হলুদ খাম ৬.
ঘুম ভাঙার পরে নিজের অজান্তেই ডাটা অন করলাম। অনুজের ছোট্ট একটা ম্যাসেজ দেখে অদ্ভুত অনুভূতি হলো।
তেমন কিছুই লেখেনি সে। মাত্র দুটি শব্দ
– গুড মর্নিং
আমিও রিপ্লাই দিলাম ওই দুটো শব্দ। আজকের সকালটা কি একটু অন্যরকম? নাকি অন্যান্য দিনের মতোই সাধারণ?
মোবাইল চার্জে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বুয়া চলে এসেছে এমনকি তার নাস্তা বানানো শেষের পথে। আমার আর মায়ের জন্য দুই কাপ চা বানালাম।
মা সকাল থেকে একটু বেশি কথা বলতে শুরু করেছে। ছোটোটা হয়তোবা আজকে বেশি মজা করে ফেলেছে।
নীরাটা একটু বেশি গম্ভীর প্রকৃতির। সবকিছুই তার কাছে সিরিয়াস ম্যাটার মনে হয়। ঠাট্টা শব্দটাতেই তার এলার্জি। আর চেহারাটাও তার মেজাজের সাথে একদম মানানসই। নীরা আমার প্রতি অনেক বেশি সেন্সিটিভ। আমি একটা হাঁচি দিলেও গোমড়া মুখ করে বলবে
– আদা চা করে দিচ্ছি।
আমার হ্যাঁ বা না এর অপেক্ষায় থাকেনা।
আর মিরাটা ঠিক উল্টো। সবকিছুতেই সে মজা খুঁজে পায়। ঠাট্টা তার শিরা ধমনীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মা বা বাবা কারোরই সাথে মিরার স্বভাব চরিত্র ঠিক মিলে না। বাবা অবশ্য বলেন, মিরা নাকি তার বড় বোনের মতো হয়েছে।
আর আমি নীরার মতো সিরিয়াসও না তেমন আবার মিরার মতো ফানি মুডেরও না। কিছু সময় খুব সিরিয়াস আর কিছু সময় খুব ফানি।
হাঁচি দেয়ার ব্যাপারটা মিরা ব্যাখ্যা করতো কিছুটা এভাবে
– বড় আপু দেখি হাঁচি দিচ্ছে। বড় আপা তোমার নাক দিয়ে কি এখন সাদা রঙের পাতলা জেলি বের হবে? নাকি ঘন ইষৎ টিয়া রঙের জেলি বের হবে? নাকি থকথকে কাদার মতো বের হবে?
নীরা আশেপাশে থাকলেই মিরা এভাবে বলবে। সাথে সাথে নীরা বমি করে ফ্লোর মাখাবে।
মা নীরা হবার পর থেকে অসুস্থ হতে শুরু করে তার জন্য নীরা আর মিরা আমার কাছেই বড় হওয়া। তবে নীরা আমাকে একটু বেশিই পেয়েছে তাই একটু বেশি ভালোবাসে আমাকে। আর মিরার সময় বাবা কাজের মেয়ে নিয়ে এসেছিল। অরিত্রের বিয়ের জন্য না বলার পর থেকে আমার প্রত্যেকটা মন খারাপের সঙ্গে নীরার পরিচয় আছে। দেখা গেছে আমি নীরবে কাঁদছি, নীরা দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়েছে।গোল গোল দুটো চোখ তখন হাজারটা স্বান্তনার বাণী ঝড়াত কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতো না।
আমার সবকিছু নীরা গুছিয়ে রাখে। আর আমার কখন কী লাগবে সব তার নখদর্পনে। ছোটো হয়েও সে বড় বোনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
মায়ের সাথে বসে চায়ের পর্ব শেষ করে গোসল সেরে নাস্তা করে নিলাম। নীরা আর মিরা স্কুলে। বাবা বারান্দায় বসে আরাম করে খবরের কাগজ পড়ছে।
হালিমা খালাকে বলে আলাদা আরেকটা বক্সে মাছের তরকারি নিলাম অনুজ সাহেবের জন্য। বেচারা আজকেও বোধহয় ভাজি আর ভাত নিয়ে আসবেন।
অফিসে এসে অনুজের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। কালো রঙের ফুল হাতা শার্টের সাথে কালো জিন্স পরেছেন। হাতের ঘড়িটা খুব সম্ভব নতুন। গলায় লাল রঙের টাই। বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে আব্দুস ছামাদ ভাইয়ের কেবিনের দিকে যাচ্ছেন। গায়ের রঙ শ্যামলা আর ঘন চুল গুলো জেল দিয়ে শান্ত বানিয়ে রেখেছেন। চেনা গম্ভীর চেহারার মানুষ টাকে আজকে কি নতুন করে দেখলাম? তাই তো মনে হচ্ছে আমার৷
চোখের সামনে এমন স্মার্ট একজন পুরুষ ছিলো এতদিন খেয়াল করিনি।
