হলুদ খাম  ১০.

0
1607
হলুদ খাম  ১০.
অর্ধেক পথে গাড়ি থামানো হলো পেট্রোল পাম্পে। কয়েকজন ওয়াশরুমে গেলেন, কয়েকজন আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। আমি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মিরার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। আমি তাকে নিয়ে আসিনি বলে খুব কান্নাকাটি করছে। আগামীতে নিয়ে যাবো এই আশ্বাস দিলাম কিন্তু সে মানতে নারাজ। অরিত্র ওয়ান টাইম গ্লাসে কফি ধরিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় কথা চালিয়ে যেতে বললেন।
আমার থেকে দুই হাত দূরে অরিত্র দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
মিরাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফোন রেখে দিলাম। কফি শেষ করে অরিত্রকে জিজ্ঞেস করলাম
– ম্যাম আসেননি?
অরিত্র ভূত দেখার মতো করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলা নামিয়ে বললেন
– ও আসলে ইংল্যান্ডে। ওর ফ্রেন্ডের ওখানে বেড়াতে গেছে।
– আপনার বাচ্চাদের দেখছিনা যে? ওরা ম্যামের সাথে?
– আমরা এখনো বাচ্চা নেইনি।
অরিত্র হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন
– আমাদের এখন রওয়ানা দেয়া উচিৎ। দুপুরের খাবার ওখানেই খাবো আমরা।
অরিত্র রাস্তার ওপারের দোকানের দিকে পা বাড়ালেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, অরিত্র তার স্ত্রীকে নিয়ে কথা বাড়ালো না কেনো? এমনকি স্ত্রীর কথা তোলার সাথে সাথে ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে রইলো। আমার মুখ থেকে এমন প্রশ্ন তিনি আশা করেননি। কিন্তু কেনো? আর স্ত্রী ইংল্যান্ডে স্বামীকে ছাড়াই চলে গেলো? হাই সোসাইটিতে যদিও এগুলো কিছুই না। আমাদের মতো মিডিল ক্লাসদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার। স্ত্রী, স্বামীকে ছাড়া একা একা ঢাকা আসলেও সালিশ বসানো হয়। আরতো ইংল্যান্ড!
যাকগে অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতো চিন্তা করা মানে সময় নষ্ট।
ওয়ান টাইম গ্লাস বিনে ফেলতে গিয়ে অনুজের দিকে চোখ গেলো। অনুজ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারা ভয়াবহ রকমের গম্ভীর। যদিও গম্ভীরতা তার রক্তের প্রধান উপাদান।
সে যদি গম্ভীর না থাকে তাহলে কে থাকবে?
হতেও পারে এক্সের কথা মনে পড়েছে।
আব্দুস ছামাদ ভাইকে তার স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটি করতে দেখলাম। সাথে ওনার ছোটো মেয়েটাকে দেখলাম না।
মেয়েটাকে অরিত্রের কোলে দেখলাম। অরিত্র খুব সম্ভব বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করেন৷ জার্নির শুরু থেকেই আব্দুস ছামাদ ভাইয়ের মেয়ের সাথে গল্প করতে দেখলাম। অনুজ অবশ্য বাচ্চাটাকে তেমন পাত্তা দেয়নি। এর কাছে শুধুই তার মেঘলা আদরের।
উফুলকি বাজারে পৌছালাম ঘড়িতে তখন দুটো বাজে। অরিত্র বললেন
– আর মাত্র ১০ মিনিটের পথ। তারপর পৌঁছে যাবো খান মঞ্জিলে।
অরিত্রের গ্রামের বাড়ির নাম খান মঞ্জিল। বাজারে তেমন লোকজন দেখলাম না। লাঞ্চ টাইম বলেই লোকজন কম। রাস্তার বাম পাশে ৬-৭ বছরের বাচ্চা হা করে দাঁড়িয়ে মাইক্রোবাস দেখছে। হয়তোবা ভাবছে, কোন আপদ এলো তাদের গ্রামকে দেখতে?
উফুলকি বাজার থেকে উত্তর দিকে গাড়ি চলতে শুরু করলো৷ কাচা রাস্তা, এ যুগেও কাচা রাস্তা আছে!
১০ মিনিটের মাথায় আমরা পৌঁছে গেলাম। রাস্তার এক পাশে যতদূর চোখ যায় সরিষার ক্ষেত। আরেক পাশে মানুষের বসবাস। ইটের দালান, টিন শেডের ঘর, টিনের চারচালা ঘর দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ধারের দোতালা বাড়ির সামনে এসে মাইক্রোবাস থামলো। মূল ফটকে মার্বেল পাথরে খোদাই করা, ” খান মঞ্জিল “।
দোতালা দালানের পেছনে বিশাল উঠোন। দোতলার উত্তরের একদম কোণার রুমটা আমার। তার পাশের রুমটা রুমকি আপার। রুমকি আপার পাশের রুমটা অনুজের। অরিত্রের রুম দোতালার পূর্ব দিকে। দোতালা এই বাড়ির স্টাইল এ যুগের না। বেশ আগের স্টাইলের আর রুম গুলোও কেমন লাইন ধরে দুই পাশে আর মাঝখানে স্পেস চলাফেরার জন্য।
আমার রুমের জানালা দিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরটা দেখা যায়। একাকী সময় কাটিয়ে দেয়ার জন্য এই জানালাটাই এনাফ।
রুমে লাগেজ থেকে জামা কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি ছেড়ে থ্রিপিস পড়ে নিলাম।
বিছানার পাশে ছোট টেবিলে খাবার পানির জগ আর গ্লাস রাখা।
ভেজা চুল মুছতে ব্যস্ত ছিলাম। দরজায় হঠাৎ টোকা পরলো।
– কে?
দরজার ওপাশ থেকে অল্প বয়সী মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেলো। গ্রাম্য স্বরেই বলল
– আপামনি নিচে খাইতে ডাকছে আপনারে।
– আচ্ছা ঠিকাছে আমি আসছি।
খাওয়ার নাম শুনেই খুদা মনে হয় একটু বেশিই লেগে গেলো। তাড়াহুড়ো করে চুল আঁচড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলাম। দরজা লাগানোর সময় অনুজকে তার রুম থেকে বের হতে দেখলাম। কিছু সময় পর নিচে নামাই ভালো। সবাই খুব সম্ভব খাবার রুমে চলে গেছে।
অনুজ সিড়ির দিকে চলে যাবার কিছু সময় পর আমি নামলাম।
খাবার টেবিলে অরিত্র তার পরিবার নিয়ে অনেক কথাই বললেন। তাতে বুঝতে পারলাম, এ-ই বাড়িতে তার ছোটো চাচা আর চাচী থাকেন। যদিও খাবার টেবিলে তারা অনুপস্থিত। মেজো চাচা সিলেটে সেটেল্ড ফ্যামিলি নিয়ে। আর বড় তার বাবা সে তো ঢাকায়। দাদা – দাদী অনেক আগেই মারা গেছেন। একটা মাত্র ফুপু, তিনি আমেরিকায় সেটেল্ড। ছোট চাচা চাচীর দুই ছেলে মেয়ের কেউই বাংলাদেশে থাকেননা৷ এর অর্থ এ-ই বিশাল দোতালা বাড়িতে দুই টোনাটুনির বসবাস। কাজের লোক যদিও আছে।
বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান সবার। আমি না করে দিলাম। এতদূর জার্নি করে এসে আমার ক্লান্তিটা বেশি লাগছিল।
লাঞ্চ সেড়ে সরাসরি নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
মোবাইলে ম্যাসেজ টোন বাজলো। সিম কোম্পানি ছাড়া কেউই ম্যাসেজ দেয়ার নাই। নীরা আর মিরা কখনো ম্যাসেজ করে না। ওরা সরাসরি ফোন দেয়। তারপরও ফোনের ম্যাসেজ চেক করলাম।
অনুজের কনট্যাক্ট নাম্বার দেখে অবাক হলাম। অফিসের স্টাফ বলেই তার কনট্যাক্ট নাম্বার মোবাইলের কনট্যাক্ট লিস্টে রাখা। যদিও আমার কখনো তাকে ফোন দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। অফিস টাইমে তার সাথে কাজ সম্পর্কিত ব্যাপার গুলো কমপ্লিট করে নিতাম।
ম্যাসেজ ওপেন করলাম। লেখা
– ম্যাম, আপনি আমার উপর কোনো বিষয় নিয়ে রেগে আছেন?
একবার ভাবলাম রিপ্লাই দিবো তারপর ভাবলাম না, দরকার নাই। ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়ে আবার আরেক ঝামেলা ঝামেলায় জড়ানোর ইচ্ছা নাই। একটা মাত্র ছবির জন্য আমার নিজের জীবন আজকে তেজপাতা।
সে ম্যাসেজ দিয়েছে আর আমি ইগ্নোর করেছি। ব্যাস কাহিনী শেষ!
মোবাইল বালিশের পাশে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
ক্লান্তিতে আর ভরাপেট খাওয়ার জন্য ঘুম আমাকে জাপটে ধরলো।
গভীর ঘুমে জড়িয়ে গেলাম!
চলবে……
~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে