হলুদ খাম ৩.

0
1447
হলুদ খাম ৩.
বাথরুমের দরজায় ছোটো বোন কড়া নেড়ে বলে গেলো
– বড় আপু, বাবা ডাকছে। আর কতক্ষণ এভাবে বাথরুমে থাকবা?
আমি কান্নাটাকে চেপে রেখে স্বাভাবিক স্বরে কথা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। কী বিশ্রী একটা ব্যাপার! এদিকে ছোটোটা দরজায় কড়া নেড়েই যাচ্ছে আর বাথরুম থেকে বের হওয়ার জন্য বলছে।
বেসিনে মুখ ধোয়া সময় আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে। চোখ, মুখ ফুলে ফেঁপে অস্থির অবস্থা। এই অবস্থায় কেউ দেখে ফেললে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তাকে। না বের হয়েও উপায় নেই।
ভাবতে ভাবতেই মুখে পানির ঝাপটা দিলাম কয়েকবার। তারপর জামা কাপড়, চুল ঠিক করে দরজা খুলে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
বাবা, মেজোটা আর ছোটোটা প্রায় কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাতে শাবল দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম
– শাবল কেনো বাবা?
নিজের কণ্ঠস্বর শুনে আমি আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম।
কণ্ঠে কেউ যেন ভাইব্রেশন সেট করে রেখেছে।
মেজোটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
– বাথরুমে কী করছিলে এতোক্ষণ?
– কই এতোক্ষণ?
– আধা ঘণ্টা ধরে তুমি বাথরুমে বসে আছো। আমরা ভাবলাম খারাপ কিছু ঘটে গেলো নাকি!
– খারাপ কিছু কেনো হবে? পেটে একটু সমস্যা হয়েছে তাই আরকি…
ছোটোটা হাসতে হাসতে বললো
– আপুর পাতলা পায়খানা হয়েছে তাই না? উইযে ডারুম ডুরুম শব্দ করে বাথরুম হয়। পুরো প্যান মেখে যায়।
মেজোটা নাক মুখ কুঁচকে বললো
– ছিঃ কীসব বাজে কথা বলছিস?
ছোটোটা আবার বলতে লাগলো
– হলুদ রঙের পাতলা পায়খানা…..
মেজোটা সাথে সাথে বমি করে বাবার লুঙ্গি মাখিয়ে দিলো।
রাতে মায়ের বিছানায় মশারি টানিয়ে দেয়ার সময় মা জিজ্ঞেস করলেন
– তোর কি মন খারাপ মা?
আমি চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললাম
– তা কেনো হবে?
মা আর কিছু বললেন না। চোখ বুজে কিছু একটা হয়তোবা ভাবতে লাগলেন।
বাবা ডাইনিং রুমে পেপার পড়ছেন। রাতে ঘুমানোর আগে কড়া লিকারের এক কাপ চা হলে নাকি তার ঘুম আসেনা। আর সেই চা – টা আমারই করে দিতে হবে। সুস্থ থাকা অবস্থায় মা বানিয়ে দিতেন।
চায়ের পাতি পানিতে ঢালার আমারও ইচ্ছে হলো বাবার সাথে বসে এক কাপ চা খেতে। যেই ভাবা সেই কাজ।
বাবার হাতে চায়ের কাপ দিলাম। বাবা পেপার রেখে দিয়ে বললেন
– বোস, কথা বলি একটু। সারাদিন তো তোকে পাওয়াই যায়না।
বাবার পাশে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম
– অফিসের কাজ অনেক বেড়েছে বাবা।
– মা
– বলো বাবা
– তোর সাথে আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি। ঠিক না?
– না তো। কবে অন্যায় করলে?
– অরিত্রের ব্যাপারটা?
– বাবা অতীত টেনে এনো না তো।
– অতীত আমি টানছিনা। তুইই টেনে আনছিস।
– কই বাবা?
– আজকে বাথরুমে সুইসাইড করার চেষ্টা করিসনি তুই?
আমি কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। আমি কখনোই সুইসাইডের কথা ভাবিনি কিন্তু বাবা এসব বলছে কেনো?
– না বাবা আমি কখনোই সুইসাইডের কথা ভাবিনি আর ভাববোও না।
– তাহলে বাথরুমে এতোটা সময় কী করছিলি?
কী বলবো ভেবে না পেয়ে ছোটো যা বলেছিলো তাই বলে দিলাম।
বাবা কিছু না বলে বললো
– এবার অন্ততপক্ষে বিয়েটা করে নে।
– কেনো যেন মন টানেনা।
– অরিত্র কিন্তু সুখে আছে আর তুই নিজেকে শেষ করছিস।
– মোটেও না বাবা। আমি ভালো আছি।
– আমরা মানুষ নামক উন্নত শ্রেণির প্রাণী। আমাদের মানুষের মন খারাপ ব্যাপারটা বোঝার ক্ষমতা অনেক। একজন মানুষের পাশে বসেই তার মন খারাপ ধরে ফেলতে পারি।
– না বাবা। আসলে পেট খারাপ তো আবার অফিসে অনেক কাজ ছিলো। তাই শরীর ক্লান্ত আর শরীরের সাথে সাথে মনও ক্লান্ত।
– তাহলে যা ঘুমিয়ে পড়।
রাতে ঘুম হলোনা। যা একটু চোখ বুজে এসেছিলো হঠাৎ অরিত্রের চেহারাটা ভেসে আসলো। এপাশ ওপাশ করতে করতেই রাত পার  হয়ে গেলো।
আজানের সাথে সাথে উঠে ওজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। বাবা অবশ্য নিজেই উঠতে পারেন ফজর নামাজ পড়ার জন্য।
বাবা মসজিদ থেকে আসার ৫ মিনিট আগেই আমার চা বানানো হয়ে যায়।
বাবা এসে বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে সল্ট বিস্কুট দিয়ে আয়েশ করে চা খান।
মাঝেমধ্যে ছোটো টাও সঙ্গ দেয় কখনো আমি। তবে মেজোটা নামাজ পড়েই আবার ঘুম দেয়। আর মা তো তার জীবনকে বিছানায় আটকে নিয়েছেন। কবে যে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে বসবেন আল্লাহ তায়ালাই জানেন।
অফিসে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে মাথাটা কেমন ভার হয়ে ছিলো। কড়া লিকারের চা খেয়েও ঠিক হলোনা। এদিকে অফিসে লেট হলে চেয়ারম্যান সাহেবের বকাঝকাও শুনতে হবে। চাকরিটা কোনোভাবেই খোয়ানো যাবেনা। তাহলে সংসারের টানাপোড়ন আবার শুরু হবে।
১ ঘণ্টার উপরে জ্যামে থাকার পরে অফিসে পৌঁছে গেলাম।
১০ টা বাজতে ১ মিনিট বাকি আমার কেবিনে ঢুকে দেখি অরিত্র ক্লায়েন্ট দের জন্য রাখা সোফায় বসে আছেন।
আমি সালাম দিলাম। সালামের উত্তর দিয়ে অরিত্র বললেন
– আপনি তো ভালো টাইম মেইনটেইন করতে পারেন।
– তাছাড়া তো উপায় নেই।
– তারপরও অনেকের ১০ টা বাজার ৫ মিনিট বা ১০ মিনিট বা তার আগে অফিসে এসে উপস্থিত হন কিন্তু আপনি তো একদম কারেক্ট ১০ টায় এসেছেন।
কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
অরিত্র বললেন
– আপনাকে দেখার পর রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে মনে হলো, আপনাকে আমি চিনি। অনেক ভেবেও মনে পড়লোনা। বেশ অশান্তিতে পড়লাম। তাই অফিসে এসে পড়লাম।
– আমার বাবার সাথে আপনার বাবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে।
– ওয়েট ওয়েট আপনার সাথেই তো আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো? এবার মনে পড়েছে।
– হুম।
– আপনি তো পুরোপুরি চেঞ্জ হয়ে গেছেন।
এতোটাই যে আপনাকে দেখে চিনতেই পারিনি।
– না চেনারই কথা। আপনি আমাকে একবারই দেখেছিলেন।
– একবার দেখে থাকলেও আপনার চেহারায় একটা কিছু আছে যেটার কারণে আপনাকে মনে রাখতে সবাই বাধ্য হবে।
– কিন্তু আপনিই তো মনে রাখতে পারেননি।
– মনে হয়না। মনে রেখেছি কিন্তু এতো প্রেশার যে ভুলে যাই।
– আপনি বসুন। চা আনতে বলি কামরুল ভাইকে?
– হ্যাঁ বলতে পারেন। তবে শর্ত আছে।
– বলুন।
– দুই কাপ চা আনতে বলবেন। এক কাপ আমার আর এক আপনার।
অগ্যতা আমাকে চা খেতে হলো তাও তার সাথে। আমার কেবিনে মিনি সোফা রাখা মুখোমুখি। আমাকেও তার মুখোমুখি বসতে হলো।
গল্পের এক পর্যায়ে অনুজ এসে উপস্থিত হলেন।
অরিত্রকে সালাম দিয়ে আমাকে বললেন
– ম্যাম, গতকালের ফাইলটা যদি একটু চেক করে দিতেন তাহলে ভালো হয়।
অরিত্র বললেন
– মিস্টার অনুজ, আপনি এখানে নিয়ে আসুন। মিসেস নীলুফার এখানেই বসে চেক করে দিবেন।
অনুজ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।
আমি আমতা আমতা করে বললাম
– আমি আনম্যারিড।
– বলেন কি এখনো বিয়ে করেননি?
– না।
– কেনো?
– এখনো তেমন কাউকে পাইনি।
কত সুন্দর করে মিথ্যা কথাটা বললাম।
– আমি কি খুঁজে পেতে সাহায্য করবো?
ভদ্রতার খাতিরে বললাম
– হ্যাঁ পারেন।
– আমাকে বিয়ে করবেন?
আমি এর উত্তরে কী বলবো? আমার দিকে তাকিয়ে অরিত্র মিষ্টি করে হাসছেন। এতো সুন্দর হাসি কীভাবে হতে পারে কারো???
চলবে……
© Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে