#হঠাৎ_বৃষ্টি
জান্নাতুল নাঈমা
পর্বঃ৭
মানুষ প্রেমে পড়লে কতো কিছুই না করে। নিজের সবচেয়ে অপছন্দের জিনিসটাও পছন্দের খাতায় নাম নেয়। যেমনটা মেঘের ক্ষেত্রে। সে বৃষ্টি পছন্দ না করলেও তার বৃষ্টিকণ্যার আবদারে সে বৃষ্টিতে ভিজেছে।
‘উফফ মানুষ বলে বাঁচলে একসাথে বাঁচব,মরলে একসাথে মরব! হাউ ইজ দিস পসিবল! আমারটা দেখো! ভিজলাম দুজনে আর ঠান্ডা লাগলো আমার! হাচ্চুউউউ..’ মেঘ হাঁচি দিতে দিতে বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলছে আর নাক মুখছে। তখন প্রেমের ঠেলায় বৃষ্টিতে ভিজলেও এখন হাতেনাতে ফল পাচ্ছে। কোনোমতে শুভ্রতাকে বাসায় দিয়েই চেঞ্জ করে কম্বলের নিচে ডুকেছে। এখনও বের হওয়ার নামও নিচ্ছে না। একটু পরে হাঁচি দিচ্ছে আর বিড়বিড় করছে। এতে বেজায় বিরক্ত মেঘের মা!
‘এই ছেলে নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে! তখন ধুম করে সুমাইয়াদের বাসা থেকে চলে এসেছে। মেয়েটি কি ভাবলো কে জানে? কোনো আক্কেল নেই ছেলেটার। এলো তো এলো বৃষ্টিতে ভিজে এলো। এখন ঠেলা সামলাও। আমি একদম ধরব না আজ। যা পারুক করুক!’ চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে নিজে নিজে বলছে মেঘের মা। উনার সুমাইয়াকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে খুব পছন্দ হয়েছে। একরকম হিনটসও ওদের পরিবারকে দিয়ে এসেছে। এখন আহনাফের বিয়ের পর মেঘের বিয়ে সারারও পরিকল্পনা আছে। মেঘ ব্রাইট স্টুডেন্ট। চাকরি পেয়ে যাবে। টুকটাক টাকা রোজগার করে। নিজের খরচ সে নিজেই চালায়। চট্রগ্রামে তাদের নিজস্ব তিনটে দোকান আছে। অবস্থা তাদের বেশ ভালো। নিজে নিজে ভাবছে আর চা বানাচ্ছেন মেঘের মা। কিন্ত এইসবের কিছুই মেঘ ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি এখনও।
মাত্র ফ্রেশ হয়ে চুল মুছতে মুছতে খাটে বসলো শুভ্রতা। আজকের বিকেলটা তার স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মেঘের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাসছে শুভ্রতা। পরক্ষণে নিজের জবের ব্যাপারটা মাথায় আসতেই জিহ্বে কামড় দিলো। নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,’ইসস রে! উনাকে তো জানানোই হয় নি। কালই তো এক তারিখ আমার জয়েনিং!’
শুভ্রতা তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিলো। কয়েকবার চেক করলো নাহ মেঘের কোনো কল বা মেসেজ নেই। লোকটা যাওয়ার সময় নাম্বার নিয়ে গেলো। অথচ একটাবার ফোন করলো নাহ! শুভ্রতার মনে মনে ভীষণ অভিমান জমে গেলো। ফোনটা রেখে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ দুটো সিক্ত হয়ে উঠলো। তবে কি সে মেঘের চোখের ভাষা ভুল পড়লো? এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ শুভ্রতার অভিমানের পাল্লা বয়ে গেলো। কিন্ত আবার মাথায় একরাশ দুঃশ্চিন্তা দেখা গেলো। লোকটা ঠিক আছে তো! শুভ্রতা ছটফট উঠে বসলো। চোখগুলো ভালোভাবে মুছে ফোনটা হাতে নিলো। ডায়েল করলো মেঘের নাম্বারে। একবার,দুবার রিং হয়ে গেলো ধরলো না। শুভ্রতা জানে দুবারের বেশি রিং হওয়ার পর কেউ কল না ধরলে দিতে নেই। কিন্ত তাও তার টেনশন হচ্ছে বলে আবার দিলো।
কম্বল মোড় দিয়ে খাটে শুয়ে আছে মেঘ। একটু আগে মা আদা দিয়ে চা, মেডিসিন সব দিয়ে গেছে। এখন মোটামুটি ভালো লাগছে। হঠ্যাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে হাত বাড়িয়ে ফোন নিলো। এর আগেও দুবার এসেছিলো ইচ্ছে করে নি ধরতে। কারণ তার চোখে ঘুমের রেশ। স্ক্রিনে না তাকিয়ে কল পিক করে কানে ধরে বলে,,’হ্যালো। আসসালামুয়ালাইকুম!’
মেঘের কন্ঠ শুনে শুভ্রতার সারা শরীররে শিহরণ বয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা কেমন ঢিপঢিপ করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এখন পানি প্রয়োজন। কিন্ত হাতের কাছে পানি নেই! শুভ্রতা কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো। তাও সালামের উত্তর নিলো।
‘কে বলুন তো?’ মেঘের প্রশ্নে শুভ্রতা মিনমিন স্বরে বলে,
‘আমি!’
মেঘ শুভ্রতার গলা চিনে বলে,,’ও শুভ্র! তুমি আবার স্বপ্নে আমাকে ফোনও করো? হায়রে স্বপ্ন! শুধু বাস্তবেই কিছু সম্ভব হইলো না। জানো শুভ্র! তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি। ওই প্রথম দিনে তোমরা টকটকে লাল দুটো চোখেই আমি আটকে গেছি। সেখানেই আমার সর্বনাশ লেখা ছিলো জানলে আরো আগেই তোমাকে খুঁজে বের করতাম। তোমার প্রথমবারের ছোঁয়া আজও আমার শরীরে লেগে আছে। তোমাকে দেখলে আমার আজও প্রথমদিনের মতো অনুভব হয়। শরীরে কম্পণ সৃষ্টি হয়! কেনো বলতে পারো? জানো তুমি? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি শুভ্র।’ মেঘ ঘুমের ঘোরের স্বপ্ন ভেবে নিজের মনে জমে থাকা সবকথা বলে দিচ্ছে। কিন্ত শুভ্রতা! সে কি শুনতে পাচ্ছে? নাহ সে কিছুই শুনছে নাহ কারণ মেঘের প্রথম কথা ‘ওহ শুভ্র!’ ওই সময়ই লাইন কেটে গেছে। ফোনের ব্যালেন্স চেক করা ছাড়াই মেঘকে কল দিয়েছিলো। শুভ্রতা এখন হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই সময় বাইরে যাওয়াও ঠিক হবে না। একে তো বৃষ্টি তারপর আবার ১১:০০ টার বেশি বেজে গেছে। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে শুভ্রতা। হালকা শীত করছে দেখে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। মেঘ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিড়বিড় করে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করছে!
