#হঠাৎ _বৃষ্টি
পর্বঃ৯
জান্নাতুল নাঈমা
কষ্টের সময়টা যেনো খুব দীর্ঘ ঠেকে মানুষের কাছে। তেমনি শুভ্রতার কাছেও ঠেকছে। এতো অপেক্ষার পরেও মেঘ আসলো নাহ! তবে কি ভাইয়ের বিয়ের কাছে শুভ্র নামক অনুভূতি খুব ফিকে হয়ে গেছে! একটি বার ফোন চেক করতে পারলো নাহ? শুভ্র নামক মানবীর কথা মনে পড়লো নাহ! নিজের মনে হাজারো জল্পনা কল্পনা করছে শুভ্রতা। একটু আগেই তার মস্তিষ্ক আবার সচল হয়েছে। তবে সে এটা বুঝতে পেরেছে যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরেছে সেটা আসিফ বুঝবে ততোক্ষণ সে কিছুই করবে না। তাই তো শুভ্রতা অচেতনের মতো পড়ে আছে। মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। তিনি যেনো এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করে।
‘ভাই মেয়েটার জ্ঞান তো এখন আসলো না। এভাবে কতোক্ষণ ফেলে রাখবো?’
‘আর থাক পড়ে। একটু একটু করে তিলে তিলে ওরে মারবো। আমাকে করা অপমানের প্রতিটা হিসাব সুদে আসলে নিবো।’ সিগারেট মুখে দিতে দিতে বলে আসিফ। সিগারেটের গন্ধ শুভ্রতা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। খুক খুক করে কেশে উঠে! তার কেশে উঠা শুনে সবার চোখ শুভ্রতার দিকে যায়। শুভ্রতা ভয় পেয়ে যায়। ফিটফিট করে তাদের দিকে তাকায়।
‘ভাই! এই মেয়ে তো বহুত সেয়ানা। এতোক্ষণ নাটক করে শুয়ে ছিলো!’
পাশের ছেলেটির কথা শুনে আসিফ রাগান্বিত দৃষ্টিতে শুভ্রতার দিকে তাকায়। তারপর একপা একপা করে শুভ্রতার দিকে এগোতে থাকে। শুভ্রতা শরীর নাড়ানোর মতো শক্তি পাচ্ছে না। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তবে কি তার সমাপ্তি এখানেই ছিলো!
______________
হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসছে মেঘের। কিন্ত তাও নড়ছে না। হাসপাতালের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অটির দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে থাকা হলদে রং য়ের পাঞ্জাবী এখন রক্তে মাখা লাল হয়ে উঠেছে। ভয়ে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। কলিজাটা যেনো কেউ খুবলে খাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ডুকরে উঠে মেঘ। হাত পা ভেঙ্গে অবশ হয়ে আসছে তার। চোখের সামনে শুভ্রতার রক্তাক্ত শরীরটা বারবার বেশে উঠছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে! পাশে বসে থাকা মৃদুল মেঘের বন্ধু কাঁধে হাত দিয়ে ভরসা যোগাচ্ছে। কিন্ত মেঘ কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। বারবার একটু আগের ঘটনা মনে পড়ছে।
কিছুটা কাজ এগিয়ে মেঘ ফোনটা হাতে নিলো। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো তার বৃষ্টিকণ্যার সাথে কথা হয়। বৃষ্টিকণ্যার গলা শুনার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে মন। তাই ঝটপট বাগানে চলে এলো। শান্তিতে কথা বলবে বলে! কিন্ত ফোন হাতে নিয়ে দেখে দুইশত চব্বিশটা মিসডকল সাথে একটা মেসেজ! মেঘের চক্ষু চড়কগাছ। আজ তার বৃষ্টিকণ্যা কথা বলার জন্য এতো আগ্রহী? অন্যদিন তো কলই দেয় নাহ। কিন্ত পরক্ষণে মনের মধ্যে অশুভ চিন্তা হানা দিচ্ছে। ঠিক আছে তো মেয়েটা। মেঘ প্রথমে মেসেজ অপশনে গেলো। ক্লিক করতেই মেসেজ ভেসে উঠলো।
‘মেঘ আমাকে বাঁচান। আমি খুব বিপদে পড়েছি। ওই আসিফ আমার পেছন ধাওয়া করছে। প্লিজ মেঘ হেল্প মি!’ শুভ্রতার মেসেজটা মেঘের মাথা ঘুরিয়ে দিলো। নিজেকে নিজে দোষারোপ করতে লাগলো। বিয়েতে এতো মজে গিয়েছিলো! এখন কি করবে? বিপদের সময় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় যেনো। মেঘ নিজেকে শান্ত করে শুভ্রতার ফোনে কল দিলো। কিন্ত ফোন অফ! মেঘ দেরী না করে রাস্তার দিকে ছুটা আরম্ভ করলো। ফোনে মৃদুলকে কল করে সব জানালো। মৃদুল একজন পুলিশ অফিসার। তাকে সব জানানোর পর নাম্বার ট্র্যাক করে একটা ভাঙ্গা পরিত্যাক্ত জায়গায় এলো। তারপর সাবধানে সবাই এগিয়ে যায়। পুলিশ আসিফ ও তার সাথের লোকজনদের কাবু করে। কিন্ত তার আগেই আসিফ শুভ্রতার হাতে পায়ে চুরি দিয়ে আঘাত করে দেয়। মেঘ ‘শুভ্র’ বলে এগিয়ে যায়। শুভ্রতার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে অজস্র আদরে ভরিয়ে দেয়। শুভ্রতা ফিটফিট চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। তারপর চোখে আঁধার নেমে আসে। মেঘ তা দেখে পাগল প্রায়। হাত,পা,কপাল ছুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। মেঘের অবস্থা দেখে মৃদুল এ্যাম্বুলেন্স এ কল করে হাসপালে শিফট করে।
‘মেঘ শান্ত হ। শুভ্রতার কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ আল্লাহ কর ভাই!’ মৃদুলের কথায় মেঘ মৃদুলের হাত ধরে বলে,,
‘কি করে শান্ত হই বল। আমি বড্ড ভালোবাসি ওকে। ওর কিছু হলে আমি মেনে নিতে পারবো না রে। আমি পারবো না ওকে ছাড়া থাকতে। মরে যাবো।’ কান্নার কারণে মেঘ কিছু বলতে পারছে না। কে বলেছে ছেলেরা কাঁদতে জানে না। নিজের প্রিয় মানুষের কষ্টে ছেলেদের মনও পুড়ে। তারাও কাঁদতে জানে! মৃদুল মেঘের পিঠে হাত রেখে শান্তনা দেয়।
ওটি থেকে একজন নার্সকে বেরিয়ে আসতে দেখে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় মেঘ। এগিয়ে গিয়ে বলে,,’শুশুভ্র না শুভ্রতা কেমন আসে সিস্টার? ভালো হয়ে যাবে তো?’
