হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে থাকা মেয়েটার পরনে স্কুল ড্রেস।

0
795

হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে থাকা মেয়েটার পরনে স্কুল ড্রেস। নেভি ব্লু জামার সাথে সাদা ওড়না, সাদা পায়জামা। মেয়েটা আমার এতোটাই গা ঘেষে বসেছে যে আমি একটু নড়াচড়া করলেই তার পা আমার গায়ে স্পর্শ করবে। মেয়েটা অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার নীলচে চোখের দিকে তাকাতেই বুকটা ধ্বক্ করে উঠলো। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দু’হাত দিয়ে চোখ কচলে আবার তাকালাম। আমার ঘুমের রেশ পুরোপুরি কেটে গেছে। এবার আমার ভয়-ভয় করছে। পনেরো ষোলো বছরের এই রূপবতী কিশোরীকে ভয় পাওয়ার কারন হলো, আমার মনে হচ্ছে এই মেয়ে মানুষ নয়, অন্যকিছু।
অন্যকিছু কী? ভূত? আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম। না আমি ভূত-টুতে বিশ্বাস করি না। ভূত জিনিসটা মানুষের ভুল ধারণা ছাড়া কিছুই না। কিন্তু এই মাঝরাতে মেয়েটির এখানে থাকার প্রশ্নই আসে না। ঘুমানোর আগে বাইরের দরজা, ঘরের দরজা আমি নিজেই বন্ধ করেছি। বাড়িতে আমি একা। মেয়েটি ঘরে ঢুকলো কিভাবে?
নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছি ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটি বলল, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। আমি ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে যে কোন সময় মেয়েটার চেহারা পাল্টে যাবে। হরর মুভির মতো দেখতে দেখতে পনেরো ষোল বছরের কিশোরী হয়ে যাবে থুড়থুড়ে বুড়ি। নীলচে চোখ দু’টো হয়ে যাবে রক্তবর্ণ। তারপর আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমি চুপচাপ বসে ভয়ংকর কিছু ঘটার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আমি জানি না। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে মনে হলো মেয়েটা আমার পরিচিত। কোথায় যেন দেখেছি। খুব চেনা মুখ। আমার এই এক সমস্যা আমি মানুষের নাম-চেহারা মনে রাখতে পারি না।
‘কী ব্যাপার আমাকে চিনতে পারছেন না?’ মেয়েটির কণ্ঠে অভিমাণ। চিনতে না পারার কারনে ভূতেরা অভিমাণ করে আমার জানা ছিলো না। মেয়েটার দিকে তাকালাম। মৃদুস্বরে বললাম, অর্পা?
মেয়েটি হেসে বলল, যাক চিনতে পেরেছেন তাহলে।
আমি চোখ বন্ধ করলাম। কী ঘটছে আমার সাথে। এই মেয়ে কোন ভাবেই অর্পা হতে পারে না। কিন্তু সেই নীল চোখ, খাড়া নাক, ভরাট রঙিন ঠোট। আমি চোখ খুলে বললাম, তুমি অর্পা নও। কে তুমি? কী চাও? কেন এসেছো এখানে?
‘আমি অর্পা। আমি কিছুই চাই না। এখানে কেন এসেছি জানি না।’
লক্ষ্য করলাম ঘরের ভেতরে অন্ধকার কমতে শুরু করেছে। তাহলে কী সকাল হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললাম। হ্যাঁ সকাল হয়েছে।
‘কি সুন্দর সকাল।’ অর্পার কণ্ঠ শুনে পাশে তাকালাম। অর্পা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। অর্পাকে দেখে আমার আগের মতো ভয় করছে না। বরং আমি কিছুটা মুগ্ধ হয়ে অর্পাকে দেখছি। একটা মানুষ এতো সুন্দর হয় কি করে। অর্পা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি দেখছেন এভাবে?’
‘কিছু না। কেমন আছো তুমি?’
‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি? হ্যাঁ ভালোই আছি। কিন্তু তুমি আমাকে আপনি করে বলছো কেন?’
‘তাই তো, আমি তোমাকে আপনি করে বলছি কেন? আমরা তো ক্লাস মেট। তোমাকে আমার তুমি করে বলা উচিত। কিন্তু তোমাকে আমার বড় বড় মনে হচ্ছে।’
অর্পার কথা শুনে আমি হাসলাম। ‘তা ঠিক তোমাকেও আমার ছোট মনে হচ্ছে। অনেক ছোট। আট দশ বছরের ছোট।’
‘তুমি কিন্তু অনেকটা বদলে গেছ। চুল বড় রেখেছ। মুখে দাড়িও রেখেছ। তোমাকে আমার চিনতে না পারার কথা। অথচ তুমি আমাকে চিনতে পারছো না।’
‘কত বছর পরে দেখা বলো।’
‘তবুও আমাকে তোমার চিনতে পারার কথা। তুমি না আমাকে পছন্দ করতে।’
‘তোমাকে তো ক্লাসের সবাই পছন্দ করতো। তবে তুমি কিন্তু আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। হার্ট এ্যাটাক করেনি সেটাই বড় কথা।’
‘ভয় পাওয়ার কারন কী?’
