#হঠাৎ_বৃষ্টি
পর্বঃ১০
জান্নাতুল নাঈমা
ধরণীতে নতুন একটি দিনের সূচনা। নতুন দিন নতুন বার্তা বয়ে আনে। কারো কাছে কষ্টের আবার কারো কাছে নিদারুণ সুখের। দীর্ঘ এক বিভীষিকাময় রাত পার করলো মেঘ। পুরোটা রাত ওভাবে বসে ছিলো আর অপেক্ষার প্রহর গুনেছিলো কখন কেউ এসে বলবে ‘তোমার শুভ্র,তোমার বৃষ্টিকণ্যা ঠিক আছে,ভালো আছে!’ মরুভূমিতে চলা এক তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো চেয়ে ছিলো ডক্টরের দিকে। অতঃপর রাত পেরিয়ে যখন ভোরের সূচনা হলো মেঘ আলোর রেখা পেলো। তার শুভ্র এখন আগের থেকে ভালো আছে। কেবিনে শিফট করা হয়েছে। উল্লাসে মৃদুলকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর দুই বন্ধু সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকর আদায় করে। চারদিকে আজানের ধ্বনি শুনে নামাজে চলে যায়।
শুভ্র কেবিনে শুয়ে আছে শুভ্রতা। শুয়ে আছে বললে ভুল হবে ঘুমের ইনজেকশনের জন্য গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। মাত্র নামাজ পরে এলো মেঘ। গায়ে শুভ্র রংয়ের একটা শার্ট। নামাজের আগে মৃদুল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। রক্ত লাগা জামায় তো আর নামাজ আদায় করা যায় না। কেবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ। মৃদুল কোনো একটা কাজে বাইরে গেছে। কাল সারারাত ছেলেটা মেঘের কাছে ছিলো। বাসায় যায় নি। শুভ্রতাকে ব্লাড দিয়েছে। মেঘ সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে! এক পা একপা করে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে যায়। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে। সারারাত কান্নার কারণে চোখ ফুলে গেছে। কাছে এসে একটা টুল টেনে শুভ্রতার বেডের পাশে বসলো। শুভ্রতার স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে মেঘের মন কেমন শান্ত হয়ে এলো। মেয়েটার মুখের বিভিন্ন জায়গায় ওয়ান্টেইম লাগানো। হাতের অনেক জায়গায় ব্যান্ডেজ। মুখটা শুকিয়ে গেছে। তাও মেঘের কাছে সে স্নিগ্ধ এক রমণী। যার এই মুখের দিকে তাকিয়ে সে জীবন পাড়ি দিতে পারবে! মেঘের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো। বারবার কালকের ঘটনা মনে পড়ছে। কাল যদি আর একটু দেরি করতো তবে! ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে মেঘের।
আলতো হাতে শুভ্রতার হাত উঠিয়ে নিজের গালে ঠেকালো মেঘ। শুভ্রতার হাত নিজের হাতের ভাজে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো। অতঃপর বলতে লাগলো,,’শুভ্র!
শুনছো তুমি? দেখেছো আমার অবস্থা! তোমাকে ছাড়া যে আমি কতোটা নিঃস্ব বুঝো তুমি? তোমার এই অবস্থায় আমার বুকের ভেতরে যে কতোটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে দেখতে পাচ্ছো তুমি? আমি খুব খারাপ তাই না? তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না। নিজের আনন্দে এতো মজে গিয়েছিলাম। তোমার খেয়ালই রাখতে পারলাম না! আমি খুব খারাপ তাই না? তুমি একবার সুস্থ হয়ে নাও,যা শাস্তি দেবে আমি সব মাথা পেতে নেবো। শুধু একটিবার সুস্থ হয়ে উঠো।’
কারো আসার আওয়াজে কথা থামায় মেঘ। ঘাড় কাত করে দেখে মৃদুল এগিয়ে আসছে। হাতে একটা খাবারের প্যাকেট। এইজন্যই সে গিয়েছিলো। ছেলেটা আর কতো খেয়াল রাখবে। যেখানে মেঘের উচিৎ ছিলো মৃদুলের খাবারের ব্যবস্থা করা সেখানে মৃদুল করছে। মেঘ ফোস করে একটা শ্বাস ফেললো। শুভ্রতার হাতটা আলতোভাবে সিটে রেখে দিলো। তারপর সম্পূর্ণ ভাবে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বলে,,’তুই বাসায় যাস নি যে? আমি তো ভেবেছি বাসায় চলে গেছিস!’
মৃদুল প্যাকেটটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,,’তোকে এই অবস্থায় রেখে যাই কি করে? একটু পরে অফিসে চলে যাবো। এখন আয় খেয়ে নে!’
‘আমার ক্ষিধে নেই। তুই খা!’ মেঘের কথায় মৃদুল প্যাকেট খুলে একটা পরটা ছিঁড়ে ডিম নিয়ে মেঘের মুখের সামনে ধরে বলে,,’না খা!’
