হলুদ খাম ২
আমার কেনো যেন পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। দুই পায়ে কয়েক মণ ওজনের পাথর লাগিয়ে দিয়েছে। এদিকে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিনই যদি লেট হয় তাহলে অবশ্যই অরিত্র সাহেবের কাছে দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভাববেন।
একজন পথচারী পিছন থেকে বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন
– রাস্তা কি নিজস্ব সম্পত্তি নাকি? কোন সময় থেকে বলছি একটু সরুন। এতোই যদি দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছা তাহলে সাইডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন।
আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম
– আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
লোকটা কিছু না বলে চলে গেলেন। আমিও এগোলাম। বাস্তবতাকে তো অনেক আগেই মেনে নিয়েছি। তাহলে সামনা-সামনি হতে সমস্যা কোথায়?
আর আমি তো সেধে তার সামনে যাচ্ছিনা। আমি তার কোম্পানির এমডি।
লিফটে দেখা হয়ে গেলো অফিসের সবচেয়ে গম্ভীর কর্মকর্তার, অনুজ এহসান। আমাকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন
– ম্যামকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?
– না তো।
আমি খুব সুন্দর করে মিথ্যেটা বললাম। এই মিথ্যেটাই তো আমার সবচেয়ে বড় ভরসা।
অনুজ এহসান মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না।
লিফট ফোর্থ ফ্লোরে এসে থামলো। আমি আর অনুজ বের হলাম।
পুরো অফিসটাকে সাজানো হয়েছে। সাজানোর প্ল্যানটা আমারই ছিলো। যেহেতু পরিচয় পর্ব প্লাস মিটিং সেহেতু আজকে সবাইকে অফিস থেকেই লাঞ্চ করানো হবে।
লাঞ্চের কথা শুনে ভোজন রসিক আব্দুস ছামাদ ভাই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বললেন
– ম্যাম, পুরান ঢাকার হাজী বিরিয়ানি হলে মন্দ হতো না।
অনুজ বললেন
– আমাদের চাকরি থাকে কিনা তাই চিন্তা করুন।
ছামাদ ভাই রসিকতা করে বললেন
– চাকরি নট করলে আমরা ধর্মঘট করবো। এতো সিরিয়াসলি নেন কেনো সবকিছু?
অনুজ আর কিছু বললেন না। ওনার এই একটা অভ্যাস। অনেক প্রশ্নের এমনকি অনেক কথারও কোনো উত্তর দেননা।
প্ল্যান অনুযায়ী সবকিছু করা হয়েছে কিনা দেখে নিলাম। সব ঠিকঠাকই লাগছে তারপরও মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। হঠাৎ মনে হলো, চাকরি টা ছেড়ে দেই।
কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিলে তো হবেনা। টাকা ছাড়া এই পৃথিবীতে নিশ্বাস নেয়াটাও অভিশাপের সমতুল্য।
হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলাম। ১০ টা ১৫ বাজে, বাঙালি বলে কথা। এরা দেরি করে আসাটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যে যত সম্পদশালী সে তত বেশি সময়ের অবহেলা করেন। কারণ এরা নিজেদের দাম টা বুঝাতে চান মানুষকে অপেক্ষা করিয়ে।
অরিত্র যে তার ব্যতিক্রম নয় সেটা অসম্ভব।
ঘড়ির মিনিটের কাটা যখন ৫ এর ঘরে গেলো তখনই অনুজ এসে বলে গেলো, চেয়ারম্যান সাহেব এসে গেছেন। ২ মিনিটের মধ্যে আমাদের অফিসে পা দিবেন আপনি আসুন।
আমি চোখ বুজে নিজেকে বুঝিয়ে নিলাম।
এ তোর হলুদ খামের অরিত্র নয়। এই অরিত্র তোর কোম্পানির চেয়ারম্যান।
তার সাথে কোম্পানির বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলা একদমই ঠিক হবেনা।
আমি যা ভেবেছিলাম ঠিক উল্টোটা হলো। খুবই স্বাভাবিক আচরণ করলাম।
তাকে দেখার পর কেমন যেন লাগছিলো কিন্তু সেই কেমন লাগাটাকে আটকে রেখে নিজেকে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করলাম। অরিত্র আমাকে চিনতে পারেননি। না চেনারই কথা। জীবনে একবারই আমাকে দেখেছেন।
চেহারায় পরিবর্তন এসেছে তবে আগের তুলনায় বেশি সুন্দর আর স্মার্ট হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য বেড়েছে, বাড়াটাও স্বাভাবিক। বিয়ের পরে কারো স্বাস্থ্য বাড়ে কারো কমে। কিন্তু বিয়ের আগে যেমন ছিলো তেমন থাকেনা।
মিটিং হবার কথা ছিলো কিন্তু হলোনা। অরিত্র পুরো অফিসটা একবার ঘুরে দেখলেন।
আমাকে বললেন
– মিস নীলুফার, কেমন আছেন?
– ভালো। আপনি কেমন আছেন?
– খারাপ না। আপনার নামটা সেকেলে ধরনের। সে যাইহোক নাম আপনার সেকেলে হলেও কাজ করতে হবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে।
– অবশ্যই। যুগের সাথে তাল মিলাতে না পারলে তো হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিক।
– সম্ভাবনা না, হারিয়ে যেতেই হবে।
– মিটিং এখনই করবেন নাকি পরে?
অরিত্র বিরক্তি নিয়ে বললেন
– আসলে আমার ওয়াইফের সাথে শপিংয়ে যেতে হবে। মিটিং টা ক্যান্সেল করে দিন। আর দুপুরের জন্য পুরান ঢাকার হাজীর বিরিয়ানি অর্ডার করা আছে। লাঞ্চের সময় পেয়ে যাবেন।
– আপনি আর আসবেন না?
– না।
অফিসে ছিলেন মাত্র ২ ঘণ্টা আর আমার কাছে লাগলো ২ যুগের সমতুল্য।
মানুষটাকে বেশ হাসিখুশি মনে হলো। সে যে সুখী একজন মানুষ বোঝাই যাচ্ছে।
মিটিং হবেনা জেনে অনেকেই শান্তি পেলো। কিছু মানুষ মিটিং টাকে জমের সাথে আলোচনার সমতূল্য ভাবে।
আব্দুস ছামাদ ভাইকে বিরিয়ানির কথা জানালাম।
সে আনন্দে গদগদ হয়ে বললেন, এই হলো চেয়ারম্যান!
মাসে দুই একবার এমন আয়োজন হলে মন্দ হয়না।
অনুজ তার গম্ভীরতা রক্ষা করেই বললেন
– আচ্ছা মিটিং কবে হবে বলে গিয়েছেন?
– আমার তো জিজ্ঞেস করতেই মনে নেই।
অনুজ আর কিছুই বললেন না।
দুপুরে বিরিয়ানি চলে এলো। সবাই বেশ হৈহল্লা করেই লাঞ্চ টাইম পার করলেন। কেনো যেন, আমারই খাবার গলা দিয়ে নামছিলো না।
বাসায় এসে বাথরুমে গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম।
সকাল থেকেই এই কান্নাটা নিজের মধ্যে আটকে রেখেছিলাম।
কিন্তু আটকে রেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না।
জানিনা এমন কেনো হলো আমার সাথে। এতোটা ভালোবেসেও তাকে পেলাম না।
কেনো পেলাম না?
এর উত্তর আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই দিতে পারবেনা।
চলবে……..
© Maria Kabir