‘পেশেন্টের অনেক ব্লাড লস হয়েছে। O+ রক্ত প্রয়োজন। এখন এই মাঝরাতে আমাদের ব্লাডব্যাংকেও নেই এরেঞ্জ করুন দ্রুত। রোগীর শরীরে কোনো জায়গা কাটা গেলে সহজে রক্তপাত বন্ধ হয় না। রক্ত না দিতে পারলে অবস্থা খারাপের দিকে যাবে।’
সিস্টারের কথায় পাশ থেকে মৃদুল বলে,,’আমি দেবো। আমারও সেম ব্লাডগ্রুপ।’ মেঘ মৃদুলের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর চলে যায়। মেঘ আবারও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে।
পকেটে থাকা শুভ্রতার ফোনটা ভাইব্রেশন করে উঠে। ফোনটা মৃদুল ওই জায়গা থেকে পেয়েছিলো। হাত থেকে পড়ে লক হয়ে যায় যার কারণে মেঘ কল দিলে সুইচডফ জানিয়েছিলো। মৃদুল শুভ্রতার ফ্যামিলিকে জানাতে চাইলে মেঘ আপাদত বারণ করে। ফোন অন করে পকেটে রেখে দেয়। মেঘের ভাবনার মাঝে আবারও ফোন ভাইব্রেট হলে মেঘ স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে,,’আম্মু!’ লেখাটা ভাসছে। মেঘ ফোনটা ধরে কাণে নিলো।
‘শুভ্রা! তুই ঠিক আছিস? আমি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখলাম রে মা। ঠিক আছিস তুই?’
সন্তানের কোনো বিপদে মা সবার আগে বুঝতে পারে। শুভ্রতার মায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সন্তান এখানে ভালো নেই মা ওখান থেকেই খবর পেয়ে গেলো। মাত্ৃত্তের টান!
‘কিরে মা কথা বলছিস না যে?” মেঘ এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না। ভাঙ্গা গলায় বলে,,’হ্যালো আন্টি!’
মেয়ের ফোনে কোনো ছেলের গলা পেয়ে মায়ের বুক কেপে উঠলো। তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করলো,,’কে আপনি? আমার মেয়ের মোবাইল আপনার কাছে কেন? আমার মেয়ে কই?’
‘আন্টি আমি মেঘ!’
‘তুমি মেঘ? শুভ্রা কই? এতোরাতে তোমরা একসাথে কি করো?’ শুভ্রতার মা এমন ভাবে কথাটা বললো যেনো উনি মেঘকে চিনেন। শুভ্রকি তবে ওর মাকে আমার ব্যাপারে বলেছে? মনের কথা মনে রেখেই মেঘ প্রথম থেকে সবটা বললো। সবশুনে শুভ্রতার মা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেঘ ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত হতে বলছে কিন্ত উনি থামছেন না। যেখানে ও নিজেই পারছে না সেখানে মা কিভাবে পারবে। মেঘ শুভ্রতার বাবার সাথে কথা বললো। উনারা রওনা দিবেন! মেঘ আর ভাবতে পারছে না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ি থেকে অনেকবার কল দিয়েছে। কিন্ত ধরতে ইচ্ছে করছে না। মাথায় শুধু শুভ্রতার চিন্তা ঘুরছে।
‘একবার ঠিক হয়ে যাও শুভ্র। আর তোমায় দূরে যেতে দিবো না। নিজের কাছে রেখে দেবো। শুধু একবার সুস্থ হয়ে যাও শুভ্র! অনেক কথা বলা বাকি তোমায়! অনেকটা পথ একসাথে পাড়ি দেওয়া বাকি শুভ্র! প্লিজ শুভ্র ভালো হয়ে যাও!’
#চলবে?
(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন,ধন্যবাদ।)