরা হেসে ফেললেন এতে। মিশ্মি ভড়কে যাওয়া চোখ দুটোয় রাজ্যের জল জমা হয়েছে। নিহান‌ চমকে উঠলো। তবে তার কথাটা মন্দ লাগে নি। বেশ ভালোই লেগেছে।

___________________

বাসন্তী রঙের শাড়ি গায়ে খোঁপায় বকুল ফুলের মালা জড়িয়েছে সোহিনী। দোহাকে বসিয়ে রাখা স্টেজে কেক নিয়ে উঠলো সে। টেবিলে কেক রেখে দোহার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়ে দোহার পাশে বসলো। দোহার চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সোহিনী এক হাতে পাশ থেকে দোহাকে জড়িয়ে ধরে ক্যামেরার দিকে তাকালো। ক্ষীণ গলায় বললো,

“হিমি আসতে পারবে না।”

দোহার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঝটপট ঘাড় ঘুরিয়ে সোহিনীর দিকে তাকালো। সোহিনী হাতের টিস্যু দিয়ে দোহার ঘেটে যাওয়া কাজল মুছে দিলো। দোহা মুখ ফুলিয়ে বললো,

“ও আমার উপর রেগে আছে?”

“আহা,,, তা কেনো হতে যাবে?”

“তাহলে এলো না কেনো?”

“জ্যাঠুমনি দেশে ফিরেছেন।”

“কার জ্যাঠুমনি?”

“গাধী। হিমির জ্যাঠুমনি। আজ আবার নিহান আর মিশ্মির বিয়ের পাকা কথা বলতে গেছেন। বেচারি আসতে চেয়েছিলো কিন্তু পারে নি। কাল আসবে বলেছে। ইন ফ্যাক্ট আমাদের সবার আগেই চলে আসবে।”

দোহা ঠোঁট উল্টালো। সোহিনী চোখ রাঙিয়ে বললো,

“ন্যাকামো করবি না একদম। হলুদের ফাংকশন এতো ইম্পোর্টেন্ট নয়, বিয়েটা ইম্পোর্টেন্ট। চুপ চাপ বসে থাক। আজ তোর দিন জানু, জি লে!”

দোহা শুকনো হেসে ঘন নিঃশ্বাস টানলো। সোহিনী দোহার শাড়ি মেক আপ ঠিক করে দিয়ে নিচে নামলো। গলার কাঠের গহনা নাড়তে নাড়তে অন্যমনস্ক চোখে এদিক ওদিক তাকালো। চোখে পরলো তার থেকেই কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো সুন্দর দেখতে ছেলেটাকে। বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী গায়ে অন্যদিনের তুলনায় অধিক সুদর্শন লাগছে তাকে। চুলগুলো খাড়া করে রেখেছে। অযত্নে বেড়ে উঠা দাঁড়িতে পুরুষালি ভাব ভঙ্গী বেশ মানিয়েছে। ছেলেটার হাতের পশম গুলো‌ও অভিনব লাগছে সোহিনীর কাছে। হঠাৎ ছেলেটা ফিরে তাকালো। সোহিনীর সাথে চোখাচোখি হলো। সোহিনী চমকে উঠলেও চোখ ফেরালো না। একদৃষ্টে তাকিয়ে র‌ইলো অসম্ভব সুন্দর ছেলেটির দিকে। ছেলেটা তীক্ষ্ণ নজরে দেখলো সোহিনীকে। পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে আড্ডায় মনোযোগী হলো। সোহিনীর হঠাৎ‌ই মনে হলো সে হ্যাংলা হয়ে যাচ্ছে। যা তার নয় তার দিকে তাকানো উচিত নয়। লোভ হয়। লোভ করা ভালোও নয়। সোহিনীর ক্ষেত্রে তো কখনোই নয়!

চলবে,,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩৫.

-তুই কি রেগে আছিস?

মোজাম্মেল সাহেবের প্রশ্নের জবাবে স্বাভাবিক গলায় হিমি বললো,

-না। আমার মন খারাপ। দুপুরে ঠিকঠাক ছিলো তবে বিকেল থেকে মন খারাপ ক্রমেই বাড়ছে।

-এর কারন কি?