________________
‘হ্যালো লিসেনারস! কেমন আছেন সবাই? আমি আপনাদের নিউ জকি আরজে শুভ্রতা! চলে এসেছি একটা নতুন শো নিয়ে ‘ভালোবাসার গল্পকথা।’ আপনারা এখানে কল করতে পারেন,মেসেজ করতে পারেন। বলতে পারেন আপনাদের মনে জমে থাকা ভালোবাসার মানুষের প্রতি জমে থাকা অব্যক্ত কথাগুলো। অথবা নিজের ভালোবাসার গল্প। তাই দেরি না করে ছটফট কল দিয়ে ফেলুন। ততক্ষণে এনজয় দা মিউজিক।’ কথাগুলো বলে একটা গান চালিয়ে দিলো শুভ্রতা।
তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। ভয়ে এখনও হাত পা কাঁপছে। এইভাবে কথা বলা যায় নাকি। যদি কোনো ভুল হয়ে যেতো? কাঁচের গ্লাসের ওপাশে তাকালো। অফিসের সবাই দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে ইশারায়। শুভ্রতা মুচকি হাসলো। তারপর আবার শুরু করলো শো। শোটা সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা অবধি। শুভ্রতা শো শেষ করে বাইরে আসতে অনেকে কনগ্রাচুলেশন জানালো। শুভ্রতা থ্যাংকস জানিয়ে বসের কেবিনে গেলো।
‘কনগ্রাচুলেশন শুভ্রতা! প্রথম দিনেই অনেক সাড়া পাওয়া গেছে। যদি শোটা ভালো রেসপন্স করে তবে তোমার স্যালারীও বাড়ানো হবে। ভালোভাবে মন দিয়ে করো। বেস্ট অফ লাক।’ বসের কথায় শুভ্রতা মুচকি হেসে ‘থ্যাংকস।’ বলে বাইরে চলে আসে।
রাস্তার পাশে বাইকে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছে মেঘ। শুভ্রতা বের হওয়ার আগেই মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সব। কিন্ত সে আসতে পারে নি। এতে শুভ্রতার মন খারাপ না হলেও মেঘের বেশ খারাপ লাগছে। শুভ্রতা মেঘকে দেখে এগিয়ে যায়। মেঘ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফোন পকেটে পুড়ে নেয়। আজ দুজনেই সাদা পড়েছে। শুভ্রতা সাদা আর গোলাপি কম্বিনেশনের জামা সাথে হিজাব। আর মেঘ সাদা টি-শার্টের উপর আকাশি কালারের শার্ট কালো প্যান্ট। শুভ্রতা এগিয়ে গিয়ে একগাল হেসে বলে,,’মেঘ! মেঘ! আমি পেরেছি। আমার শোটা বেশ ভালো হয়েছে।’ শুভ্রতা হাসলে চোখ দুটোও হেসে উঠে। মেঘ সেদিকে তাকিয়ে বলে,,’কনগ্রাচুলেশন শুভ্র! দেখবে আরো ভালো হবে। এখন চলো একটা সারপ্রাইজ আছে।’
‘কি সারপ্রাইজ?’
‘গেলেই দেখতে পাবে। উঠো।’ তারপর দুজন মিলে রওনা দিলো।
_____________________
‘মেঘ আপনি আমায় হঠ্যাৎ এই নিরিবিলি রাস্তায় আনলেন যে?’ বাইক থামিয়ে দুজনে রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে শুভ্রতা বলে। মেঘ পকেটে দুহাত ডুকিয়ে বলে,,
‘তোমাকে বেঁধে পাচার করে দেবো!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা হেসে বলে,,’আচ্ছা দিয়েন। যা পাবেন তার হাফ আমার!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ হেসে মাথা দুলিয়ে বলে,,’আচ্ছা!’
কিছুদূর যেতেই শুভ্রতা দেখে খালি একটা জায়গা। কিন্ত সেখানে অনেকগুলো ফুলের চারা। শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকালে মেঘ বলে,,’এখানে মোট ত্রিশটা গাছের চারা আছে! সবগুলো তোমার। আর এখন তুমি আর আমি মিলে ওই যে খালি জায়গাটা দেখছো (হাত দিয়ে ইশারা করে) ওখানে লাগাবো। এটাই তোমার এছাইভমেন্টের সেলিব্রেশন!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা লাফিয়ে উঠলো। উচ্ছাসিত হয়ে মেঘের বাহু ধরে বলে,,’সত্যি মেঘ? এইসবগুলো চারা আমরা লাগাবো?’ শুভ্রতার খুশিতে মেঘ নিজেও খুশি হয়। মাথা দুলিয়ে শুভ্রতার হাত ধরে বলে,,’সত্যি শুভ্র! তোমার খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। চলো যাও যাক।’
শুভ্রতা আগে আগে গেলো। মেঘ মুচকি হেসে পিছুপিছু গেলো। তারপর দুজন মিলে সম্পূর্ণ জায়গাটায় ফুলের গাছ লাগালো। মাঝে হাটার জন্য ছোট্ট রাস্তা। শুভ্রতার উচ্ছাসিত মুখ আর মেঘের তৃপ্তিকর মুখচ্ছবি!
#চলবে?
(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)