মেঘ না করতে পারলো না। মুখে নিলো। মৃদুল তা দেখে মৃদু হেসে বলে,,’মনে আছে? প্রথম যেদিন আমি স্কুলে গিয়েছিলাম,কেউ আমার বন্ধু ছিলো না। তুই এসেছিলি আমার কাছে,এইভাবে নিজের টিফিন থেকে আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলি!’ মৃদুলের কথায় মেঘ মুচকি হাসলো। তারপর নিজেও এক টুকরো পরোটা মৃদুলের মুখে দিলো। মেঘ আর খেতে চাইলো না। গলা দিয়ে নামছে না। মৃদুলের কথা রাখতে এক টুকরো মুখে দিয়েছিলো। পানি খেয়ে আবারও শুভ্রতার দিকে তাকালো। মৃদুল তা দেখে নিজেও খেলো না রেখে দিলো।
‘আন্টি টেনশন করছে হয়তো। খবর দিয়েছিস?’ মৃদুলের কথায় মেঘ মাথা দুলিয়ে ‘না’ বুঝালো।
‘একটা খবর তো দিয়ে দিবি।’
‘হ্যাঁ জানাবো। আচ্ছা আমি কল করে আসছি।’ মেঘ কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল। ‘আচ্ছা।’ মৃদুল বলে।
________________
বিয়ে বাড়ির এতো হই হট্টোগলের মাঝে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে মেঘের মা। উনার ছেলে এমন বেয়ারা কিভাবে হলো বুঝতে পারছেন না। হুটহাট বলা কয়া ছাড়া বেরিয়ে যায়। জ্বালিয়ে মেরে খেলো উনাকে। উনার পাশেই কাঁদোকাঁদো মুখে সুমাইয়া বসে আছে। কাল এতো সুন্দর করে সেজেছিলো মেঘকে দেখাবে বলে। কিন্ত মেঘই নেই। হঠ্যাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গে দুজনের। দুজনেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘মেঘ’ নামটা দেখে চোখ চকচক করে উঠলো।
‘কিরে কই তুই? বলা কওয়া ছাড়া কোথায় চলে যাস? এমন বেয়ারা কবে থেকে হয়েছিস তুই!’ মায়ের ঝাঁঝালো আওয়াজে মেঘ কান থেকে ফোনটা একটু দূরে সরালো। উনার বলা শেষ হলে মেঘ শান্ত কন্ঠে বলে,,’মা আমি ঠিক আছি। তুমি বিয়ে এটেন্ড করো। আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
ছেলের এই রকম গলায় মেঘের মায়ের মন নরম হলো। নম্র গলায় বলেন,,’কেনো কোথায় তুই?’
‘হসপিটাল!’ হসপিটাল কথাটা শুনে মায়ের বুক কেপে উঠে। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাস করে,,’হসপিটাল মানে? কি হয়েছে তোর?’
মেঘের মায়ের কথায় সুমাইয়াও উদগ্রীব হয়ে উঠেছে শুনার জন্য। কান খাড়া করে রইলো।
‘আমার কিছু হয় নি। আমার খুব কাছের একজনের! আমার জন্য সব হয়েছে। আমি খেয়াল রাখতে পারি নি।’ কথাটা বলার সময় মেঘের গলা ভেঙ্গে এলো। মেঘের মা ছেলের কথা বুঝতে না পেরে বলে,,’কি হয়েছে আমায় বল না বাবা!’
‘তুমি (—–) হসপিটালে চলে এসো বিয়ের পর সব বুঝবে। রাখছি আমি!’ কথাটা বলে মেঘ ফোন কেটে দিলো। ‘কি হয়েছে আন্টি?’ মেঘের মা সুমাইয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে বিয়ে বাড়ি রেখে মেঘের বোন মেঘলাকে নিয়ে হসপিটালে বেরিয়ে গেলো। সবটা আগে জানা দরকার।
_________________
হসপিটালের করিডরে মেঘের মা আর মেঘ মুখোমুখি বসে আছে। পাশেই মেঘলা দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের অবস্থা দেখে মেঘের মা কিছুটা বুঝতে পারছেন। কিন্ত ছেলের মুখ থেকে না শুনা অবধি তিনি কিছু বলবেন না।
‘মা আমি একজনকে ভালোবাসি। তার সাথে আমার পরিচয় অনেকগুলো দিন থেকে। একদিন হুট করেই আমাদের দেখা হয়। আমরা একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। সে আমার জুনিয়র। আর সব থেকেও বড় কথা হলো আমি শুভ্রকে অসম্ভব ভালোবাসি। কাল রাতে তারই এক্সিডেন্টে আমি হসপিটালে আসি।’ সংক্ষেপে নিজের মাকে এইটুকু বললো। মেঘের মা গম্ভীর মুখে বলে,,
‘আমাকে এইসব আগে বলো নি কেনো?’
‘ভেবেছিলাম আরও কিছুদিন গেলে আমি জব পেলে দু পরিবারকে জানিয়ে বিয়ে করবো!’
মেঘের সোজা সাপ্টা উত্তরে মেঘের মা চোখ ছোটছোট করে তাকালো। তার ছেলে এতো চালাক হলো কি করে? প্রেম করে আবার বিয়ে করার প্ল্যানও করছে? বাচ্চার প্ল্যান করেছে কিনা কে জানে!
‘আমি মেয়টাকে দেখতে চাই।’ মায়ের রাশভারী কন্ঠে মেঘ মায়ের দিকে তাকালো। তারপর মাথা নুইয়ে বলে,,
‘ওর এখনও ঘুম ভাঙ্গে নি। ভাঙ্গলে কথা বলতে পারবে। এখন তোমরা বিয়ে বাড়িতে চলে যাও। আমি তোমাদের ডাকবো।’ মেঘের কথার পিঠে মা আর কিছু বললেন না। মেঘলাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেঘ সেদিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেললো। মা এবার কি করবে কে জানে? তারপর শুভ্রতার কেবিনের দিকে অগ্রসর হন!
#চলবে?
(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)