-বলতে পারছি না। হয়তো দোহার হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে পারি নি বলে। আবার এও হতে পারে তুমি আসার পর থেকে আমায় সময় দাও নি বলে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

মোজাম্মেল সাহেব মৃদু হাসলেন। বললেন,

-তখন ওবাড়ি যাওয়া জরুরী ছিলো। এখন তো সময় দিচ্ছি!

-তখন আর এখনের মধ্যে বিস্তর ফারাক তোমার চোখে পরছে না জ্যাঠুমনি! তুমি জানো, তোমার অভিমান হবে ভেবে আমি এক ঘন্টার জন্য‌ও বান্ধবীর গায়ে হলুদে থাকতে চাই নি। সবার অনুরোধকে নাকচ করে দিয়েছি। অথচ তোমার কোনো হেলদোল নেই!

-আমি কি জানতাম না কি যে তুই আমার জন্য এতবড় সেক্রিফাইস করছিস? জানলে অবশ্য‌ই যেতাম না।

-মিথ্যে কথা। তুমি যেতে।

-আমি যেতাম? সেটা তুই কি করে বলছিস?

-না বলার কি আছে? আমি জানি। চিনি তোমায়। ভাতিজার বিয়ের তারিখ ঠিক করা আর ভাইঝির সাথে সময় কাটানো এক নয়। দুটোর গুরুত্ব‌ও এক নয়।

-তোর কথায় কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না।

-পাবেও না। ছাড়ো। কিছু খাবে? আমার খিদে পেয়েছে দেখি রান্নাঘরে কিছু পাই কি না!

মোজাম্মেল সাহেব খাটে দু হাত রেখে পেছন দিকে শরীর এলিয়ে দিলেন। ঘাড় উল্টো দিকে শক্ত করে রেখে পা টানটান করে বললেন,

-তোর বড়মাকে বল চা করে দিতে।

-বড়মা তো এখন রান্নাঘরে নেই।

-নেই তো কি হয়েছে। গিয়ে করে দেবে।

-রাত নটার আগে বড়মা দাদুর ঘর থেকে বেরুবে না।

-কেনো?

-দাদুকে ঔষধ খাইয়ে, পা ম্যাসাজ করে, মাথা টিপে ঘুম পারাবে তাই। সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

-তুই চা বানাতে পারিস?

-চা বানাতে দেখেছি অনেককে। কখনো চেষ্টা করি নি। আজ করবো?

-না থাক। তোর ছোটমাকে বল দু কাপ চা করে দিতে। তুই আর আমি খাবো।

হিমি মাথা দুলিয়ে চলে গেলো। রান্নাঘরে আসতেই চোখে পরলো রাদিবাকে। তিনি চোখ মুখ শক্ত করে কাজ করছেন। করছেন বললে ভুল হবে দুমদাম করে জিনিস এদিক ওদিক রাখছেন। হিমিকে দেখে যেনো ওনার কাজের গতি বাড়লো। চোখ রাঙিয়ে হিমির দিকে তাকিয়ে মুখে কিছু বিরবির করলেন। হিমি ভাবলো ছোটমা কি তাকে গালি দিলো? দিলে কি গালি দিলো? আর কেনোই বা গালি দিলো? যদি না দিয়ে থাকে তবে বিরবির করে কি বললো? অভিশাপ দিলো বুঝি? দিতেই পারে। তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই হিমির। ভাবনা এটাই যে কি অভিশাপ দিলো। ফলবে না তো!

রাদিবা ধপাধপ পা ফেলে কেবিনেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর হাতের গুড়া মরিচের বয়ামটা ঠাস করে কেবিনেটের উপর রাখলেন। ঘুরে গিয়ে অন্য দিকের তাক থেকে তরকারির হাড়ি তুলে এনে চুলায় বসালেন। খট করে চুলার আগুন জ্বেলে দিয়ে লবনের কৌটটা ডানদিক হতে বামদিকে সরালেন। চামচের রিঙ থেকে বড় চামচ নিয়ে হাড়ির ঢাকনা সরিয়ে তাতে চামচ নাড়তে লাগলেন। পুরো কাজটাই তিনি করলেন হিমির দিকে তীক্ষ্ণ কড়া নজরে তাকিয়ে। হিমি রান্নাঘরের দরজাতেই থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে রাদিবার কান্ড কারখানা দেখলো। রাদিবা ক্ষীপ্ত গলায় বললেন,

-এখানে পিলার হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? কি করতে এসেছিস করে বিদায় হো।

হিমি মৃদু হাসার চেষ্টা করে রান্নাঘরে ঢোকলো। ফ্রিজ খোলে এক লিটারের সেভেন আপ এর বোতল হাতে নিলো। বোতলে সেভেন আপ নেই, পানি। ঠান্ডা হিম শীতল পানি। হিমি বরাবর‌ই বোতল উপর করে মুখ হা করে পানি খায়। কিন্তু এবার গ্লাস নিলো সে। অর্ধেকটা ঠান্ডা পানিতে পূর্ণ করে বাকি অর্ধেকটা ফিল্টার থেকে নরমাল পানিতে পূর্ণ করলো। অন্যদিনের মতো এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিয়ে বোতলের কমে যাওয়া অংশে পানি ভরে আবার‌ও ফ্রিজে রাখলো।

রাদিবা ভ্রু কুঁচকে দেখলেন একবার। রাদিবার জায়গায় আমিনা হলে ভড়কে যেতেন। হা করে তাকিয়ে থাকতেন হিমির দিকে। মৃদু হেসে বলতেন,’কি ব্যাপার রে? কিছু চাই?’

কিন্তু রাদিবা উচ্চবাচ্য করলেন না। হিমি ঢোক গিলে চায়ের কথা বলতে গিয়েও বললো না। রান্নাঘর থেকে বেরোতে নিতেই রাদিবা বলে উঠলেন,

-শোন? তোর ‌ওই বোনকে বলে দিস তোর মতো অকর্মণ্য যেনো নাহয়! কাজ ফাজ শিখে আসে যেনো। এখানে আমি ওকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো না! কখনো কেউ ব‌উয়ের মর্যাদা না দিলেও এখন শাশুড়ির মর্যাদা পাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না আমায়। একটা মানুষ‌ও আমার কথা শুনলো না। আসুক ওই মেয়ে ঘরে, দেখাবো, আমি কি জিনিস!

হিমি শুকনো হেসে বেরিয়ে এলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। মিশ্মি এবাড়ির ব‌উ হলে তার সাথে কি কি হবে সেসব হিমি জানে না তবে এটুকু জানে তার ছোটমা শাশুড়ির মর্যাদা পেতে গিয়ে ব‌উয়ের মর্যাদার কথা ভুলে গেছেন। এবং ভবিষ্যতে তিনিও বিশ্বাস করবেন ব‌উদের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা পরের বাড়ির মেয়ে। শ্বশুর বাড়িতে শুধুই কর্তব্য পালন করতে আসবে বিনিময়ে অধিকার পাবে না কিছুই।

হিমিকে হতাশ হয়ে ফিরতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন মোজাম্মেল সাহেব। পাঞ্জাবীর হাতা ঠিক করতে করতে বললেন,

-বাচ্চা ডাক্তার কে রে?

হিমি কপাল কুঁচকালো। জ্যাঠুমনির দিকে তাকিয়ে র‌ইলো নির্বিকার। তিনি আবার‌ও বললেন,

-বাচ্চা ডাক্তার কে?

-তুমি কি করে চেনো?

-চিনি না তো। জানতে চাইলাম কে এই ব্যক্তি!

-হঠাৎ জানতেই বা চাইছো কেনো ওনার কথা? ‘বাচ্চা ডাক্তার’ কেনো বললে? আমি তো কিছু বলি নি ওনার বিষয়ে!

চলবে,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩৬.

-ফোন এসেছিলো।

-কার ফোন?