আমার কেবিনে এসে কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম। নিজের মনকে বোঝালাম, সারাদিন অনুজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবেনা। অরিত্র এসে যদি দেখেন অফিসের কাজ ফেলে পরপুরুষকে দেখছি তাহলে চাকরি আর থাকবেনা।
অনুজ সাহেব প্রায় প্রতিদিনই আমার কেবিনে কিছু না কিছু কাজের জন্য আসেন৷ কিন্তু আজকে আসছেন না। কাছ থেকে দেখার এটাই একটা সুযোগ। কিন্তু লাঞ্চ টাইম হয়ে আসছে কিন্তু সে এ পথে এলোই না। লাঞ্চ টাইমই একমাত্র ভরসা মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।
অনুজ সাহেবের ক্যানটিনে ঢোকার মিনিট পাঁচেক পরে আমি গেলাম।
তরকারির বক্স তার টেবিলে রেখে বললাম
– আপনার জন্য।
মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বললেন
– এসবের দরকার ছিলো না।
– আপনার কাজের বুয়া চলে আসলেই আর দরকার হবেনা।
অনুজ আর কিছু বললেন না। অথচ আমি চাচ্ছিলাম উনি আমাকে গতকালের মতো একসাথে লাঞ্চ করার জন্য অফার করুক।
কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে নিজের টেবিলে এসে খেতে বসলাম। আর কানে ধরে প্রমিজ করলাম, আর কোনোদিন তার জন্য খাবার আনবো না। সে হাজার রিকুয়েস্ট করে মরে গেলেও আমি তার সাথে খেতে বসবো না। অসভ্য ফাজিল লোক।
ছুটি হবার দশ থেকে পনেরো মিনিট আগে অরিত্র এলেন। এসেই আমার কেবিনে ঢুকলেন। আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে গল্প জুড়ে দিলেন।
আমি বারবার অফিস সংক্রান্ত কথাবার্তা শুরু করার চেষ্টা করে পারলাম না। আমার ভালো লাগা, কী কী পছন্দ এসব নিয়েই কথা চালিয়ে যেতে চাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে আমাকেও চালাতে হচ্ছে।
মাঝে কামরুল ভাইকে দিয়ে ব্ল্যাক কফি আর বার্গার আনিয়েছেন অরিত্র।
অনুজ এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। হাত ভর্তি ফাইল নিয়ে কেবিনে ঢুকলেন। বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন
– ম্যাম, ফাইল গুলো চেক করে দেখুন। ঠিকঠাক আছে কিনা।
অরিত্র অনুজের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন।
ফাইল নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়াতে অরিত্র নিজ থেকেই উঠে দাঁড়ালেন। মুখে প্রশস্ত হাসি এনে বললেন
– মিস নীলুফার, আপনি কাজ করুন। আমার একটু ব্যস্ততা আছে।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।
ফাইল চেক করে অনুজের হাতে দিয়ে বললাম
– ঠিকঠাকই আছে।
অনুজ আমার দিকে তাকিয়ে খুবই ধীরে ধীরে বললেন
– ম্যাম আপনাকে নীল রঙে দারুণ মানায়। নীল শাড়িতে আপনাকে নীল অপ্সরাদের মতো লাগবে।
কোনো পুরুষের কাছ থেকে এই প্রথম এমন প্রশংসনীয় উপমা শুনলাম। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যাবার উপক্রম। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হয়েই যাচ্ছে। মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেলো।
অনুজ বললেন
– ম্যাম, একটা রিকুয়েস্ট রাখবেন?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন
– নীল শাড়ি পরে আপনি আমার সামনে কখনো আসবেন না। তাহলে আমার পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
কথাটা বলে অনুজ দ্রুত পায়ে ফাইল গুলো নিয়ে কেবিন ছেড়ে পালালো। অনুজের কাছ থেকে এমন কথা শুনবো ভাবতেও পারিনি আমি।
শেষ কথাটা শোনার পরপর আমি নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম৷ এভাবে তো দূরে থাক কোনো ছেলেই আমাকে এ ধরনের কথা কখনোই বলেনি।
নিজের অজান্তেই অনুজ শব্দটা কয়েকবার উচ্চারণ করলাম।
চলবে…..
~ Maria Kabir