প্রশ্নটা শুনে অর্পার দিকে তাকালাম। প্রশ্নটার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। অর্পাকে বললাম, আচ্ছা তুমি কিভাবে জানলে আমি তোমাকে পছন্দ করতাম?
অর্পা হেসে বলল, আমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে। চোখাচোখি হলেই চোখ ফিরিয়ে নিতে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমাকে পছন্দ করো।
‘কিন্তু তুমি তো পছন্দ করতে জাহিদ’কে। যতটুকু জানি তোমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।’
‘হ্যাঁ।’
‘ভালোবাসতে জাহিদ’কে?’
‘ভালোবাসি কি’না জানি না। তবে একটা টান অনুভব করি।’
‘তোমাদের প্রেমের গল্প কিন্তু ভালোই ছড়িয়েছিলো। লামিয়া তোমাদের লাইব্রেরিতে চুমু খেতে দেখেছিলো।’
‘ছিঃ সব মিথ্যা কথা। লামিয়া মিথ্যা কথা বলেছিলো। আমি চুমু খাইনি। আমরা শুধু গল্প করছিলাম।’
‘তুমি কী জানো এই কথাটা শুনে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম?’
‘বুঝতে পেরেছিলাম। কারন কথাটা ছড়ানোর পর থেকে তুমি আমার দিকে আর তাকাতে না।’
‘আচ্ছা তখন যদি আমি তোমাকে বলতাম আমি তোমাকে পছন্দ করি তাহলে কী আমাকে ভালোবাসতে?’
‘না। একটা সুন্দরী মেয়েকে কতো ছেলেই তো পছন্দ করে, ভালোবাসে। তাই বলে কী সবাইকে ভালোবাসা যায়?’
‘হুম তাও ঠিক।’
‘আমার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছো?’
‘নাহ্…’
‘আচ্ছা জাহিদের সাথে তোমার কথা হয়?’
‘স্কুল শেষ হবার পর দু’চার জন ছাড়া কারও সাথেই তেমন যোগাযোগ নেই।’
‘ও’
অর্পাকে দেখে মনে হলো সে মন খারাপ করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, জাহিদের সাথে দেখা করবে?
‘তুমি জানো সে কোথায় আছে?’
‘জানি না। তবে ঠিকানা যোগাড় করতে পারবো।’
‘আচ্ছা।’
অর্পা আনমনে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমি বাথরুমের দিকে পা বাড়ালাম। অর্পাকে পেছন পেছন আসতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, কি ব্যাপার আমার সাথে বাথরুমেও আসবে নাকি?
অর্পা দরজার সামনে এসে থেকে গেল। আমি চোখে মুখে পানি দিলাম। আমার মধ্যে এখন কোন ভয় কাজ করছে না। কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে। অর্পার উপস্থিতি যে এক ধরণের ভালো লাগা সৃষ্টি করেছে সেটাও বুঝতে পারছি।
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলাম অর্পা নেই। দু’বার অর্পার নাম ধরে ডাকলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই। হুট করে এক ধরণের শূণ্যতা অনুভব করলাম। দৌড়ে ঘরে আসলাম। অর্পা জানালার পাশের চেয়ারটায় বসে আছে। টেবিলে মাথা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। টুলটা নিয়ে অর্পার পাশে গিয়ে বসলাম। অর্পা টেবিল থেকে মাথা না তুলেই বলল, কিছু বলবে?
‘হ্যাঁ, কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।’
‘আমি কিন্তু জানি তুমি কী বলতে চাচ্ছো।’
‘তুমি জানো?’
‘হ্যাঁ জানি। জানো সেদিনের পর থেকে বাথরুম গেলে আমার ভয় করতো। সেদিনের পর থেকে আমি বাথরুমের লাইট কখনো জ্বালাতাম না। সন্ধ্যায় অন্ধকারে গোসল করতাম।’
‘আমি কিন্তু সেদিন কিছুই দেখিনি।’
‘তখন তো সেটা জানতাম না। এখন জানি।’
‘কিভাবে জানো?’
‘কিভাবে জানি সেটা বলতে পারছি না। তবে জানি সেদিন সাকীফ তোমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো। সাকীফ বাথরুমে উঁকি দিয়েছিলো। তুমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলে।’
‘তবুও সেদিনের জন্য স্যরি।’
‘বাদ দাও পুরোনো কথা।’
আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। ফোনটা হাতে নিয়ে এক এক করে বন্ধুদের কল করলাম। শেষমেষ রোহিতের কাছে জাহিদের ঠিকানা পেলাম। অর্পার দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিকানা পেয়েছি।
অর্পা এবার টেবিল থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে বলল, এখুণি যাবে?
‘হুম… আচ্ছা তুমি কী একটু বাইরে যাবে? আমি চেঞ্জ করবো।’
অর্পা ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আফিয়া ভাবির সাথে দেখা হলো। তিনি ছেলেকে স্কুলে দিতে যাচ্ছেন। আমাদের ক্ষণিকের চোখাচোখি হয়ে গেল। আফিয়া ভাবি কিছুদূর এগিয়ে যেতেই অর্পা জিজ্ঞাসা করলো, কে উনি?
‘কার কথা জিজ্ঞাসা করছো?’
‘ওই যে আন্টি। যার দিকে তাকিয়ে ছিলে।’
আফিয়া ভাবিকে আন্টি বলায় আমি একটু অবাক হলাম। তারপর ভাবলাম পনেরো ষোলো বছরের একটা মেয়ে তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছরের এক মহিলাকে আন্টি বলতেই পারে। অর্পা বলল, কী হলো কিছু বলছো না কেন?
‘পাশের এলাকার নতুন ভাড়াটে।’
‘আসলে তোমাদের পুরুষদের দৃষ্টি খারাপ।’
‘হুম ঠিক বলেছো। রূপবতী মেয়েদের দেখলে আমাদের চরিত্র নড়বড়ে হয়ে যায়।’
‘তার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক-টম্পর্ক আছে না-কি?’
‘এমন কিছু না। তাকে আমার ভালো লাগে। আমি ভালো লাগা থেকে তাকাই।’
‘কী রকম ভালো লাগে?’
‘তুমি যেমনটা ভাবছো সেরকম না। আমি কল্পনায় তার শাড়ি খুলি না, তার কোমরের বাঁকে কপালের ঘাম মুছি না। ভালো লাগাটা শুধু চোখে। চোখের দৃষ্টিতে বলি আপনি সুন্দর। তিনি চোখের দৃষ্টিতে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যান, এটুকুই।’
‘ছিঃ তুমি অশ্লিল কথা বলো।’
‘মনে মনে সবাই অশ্লিল। মুখে বললেই দোষ।’
‘ওসব কথা থাক চলো।’
আমি আর কোন কথা না বলে পা বাড়ালাম। অর্পা আমার পাশে হাঁটছে। আমার ইচ্ছে করছে অর্পার হাত ধরতে। ইচ্ছেটা আজকের না, বহু পুরোনো ইচ্ছে। ধূলি জমা ইচ্ছেতে আজ অর্পা ফুঁ দিয়ে ধূলি উড়িয়ে দিয়েছে।
অর্পা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, তোমার ইচ্ছেগুলো পূরণ হবার নয়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কিসের ইচ্ছে?
‘এই যে আমার হাত ধরতে ইচ্ছে করছে। চুলের ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে করছে।’
‘তোমাকে কে বলল?’
‘আলিফ আমি বুঝতে পারি।’
পুরো রাস্তা আমি আর কোন কথা বললাম না। মনে কতো ভাবনা আসছে সব তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। আমার মনে হচ্ছে অর্পা আমার ভাবনাগুলো বুঝতে পারছে।
বাসে পেছনের দিকে একটা সিট পেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি অর্পা নেই। সে কী বাসে ওঠেনি? ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলে দ্রুত নেমে পড়লাম। অর্পার নাম ধরে ডাকলাম। এক বুড়ো সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সাইকেল থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অবাক হওয়াই স্বাভাবিক এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই। আবার ডাকলাম, অর্পা।
অর্পার কণ্ঠ শুনতে পেলাম, কী হলো বাস থেকে নামলে কেন?
‘তুমি কোথায় ছিলে?’
‘আমি তো তোমার পাশেই ছিলাম।’
‘তোমাকে দেখতে পাইনি তাই নেমে গেছি।’
অর্পা হাসলো। বুড়োটি এখনও দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
পরের বাসে অর্পা আমার সাথেই উঠলো। রংপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। অনেক কষ্টে জাহিদের অফিস খুঁজে বের করলাম। স্যুট বুট পরা লোকটাকে প্রথমে চিনতেই পারিনি। কত বছর পর দেখছি। ক্লাসে মারামারি করার কারনে যেই ছেলেটাকে নিয়মিত মোরগ বানিয়ে রাখা হতো, সেই ছেলেটা আজ স্যুট বুট পরে গদিঅলা চেয়ার গরম করছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জাহিদ বলল, ‘কী করছিস ইদানিং?’
‘কিছুই করছি না। বেকার।’
‘তা হঠাৎ করে আমার খোঁজ কেন?’
‘এমনি। তোর কথা মনে পড়ল তাই ভাবলাম দেখা করি।’
জাহিদের মুখ দেখে বুঝতে পারলাম সে আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। কিন্তু মুখের ওপর বলতে চাচ্ছে না। অর্পা আমার পাশের চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে জাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে বসে বললাম, তোর অর্পার কথা মনে আছে?
আমার প্রশ্ন শুনে জাহিদ বেশ অবাক হলো। ভ্রু কুচকে বলল, আলিফ ঘটনা কি বল তো। তুই কেন এসেছিস।
‘বল না অর্পার কথা মনে আছে তোর?’
‘মনে থাকবে না কেন।’
‘ওকে ভালোবাসিস এখনও?’
‘দেখ তুই যদি সব খুলে না বলিস তাহলে আমি কিছুই বলবো না।’
কথাটা বলার সময় জাহিদের ফোন বাজছিলো। কথাটা শেষ করে জাহিদ ফোন রিসিভ করে বলল, আমি একটু ব্যস্ত আছি। ফ্রি হয়ে তোমাকে কল করছি।
জাহিদ ফোনটা রাখতেই বললাম, তোর ওয়াইফ?
‘না। এখনও বিয়ে করিনি।’
‘গার্লফ্রেন্ড?’
জাহিদ আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না। আমি জাহিদের কাছে বিদায় নিয়ে তার অফিস থেকে বের হলাম। অর্পার দিকে তাকিয়ে বললাম, মন খারাপ?
অর্পা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, জাহিদ এখন আর আমাকে ভালোবাসে না।
.
প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। আমি স্কুলের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। দোতলার কোণের রুমটা দশম শ্রেণীর। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। দশম শ্রেণীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। অর্পা আমাকে পাশ কেটে ক্লাস রুমে ঢুকে গেল। প্রথম বেঞ্চে গিয়ে বসলো। অর্পা এখন আমার দিকে তাকাচ্ছে না। মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছে। এমন সময় ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো। আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি। ভীড়ের মাঝে অর্পাকে দেখতে পেলাম। সেই বেণী করা চুল, সেই স্কুল ব্যাগটি কাঁধে, সেই নীল চোখ। মাঠে দাঁড়িয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে অর্পা। আমি তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। ততক্ষণে মাঠ খালি হয়ে গেছে। স্কুলের পিয়ন চাবির গোছা হাতে নিয়ে প্রতিটা রুমের দরজায় তালা দিচ্ছে। আমি অর্পার নাম ধরে ডাকলাম। অর্পা নেই।
স্কুল থেকে বের হয়ে রাস্তার ওপাশে সালাম স্যারকে দেখতে পেলাম। উনাকে আমরা হুজুর বলেই ডাকতাম। কেননা তিনি শুধু ইসলাম শিক্ষার ক্লাস নিতেন। পরনে জুব্বা টুপি। এই লোকটা সেদিন অর্পার জন্য দোয়া করতে করতে কেঁদেছিলো। অনেকেই কেঁদেছিলো সেদিন। হুট করে অর্পার চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারেনি। অর্পার শেষ যাত্রার দিন আমি ছিলাম না। সাহস হয়নি। সাহস হয়নি পছন্দের মানুষটাকে চিরকালের জন্য বিদায় দেয়ার। অর্পা যখন অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে নিজের শেষ দিনগুলো পার করছিলো তখনও যাইনি দেখতে। ওর কষ্টটা দেখার সাহস করে উঠতে পারিনি।
বাসায় ফিরে গোসল করলাম। মাথাটা ঝিম ধরে ছিল। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। ঘরে এসে অর্পাকে কয়েকবার ডাকলাম। কোন সাড়া পেলাম না। হুট করে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বুকে চাপা ব্যাথা অনুভব করছি।
.
কবরটার মাটি ধসে বড় গর্ত হয়ে গেছে। গর্তের ভেতরে নিকষ কালো অন্ধকার। কিছু জংলী গাছ জন্মেছে। কবরটার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, অর্পা ভালো আছো? কোন সাড়া পেলাম না। আমার নেশা কেটে গেছে তাই হয়তো অর্পা সাড়া দিচ্ছে না। সন্ধ্যা নেমে আসছে। ইচ্ছে করছে আরেকবার নেশায় বুঁদ হতে। যদি নেশার ঘোরে আবার অর্পার দেখা পাই। সেখান থেকে চলে আসার আগে অর্পাকে বললাম, ভালো থেকো। কোথাও না কোথাও আবার দেখা হবে।।
.
written by:- MD Noor Islam

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে