হলুদ খাম ৭.
সন্ধ্যা থেকে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত অনুজের ঘোরে রইলাম। সারাক্ষণ মাথার ভেতরে অনুজের কথা গুলো রিপিট হচ্ছিলো। মিরা কয়েকবার বাবাকে বলল
– বাবা, বাবা বড় আপা না পাগল হয়ে গেছে।
বাবা বিরক্তি নিয়ে বলল
– কেনো নীলু কী করেছে?
– একা একাই হাসছে।
সত্যিই কি আমি একা একাই হাসছি? শিওর হলাম নীরার কথায়৷ রাতে বিছানায় আমার পাশে শুয়ে শুয়ে তার চিরকালের গম্ভীর স্বরে বলল
– আপু কী হয়েছে তোমার? অফিস থেকে আসার পর থেকে একা একাই হাসছো।
– হাসির একটা কথা মনে পড়তেই হাসি আসছে।
– আপা, হাসির কথা মনে করে হাসা আর তোমার হাসির মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে।
নীরা কি বুঝতে পেরেছে? ছোটো বোনের কাছে এসব কথা শেয়ার করা যায়না। ব্যাপারটা এখানে চেপে যেতে হবে। আর অনুজ সাহেব কী ভেবে কথাটা বলেছে, তা তো আমার জানা নেই। দেখা গেলো সে হেয়ালির বশে বলেছে।
অনুজের মতো ছেলের আমার দিকে তাকানোর সময় এবং শখ কোনোটাই নেই।
গম্ভীর ভাব আনার চেষ্টা করে নীরাকে বললাম
– আমি হাসির কথা ভেবেই হাসছিলাম। বুঝতে পেরেছো?
নীরা কোনো উত্তর দিলো না। মোবাইল হাতে নিয়ে ডাটা কানেকশন অন করলাম। ভয়ে ভয়ে ম্যাসেঞ্জারে ঢুকলাম।
অনুজ সাহেব লিখেছেন
– মাছের তরকারিটা দারুণ স্বাদের ছিলো।
– ধন্যবাদ।
অনুজ সাহেব অনলাইনেই ছিলেন। ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলেন সাথে সাথেই।
– আপনি গল্পের বই পড়তে পছন্দ করেন?
– আসলে ঠিক পছন্দও না আবার অপছন্দও না। মনে করুন একটা বইয়ের প্রথম পেজ পড়ে ভালো লাগলে পড়ি।
আপনার কেমন লাগে?
– আমার বই পড়তে খুব ভালো লাগে। অবসর সময় বই দিয়েই কাটিয়ে দেই। একা থাকার অভ্যাস করতেই বইকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি।
একবার মনে মনে ভাবলাম জিজ্ঞেস করি নীল রঙের কথা কেনো বলল। আবার ভাবলাম যেহেতু সেই ওই বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছে না সেহেতু আমার না উঠানোই বেটার।
– গার্লফ্রেন্ডের সাথেই তো অবসর সময় কাটাতে পারেন। একাও হতে হবেনা।
– আমার জিএফ নাই।
– বলেন কি! বিশ্বাস হয়না।
– না মানে জিএফ ছিলো। ৭-৮ মাস হয়েছে ব্রেকাপের।
– কয়েকটা প্রশ্ন করি। কিছু মনে করবেন না তো?
– জিএফ সম্পর্কে তো? ব্রেকাপের কারণ আর প্রেম কীভাবে হলো এসবই তো?
– হ্যাঁ।
– আমাদের প্রথম পরিচয় ইউনিভার্সিটি কোচিং করতে এসে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে, আমারও তাই হয়েছিলো। অসম্ভব সুন্দর আর প্রাণোচ্ছল মেয়েটাকে দেখেই আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। ওর নাম মেঘলা। আমিই সেধে ওর সাথে কথা বলি প্রথমে। প্রথম যেদিন কথা বলতে যাই, আমার এখনো মনে পড়ে পা কাঁপছিল আমার। তোতলানোর অভ্যাস নাই তারপরও তোতলাচ্ছিলাম। মেঘলা এক গাল হেসে বলেছিল, অনুজ তুমি এভাবে কাঁপছ কেনো?
তখন আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়।
তারপর থেকে মেঘলা নিজ থেকেই আমার সাথে কথা বলতে আসতো। কোচিং ক্লাসের পর আমরা প্রায় সময়ই গল্প করে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কাটাতাম। আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে ডেটে যাওয়ার অফার দিতে বলল। যেখানে আমি মেঘলার সামনে দাঁড়িয়ে নরমাল ভাবে কথাই বলতে পারিনা সেখানে ডেটের জন্য অফার কীভাবে করবো? ফ্রেন্ডরা হাজারটা উপায় বলে দিল। হাজার বার প্রাকটিস করে গেলাম। কিন্তু মেঘলার সামনে গিয়ে কিছু তো বলতেই পারলাম না। উল্টো ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলাম। পরে, আমারই ফ্রেন্ড মেঘলাকে জানাল।
আমরা যেদিন প্রথম ডেটে গেলাম, সেদিন মেঘলা আকাশ ছিলো। ওর পরনে সাদা রঙের শাড়ি ছিলো। দুজনে ঘোরাঘুরি করলাম বেশ সময় ধরে তারপর রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলাম। ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলাম।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন বলেন, সময় বলেন সবই ওইদিন আর ওইসময়টা! প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিটা অদ্ভুত ছিল। ওর হাত যেদিন প্রথম ধরলাম, আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিলো। মেঘলা হাসতে হাসতে আমার গাল টেনে দিয়ে বলেছিল, এতো ভয় পাবার কিছু নেই অনুজ।
আমরা একই ডিপার্টমেন্টে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। একই সাথে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। ডিপার্টমেন্টে আমাদের সেরা কাপল বলা হতো।
দীর্ঘ সময় যাবত নিজের আশা ভঙ্গের গল্প শোনার মতো ক্ষমতা আমার আছে। মাত্র এক দিনের অল্পসময়ের তুচ্ছ একটা কথায় কতকিছু ভেবে বসেছিলাম আমি। অনুজের সাথে মেয়েটার সম্পর্কের বয়স অনেক আর ভালোবাসাটাও গভীর।
অনুজ যে এখনো মেয়েটাকে ভুলতে পারেনি বোঝাই যাচ্ছে।
ডাটা কানেকশন অফ করে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ব্রেকাপ কীভাবে হয়েছে জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। মাত্র ৭-৮ মাসের ব্রেকাপ। যেকোনো সময় আবার সম্পর্ক হয়েও যেতে পারে।
সেধে গিয়ে আবার কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ হয়না।
নিজের অজান্তেই দুই এক ফোটা পানিও গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে। ধুর!
চলবে…..
~ Maria Kabir