হলুদ খাম
৮.
রাতে ঘুম হলোনা। ঘুমানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এলাম। ঘড়িতে রাত ৩ টা বেজে ৫ মিনিট। পুরো ঢাকা এখন গভীর ঘুমে ব্যস্ত হলেও রাস্তায় গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে আসছে। বারান্দার এপাশ থেকে ওপাশে কয়েকবার ধীরে গতিতে হাঁটলাম। যদি ঘুম আসে সেই আশায় কিছু সময় দ্রুত গতিতে হাঁটলাম কিন্তু লাভ হলোনা।
আমার ড্রেসিং টেবিলের নিচের ডান পাশের ড্রয়ারে পুরনো সেই খামটা রাখা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে খামটা হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় গিয়ে রেলিঙ ধরে দাঁড়ালাম।
নিকশ কালো অন্ধকার রাতের এই অশ্রুবর্ষণ কে দেখবে? দিনের আলোতেই কেউ দেখে না আর তো রাত!
হলুদ খাম খোলার সাহস পেলাম না। ছবির এই মানুষটা এখন আমার সামনে দিয়েই ঘুরেফিরে বেড়ায়। আমার সাথে কথা বলে। একসাথে চা, কফি খাওয়ার সুযোগও হয়তোবা খুঁজে। কিন্তু এই মানুষটার সামনে যাওয়ার ক্ষমতা একসময় আমার ছিলোনা। সামান্য একটা ছবির প্রেমে পড়ে অনেকটা নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছিলাম। গুটিয়ে থাকাটাই ভালো ছিলো আমার জন্য। শুধু শুধু এই অনুজ নামের ঝামেলায় পড়লাম।
অনেক হয়েছে এসব প্রেম ভালোবাসার চ্যাপ্টার। এখন নিজেকে এই পরিবেশ থেকে মুক্ত করতে হবে।
কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে ঠিক বাঁচা যায়না। যে স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম অরিত্রকে নিয়ে সেই স্বপ্ন আজ অতীতের ধুলো জমা স্মৃতি ছাড়া কিছুই না। যে ঘর বাঁধার, সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্ন ভাঙার শব্দে আমি বধির প্রায়!
ক্লাসমেট সবারই প্রায় বিয়ে, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে। যাদের হয়নি তাদেরও হবার পথে। পরে আছি একা আমি। না জীবনে করলাম প্রেম না করলাম বিয়ে!
আকাশ ভেঙে ঢাকার পথে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। আশেপাশে আজানের ধ্বনিতে সময়টা বুঝতে পারলাম। হলুদ খাম রেখে দিয়ে ওজু করে নামাজ পড়ে নিলাম।
মোনাজাতে চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ! আমাকে মুক্তি দাও। আমি আর পারছিনা সহ্য করতে।
রাত জাগলে আমার তেমন একটা কষ্ট হয়না। একপ্রকার অভ্যাস হয়ে গেছে। অরিত্রের রিজেকশনের পর অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। রাত জাগলে মনে হয় জ্বর জ্বর। পুরো শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ঘুম তেমন আসেনা তবে সন্ধ্যার দিকে চোখ জ্বালা শুরু করে। তখন না ঘুমালে পাগল পাগল অবস্থা হয়।
বৃষ্টি থামলো ঠিক সকাল আটটায়। ততক্ষণে ঢাকার রাস্তায় পানি জমে ভয়াবহ অবস্থা। অফিসে এসে স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম যে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পেরেছি। আজকে অনুজ সাহেবের মুখোমুখি হতে হলো না। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন দুইদিনের। আব্দুস ছামাদ ভাই বললেন। ভালোই হয়েছে চোখের সামনে যতক্ষণ থাকবে কষ্টটা তত বাড়বে। দুইদিনে আমার আশাহত হবার কষ্টটা অনেকটা সয়ে যাবে তখন সামনে লাফালেও সমস্যা নেই।
লাঞ্চ টাইমের পরে অরিত্র অফিসে এলেন। আমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলেন। বেশিরভাগই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে। আমি যতটা সম্ভব হাসিমুখে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি। যাবার আগে কনফারেন্স রুমে সবাইকে ডেকে পাঠালেন।
অরিত্র বেশ ভালো মুডেই আছে বোঝা যাচ্ছিলো। আমি আমার আসনে চুপচাপ বসে ভাবছি হুট করে মিটিং ডাকার পেছনের কারণ। ভয় ভয় লাগছে চাকরিটা চলে যায় নাকি! সংসারের অবস্থা খুব খারাপ দিকে চলে যাবে। ঢাকার শহরে একটু ভালোভাবে বাঁচতে হলে টাকার খুব প্রয়োজন। তাও কম টাকা না, মোটা অংকের টাকা।
সবাইকে উদ্দেশ্য করে অরিত্র বললেন
– একটা মিনি ট্যুরের ব্যবস্থা করেছি আমি। স্পট আমার গ্রামের বাড়ি। টাঙ্গাইলে আমার গ্রামের বাড়ি। মোটামুটি ৩-৪ দিন থাকবো সেখানে। আপনারা কে কে যাবেন একটা লিস্ট করে মিস নীলুফারকে দিবেন।
মিসেস ফারিহা বললেন
– স্যার, ঢাকার বাহিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে আমি নেই। আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ।
অরিত্র মুখে প্রশস্ত হাসি এনে বললেন
– আমি সবাইকে ৩-৪ দিনের ছুটি দিতে চাচ্ছি। ভেবেছি বছরের কোনো একটা সিজনে আপনাদের ঘোরাঘুরির জন্য কয়েকটা দিন ধার্য করে রাখবো। এই মাসেরই ২০ তারিখ থেকে ছুটি শুরু হবে। আপনারা চাইলে অন্য কোথায় যেতে পারেন। আমার গ্রামের বাড়িতে গেলে সব খরচ আমি বহন করবো।
মিসেস ফারিহা বললেন
– এবারের মতো পারছিনা। সামনে বার চেষ্টা করবো।
অরিত্র বললেন
– দুইজন ব্যক্তির টাঙ্গাইলে যাওয়া বাধ্যতামূলক।
আব্দুস ছামাদ ভাই লাফিয়ে উঠে বললেন
– স্যার আমি এক নাম্বারে।
অনুজ হা হা করে হাসতে শুরু করলেন। অরিত্র দেখতেও যেমন সুন্দর তার হাসিটাও দারুণ। আমার ইচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। আর পারছিনা সহ্য করতে। তিক্ত অতীত যখন সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন কারই বা সহ্য ক্ষমতা ঠিক থাকে?
অরিত্র বললেন
– এক নাম্বারে আব্দুস ছামাদ ভাই আর দুই নাম্বারে মিস নীলুফার। আর লিস্ট আগামীকাল দিতে হবে। একদম কনফার্ম লিস্ট।
লস্কর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন
– স্যার আপনার গ্রামের বাড়ির লোকেশনটা যদি ভালোভাবে বলতেন।
– উফুলকি, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল।
– দারুণ হবে স্যার।
অফিস ছুটি হবার পরে বাসায় যাওয়ার জন্য রিক্সা খুঁজছি। অরিত্র তার নতুন মার্সিডিজ নিয়ে হাজির হলেন। আমার দিকে মুচকি হেসে বললেন
– আসুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
– আমি রিক্সায় যেতে পারবো।
– নীলুফার আমি জানি আপনি যেতে পারবেন কিন্তু চাচ্ছিলাম আপনাকে পৌঁছে দিতে আর ট্যুর বিষয়ে কথা বলতে।
আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। আর তখন আপনার রিক্সা খুঁজে পেয়ে বাসায় পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হবে।
অজ্ঞতা আমাকে অরিত্রের পাশের সিটে বসতে হলো। অরিত্র ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন আর তার পাশের সিটে বসতে হয়েছে। ড্রাইভ করছে আর ট্যুর বিষয়ে কথা বলছে।
আমি হ্যাঁ বা না দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।
মানুষের জীবন অনেক অদ্ভুত রকমের। যেটা থেকে পিছু ছাড়াতে চাই সেটাই বারবার পিছু নেয়।
আমাকে পালাতে হবে এই শহর থেকে এট এনি কস্ট!
চলবে…..
~ Maria Kabir