-বাচ্চা ডাক্তারের।

-তোমার কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে জ্যাঠুমনি।

মোজাম্মেল সাহেব হিমির ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-তোর ফোনে একটু আগে ‘বাচ্চা ডাক্তার’ লিখা একটা নাম্বার থেকে কল এসেছিলো। আমি ধরলাম। হ্যালো বলার আগেই একজন বললো, দেখা করবেন? আমি বললাম, কার সাথে দেখা করবো? ছেলেটা ভড়কে গেলো মনে হলো। জিজ্ঞেস করলো আমি কে? আমি বললাম, আমি মোজাম্মেল রহমান। তুমি কে? ছেলেটা ফট করে ফোন কেটে দিলো। আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না। কে এই ছেলে?

হিমি মোবাইল অন করে কল লিস্টে ঢোকলো। তাহিরের কল এসেছে তিন মিনিট আগে। মোজাম্মেল সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন,

-বলবি তো!

-একজন ডাক্তার।

-হ্যা সে তো আমি নাম দেখেই বুঝেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে কিসের ডাক্তার? তোকে কেনো ফোন করছে? আর তোর ফোনে এই ডাক্তারের নাম্বার ‘বাচ্চা ডাক্তার’ নামে সেইভ করা কেনো? গলার আওয়াজ শোনে মোটেও বাচ্চা মনে হয় নি। তার উপর ডাক্তার মানুষ। ঘটনা কি?

হিমি মাথা ঝেড়ে খাটে এসে বসলো। মাথা চুলকে বললো,

-ঘটনা কিছুই না।

-কিছু তো অবশ্য‌ই। ঠিক ঠিক বল। কিসের ডাক্তার?

হিমি অলস গলায় বললো,

-সাইকিয়াট্রীস্ট। চাইল্ড স্পেশালিস্ট বলে আমি ওনাকে ওই নামে ডাকি। আর কিছু না।

-সাইকিয়াট্রীস্ট! মানে পাগলের ডাক্তার?

-উহু, মনের ডাক্তার।

-ওই এক‌ই কথা।

কয়েক সেকেন্ড থেমে হিমির দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বললেন,

-তুই কি ওই ডাক্তারের থেকে ট্রীটমেন্ট নিচ্ছিস?

-কেনো বলোতো?

-ডাক্তারদের সঙ্গে সাধারনত তোর আত্মীয়তা থাকার কথা না। বন্ধুত্ব‌ও হতে পারে বলে মনে হয় না। তাহলে ডাক্তারের সাথে ঘনিষ্ঠতা কেনো? নিশ্চয় ট্রীটমেন্ট নিচ্ছিস! তবে লোকটা তো বাচ্চাদের ডাক্তার। তুই তো বাচ্চা নস। কৈশোর কাল‌ও পেরিয়ে গেছিস। তবুও ওই ডাক্তার তোকে ট্রীটমেন্ট দিচ্ছে!

-আমি তো ট্রীটমেন্ট নিচ্ছি না জ্যাঠুমনি। এমনি দেখা করছি, কথা বলছি।

মোজাম্মেল সাহেব থমথমে গলায় বললেন,

-কারন ছাড়া দেখা করছিস, কথা বলছিস?

-কারন ছাড়া নয়। কিছু না কিছু কারনেই দেখা করছি। কখনো ওনার দরকার কখনো বা আমার। আজ ওনার দরকার পরেছে। কাল হয়তো আমার দরকার পরবে।

-বাঃ বেশ ভালো কথা। তা আজ তার কি দরকার পরলো?

-জানতে হলে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। আমার আজ বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই যাবো না। যখন দেখা হবে তখন জানবো, ওনার কি দরকার ছিলো।

-তোর এখন জানতে ইচ্ছে করছে না?

-করছে।

-তাহলে ফোন করে জেনে নে। আমিও শুনি এতো রাতে কি দরকার পরলো!

-সম্ভব না।

-কেনো?

-কারন উনি ফোনে সব কথা বলেন না। কয়েক লাইনই বার বার রিপিট করেন।

-কি রিপিট করে?

-“আসতে পারবেন? ‌দরকার ছিলো। পরে বলবো।আসছেন তো? আসবেন না? আসুন তবে! কখন আসছেন? আগের জায়গাতেই।” এগুলোই।

মোজাম্মেল সাহেব ভয়ার্ত চোখে তাকালেন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

-এমনটা কি রোজ বলে?

-না। মাঝে মাঝে বলেন।

-তুই দেখা করতে যাস?

-কাজ না থাকলে যাই। নয়তো অন্যদিন দেখা করি।

-দেখা করে কি কথা বলে?

-ব্যক্তিগত কিছু কথা। সেসব তোমায় বলা যাবে না।

মোজাম্মেল সাহেব এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। হিমি তাতে পাত্তা দিলো না। খাটে বসে স্যান্ডেল খোলে রেখে পা উপরে তুললো। মোজাম্মেল সাহেব নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন,

-মনের ডাক্তার তোর সাথে ব্যক্তিগত কথা বলে?

হিমি মাথা নেড়ে জবাব দিলোস

-হ্যা বলে।

-তুই বলিস?

-কখনো কখনো বলি।

-তোর সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে হিমি?

-হ্যা। দরকারের সম্পর্ক। বললাম না, দরকার ছাড়া দেখা সাক্ষাত হয় না আমাদের।

-দরকারের সম্পর্ক বলে কিছু হয়?

-হয়। পৃথিবীতে সবথেকে বেশি যদি কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে তবে তা হলো দরকারের সম্পর্ক। জটিল ভাষায় স্বার্থের সম্পর্ক। অধিকাংশ মানুষ‌ই নিজ স্বার্থের কথা ভেবে সম্পর্ক গড়ে। আমাদের বেলাতেও তাই। স্বার্থ তথা দরকার। দরকার ফুরিয়ে গেলেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

মোজাম্মেল সাহেব শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। হিমি উষ্কখুষ্ক চুল হাতিয়ে বললো,

-ছোট মা ভীষন রেগে আছে। চায়ের কথা বলার সাহস পাই নি। তুমি বলো। দিয়ে দেবে। আমার জন্য এনো না, খেতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে। রাতের খাবারের সময় হ‌ওয়ার আগেই এক ঘুম দিয়ে উঠি। কি বলো?

মোজাম্মেল সাহেব মাথা দুলিয়ে ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। হিমি ফোন হাতে নিয়ে আছে এখনো। বুঝতে পারছে না তাহিরকে কল করবে কি করবে না! দেখা করতে যাচ্ছে না, জানিয়ে দিবে? তাহির কি হিমির ফোনের অপেক্ষা করছে? নাও করতে পারে। হয়তো এখন তাহির রাউন্ডে আছে। একটু পর বাড়ি চলে যাবে। কি দরকার কল করে বিরক্ত করা? কাল সকালে এক দেখা দিয়ে আসবে তাহিরকে। চেম্বারে হুট করে ঢোকে সারপ্রাইজ দিবে। সারপ্রাইজ শব্দটা ভাবতেই হিমির মনে হলো জ্যাঠুমনি আজ দেশে ফিরে সবাইকে অনেক জিনিস দিলো। তাকে তো দিলো না। কেনো দিলো না? জ্যাঠুমনি কি হিমির পছন্দ অপছন্দ জানে না? না কি ইচ্ছে করেই আনে নি? হিমির নামটা নিশ্চয় জ্যাঠুমনির প্রিয় মানুষদের তালিকা থেকে বাদ পরে নি। তবে কেনো কিছু আনলো না জ্যাঠুমনি। ঘাপলা আছে কিছু।

……………………………

মানুষের সমাগমে ভীষন ভীড় হয়ে গেছে। চারদিকে হৈ হৈ আওয়াজ। জমকালো আসর। হিমি সেন্টারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে জটলা হয়ে আছে। কোনদিকে ব‌উ বসে আছে সেটা সে জানে না। বিয়ে হয়ে গেছে কিনা সেটাও অজানা তার। পুরুষ মহলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে। বন্ধুদের দেখা পাওয়াও দুষ্কর ঠেকছে হিমির কাছে। তাড়াহুড়ায় মোবাইল আনতে ভুলে যাওয়ায় এই মুহুর্তে কারো সাথে যোগাযোগ‌ও করতে পারছে না। ব্যাপক অস্বস্তিতে পরে গেছে সে। এর মধ্যেই আবার কয়েকজন আড় চোখে তো কয়েকজন বিরক্ত চোখে দেখছেন হিমিকে। হিমি মাথা উচিয়ে দূর দূরান্তে চোখ বুলিয়ে ব্যর্থ চেহারায় দাঁড়িয়ে র‌ইলো। মানুষের গিজগিজে এসির ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে না। উত্তপ্ত শরীর আরো উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হিমির কপাল থেকে ঘাম গালে গড়াচ্ছে। তীব্র বিরক্ত হয়ে সেন্টার থেকে বেরুতেই সূর্যের মুখোমুখি হলো হিমি। তার দু হাতে অনেকগুলো আইস্ক্রিম। হিমিকে বেরুতে দেখে গোল গোল চোখ করে সূর্য বলে উঠলো,

-তুই কখন এলি? দেখলাম না তো!

হিমি মুখটা হাসি হাসি করে তাকালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-এক্ষুনি এসেছি।

-তাহলে চলে যাচ্ছিস যে!

-কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি যাওয়াই উত্তম।

সূর্য কপাল কুঁচকে ভেতরে উকি দিলো। গমগমে গলায় বললো,

-আজাইরা কথা। ভেতরে এতো মানুষ আর তুই কাউকে চোখে দেখলি না!

-চোখে দেখি নি বলি নি তো। বলেছি খুঁজে পাই নি। ভেতরে এতো মানুষ বলেই তোদের কাউকে খুঁজে পাই নি। দোহা কোথায় আছে সেটাও জানি না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো!

সূর্য গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো,

-আমার হাত থেকে দুটো আইস্ক্রিম নে তো। হাত বরফ হয়ে যাচ্ছে।

-এগুলো কার জন্য?

-কার জন্য আবার! দোহার কাজিনদের জন্য। চল চল আয়। দোহা সেই কখন থেকে তোর কথা বলে বলে অস্থির হচ্ছে। দেখা গেলো তোর দেখা না পেয়ে কেঁদে কেটে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলো!

হিমি কৌতুহলী গলায় বললো,

-বিয়ে এখনো হয় নি?

-আপাতত বর যাত্রী খাচ্ছে। তাদের খাওয়া শেষ হলেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়াবেন। আর দাঁড়ানো যাবে না দোস্ত, আইস্ক্রিম গলে যাচ্ছে। পরে আবার আমার টাকা দিয়ে খাওয়াতে হবে রাক্ষসগুলোকে! চল না!

হিমি মুচকি হেসে সূর্যের হাত থেকে কয়েকটা আইস্ক্রিম নিয়ে তার পেছনে চললো। সূর্য ভেতরে ঢোকে ভীড় ঠেলে উল্টো দিকের লনে চলে এলো। সেখানে জড়ো হয়েছিলো দোহার কাজিনরা। সূর্য এগিয়ে গিয়ে তাদের হাতে আইস্ক্রিম তুলে দিয়ে হিমিকে নিয়ে ডানদিকে চলে গেলো। কয়েক কদম যাওয়ার পর‌ই হিমির চোখে পরলো স্টেজে সিঙ্গেল সোফায় বসে থাকা কনের সাজে দোহাকে। বেগুনি রঙের বেনারসি গায়ে। গা ভর্তি সোনার গহনা। ঠোঁটে হাসির রেখা নেই। হয়তো বিয়েতে খুশির চেয়ে দুঃখটাই বেশি গ্রাস করে! তবে হিমিকে তার দিকে আসতে দেখেই সে চমৎকার এক হাসি দিলো। যেনো এটাই তার প্রাপ্তি। হিমিও হাসলো তার দিকে তাকিয়ে। দোহার চোখে মুখে অন্যরকম এক ঝলক দেখা যাচ্ছে এখন। হিমিকে দেখেই বুঝি? হিমি বুঝে না এই পাঁচটা প্রাণ তাকে এতো ভালোবাসে কেনো। কিসের এতো টান তাদের? কেনো এতো শাসন, আদর, আবদার, মান-অভিমান? তবে তাদের এহেন কাজগুলোয় শান্তি পায় হিমি। ভালো লাগে তার। মনে হয় বন্ধুত্বের চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কিছু নেই। থাকতে পারে না।

চলবে,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে